লাকি – মহাশ্বেতা দেবী

লাকি – মহাশ্বেতা দেবী

পরীক্ষা শেষ। এক সপ্তাহ ছুটির পর আজই স্কুল খুলেছে। দিদিমনির হাতে এক বান্ডিল রুলটানা কাগজ দেখলেই বুক ধড়ফড় করে ওঠে। তারপর যদি দিদিমনি বলে ওগুলো অন্য ক্লাসের পেপার তাহলে হতাশ লাগে। সেকেন্ড পিরিয়ডে বিজ্ঞানের পেপার বেরোনর পর ক্লাসে প্রায় চোখের জলের বন্যা বয়ে গেল। নিষ্ঠুর দিদিমনি। কত মেয়ের চোখের জল বইয়ে গটগট করে বেরিয়ে গেল ক্লাস থেকে। আমি সকালবেলা যতটুকু সাহস সঞ্চয় করে স্কুলে এসেছিলাম সবই চলে গেল। ফোর্থ পিরিয়ডে এলেন বাংলা দিদিমনি। হাতে পেপারের বান্ডিল দেখেই ইষ্টনাম জপ শুরু হয়ে গেল। সকালবেলাতেই কেউ একজন গুজব ছড়িয়েছিল যে বাংলায় আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে বেশি নম্বর উঠেছে ৮১।

পেপার দেওয়া শুরু হল দরজার কাছে ফার্স্ট বেঞ্চ থেকে। কাগজের ওপর লাল কালি দিয়ে লেখা একটা নম্বর যেন জাদু জানে। মুহূর্তে কাঁদিয়ে দিতে পারে।

পেপার হাতে পেয়ে দুরু দুরু বক্ষে নম্বরের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলাম। না ফেল করিনি। তবে খুব একটা খুশিও হলাম না। পেপার হাতে পাওয়ার পর মনে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাওয়ার একটা খুব ক্ষীণ আশা জেগেছিল। পেলে কি ভালই না হত। প্রথমত ক্লাসের তরফ থেকে হাততালি তারপর বাড়ি গিয়ে ঠাম্মার কাছ থেকে কিছু পয়সা হাতানো যেত। বাবা মার স্পেশাল খাতিরের কথা আর না-ই বললাম। তবে নাহ্‌, সেসব আর এ যাত্রা হল না।

ক্লাসে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চোখ পড়ল ফার্স্ট বেঞ্চে । ওখানে বসে অনিন্দিতা সেনগুপ্ত। ক্লাসের সবচেয়ে ভালো মেয়ে। ক্লাস ওয়ান থেকে নাকি ফার্স্ট হয়ে আসছে। একেই বলে ভাগ্য। ওকে পেপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয় না। ঠাকুরঘরে টানা এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে প্রার্থনা করতে হয় না। রেজাল্টের আগের দিন ঘুম নিয়ে ভাবতে হয় না। পরীক্ষার ঠিক কয়েক মূহূর্ত আগে ওর পেট গোলায় না। উফ কি মজা ওর।

ক্লাসে দিদিমনির টেবিলের সামনে ইতিমধ্যে একটা লম্বা লাইন তৈরি হয়ে গেছিল। এক-আধ নম্বর বাড়ানোর জন্য পাঁচ মাইল লম্বা লাইনে দাঁড়ানো এদের কাছে ছেলেখেলা। আরও কত কি শোনা যায়! একবার নাকি বি সেকশনের নীপা কেঁদে কেঁদে অজ্ঞান হয়ে গেছিল অংক পরীক্ষায় এক নম্বর বাড়ানোর জন্য।

দুয়েকজনের পেপার দেখার পর দিদিমনি বিরক্ত হয়ে সবাইকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিলেন। এরপর যে বক্তৃতা শুরু হবে তা জানত সবাই। এবারও তার ব্যাতিক্রম হল না। দিদিমনি বলা শুরু করলেন – ‘এবারের খাতা দেখে আমার তিন রাত ঘুম হয়নি। কি জঘন্য সব উত্তর লিখেছ তোমরা। আর হাতের লেখা কত বাজে হতে পারে তা তোমাদের খাতা দেখলে বোঝা যায়। তোমাদের সবচেয়ে বেশি নম্বর কমেছে রচনাতে। একটি ভ্রমণের বিবরণী- এমন একটা সোজা বিষয় পেয়েও তোমরা কি করে এত বাজে পেতে পারো ? এই ক্লাসে কি কেউ রচনাতে পুরো নম্বর পেয়েছে?’

প্রশ্ন করার পর গোটা ক্লাসের মধ্যে একটাই হাত উঠল। যথারীতি এবারেও সেই অনিন্দিতা।

.

ক্লাসের সত্তর জোড়া চোখ একযোগে অনিন্দিতার দিকে তাকাল। ওকে দেখে দিদিমনিও নরম হলেন। মুহূর্তে গলার স্বর পাল্টে ফেলে বললেন – “আহ ! অনিন্দিতা। আমি জানতাম। তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী ছাড়া আর কে এত সুন্দর রচনা লিখবে।এই বলে আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের সবার ওকে দেখে শেখা উচিৎ।” তারপর অনিন্দিতাকে ডেকে বললেন, “এসো অনিন্দিতা, পড়ে শোনাও তোমার রচনাটা এদের।” চোখে ভারি চশমা পড়া ছোট-খাট মেয়েটি হাতে পরীক্ষার খাতা নিয়ে রচনা পড়তে লাগল। বেনারস বেড়াবার গল্প। সত্যিই কি সুন্দর। যেন বেনারস শহরটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে আমার দু চোখের সামনে।

লেখার উপসংহারটা ছিল এই রকম– ‘ফিরে আসার আগের দিন আর কোথাও যাওয়া হল না। হোটেলের বারান্দা থেকে বেনারসের সরু গলিতে লোক-জনের যাতায়াত দেখছিলাম। ভারত যেন এখানে আর বদলায়নি। সেই পুরোনটিই থেকে গেছে। হিন্দু ধর্ম যেন এখানকার প্রত্যেক ধূলি-কণা থেকে প্রকাশ পাচ্ছে। সন্ধে বেলা গঙ্গার ঘাটে ঘাটে ঘুরলে মনে একটা অদ্ভুত ভাব আসে যা অন্য কোথাও গিয়ে পাওয়া সম্ভব নয়।’

অনিন্দিতার রচনা যে কখন শেষ হল বুঝতে পারলাম না। লেখার ঘোর কাটার পর গোটা ক্লাস হাততালিতে ফেটে পড়ল। এমনকি গোমড়ামুখো দিদিমনিও হাততালি দিলেন। হল্লা কমার পর দিদিমনি অনিন্দিতার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন- ‘বেনারসে কি পুজোর সময়ে গেছিলে? নিশ্চয় খুব মজা করেছ?”

এই প্রশ্নে যে অনিন্দিতার কী যে হল বোঝা গেল না। দেখতে পেলাম অনিন্দিতা চশমা খুলে চোখ মুছল। গোটা ক্লাস অবাক। দিদিমনিও অবাক। একটু পরে ধরা গলায় অনিন্দিতা বলে উঠল-“ আমাকে বাবা মা কোথাও নিয়ে যায়নি। আমি আজ পর্যন্ত কোথাও বেড়াতে যাইনি। এই বলে অনিন্দিতা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমরা স্তব্ধ। আমাদের সামনে কেঁদে যাচ্ছে আমাদের মতে ক্লাসের সবচেয়ে লাকি মেয়ে- অনিন্দিতা সেনগুপ্ত।

.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *