লব্ধপ্ৰণাশ
বানর ও কুমির
সে-ই বাঁচে বিপদে যার বুদ্ধি খেলে যায়।
কুমির থেকে চতুর বানর তাইতো রক্ষা পায়।।
সুমদ্রের ধারে ছিল এক মস্তবড় জামগাছ। বারোমাস জাম ধরে। যেমন বড়, তেমন মিষ্টি। সেই গাছে থাকত এক বানর। রক্তমুখ।
একদিন করালমুখ নামে এক কুমির উঠে এল পাড়ে। গাছের নিচে বালুতটে জিরোচ্ছিল। তাকে দেখে রক্তমুখ ভাবল: অতিথি নারায়ণ। পণ্ডিত কিংবা মূর্খ হোক, প্রিয় কিংবা অপ্রিয়—অতিথিসেবা হচ্ছে স্বর্গে যাওয়ার সেতু। তাইতো মনু বলেছেন: দূরাগত ক্লান্ত অতিথির বংশ, গোত্র, বিদ্যা কিছুই জানতে চাইবে না। শুধু অন্তর দিয়ে তার সেবা করবে। তাহলে অন্তিমে সদ্গতি লাভ করবে। আর অতিথি যদি কারো বাড়ি থেকে আদর না পেয়ে নিঃশ্বাস ফেলে চলে যায়, তাহলে তার পিতৃপুরুষ ও দেবগণ তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।
এরূপ ভেবে রক্তমুখ কুমিরের উদ্দেশে বলল: ভাই, তুমি আজ আমার অতিথি। নারায়ণ। এই নাও কালো জাম। অমৃতের সঙ্গে এর পার্থক্য সামান্যই।
এই বলে কয়েকটি জাম ছুঁড়ে মারল। কুমিরও সেগুলো খেয়ে পরম তৃপ্তি লাভ করল। তারপর মহানন্দে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে বাড়ি গেল।
এভাবে স্থলের বানর আর জলের কুমিরে গভীর সখ্য গড়ে উঠল। করালমুখ রোজ জামতলায় উঠে আসে, আর রক্তমুখ তাকে জাম দেয়। এক পর্যায়ে কুমির তার হিংস্রতা ভুলে যায়। আর বানরও ভয় কাটিয়ে ওঠে। তাই করালমুখ এলে সে জাম নিয়ে নিচে নেমে আসে। দুজনে জাম খায়, আর চৌদ্দ ভুবনের গল্প করে। এভাবে পরমানন্দে তাদের দিন কাটতে থাকে। করালমুখ যাওয়ার সময় রোজ স্ত্রী মকরীর জন্য কিছু জাম নিয়ে যায়। মকরী অমৃতের ন্যায় সেই জাম খেয়ে একদিন স্বামীকে বলল: হাঁ গা, তুমি এ ফল কোথায় পাও গো?
করালমুখ: আমার এক বানর বন্ধু আছে, রক্তমুখ। সে দেয়। সে ঐ জামগাছেই থাকে। রোজ খায় আর আমাকে দেয়। আমি তোমার জন্য নিয়ে আসি।
এ-কথা শুনে স্ত্রী দৌড়ে এসে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে নাকি সুরে বলল: তাই না-কি! ও নিত্য নিত্য এই জাম খায়! তাহলে তো ওর কলজেটাই মিষ্টি হয়ে গেছে! ওগো, তুমি ওর কলজেটা এনে দাও না! আমি খাব! খেয়ে অমর হব!
করালমুখ ধাক্কা মেরে স্ত্রীকে সরিয়ে দিয়ে বলল: কি বাজে বকছ! সে আমার পরম বন্ধু। কত বিশ্বাস করে আমায়। ভালোবাসার তো অন্তই নেই। তুমি এ আবদার ছাড়। এ—কদিনের আলাপে সে আমার ভাইয়ের মতো হয়ে গেছে। দেখ—এক ভাইয়ের জন্ম হয় মায়ের পেটে। আরেক ভাইয়ের জন্ম হয় আলাপে। কাজেই এ নিষ্ঠুর কাজ আমার দ্বারা হবে না।
মকরী তখন ক্রুদ্ধ ফণিনীর মতো ফোঁস ফোঁস করে বলতে লাগল: বুঝেছি! তুমি অন্য রমণীতে মজেছ। নাহলে এর আগে তো আমার কথার অন্যথা করোনি। যা চেয়েছি, তা-ই দিয়েছ। তবে আজ কেন ব্যতিক্রম? ও নিশ্চয়ই বানর নয়, বানরী। কিংবা অন্য কোনো রমণী। তাই সারাটা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যে বেলা বাড়ি ফের। তোমায় আমি ঠিক ধরেছি। তুমি এখন আর আগের মতো আমার কথায় সানন্দে সাড়া দাও না। আমার পছন্দের জিনিস এনে দাও না। গলা জড়িয়ে ধরে একটু চুমুও খাও না। রাতের বেলা গরম গরম নিঃশ্বাস ছাড়। আমার বিশ্বাস—তোমার বুকের মধ্যে এখন আর আমি নই, ঠাঁই নিয়েছে অন্য কোনো নারী। তুমি ধূর্ত! প্ৰবঞ্চক!
করালমুখ বিপদ বুঝে সুর পাল্টে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল: আমায় তুমি ভুল বুঝ না। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? আমি শপথ করে বলছি:
আমি তোমার নফর, ওগো, পড়ছি তোমার পায়।
তোমা বিনে অন্যকে আর ভাবা কভু যায়??
মকরী ঝামটা মেরে সরে গিয়ে বলল: আর ঢং দেখিয়ে কাজ নেই! ধূর্তরা কথায় কথায় এভাবেই স্ত্রীলোকের পা ধরে। ওতে আমি আর গলছি নে। তুমি যাকে মন দিয়েছ, তার কাছেই যাও। আর যদি তা না হয়, তাহলে কলজে এনে দাও। নতুবা আমি উপোস দিয়ে মরব।
করালমুখ তো মহা বিপদে পড়েছে! ঘর রাখবে, না পর রাখবে—বুঝে উঠতে পারছে না। মনে মনে বলছে: কর্কট, বৃশ্চিক, মূর্খ, নারী, আর মদ্যপ এরা একবার ধরলে আর ছাড়ে না। কিন্তু রক্তমুখকে আমি মারব কি করে? সে আমাকে এত বিশ্বাস করে! এরূপ ভাবতে ভাবতে পরের দিন বেশ খানিকটা দেরি করেই সে বানরের কাছে গেল। একে দেরি, তায় আবার মুখ শুকনা। দেখে রক্তমুখ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল: কি হয়েছে, ভাই? তোমাকে এমন মনমরা দেখাচ্ছে কেন? কোন বিপদ-টিপদ?
করালমুখ গম্ভীরকণ্ঠে বলল: তোমার ভ্রাতৃবধূ আজ আমায় ভীষণ গালমন্দ করেছে! বলেছে: তুমি এত অকৃতজ্ঞ! যে তোমায় রোজরোজ এত মিষ্ট জাম দেয়, প্রতিদানে তুমি তাকে কিছুই দিচ্ছ না! একদিন তাকে বাড়িতেও আনলে না! তুমি কি শাস্ত্রও জাননা যে—
ব্রহ্মহত্যা সুরাপান ব্রতভঙ্গ চুরি।
সবকিছুরই ক্ষমা আছে—
নেই কো কেবল অকৃতজ্ঞ—তার-ই।।
কাজেই, আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। তুমি যেভাবেই পার, আজ আমার দেবরটিকে নিয়েই আসবে। নইলে পরপারে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।
একটু বিরাম নিয়ে করালমুখ আবার বলল: একারণেই তো দেরি হয়ে গেলো। সে তো তোমার জন্যে সেজেগুজে বসে আছে। এখন আমি কি করি বলত?
রক্তমুখ বলল: ভ্রাতৃবধূ তো ঠিকই বলেছে। তাঁতি আর বন্ধু এক নয়। তাঁতি ইঁদুরটাকে কেবল নিজের দিকেই টানে। বন্ধুও যদি তা-ই করে, তাহলে তাকে বর্জন করা উচিত। দেখ, বন্ধুত্বের লক্ষণ হচ্ছে ছয়টি—গোপন কথা বলা, গোপন কথা শোনা, দান দেয়া, দান নেয়া, খাওয়া এবং খাওয়ানো। কিন্তু, ভাই, আমরা হলুম বনের বাসিন্দা। আর তোমরা থাক গভীর জলে। কাজেই তোমার বাড়ি আমি যাব কি করে? তার চেয়ে তুমি ভ্রাতৃবধূকেই এখানে নিয়ে এস। আমি পেন্নাম করে তার আশীর্বাদ নেই। করালমুখ: না না, বন্ধু। আমাদের বাড়ি সমুদ্রের ঐ পারে চড়ায়। তোমাকে আমি পিঠে করে নিযে যাব। তুমি কিচ্ছু ভেবনা।
রক্তমুখ সানন্দে বলল: তাহলে আর দেরি কেন? চলো যাই।
এই বলে বানর কুমিরের পিঠে উঠে বসল। আর কুমির তাকে নিয়ে চলল। কুমির যতই গভীর সমুদ্রের দিকে যায়, ততই বানরের ভয় করে। ঢেউয়ে গা-ও ভিজে যাচ্ছে। সে কুমিরকে বলল: ভাই, একটু আস্তে যাও। আমার গা ভিজে যাচ্ছে যে।
শুনে করালমুখ ভাবল: এই গভীর সমুদ্রে মূর্খ বানরটা এখন আমার হাতের মুঠোয়। আমার পিঠ থেকে একচুলও নড়ার ক্ষমতা ওর নেই। কাজেই আসল কথাটা বলেই ফেলি, যাতে ও ইষ্টনাম জপ করতে পারে। এই ভেবে সে বলল: বন্ধু, আমার স্ত্রীর কথায় তোমায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে এলুম। এবার তুমি ইষ্টনাম জপ কর। কুমিরের মুখে একথা শুনে বানরের তো পিলে গেল চমকে! সে কাতর কণ্ঠে বলল: আমি তোমাদের কি ক্ষতি করেছি যে, আমায় তোমরা মারতে চাও?
করালমুখ হাসতে হাসতে বলল: কি করব? স্ত্রীর আবদার। সে বায়না ধরেছে তোমার কলজে খাবে। মিষ্টি জাম খেয়ে খেয়ে মিষ্টি হয়ে গেছে তো, তাই।
এ ভয়ানক কথা শুনে রক্তমুখ প্রথমে একটু ভরকে গেল। কিন্তু তার ছিল অসম্ভব উপস্থিত বুদ্ধি। মুহূর্তেই সে করণীয় স্থির করে ফেলল। একগাল হেসে বলল: ও, এই কথা! তা আগে বলনি কেন? আমার কলজে তো গাছের কোটরে রেখে এসেছি। রক্তমুখের কথা শুনে করালমুখ আহ্লাদের সুরে বলল: ভাই, তোমায় আমি গাছতলায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার কলজেটা আমায় দাও। আমার ন্যাওটা বউটা খেয়ে শান্ত হোক। তোমার-আমার বন্ধুত্বও পাকা হবে।
রক্তমুখ অনেকটা আশ্বস্ত হয়ে বলল: তা-ই হবে। তুমি দ্রুত আমায় গাছের কাছে নিয়ে চল।
করালমুখ দিক পরিবর্তন করে সেই জামগাছের দিকে যেতে লাগল। আর রক্তমুখ তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর কাছে মানত করতে লাগল, যাতে গাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। তারপর গাছের কাছে আসতেই সে লাফ দিয়ে একেবারে মগডালে উঠে বসল। করালমুখ তখন বলল: কই বন্ধু, কলজেটা দাও।
রক্তমুখ তাকে ধমক দিয়ে বলল: দূর হ, মূর্খ! কলজে কি কারো দুটি, যে একটা গাছে থাকবে? তুই একটা বিশ্বাসঘাতক! আর কোনোদিন এখানে আসবি না। একবার যে বিশ্বাস ভাঙ্গে, দ্বিতীয়বার তার সঙ্গে আর বুদ্ধিমানে বন্ধুত্ব করেনা।
রক্তমুণের কথা শুনে করালমুখ অনুশোচনা করে মনে মনে বলল: আঃ! আমি কি বোকা! ওকে কেন আসল কথাটা বলতে গেলাম! এখন এক কাজ করি, ওকে কোনো রকমে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যাই।
এরূপ চিন্তা করে করালমুখ বলল: বন্ধু, তোমার সঙ্গে একটু মসকরা করছিলুম। দেখি তুমি করি কর? তোমার কলজেতে কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি ফিরে এস। তোমার জন্য তোমার ভ্রাতৃবধূ কতকিছু রান্না করে বসে আছে।
রক্তমুখ তখন তীব্র ভাষায় বলল: ওরে পাজি, যা এখান থেকে! ভুল কি আর মানুষ দুবার করে? শুনিস নি—
শত্রু মারতে সাপকে নিয়ে ঘরে।
গঙ্গদত্ত আর নাহি যায় ফিরে।।
করালমুখ: সে কি রকম?
রক্তমুখ: শোন তাহলে…
ব্যাঙ ও কেউটে
এক কুয়োয় থাকত এক ব্যাঙ। নাম গঙ্গদত্ত। সঙ্গে থাকত জ্ঞাতিরাও। কিন্তু বনিবনা ছিল না মোটেই। নিত্য ঝগড়া। কত অর সহ্য হয়? তাই একদিন সে জলচাকার বালতিতে চড়ে উঠে এল পারে। ভাবতে লাগল, কি করে জ্ঞাতিশত্রুদের শেষ করা যায়।
ভাবতে ভাবতে একটু দূরেই তার চোখ পড়ল। দেখল, একটা কেউটে গর্তে ঢুকছে। ভাবল, একে কুয়োয় নিয়ে গেলে শত্রুদের সাবাড় করে ফেলবে। কথায় বলে না—শত্রুর বিরুদ্ধে শত্রুকে, আর বলবানের বিরুদ্ধে বলবানকে লাগিয়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। পণ্ডিতেরা তাই বলেছেন:
কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলে যেমন বুদ্ধিমান।
শত্রু দিয়ে শত্রু মারে প্রাজ্ঞ যেই জন।।
এরূপ চিন্তা করে গঙ্গদত্ত গর্তের মুখে গিয়ে মিষ্টি গলায় ডাকল: বন্ধু দীর্ঘকায়, একবারটি বেড়িয়ে এস না।
ডাক শুনে দীর্ঘকায় ভাবল: এ তো আমার জাতের কেউ নয়। তাই পরিচয় না জেনে বেরনো ঠিক না। বৃহস্পতি ঠাকুর বলেছেন না—
জাননা যার চরিত্র আর বংশ কিংবা ধৰ্ম।
তার সঙ্গে মেশা নাহি বুদ্ধিমানের কর্ম।।
হয়তো কোনো ওঝা-টোঝা হবে। মন্তর-তন্তর জানে। ফাঁদে ফেলে ধরে নিয়ে যাবে। কাজেই ভেতরে থেকেই ওর পরিচয় জেনে নেই। এই ভেবে সে জিজ্ঞেস করল: তুমি কে হে?
গঙ্গদত্ত: আমি ব্যাঙরাজ। গঙ্গদত্ত।
দীর্ঘকায়: কি চাই?
গঙ্গদত্ত: বন্ধুত্ব।
দীর্ঘকায়: সম্ভব নয়?
গঙ্গদত্ত: কারণ কি?
দীর্ঘকায়: বৈপরীত্য। তৃণের সঙ্গে আগুনের বন্ধুত্ব হয়? কিংবা—
খাদ্য আর খাদকের সখ্য কেউ দেখেছে?
তাই তুমি এত করে বলছ কেন মিছে??
গঙ্গদত্ত এবার বিনয়ের সঙ্গে বলছে : তুমি ঠিকই বলেছ। তোমাতে-আমাতে জাতশত্রুতা। তবু আমি তোমার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছি। শত্রুর হাতে যার ধন—মান, এমনকি প্রাণও যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন সে অন্য শত্রুর আশ্রয় নেয় বাঁচার জন্য।
দীর্ঘকায়: তা অবিশ্যি ঠিক। রাজনীতিতে তা-ই বলে। তা বলো, কারা তোমার সর্বনাশ করছে?
গঙ্গদত্ত: আর কারা? জ্ঞাতিরা।
দীর্ঘকায় একটু চিন্তা করে বলল: তা তুমি থাক কোথায়? বিলে, ঝিলে, কূপে না সমুদ্রে?
গঙ্গদত্ত: পাথরে গাঁথা এক কুয়োয়।
দীর্ঘকায়: কিন্তু সেখানে আমি থাকব কোথায়? তোমার শত্রুদের খাবই বা কি করে?
গঙ্গদত্ত: সব ব্যবস্থা করা আছে। কুয়োর দেয়ালে একটা গর্ত আছে। তুমি সেখানে ঢুকে থাকবে। আর একেকটাকে ধরে ধরে খাবে। এবার তুমি আমার সঙ্গে চল।
দীর্ঘকায় ভাবল: মন্দ কি? বয়স হয়েছে। কালে-ভদ্রে এক-আধটা ইঁদুর পাই। না পেলে উপোস যাই। এ কুলাঙ্গার তো আমার মঙ্গলই চাচ্ছে। আরামে বাঁচার ব্যবস্থা করছে। বসে বসে জ্যান্ত ব্যাঙগুলো খাব। এই ভেবে সে বলল: ওহে গঙ্গদত্ত, তবে চলো।
গঙ্গদত্ত: চলো। তবে একটা কথা। আমার পরিবারের দিকে কিন্তু হাত বাড়াবে না। তুমি শুধু আমার জ্ঞাতিদেরই খাবে।
দীর্ঘকায় তাকে আশ্বস্ত করে বলল: ছিঃ ছিঃ ছিঃ! সে কি হয়? তুমি তো আমার বন্ধু হয়ে গেছ। তোমার ক্ষতি? সে ভাবাও পাপ! তুমি যেমনটি বলবে, তেমনটিই হবে। গঙ্গদত্ত: তবে বেরিয়ে এস।
দীর্ঘকায় গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে গঙ্গদত্তকে জড়িয়ে ধরে রওনা দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন কুয়োয় পৌঁছে গেল। তারপর জলচাকার বালতিতে করে গঙ্গদত্ত দীর্ঘকায়কে নিয়ে কুয়োয় নামল। কুয়োর দেয়ালে গর্তে দীর্ঘকায়কে বসিয়ে দিয়ে তার জ্ঞাতিদের দেখিয়ে দিল। দীর্ঘকায়ও এক এক করে ব্যাঙগুলোকে খেতে লাগল। এক সময় শত্রুরা শেষ হয়ে গেল। তখন দীর্ঘকায় গঙ্গদত্তকে বলল: বন্ধু, খাবার তো শেষ একটা ব্যবস্থা কর। তুমিই তো আমায় নিয়ে এসেছ।
গঙ্গদত্ত: বন্ধু, তোমায় ধন্যবাদ। আমার বিরাট উপকার করেছ। এবার ঐ জলচাকায় উঠে নিজের বাড়ি চলে যাও।
দীর্ঘকায় ক্রুদ্ধস্বরে বলল: তা কি হয়? আমি সেখানে গিয়ে খাব কি? তাছাড়া আমার দুর্গ হয়তো অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে। অতএব আমি এখানেই থাকব।
গঙ্গদত্ত যেন বিপদের আগমন বার্তা টের পেল। তাই শঙ্কিত হৃদয়ে বলল: কিন্তু এখানে খাবে কি?
দীর্ঘকায়: কেন? তোমার পরিবার থেকে রোজ একটা করে দিও। নইলে সবগুলোকে সাবাড় করব।
দীর্ঘকায়ের কথায় গঙ্গদত্তের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। সে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল। কি ভুলটাই না সে করেছে—এই কেউটেটাকে ঘরে এনে! এখন একটা একটা করে দিলেও তার পরিবার শেষ! আবার না দিলে এক সঙ্গে সব শেষ! উভয় সঙ্কট!
তাই সে মনে মনে বলছে:
জ্ঞাতিবধে শত্রুকে যে ঘরে টেনে আনে।
নিজের দেহে নিজেই সে মৃত্যুবাণ হানে।।
শেষে এই ভেবে সে সান্ত্বনা পায় যে—
একটু দিয়ে অনেক রাখে — সে-ই বুদ্ধিমান।
একটু রাখতে অনেক হারায়—সে-ই হতজ্ঞান।।
তারপর গঙ্গদত্ত নিজের পরিবার থেকে রোজ একটা করে ব্যাঙ পাঠাতে লাগল। কিন্তু তাতে খিদা মেটে না। তাই লুকিয়ে লুকিয়ে দীর্ঘকায় গঙ্গদত্তের পরিবার প্রায় শেষ করে আনে। শেষে একদিন গঙ্গদত্তের প্রিয় পুত্রকেও সে খেয়ে ফেলল। তা দেখে গঙ্গদত্ত করুণ সুরে বিলাপ করতে লাগল। তখন তার স্ত্রী কেঁদে কেঁদে বলল :
নিজের হাতে কুমির এনে আদর দিলে বেশ।
জ্ঞাতি-গুষ্টি কেউ র’ল না, সকল করল শেষ।।
তারপর একদিন ব্যাঙের স্ত্রীকেও খেয়ে ফেলল দীর্ঘকায়। তাতেও খিদা মেটেনি। তাই গঙ্গদত্তকে ডেকে বলল: বন্ধু, বড় খিদা। তুমিই তো আমায় এনেছ। আমি তোমার অতিথি। কিছু একটা কর।
গঙ্গদত্ত ক্ষোভ আর ভয় চেপে রেখে বলল: বন্ধু, আমি থাকতে তোমার চিন্তা কি? সবই তো শেষ। এখন হয় আমাকে খাও। না হয় সুযোগ দাও। অন্য কুয়ো থেকে বোকা ব্যাঙদের নিয়ে আসি।
দীর্ঘকায়: তা-ই কর। আমার আর নড়তে ইচ্ছে করছে না। তুমি আমার স্বভাবটাই পাল্টে দিলে।
গঙ্গদত্ত আশ্বাস পেয়ে জলচাকার বালতিতে গিয়ে উঠল এবং স্বর্গের সব দেবতার কাছে মানত করতে লাগল, যাতে ভালোয় ভালোয় পালাতে পারে। তারপর এক সময় কুয়ো থেকে বেরিয়ে অনেক দূরে চরে গেল।
এদিকে দীর্ঘকায় দিনের পর দিন তার পথ চেয়ে রইল। খিদায় তার প্রাণ যায় যায়। একদিন পাশের গর্তের গোসাপকে ডেকে বলল: ভাই, তুমি তো বাইরে যাও। আমার বন্ধু গঙ্গদত্তকে একটু খুঁজে দেবে? হয়তো কোনো পুকুর-টুকুরে আছে। দেখা হলে বলো—আমি তার কোনো ক্ষতি করব না। সে যেন ফিরে আসে। আমার মাথার দিব্যি রইল।
গোসাপ অনেক খুঁজে গঙ্গদত্তকে বের করল। তারপর দীর্ঘকায়ের দিব্যি দিয়ে বলল: সে তোমার পথ চেয়ে বসে আছে। বলেছে— তোমার কোনো অনিষ্ট করবে না। তুমি ফিরে চল।
গঙ্গদত্ত: অনিষ্টের আর বাকি কি? এবার আমায় গিললে ইষ্ট-অনিষ্ট এক হয়ে যাবে। তুমি তাকে গিয়ে বলো—চেহারা যাদের ভয়ঙ্কর, হৃদয়টাও তাদের তদ্রূপ হয়। আর ক্ষুধার্ত ব্যক্তির কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। কাজেই আমি আর ও কুয়োয় যাচ্ছি না।
কেউটে আর ব্যাঙের এ কাহিনী বলে রক্তমুখ করালমুখকে বলল: বুঝলে, ওহে পাজি জলচর, ঐ গঙ্গদত্তের মতোই আমি আর তোমার বাড়ি যাচ্ছি না। তুমি এখান থেকে চলে যাও।
করালমুখ তখন বিনয়ের সঙ্গে বলল: বন্ধু, তুমি ভুল করছ। কেউটে আর আমি এক নই। তুমি আমায় বিশ্বাস কর। একটিবার আমার বাড়িতে গিয়ে আমায় কৃতঘ্নতা থেকে উদ্ধার কর।
রক্তমুখ ভেংচি মেরে বলল: আরে মূর্খ! তুই কি আমায় ঐ লম্বকর্ণ গাধার মতো মনে করছিস? যে—
পরাক্রম দেখেও পুনঃ সিংহের কাছে যায়।
বোকার মতো বেঘোরে তাই পরাণটা হারায়।।
করালমুখ: ঘটনাটা কি, ভাই? খুলে বলো না।
রক্তমুখ: শোনো তাহলে…
সিংহ শেয়াল গাধা
এক বনে থাকত এক সিংহ। ঘাড়ে ভয়ানক কেশর। তাই নাম হয়েছে করালকেশর। তার ছিল এক বান্দা চাকর। ধূসর বর্ণের এক শেয়াল। নাম ধূসরক
একদিন এক হাতির সঙ্গে লড়তে গিয়ে দুজনেই আহত হলো। ভীষণভাবে! নড়ার ক্ষমতা নেই। সেই থেকে উপোস। কদিন হয়ে গেল। খিদায় গলা শুকিয়ে কাঠ। তখন
ধূসরক বলল: হুজুর, আর তো পারছি না! যানটা বোধ যাবেই! একটা কিছু করুন! নইলে অপনার সেবাই বা করব কি করে?
করালকেশর আর্ত কণ্ঠে বলল: তবে যা-না, একটা জানোয়ার-টানোয়ার খুঁজে নিয়ে আয়। মেরে খাওয়ার ব্যবস্থা করি।
প্রভুর আজ্ঞা পেয়ে ধূসরক খুঁজতে বেরুল। কোথাও কিছু মিলছে না। খুঁজতে খুঁজতে এক গাঁয়ে গিয়ে ঢুকল। সেখানে দেখে এক আধমরা গাধা। লম্বকর্ণ। খুঁটে খুঁটে ঘাস খাচ্ছে। কাছে গিয়ে বলল: কি মামা, কেমন আছ? হাড্ডি তো সব দেখা যাচ্ছে। লম্বকর্ণ তাকিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল: কি আর বলব, ভাগনে! ধোপার বেটা এমন কঞ্জুস যে, এক মুঠো ঘাসও দেয় না। খালি বোঝার পর বোঝা! দূরে কোথাও যেতেও দেয় না। তাই তো কেবল গজিয়ে ওঠা এই ঘাস খাচ্ছি। এর অর্ধেকটাই ধুলোবালি। ধূসরক: তা-ই তো দেখছি। এ সারাদিন খেলেও তো তোমার পেটের এক কোনাও ভরবে না।
লম্বকর্ণ: কি আর করা! এই ভাগ্য নিয়েই জন্মেছি! দোষ দেব কার?
ধূসরক: দোষ-গুণের কথা নয়। চেষ্টায় মানুষের অবস্থা ফেরে। চাইলে তোমারও ফেরতে পারে।
লম্বকর্ণ: কিভাবে?
ধূসরক: চলো না আমাদের ডেরায়। পাশে নদী। তীর জুড়ে পান্নার মতো ঘাস। ইচ্ছেমতো খাবে। কে তোমায় খেদায়? দেখবে—দুদিনেই চেহারায় কি চেকনাই ধরে। লম্বকর্ণ: কিন্তু আমরা তো গাঁয়ের লোক। তোমাদের বনে হিংস্র প্রাণী আছে। আমরা তাদের শিকার। শেষে জীবনটাই না যায়! কাজ নেই বাপু!
ধূসরক: তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমি আছি না? দুই বাহুবলে তোমায় আগলে রাখব। কার সাধ্য তোমায় ছোঁয়? তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার আছে।
লম্বকর্ণ আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইল: কি ভাগনে?
ধূসরক: ওখানে এক গর্দভী আছে। তোমার মতোই মালিকের অত্যাচার। সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে এসেছে। উঠতি বয়স! কি চেহারা! যৌবন যেন ফেটে বেরুচ্ছে! স্বয়ং যেন রতি! আমায় একদিন বলল—তুমি যদি আমার বন্ধু হও, তাহলে দাও না একটা
বর জুটিয়ে। তাই তো তোমার কাছে এলাম।
লম্বকর্ণ এবার উৎসাহিত হয়ে বলল: তাই না-কি! ভাগনে? ধোপার বোঝা টানতে টানতে ওসব তো ভুলেই গেছি। কথায় বলে না—
নারী সে যে অমৃত, বিষও সমান।
মিলনে জীবন তার, বিরহে মরণ।।
তাই এক্ষুনি চল। বিলম্বে কার্য নষ্ট।
এই বলে দুজনে রওনা দিল। ধূসরক আগে আগে পথ দেখিয়ে চলল। লম্বকর্ণ তাকে অনুসরণ করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা চলে এল করালকেশরের গুহায়। সে তখন ব্যথায় কোঁ কোঁ করছিল। লম্বকর্ণকে দেখে উঠতে-না-উঠতেই ভয়ে লম্বকর্ণ দিল দৌড়। করালকেশর থাবা মেরেও সুবিধে করতে পারল না। লম্বকর্ণ পালিয়ে গেল। ধূসরক এবার রেগেমেগে বলল: হুজুর! একি করলেন? এত বুদ্ধি খরচ করে ওটাকে নিয়ে এলাম। আর আপনি ছেড়ে দিলেন? একটা গাধা ধরারও সামর্থ্য নেই আপনার? তাহলে আর মহারাজ কেন?
করালকেশর একটু লজ্জিত হয়ে বলল: আমি ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। তাছাড়া ব্যথাটা ও টনটনে। নাহলে হাতি মারাও আমার কাছে কোনো ব্যাপার?
ধূসরক: ঠিক আছে, ঠিক আছে। দেখি আরেকবার চেষ্টা করে। বোকাটাকে আনতে পারি কি-না।
করালকেশর: কিন্তু একবার যে যমের মুখ থেকে ফসকে গেছে, সে কি আর ফিরে আসবে?
ধূসরক: সে চিন্তা আমার। বুদ্ধিতে কি-না হয়? তাছাড়া ওকে যে টোপ দিয়েছি, তা ও গিলতে বাধ্য। আপনি শুধু ওৎ পেতে থাকুন। সেবার যেন এবারের মতো না হয়। এই বলে ধূসরক লম্বকর্ণের পথ ধরে চলতে শুরু করল। গিয়ে দেখে আগের জায়গায়ই লম্বকর্ণ চরে বেড়াচ্ছে। ধূসরককে দেখে বলল: ভাগনে, তুমি আমায় কোন যমের মুখে নিয়ে গেলে? ভাগ্যবলে বেঁচে গেলাম! ওটা কি জন্তু গো?
ধূসরক বুঝে ফেলল গাধাটা গাধাই। তাই হাসতে হাসতে বলল: মামা, ও-ই তো গর্দভী। তোমায় দেখে আর তর সইছিল না। তাই হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েছিল। আর তুমি কি-না ভয়ে পালিয়ে এলে। বুদ্ধু কোথাকার! এসবের কিছুই বোঝনা। একবার গিয়ে দেখ
তোমার বিরহে তার কি দশা হয়েছে। তুমি তো স্ত্রী হত্যার দায়ে অভিযুক্ত হবে?
লম্বকর্ণ আশ্বস্ত হয়ে বলল: সত্যি বলছ?
ধূসরক: মিথ্যা বলায় আমার লাভ কি? ও কি শেয়ালি?
লম্বকর্ণ: তবে চলো।
এই বলে লম্বকর্ণ ধূসরকের পেছনে পেছনে চলতে লাগল। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তারা গন্তব্যে পৌঁছে গেল। করালকেশর আগে থেকেই ওৎ পেতে ছিল। যাওয়ামাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়ল লম্বকর্ণের উপর। মৃত্যু নিশ্চিত করে তবে ছাড়ল। তারপর ধূসরককে বলল—তুই এটাকে পাহারা দে। আমি নদী থেকে চানটা সেরে আসি।
এই বলে সে নদীতে চলে গেল।
এদিকে কয়েকদিনের উপবাস। তাই ধূসরকের আর তর সইছিল না। সে গাধার মগজ আর কলজেটা খেয়ে ফেলল। করালকেশর ফিরে এসে দেখে মগজ আর কলজে নেই। সে তো রেগে আগুন! দাঁত কটমট করে বলল: ওরে পাজি, তোর এত সাহস যে গাধাটাকে এঁটো করে দিলি! মগজ আর কলজেটা খেয়ে ফেললি!
ধূসরক হাসতে হাসতে বলল: হুজুর, এ কথা বলবেন না। আপনার প্রসাদ আমি এঁটো করব, এতবড় সাহস আমার হবে কি করে?
করালকেশর: তবে ওর মগজ আর কলজে কোথায়?
ধূসরক: হুজুর, ওর যদি মগজ আর কলজেই থাকবে, তাহলে কি দ্বিতীয়বার আর আপনার কাছে ফিরে আসে?
করালকেশর ভাবল, তাই তো। গাধাটার বুদ্ধিও নেই, ভয়ও নেই। সেজন্যই তো মালা পড়ল। এই ভেবে সিংহ আর শেয়াল মিলে গাধাটাকে খেয়ে ফেলল।
এই বলে রক্তমুখ করালমুখকে বলল: তাই বলছিলুম, আমি ঐ বোকা গাধই যে, দ্বিতীয়বার যমের দুয়ারে যাব। আরে মূর্খ, তুই ফন্দিটা তো ভালই এঁটেছিলি, কিন্তু জানিস না যে—
প্রতারণা করে যদি সত্যি কথা বলে।
যুধিষ্ঠিরের মতোই তার সব যায় চলে॥
করালমুখ: সে আবার কোন কাহিনী?
রক্তমুখ: শুনতে চাস? তবে শোন …
কুমোর যুধিষ্ঠির
এক অধিষ্ঠানে থাকত এক কুমোর। নাম যুধিষ্ঠির। নেশার মধ্যে একটাই ছিল মদ্যপান।
একদিন মদ্যপ অবস্থায় সে দৌড়াচ্ছিল। গাছে লাগল ধাক্কা। কপাল গেল কেটে। রক্তে ভেসে গেল তার গা। কোনোরকমে উঠে বাড়ি গেল। তারপর অপথ্য-কুপথ্য খেয়ে ঘা হলো ভয়ঙ্কর! অনেক কষ্টে অনেক পরে ঘা সারল। কিন্তু দাগখানা উজ্জ্বল হয়ে রইল। এর কিছুদিন পরে দেশে লাগল আকাল। অসুখে পড়ে উপার্জনও গেছে কমে। তাই ঘরে হাঁড়ি চড়ে না। সপরিবার উপোস।
একদিন দেখে, বাড়ির পাশ দিয়ে রাজকর্মচারীরা যাচ্ছে ভিন দেশে। কাজের সন্ধানে। তাদের সঙ্গে সেও জুটে গেল। ভিন রাজ্যে গিয়ে রাজার চাকরিও পেয়ে গেল।
রাজা দেখতে পেল এর কপালে ভয়ঙ্কর কাটার দাগ। ভাবলেন, নিশ্চয়ই এ বীরপুরুষ। সম্মুখ যুদ্ধে কপাল কেটে গিয়েছিল। এ দাগ তারই। এই ভেবে রাজা তাকে বিশেষ খাতির রতে লাগলেন। অন্যান্য রাজপুরুষ, এমনকি রাজপুত্রদের সামনেও তাকে বিশেষ সম্মান দিতেন। রাজার এই বাড়াবাড়িতে সকলেই ক্ষুব্ধ হলো। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছিল না।
এভাবে কিছুদিন কেটে গেল। তারপর একদিন যুদ্ধ বাঁধল। রাজা সৈন্যবাহিনী সাজাচ্ছেন। যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য দায়িত্ব দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন: আচ্ছা রাজপুত্র, তুমি কোন বিষয়ে অভিজ্ঞ? আর কোন যুদ্ধে গিয়েই বা তোমার কপাল কেটেছিল?
কুমোর সরলভাবে বলল: মহারাজ, এটা অস্ত্রের দাগ নয়। আমি আসলে কুমোর। নাম যুধিষ্ঠির। একদিন মদ খেয়ে দৌড়াতে গিয়ে কপাল কেটে গিয়েছিল। এ তারই দাদ। এ-কথা শুনে রাজা লজ্জায় মাথা নত করে রইলেন। কুমোরটা তাকে ঠকাল! রাজপুত্রের ভান করে এতদিন সে ফায়দা লুটেছে! এই বলে তিনি হাঁক দিলেন: কে আছিস? গলা ধাক্কা দিয়ে একে বের করে দে।
কুমোর তখন বিনয়ের সঙ্গে বলল: মহারাজ, এমন করবেন না! যুদ্ধটা আগে বাঁধুক। তখন দেখবেন আমার হাতের কাজ।
রাজা তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন: মানলাম—
তুমি বীর, দেখতে ভালো, হাতও ভালো, চওড়া বুকের ছাতি।
কিন্তু শোনো, জন্ম যেথা, সেই কুলে কেউ মারে না কো হাতি॥
কুমোর: তার মানে?
রাজা: শোনো বলছি…
সিংহ সিংহী ও শেয়ালের বাচ্চা
এক বনে থাকত এক সিংহ-দম্পতি। সিংহীর দুটি বাচ্চা হয়েছে। তাই রোজ সকালে সিংহ বনে যায়। সিংহীর জন্য শিকার ধরে আনে।
একদিন কিছুই পেল না। ঘুরতে ঘুরতে সূর্যদেব প্রস্থান করলেন। বাড়ি ফেরার পথে দেখে একটা শেয়ালের বাচ্চা। একেবারেই বাচ্চা। তাই সিংহ তাকে না মেরে দাঁতের ফাঁকে করে নিয়ে এল। সিংহীকে দিয়ে বলল: প্রিয়ে, আজ আর কিছুই পেলাম না। এই শেয়ালের বাচ্চাটা ছাড়া। বাচ্চা বলে আর মারলাম না। জ্যান্তই নিয়ে এলাম। শাস্ত্রে আছে না—
শিশু সন্ন্যাসী নারী আর ব্রাহ্মণ।
অবধ্য জগতে হয় এই চারজন।।
তাই আজ এটাকে গিলে উপোস ভাঙ্গ। কাল অন্য ব্যবস্থা করব।
বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে সিংহীর মায়া হলো। কোলে তারও তো দুটো রয়েছে। তাই স্বামীর উদ্দেশে বলল: ওগো, বাচ্চা বলে তুমি যাকে মারলে না, আমি কি করে তাকে দিয়ে উদর পূরণ করি? কথায় বলে না—
অকর্তব্য ন কর্তব্য, যায় যাক প্রাণ।
কর্তব্য কর্তব্য—এই ধর্ম সনাতন।।
তাই আজ থেকে ও আমাদের তৃতীয় পুত্র। এই বলে সিংহী শেয়ালের বাচ্চাটাকে বুকে তুলে নিল এবং নিজের দুধ খাইয়ে আত্মজদের সঙ্গে বড় করে তুলল। এভাবে বাচ্চা তিনটি পরস্পরের জাতিভেদ ভুলে একসঙ্গে খেলাধুলা করে ছেলেবেলা কাটাতে লাগল। একদিন ঐ বনে এল এক হাতি। তাকে দেখে স্বভাববশে সিংহশাবকদ্বয় গর্জন করে ছুটল তাকে আক্রমণ করতে। সঙ্গে সঙ্গে শেয়ালের বাচ্চা চিৎকার করে বলল: এই, কি করছিস তোরা? হাতি আমাদের শত্রু! একেবারে পিষে ফেলবে! যাসনে ওর কাছে! এই বলে শেয়ালের বাচ্চা পোঁ-পোঁ করে দৌড় দিল বাড়ির দিকে। বয়সে সে একটু বড়। তাই বড়দাকে পালাতে দেখে ছোট দুজনও রণে ভঙ্গ দিল। এ কারণেই যুদ্ধশাস্ত্রে বলা হয়েছে— দলে একজনও ধীরস্থির বীর সেনা থাকলে, অন্যরা উৎসাহ পায়। কিন্তু একজন রণে ভঙ্গ দিলে, অন্যদেরও মনোবল ভেঙ্গে যায়। তখন সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তাই জিগীষু রাজা মহাবল, বীর, ধীর ও উৎসাহী যোদ্ধাদেরই চান, ভীরুদের নয়।
এভাবে তিনজন দৌড়ে বাড়ি এল। ছোট দুজন হাসতে হাসতে মা-বাবার সামনে দাদার কীর্তি সব বলে দিল। শুনে সিংহ তো বেজায় খেপা! ভ্রূ কুঁচকে ঠোঁট কাঁপিয়ে দাঁত কটমট করে তিনজনকে যা-তা বলতে লাগল! কারণ সিংহের বাচ্চা হাতি দেখে পালাবে কেন? শেয়ালের বাচ্চার কারণেই এটা হয়েছে। এটাই হচ্ছে তার রাগের কারণ। তার পুত্ররা শেষে শেয়াল না হয়ে যায়। এটাও তার ভাবনা।
অবস্থা বেগতিক দেখে সিংহী শেয়ালের বাচ্চাটাকে ডেকে নিয়ে বলল: বাবা, তুমি কাজটা ভালো করোনি। তুমি এরকম করলে তোমার ভাইদের শিক্ষা হবে কি করে? সিংহের বাচ্চাকে তো সিংহই হতে হবে।
সিংহীর কথা শুনে শেয়ালের বাচ্চা রেগে-মেগে একেবারে টং। সে ক্রোধের সঙ্গে বলল : দেখ, মা! বীরত্বে আমি কি ওদের চেয়ে কম, 7 ওরা আমাকে এভাবে ব্যঙ্গ করল? আমি তো ওদের বাঁচানোর জন্য এটা করেছি। দাঁড়াও, আমি ওদের মারবই মারব। সিংহী তখন বলল: বাছা, তুমি তো তোমার আসল পরিচয় জান না। তাই এমন বলছ। তাহলে শোনো।
এই বলে সে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে শেয়ালের বাচ্চা দমে গেল। সিংহী তখন তাকে বলল: ওরা তোমাকে শেয়াল বলে জানার আগে তুমি স্বজাতের মধ্যে পালিয়ে যাও। নইলে ওদের হাতে তোমারই প্রাণ যাবে।
শেয়াল তখন এক দৌড়ে পালিয়ে গেল।
এরপর রাজা কুমোরের উদ্দেশে বললেন: তাই তুমিও পালাও। তোমার আসল পরিচয় পেলে তোমাকেও ওরা ছাড়বে না।
এই শুনে কুমোর তক্ষুনি পালাল।
রক্তমুখ এবার করালমুখকে বলল: তাই, বুঝলে, মূর্খ যতক্ষণ চুপ থাকে ততক্ষণই ভালো; কথা বললেই ধরা খায়। যেমন—
বাঘের চামড়া পরে গাধা চরছিল বেশ ভালো।
গলার আওয়াজ করেই তাকে প্রাণ দিতে হলো।।
করালমুখ: কিভাবে?
রক্তমুখ: শোনো তাহলে…
ব্যাঘ্রচর্ম গাধা
এক গাঁয়ে থাকত এক ধোপা। নাম শুদ্ধপট। তার ছিল এক গাধা। একেবারে হাড্ডিসার! নড়তে-চড়তেও কষ্ট হয়! হবে না? ধোপা কি আর খাবার দেয়? শুধু মোট বওয়ায়।
একদিন ধোপা বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে পেল এক বাঘের চামড়া। ভাবল: বাঃ, ভালই হলো। এটা গায়ে চড়িয়ে রাতে গাধাটাকে ছেড়ে দেব। যবের ক্ষেত্রে ইচ্ছেমতো ঘুরে—ফিরে খাবে। দূর থেকে বাঘ মনে করে কেউ কাছেই যাবে না। আমারও খরচ কমবে, ওরও চেহারা ভালো হবে। দ্বিগুণ লাভ।
যেই কথা সেই কাজ। ধোপা সন্ধেবেলা চামড়া পরিয়ে গাধাটাকে ছেড়ে দেয়। ভোর হওয়ার আগে আবার নিয়ে আসে। ভয়ে ক্ষেতের প্রহরীরা তার কাছেও যায় না।
এভাবে ছাড়াঘাস খেয়ে গাধা অল্পদিনেই নাদুস-নুদুস হয়ে ওঠে। তাকে সামলানোই দায় হয়ে পড়ে।
একদিন মনের আনন্দে সে কচিকচি যবের ডগা খাচ্ছে। এমন সময় দূরে কোথাও গর্দভীর ডাক শুনে সেও ডেকে উঠল। অমনি পাহারাদাররা বুঝে ফেলল—এ বাঘ নয়, গাধা। তখন চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে ইট পাথর তীর মেরে ওকে মেরে ফেলল। তাই বলছিলাম:
মূর্খের মৌন ভূষণ, পণ্ডিতের বাক্।
অমৌনী মূর্খের কাটা যায় নাক।।
মানে মানে যদি কেউ সরে নাহি যায়।
শ্যামলের মতো সে গলাধাক্কা খায়।।
করালমুখ: সে আবার কি?
রক্তমুখ: তা-ও শুনবে? শোনো তাহলে…
চার জামাই
বিকণ্টক নামে এক নগর ছিল। সেখানে থাকত এক বণিক। নাম ঈশ্বর। যেমন ধনী, তেমন কঞ্জুস।
তার ছিল চার জামাই—গর্গ, সোম, দত্ত, শ্যামল। দুর্গাপূজায় চার জামাই এসেছে শ্বশুর বাড়ি। প্রথম কদিন খুব সমাদর পেয়েছে। নতুন জামা-কাপড়, ছাতা-জুতা। সব! মাছ—মাংস, মিষ্টি-মণ্ডার তো কথাই নেই। খাওয়া, ঘোরা আর ঘুম। আর কোনো কাজ নেই। এই আদর ফেলে কেউ আর নড়তে চাইল না। চারজনই মনে মনে ভাবে, ও গেলে আমি যাব। এই ভেবে কারো আর যাওয়া হয় না।
এদিকে ঈশ্বর তো মহা খেপা! মাথায় তার দাবানল জ্বলছে! মুখে কষ্টের হাসি। জামাই বলে কথা।
একদিন আর সইতে পারল না। স্ত্রীকে ডেকে বলল: একেই বলে জামাই আদর। ছমাস হয়ে গেল। কারো মুখে বাড়ি যাওয়ার নামটি পর্যন্ত নেই! আদর-যত্নে একেবারে বাড়ির কথা ভুলেই গেছে! এখন দেখছি মানে মানে সরবে না। কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এক কাজ করো। আজ খাবার সময় পা ধোয়ার জল দেবে না। তাহলে অপমান বোধ করে চলে যাবে।
তা-ই হলো। পা ধোয়ার জল না পেয়ে অপমানে গর্গ চলে গেল। পরের দিন আসন দিল না। তাতে সোম চলে গেল। তারপরের দিন দিল মোটা চালের ভাত। তাতে গেল দত্ত। শ্যামল ভাবল: ক্ষতি কি? এতদিন চিকন চালের ভাত খেয়েছি। এখন না হয় কদিন মোটা চালই খাই।
এই ভেবে সে থাকতে লাগল। অগত্যা তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হলো। তাই তোমাকেও দেখছি গলা ধাক্কাই দিতে হবে। এমনিতে যাবে না।
রক্তমুখের কথা শুনে করালমুখ বলল: বন্ধু, তুমি আমায় আর একটিবার বিশ্বাস কর। রক্তমুখ: তুমি কি আমাকে ঐ বোকা ছুতোর পেয়েছ? যে—
নিজের চোখে পাপ দেখেও অন্ধ বিশ্বাস করে।
প্রেমিকসহ বৌকে দেয় আদর সোহাগ ভরে।।
করালমুখ: খুলে বলো তো ঘটনাটা!
রক্তমুখ: আচ্ছা, শোনো…
বোকা ছুতোর
এক গাঁয়ে থাকত এক ছুতোর। সাদাসিধে। বৌটি ছিল পরকীয়া।
কাজের উদ্দেশ্যে ছুতোরকে প্রায়ই বাইরে যেতে হতো। ফিরে এসে কানাঘুষো শুনত। একদিন ভাবল: বৌকে পরীক্ষা করবে। আবার ভাবল: করাটা কি ঠিক? নদী, বংশ, সাধু, নারী—এদের ইতিহাস আর কতটা ভালো? নদীর ইতিহাসে দেখা যায়—অতীতে সে কত জনপদ ধ্বংস করেছে। বংশের ইতিহাস আরো বিপজ্জনক। নিষ্কলঙ্ক বংশ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। সাধু-সজ্জন? প্রায়ই দেখা যায় অতীতে কুকর্ম করে পরে সাধু সেজেছে। আর নারী? তার চরিত্র দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যাঃ। আবার ভাবল : পরীক্ষা করে দেখিই না, লোকের কথা কতটা সত্য।
এই ভেবে একদিন সকালবেলা ছুতোর বৌকে বলল: ভিন গাঁয়ে যাব কাজ করতে। কয়েকদিন থাকতে হবে। ভালো কিছু খাবার তৈরি করে দাও তো দেখি।
শুনে বৌ তো মহাখুশি! কথায় বলে—
মেঘলা দিবস আঁধার রাত পতি দূরদেশে।
এমন দিনে মন্দ মেয়ে মহানন্দে ভাসে।।
তাই ছুতোর-বৌ দ্রুত স্বামীকে নানা রকম খাবার তৈরি করে দিল। ছুতোর খাবার নিয়ে বেরিয়ে গেল। তা দেখে বৌয়ের আহ্লাদ আর ধরে না। একদিন নয়, কয়েকদিনের সুযোগ। তাই সে তড়িৎগতিতে সেজেগুজে প্রেমিক দেবদত্তের বাড়ি গেল। বলল: মিনশেটা ভিন গায়ে গেছে। কদিন বাদে আসবে। এ-কদিন বুক ভরে শ্বাস নেব। তুমি কিন্তু আজ রাতে আসবে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে।
তা-ই হলো। দেবদত্ত গভীর রাতে ছুতোরের বাড়ি এল। চলে গেল সোজা অন্দরে। খাটের উপরে। বাধা তো নেই, আছে জোয়ারের আকর্ষণ।
এদিকে ছুতোর সারাদিন বাড়ির পাশে জঙ্গলে কাটিয়ে রাতের অন্ধকারে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল। খাটের উপরে দেবদত্ত। তার প্রতিদ্বন্দ্বী। রাগে ছুতোর গজগজ করতে লাগল। একবার ভাবল: দেই বেটাকে শেষ করে।
আবার ভাবল: না, ঘুমোলে একসঙ্গে দুটোকেই শেষ করব। তাছাড়া দেখা যাক, ওরা কি করে।
এমনি সময় ছুতোর-বৌ এসে খাটে উঠল। ওঠার সময় ছুতোরের গায়ে তার পা লাগল। বৌ মনে করল: এ নিশ্চয়ই মুখপোড়াটা। ভিন গায়ে না গিয়ে আমাকে পরীক্ষা করছে।
তারপর মনে মনে বলল: আমাকে পরীক্ষা? দাঁড়াও, স্ত্রীচরিত্র কি জিনিস তা হতচ্ছাড়াটাকে টের পাওয়াচ্ছি।
এই বলে সে দেবদত্তের উদ্দেশে মিনতি করে বলল: হে মহানুভব, আমার শরীর স্পর্শ করবেন না; করলে অভিশাপে ভস্ম করে ফেলব। আমি সতী-সাধ্বী ছুতোর-স্ত্রী। দেবদত্ত বিস্মিত হয়ে বলল: তাহলে আমায় ডাকলে কেন?
ছুতোর-বৌ: কেন ডেকেছি? শুনুন তাহলে। আজ ভোরবেলা গিয়েছিলাম চণ্ডী দর্শনে। মা দৈববাণীতে বললে: বাছা! তুই আমার সবচে প্রিয়। তাই তো তোর আসন্ন দুঃখে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে!
আমি ভয় পেয়ে বললাম: কিসের দুঃখ, মা?
মা বললে: ছ-মাসের মধ্যে তুই বিধবা হবি!
শুনে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে বললাম: মা, তুমি যেমন ফাঁড়া জান, তেমনি ফাঁড়া কাটানোর উপায়ও জান। বল না, কি করলে আমার স্বামীর শতবর্ষ পরমায়ু হবে?
মা তখন গম্ভীর কণ্ঠে বললে: উপায় তো একটা আছে। কিন্তু সে বড় কঠিন! তুই কি পারবি?
আমি বললাম: স্বামীর চেয়ে বড় আর কি আছে, মা? তুমি বলো। প্রয়োজনে প্রাণ দেব। মা বললে: ‘আজ রাতে যদি কোনো পরপুরুষকে নিয়ে এক বিছানায় ঘুমাতে পারিস, তাহলে তোর স্বামী বাঁচবে। মনে রাখিস, এ হচ্ছে তোর সতীত্বের পরীক্ষা। তোর সতীত্বের জোরেই তোর স্বামীর ফাঁড়া কাটবে।’ হে মহানুভব! এ কারণেই আপনাকে ডেকেছি। দেবতার কথা মিথ্যে হবে না—এ আমার বিশ্বাস।
স্ত্রীর মুখে নিজের মঙ্গল-কামনার কথা শুনে বোকা ছুতোর সব ভুলে গেল। স্ত্রীর পুণ্যে দীর্ঘায়ু লাভ করে তার শরীর রোমাঞ্চিত হলো। সে দ্রুত বের হয়ে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলল: বাঃ! একেই বলে পতিব্রতা! সতী-সাধ্বী! ধন্য আমি! দুষ্টলোকের কথায় আমি তোমায় ভুল বুঝেছিলাম। তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলাম। আমি অধম। তুমি আমায় ক্ষমা করো।
এরপর দেবদত্তকে আলিঙ্গন করে বলল: হে মহানুভব, আপনার কারণে আজ আমি দীর্ঘায়ু লাভ করলাম! আমার স্ত্রীর পুণ্যবলে আপনি এখানে এসেছেন। আপনি আমার দেবতা!
এই বলে বোকা ছুতোর দু-হাতে স্ত্রী আর দেবদত্তের হাত ধরে আনন্দে নাচতে লাগল। আসল ঘটনা কিছুই জানল না।
রক্তমুখ তখন করালমুখকে উদ্দেশ্য করে বলল: আরে মূর্খ, তুই কি আমায় ঐ ছুতোর মনে করছিস? বৌয়ের রঙবদল সে বুঝতে পারেনি, কিন্তু আমি তো তোর রঙবদল দেখেছি। তাই কি করে আবার তোর বাড়ি যাব, বল? তবে তুই যে আমায় পটাবার চেষ্টা করছিস, এ তোর দোষ নয়। তোর জাতের দোষ। জাতের দোষ সৎসঙ্গেও যায় না। শাস্ত্রে আছে না—
স্বভাব না যায় দুষ্ট লোকের যতই সাধু-সঙ্গ ধরে।
যতই ঘষো কয়লা তাহার ময়লা নাহি ত্যাগ করে।।
তাই তো—
সূর্য ঘন বায়ু গিরি কেহই না তার মনে ধরে।
ইঁদুর-কন্যা ইঁদুর পেয়ে মনের সুখে বরে তারে।।
করালমুখ সবিস্ময়ে বলল: তাই নাকি? খুলে বলত!
রক্তমুখ: আর কত বলব? আচ্ছা, শোন…
মুনি-দম্পতি ও ইঁদুর-কন্যা
এক তপোবনে থাকতেন এক মুনি। নাম শালঙ্কায়ন। তিনি একদিন চান করতে গেছেন গঙ্গায়। চান সেরে সূর্যপ্রণাম করছেন। এমন সময় দেখেন এক বাজ ছোঁ মেরে এক ইঁদুরীকে নিয়ে যাচ্ছে। ধারালো নখের আঘাতে ইঁদুরী ব্যথায় কোঁ-কোঁ করছে।
ঐ দৃশ্য দেখে মুনির মনটা করুণার্দ্র হয়ে উঠল। তিনি বাজকে লক্ষ্য করে বললেন: ছেড়ে দে, ছেড়ে দে বলছি!
কিন্তু বাজটা উড়েই চলল। মুনি তখন একখণ্ড পাথর ছুঁড়ে মারলেন ওর দিকে। পাথরের চোটে অবশ হয়ে বাজটা মাটিতে পড়ে গেল। আর ইঁদুরীটা ছিটকে পড়ল দূরে। ইঁদুরী কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে মুনির পায়ে আশ্রয় নিল। এদিকে বাজটা জ্ঞান ফিরে পেয়ে মুনিকে বলল: আপনি আমায় মারলেন কেন? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি।
মুনি: প্রাণিহত্যা মহাপাপ! তুই জানিস না?
বাজ: কিন্তু ও তো আমার খাদ্য। আমার খাদ্য কেড়ে নিয়ে আপনি অন্যায় করেছেন। এটা অধৰ্ম।
মুনি: আরে বিহগাধম! তুই আমায় ধর্মাধর্ম শেখাচ্ছিস? শোন—প্রাণীর প্রাণ রক্ষা করাই ধর্ম। দুষ্টকে শাস্তি দেয়াই ধর্ম। সজ্জন ও গুরুজনদের সেবা করাই ধর্ম। আর সবই অধর্ম।
বাজ: আপনি তো ধর্মের মূল তত্ত্বই জানেন না। যে-বিধাতা আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাদের আহারও দিয়েছেন। এই যেমন আপনাদের অন্ন, তেমনি আমাদের ইঁদুর-টিদুর ইত্যাদি।
মুনি: কিন্তু খাওয়ার নামে প্রাণিহত্যা অন্যায়।
বাজ: আপনি কি মাৎস্যন্যায়ের কথা শুনেছেন? নদীতে বড়মাছ ছোটমাছকে খেয়ে বাঁচে? একেই বলে মাৎস্যন্যায়। এতে কোনো দোষ নেই। আমিও তো খাওয়ার জন্যই ওকে ধরেছি। তাহলে আমার দোষ কোথায়? যার যা খাদ্য তা খেলে দোষ হয়না। অখাদ্য খেলেই দোষ। যেমন ব্রাহ্মণের সুরাপান। তাছাড়া শাস্ত্রেই তো আছে—
অভক্ষ্য করিলে ভক্ষণ যত দোষ হয়।
ভক্ষ্য করিলে ভক্ষণ তত গুণ হয়।।
তাছাড়া আপনি তো মুনি। আপনার তো এসব দেখার কথা নয়। মুনিরা কিছু দেখে ও দেখেন না, শুনেও শোনেন না। তাঁরা হন নির্লোভ। তাঁদের কোনো শত্রু-মিত্র নেই। পাপী-তাপী, সুজন-দুর্জন, শত্রু-মিত্র সকলকে তাঁরা সমান দেখেন। সোনা আর মাটি তাঁদের কাছে সমান। তাঁরা শুধু নির্জনে বসে ধ্যান করেন। বিষয়াসক্তিতে তাঁদের তপোভঙ্গ হয়। আপনার তপোভঙ্গ হয়েছে, যেমন হয়েছিল দুই মুনিভ্রাতার।
মুনি: কি রকম?
বাজ: শুনুন তাহলে…
মুনিত্রয়
যমুনার তীরে ছিল এক তপোবন। সেখানে থাকতেন তিন মুনি। তাঁরা তিন ভাই। তাঁরা দিনরাত তপস্যা করতেন। তাঁদের তপস্যার প্রভাব ছিল অবিশ্বাস্য। স্নান করে ভিজে কাপড় তাঁরা শূন্যেই মেলে দিতেন। তপস্যার প্রভাবে তা মাটিতে পড়ত না।
একদিন তাঁরা স্নান সেরে যাঁর যাঁর কাপড় মেলে দিয়েছেন। এমন সময় এক শকুন এক ব্যাঙীকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছিল। তা দেখে প্রথমজন বলে উঠলেন, ‘ছাড় ছাড়’। অমনি তাঁর ভাসমান কাপড় মাটিতে পড়ে গেল। এ ঘটনায় ভয় পেয়ে দ্বিতীয়জন বললেন, ‘ছাড়িসনে ছাড়িসনে’। তাঁরও কাপড় পড়ে গেল। কনিষ্ঠজন এসব দেখে নীরব রইলেন। তাঁর কাপড় যথাস্থানেই রইল। তাই বলছিলাম: মুনিদের কোনো কিছুতে আসক্ত হতে নেই।
শালঙ্কায়ন এবার হেসে বললেন: আরে মূর্খ! এ-ধর্ম ছিল সত্যযুগে। তখন পাপীর সঙ্গে কথা বললেও পাপ হতো। তাই মুনিদ্বয়ের কাপড় পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এটা কলিযুগ।
এযুগে নিজে না করলে পাপ তার লাগে না। কাজেই আর বকবক না করে সরে পড়। নইলে শাপ দেব।
শাপের ভয়ে বাজটা এবার চলে গেল। ইঁদুরী তখন করজোড়ে মুনিকে বলল: ভগবন্! আমায় রক্ষা করুন। এযাত্রা বেঁচে গেলেও অন্য কেউ আমায় খেয়ে ফেলবে। তার চেয়ে আমায় আপনার বাড়ি নিয়ে চলুন। আপনাদের উচ্ছিষ্ট পেলেই আমার চলবে।
মুনির দয়া হলো। তিনি স্থির করলেন ওকে বাড়ি নিয়ে যাবেন। কিন্তু একটা ইঁদুরছানা হাতে করে নেবেন কি করে? তাই ইঁদুরটাকে তপোবলে ছোট্ট মেয়ে করে দিলেন। বাড়ি পৌঁছে স্ত্রীর হাতে তাকে তুলে দিলেন।
স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন: ঠাকুর, একে কোথায় পেলেন?
মুনি তখন সব ঘটনা খুলে বললেন। এ-ও বললেন: বড় হলে আবার ওকে ইঁদুর করে দেব।
স্ত্রী ‘না-না’ করে উঠলেন। করুণ কণ্ঠে বললেন: ঠাকুর, আমাদের কোনো সন্তান নেই। তাছাড়া আপনি ওর প্রাণ রক্ষা করেছেন। তাই এক অর্থে আপনি ওর পিতাও। শাস্ত্রে আছে না: জন্মদাতা, দীক্ষাদাতা, বিদ্যাদাতা, অন্নদাতা আর আশ্রয়দাতা—এই পাঁচজনই পিতৃতুল্য। কাজেই ও আমার মেয়ে হয়েই থাকবে।
তা-ই হলো। ইঁদুরী মুনিকন্যা হয়ে চন্দ্রকলার ন্যায় দিনে দিনে বাড়তে লাগল। এক সময় পূর্ণিমার জোয়ারের মতো যৌবন তার দেহ-মনে প্রকাশ পেল। মুনি তখন পত্নীকে ডেকে বললেন: আর তো দেরি করা যায় না। শাস্ত্রে আছে: যার ঘরে অনূঢ়া কন্যা যৌবনবতী হয়, তার পিতৃপুরুষগণ অধঃপতিত হন। কাজেই যথাশীঘ্র একে পাত্রস্থ করা প্রয়োজন।
মুনিপত্নী: তা ঠিক। তবে এক্ষেত্রে বিবেচনার প্রয়োজন আছে।
মুনিঃ অবশ্যই। বিজ্ঞরা বলেন: বংশ, চরিত্র, গুরুজন, বিদ্যা, অর্থ, চেহারা, বয়স—এই সাতটি বিষয় যাচাই করে তবে পাত্র নির্বাচন করা উচিত। তার পরে যা হবে তার ওপর কারো হাত নেই। প্রবাসী, অবিদ্বান, মোক্ষকামী, দুঃসাহসী এবং দরিদ্র—এমন পাত্রের হাতে বিজ্ঞরা কন্যাদান করেন না। তবে পাত্রটি সুশ্রী হওয়া চাই, কারণ—
কন্যা কাময়তে রূপং মাতা বিত্তং পিতা শ্রৌতম্।
বান্ধবা কুলমিচ্ছন্তি মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ।।
অর্থাৎ, বিয়ের ক্ষেত্রে মাতা অর্থ, পিতা খ্যাতি, স্বজনেরা বংশ এবং অন্যরা উত্তম ভোজ চাইলেও, কন্যা চায় পাত্রের সুন্দর চেহারা। কাজেই বিয়ের ব্যাপারে কন্যার মতামত একান্ত জরুরি।
মুনিপত্নী: এতে আর দোষ কি? তা-ই করুন।
মুনি তখন সূর্যদেবকে আহ্বান করে বললেন: দেব, এ আমার কন্যা। যদি পছন্দ হয় তাহলে একে গ্রহণ করুন।
কন্যাকে বললেন: মা, ইনি সূর্যদেব। তিন ভুবন আলো করেন। তোমার কি এঁকে পছন্দ?
মেয়ে বলল: পিত, এঁর তেজ বেশি। সবাইকে জ্বালান-পোড়ান। আমি এঁকে চাইনা। আপনি এঁর চেয়ে ভালো কাউকে আনুন।
মুনি তখন সূর্যদেবকে বললেন: দেব, আপনিই বলুন, পাত্র হিসেবে অপনার চেয়ে ভালো কে?
সূর্য: আমার চেয়ে ভালো ঘন, অর্থাৎ মেঘ। সে ঢেকে ফেললে আমায় কেউ দেখে না।
মুনি তখন মেঘকে ডেকে সব বললেন। কিন্তু মেয়ে বলল: এঁর বর্ণ কালো। আপনি এঁর চেয়ে বড় কাউকে আনুন।
মুনি তখন মেঘকে বললেন: দেব, দয়া করে বলুন, আপনার চেয়ে বড় কে?
মেঘ সহাস্যে বলল: ভগবন, বায়ু আমার চেয়ে বড়। সে আমাকে ইচ্ছেমতো উড়িয়ে নিয়ে যায়।
মুনি তখন বায়ুদেবকে আহ্বান করে সানুনয়ে বললেন: দেব, এ আমার কন্যা। দয়া করে আপনি একে গ্রহণ করুন।
কিন্তু মেয়ে বলল: পিত, এঁ শক্তিশালী বটে, তবে বড়ই চঞ্চল। আপনি এঁর চেয়ে ও শক্তিশালী কারো হাতে আমায় দান করুন।
মুনি তখন বায়ুকে বললেন: ভগবন্, আমার আপরাধ নেবেন না। আমি কন্যাদায়গ্রস্ত। অনুগ্রহ করে বলুন আপনার চেয়ে বলবান কে?
বায়ু বলল: আমার চেয়ে বলবান গিরি, অর্থাৎ পর্বত। কারণ সে আমাকে আটকে রাখে। মুনি তখন পাহাড়ের কাছে গিয়ে বললেন: গিরিরাজ, আপনি আমার মেয়েকে গ্রহণ করুন।
কিন্তু মেয়ে বলল: পিত, এঁ তো স্থবির। নড়েও না, চড়েও না। এঁর সঙ্গে আমার জীবন চলবে কি করে? আপনি এঁর চেয়েও বড় কাউকে খুঁজুন।
মুনি: গিরিরাজ, আপনার চেয়ে বলবান কি কেউ আছে?
গিরি: অবশ্যই। সে ইঁদুর। সে ইচ্ছেমতো আমায় ছিদ্র করে বাসা বানায়। আমি কিছুই করতে পারি না।
মুনি তখন ইঁদুররাজকে ডেকে বললেন: মা, দেখো তো, একে তোমার পছন্দ কি-না? মেয়ে তাকে দেখে বুঝল ‘এ আমার জাতের লোক’। তাই আনন্দে তার সর্বাঙ্গ নেচে উঠল। সে বলল: পিত, এ-ই আমার পছন্দ। আপনি এর হাতেই আমায় সমৰ্পণ করুন।
মুনি তখন তাকে ইঁদুরী করে ইঁদুরের হাতে সমর্পণ করলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন—
সোনা-দানা-মণি-মুক্তা কি-বা তার দর।
বিবাহেতে মেয়ে চায় মনমতো বর।।
রক্তমুখ এবার করালমুখের উদ্দেশে বলল: এই ইঁদুরী যেমন মানুষের ভালোবাসা পেয়েও, বড়বড় দেবতাদের স্বামী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ পেয়েও স্বজাতিকে ভুলতে পারেনি, তুইও তেমনি তোর স্বজাতিকে ভুলতে পারিসনি। তাই তোকে আর বিশ্বাস কি? অবশ্য তোকেই বা কি বলব? যারা মূর্খ, স্ত্রৈণ, তারা বৌয়ের কথায় আত্মীয়—বন্ধুকেও মারতে দ্বিধা করে না। তারা সবকিছুর বিনিময়ে বৌয়েরই আলিঙ্গন কামনা করে, যেমন করেছিল ঐ বৃদ্ধবণিক।
করালমুখ: কি সে ঘটনা? খুলে বলো না।
রক্তমুখ: আচ্ছা, বলছি…
বৃদ্ধবণিক ও চোর
এক নগরে থাকত এক বৃদ্ধবণিক। তার সব ছিল, শুধু সুখ ছিলনা। স্ত্রী গত হয়েছে। ছেলে-মেয়েরা তত্ত্ব নেয় না। তাই অসহায়ের মতো জীবন কাটত।
একদিন গাঁয়ের এক কচি মেয়েকে বিয়ে করে আনল। বিয়ে তো নয়, বেচা-কেনা। একে তো বয়সের ফারাক, তায় আবার শ্রীহীন। তাই নববধূ স্বামীর দিকে তাকাতো পর্যন্ত না। রাতের বেলা দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকত। এতে বণিকের কষ্ট আরো বেড়ে গেল। নববধূর আলিঙ্গনের জন্য মনটা ছটফট করত। কিন্তু জোর তো চলে না।
একদিন রাতের বেলা অন্যদিনের মতোই দুজন শুয়ে আছে। হঠাৎ স্ত্রী বণিককে জড়িয়ে ধরল। তার স্পর্শে বৃদ্ধবণিকেরও সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হলো। বণিক তো অবাক! কারণ কি? তারপর ভালো করে তাকিয়ে দেখল—ঘরের কোণে এক চোর লুকিয়ে আছে। তখন বণিক ভাবল: নিশ্চয়ই চোরের ভয়ে এ আমায় জড়িয়ে ধরেছে। আঃ! কি শান্তি চোরকে ধন্যবাদ। ও যা আমায় দিল, তার বিনিময়ে সব নিয়ে নিক।
এই ভেবে বণিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, চোর যা পারে ব্যাগ ভরে নিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার উদ্দেশে বণিক বলল: ভাই, তুমি রোজ এস। তুমি যা দিলে, তার বিনিময়ে আমার সব নিয়ে যেও। ওসব তোমারই।
এই বলে রক্তমুখ করালমুখকে বলল: ওরে মকর, ঐ বৃদ্ধবণিক যেমন বৌয়ের কারণে তার অর্জিত সম্পদ সব দিয়ে দিল, তুইও তেমনি বৌয়ের কারণে আমার মতো বন্ধুকে হারালি। কাজেই তোকে আর বিশ্বাস নয়। এক্ষুণি কেটে পড়।
এমন সময় এক জলচর এসে করালমুখকে বলল: ওহে মকর, তোর বৌ উপোস করে বসেছিল। তোর দেরি দেখে সে আত্মহত্যা করেছে।
এ-কথা শুনে করালমুখ বিলাপ করতে করতে বলল: হায়! হায়! এ কি হলো আমার? আমি এখন কাকে নিয়ে বাঁচব?
শুধু ঘর ঘর নয় ঘরণীই ঘর।
ঘরণীবিহীন ঘর অরণ্যের পরা।।
সাথে যদি থাকে প্রিয়া গাছতলা ঘর।
না থাকিলে রাজবাড়ি সে-ও হয় পরা।।
যার ঘরে স্নেহময়ী মা নেই, মিষ্টভাষী স্ত্রী নেই, তার কাছে ঘর আর অরণ্য সমান সুতরাং আমায় ক্ষমা করো বন্ধু, আমি চললুম।
করালমুখের বিলাপ শুনে রক্তমুখ বলল: ওরে মূর্খ! শোন। পণ্ডিতেরা বলেন: দুষ্ট নারীর মুখে থাকে মিষ্টি, অন্তরে থাকে বিষ। তাদের মনে এক, মুখে আর। এমন নারীর প্রেমে যারা পড়ে, তারা পতঙ্গের ন্যায় পুড়ে মরে। কাজেই দুষ্ট স্ত্রীর জন্য কেন শোক করছিস? বরং আনন্দ কর।
করালমুখ: বন্ধু, সে না হয় হলো, কিন্তু এক সঙ্গে দু-দুটো শোক আমি সইব কি করে? একদিকে তোমার মতো বন্ধুকে হারালাম, অন্যদিকে স্ত্রী-ও গেল। অথবা, দৈব যারে মারে তার এমনটাই হয়। তাইতো—
একের গেল স্বামী টাকা প্রেম হলো না।
অন্যের গেল মাছ মাংস কিছুই পেল না॥
রক্তমুখ: সে কি রকম?
করালমুখ: শোনো বলছি…
তাঁতিবৌ ও শেয়ালনি
এক গাঁয়ে থাকত এক তাঁতি আর তার বৌ। স্বামী বুড়ো বলে বৌটি আনমনা। বাড়িতে মন টেকে না। খালি পরপুরুষের প্রতি দৃষ্টি।
একদিন এক চোর এল বাড়িতে। তার চোখে আর কিছুই পড়ল না, পড়ল শুধু তাঁতিবৌয়ের দৃষ্টি। কাছে গিয়ে প্রেম নিবেদন করল।
চোর হলে কি হবে? বয়সে নবীন। তাগড়া জোয়ান। তাই দশ পা এগিয়ে তাঁতিবৌ বলল: আমার স্বামীর অনেক টাকা। কিন্তু মনটা খালি। সুতরাং টাকাটা নিয়ে আসি। তারপর চলে যাব বহুদূরে।
চোর তো হাতে স্বর্গ পেল। কড়ি ও নারী এক সঙ্গে! সে বলল: তবে তা-ই হোক। কাকভোরে ঐখানে চলে এস। তারপর দুজনে চলে যাব অচিন দেশে। ভোগ করব অনন্ত সুখ।
তাঁতিবৌও ‘আচ্ছা’ বলে নাচতে-নাচতে ঘরে এল। তারপর স্বামীর সব টাকা-পয়সা নিয়ে কাকভোরে চলে গেল সেই সঙ্কেত স্থানে। চোর আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিল। তারপর দুজনে চলল দক্ষিণের পানে।
যেতে-যেতে চোর আপন মনে ভাবছে: পরের বৌ, তায় আবার যৌবন যায়-যায়। এ নিয়ে কি করব? তাছাড়া কেউ দেখে ফেললে বিপদ। এর খোঁজে লোকও আসতে পারে। তাই কৌশলে টাকাটা নিয়ে পিঠটান দেয়াই ভালো।
এমন সময় সামনে পড়ল এক নদী। খরস্রোতা। চোর বলল: প্রিয়ে, ভয়াল নদী! পার হওয়া কঠিন। এক কাজ করি, টাকার থলিটা আগে ওপাড়ে রেখে আসি। তারপর তোমাকে পিঠে করে পার করব। একবার নদী পার হতে পারলে আর পায় কে? তারপর তুমি আর আমি।
তাঁতিবৌ অনন্ত বিশ্বাসে বলল: তাই করো।
এই বলে সে টাকার থলিটা চোরের হাতে তুলে দিল। চোর দুই পা এগিয়ে আবার ফিরে এসে বলল: তোমার পরনের কাপড়টাও দাও। তাহলে স্রোতের মধ্যে নির্বিঘ্নে যেতে পারবে।
তাঁতিবৌ কাপড় খুলে চোরের হাতে দিল। চোর নদী পার হয়ে চলে গেল। একবার ফিরেও তাকাল না। বোকা তাঁতিবৌ তখন মাথায় হাত দিয়ে এপাড়ে পড়ে রইল।
এমন সময় সেখানে এল এক শেয়ালনি। মুখে এক টুকরো মাংস। অল্প দূরেই এক বিশাল মাছ লাফ দিয়ে পাড়ে উঠে এল। তা দেখে শেয়ালনি মাংস ফেলে যেই মাছটাকে ধরতে গেল, অমনি আকাশ থেকে এক শকুন এসে তা নিয়ে গেল। ওদিকে শেয়ালনিকে আসতে দেখে মাছটাও জলে ঢুকে পড়ল। শেয়ালনি তখন মনের দুঃখে একবার শকুনের দিকে, আরেকবার জলের দিকে তাকাতে লাগল। এই দৃশ্য দেখে তাঁতিবৌ শেয়ালনির উদ্দেশে মুচকি হেসে বলল:
মাছ গেল মাংস গেল, ও শেয়ালের ঝি!
বুদ্ধিদোষে সব হারিয়ে ভাবছ এখন কি??
তাঁতিবৌয়ের টিটকারি শুনে শেয়ালনি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। তাকে বস্ত্রহীন দেখে সে ফোড়ন কেটে বলল:
আমার না হয় খাদ্য গেছে, লজ্জাহীনা নারী—
স্বামী সম্পদ প্রেমিক খুইয়ে বড়াই করছ ভারি!!
করালমুখ এবং রক্তমুখ যখন এসব কথাবার্তা বলছে, তখন আরেক জলচর এসে করালমুখকে বলল: সর্বনাশ হয়েছে! মস্ত এক মকর এসে তোমার বাড়িঘর দখল করে নিয়েছে।
এ-কথা শুনে করালমুখ বিলাপ করতে করতে বলল: একে-একে আমার সব গেল! স্ত্রী গেল, বন্ধু গেল, বাড়িটাও গেল! এখন আমি কি করি? বিধাতা সর্বতোভাবেই আমার প্রতি বিমুখ! পাঁকে পড়লে পাঁক যেমন চারদিক থেকে ঘিরে ধরে, বিপদও আমাকে তেমনিভাবে ঘিরে ধরেছে। এই শত্রুকে এখন বাড়ি থেকে কি করে তাড়াব? সাম, দান, ভেদ, দণ্ড—কোন নীতি অবলম্বন করব? কে আমাকে সৎ পরামর্শ দেবে?
কিছুক্ষণ চিন্তা করে মনে-মনে বলল: বিপদে বিজ্ঞজনের পরামর্শ নেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আমার বানরবন্ধু যে একজন বিজ্ঞ, তা এতদিনে বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি। তাই তাকেই জিজ্ঞেস করি এখন কি করণীয়। এই বলে সে রক্তমুখকে বলল: বন্ধু, আমার মহাবিপদ! এক শক্তিশালী মকর আমার বাড়ি দখল করে নিয়েছে। এখন কি করি? একটা বুদ্ধি দাও না।
রক্তমুখ ভেংচি কেটে বলল: ওরে কৃতঘ্ন! তুই এখনো কেন আমার পেছনে লেগে আছিস? তুই চলে যা। তুই একটা মূর্খ। মূর্খকে কখনো জ্ঞান দিতে নেই। তাইতো শাস্ত্র বলছে:
যাকে তাকে দিলে জ্ঞান আপনার ক্ষতি।
চড়ুইয়ের বাসা ভাঙে বানর দুর্মতি।।
করালমুখ: কি রকম?
রক্তমুখ: শোন তাহলে …
চড়ুই ও বানর
বনের ধারে ছিল এক বড় বটগাছ। তার ডালে বাসা বেঁধে থাকত এক চড়ুই দম্পতি। তখন মাঘমাস। হাঁড় কাঁপুনে শীত। তার মধ্যে হঠাৎ এল বৃষ্টি। একটা বানর বিড়াল হয়ে এল ঐ গাছের নিচে। দাঁতে দাঁত ঠকঠক করছে। তা দেখে চড়ুইয়ের দয়া হলো। সে বলল:
হাত আছে পা আছে—দেখতে মানব-হেন।
জলে ভেজো রোদে পোড়ো—ঘর বাঁধ না কেন?
শুনে বানর অবজ্ঞার হাসি হেসে বলল : আত্মগর্বে কে না গর্বিত হয়? এই সামান্য চড়ুইও আমাকে উপদেশ দেয়। প্রকাশ্যে চড়ুইয়ের উদ্দেশে বলল: নিজেকে খুব পণ্ডিত মনে করিস? বাঁচতে চাস তো চুপ থাক। নইলে সব ভেঙেচুরে দেব।
চড়ুই পুনরায় বিজ্ঞের ন্যায় বলল: রাগ করো কেন? তোমার ভালোর জন্যই তো বললাম।
চড়ুইয়ের এই অযাচিত উপদেশে বানর ক্ষুব্ধ হয়ে বলল: বৃষ্টি থামুক। দেখাচ্ছি মজা! এরপর বৃষ্টি থামলে বানর গাছে উঠে চড়ুইয়ের বাসা ভেঙে তচনচ করে দিল। রক্তমুখ এবার করালমুখের উদ্দেশে বলল: তাই মূর্খকে কোনো উপদেশ দিতে নেই।
করালমুখ এবার কাতর সুরে বলল: ভাই, আমি অপরাধ করেছি। তারপরেও বলছি পূর্বের ভালোবাসা স্মরণ করে আমার এই উপকারটুকু করো।
রক্তমুখ: কোন বিশ্বাসে করব? স্ত্রীর কথায় তুই আমায় মারতে চেয়েছিলি। তখন বন্ধুর উপকারের কথা মনে পড়েছিল? স্ত্রী সবার প্রিয়, মানলাম, কিন্তু তার কথায় বন্ধুকে যে মারতে চায়, তার মতো মূর্খ দ্বিতীয়টি নেই। আরে অধম! স্ত্রীলোককে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে নেই, কারণ—
যার জন্য ছাড়ে কুল আত্ম-পরিজন,
টাকা-পয়সা ধন-দৌলত অর্ধেক জীবন।
পঙ্গুকে সে দেয় তার জীবন-যৌবন
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে তাই বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণ॥
করালমুখ বিস্ময়ের সঙ্গে বলল: কি সে ঘটনা, খুলে বল?
রক্তমুখ: শোন ..
ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী ও পঙ্গু
এক নগরে থাকতেন এক ব্রাহ্মণ। বয়স হয়েছে। শেষ পক্ষের স্ত্রীটি যুবতী—যাকে বলে বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা। তাই মনটা চঞ্চল। কিন্তু ব্রাহ্মণ প্রাণের চেয়েও ভালোবাসেন তাকে।
ব্রাহ্মণী শ্বশুর বাড়ির কাউকেই একদম সহ্য করতে পারত না। রাতদিন ঝগড়া লেগেই থাকত। তাই ব্রাহ্মণ একদিন আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন দূরদেশে। পথে যেতে-যেতে ব্রাহ্মণী তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ল। প্রাণ যেন যায়-যায়। স্বামীকে বলল জল আনতে। স্ত্রীকে গাছের নিচে বসিয়ে ব্রাহ্মণ গেলেন জল আনতে। কিন্তু এসে দেখেন স্ত্রী আর বেঁচে নেই। ব্রাহ্মণ করুণ সুরে বিলাপ করতে লাগলেন।
এমন সময় এক দৈববাণী হলো। বৃক্ষদেবী তাঁর উদ্দেশে বললেন: তুমি যদি তোমার পরমায়ুর অর্ধেক দাও, তাহলে তোমার স্ত্রী বেঁচে যাবে।
দৈববাণী শুনে ব্রাহ্মণ শুচিশুদ্ধ হয়ে তিন সত্য উচ্চারণ করে তাঁর আয়ুর অর্ধেক স্ত্রীকে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে ব্রাহ্মণী প্রাণ ফিরে পেল। এরপর দুজন জল খেয়ে, বনের ফল খেয়ে পথ চলতে লাগলেন।
কিছুদূর যাওয়ার পর এক নগর পড়ল। নগরে ঢুকতেই এক বাগান। নানা রঙের ফুলে সুশোভিত। গন্ধে ম-ম করছে। সেখানে ঢুকে ব্রাহ্মণ স্ত্রীকে বললেন: তুমি এখানে একটু বস। আমি নগরে গিয়ে কিছু খাবার নিয়ে আসি।
এই বলে তিনি নগরে চলে গেলেন।
বাগানে জল দেয়ার জন্য ছিল একটি জলচাকা। সেটা ঘোরাত এক সুদর্শন পঙ্গু। বয়সে নবীন। বিধাতা তার পা দেননি বটে, কিন্তু কণ্ঠে দিয়েছেন মধু। তাই সে স্বর্গীয় গলায় গান গাইছিল। গান শুনে ব্রাহ্মণী তার দিকে তাকিয়েই শরাহত হলো। কাছে গিয়ে বলল: ভদ্র! তুমি আমায় ভালোবাসো। নইলে আমি আত্মহত্যা করব। তুমি নারীহত্যার অপরাধে অপরাধী হবে।
পঙ্গু হতবাক! বলল: কল্যাণী! আমি অঙ্গহীন। আমায় নিয়ে তুমি কি করবে? ব্রাহ্মণী: সে আমি বুঝব। তোমাকে আমার চাই-ই!
অগত্যা পঙ্গু রাজি হলো এবং ব্রাহ্মণী বলল: আজ থেকে আমার সব তোমায় দিলাম। তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো।
পঙ্গু বলল: বেশ।
খানিক পরে ব্রাহ্মণ ফিরে এসে দুজনে খাবার খেতে লাগলেন। তখন ব্রাহ্মণী বলল: এই পঙ্গু লোকটা ক্ষুধার্ত। একেও কিছু দাও।
ব্রাহ্মণ তাই দিলেন। তারপর ব্রাহ্মণী বলল: তোমার কোনো সঙ্গী নেই। তুমি ভিন গাঁয়ে গেলে আমি কথা বলার লোক পাইনে। একে সঙ্গে নিলে আমার সময় কাটবে। ব্রাহ্মণ: তুমি নিজেই চলতে পারনা, একে নেবে কি করে?
ব্রাহ্মণী: এই প্যাটরার মধ্যে করে নিয়ে যাব। সে তুমি ভেবো না।
বৌপ্রেমী ব্রাহ্মণ স্ত্রীর কথা মেনে নিলেন। এরপর তিনজন চলতে লাগলেন। কিছুদূর গিয়ে তারা এক নির্জন কুয়োর পাড়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এক সময় পেছন থেকে ব্রাহ্মণী ধাক্কা মেরে ব্রাহ্মণকে ফেলে দিল কুয়োর মধ্যে। তারপর পঙ্গুকে নিয়ে সে চলতে লাগল। ঘণ্টা দুয়েক হাটার পর তারা এক নগরে গিয়ে ঢুকল।
নগর-রক্ষীরা ব্রাহ্মণীকে ব্যবসায়িনী মনে করে শুল্কফাঁকির অভিযোগে আটক করল। ব্রাহ্মণী প্যাটরা খুলতে রাজি না হওয়ায় তাকে নিয়ে গেল রাজার কাছে। রাজা প্যাঁটরা খুলে দেখেন পঙ্গু। ব্রাহ্মণী তখন বলল: এ আমার স্বামী। জ্ঞাতিরা একে সইতে পারে না। তাই আমরা রাজ্য ছেড়ে চলে এসেছি।
রাজার খুব দয়া হলো। তিনি বললেন: তোমাদের যতদিন খুশি এখানে থাক। ইচ্ছে হলে সারাজীবনও। তোমাদের কেউ জ্বালাবে না।
এদিকে এক সন্ন্যাসীর দয়ায় ব্রাহ্মণ কুয়ো থেকে বেরিয়ে আসেন। তারপর ঘুরতে ঘুরতে সেই রাজবাড়ি এসে উপস্থিত হন। তাকে দেখে ব্রাহ্মণী রাজাকে বলল: মহারাজ, এ-ই আমাদের শত্রু। সম্পত্তির লোভে আমার স্বামীকে হত্যা করতে চায়।
ব্রাহ্মণীর কথা শুনে রাজা ব্রাহ্মণকে বললেন: তোমার কোনো বক্তব্য আছে?
ব্রাহ্মণ ভাবলেন: এখানে সবই আমার প্রতিকূল। আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে এমন কেউ নেই। ধূর্ত স্ত্রীলোক সবাইকে বশ করে রেখেছে। তাই আত্মপক্ষ সমর্থন করে কোনো লাভ নেই। এসব ভেবে তিনি বললেন: মহারাজ, আমার কোনো বক্তব্য নেই। তবে আমার একটি একান্ত ব্যক্তিগত জিনিস ওর কাছে আছে। আপনি যদি ধার্মিক হন, তাহলে সেটি ওকে ফেরত দিতে বলুন।
রাজা ব্রাহ্মণীকে বললেন: ভদ্রে, তুমি আমার বোনের মতো। তোমার কিছুর অভাব নেই। তাই ওর জিনিস ওকে ফিরিয়ে দাও। মরার আগে ওর আশা পূরণ কর। ব্রাহ্মণী বলল: মহারাজ, আমি ওর কিছুই নেইনি।
ব্রাহ্মণ তখন অবজ্ঞার হাসি হেসে বললেন: তোমাকে যে আমি তিন সত্য করে আমার অর্ধেক আয়ু দিয়েছিলাম, তা ফেরত দাও।
তখন রাজার ভয়ে তিন সত্য করে ‘জীবন দিলাম’ বলার সঙ্গে-সঙ্গেই ব্রাহ্মণীর মৃত্যু হলো। রাজাসহ সবাই বিস্মিত হয়ে বললেন: একি কাণ্ড! ব্রাহ্মণ তখন আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন।
রক্তমুখ এবার করালমুখকে বলল: তাই বলছিলুম, স্ত্রৈণ পুরুষদের মেরুদণ্ড থাকেনা। তারা বৌয়ের কাঁধে ভর দিয়ে হাটে, যেমন হাটত নন্দ ও বররুচি।
করালমুখ: কি রকম?
রক্তমুখ: এরকম…
নন্দ ও বররুচি
প্রাচীন ভারতে নন্দ নামে এক রাজা ছিলেন। যেমন ছিল তাঁর শক্তি, তেমন ছিল পরাক্রম। প্রণত রাজাদের মুকুটমণির কিরণে জ্বলজ্বল করত তাঁর পদযুগল। শরৎচন্দ্রের কিরণের মতো নির্মল ছিল তাঁর যশ-খ্যাতি। তাঁর মন্ত্রী ছিলেন বররুচি। সর্বশাস্ত্রে নিষ্ণাত।
রাজা ও মন্ত্রী স্ব-স্ব স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। মন্ত্রীর স্ত্রী একদিন মান করেছেন। অনেক চেষ্টায়ও মান ভাঙছে না। মন্ত্রী তখন উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন: ভদ্রে, কিসে তোমার মান ভাঙবে, বল না। কথা দিচ্ছি, তা-ই করব।
স্ত্রী মুখখানা পেঁচার মতো করে নাকিয়ে নাকিয়ে বললেন: যদি মাথা মুড়িয়ে আমার পায়ে পড়, তবে মুখ তুলে চাইব।
বররুচি তাই করলেন এবং স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটল।
এদিকে রাজমহিষী একদিন গোঁসা করে বসে আছেন। খানও না, কথাও বলেন না। অনেক সাধাসাধিতেও নয়। রাজার রাজকার্য চুলোয় উঠেছে। তিনি স্ত্রীর হাত ধরে বললেন: ভদ্রে, তোমার কিসের কষ্ট, আমায় বলো। তোমায় ছাড়া আমার এক মুহূর্তও চলে না। তোমার পায়ে পড়ছি। প্রসন্ন হও।
অনেক সাধাসাধির পরে রানী বললেন: আমার একটা সখই বাকি আছে। সেটা মিটলেই হাসব।
রাজা দুহাত ধরে বললেন: তোমার বলতে যত সময়, আমার করতে তার অর্ধেকও লাগবে না। তুমি শুধু বলো।
রানী: ঘোড়ায় চড়ব।
রাজা সঙ্গে-সঙ্গে হাঁক দিলেন: কে আছিস …?
রানী তাঁকে বারণ করে বললেন: না-না, চতুষ্পদ নয়, দ্বিপদ।
রাজা স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রানী তখন বুঝিয়ে বললেন: তুমি ঘোড়ার মতো ছুটবে, আর আমি তোমার পিঠে চড়ে লাগাম টেনে ধরব। তুমি চিঁহিঁ চিঁহি করে ডাকবে।
রাজা তা-ই করলেন এবং রানীর মান ভাঙল।
পরের দিন সকালবেলা। রাজসভায় সবাই উপস্থিত। সবার দৃষ্টি রাজা ও মন্ত্রীর দিকে। কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলছে না। এক সময় নীরবতা ভঙ্গ করে রাজা মন্ত্রীকে বললেন: মাননীয়, আপনার কি পিতৃবিয়োগ না মাতৃবিয়োগ ঘটেছে?
মন্ত্রী ইঙ্গিত বুঝতে পেরে শিরস্ত্রাণ ঠিক করে বললেন: মহারাজ, ও-পর্ব আগেই শেষ এখন স্ত্রীবিয়োগ বাকি। তাই আগেই মাথা মুড়োলাম। কিন্তু, মহারাজ, আপনার গলায় দাগ কিসের?
রাজা গলাবন্ধ ঠিক করতে করতে বললেন: স্ত্রীর ভালোবাসা তো পাননি, তাই বুঝবেন কি করে? গভীর ভালোবাসা গলায় ফাঁসের মতো লেগে থাকে।
রক্তমুখ এবার করালমুখের উদ্দেশে বলল: ওরে মূর্খ, স্ত্রীর কথায় যে-রাজা ঘোড়া হয়, আর তার মন্ত্রী মাথা মুড়ায়—তাদের রাজ্য অন্যেই নিয়ে যায়, ঠিক তোর মতো। কাজেই আমাকে অর বিরক্ত না করে এবার বিদায় হ।
করালমুখ সব শুনে কাতর কণ্ঠে বলল: বন্ধু, আমার মতিচ্ছন্ন হয়েছিল, তাই তোমার মতো বন্ধুর অনিষ্ট করতে চেয়েছিলাম। তার শাস্তিও পেয়েছি। তারপরেও বলছি: বায়ুর দিক পরিবর্তন হয়, দিনের পর রাত আসে, পাহাড় ধসে পড়ে, সমুদ্র ভেসে ওঠে, কিন্তু মহতের চরিত্র বদলায় না। তুমি মহাজন। তাই আমাকে একটা ভালো উপায় বলে দাও, যাতে আমার বাস্তুটা ফিরে পাই।
রক্তমুখ: ওরে দুর্মতি! আমি বললেও তুই শুনবি না। কারণ তোর মতো মূর্খরা—
দর্পভরে বন্ধুর কথা অবহেলা করে—
সিংহের হাতে উটের মতো প্রাণে মারা পড়ে।
করালমুখ: কিভাবে?
রক্তমুখ: এভাবে …
সিংহ ও উট
এক গাঁয়ে থাকত এক ছুতোর। নাম মন্দমতি। নিজের কাজ ভালো জানত না তো। তাই এ নাম। তার ছিল এক উটী। এই নিয়েই দিন কাটত।
এক সময় উটা একটা বাচ্চা প্রসব করল। পুরুষ বাচ্চা। নাদুস-নুদুস। মাতৃদুগ্ধ পান করে লকলক করে বাড়তে লাগল। ছুতোর আদর করে তার গলায় একটা ঘণ্টা পরিয়ে দিল। সেই থেকে এর নাম হলো ঘণ্টি।
ছুতোরের সুদিন ফিরে এল। উটী প্রচুর দুধ দেয়। বাচ্চা খায়, নিজেরা খায়, তারপরে ও বিক্রি করে প্রচুর টাকা পায়। তাই ছুতোর তার পৈতৃক পেশা ছেড়ে দিল। স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে গুজরাট থেকে আরো কয়েকটি উটা নিয়ে এল। দেখতে দেখতে তার উটের এক পাল হয়ে গেল। দেখভালের জন্য কয়েকজন রাখালও রাখল। এবার তার সুখের দিন।
স্বল্প দূরেই ছিল এক গভীর বন। মাঝে এক সরোবর। উটের দল সকালবেলা সেই বনে যায়। লতা-পাতা খায়। সরোবরে জলপান করে। তারপর সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফেরে। সব কিছুই নিয়মমতো চলে। অনিয়ম শুধু ঘণ্টির বেলায়।
ঘণ্টি যেহেতু পালের প্রথম সন্তান, সেহেতু তার আদরটাও ছিল একটু বেশি। এই সুযোগে সে অনেকটা বেয়াড়া হয়ে উঠেছিল। হয় সবার আগে, নাহয় সবার পেছনে সে চলত। সবার সঙ্গে থাকলে যেন মান যায় এরূপ ভাব। মায়ের কথাও শুনত না, রাখালদেরও নয়।
একদিন সকলে দল বেঁধে বাগান থেকে বেরিয়ে আসছে। ঘণ্টি সবার শেষে। অনেক পেছনে। তার ঘণ্টাধ্বনি শুনে এক সিংহ এগিয়ে এল। একা পেয়ে ওৎ পেতে থাকল। ঘণ্টি কাছে অসতেই ঘার মটকে দিল।
তাই বলছিলুম, বন্ধুর কথা যে না শোনে, সে এভাবেই বেঘোরে প্রাণ হারায়।
করালমুখ বলল: বন্ধু, আমার ঘাট হয়েছে। আমি কৃতঘ্ন। তবু দয়া করে আমায় একটা পথ বাতলে দাও। দেখ, শাস্ত্রেই তো আছে—সজ্জনের প্রতি যে উদার, তার উদারত্বের বাহাদুরি কি? বরং দুর্জনের প্রতি যে উদার, তার উদারত্বই প্রশংসা পায়।
রক্তমুখ এবার আর অস্বীকার করতে পারল না। তাই করালমুখকে বলল: আচ্ছা, তবে যাও, শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করো। মরলে স্বর্গ পাবে, বাঁচলে ঘর পাবে। মনে রেখ—
উত্তমে প্রণিপাত সদা করতে হয়
অধমেতে উপেক্ষা কভু কাৰ্য নয়।
শূরে-শূরে ভেদনীতি রাজনীতি বলে
সমানে সমান সদা বিগ্ৰহ চলে।।
করালমুখ: কি রকম, ভাই?
রক্তমুখ: শোনো …
মরাহাতি ও শেয়াল
এক বনে থাকত এক শেয়াল। নাম মহাচতুরক। দুর্দান্ত চালাক তো। তাই এ নাম। চতুরক কয়েকদিনের অভুক্ত। পেট পিঠের মধ্যে ঢুকে গেছে। হঠাৎ দেখল— বনের মধ্যে এক হাতি মরে রয়েছে। কিন্তু হাতির মোটা চামড়া সে ছিঁড়বে কি করে? তাই জিহ্বাটা বের করে শুধু চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
এমন সময় সেখানে এল এক সিংহ। তাকে দেখে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে করজোড়ে বলল: হুজুর, আমি আপনার লেঠেল। অনেকক্ষণ হয় আপনার জন্য হাতিটাকে পাহারা দিচ্ছি। খান, হুজুর, খান।
সিংহ আভিজাত্যের সঙ্গে জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলল: আমি অন্যের মারা খাই না। তাই এটা তোকে বকশিস দিলুম।
চতুরক মহাখুশি হয়ে আরেকবার পেন্নাম ঠুকে বলল: এই না হলে প্রভু! ভৃত্যের সঙ্গে প্রভুর এ-ই তো সাচ্চা ব্যবহার। কথায় বলে না―মহতের মহত্ত্ব অন্তিমকালেও অটুট
থাকে, কারণ তিনি যে খাঁটি; খাঁটি সোনা আগুনে পোড়ালেও রং পাল্টায় না। চতুরকের প্রশংসা শুনে সিংহ খুশিমনে চলে গেল।
এর কিছু পরেই এল এক বাঘ। তাকে দেখে শেয়াল ভাবল: একটাকে তো পেন্নাম ঠুকে তাড়ালাম। এখন এটাকে তাড়াই কি করে? এ তো বয়সে জোয়ান। তাই ভেদনীতি ছাড়া উপায় নেই। শাস্ত্রে আছে না—
যেখানে চলে না সাম কিংবা ঐ দান।
সেখানে বিজ্ঞ ব্যক্তি ভেদ-ই চালান।।
এরূপ চিন্তা করে চতুরক বাঘের দিকে তাকিয়ে কাঁপাকণ্ঠে বলল: মামা, একেবারে যমের মুখে এসে পড়লে যে! সবেমাত্র এক সিংহ একে মেরেছে। আমাকে পাহারায় রেখে গেছে চান করতে। বলেছে: কোনো বাঘ এসে যেন মুখ না দেয়। তাহলে এ বনকে নির্ব্যাঘ্র করে ফেলব।
বাঘ: কেন, ভাগনে?
চতুরক: কিছুদিন আগে এরকম এক হাতি মেরে গেছিল চান করতে। এসে দেখে এক বাঘ এঁটো করে দিয়েছে। সেই থেকে বাঘেদের ওপর মহাক্ষ্যাপা।
এই শুনে বাঘ ভয়ে ভয়ে বলল: ভাগনে, মাতুল বংশ রক্ষা কর! আমি যে এসেছিলাম, তা তাকে বলো না।
এই বলে বাঘ পালিয়ে গেল। এর কিছুক্ষণ পরে এল এক চিতা। তাকে দেখে চতুরক ভাবল: এর দঁতগুলো বেশ মজবুত ও ধারালো। তাই একে দিয়ে হাতির চামড়াটা ছাড়িয়ে নেই। এই ভেবে সে আগ বাড়িয়ে বলল: কি ভাগনে, কেমন আছ? অনেক দিন দেখা নেই। কয়েকদিন খাওয়াও হয়নি মনে হচ্ছে। পেট তো দেখাই যাচ্ছে না। চিতা: ঠিকই ধরেছ, মামা। কোথাও কিছু পাইনি।
চতুরক: তা এক কাজ করো না। মহারাজ কেবল একে মেরে চান করতে গেছেন। আমি পাহারায়। আসার আগে যতটা পার খেয়ে নাও।
চিতা ভয়ে-ভয়ে বলল: মামা, যদি তাই হয় তাহলে এ মাংস খেয়ে আমার কাজ নেই। বাঁচলে ঢের খেতে পারব। কথায় বলে না—বুদ্ধিমান তা-ই খায়, যা হজম করতে পারবে। সুতরাং আমি চললুম।
চতুরক দেখল তার পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। এত খাবার থাকতেও তাকে অভুক্ত থাকতে হচ্ছে। সিংহ-বাঘকে ঘোল খাইয়ে সামান্য একটা চিতায় এসে আটকে যাবে? এ হয় না। তাই সে চিতার উদ্দেশে বলল: আরে ভীতু কোথাকার! আমি আছি না? তুমি নিশ্চিন্তে খেতে থাক। আমি পথের দিকে তাকিয়ে আছি। আসতে দেখলেই সাড়া দেব। তুমি দৌড় দেবে। পরেরটা আমি সামলাব।
চিতা আশ্বস্ত হয়ে বলল: তবে তাই হোক।
এই বলে সে যেই চামড়াটা কেটে ফেলেছে, অমনি চতুরক বলল: ভাগনে, পালাও, আসছে। তা শুনে চিতা এক দৌড়ে চম্পট।
তখন চিতার করা ছিদ্র দিয়ে চতুরক কেবল মাংস খাওয়া শুরু করেছে। অমনি আরেকটা শেয়াল তেরিয়া হয়ে ছুটে এল। তাকে দেখে চতুরক ধেয়ে গেল। দুজনে সমানে-সমান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কিন্তু চতুরকের জয় হলো। তীক্ষ্ণ দন্তের আঘাতে শত্রুকে হত্যা করে সে ফিরে এল। তারপর তৃপ্তিসহকারে অনেকদিন ধরে সেই হাতির মাংস খেল।
রক্তমুখ এবার করালমুখের উদ্দেশে বলল: তুমিও গিয়ে তোমার স্বজাতি-শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে দাও। নইলে একবার গেড়ে বসলে পরে তোমাকেই সাবাড় করবে। দেখ— গাভীর দুধ, ব্রাহ্মণের তপস্যা আর মেয়েদের চাপল্য যেমন স্বাভাবিক, স্বজাতির শত্রুতাও তেমনি। তাইতো—
বিদেশ গিয়ে ভালো খেয়ে কাটছিল দিন বেশ।
জাতির দোষে চিত্রাঙ্গর সুখের হলো শেষ।।
করালমুখ: কে চিত্রাঙ্গ? কি হয়েছিল তার?
রক্তমুখ: শুনবে? শোনো তাহলে …
চিত্রাঙ্গর প্রবাসজীবন
এক নগরে ছিল এক কুকুর। নাম চিত্রাঙ্গ।
দীর্ঘ অনাবৃষ্টির কারণে ঐ নগরে এক সময় দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। মানুষই খেতে পায় না। পশু-পাখি আর কি খাবে? তাই চিত্রাঙ্গ একদিন স্বজাতিদের ছেড়ে চলে গেল পাশের রাজ্যে। সেখানে সহজেই খাবার মিলত।
চিত্রাঙ্গ হাটতে হাটতে এক বাড়িতে গিয়ে উঠল। গায়ে বিভিন্ন রঙের দাগ থাকায় তাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগত। তাই বাড়ির গৃহিণীর চোখে পড়ল। তার দয়ায় খাবার-দাবার ভালই জুটতে লাগল। ফলে অল্পদিনেই চেহারায় চিকনাই ধরল। মাঝে-মধ্যে বাইরে বেরুলে কুকুরীরা সঙ্গ কামনা করত।
কিন্তু সমস্যা হলো স্বজাতিদের নিয়ে। তারা চিত্রাঙ্গর এই সৌভাগ্যকে মেনে নিতে পারছিল না। সুযোগ পেলেই তারা দাঁতে-নখে তাকে ক্ষত-বিক্ষত করত। এমনিভাবে কিছুদিন চলার পর চিত্রাঙ্গ ভাবল: শুধু খাবার লোভে এই বিদেশে পড়ে থেকে এভাবে মার খাওয়া অপমানজনক। এখানে আপন কেউ নেই যে আমার সহায় হবে। তার চেয়ে স্বদেশই ভালো। দুর্ভিক্ষ হোক আর যা-ই হোক, সেখানে কেউ তেড়ে আসবে না। সেখানে আমার অধিকারও আছে। এ-কথা ভেবে সে দেশে ফিরে এল।
করালমুখ এসব উপদেশ শুনে মরণকে তুচ্ছজ্ঞান করে রক্তমুখের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের বাড়ি চলে গেল। যে শত্রু তার বাড়ি দখল করেছিল, সর্বশক্তি দিয়ে তার সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে মেরে ফেলল। তারপর নিজের বাড়ি ফিরে পেয়ে পরম সুখে বসবাস করতে লাগল। তাইতো পণ্ডিতেরা বলেন:
পৌরুষে অর্জিত ধন যতই তুচ্ছ হোক।
দয়ার দান সে ঘৃণ্য—হোক না রাজভোগ