র‌্যামেসিস রা-এর রক্তধারা

র‌্যামেসিস রা-এর রক্তধারা

তাঁবুর কাছেই একটা ঢিপির ওপর বসে আহার সেরে নিচ্ছিলাম আমি। ভিতরে ভিতরে ভীষণ উত্তেজিত লাগছিল। আমি যেখানে বসে আছি তার কিছু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে এক অনুচ্চ পিরামিড। অনুচ্চ মানে, উচ্চতা আড়াইশো ফুট হবে। তবে কায়রোর অনুবর্তী গিজার গ্রেট পিরামিডের তুলনায় একে শিশুই বলা যায়। ওই পিরামিডের অভ্যন্তরে আজ আমার নৈশ অভিযান। আমি পুরাতত্ত্ব গবেষক হার্বাট, আমার জীবন-যৌবন যার খোঁজে উৎসর্গ করে আজ বার্ধক্যের সীমানায় এসে উপনীত হয়েছি, অমানুষিক পরিশ্রম করে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অতিবাহিত করেছি এক ঊষর মরুভূমির দেশে, তা আজ আমার প্রায় করতলগত।—ফারাও দ্বিতীয় র‌্যামেসিসের বংশধর, র‌্যামেসিস রা-র কবর! ওই পিরামিডের এক গোপন কক্ষে লুকিয়ে রাখা আছে তা। ফারাও র‌্যামেসিসের মতো অতুলনীয় কীর্তি কাহিনি তিনি স্থাপন করে যেতে পারেননি। দ্বিতীয় র‌্যামেসিসের রাজত্বকাল ছিল আজ থেকে ৩০০০ বছর আগে। মিশরের ইতিহাসে সব থেকে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তাঁর রাজত্বকাল। আবু সিম্বলের গ্রেট টেম্পল সহ বহু পুরাকীর্তির জনক তিনি। ফারাও র‌্যামেসিস ও তাঁর প্রিয় রানি নেফারতিতির বহু মূর্তি আজও খোদিত আছে বহু প্রাচীন মন্দির গাত্রে। কিন্তু র‌্যামেসিস রা-র খোঁজ পাওয়া যায় না কোথাও। কোনো উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থাপত্য তৈরি করে যেতে পারেননি এই র‌্যামেসিস রা, মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ করেননি নিজের নাম। তাই ইতিহাস তাকে ভুলে গেছে। বহমান নীল নদের স্রোত, আর সদা সঞ্চরণশীল বালির সমুদ্র ঢেকে দিয়েছে র‌্যামেসিস রা-র নামটাকেও। আমি তার সন্ধান পাই আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামের মিশর গ্যালারির এক অতি প্রাচীন পার্চমেন্ট প্যাপিরাস থেকে। আর তারপরই শুরু করি অনুসন্ধান। কঠিন পরিশ্রম আর অধ্যবসায় আমাকে পঁচিশ বছর পরে আজ পৌঁছে দিয়েছে অভীষ্ট লক্ষ্যের দ্বারপ্রান্তে। হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত, ওই পিরামিডের এক গোপন কক্ষেই আড়াই হাজার বছর ধরে ঘুমিয়ে আছেন ফারাও র‌্যামেসিস রা। আপনার হয়তো মনে হতে পারে ‘রা’ তো বিখ্যাত কেউ ছিলেন না, তাহলে এই পিরামিডের এই পদপ্রান্তে পৌঁছতে, এত কৃচ্ছ্রসাধন করলাম কেন আমি? হ্যাঁ, এ কথা আগেই বলেছি যে তিনি মিশরের ইতিহাসে তেমন কোনো নজির স্থাপন করতে পারেননি। হয়তো করার চেষ্টাও করেননি। মাত্র তিন দশক তিনি রাজত্ব করেন এই নীলনদ অববাহিকায়। আর ওই তিন দশকই তিনি ব্যয় করেছিলেন মানবদেহবিদ্যা অধ্যয়নে। দেহবিজ্ঞানে প্রাচীন মিশরীয়রা বহু ধরনের উৎকর্ষতা লাভ করেছিলেন, নশ্বর দেহকে হাজার হাজার বছর ধরে অবিকৃত রাখার কৌশল তাঁরা আবিষ্কার করেছিলেন তা আমরা জানি। ল্যুভরের প্যাপিরাসে হিয়ারোগ্লিফিকে বর্ণিত কথাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে ‘রা’ ওই বিদ্যাতে চূড়ান্ত পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন, রক্ত বিষয়ক এমন কিছু তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যা নাকি ভবিষ্যতের পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেবে। এ বিষয়ে তিনি এক পুঁথি রচনা করেন, যা তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর সারকোফেগাস অর্থাৎ কফিনের পাথুরে আধারের মধ্যেই রাখা হয়। এবার হয়তো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে কীসের অন্বেষণে সারাটা জীবন কাটিয়েছি আমি? ‘রা’—ওই পুঁথি। হয়তো তাক লাগিয়ে দেবে সারা পৃথিবীকে। হ্যাঁ, এমন ব্যাপারের সুষ্পষ্ট ইঙ্গিত দেওয়া আছে পার্চমেন্টে। যদিও রক্ত সম্বন্ধীয় আবিষ্কারের ব্যাপারটা আসলে কী, তা বলা নেই ল্যুভরের পার্চমেন্ট প্যাপিরাসে।

খেতে খেতে উঠে দাঁড়িয়ে পশ্চিমদিকে তাকালাম আমি। অনেক দূর পর্যন্ত সেদিকে দেখা যাচ্ছে। এখন শেষ বিকাল। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। ওই যে দূরে দিগন্তে একটা রেখা চিকচিক করছে, ওটাই নীল নদ। আমি দেখার চেষ্টা করলাম আমার যে দুজন স্থানীয় মিশরীয় সঙ্গীর ফিরে আসার কথা, তারা ফিরে আসছে কিনা? আমার নির্দেশেই ওরা এখানে যেসব কুলির দল ছিল তাদের ছেড়ে আসতে গেছে নীল নদের অনতিদূরবর্তী এক গ্রামে। গতকাল পর্যন্ত ওই কুলির দল এখানেই খননকার্যে লিপ্ত ছিল। ওদের আমি সরিয়ে দিলাম কারণ, সমাধিকক্ষের গোপনীয়তা বজায় রাখতে চাই আমি। যে দুজন ফিরে আসবে তারাও সঙ্গে না থাকলেই ভালো ছিল। কিন্তু আরও কয়েকটা পাথরের দেওয়াল ভাঙতে হবে। অত প্রাচীন পাথুরে শবাধারটাও খুলতে হবে, যা আমার পক্ষে একা করা সম্ভব নয়, তাই ওদের রাখতে হয়েছে। তবে আমার গোপনীয়তার কারণ এই নয় যে, আমি অবৈধভাবে পিরামিডে প্রবেশ করেছি বা কবর চোরদের মতো কবরের সোনাদানা লুণ্ঠন করতে চাই। সরকারি অনুমতিপত্র আমার আছে, তাছাড়া সরকার এই টেম্পলকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ ইতিপূর্বে সরকারিভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে কোনো কবরের সন্ধান পাওয়া যায়নি। আমার ভয়ের কারণ হল, স্থানীয় খননকারীদের মধ্যে অনেকে বড় বড় প্রত্ন-অভিযাত্রী দলের হয়ে এজেন্টের কাজ করে। ছোট ছোট অভিযাত্রীদের সঙ্গে ঘোরে তারা। তারপর দৈবাৎ তেমন কিছু বড় ধরনের আবিষ্কার হলে, তারা সঙ্গে সঙ্গে বড় দলের কাছে সে খবর পৌঁছে দেয়। অর্থবল, লোকবলে বলীয়ান বড় অভিযাত্রীরা এসে কোনো হতভাগ্যের সারা জীবনের কৃতিত্ব, পরিশ্রম আত্মসাৎ করে। এ ঘটনা বহু ঘটে। আমি একা, বলতে গেলে প্রায় নিঃস্ব এই মুহূর্তে। আমি চাই না ওরকম কোনো বড় দল এসে ছিনিয়ে নিক আমার পরিশ্রমের ফল। তাই আমার এই গোপনীয়তা।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমি আমার নৈশ অভিযানের সঙ্গীদের উটের পিঠে চেপে ফিরে আসতে দেখলাম। আশ্বস্ত হলাম আমি। এরপর আমি ফিরে তাকালাম পিরামিডের দিকে। অস্তাচলগামী সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে পিরামিডের শীর্ষে। অপূর্ব লাগছে! ভাবলাম একটা ছবি তুলে রাখি। ঢিপি থেকে নেমে তাঁবুর দিকে ক্যামেরা আনবার জন্য এগোতে যাচ্ছি, ঠিক সেই সময় দেখতে পেলাম একটা লোককে সমাধি মন্দিরে কয়েক হাত তফাতে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে অস্তাচলগামী সূর্যের দিকে। ঈষৎ ঝুঁকে প্রার্থনার ভঙ্গিতে যেন সে দাঁড়িয়ে। এখানে লোক এল কোথা থেকে? আমি একটু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। একটু পর যেন আমার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন হল লোকটা। মুখ তুলে দেখল আমাকে। তারপর ধীর পায়ে সামনে ছোট বালিয়াড়িটা অতিক্রম করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তার পরনের শতছিন্ন স্থানীয় পোশাক দেখে আমার তাকে ভিখারি গোত্রের লোকই মনে হল। খাদ্যের লোভে এরা যেখানে খননকার্য চলে সেখানে তাঁবুর আশেপাশে ঘুরঘুর করে। এ জাতীয় লোক আমি দেখেছি।

সামনে এসে দাঁড়াবার পর, আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল আমার হাতে তখনও ধরা একটা খণ্ড রুটির ওপর। তাতে তার ওপর আমার প্রাথমিক ধারণা বদ্ধমূল হল। কয়েক মুহূর্ত দেখার পর আমি তাকে বললাম, ‘এ রুটি তুমি খাবে?’ লোকটা আমার কথা শুনে মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে প্রশ্ন করল, ‘ও রুটি তুমি এঁটো করেছ?’

লোকটার প্রখর আত্মমর্যাদা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মৃদু হেসে বললাম, ‘না, এ টুকরো আমি এঁটো করিনি। তুমি নাও।’ এই বলে রুটিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।

লোকটা কিন্তু হাত বাড়াল না। একটু ইতস্তত করে সে বলল, ‘রুটির জন্য কী করে দিতে হবে তোমার?’ আমি বললাম, ‘কিছু করতে হবে না। এমনিই দিচ্ছি। আরও দিতে পারি, তাঁবুতে আছে।’

আমার কথা শুনে লোকটা ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না, আমি দান গ্রহণ করি না।’ চমকে উঠে আমি ভালো করে তাকালাম তার দিকে। লোকটার সুগোল চিবুক, চওড়া কপাল, গায়ের রং, কাঁধের কৌণিক গড়ন, সংকীর্ণ নিতম্ব দেখে আমার অভিজ্ঞ চোখ মুহূর্তের মধ্যে আমাকে জানিয়ে দিল, খাঁটি মিশরীয় রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে ওর ধমনীতে! চোখদুটো কেমন গভীর আর উজ্জ্বল। তার ওই প্রশস্ত কপালের আড়ালে যেন লুকিয়ে আছে প্রচণ্ড ধীশক্তি। এমন লোক সচরাচর দেখা যায় না। আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে, আর সেও আমার দিকে।

কিছুক্ষণ পর উটের পায়ের শব্দ আর কথাবার্তার শব্দে সম্বিত ফিরল আমার। আমার সঙ্গীরা কাছে এসে পড়েছে। পিরামিডে ঢোকার আগে কিছু প্রস্তুতি বাকি আছে। এই লোকটাকে এবার সরাতে হবে। আমি লোকটার হাতটা টেনে রুটিটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘যাও এবার।’ লোকটা কিন্তু গেল না। রুটি হাতে দাঁড়িয়ে রইল। এবার আমার একটা অস্বস্তি শুরু হল। ও দাঁড়িয়ে আছে কেন? ঠিক এই সময় আমার উটওলা স্থানীয় লোক দুজন আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। আর ওই লোকটাকে দেখে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ভাগ ভিখারি, ভাগ এখান থেকে! ‘ভিখারি’ কথাটা কানে যেতেই লোকটার চোখ দুটো যেন দপ করে জ্বলে উঠল। আমার সেই সঙ্গীর প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণায় চিৎকার করে সে বলল, ‘আমি ভিখারি নই, ভিখারি তোমরা। যারা অর্থের লোভে সমাধিমন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট কর! মৃতদেহের প্রতি অসম্মান কর! ভিখারি তোমরা।’

যে লোকটা তাকে চলে যেতে বলেছিল সে এবার হঠাৎ তার জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে উট চালানোর কাঁটাঅলা লাঠিটা ছুড়ে মারল ছিন্ন পোশাক পরা মিশরীয়কে লক্ষ্য করে। ঘটনাটা ঘটল আমি তাকে বাধা দেবার আগেই। সেটা গিয়ে লাগল লোকটার কনুইতে। কাটার খোঁচায় সঙ্গে সঙ্গে রক্তপাত শুরু হল। লোকটা হাত দিল কনুইতে। তারপর হাতের তালুতে রক্ত নিয়ে মেলে ধরল নিজের চোখের সামনে। রক্তটা দেখে মুহূর্তের জন্য কেমন যেন একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল তার চোখের কোণে। এরপর সেই অদ্ভুত লোকটা আর দাঁড়াল না। আমার দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল পিরামিডের আড়ালে।

লোকটা চলে যাবার পর যে লোকটা লাঠি ছুড়েছিল তাকে আমি তিরস্কার করলাম তার এই ব্যবহারের জন্য। তারপর আমি তাদের নিয়ে তাঁবুর দিকে এগোলাম আসন্ন নৈশ অভিযানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে। অভিযানের উত্তেজনায় কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ভুলে গেলাম ওই লোকটার কথা।

সূর্য ডুবে গেল। তারপর যখন চাঁদ উঠল তখন গোছগাছ করে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়ালাম আমরা। চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত সারা উপত্যকা। তার মধ্যে আমাদের কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে পিরামিড, যেখানে ঘুমিয়ে আছেন ফারাও র‌্যামেসিস রা। আড়াই হাজার বছর পর আমিই প্রথম মানুষ যে প্রবেশ করব ঘুমন্ত রাজার কক্ষে। সঙ্গী দুজনকে নিয়ে আমি এগোলাম পিরামিডের দিকে। খানিকক্ষণের মধ্যেই পিরামিডের অন্ধকার গর্ভে প্রবেশ করলাম আমরা। ভিতরে ঢোকার পরই মশাল জ্বালিয়ে নিল সঙ্গী দুজন। আমার হাতে ইলেকট্রিক টর্চ। আপনি নিশ্চয় ভাবছেন আমরা নীচের দিকে নামব? কারণ, পিরামিডের যে অংশ পৃথিবীর দিকে দৃশ্যমান হয় তা নিরেট হয়। আর ভূগর্ভস্থ কক্ষে থাকে সমাধি। এ পিরামিডেও ভূগর্ভস্থ কক্ষ আছে বটে তবে তা লোককে ফাঁকি দেবার জন্য। এই প্যাপিরাস থেকে আমি জেনেছি, এই ব্যতিক্রমী পিরামিডে সমাধিকক্ষ লুকোনো আছে পিরামিডের উপরিভাগে। যে খবর অন্য কেউ না জানার কারণে ইতিপূর্বে পিরামিডে প্রবেশ করলেও তারা সমাধিকক্ষের সন্ধান পায়নি। সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করে তারা অনুসন্ধান করেছিল ভূগর্ভে। নইলে কবে প্রত্নবিদ বা চোরের দল পৌঁছে যেত সমাধি কক্ষে!

পিরামিডের ভিতরে ঢুকে কাজ শুরু করলাম। মাটির প্রায় সমতলে একটা ছদ্ম দেওয়াল আমার নির্দেশে গাঁইতি দিয়ে সঙ্গীরা ভেঙে ফেলতেই তার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল নিচু ছাদওলা সংকীর্ণ এক সিঁড়ি। মশালের আলোতে মাথা নিচু করে গুঁড়ি মেরে ওপরে উঠতে শুরু করলাম আমরা। ভ্যাপসা বাতাসে শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আড়াই হাজার বছরের জমে থাকা ধুলোতে সর্বাঙ্গ মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। হাত লেগে যেখানে দেওয়ালে ধুলোস্তর সরে যাচ্ছে, সেখানেই দেওয়ালের গায়ে ফুটে উঠেছে বিচিত্র সব প্রাচীন চিত্র। নানা মিশরীয় দেবতার ছবি। তার কোনোটা বা বাজপাখির মাথা আর মানুষের দেহধারী আকাশদেব হোরাসের ছবি, কোনোটা ভেড়ার মাথাওলা দেবতা হ্যাথোরের, কোনোটা আবার সূর্যদেব ”আমন রা-র। সিঁড়ি সোজা ওপরে ওঠেনি। ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠছে। মাঝে মাঝে অপরিসর সব কক্ষ। তার দেওয়ালও বিচিত্র সব ছবিতে চিত্রিত।

আনুমানিক দেড়শো ফিট ওপরে ওঠার পর একটা পাথুরে দেওয়াল আমাদের পথ আটকে দাঁড়াল। বেশ শক্ত দেওয়াল। সে দেওয়াল ভাঙতে আমাদের ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। তার ওপাশে এক প্রশস্ত সিঁড়ি সোজা ওপরে উঠে গেছে। সেখানে পা রেখেই বুঝতে পারলাম এই সিঁড়ি আমাদের পৌঁছে দেবে আমাদের অভীষ্ট কক্ষের কাছে। সিঁড়ির দু-পাশে দেওয়ালে আঁকা রয়েছে মৃত ফারাওয়ের শেষযাত্রার ছবি।

সত্যি সেই সিঁড়ি আমাদের কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে দিল এক চত্বরের মতো জায়গায়। তার এক পাশে একটা দরজা, চত্বর সংলগ্ন কক্ষে প্রবেশের জন্য। আর সেই দরজার সামনে পা ছড়িয়ে বসে দরজা আগলাচ্ছেন প্রাচীন মিশরীয়দের কুকুরদেহী মৃত্যুদেব অনুবিসের পাথুরে মূর্তি। মশালের আলোতে তার চোখ আর থাবার নখ জ্বলজ্বল করছে। কেমন একটা বঙ্কিম হাসি ফুটে আছে তার মুখে। সে হাসি পরিহাস করছে অর্বাচীন আগন্তুকদের। কারুকাজ করা প্রাচীন কাঠের দরজার দু-পাশে পাথুরে দেওয়ালে খোদিত স্বর্গদেব অসিরিসের মূর্তি। যা দেখে আমার বুঝতে অসুবিধা হল না ওই দরজাই হল সমাধিকক্ষের প্রবেশ মুখ। উত্তেজনায় আমার পা তখন কাঁপতে শুরু করেছে।

চৌকাঠের ধুলো সরিয়ে দরজা খুলতেই একটা কাণ্ড ঘটল। ভিতরের কক্ষের একপাশের পাথুরে দেওয়ালের এক পাশ যেন ঘরঘর শব্দে সরে গেল! আর সেখান দিয়ে একরাশ চাঁদের আলো এসে প্লাবিত করল সমাধিকক্ষ। আমরা পা রাখলাম ঘরের ভিতর। ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা বেদি মতন জায়গাতে রাখা আছে পাথরের তৈরি শবাধার—ফারাও র‌্যামেসিস রা-র সারকোফেগাস, দেওয়ালের গায়ে নানা কুলুঙ্গিতে মমির অন্তযন্ত্র রাখার ফুলদানি আকৃতির সোনার পাত্র, ফারাওয়ের ব্যবহৃত বহুমূল্য সব জিনিস! চাঁদের আলোতে ঝলমল করছে সেসব। প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল সবার। তারপরই আমি সঙ্গীদের নির্দেশ দিলাম সারকোফেগাসটা খুলে ফেলার জন্য। তারা গাঁইতির চাড় দিয়ে শবাধারটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। আর আমি উন্মুক্ত দেওয়ালের কাছে গিয়ে তাকালাম বাইরের দিকে। চাঁদের আলোতে বাইরে বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বুঝতে পারলাম এখন আমরা পিরামিডের শীর্ষে অবস্থান করছি। আড়াই হাজার বছর পর চাঁদের আলো, মুক্ত বাতাস প্রবেশ করেছে এই কক্ষে। ভাবতেই আমার কেমন অদ্ভুত লাগল! আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইলাম চাঁদের দিকে।

হঠাৎ বেশ শব্দ করে শবাধারের আচ্ছাদন মেঝেতে খসে পড়ল। যারা কাজ করছিল তারা ঝুঁকে পড়ল শবাধারের ভিতরে। আমিও এগোলাম সেদিকে। কিন্তু তার কাছাকাছি পৌঁছবার আগেই আমার সঙ্গী দুজনের একজন চিৎকার করে অপরজনকে বলল, ‘এ রাজার ঐশ্বর্য আমরাই নেব। শেষ করে দে সাহেবটাকে!’ মুহূর্তের মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম কী হতে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের একটা দেওয়ালের কাছে প্রাণ বাঁচাবার জন্য সরে এলাম আমি। আর আমার সঙ্গী দুজন গাঁইতি হাতে এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে। অসহায় ভাবে আমি তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে। ক্রমশই এগিয়ে আসছে তারা! তারা তখন আমার প্রায় কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে, ঠিক সেই সময় দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর প্রবেশ করল এক মূর্তি। তাকে দেখে গাঁইতি হাতে লোক দুটো থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। চাঁদের আলো এসে পড়েছে সেই লোকটার মুখে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমি চিনতে পারলাম তাকে। বিকেলের রুটির জন্য আসা সেই মিশরীয়! ও এই কবরের খোঁজ পেল কীভাবে?”

লোকটা এগিয়ে আসতে লাগল গাঁইতি ধরা লোক দুজনার দিকে। হঠাৎই এরপর আমার সঙ্গী দুজনের গলা দিয়ে বেরিয়ে এল ভয়ার্ত চিৎকার। গাঁইতি ফেলে লোকটাকে দেখে পালাবার জন্য ছুটল উন্মুক্ত দেওয়ালের দিকে। দেওয়ালের বাইরে যে মহাশূন্যতা খেয়াল রইল না তাদের। প্রাণভয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে লাফ দিতেই অতল গহ্বর গ্রাস করে নিল তাদের। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘটে গেল ব্যাপারটা।

আমার সঙ্গী দুজনের অন্তর্ধানের পর লোকটা ফিরে তাকাল আমার দিকে, তারপর আমার উদ্দেশে শান্ত কন্ঠে বলল, ‘তুমি চলে যাও এখান থেকে। সম্পদ লুন্ঠন করে কবর অপবিত্র কোরো না। শান্তিতে ঘুমোতে দাও ফারাওকে।’

আকস্মিক মৃত্যুর মুখ থেকে রক্ষা পাবার বিহ্বলতা কাটিয়ে আমি ত্রাণকর্তার জবাবে বললাম, ‘আমি কবর লুন্ঠন করতে আসিনি। এসেছি ফারাওয়ের পুথির খোঁজে। আমি জানতে চাই তাতে এমন কী লেখা আছে যা হাজার বছর পরও মানুষকে বিস্মিত করবে। ওই পুথিটাই শুধু প্রয়োজন। যা রাখা আছে ওই শবাধারে।”

কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর মিশরীয় আমার কথা শুনে বলল, ”হ্যাঁ, ওটা ওখানেই আছে। ওটা তুমি পাবে না। তবে তোমার প্রশ্নের জবাব তুমি পাবে। তোমার রুটির দাম মিটিয়ে দেব আমি।’ এই বলে সে উন্মুক্ত কফিনের কাছে এগিয়ে গিয়ে আমাকে ইশারাতে কাছে ডাকল। কম্পিত পায়ে আমি এগিয়ে গেলাম সেখানে, তারপর লোকটার আঙুলের নির্দেশে উকি দিলাম সারকোফেগাসের ভিতর। স্বর্ণভুষণে সজ্জিত ফারাও র‌্যামেসিস- রা শুয়ে আছেন দারুকাঠের কফিনে। তার বুকের ওপর রাখা আছে অমূল্য সেই পুথি। ফারাও তার হাত দুটো দিয়ে পুথিটা চেপে ধরে রেখেছেন। আর এরপরই ফারাওয়ের মুখ বসানো সোনার মুখোশ দেখে চমকে উঠলাম আমি। আমি জানি ওই মুখোশ জীবিত ফারাওয়ের মুখের হুবহু প্রতিলিপি হয়। আর ওই মুখের আর এক মালিক জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। হুবহু এক মানুষ! আমার সঙ্গীরা কেন বাইরে ঝাঁপ দিল তা বুঝতে পারলাম আমি। চমকে উঠে আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিকে বললাম, ‘তুমি কে?’

মিশরীয় জবাব দিল, ‘ভয় পেয়ো না, আমি মানুষ। র‌্যামেসিস রা-র বংশধর।’ আমি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।

লোকটা এবার আমাকে বলল, ‘পুথিতে কী লেখা আছে তা নিশ্চয়ই এখন অনুমান করতে পারছ তুমি? এবার তাহলে কক্ষ ত্যাগ করো।’

আমি তার কথা শুনে অবাক হয়ে বলতে যাচ্ছিলাম, ‘পুথি পাঠ না করে আমি কী করে বুঝলাম ওতে কী লেখা আছে?’ কিন্তু তার আগেই আমার চিন্তাশক্তি ঝিলিক দিয়ে উঠল! হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারলাম ওতে কী লেখা আছে। লেখা আছে রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষা করার এমন এক কৌশল, যাতে কয়েক হাজার বছর পরও বংশধরদের মধ্যে ফুটিয়ে তোলা যায় নিজের প্রতিলিপি। হুবহু একরকম! যার প্রমাণ আমার সামনে বিদ্যমান। আমি আর কথা বললাম না। কফিনে শায়িত প্রজ্ঞাবান ফারাওয়ের প্রতি নীরবে অন্তরের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। পিছনে ঘরের ভিতরে একটা শব্দ হল, বুঝতে পারলাম দেওয়ালের ফাটলটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। তারপরে বন্ধ হয়ে গেল দরজাও।

পরদিন সকালে আমি তখন আমার নৈশ অভিযানের সহচরদের কবর দিয়ে উটের পিঠে মালপত্র বাঁধছি, কিছুক্ষণ আগেই একটা বড় দল এখানে এসেছে সিনেমার শুটিং করার জন্য, অনেক লোকজন তখন পিরামিডের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ফারাওদের পোশাকে সেজে, হঠাৎ কানে এল আমার কাছাকাছি একজন লোক তার সঙ্গীকে বলল, ‘ওই ঢিপির ওপর যে ভিখারিটা বসে আছে তাকে খাবার দিতে গেলাম নিল না! ও বলে কিনা ও রাজার বংশধর। দান নেয় না।’ কথাগুলো শুনে তার সঙ্গী বলল, ‘লোকটা নির্ঘাত পাগল হবে!’

কথাগুলো কানে যেতেই আমি চমকে তাকালাম ঢিপির দিকে। ঢিপির ওপর বসে সেই মিশরীয় তাকিয়ে আছে আমার দিকে। লোক দুজনের কথাগুলো মনে হয় তার কানেও পৌঁছেছে। একটা চাপা হাসি ফুটে উঠেছে তার ঠোঁটের কোণে। মাথা ঝুঁকিয়ে সে আমার উদ্দেশে বিদায় সম্ভাষণ জানাল। আমি প্রত্যুত্তরে মাথা ঝুঁকিয়ে উঠে বসলাম উটের পিঠে। র‌্যামেসিস রা-র পিরামিড তখন প্রভাতী সূর্যকিরণে ঝলমল করছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *