লাইফার – মহাশ্বেতা দেবী

লাইফার

মাগন সাঁওতাল লোকটা লাইফার ছিল। বড়শুলি মৌজায় ওর বাড়ি যেখানে, সেখানে কোনো থানা ছিল না। নিকটতম থানা চামারিতে। সে সময়ে চামারি থানার ঘরটা ছিল পাকা, তাতে খড়ের চাল। কালীপুজোর আগে থেকে বৃষ্টি চলছিল, বাঁধনা পরবের আনন্দ মাটি। খুব বর্ষণ! কলকল জল ছুটে পুকুর ডোবা ভাসায়। এমন বৃষ্টি অনেকদিন দেখা যায়নি। সেই তো দিলি জল, তবে সময়ে দিলি না কেন? থানাবাবু বলছিল। দেশে তার চাষবাস আছে। বৃষ্টি দেখেই তার মনে হচ্ছিল, গরিব এলাকায় থাকলে দুশো হেপাঝেপা। সময়ে গোয়ালটা ছেয়ে নেওয়া হয়নি। কাড়াগুলো জলে ভিজবে সারাদিনরাত।

সকালে যখন জল কমল, তখনো আকাশ ঘোলাটে। থানার পিছনেই তার থাকার ঘর। তা দোর খুলে বেরিয়ে এসে বাবু দেখেছিল ঘরের ছামুতে অনেক সাঁওতাল। সকলেই মুখ চেনা। বাঁধনার কারণে বাঁকে বহে কিছু এনেছে কিনা, বাবু ভাবছিল।

তখন এ—ওকে ঠেলে, ও—তাকে ঠেলে। কী—বা যেন ব্যাপার আছে বাপ!—কী রে জগনু?

মাগন সাঁওতাল এগিয়ে এসেছিল। বাপ রে রক্তবর্ণ চক্ষু, আর মুখচোখ যেন কেমন।

—বউটাকে কেটে দিলাম বাবু! নিয়ে এসেছি। এখন কী করবি তা কর। হাঁ বাবু, বাঁকে চাপিয়ে আমিই বহে আনলাম। বউ তো আমারই।

—কেন, কেন কাটলি?

—রাগ উঠে গেল বাবু। ঝগড়া করছিলাম দুজনে, তা রাগ উঠে গেল খুব। যত বলি, হাতে টাঙি, আমাকে চটাস না, টাঙি শান দিয়ে এনেছি, তত চেঁচায়, কী করবি, কাটবি? তাতে বাবু!

—দিলি কেটে?

—দিলাম।

যেন মাগনের স্বীকারোক্তি এবং জমায়েত সাঁওতালদের মৌন মুখ যথেষ্ট নয়। তাই মাগন বাঁকের ঝুড়ি দুটির ওপর থেকে কাপড়—গামছার আচ্ছাদন সরাতে গিয়েছিল। বাবু আতঙ্কে বলেছিল, না না, থাক।

বড় ব্যথা পেয়েছিল বাবু। বৃষ্টিধারায় চারদিক শান্ত ও সিক্ত। নয়ানজুলি থেকে এতগুলো চ্যাং মাছ ধরা গেছে, সেগুলো ঝাল ঝাল রান্না হবে। কালীপুজোও পুজো একটা, বাঁধনাও পরব। গোহাল মার্জনা, গোরুমোষ মার্জনা—সার্জনা। মনটা বেশ ভরাভর্তি টইটম্বুর ছিল। এমন পবিত্র সকালে বাবু পরবে ছাগল কেটে ভক্ষণ, বা সাইকেল চুরিও আশা করেনি। আর দেখো! মাগনের যুবতী ও বন্ধ্যা বউ দু—ঝুড়ি বোঝাই হয়ে থানায় হাজির।

বাবু মুষড়ে পড়েছিল। থানা যদি কাছে না থাকত, তবে কী এমন হেপাঝেপা হত?

—ভিতরে আয়!

বাবু এরপর যা যা করার সবই করেছিল। মাগন কেন, বড়শুলি মৌজায় সব সাঁওতালদের বাবু চেনে। কোনো ঝামেলায় থাকে না। তারাও কারুকে ঘাঁটায় না, তাদেরকেও কেউ ঘাঁটায় না। কার টুকচে জমি, কার নাই। তা গতরে খাটবে, সদানন্দ জাত। মাগন তো অত্যন্ত শান্ত। কখনো কোনো…

বাবুকে মাগনের কাকা জগনু কিছু টাকা, মুরগি এনে দিয়েছিল। যা হয় কর বাবু। বাপ—মা নেই ওর। কোনোদিন রাগ—ঝাল স্বভাবে নেই। ফাঁস দিবে কি—বা তাই ভেবে আমার বউ খুব কাঁদছে।

ফাঁসি ওর হতই। অন্তত মাগন খুব চেষ্টা করেছিল। সরকারি উকিল যত বোঝায়, অমন বলবি, অমন বলবি, তাতে বেঁচে যাবি। ও তত বলে, তা কেন বলব? আমার বউ নষ্ট মেয়ে নয়, কোনোদিন সংসারে অবহেলা দেখায়নি।

শেষে কোনো মতে ফাঁসি হতে বেঁচে ওর যাবজ্জীবন হল। একটা কথা থানাবাবুও লিখেছিল যে, মাগন চিরকাল শান্ত, কোনোদিন কোনো মারদাঙ্গায় থাকেনি, ঝগড়াবিবাদ তো কখনো করেনি। তার মতো লোক প্রচণ্ডভাবে প্ররোচিত হয়ে এ কাজ মুহূর্তের ক্রোধে করেছে। মাগনের মৃতা স্ত্রী দনি ছিল খুবই কল্লা মেয়েছেলে এবং মাগনকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করত।

যথেষ্ট লিখেছিল। সাতাশ টাকা ও জোড়া মুরগিতে এর চেয়ে বেশি লেখা যায় না।

থানাবাবু হাত উলটে সেপাইকে বলেছিল, খুন করবে তো যেচে ধরা দিবে, পালাবে না। এ এক অদ্ভুত জাত! এদের বিচারবুদ্ধি আলাদা।

মাগন জেলে যায়। জেলে জেলে ঘোরে। জেলেও তার রেকর্ড খুব ভালো থাকে। লাইফার সে। পায়ে বেড়ি নিয়ে বাগান করে, জেলারবাবুর বাড়িতে ডিউটি দেয়। চোদ্দো বছর ধরে পা মেপে মেপে ফেলতে ফেলতে মাগন জেনে গেল, তার পা ফেলার মাপ অতটুকুই। বেড়ির বাঁধনে যতটুকু ফেলা যায়।

মাগন যখন ছাড়া পেল, প্রথমে সে বড়শুলি যাবে বলে রওনা হয়েছিল। এখন পানাট থেকে চামারি বাস চলে, আর খাসপথের দুধারে ঘর কত, সব অন্যরকম, চামারিতে নেমে সে কোথা যাবে, এ চামারিও তার অজানা।

—ভাই, থানা কোথা বলতে পার?

—থানার সামনে দাঁড়িয়ে আছ।

—বাপ রে। এত বড় থানা!

—চামারি এখন সার্কেলের বড় থানা। থানার মস্ত এলাকা পাঁচিলেঘেরা, বাড়ি দোতলা, উপরে সার্কেল ইনস্পেক্টরের থাকার ব্যবস্থা। থানা মানে সেপাই দারোগা, খাকি জামা—প্যান্ট।

নিজের অজানতে মাগন পা ঘষে ঘষে সেখানে ঢুকেছিল। তারপর বয়সবাড়া চেহারায় সেই থানাবাবুই তাকে দেখেছিলেন। পৃথিবী বড় গোল হয়। সেদিনের ছোটো চামারির বাবু বহু থানা ঘুরে কাজ দেখিয়ে সার্কেল ইনসপেক্টার হয়ে বড় থানা চামারিতে এসেছেন। মাগনকে তিনি চিনে ফেলেন। মাগন তাঁর লক্ষ্মী বললেও হয়। কেননা সে চালান যাবার পরেই পোস্টাপিসে ডাকাতি এবং পুকুর থেকে সেচজল নেওয়া নিয়ে দাঙ্গা, দুটি ব্যাপারে কৃতিত্ব দেখিয়ে তাঁর সুনাম হয়েছিল।

—মাগন?

—বাবু!

মাগনের কাছে সেই থানাবাবুর আজও বসে থাকার ব্যাপারটি খুব স্বাভাবিক মনে হয়। বড় গোল হয় পৃথিবী।

—ঘরে যাচ্ছি বাবু।

—ঘর…ঘর যেন কোথা?

বড়শুলি—মাঝিপাড়া।

বড় সমবেদনায় বাবুর চোখ কাঁপে।—তা! ঘরে যেয়ে কী করবি? তারা তো নাই রে কেউ সেখানে। আজ কয় বছর সব চলে গিছে।

—কোথা গেল বাবু?

—কে জানে?

—কেন, গেল কেন?

—বাবুরা বসিয়েছিল। তারাই উচ্ছেদ করল। তুই চালান গেলি, তা বাদে নকশালি হাওয়া খুব উঠল। মাঝিরা কেন, ডমরাও খুব নাচছিল। এই খেতের ধান কেটে নেয়, এই বাবুদের ঘরে আগুন দেয়,—বাবুরা তা বাদে মামলা করে তুলে দিল সব।

—সব?

—হ্যাঁ রে!

বাবু ও প্রসঙ্গটি সেরে দেন হাত নেড়ে। তোলার কাজটি তখনি হয়নি, পরে হয়েছে। সে ব্যাপারে তাঁর অবদানও কম ছিল না। সে সব কথায় আর গিয়ে লাভ কী?

—ঘরগুলাও নাই?

—মানুষ গেলে ঘর থাকে? এখন সব নতুন নতুন লোক। যেয়ে দেখতে পারিস।

—একটু জল খেতাম বাবু।

—যা, বাগানে কল আছে।

চাপা কল! দেখ, ভুস করে জল উঠছে। আগে সকলই কুয়া ছিল। জল খেয়ে মাগন বেরিয়ে আসে। থানার দিকে পিছন ফিরতেই ক্রমে তার পা ফেলা স্বাভাবিক হয়। থানায় ঢুকে যে সে পা ঘষে ঘষে চলছিল, তা যেমন মাগন খেয়াল করেনি, এখন যে সে বড় বড় পা ফেলে চলছে, তাও মাগন খেয়াল করে না।

বড়শুলি অবধি সে হেঁটেই যায়। চোদ্দো বচরে তার বয়স চল্লিশ হয়েছে। সে নিশ্চয় বদলে গিয়েছে অনেক। কিন্তু তার আজন্ম চেনা জায়গা যেন আরো অনেক বেশি বদলে গেছে! সেই ছাতিম গাছগুলো কোথা গেল? সাঁওতাল মেয়েরা ছাতিম ফুল পরত মাথায়। ছাতুলাল পান দোকানি এখনো আছে। মাগন একটু দাঁড়ায়।

—কি, পান খাবে?

—না। বিড়ি দাও একটা।

—নাও।

ছাতুলাল তাকে চেনে না। মাগনও বলে না কিছু। কী বলবে?

—কিছু বলবে?

—বড়শুলি যাব।

—বড়শুলি…তুমি…তুমি…

—মাগন সাঁওতাল।

—হ্যাঁ, বুঝলাম। তা সেখানে তো তোমাদের নাই কেউ এখন। কয়েক বছর…

—কোথা গেছে বলতে পার?

—না। কোথা গেল…

মাগনের ভিতর থেকে সব নিরুদ্যম ও নিস্তেজ হয়ে আসে। এখন বড়শুলি গিয়ে—বা কী লাভ? সে যাবেই—বা কোথায়? পথে একটা গাছও নেই।

আবার সে ফিরে চলে চামারির দিকে। হ্যাঁ, পুকুরটা আজও আছে। সেদিনে পুকুরটা ভরাভর্তি ছিল। দনিকে নিয়ে ওরা আসছিল। পুকুরে জল খেল। দনির মুখটাও মনে পড়ে না। ক্রোধ বড় চণ্ডাল হে! দনি—বা কেন তাকে তাতাল? সে—বা কেন তাতল? পলকে প্রলয় হয়ে গেল যেন। সেদিন যদি সে খেপে না যেত, তাহলে দনি থাকত। সে থাকত, সব যেমন ছিল তেমন থাকত আর সাঁওতালদের সঙ্গে সেও উচ্ছেদ হত। তবু তো একসঙ্গে থাকা হত। এমন করে তারা হারিয়ে যেত না। সাঁওতাল অন্য সাঁওতালের সাহচর্য খোঁজে। বড় তাপিত চিত্তে মাগন পুকুরের জল খায়, মাথায় দেয় খানিক।

তারপর আবার ফেরে চামারিতে। থানা দূরে রেখে বাসপথের ধারে একটি গাছতলায় বসে। কাছে তো কিছু টাকাপয়সা আছে। মুড়ি কেনে চারটি। জেল কেমন জায়গা! কিছু জানেনি মাগন। মুড়ির দর এখন চার টাকা কিলো।

দুই—তিনদিন মাগন চামারি বাজারে ঘোরে। বাজারেও সাঁওতাল আসে না কোনো। কাকে কী শুধায় সে, কোথা যায়। অবশেষে ছাতু কলাইভাজা দোকানির নালিশে সেপাই তাকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। পা ঘষে ঘষে মাগন গিয়ে দাঁড়ায়। বড়বাবু বিরক্ত হয়ে চোখ তোলে। উটকো ভোগান্ট চামারিতে? কে বাবা তুমি? ডাকাতি করবে বলে শুলুক সন্ধান নিতে এসেছ?

—তারপরই তিনি অবাক হন।

—কে রে, মাগন?

—হ্যাঁ বাবু।

—এখনো এখানে আছিস?

—কোথা যাব বাবু?

—বড়বাবু তাকিয়ে থাকেন। লাইফার। থানা—পুলিশকে ডরাবে। সাঁওতাল বিশ্বাসী হবে, খাটবে খুব। ভালোভাবে না চললে কবছর ছাড় পেত না। বটবাড়ির ছোটো থানায় বড়বাবুর দূরসম্পর্কের শালা বড় কষ্টে আছে। প্রধান কষ্ট জলকষ্ট। থানায় কুয়ো করা যাচ্ছে না। যত চোটাও নীচে পাথর। ব্লাস্টিং করলেও জল বেরোয় না, এ এক ঝামেলা। জল টানতে হয় পঞ্চায়েতি কুয়া থেকে, বাঁধ থেকে।

—কাজ করবি?

—করব।

—কাল পাঠিয়ে দেব। আজ বাগানটা ঝাঁটপাট দে, সাফ কর।

কত বছর মাগন নিজের উদ্যোগে কিছু করে না। যা বলা হয় তাই করে। জেলারবাবুর বাগান করত। ঝাড়ু দাও বাবু, আর খুরপি। ঘাস চেঁছে দিই! মাগন পা ঘষে ঘষে কাজ করে। চারদিকে খাকি পোশাক, লাইফার! সাঁওতাল লাইফারটাকে ভেজে দেন জেলারবাবুর বাড়ি। বাগান যেন ঝলমল করে। লাইফার! মাগন নিপুণ হাতে ঝাঁট দিতে থাকে। জঞ্জাল জ্বালিয়ে দেই বাবু? না গর্ত খুঁড়ে পচতে দিব, সার হবে? আবার সে লাইফবয়ে স্নান করে। আবার ভাত খায় লোহার থালায়। পা ঘষে ঘষে মেপে মেপে বাগানে যায়। গামছা বিছায় কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায়, ঘুমায়। বাগান ঝাঁট দেয়া ধুলোর ওপর মাগনের পা ঘষে ঘষে চলার দাগ। লাইফার! ঘুমন্ত মাগনকে দেখে বড়বাবুর মনে, ‘যাহোক গরিবের উপকার করেছি’ মনে হয় ও তিনি গভীর সন্তাোষ পান মনে।

পরদিন মাগনকে জিপে চড়িয়ে নিয়ে যান বটবাড়ি। চারধারে অপার ধানখেত, অবশ্যই আলে আলে বিভক্ত। বটবাড়ি জায়গাটা শুকনো বটে। সামনে অঘ্রাণ। ধানের চেহারা বামন বামন। ধূরে রামগেরি পাহাড় দেখা যায়। সলাই নদী হতে খালকাটার চেষ্টা করে লাভ হয়নি। খালটিকে বাঁধ করে দিয়েছে। সরকার ফরেস করেছে বটবাড়ির ওধারে।

গ্রামের চেহারা ধূলিধূসর। থানার চেহারাও তাই। বড়বাবুর শালাজ ‘লাইফার’ শুনে চমকে ওঠে। বড়বাবু বলে, লাইফার ছাড়া কেউ পেটভাতায় জল টানবে না। মাসে পাঁচটা টাকা দিও। আর কথা বলবে খুব কম, বেটা কেটা বোলো না। দিয়ে গেলাম, পরে দেখবে ভালোই করেছি।

শালা বলে, বদলি না হলে তো মরে যাব জামাইবাবু। না ইস্কুল, না কিছু!

—ভাই রে। অমন নির্বাসনে আমরাও থেকেছি। কিছুকাল ঘষতে হবে। তারপর জোরবাড়িতে দেব এখন। জায়গা ভালো। স্কুল পাবে, ইলেকট্রিক আছে।

বড়বাবু চামারি ফিরে যায় জিপে। ভালো হয়ে থাকিস মাগন। কোনো অসুবিধা হলে বাবুকে বলবি, মাকে বলবি।

—বড়শুলি মাঝিপাড়ায় খোঁজ পেলে বোলো বাবু! দেখা হলে তাদেরকে বোলো।

—বলব নিশ্চয়।

বড়বাবু যখন জিপে ওঠে, তখন বটবাড়ির থানাবাবু তাড়াতাড়ি একটা হাঁড়ি তুলে দেয় গাড়িতে। বটবাড়ির খাসা সন্দেশ। আসবেন জানলে এনে রাখতাম। এ তো নমুনা মাত্তর, আনা ছিল সামান্য।

—দিনকাল পালটে গেছে ভায়া! তারা দিলে নিতে পার, কিন্তু চেও না কিছু। দিনকাল ভালো নয় হে।

—তা নিয়ত জানছি। থানাতে আসে—বা কে? পাবলিকও জানে যে থানার উপর আর কোনো ভরসা নেই। দাদারা যা বলবে থানাকে তাই মানতে হবে।

—আবার এদিক—ওদিক হলে থানার নামে থুথু দিবে। জানো তো সব। যা হোক, মাগনকে দিয়ে গেলাম…

—ও পা ঘষে ঘষে চলে কেন?

—লাইফার ছিল…অভ্যাস হয়ে গেছে…চলি ভাই। চললাম রেণু গো! স্বামীর সঙ্গে নির্বাসনে থাকো। পরে তোমার দিদির মতো সুখ হবে।

—আবার আসবেন…

অস্পষ্ট শব্দ করে সম্ভবত ‘হ্যাঁ’ বলে চলে যায় বড়বাবু। ছোটবাবু মাগনকে ডাকে। বলে, চলো বাবা! ঘর দেখিয়ে দেই। জলের সঙ্গে সম্পর্ক নাই, বাগান দেখো কত বড়। এই ঘর।

বাগানের দিকে ছোটো ঘর। মাগন ঘাড় কাত করে। পারবে, থাকতে পারবে। তবে চলো কুয়ো কোথা দেখাই। জলের কষ্টে থানা শুকায়। গরমকালে সব যেন…

মাগন পা ঘষে ঘষে, মেপে চলে। বাঁকে জল বইলে তোর আর কোনো অসুবিধা হবে না কুয়ো থেকে পাকসাকের জল, খাবার জল, স্নানের জল বাঁধ হতে। আমি বাঁধেই চলে আসি। মেয়েছেলেদের জন্য…মাগন ঘাড় হেলায়। ছোটো ছোটো পায়ে হাঁটে। উন্নত ও উন্নয়নহীন বটবাড়িকে তার মনে হয় যেন শৈশব হতে চেনা বড়শুলি। ছোটোবাবু যা যা বলছে সবই সে করবে।

সবই সে করে চলে। বিনা প্রতিবাদে। ছোটো ছোটো পদক্ষেপে বাঁকে বহে আনে জল। স্নানের ঘর ও রান্নাঘর থেকে নালা কেটে আনে খানিকদূর। সেখানে লাগায় তরিতরকারি। দেখো দেখো, জেলে ছিল বলে বাগান করতে শিখেছে কেমন। সব সময়ে সে থাকে আচ্ছন্ন, যেন কোনো জাদুমন্ত্র বশ হয়ে আছে। যা করছে সবই সেই মন্ত্রের বাঁধনে বন্দী থেকে।

জেলের জীবনে যাবার আগে তার কোনো নিজস্ব জীবন ছিল! জেলে যাবার কালে তার মনে বড় দুঃখ ছিল যে পাখি যেমন ফান্দায় পড়ে তেমনই বান্ধা পড়ে গেলাম। বড় কষ্টে সে কাকাকে বলেছিল, কাকা! কত বছর ধরে বেন্ধে মারবে। তবে কেন ফাঁস যেতে দিলে না।

কাকার মুখ দুঃখে ভেঙে ফেটে গিয়েছিল। হা দেখ। এ ছেলেটা কেমন কথা বলে। তুই শুধু নিজের জন্য জন্মেছিস না কি রে মাগন? তোর মায়ের সকল সন্তান মরে যেত। তাতে বাবুদের গিন্নিরা বলল, এ ছেলেটাকে তোরা মেগে নে। নাম দে মাগন। তবে ও বাঁচবে। মরুঞ্চে পোয়াতীর ছেলেকে বাঁচাতে হলে এই উপায়। তুই ফিরে আসবি তোকে আবার বিয়ে করা। তোর ছেলেকে কোলে নেব। বুক জুড়াব।

তখন ভরসা ছিল যে কোথাও তার নিজস্ব জীবন অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু জেল হতে বেরোতে তো দেখে সে—সব নেই কোথাও। কোন—বা চিত্রকর বড়শুলি মৌজা হতে মাঝিপাড়ায় ছবি মুছে দিয়ে অন্য ছবি এঁকে রেখেছে।

তাহলে আবার থানা—পুলিশ—উর্দি নিয়ে জীবন ও জগৎ। লাইফার সে। এখনো বন্দী। পায়ে বেড়ি। মেপে মেপে হাঁটো, হুকুম মেনে কাজ করো। যদি অন্য কোথাও যেতে পারত যেখানে সে যে লাইফার, তা মনে করাতে উর্দি পুলিশ নেই, তাহলে তো সে ওই রামগেরি পাহাড় অবধি দৌড়ে চলে যেত, দেখে নিত কোথাও কি বাজে ডিম—ডিম মাদল? কোথাও কি সহরায় উৎসবে যে সাঁওতাল বউয়ের মা—বাবা—ভাই—বোন নেই সে কি দুঃখ করে গায়—

ভালো রে! এগাঞ আপুঞ!

ভালো রে!

কোথাও কি সারহুল পরবে মেয়েরা শালফুল পরে নাচে?

বন্দি বন্দি সে, তাই তো মাগন হাঁটে পা—পা, ছোটো ছোটো পদক্ষেপ। থানা থেকে বাঁধ, বাঁধ থেকে থানা। সর্বত্র তার পা ঘষে চলার দাগ।

থানাবাবুর বাড়িতে সে কারো সঙ্গে কথা বলে না, কথা বলে না সেপাইদের সঙ্গে। কাজ হয়ে গেলে চলে যায় সরকারি ফরেসে। ইউক্যালিপটাস লাগিয়েছে সরকার। তবু গাছপালা, মানুষ নেই কোনো। মাগন বুঝতে পারে না যে বনে যখন ঢোকে তখন ও বড় বড় পা ফেলে হাঁটে।

এমন হাঁটতে হাঁটতেই বিটবাবুর সঙ্গে দেখা হয় মাঝে মাঝে। সবজে—খাকি জামা ও প্যান্টপরা বিটবাবুকে দেখলেই মাগন অজানিতে হাঁটে ছোটো ছোটো পদক্ষেপে। বিটুবাবু থানায় মাঝেমাঝেই যায়। নির্বান্ধব পুরীতে বাস। আমি আপনার কাছে আসব, আপনি আমার কাছে যাবেন, নইলে মানুষ বাঁচে কি—বা! মাগনকে চেনে বিটুবাবু খুব। দেখলেই কথা বলে।

—এই যে মাগন!

—হাঁ বাবু!

—ঘুরছিস যে, গার্ড দেখলি কোথাও?

—না বাবু।

—সব বেটা ফাঁকি দেয়।

—জানি না বাবু।

—দেখবি, কেউ যেন গাছ না কাটে। দেখলেই বেঁধেছেঁদে আপিসে নিবি, জানলি? টাকা পাবি, টাকা!

—হাঁ বাবু!

সে যে কাউকে ধরতে পারে, জঙ্গল আপিসে নিতে পারে, সে জন্যে টাকা পেতে পারে, এসব কথা মাগনের কখনো মনে বিশ্বাস হয় না।

সেপাইরা বলে, তুই বড় বোকা রে মাগন! বনে ফিরিস, কেউ গাছ কাটে না?

—কে কাটবে?

—তোর জাতির লোকরা।

—তারা কোথায়?

—রামগেরির ওপার হতে আসে।

—ফরেসে?

—হ্যাঁ রে বোকা! ধরলে হেথা আনবি। দমাদম জরিমানা, আমরা নিব, বিটবাবু নিবে,—এখানে আছে—বা কী? শুধু মাইনাতে চলে?

মাগন ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করে। তারপর থানাবাবুকে শুধায়, হাঁ বাবু?

—কী রে মাগন?

—সাঁওতালরা ফরেসে ঢুকে?

—তুই দেখেছিস?

—সেপাইরা বলছিল?

—ঢুকতে পারে। বনে তো ঘুরিস, দেখলে পরে বলে দিবি, নয় ধরে আনবি। পারবি না?

—ধরে আনব।

—ধরে আনবি।

—বনে সাঁওতাল ঢুকে?

—ঢুকে বইকী।

—কোথা হতে আসে?

—দূর হতে। তাদের—বা কী বলব? ধরলে পরে বলে, টাকা দিছে, গাছ কাটাইছে বাবু। তা ভোখের জ্বালা। পাঁচ টাকা হাতে দিবে তো গাছ বলো গাছ, মানুষ বলো মানুষ, পাহাড় বলো পাহাড়, যা বলে সব কাটি দিব। এমন কথা!

—বাবু! আমি তো তারাদের দেখি না।

—তারা তোকে ঠিকই দেখে।

অত্যন্ত বিপন্ন বোধ করে মাগন। এতকাল স্বজাতির সাহচর্য নেই। তাতে কি সে অন্যরকম হয়ে গেছে? সাঁওতাল হড় খুঁজে খুঁজে চোখ তার ক্ষয়ে গেল, অথচ তারা আসে, ওই ফরেসে আসে। তবু মাগন তারাদের দেখতে পায় না।

—আমি ঠিক তাদের বের করব।

—যদি দেখিস তারা অনেক, তাহলে চুপে এসে বলে দিবি। ফরেস রাখা যাচ্ছে না মোটে! সরকারের—বা বুদ্ধি কেমন! কেমন নিজনে—বিজনে ফরেস করছে।

মাগন যান্ত্রিকভাবে বলে, হাঁ বাবু!

অথচ একটু সজাগ থাকলে সে বুঝতে পারত, ফরেস যদি করতে হয় তবে নিজনে—বিজনেই করতে হবে। টাউনের বুকে কি দশ হাজার বিশ হাজার গাছের ফরেস বানানো সম্ভব?

খুব তাড়াতাড়ি থানার কাজ সেরে মাগন এখন থেকে ফরেসে চলে যায়। থানাবাবুর বউ বাবুকে বলে, কেমন কেমন লাগত বাপু। এই ষাঁড়াষাঁড়ি জোয়ান! মুখে কথা বলে না, নিয়ত ঘুরে ঘুরে কাজ করে। তা, ওকে কি গাছের ফরেসে কাজ দিলে?

—মেয়েছেলের ভেমো বুদ্ধি! আমি কি দেশের রাজাগজা যে ফরেসে ওকে কাজে ঢোকাব? ফরেসে একটা তাল ধরিয়ে দিয়েছি বই তো নয়। তোমার কাজকর্ম সেরে নিয়েই যাচ্ছে।

—তা দিচ্ছে।

—জল একটু টেনে খরচ কোরো, জানলে? একটা লোক টেনেই যাচ্ছে, তুমি ঢেলেই যাচ্ছ, এ কেমন কথা?

—লাইফার বলে পারছে।

—তা বটে।

থানাবাবু ও তার গিন্নি যেন ভুলেই যায় যে মাগন এখন লাইফার নয়। আসলে সে মুক্ত এবং স্বাধীন। সে সব ওদের মনে থাকে না, কেননা মাগনের নিজেরও সে কথা মনে থাকে না।

সাঁওতাল জীবন, জগৎ ও সাহচর্য থেকে সে চিরতরে নির্বাসিত, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরিত, এটা জেনেছে বলেই মাগন লাইফার হয়ে থাকাই মারাংবুরুর ইচ্ছা বলে মনে করত।

কিন্তু তারা আসে, ফরেসে ঢোকে, মাগনকে দেখে, দেখা দেয় না, এ—কথা জেনে মাগনের লাইফার সত্তার ভিতে যেন ফাটল ধরে। কোথায় যেন বারতিরা করম পরবের শস্যবীজ জাওয়ায়, কারা কোথায় শহরায় পূজায় আতপচালের গুঁড়োর খঁড় ঘিরে পাঁচ শালপাতে সাজায় পিঠা, জ্বালায় প্রদীপ। কোথায় নে খরাপোড়া মাটিতে বৃষ্টি পড়ে। কোদো গাছ আঁকুর জাগায়।

বড় বিচলিত হয় মাগন। ফরেসে ঢুকে সে অন্য মাগন হয় অন্যমনে। এই মাগন হওয়ার মতো সর্বত্রগামী, খরগোশের মতো সতর্ক, অন্ধকারের মতো নিঃশব্দ।

গাছের পর গাছ, গাছের পর গাছ। ইউক্যালিপটাসের শেষ যেখানে, শালবন সেখানে। মহীরুহ নয়, তরুণ তরুণ শাল। ঝাটিবন কত—বা। কারা গাছ কাটে, কারা ঝাটি সংগ্রহ করে, কারা তাকে ছায়ার মতো নিঃশব্দ সতর্কতায় অনুসরণ করে?

—কে আছ গো সন্তাল হড়! সাড়া দেও গো! আমি কারেও ধরাব না। কতকাল স্বজাতির মুখ দেখি না, স্বজাতির ভাষা শুনি না, বড় খরাপোড়া হয়ে আছি, দয়া করো গো!

বাতাস হয়ে কারা সরে যায়, খরগোশ হয়ে কারা ক্ষিপ্র পায়ে দৌড়ায়, গাছের পাতার সরসর মর্মরে কারা ফিসফিস করে কথা বলে। মাগন খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ বিফল হয়ে ফিরে আসে। বেড়ি নামে না পা থেকে, বেড়ি নামে না।

পা মেপে মেপে লাইফার বাঁকে জল বয়। ওর চোখ খোলা থাকে। চোখের মণির দিকে চেয়ে দেখো, ও স্বপ্ন দেখছে। ও কোনো জাদুকাঠির পরশে বন্দী হয়ে আছে। কাকা কাকে বলেছিল বিয়ে করাবে, কার ছেলেকে কোলে নিয়ে বুক জড়াবে? সে লাইফার নয়, সে লাইফার নয়। সে লাইফার কেমন করে মাগন হবে, যদি ফরেসে কারা ঢোকে আর বেরোয়, তাদের নাগাল না পায়? তারা কি তাকে বিটলাহা করে রেখেছে? সে তো জেলবাসের প্রায়শ্চিত্ত করতে এখনি রাজি আছে।

—লাইফার! জালাটা ভরে দে, অতিথি আসবে।

বাঁধ থেকে জল আনতে গিয়ে চেটালো কালো পাথরটা মাগনের গায়ে কাকির ফাটাচটা হাতের স্নেহপরশ বুলায় আজ।

নিম তেলের গন্ধ। নিমবীজ পেষা তেলের কটু ও তীব্র গন্ধ, চেনা গন্ধ। মাগন মাথা ঠেকায় পাথরে, মুখ ঘষে। কোন সাঁওতাল মেয়ে পুরুষ স্নান করে গেছে বাঁধের জলে। রুক্ষ গায়ে স্নান করে পাথরে বসে মাথায় গায়ে নিম তেল মেখেছে ঘষে ঘষে। মাগন বুক ভরে বাস নেয়। কাকি গো! দনি রে! মাগন কাঁদে। মাগনের হারানো অতীত, মাগনের অপহৃত জীবন, সব ফিরে আসে নিম বীজ পেষা তেলের কটু, কষায়, চেনা গন্ধে।

বাঁকে জল বহে নিয়ে ফেরে মাগন, মুখচোখ থমথম করে তার। ধান কাটা হয়ে গেছে। অঘ্রাণের শেষ ও পৌষের প্রথমে হিমেল হাওয়ায় শীতের দাঁত। সেপাইরা পাতা কুটোয় আগুন জ্বালে। মাংস রান্নার সুবাস আসে। আজ থানায় অতিথি অনেক। বিটবাবু, বিটবাবুর বউ, ছেলেমেয়ে।

বিটবাবু তাকে ডাকে।—কি রে মাগন! ধরতে পারলি কারুকে?

—না বাবু! ধরলে তো ছাড়ব না।

—ধরবি—বা কেমন করে। শেষ রাতে আসে, ভোর ভোর পালায়। বিকালে সব গুছিয়ে রেখে যায়। কে করাচ্ছে, কী হচ্ছে, বুঝি সব। দুইটা গার্ড নিয়ে তারাদের সামনে যাব কী করে—বা। টাঙ্গি, কুড়াল কী চালায়, হট্টাকট্টা জাত।

—তাহলে তখন যাব বাবু।

—পাগলের কথা। রাত কাটাবি নাকি বনে?

—রাত কাটালে তাদের দেখা পাব?

থানাবাবু ও বিটবাবু হাসে। থানাবাবু বলে, যা। খেয়ে নে গা। দিনমান অনেক খাটিস।

—যাই বাবু।

—লাইফার খুব খাটে, জানলেন বিটবাবু? সবাই যেখান হতে জল আনে, সেখানে নেয় না। অনেক পথ উজায়। না, কি রে?

—হাঁ বাবু।

—দেখিস বাপু, বনে গেলে, লাঠি নিয়ে যাস। তাদের কথা বলা যায় না।

—হাঁ বাবু।

পা ঘষে ঘষে যায় মাগন। তার খাবার বেড়ে ঠেলে দেয় রেণুবালা। ভাতের চূড়ায় ডাল, পাশে একটু মাংস। এখন কুসুম কুসুম শীতে শুওরের মাংস আর গরম ভাত খাবার দিন। শীতের চাঁদ কেমন মলিন মুখ তাই দেখ। মাগন ভাত নিয়ে নিজের ঘরের দাওয়ায় এসে বসে। বিটবাবুর কথাই ঠিক। বিকেল বিকেল, নয়তো শেষরাতে তারা আসে।

সেপাই সদয় কণ্ঠে বলে, কি রে লাইফার! মাংস দিল তোকে?

—দিল।

—ভালো, ভালো, খা।

—আচ্ছা, তারা বনে ঢুকলে তারাদের থানায় আনতে পারে?

—নিশ্চয়। থানা সব পারে।

—তারপর কি জেলে পাঠায়?

—পাঠাতে পারে। তবে ধরতে পারলে দা কুড়াল কেড়ে নেয়, জরিমানা করে ছেড়ে দেয়।

—তারা গরিব হয়।

—সব বেচেবুচে জরিমানা দেয়। কত কষ্ট করে, কত চেষ্টা করে সরকার ফরেস করে। খাজনা পায় কত কাঠ বেচে,—তা চুরি করলে মানবে?

—না, কেন মানবে।

—মাগন আত্মগতভাবে বলে। সেপাইটি ছুটি না পেয়ে বড় বিরক্ত। সে বলে, বিটবাবুকেও জানি, আমাদের বাবুকেও জানি। ফরেস নিয়ে কী করছে তাও জানি। কিন্তু মাগন। পালধিবাবু যত গাছ কাটাচ্ছে আর চালান দিচ্ছে, সে সকল টাকা তো আমরা দেখি না, গার্ডরাও দেখে না। দু—চারটা ডম সাঁওতাল ধরা পড়লে আমরা দুই পাঁচ টাকা পেতে পারি। এ থানায় কিছু নাই আর। খুব খারাপ জায়গা এটা।

—তাহ হবে।

—তুই ভালোই আছিস। জল টানলি, মাটি কোপালি, খেলি আর ঘুমোলি।

—হাঁ ভাই।

সেপাই চলে যায়। মাগন তার থালা গেলাশ মেজে রাখে। তারপর দাওয়াতে বসে। এমন রাতে তারা আসে কি—বা ফরেসে? রামগেরি পাহাড়ের ওপারে কী আছে? সাঁওতাল বসতি? বড়শুলির লোকরা কি ওখানে ঘর বেঁধেছে? জেলে থাকা মানে একরকম অশুচি হয়ে থাকা। সমাজকে খাওয়াতে হবে কি? সমাজ যা বলে।

অন্ধকার থাকতে উঠে পড়ে মাগন। এমন সময় তারা আসতে পারে। জল বইবার বাঁকটা নেয় হাতে। পাকা বাঁশের পোক্ত বাঁক। এতেই লাঠির কাজ করবে। সে তো মারবে না কাউকে। শেয়ালটা হুড়ারটা তাড়াবে শুধু। এখন বটাবাড়িতেও সব অন্যরকম। নইলে বাঁধের ধারে ঘন কালো ও উলু ঘাসের বন থাকলে এমন শীতে জলচর পাখি উড়ে আসত, বাঁসা বাঁধত। বড়শুলির জীবনে মাগন কাঁড় মেরে পাখি শিকার করত ঝিনাই নদীর বুক থেকে। কাকি পাখির মাংস রাঁধত। ইউক্যালিপটাস বন বড় নিঃশব্দ হয়। বিহঙ্গ বাসা বাঁধে না তার ডালে।

মাগন থানা পিছনে রেখে বড় বড় পায়ে চলে। লাঠিতে ভর দিয়ে লাফিয়ে যেতে আনন্দ কত। পায়ে বেড়ি রাখব না হে। থানা—পুলিশ দেখলে পা বাঁধা পড়ে যায়। পা ঘষে ঘষে চলতে হয়। কোথায় আছ তোমরা? কাদের জন্যে কাঠ চুরি করো? তারাই কি তোমাদের ধরা করায়? মাগন তোমাদের দুশমন হয় না হে। মাগনকে তোমরা ডেকে নাও। নিমতেলের গন্ধ মাগনকে পাগল করে দিয়েছে। কারা শীতের বাতাসে রুক্ষ গা মাটিতে মেখে স্নান করে? তারপর গা মুছে ঘষে ঘষে মাখে নিম গন্ধ কটু তেল? ঝুনো ঝুনো গন্ধ। গরিব সাঁওতালের গায়ের গন্ধ।

মাগন বনে ঢোকে। না, দীর্ঘ ও উন্নত ইউক্যালিপটাসের উদ্ধত বন নয়। তারা ফেরে শালবনে। শাল, সার্জোম, গড়াম দেবতা হও। তারা ফেরে ঝাটিবনে। কোথায় চলাফেরার শব্দ, কারা দৌড়ে সরে যায়, মাগন নক্ষত্র বেগে ছোটে, ঝড়ের মুখে পাতার মতো ভেসে চলে যায়। ছায়া সরে, ছায়া নড়ে। মাগন শালপত্র ডাল ভেঙে নেয়। হাতে শালপত্রডাল নিয়ে এসেছি হে, আমাকে মেরো না।

—দাঁড়া!

কে চাপা গর্জনে বলে, পাথর ছুঁড়ে মারে। না, মেরো না, আমি মাগন সাঁওতাল হে! বহু বৎসর বেড়ি পরে আছি। পা ফেলে চলতে পারি না।

পায়ে লাঠি মারে কে! মাগন পড়ে যায়। না, লাগেনি বেশি। মাগন উঠতে পারে। ওরা ঘিরে আসে। কালো কালো মুখ সব।

—থানার খুঁখড়া তুই!

—সাঁওতাল হয়ে সজাতিকে ধরতে আস?

—কেটে রেখে যাব।

—আমার হাতে শালপত্র ডাল।

—শালপত্র ডাল?

—এই দেখো।

—তবে?

গবাই নিচু হয়ে কৌতূহলে দেখে। নিমবীজতেলের গন্ধ হে, নিমবীজতেলের গন্ধ!

রাত ভোর ভোর। দিন কুসুম কুসুম। মাগন নদীর কলকলে নিজের কথা বলে বৃষ্টি ও শিশিরের বর্ষণবিন্দুতে কাঁদে। কালো কালো মুখগুলি নিশ্চুপ, ভাবলেশহীন। মাগন সকলের দিকে চায়। সকলে চায় প্রৌঢ় পাহাড় হাঁসদার দিকে।

পাহাড় হাঁসদা কুড়ালে ভর দিয়ে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ ভাবে আর ভাবে আর ভাবে।

—কী বলো পাহাড় হাঁসদা? সকাল যে হয়।

পাহাড় পিচ করে থুথু ফেলে, মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ওঠো মাগন, ওঠো।

পাঁচজনের দিকে তাকায় পাহাড়। আমাদেরই সজাতি। সন্তাল হড়। গরিব আমরা, গরিবই থাকি, কিন্তু মাগনকে ত্যাগ করা ধর্ম হয় না। চারদিকে শালপত্র বন। পুব আকাশে দেবতা। চলো মাগন, সন্তাল হড়ের দুঃখজর্জর অনিশ্চিত জীবনে ফিরে চলো!

মাগন উঠে দাঁড়ায়। দাও, ওর মাথাতেও একটি কাঠের বোঝা দাও। সামনে অনেক পথ। খুব তাড়াতাড়ি যেতে হবে, রামগেরির ঢালে উঠে ওপারে নামতে হবে।

বাঁকটা ফেলে দেয় মাগন, বেড়ি ফেলে দেয় পা থেকে। মাগন এখন বড় বড় পা ফেলে হাঁটে, নদীর কলকলে কথা বলে। গুন, গুন সজাতি সজ্জন। বড়শুলি—মাঝিপাড়ার সাঁওতালদের খবর জানো? না না, তাদের কথা এমনি শুধাই। পেলাম ভালো, না পেলাম তাও ভালো। মাগন এখন সেই গাছ, যে মাটি পেয়ে গেছে ভাসতে ভাসতে। নতুন সমাজেই শিকড় চালিয়ে দেবে, জিয়ন্ত শিকড়বাকড়ে গাছ সত্বর আবার সজীব হয়। সামনে রামগেরির ঢাল, কত তাড়াতাড়ি মাগন পৌঁছে গেল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *