পূর্বখণ্ড- সংশয়
মধ্যখণ্ড— সংযোগ
উত্তরখণ্ড— সংকাশ

লখনের কথা

লখনের কথা

১।

১৮৮০ সালের ডিসেম্বর মাস। সদ্য সিমলা থেকে সপরিবারে কলকাতায় বদলি হয়েছেন সাহেব সিভিলিয়ান উইলিয়াম সেটন। সামনেই বড়দিন। তাই কেনাকাটা করতে একটা ল্যান্ডো চেপে তিনিও এসেছিলেন মেমসাহেবের সঙ্গে। আগে এখানে দুটো বাজার পাশাপাশি ছিল। সাহেবদের জন্য ফেনউইক বাজার আর নেটিভদের কলিঙ্গবাজার। কিন্তু নেটিভদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাজার করতে সাহেবদের ঘোর আপত্তি। কিছুদিন আগে তাই কলকাতা কর্পোরেশন ফেনউইক বাজার ভেঙে শুধু সাহেবদের জন্য নতুন এক বাজার বানিয়েছেন। তাতে এক ছাদের নিচে নিত্য প্রয়োজনীয় সবজি, ফল, স্টেশনারি বইপত্র থেকে পোশাক জুতো ব্যাগ উপহার সামগ্রী সব সমস্ত কিছুই পাওয়া যাবে। নেটিভদের সঙ্গেও আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না। বাজারের এক গালভরা নাম রাখা হয়েছে, ভিক্টোরিয়ান গথিক মার্কেট কমপ্লেক্স। কিন্তু মুখে মুখে সাহেবরা একে নিউ মার্কেট বলে থাকেন। কলকাতায় এসে বড়দিনের বাজারের জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা হয় না। ফেরার পথে একটা মুশকিল হল। কর্পোরেশনের একদল কুলি বিনা রেজিস্ট্রেশানে মাল বইছিল। তাদের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশান করা কুলিদের ঝামেলা বেঁধে এখন মারামারির পর্যায়ে গেছে। পুলিশ তেমন কিছু করছে না, বা করতে পারছে না। সেটন সাহেব কলকাতায় নতুন। তিনি ভয় পেলেন। সহিসকে বললেন অন্য পথ ধরতে। সহিস একটু অনিচ্ছাতেই পাশের কলিঙ্গবাজারের গলি ধরল।

উপরতলার ইংরেজরা এই রাস্তা এড়িয়েই চলতেন। যদিও রাতের অন্ধকারে এখানে সাহেবসুবোদের আনাগোনার কমতি ছিল না। কলকাতার একমাত্র ইউরোপিয়ান বেশ্যাদের কুঠি এই রাস্তায়। সেটন সাহেব এসব কিছুই জানতেন না। জানলে হয়তো গলিতে ঢোকার আগে দুবার ভাবতেন। ঢুকে দেখেন এক জায়গায় প্রচুর নেটিভ পুরুষ মহিলা ভিড় করে দাঁড়িয়ে। গাড়ি একচুল এগোতে পারছে না। কী ব্যাপার দেখার জন্য সাহেব নিজেই ল্যান্ডো থেকে নেমে পড়লেন। রাস্তা জুড়ে এক প্রকাণ্ড চেহারার মানুষ খেলা দেখাচ্ছে। পরনে কেবল একটা টকটকে লাল ধুতি। মাথায় জটা। লোকটির সামনে দুটো বেতের ঝুড়ি। একটা ছোটো। একটা অপেক্ষাকৃত বড়ো। ছোটো ঝুড়ি থেকে মাথা বার করে প্রায় সোজা হয়ে ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে মিশমিশে কালো একটা কেউটে সাপ। মাঝে মাঝে জিভ বার করছে। লোকটা সাপের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে মন্ত্রের মতো বলে যাচ্ছে, “লাগ-লাগ-লাগ-লাগ ভেলকি লাগ। লাগ বললে লাগবি, ছাড় বললে ছাড়বি। ভাটরাজার দোহাই রে বাবা। ভাটরাজার দোহাই।” সাহেব কথাগুলো না বুঝলেও অবাক চোখে লোকটাকে দেখছিলেন। এমন জিনিস তিনি আগে কোনও দিন দেখেননি। পাশে ততক্ষণে সহিস এসে দাঁড়িয়েছে। সে অল্প ইংরাজি জানে। সাহেবকে বুঝিয়ে দিল এরা বেদে। সাপের খেলা দেখায়। জাদু দেখায়। বেদে ততক্ষণে মন্ত্র বদলে ফেলেছে। নিজের হাতকে সাপের ফণার মতো দোলাচ্ছে সাপের সামনে, সাপের মাথাও দুলছে তালে তালে। প্রায় গানের মতো অদ্ভুত বোলে লোকটা বলে চলল-

প্রথমে জুড়িলাম মাতা সয় ব্ৰাহ্মণী
ফুঁক দিতে ওগো মাতা বিষ নৈল পানি।
তা বাদে জুড়িলাম মাতা রক্ত রোহিণী।
সভা পানে চাইতে সাপের বিষ হৈল পানি।

বলেই হাতে অদ্ভুত এক ঝাড়া মারল। আর মারতেই সেই ফণা তোলা সাপ বাধ্য শিশুর মতো মাথা গুটিয়ে ঢুকে গেল বেতের ঝুড়িতে। সবাই তালি দিয়ে উঠল। নিজের অজান্তেই তালি দিলেন সেটন সাহেবও। বিষধর সাপ মানুষের কথা শুনছে। আশ্চর্য! কিন্তু আসল চমক ছিল এর পরেই। ঠিক পাশেই ছোট্ট একটা ইজের পরে দাঁড়িয়ে ছিল বছর আটেকের একটা বাচ্চা ছেলে। কুচকুচে কালো গায়ের রং। সামনের দাঁতদুটো উঁচুমতন। চোখদুটো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। বেদে তাকে বড়ো ঝুড়িতে ঢুকতে বলল। সে ঢুকবে না। বেদে যতবার বলে, সে মাথা নেড়ে না করে। শেষে বেদে রেগেমেগে একগাছা মোটা দড়ি আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল ছেলেটাকে। সে বারবার হাত পা ছুড়ে বাধা দিতে চাইল। পারল না। এবারে বেদে জোর করেই তাকে ঢুকিয়ে দিল বড়ো বেতের ঝুড়িটায়। বাচ্চাটা কাঁদতে শুরু করল। ঝুড়ির ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে সেই কান্না। বেদে বড়ো একটা হাঁ করে নিজের পেটের ভিতর থেকে বের করে আনল লম্বা একটা তলোয়ার আর তীব্র রাগ আর ঘৃণায় সেই তলোয়ার বিধিয়ে দিতে লাগল ঝুড়ির গায়ে। শিশুটির আর্ত চিৎকারে গোটা গলি কেঁপে উঠল। ঝুড়ির গা বেয়ে বেরিয়ে এল তাজা লাল রক্ত। এতটা সহ্য করা সেটনের পক্ষে অসম্ভব। তিনি প্রায় কিছু না ভেবেই ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে বেদের হাত চেপে ধরলেন। বেদে চমকে তাঁর দিকে তাকাল। সে বোধহয় সাহেবকে দেখবে বলে ভাবেনি। তার চোখে ভয়। কিছু বোঝার আগেই সেটনের আপারকাট তাকে ধরাশায়ী করল। ঠিক সেই সময় রিনরিনে গলায় কে যেন বলে উঠল, “প্লিজ স্যার, প্লিজ।” সেটন অবাক হয়ে দেখলেন ভিড়ের মধ্যে থেকেই এক কিশোরী মেয়ে এসে তাঁর হাত চেপে ধরেছে। মেয়েটার দুই চোখে জল। চারিদিকে হাততালি দেওয়া নেটিভরা চুপ। তারাও বুঝতে পারছে না কী করবে। আর সাহেবকে সম্পূর্ণ হতবাক করে দিয়ে সেই মেয়েটার ঠিক পাশেই যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়েছে সেই বাচ্চা ছেলেটা। অক্ষত। নিশ্চুপ। হতভম্ব সেটনকে আরও চমকে দিয়ে মেয়েটা আবার স্পষ্ট ইংরেজিতে বলল, “ইটস জাস্ট এ ম্যাজিক ট্রিক স্যার।” বেদে ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে লম্বা একটা বাঁশ। সেটনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সেই মেয়ে তরতর করে উঠে গেল বাশ বেয়ে। বাশের মাথায় তীক্ষ্ণ লোহার ছুরি। অদ্ভুত ব্যালান্সে সেই ছুরিতে নাভি ঠেকিয়ে বনবন করে ঘুরতে লাগল সে।

ফেরার আগে মেয়েটার হাতে দুটো সিক্কা টাকা গুঁজে দিয়েছেন সাহেব। দুটো মিষ্টি কথাও বললেন। মেয়েটার চুলের রং লালচে। ত্বক গোলাপি। চোখের মণি কটা। এ মেয়ে নেটিভ হতেই পারে না। কথা বলে সাহেব বুঝলেন এর মা কলিঙ্গবাজারের ইউরোপীয় বেশ্যা। ইদানীং আয় প্রায় নেই। তাই ছেলেমেয়েকে বেদের দলে ভিড়িয়েছে। হ্যাঁ, ওই নিকষ কালো শিশুটি নাকি এই মেয়েটির ভাই। হতেই পারে অবশ্য। সেটন ভাবলেন। এদের বাবার ঠিক আছে নাকি?

ল্যান্ডোতে ফেরার পথে সারাক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে রইলেন সেটন। মেমসাহেব বারবার জিজ্ঞেস করাতেও উত্তর দিলেন না। সেই রাতে তাঁর ঘুম এল না। বারবার চোখে ভাসতে লাগল মেয়েটার মুখ, হাসি, সদ্য যৌবনের কুঁড়ি ধরা শরীর। এমন রমণীরত্ব বেশিদিন কলিঙ্গবাজারের মতো জায়গায় থাকলে অচিরেই নষ্ট হয়ে যাবে। তাঁর উচিত এই মেয়েকে উদ্ধার করে নিজের আশ্রয়ে আনা। শুধু গিন্নিকে জানানো যাবে না। তাঁর বাবা নামজাদা সিভিলিয়ান। সেটনের অফিসের বড়োকর্তা। শ্বশুরের জোরেই এত দ্রুত উত্থান হয়েছে সেটনের। কিন্তু তা বলে কি তিনি উপোসি থাকবেন?

সেটন সেই রাতেই ঠিক করে নিলেন তাঁকে কী করতে হবে। কী যেন নাম বলেছিল মেয়েটা নিজের? মারিয়ানা। আর ওর ভাইয়ের নাম ল্যানসন। তবে ওই নাম খেলা দেখাতে গেলে নাকি চলে না। বেদে ওদের হিন্দু নাম দিয়েছে। ময়না আর লখন।

গভীর ঘুমের দেশে মাঝে মাঝে কারা যেন এসে সাড়া দিয়ে যায়। লখন বুঝতে পারে না। শুধু আবছা ভেসে আসে কাদের যেন চিৎকার। প্রায় প্রতিদিন। স্বপ্নে। সেই কবেকার কথা। কিন্তু যেন সদ্য ঘটেছে। পরের দিন নববর্ষ। কলিঙ্গবাজারের ইউরোপিয়ান বেশ্যাপাড়া নিজেদের মতো সেজবাতি আর আলোয় সেজেছে। কিছু চিনা আর ইহুদি মহিলাও থাকে এখানে। তারাও যোগ দিয়েছে এই উৎসবে। লখনের মায়ের অসুখ সেদিন খুব বাড়াবাড়ি। জ্বরটা কিছুতেই কমছে না। বছর দু-এক আগেও সন্ধে হতে না হতে মায়ের ঘরে লোক ঢুকত। বহুদিন পরে বন্দরে আসা সাহেব নাবিক, জাহাজ-পালানো মাতাল। তাদের ডেরা লালবাজার আর বউবাজারের পাঞ্চহাউস। সারাদিন সেখানে বসে মদ টানে আর সন্ধ্যা হতেই সোজা চলে আসে কলিঙ্গবাজারে। এদের নিয়ে কলিঙ্গবাজারের বেশ্যারা রীতিমতো ভয়ে থাকে। একে তো দরজা বন্ধ করে যথেচ্ছ অত্যাচার করে, তায় আবার অনেক সময় পয়সাও ঠেকায় না। সন্ধ্যা হবার আগেই লখনের মা জেনি তাদের দুই ভাইবোনকে পাশের এক ঘরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিত। লখনের কানে আসত মায়ের অসহায় চিৎকার, অচেনা পুরুষ গলায় অশ্রাব্য গালিগালাজ। মারের শব্দ। দিদি মারিয়ানা তার দুই কানে হাত চেপে ধরত জোরে। তাতেও কাজ হত না। ফিরে যাবার সময় এদের কেউ টাকা দিত। কেউ দিত না। কিচ্ছু করার নেই। কার কাছে নালিশ করবে? আর তারপরেই কলিঙ্গবাজারের সবচেয়ে সুন্দর বেশ্যা বিবিজান খুন হল। মার্কিন জাহাজের নাবিক ফ্র্যাঙ্ক রাসেল তাকে ভোগ করে টাকা না দিয়েই চলে যাচ্ছিল। সে বাধা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে পিস্তল বার করে সে বিবিজানের মাথায় গুলি করে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে কিছু লেখালেখি হলেও পুলিশ তাদের রিপোর্টে অনিচ্ছাকৃত খুন দেখিয়ে রাসেলকে ছেড়ে দেয়।

সেদিন থেকেই জেনি ঠিক করেছে এই ব্যবসা ছেড়ে দেবে। বিবি তার মেয়ের চেয়ে কিছু বড়ো। মেয়ের মতোই তাকে স্নেহ করত সে। এদিকে জেনির দেহেও রোগ বাসা বেঁধেছে। জ্বর আসে প্রায়ই। পেচ্ছাপে জ্বালা। যোনিপথ দিয়ে রক্ত গড়ায়। কোমরের পর থেকে ব্যথায় অসাড়। তবু জেনি কাউকে জানায়নি। এ দেশে চৌদ্দ আইনের জোরে পুলিশ জানতে পারলেই ধরে নিয়ে যাবে হাসপাতালে। আর পরীক্ষার নামে ডাক্তার নিজের সুখটি করে নেবে। অকারণে মুচড়ে ধরবে স্তন। যোনি পরীক্ষার নামে নিজের লালসা মেটাবে। সঙ্গে আছে উৎপীড়ন। বেশ্যা যত কাঁদে, পুরুষ ডাক্তার তত মজা পায়। ভয়ে এই পাড়ার কেউ কেউ চন্দননগরে ফরাসিদের ডেরায় পালিয়েছে।থকে জেনির সে উপায় নেই। পারমিট মেলেনি।

জেনি অসুস্থ হতেই ঘরে লোক নেওয়া বন্ধ করল। পেটে টান পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। আর ঠিক সেই সময়ই একদিন প্রায় ভগবানের মতো দেখা দিল বাবুলাল। বাবুলালের পুরো নাম কেউ জানে না। বাবুলাল বেদে। হাতসাফাই আর সাপের খেলা দেখায়। কলিঙ্গবাজারের মুখটাতে এসে ডুগডুগি বাজালেই সবাই এসে জড়ো হয়। মাসে একবার তো আসেই। মারিয়ানা আর ল্যানসন বড্ড ভালোবাসে তার খেলা দেখতে। কিন্তু সে রাতে সে এসেছিল একা। হাঁফাতে হাঁফাতে জেনির দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল। দরজায় ধাক্কা শুনে জেনি প্রথমে দরজা খোলেনি। ভেবেছিল কোনও মাতাল-দাতাল হবে। পরে ভাঙা গলায় “হেল্প মি। হেল্প মি” শুনে দরজা খুলতেই তাকে প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল বাবুলাল। তাকে পুলিশে তাড়া করেছে। রয়্যাল নেভির এক পাড় মাতাল নাবিক তার পোষা সাপকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। রাগে বাবুলাল মাথা ঠিক না রাখতে পেরে সাহেবের বুকে মেরেছে এক ঘুসি। আর তাতেই সাহেব অক্কা পেয়েছে। বাবুলাল জানে পুলিশ তাকে খুঁজতে এ পাড়ায় আসবে না। এ পাড়ায় নেটিভ লোকের আনাগোনা কম।

টানা ছয়মাস ঘরবন্দি ছিল বাবুলাল। তার কাছে কিছু টাকা গচ্ছিত ছিল। সেই টাকাতেই সংসার চলত। ল্যানসনের জীবনে সেই ছয়মাস প্রায় স্বপ্নের মতো। বাবুলাল তাদের শেখাল ভানুমতীর খেল, বেদের বিদ্যা। হাত থেকে টাকা উড়ানো, ঝুড়ির ভিতর থেকে অদৃশ্য হওয়া, পালককে পায়রা বানানো, আরও কত কী। মারিয়ানাও শিখত সঙ্গে সঙ্গে। একটা বাঁশের উপরে ছুরির ডগায় কী করে নিজেকে ব্যালেন্স করে রাখা যায়। পেটে শুধু আগে থেকেই বেঁধে নিতে হবে লোহার একটা পাত। পাতের মাঝে একটা ফুটো। লোকে যাতে বুঝতে না পারে, সেই পাতের উপরে পেঁচিয়ে নিতে হবে লাল শালু। দুপুর হতেই জেনি গুনগুনিয়ে তাদের পড়ে শোনাত বাইবেল। কালো মলাটের সেই পুরোনো বাইবেল আর খয়েরি চামড়ায় মোড়া একটা হাতে লেখা পুরনো ডায়রি। এই ছিল জেনির সম্বল। এই ডায়রি কাউকে ধরতে দিত না সে। বলত একদিন এই ডায়রি আমাদের হাল ফেরাবে। কীভাবে? কেউ জানে না।

ছয়মাস হতে না হতে একদিন লোকটা এল। বাবুলালের খোঁজে। ঘরে থেকে থেকে বাবুলালের চেহারা ভেঙে পড়েছে। সারারাত ঘুমাতে পারে না কাশির চোটে। জেনি আদা গোলমরিচ ফুটিয়ে দেয়। অল্প আরাম হয়। লোকটা বাবুলালের খবর কীভাবে পেল কে জানে? দরজা খোলা পেয়ে সোজা ঢুকে এল জেনিদের ঘরে। বাবুলাল বিছানায় বসে ছোট্ট লখনকে হাতসাফাইয়ের খেলা দেখাচ্ছিল। ঢুকেই বাবুলালকে বলল, “কি গুরুদেব? ভালোই তো গা ঢাকা দিয়ে আচ? সবাই ভাবচে তুমি বুঝি পুলিশের গুলিতে মরেচ। আমি তো জানি তুমি সেই বান্দা নও।”

অস্বাভাবিক মোটা। দাড়িগোঁফ কামানো। পরনে ফতুয়া। গলার স্বরে কী একটা ছিল, লখন চোখ ফেরাতে পারছিল না লোকটার থেকে। বাবুলাল খুব ধীরে ধীরে বলল, “তোকে এই ঠিকানা কে দিল রে হরিরাম?”

“দিতে হয় নাকি? খুঁজে নিতে হয়।”

“কোনও ঝামেলায় পড়েছিস নাকি?”

“হ্যাঁ। চুরির। এক গয়নার দোকানে। পুলিশের নতুন এক দারোগা এইয়েচে। পিয়নাথ না কী যেন নাম। ব্যাটা হাড় জ্বালিয়ে মাচ্চে। তোম একানে ঠাঁই হবে তো বলো।”

“জেনিকে বলে দেকচি। কিন্তু আগে বল খাবি কী? জেনির ঘরে লোক আসে না। আমার জমানো ট্যাকা শেষ। তার উপরে তুই। পুরোনো বিদ্যে কিছু মনে আচে? না চুরির নেশায় ভুলে মেরেচিস?”

“কী যে বলো গুরুদেব। সব জানি।”

“বটে? তবে হাতের এক ঝটকায় এই হরতনের তিরির উপরে চিড়েতনের এক্কাটা নিয়ে আয় দেকি।”

হরিরাম নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বাঁ হাতে তাসের বান্ডিলটা ধরে একটা ঝাড়া মারতেই ভিতর থেকে চিড়েতনটা টুক করে উপরে এসে বসে পড়ল। “সাব্বাস বেটা! এক কাজ কর তবে। এই ছেলেমেয়ে দুটোকে আমি নিজের হাতে শিক্ষে দিয়েচি। তোকে যেমন দিয়েচিলাম। তুই ভোল পালটে ফেল। সাধুর বেশ নে। সাহেবরা আর নেটিবরা সাধুদের গায়ে হাত দিতে দশবার ভাবে। চম্পক ওঝার কাচে যা। বড়বাজারের পিছনে থাকে। একখান সাপ জোগাড় করে নে। বিষদাঁত দেকে নিস। হপ্তা দু-এক দাড়ি বাড়িয়ে খেলা দেকানো ধর। আর এই দুটোকে নিস। আমার নতুন চ্যালা।”

সাধু সেজে হরিরাম নতুন নাম নিয়েছিল পিন্ডারী বাবা। লোকের সামনে কথা বলত ভাঙা হিন্দিতে। দেশের বাড়ি হুগলী জেলার তারকেশ্বরের ভাণ্ডারহাটি গ্রাম। হরিরামই ল্যানসনের নাম দিয়েছিল লখন। সে রাম আর তার সঙ্গী লখন। হরিরাম আসার কিছুদিনের মধ্যেই বাবুলাল ঘুমের মধ্যে মারা গেল। সন্ন্যাস রোগ বলেছিল সবাই। বাবুলাল মারা যেতেই হরিরাম বাড়ির মুরুব্বি হয়ে বসল। কথায় কথায় জেনিকে গালাগাল দিত। মারত। লখন ছাড় পেত না। ময়না না। দুধ দেওয়া গোরুর চাট খেতে বাধ্য ওরা। তাও একরকম চলছিল। সব বদলে গেল নববর্ষের সেই আগের রাতে।

দিদির বুকের কাছে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে ছিল সে। আচমকা দরজা খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল একগাদা লোক। কিছু সাহেব। কিছু নেটিভ। লখন এদের কাউকেই চেনে না। ঢুকেই একটানে উঠিয়ে নিল ময়নাকে। প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিল দুজন মিলে। তার মায়ের আর দিদির চিলচিৎকারে ঘর ভরে গেছে। লখন বুঝতে পারছে না কী করবে। সে দৌড়ে গিয়ে কামড় বসিয়ে দিল একজনের পায়ে। সঙ্গে সঙ্গে জোর লাথি। বুক ফেটে যাবে যেন। দিদি চিৎকার করে হাত পা ছুড়ছে। অন্ধকার ঘরে শুধু দুই একটা ঢাকা লণ্ঠনের ঝলকানি। সেই আলোতেই লখন দেখতে পেল তিনটে সোমত্ত সাহেব তার দিদিকে একটা বড়ো বস্তায় পুরে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। ঘরের এক কোনায় মা গোঙাচ্ছে। তার উপরে হামলে পড়েছে দুজন নেটিভ। দুজনেই একেবারে ল্যাংটো। মায়ের চিৎকার বাড়তে বাড়তে ফেটে গিয়ে ফ্যাসফ্যাসে। লখনের বুকের ব্যথা বাড়ছে। লখন অজ্ঞান হয়ে গেল।

সেই রাতের পর হরিরামকেও কেউ দেখেনি। বন্ধ দরজার খিল কে খুলেছিল তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবু পুলিশ অভিযোগ নেয়নি। বেশ্যার আবার ধর্ষণ হয় নাকি? বেশ্যার মেয়েকে কে অপহরণ করবে? নিজেই পালিয়েছে কারও সঙ্গে। এর উপরে যা শোনা যাচ্ছে, কিছু সাহেবও নাকি ছিল সে রাতে। সায়েবে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। কে ঘাঁটাতে যাবে? তাও এক বেশ্যার কথা শুনে? মারিয়ানা চলে যাবার পরে জেনি কেমন একটা পাগল মতো হয়ে গেল। সারাদিন একা একা কথা বলে। বিড়বিড় করে। বাইবেলের পাতা ওলটায়। রাত হলেই বারবার করে দরজার খিল আটকায়।  

জেনিদের ঠিক পাশেই লিলির কুঠি। লিলি বয়সে মারিয়ানার চেয়ে কিছু বড়ো। অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। বড্ড ভালোবাসত মারিয়ানাকে। তার ঘরে এক বড়োলোক সাহেব যাতায়াত করতেন। লিলি তার সাহেবকে জেনিদের কথা বলে। সাহেব খোঁজ নিয়ে জানান সিটন নামে কোনও এক সিভিলিয়ান নাকি মারিয়ানাকে নিয়ে উঠিয়েছেন চন্দননগরে নিজের ভাড়া করা বাগানবাড়িতে। সিটনের হাত অনেক উঁচু। পুলিশের বাবার ক্ষমতা নেই সেখানে হাত দেয়। লিলির অনুরোধেই সাহেব নিজে মিশনারি জেমস থবর্নের কাছে সুপারিশ করে অনাথদের স্কুল ক্যালকাটা বয়েজে লখনকে ভরতি করে দেন। এই সাহেব লখনের জীবনটা ঠিক কীভাবে বদলে দিলেন সেটা বুঝতে বুঝতে লখনের আরও দশ বছর সময় লেগেছিল।

সাহেবের নাম জেকব ওয়ার্নার।

৩।

টানা সাত বছর ক্যালকাটা বয়েজে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ল্যানসনের। শুরুতেই ভরতি হয় জুনিয়র শ্রেণিতে বালি বিভাগে। এখানে ছাত্রদের প্রথামতো বালির উপরে অক্ষর শিখতে হত। কিছুদিনের মধ্যেই জ্যামিতি, অঙ্ক আর ইংরাজিতে পারদর্শী হয়ে ওঠে। তার মূল সমস্যা ছিল দুটো। এক, তার গায়ের রং। দুই, তার ঠিকানা যে কলিঙ্গবাজার, তা কীভাবে যেন ফাঁস হয়ে গেছিল। জেনির অসুখ বেড়েছে। এখন প্রায় বিছানাতেই থাকে তবে সামান্য কিছু সেলাইয়ের কাজ করে সংসার চালিয়ে নেয়। ল্যানসনের পক্ষে লেখাপড়া চালানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু পড়াশুনোয় তার উৎসাহ দেখে স্বয়ং জেমস থবর্ন তাকে মাসে দুই টাকা জলপানির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

ক্লাসে পাক্কা সাহেবরা একদিকে আর অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা অন্যদিকে বসত। একে অপরের সঙ্গে মিশত না। ল্যানসনের অবস্থা আরও করুণ। ইউরেশিয়ানরাও তাকে এড়িয়ে চলে। ক্লাসের একেবারে শেষে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে সে। তাতেও রেহাই নেই। প্রায় অকারণেই “ব্ল্যাকি” আর “বাস্টার্ড” শব্দ দুটো তার নামের প্রতিশব্দ হয়ে উঠল। ক্লাসে লালমুখো ইংরেজ সাহেব গ্রিফ ইংরাজি পড়াতেন। ল্যানসনকে দেখলেই তাঁর মুখ বিকৃত হয়ে উঠত। সাহেব ক্লাসে এসেই জোরে জোরে গ্রে-র কবিতার বই কিংবা বেকনের প্রবন্ধ থেকে পড়ে শোনাতেন। তারপরেই পড়া ধরতেন। ইংরেজ ছাত্রদের সাত খুন মাফ। ইউরেশিয়ানদের পান থেকে চুন খসলেই সাহেব মস্ত বাঁটওয়ালা এক কাঠের ফেরুল দিয়ে তাদের হাতে জোরে জোরে মারতেন। আঘাতে হাত ফেটে রক্ত পড়ত। সবচেয়ে বেশি মার খেত ল্যানসন। গ্রিফের হাতে ফেরুল আর বেতের বাড়ি তার বাঁধা ছিল। তাকে পিটিয়ে অদ্ভুত এক পাশবিক আনন্দ পেতেন সাহেব। পিটিয়েই যেতেন, যতক্ষণ না তিনি হাঁফিয়ে যান। ল্যানসন কিছু বলত না। মুখ বুজে থাকত। স্কুলে তার তিন-চারটি বন্ধু হয়েছিল। তাদের সবাই নিচু জাতের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। অনাথ। প্রায় সবারই বাবা এই দেশে সেনা হিসেবে এসেছিলেন। তারপর হিন্দু বা মুসলমান মায়ের গর্ভে তাদের জন্ম দিয়েই আবার দেশে ফিরে গেছেন। সাহেব কলকাতায় এদের সবাই ডাকে চি চি বলে। কারও মা এখন হাসপাতালে আয়ার কাজ করে, কেউ ইংরেজ বাড়ির গভর্নেস, আবার কেউ এখনও অন্য কোনও সাহেবের রক্ষিতা হয়ে আছে। এই বন্ধুদের মধ্যে ল্যানসনের সবচেয়ে কাছের ছিল বনি। বনি নিজের সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলত না। ওইটুকু বয়সেই অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে। কেন জানি না ল্যানসনের উপরে বনির স্নেহদৃষ্টি ছিল। বনির দলের তিন-চারজন অফ পিরিয়ডে প্রায়ই একত্র হয়ে কী যেন আলোচনা করত। অদ্ভুত ভাষায়। সে ভাষা ল্যানসন কোনও দিন শোনেনি। শুধু ঠোঁট নড়ত। মুখের কোনও বিকৃতি নেই। গ্রিফ সাহেব যখন গলার শির ফুলিয়ে মিলটনের কবিতা আবৃত্তি করছে, বনির দল নির্বিকার মুখে শুধু ঠোট নেড়ে নিজেদের কথা চালিয়ে যেত। একেবারে পিছনে বসে থাকা লখনের পক্ষে সেসব কথা বোঝা সম্ভব না। তবে দীর্ঘদিন ধরে খেয়াল করে ল্যানসন বুঝেছে প্রতি মাসের সাত তারিখ এদের আলোচনা যেন একটু বেশিই বেড়ে যায়। একটা অস্থির ভাব। ক্লাসে মন নেই। একটা উত্তেজনা যেন চারিয়ে আছে সবার মধ্যে। ক্লাস শুরু হত ভোরে। দুপুরে শেষ হবার পরেও অন্যদিন সবাই খানিক স্কুলের লাইব্রেরিতে কাটিয়ে যেত। কিন্তু ওই একদিন বনির দলবল ক্লাস শেষ হতেই পড়ি কি মরি করে ছুট লাগাত কোথায় যেন।

ল্যানসনকে যেমন ওরা ব্ল্যাকি বলে ডাকত না, তেমন নিজেদের আলোচনার ঢুকতেও দিত না কখনও। ক্লাসের শেষে লাইব্রেরি রুমে বসে বনি, মিলার, ডেভিড আর থিওন মিলে একত্রে পড়াশুনো করত। একই টেবিলে। রোজ। ল্যানসন ঠিক পাশের টেবিলেই বসে। মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব শব্দ কানে এসে যায়, “লজ”, “মাস্টার”, “আর্টিফিসার”, “মার্সেনারি।” ল্যানসন এসবের মানে জানে না। একটু কান খাড়া করে শুনতে গেলেই কেউ না কেউ বুঝে ফ্যালে। সঙ্গে সঙ্গে একজন বলে ওঠে “কাওয়ান”, আর প্রায় ম্যাজিকের মতো সবাই একসঙ্গে একেবারে কেজো কথা আর ক্লাসের পড়াশুনোর কথা বলতে থাকে।

স্কুলের সপ্তম বছরে বনিদের দলে ল্যানসনের ঢুকে যাওয়াটা একেবারে ম্যাজিকের মতো। হেন্ডারসন সাহেব ছিলেন অঙ্কের মাস্টার। যেমন ভালো পড়ান, তেমন কড়া। তাঁর হোমওয়ার্কে ফাঁকি দেওয়া যেত না কোনওমতে। বনি তাঁর প্রিয় ছাত্র। ক্লাসে এসে হোয়েওয়েলের মেকানিকস কিংবা ফেল্পসের অঙ্ক বই থেকে কিছু অঙ্ক টুকে দিতেন বোর্ডে। সব শেষে ‘ফর স্পেশাল স্টুডেন্টস’ লিখে আরও খান দুই অঙ্ক। সবাই জানত এই স্পেশাল স্টুডেন্ট কে? বনি আর তার বন্ধুরা ছাড়া কারও সাধ্য ছিল না সেই অঙ্কে হাত দেবার। আর একজন পারত। ল্যানসন। কিন্তু সে কোনও দিন কাউকে বলেনি। পরের দিন হেন্ডারসন বোর্ডে সেই অঙ্ক কষে দিলে ল্যানসন শুধু মিলিয়ে নিত নিজের কপির সঙ্গে। হেন্ডারসন বনিদের কপি দেখে মৃদু হেসে বনিকে বলতেন বোর্ডে এসে অঙ্ক কষে দিতে।

সেদিন লাইব্রেরিতে বসে ল্যানসন সবে হেন্ডারসনের স্পেশাল অঙ্ক কষে উঠতে যাবে, এমন সময় বনির উত্তেজিত গলা কানে এল।

“এভাবে হতেই পারে না। ভুল অঙ্ক। ইউক্লিডের থিয়োরির সঙ্গে তো একেবারেই মিলছে না!”

বাকি তিনজনও গালে হাত দিয়ে বসে। থিওন পালকের কলম কানে ঢুকিয়ে চুলকাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই অঙ্কের মাথামুণ্ডু উদ্ধার করা তাদের কম্ম না। ল্যানসনের হাসি পেল। বার্কলের জ্যামিতির বইতে একেবারে শেষের দিকে এই ধরনের কিছু সমস্যার কথা আছে। নিশ্চিতভাবে এরা সেই বই পড়েনি। শুধু পাঠ্যে থাকা ইউক্লিডের প্রথম ছটা খণ্ড আর এগারো নম্বরটা পড়েছে। হেন্ডারসন একবার বার্কলের কথা বলেছিলেন ক্লাসে। কিন্তু ওই বই থেকে অঙ্ক দেবেন এটা ল্যানসনও ভাবতে পারেনি। বনিদের পিছনের তাক থেকে বই বার করার ছলে খুব ধীরে ল্যানসন বলল, “এটার উত্তর ইউক্লিডের থিয়োরিতে হবে না। ল্যামবার্টের সূত্র ব্যবহার করতে হবে। চতুর্ভুজের তিনটি কোণ সমকোণ আর অন্যটা সূক্ষ্মকোণ। খেয়াল কর।”

চমকে উঠে চারজনেই তাকাল ল্যানসনের দিকে। বনি খানিক স্থিরভাবে ওর মুখের দিকে চেয়ে হাতের খাগের কলমটা ছুড়ে দিয়ে বলল, “দেন ডু ইট।”

পরের দিন ক্লাসে নিতান্ত অনিচ্ছাতেও হেন্ডারসনের কাছে খাতা নিয়ে যেতে হল ল্যানসনকেই। বনিরা খুব সম্ভব হেন্ডারসনকে কিছু বলেছিল। তিনি একবার ভুরু তুলে ল্যানসনকে দেখে ডেকে নিলেন বোর্ডে। নিখুঁতভাবে অঙ্কটা কষে দেবার পর শুধু পিঠে হাত রেখে বললেন, “ওয়েল ডান।”

এরপর থেকে বনিরাই ল্যানসনকে ডেকে নিতে থাকল নিজেদের সঙ্গে। প্রায়ই বনি তাকে নানারকম ছোটো ছোটো লিফলেট দিত গোপনে। অনামা লেখকদের এইসব পুস্তিকায় লেখা থাকত কীভাবে এই দেশে অ্যাংলোদের ব্যবহার করছে ইংরেজ সরকার। কতটা ঘেন্না পুষে রেখেছে নেটিভরা তাদের জন্য। ল্যানসন বারবার জিজ্ঞেস করেছে, বনি কোথা থেকে এসব পায়? বনি বলেনি। এড়িয়ে গেছে। বলেছে সময় হলেই বলবে।

সময় হল।

সেদিন কলিঙ্গবাজারে ঢোকার মুখেই অচেনা এক লোককে দেখতে পায় ল্যানসন। এই পাড়ার নিয়মিত খদ্দের না। তখন সন্ধে নেমে এসেছে। রাস্তার ধারে ছোট্ট হালুইকরের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে লোকটা ফিসফিস করে লিলির সঙ্গে কী যেন কথা বলছে। সন্দেহ হতে ল্যানসন পাশেই একটা পাকুড়গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল। লিলি তো কোনও দিন ঘরের বাইরে বেরোয় না! অবাক হয়ে সে দেখতে পেল লিলি সম্পূর্ণ অচেনা সেই লোকটাকে তার হাত থেকে সোনার বালা খুলে দেখাল। লোকটা হাতের কাগজের সঙ্গে সেই বালা মিলিয়ে নিল। তারপর লিলিকে একটা ফটো দেখাল। নাড়তেই হেসে লোকটা লিলির হাতে কটা টাকার নোট গুঁজে দিল। লিলিও হাসিমুখে গলির ভিতর ঢুকে গেল।

ল্যানসন লোকটাকে চেনে না। বালাটা চেনে। গতকালই লিলি তার মায়ের কাছে এসে বালাটা দেখিয়ে গেছে। তার সোহাগের সাহেব ওয়ার্নার নাকি এটা দিয়েছে। ল্যানসনও দেখেছে বালাটা। হাতে নিয়ে। তাই ভুল হবার উপায় নেই। তাহলে এই লোকটা এখানে কী করছে? লিলিই বা তাকে বালাটা দেখাল কেন? ল্যানসন লোকটার পিছু নিল। মোড় ঘুরে নিউ মার্কেট পেরিয়েই যখন একদল লাল পাগড়ির কাছে গিয়ে লোকটা কী যেন বলতে লাল পাগড়ি লম্বা স্যালুট ঠুকে তার জন্য পালকি ডেকে দিল, তখন আর সন্দেহ রইল না। ওয়ার্নারের পিছনে পুলিশ লেগেছে।

ল্যানসন বেইমানি করতে পারবে না। যে ওয়ার্নারের জন্য আজ সে পড়াশুনো করতে পারছে, জলপানি পাচ্ছে, সে পুলিশের হাতে ধরা পড়বে, এ হতেই পারে না। আজ বুধবার। প্রতি শুক্রবার লিলির ঘরে আসে ওয়ার্নার। তার আগেই তাকে সাবধান করতে হবে। কিন্তু সে ওয়ার্নারের ঠিকানা জানে না। শুক্রবার স্কুলে গেল না সে। বিকেল হতে না হতে দাঁড়িয়ে রইল গলির একেবারে মুখে। বেরোবার সময় সে দেখে এসেছে লিলির বাড়ি ঘিরে ফেলেছে একদল সাদা পোশাকের পুলিশ। আজ ওয়ার্নারের রেহাই নেই।

সন্ধে হতেই গলি থেকে একটু দূরে একটা ফিটন এসে থামল। দরজা খুলে গেল। ভিতরে ওয়ার্নার। একা। হাতে একটা বাক্স। ওয়ার্নার বাক্স থেকে কিছু একটা বের করার চেষ্টা করছে। ল্যানসন যেন বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছে, এভাবে গাড়ির পাশে গিয়ে স্পষ্ট কিন্তু চাপা উচ্চারণে বলে উঠল, “ডিঙুর।” এই পাড়ায় আসা যাওয়া করে, কিন্তু এই শব্দের মানে জানে না, তা হতে পারে না। কলকাতার একেবারে নিচুতলায় থাকা হিজড়ে আর বেশ্যাদের কাছে এই শব্দের একটাই মানে, ‘পুলিশ’। এই বার্তা অস্বীকার করার ক্ষমতা ওয়ার্নারের নেই। সে দ্রুত দরজা বন্ধ করে গাড়ি ছোটাতে বলল।

পরের সোমবার ক্লাস শেষ হতেই বনি ল্যানসনকে বলল, “একটু অপেক্ষা করে যাও। হেন্ডারসন সাহেব ডেকেছেন।” ল্যানসন অবাক। আজ হেন্ডারসনের ক্লাস ছিল না। তিনি কাউকে ডাকেন বলেও শোনা যায়নি। তবে কি সে কোনও গর্হিত অপরাধ করে বসল? বনিই নিয়ে গেল হেন্ডারসনের কামরায়। ওকে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা ভেজিয়ে দিল। হেন্ডারসন একটা মোটা বইতে মুখ ডুবিয়ে বসে ছিলেন। ল্যানসনকে দেখেই হাসলেন, “কাম ইন মাই বয়।”

“আপনি ডেকেছিলেন স্যার?”

“হ্যাঁ। বসতে পারো।”

ল্যানসন তবুও দাঁড়িয়ে রইল।

“তোমায় একটা কথা জানানো প্রয়োজন। প্রয়োজন কেন, কর্তব্য। আমার বন্ধু ওয়ার্নার নিরাপদে এই দেশ ছেড়ে যেতে পেরেছে। অ্যান্ড দি এনটায়ার ক্রেডিট গোজ টু ইউ। ব্রাদার ওয়ার্নার যাবার আগে আমার কাছে এসেছিল। তোমার বিষয়ে সব কিছু বলেছে। তোমার এক দিদি আছে না? মারিয়ানা? যাকে সেটন তুলে নিয়ে গেছে?”

দিদির নাম শুনতেই ল্যানসনের চোখে জল। সে কোনওক্রমে মাথা নাড়াল।

“চিন্তা কোরো না। তোমার দিদিকে উদ্ধার করে আনার দায়িত্ব আমাদের। আমরা তোমার দিদির আর মায়ের দেখভাল করব। তোমার মায়ের চিকিৎসা করাব। কিন্তু শর্ত একটাই। তোমাকে আমাদের হয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের সংঘের কাজ। এ কাজে প্রাণসংশয় হতে পারে, কিন্তু যদি জিতি তবে সপাটে চড় মারা যাবে যারা আমাদের অবজ্ঞা করে তাদের মুখে। সুযোগ এসেছে। কিন্তু দরকার ভালো উদ্যমী ছেলের। কি, পারবে?”

অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ল ল্যানসন, “আই ডাউট স্যার।”

“বাট আই হ্যাভ নো ডাউটস। আমি অনেকদিন ধরে তোমায় দেখছি। বনিরাও আমায় তোমার কথা বলেছে। তোমার সবচেয়ে বড়ো সুবিধে, তোমায় দেখে এ দেশের নেটিভ বলেই মনে হয়। বাংলা আর হিন্দিও তুমি নেটিভদের মতোই বলতে পারো। শুনলাম তোমার নাকি একটা নেটিভ নামও আছে। এটা আমাদের কাজে লাগবে। কিন্তু তার জন্য তোমাকে আমাদের সংঘে যোগ দিতে হবে। সংঘে থাকলে সব পাবে। বিশ্বাসঘাতকতা করলে সব কিছু কেড়ে হয় অনন্ত জীবন, নয় বিস্মৃতির মৃত্যু। রাজি?”

ল্যানসেন কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না,”কোন সংঘ? কীসের কথা বলছেন স্যার?”  

“শোনো, হ্যাঁ বা না বলার আগে তুমি ভেবে নিতে পারো”, বলে চললেন হেন্ডারসন, “তোমার উত্তর যদি ‘না’ হয়, আমাদের আজকের আলোচনাটা কোনও দিন হয়নি। সেক্ষেত্রে তোমার মা বা দিদির কথা তোমাকেই ভাবতে হবে। কিন্তু যদি ‘হ্যাঁ’ হয়, দেন দেয়ার ইজ নো টার্নিং ব্যাক। নাও ইউ ক্যান টেক ইয়োর টাইম সন।”

খুব বেশি সময় নিল না ল্যানসন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলল, “আমি রাজি স্যার। কিন্তু এই সংঘের ব্যাপারে তো আমি কিছুই জানি না।”

চেয়ার থেকে উঠে, হাতের বইটা তাকে ঢুকিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ রেখে হেন্ডারসন বললেন, “হ্যাভ ইউ এভার হার্ড দ্য নেম অফ জাবুলন?”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *