রেডিয়ো আর্টিস্ট

রেডিয়ো আর্টিস্ট

ঘড়িতে ছ-টার ঘণ্টা বাজল৷ শীতের বেলা, অন্ধকার নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে৷ সতীনাথ বাড়ুজ্জ্যে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবলেন; ভদ্রলোক এখনও এলেন না কেন? প্রাসাদবাবুতো বলেছিলেন; ‘ঠিক সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছে যাবেন ভদ্রলোক৷ বেশ কিছুদিন ধরে তার পিছনে ঘুর ঘুর করছেন একটা কাজের জন্য৷ বয়স হলেও গলাটা এখনও ঠিক আছে৷ দেখুন যদি ওনাকে দিয়ে আপনার কাজ চলে৷ আপনার রেডিয়োর নাটক উনি নিয়মিত শোনেন৷ এক কথায় বলতে গেলে ভদ্রলোক আপনার ফ্যান৷’

সতীনাথ বলেছিলেন; ঠিক আছে, পাঠিয়ে দিও৷ একবার কথা বলে দেখি৷ ঠিক সাড়ে পাঁচটায় কিন্তু…৷’ সতীনাথ আধঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন অথচ ভদ্রলোকের পাত্তা নেই৷ সাতটার মধ্যে রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে পৌঁছতে হবে সতীনাথকে৷ সে জায়গা কলকাতার একটু বাইরে৷ স্টুডিয়োটা দেখার পর আবার ফিরেও আসতে হবে তাঁকে৷ সাড়ে আটটায় আর্মহাস্ট স্ট্রিটে একটা অনুষ্ঠানে ঘোষকের ভূমিকা পালন করতে হবে তাঁকে৷ সরকারী অনুষ্ঠান, মন্ত্রী-মন্ত্রী থাকবেন৷ সঠিক সময় উপস্থিত না হতে পারলে একটা বিতিকিচ্ছিরি কান্ড হবে৷ আর দেরি করা যায় না৷ এ সব সাত-পাঁচ ভেবে সতীনাথ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় ড্রয়িংরুমে ঢোকার দরজার পর্দার আড়াল থেকে একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল– ‘আসতে পারি?’

সতীনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ আসুন৷’

ঘরে ঢুকলেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক৷ পরনে ধুতি পাঞ্জাব, চোখে ঘষা কাচের গোল চশমা৷ কাঁধে ঝোলা৷ ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক হাত জোর করে কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম জানিয়ে বললেন, আমার নাম হল গিয়ে বামাপদ মজুমদার৷ প্রসাদবাবু আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন কথা বলার জন্য৷’

সতীনাথ বুঝতে পারলেন, তাহলে এই সেই ভদ্রলোক, যার জন্য তিনি এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন৷’ মৃদু উষ্মা প্রকাশ করে সতীনাথ বললেন, ‘আপনার তো সাড়ে পাঁচটায় আসার কথা ছিল?’

ভদ্রলোক একটু কাচুমাচু হয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে স্যার আমি ঠিক সময়ই এসেছিলাম৷ কিন্তু মেইন গেটের সিকিওরিটির লোকটা কিছুতেই আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিতে চাচ্ছিল না৷ এদিকে আমার কোনো মোবাইল ফোনও নেই যে ব্যাপারটা আপনাকে ফোন করে জানাব৷ আপনি আবার বিখ্যাত মানুষ৷ পাক্কা আধ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ছাড়ল৷ যদি দশটা মিনিট আমাকে সময় দেন৷ খুব আশা নিয়ে এসেছি৷’ সতীনাথ ভালো করে ভদ্রলোকের দিকে তাকালেন৷ তার পরনে বিবর্ণ পোশাক৷ পাঞ্জাবির বুকটা একটা সেফটিপিন দিয়ে আটকানো, চশমার একটা ডাট মনে হয়ে ভেঙে গেছে, সেটা সুতো দিয়ে বেঁধে মেরামতের চেষ্টা হয়েছে, পায়ে সস্তা দামের প্লাস্টিকের চটি৷ কাঁধের কাপড়ের ব্যাগটাও সুতো ওঠা৷ নীচের দিকের একটা ছিদ্র দিয়ে ব্যাগের ভিতরের কাগজ উঁকি দিচ্ছে৷ সব মিলিয়ে একটা বিবর্ণ, বিষণ্ণ অবয়ব৷ দৈন্যতা বেশ প্রকট ভাবেই ফুটে আছে তাঁর পোশাকে৷ সিকিওরিটির লোকটা তাকে আটকে খুব একটা ভুল করিনি৷ মাঝে মাঝে নানা উঠকো লোক সতীনাথের কাছে এসে হাজির হয় রেডিও টিভিতে একটা চান্স করিয়ে দেবার জন্য৷ সতীনাথ তাই সিকিওরিটির ছেলেটাকে বলে রেখেছেন যে ইদানিং কেউ তাঁর সাথে দেখা করতে এলে তাকে ভালো করে জিজ্ঞেসাবাদ না করে যেন তার ফ্ল্যাটে না পাঠানো হয়৷

সতীনাথ তাঁর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বললেন, ‘বুঝলাম৷ কিন্তু আমাকে যে এখন বেরোতে হবে৷ এতক্ষণ আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম৷ আপনি না হয় পরে কোনো সময়… ভদ্রলোক তাঁর কথা শেষ হবার আগেই ব্যাগ্রভাবে বললেন, ‘প্রিজ স্যার প্লিজ৷ জানি আপনি ব্যস্ত মানুষ৷ সেই কাশীপুর থেকে এই বৌবাজার পর্য্যন্ত পায়ে হেঁটে এসেছি স্যার৷ যদি দশ পনেরোটা মিনিট আমায় সময় দেন?’

‘কেন, পায়ে হেঁটে কেন?’ বিস্মিত সতীনাথ জানতে চাইলেন৷

বামাপদ নামের ভদ্রলোক কয়েক মুহুর্ত মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকার পর ঠোঁটের কোনো যেন কষ্ট করে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘ শীতের বেলা তো, হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল৷ হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম৷’

সতীনাথের কিন্তু তাঁর জবাব দেবার ভঙ্গী দেখে মনে হল, ভদ্রলোক সম্ভবত লজ্জায় সত্য গোপন করলেন৷ হয়তো বা তাঁর হাঁটার উদ্দেশ্য সাতটা টাকা বাস ভাড়া বাঁচানো৷ তাঁর পোশাক-আশাক তেমন কথাই বলছে৷

সতীনাথ আবার তাঁর ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘একটা ব্যাপার করা যেতে পারে৷ আমি এখন দমদমের দিকে গাড়ি নিয়ে একটা স্টুডিও দেখতে যাব৷ অসুবিধা না হলে আপনি আমার সাথে যেতে পারেন৷ পথে যেতে যেতে কথা হতে পারে৷ আপনার সুবিধা মতো কোথাও আপনাকে ড্রপ করে দেব৷’

কথাটা শুনে বামাপদবাবু বলে উঠলেন, ‘এতো আমার পরম সৌভাগ্য স্যার৷ আমার কোনো অসুবিধা হবে না৷’

বাইরে বেরোবার জন্য একদম তৈরি হয়ে বসেছিলেন সতীনাথ৷ বামাপদবাবু সম্মত হওয়ায় মিনিট খানেকের মধ্যে সতীনাথ ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে বেসমেন্টে নেমে তাঁর গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালেন৷ গাড়ির দরজা খুলছেন সতীনাথ, সেই ফাঁকে বামাপদবাবু তাঁর কাঁধের ব্যাগ থেকে হাতে বোনা একটা লাল উলের সোয়েটার বার করে একটু যেন ইতস্তত করে সেটা গায়ে চাপালেন৷ পুরানো সোয়েটার, ডান কাঁধের কাছে সেলাই খুলে ফাঁক হয়ে গেছে৷ ড্রাইভিং সিটে বসে সতীনাথ তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘নিন, এবার উঠে পড়ুন৷’

ভদ্রলোক বললেন, ‘কোথায়?’

‘আমার পাশে’ জবাব দিলেন সতীনাথ৷

‘আপনার মতো বিখ্যাত মানুষের সাথে এক আসনে যাব; ভাবতেই কেমন লাগছে; আমি পিছনেও বসতে পারি৷’ সতীনাথ হেসে বললেন, ‘না, না, আপনি আমার পাশেই বসুন৷’

ভদ্রলোক গাড়িতে উঠে বেশ সঙ্কুচিত ভাবেই বসলেন সতীনাথের পাশে৷ গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন সতীনাথ৷

কলকাতা শহরের ব্যস্ত রাস্তা কাটিয়ে ফাঁকা রাস্তায় উঠতে সতীনাথের মিনিট পনেরো সময় লাগল৷ গাড়ি চালাতে চালাতে সতীনাথ আড়চোখে খেয়াল করলেন তাঁর পাশে বসা ভদ্রলোক বিস্মিত ভাবে তাঁকে দেখছেন৷ মনে মনে একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করলেন সতীনাথ৷ যদিও এখন টেলিভিশনের যুগ, তবুও এখনও লাখ লাখ মানুষ রেডিও শোনেন৷ বিশেষত এফ. এম. চ্যানেলতো বহু লোকই শোনেন৷ সতীনাথের ভরাট কণ্ঠস্বর ইথার তরঙ্গর মাধ্যমে পৌঁছে যায় সে সব মানুষের কাছে৷ কত লোক গলা শোনে তাঁর, নাম জানে! এই ভদ্রলোক যে এভাবে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকবেন তাতে আর আশ্চর্য কি?

রাস্তাটা একটু ফাঁকা হবার পর সতীনাথ কথা শুরু করলেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কী করেন?’

বামাপদবাবু জবাব দিলেন, জীবনে অনেক কাজেই করেছি৷ কাজ বলতে অর্থ উপার্জনের কথা বলছি৷ তবে কোনো কিছুই তেমন জমাতে পারিনি৷ সাপ্লায়ার্স, বইয়ের ক্যানভাসার, মারোয়াড়ির গদিতে খাতা লেখা, এমন নানা কাজ৷ তার পাশাপাশি মাঝে মাঝে থিয়েটারও করেছি…৷’

সতীনাথ বললেন, ‘তা হঠাৎ রেডিয়োর ভূত মাথায় চাপল কেন? এ মাধ্যমে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা আছে?’

বামাপদবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর প্রথম প্রশ্নর জবাব না দিয়ে দ্বিতীয় প্রশ্নর উত্তর দিলেন, ‘আছে স্যার৷’

‘কোথায়? কী কাজ?’ জানতে চাইলেন সতীনাথ৷

উলটোদিক থেকে আসা গাড়ির হেড লাইটের আলোতে সতীনাথ খেয়াল করলেন ভদ্রলোকের চোখ দুটো যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ তিনি বললেন, ‘সে প্রায় পঞ্চাশ বছরের আগের কথা৷ আমার তখন পঁচিশ বছর বয়স৷ গাস্টিন প্লেসে সেখানে প্রথম রেডিয়ো স্টেশন খোলা হয়েছিল, সেই স্টুডিওতে কাজ করেছি আমি৷ ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটকে ইয়ার লতিফের পার্ট করেছি, ‘হলদীঘাট’ নাটকে শক্ত সিংহ, আর রমেশচন্দ্রর ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাতে’ রঘুনাথজীর পার্ট৷ জানেন, ওই গাস্টিন প্লেসের স্টুডিওতে আমি একবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে দেখেছিলাম৷ ব্যাপারটা এতদিন পরও যখন চিন্তা করি তখন কেমন রোমাঞ্চ লাগে৷ বিশেষত আজও মহালয়ের ভোরে যখন তাঁর গলা শুনি তখন!’

সতীনাথ বললেন, ‘বাঃ বেশ; কিন্তু ব্যাপারটা ধরে রাখলেন না কেন?’

বামাপদবাবু বললেন, ‘সংসারের চাপ মশাই৷ ঠিক যখন আমার ওঠার সময় তখন বাবা মারা গেলেন৷ বিধবা মা, তার ওপর চারপাঁচজন ভাইবোন৷ রেডিয়োতে পার্ট করলে তো মার সংসার চালানো যাবে না৷ ঢুকে গেলাম চটকলের কাজে৷ ভাইবোনকে মানুষ করার পর বিয়ে থা করলাম, তার পর ছেলে হল, তাকে মানুষ করা৷ প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সামনে দিয়ে যেমন ট্রেন বেরিয়ে যায়, ঠিক তেমনই চোখের সামনে দিয়ে সময়টা কেমন যেন বেড়িয়ে গেল’

সতীনাথ বললেন, ‘বুঝলাম ব্যাপারটা৷’

সতীনাথের এরপর মনে হল, একটা কাজ করলে হয়, ভদ্রলোক যদি তাঁর সাথে স্টুডিয়োতে যান তাহলে ভালোই হয়৷ তাঁর ভয়েস টেস্ট করে নেওয়া যাবে৷ এলেমটা কতদূর তাও বোঝা যাবে৷ এই ভেবে তিনি তাঁকে বললেন, ‘আমার সাথে এখন স্টুডিওতে যেতে আপত্তি আছে?’

বামাপদবাবু স্বাগ্রহে রাজি হয়ে গেলেন তাঁর প্রস্তাবে৷

স্টুডিওটা দম দম শহরের বাইরে একটা এক্সপ্রেস ওয়ের পাশে নতুন হয়েছে৷ চারপাশে জলা ধানখেত৷ শীতের কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে আছে চারপাশ৷ স্টুডিওর মালিক বিশেষ পরিচিত৷ তার সাথে আগেই কথা বলা আছে৷ টেলিভিশনের দৌলতে সতীনাথের মুখটা অনেকের কাছেই পরিচিত৷ তাঁকে দেখেই স্যালুট ঠুকল সিকিওরিটির লোক৷ তিনি গাড়ি থেকে নামতেই একজন লোক বেশ খাতির করে দোতলায় কাঁচের স্টুডিওরুমে নিয়ে গেল৷ প্রয়োজনীয় আলো, শব্দ গ্রহণের যন্ত্র এসব চালু করল সে৷ সতীনাথও যথা সম্ভব দেখে নেবার চেষ্টা করতে লাগলেন যন্ত্রগুলো৷ বামাপদবাবু বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন কাঁচের শব্দ নিরোধক ঘরটার প্রতিটা কোণা৷

সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে সতীনাথ তাঁর ব্যাগ থেকে একটা বই বার করে সেটা বামাপদবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শরৎবাবুর শ্রীকান্ত উপন্যাসের এই প্রথম পাতাটা আপনি মাইক্রোফোনে পাঠ করুন৷ ভয়েসটা দেখে নিতে হবে৷’ ভদ্রলোক তাঁর জায়গা মতোন বসলেন৷ সতীনাথ কানে হেডফোন লাগিয়ে ইশারা করলেন তাঁকে৷ রামাপদবাবু পাঠ করতে লাগলেন—

‘আমার এই ‘ভবঘুরে’ জীবনের অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়াইয়া ইহারই একটা অধ্যায় বলিতে বসিয়া আজ কত কথাই না মনে পড়িতেছে৷;

ছেলেবেলা হইতে এমনি করিয়াই তো বুড়া হইলাম৷ আত্মীয় অনাত্মীয় সকলের মুখে শুধু একটা একটানা ‘ছি-ছি’ শুনিয়া শুনিয়া নিজেও নিজের জীবনটাকে একটা মস্ত ‘ছি-ছি-ছি’ ছাড়া আর কিছুই জানিতে পারি নাই৷ কিন্তু কি করিয়া যে জীবনের প্রভাতেই এই সুদীর্ঘ ‘ছি-ছি’র ভূমিকা চিহ্নিত হইয়া গিয়াছিল, বহুকালান্তরে আজ সেই সব স্মৃত ওই বিস্মৃত কাহিনির মালা গাঁথিতে বসিয়া যেন হঠাৎ সন্দেহ হইতেছে, এই ‘ছি-ছি’টা যত বড়ো করিয়া সবাই দেখাইয়াছে, হয়তো ঠিক তত বড়োই ছিল না…৷’

বামাপদবাবুর পাঠ করে যেতে লাগলেন, শুনে যেতে লাগলেন সতীনাথ৷ সত্যিই ভদ্রলোকের গলাটা বেশ ভালো৷ যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসে শরৎবাবুর শ্রীকান্তই বলছে কথাগুলো৷ একটা নয়, দু-দুটো পাতা পাঠ করলেন ভদ্রলোক৷ তারপর হাসলেন৷

সতীনাথ তাঁর কান থেকে হেডফোন খুলে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে৷ বামাপদবাবুও সতীনাথের দিকে চেয়ে আছেন তাঁর প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য৷ সতীনাথ ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে এর পর বললেন, ‘হবে৷ আপনিই করবেন পার্টটা৷ শ্রীকান্তর পাঠ৷ এফ. এম. রেডিয়োর জন্য ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের একটা অংশ করব আমরা৷ আপনি শ্রীকান্ত, আমি ইন্দ্রনাথ৷ তবে হাতে সময় একদম কম, কাল রিহার্সাল, পরশু রেকডিং, স্ক্রিপ্ট আপনাকে আজই দিয়ে দেব৷ কী পারবেন তো?’

ভদ্রলোক তাঁর নিজের কানের হেডফোন খুলে আবেগতাড়িত গলায় বললেন, ‘পারব, পারব, নিশ্চয় পারব৷ আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব তার ভাষা নেই৷’

সতীনাথ বললেন, ‘ঠিক আছে, অত ধন্যবাদ দেবার দরকার নেই৷ কাল বিকাল পাঁচটায় এখানে আসবেন৷ আমাদের মিউজিক কম্পোজিটর রাজাও থাকবেন৷ চলুন এবার বেরোতে হবে৷ আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাব৷’

আগের দিন ফেরার পথে সতীনাথ বামাপদবাবুকে তাঁর সুবিধা মতো জায়গাতে ড্রপ করে দিয়েছিলেন৷ পরদিন মিউজিক কম্পোজিটর রাজাকে নিয়ে সতীনাথ যখন স্টুডিয়োতে পৌঁছলেন তখন সন্ধ্যা নামবে নামবে করছে৷ স্টুডিয়োর দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন বামাপদবাবু৷ আজ তাঁর পরনে আলপোকার একটা পুরানো কোট, গলায় জড়ানো নীল মাফলার, পায়ে বাদামী রঙের কেডস৷ বেশ স্বপ্রতিভ লাগছে তাকে৷ সতীনাথ গাড়ি থেকে নামতেই ভদ্রলোক মাথা ঝুঁকিয়ে সতীনাথকে নমস্কার করে কাছে এগিয়ে এসে তাঁর মুঠো করা ডান হাত একটু ওপরে তুলে ধরে বললেন, ‘আপনার হাতটা একটু পাতুন৷’

সতীনাথ হাত পাততেই ভদ্রলোক অনেকটা শিউলী ফুলের মতো থেকে ছোটো সাদা ফুল বেশ কয়েকটা তাঁর হাতে দিলেন৷ শুকলেন সতীনাথ৷ বেশ মিষ্টি গন্ধ৷ একটু অবাক হয়ে সতীনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় পেলেন? কী ফুল ওগুলো? সুন্দর গন্ধ তো!’

বামাপদবাবু বললেন, বিকাল থাকতে থাকতেই এসে গেছিলাম এখানে৷ হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছিলাম ওই রাস্তার ওপাশে জলার ধারে৷ একটা ঝোঁপে দেখি ফুটে আছে ফুলগুলো৷ আপনার জন্য তুলে আনলাম৷ তবে নাম জানি না৷ আমার মতো নামগোত্রহীন কোনো একটা ফুল৷ এই বলে হাসলেন ভদ্রলোক৷

বাবাপদবাবুর কথায় সতীনাথের প্রতি উষ্ণতার সাথে সাথে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকা বিষণ্ণতা, বিপন্নতা মুহূর্তের জন্য উঁকি দিয়ে গেল৷

সতীনাথ বললেন, ‘চলুন তাহলে ভিতরে যাওয়া যাক৷’ একজন স্টুডিয়ো অ্যাসিস্টেন্টের সাথে তাঁরা হাজির হলেন স্টুডিয়োতে৷

সতীনাথ বামাপদবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্ক্রিপ্টটা ভালো করে দেখেছেন তো?’

ভদ্রলোক জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কাল বাড়ি ফেরার পর থেকে আজ এখানে আমার আগে পর্য্যন্ত দেখেছি৷ বলতে গেলে পুরো স্ক্রিপ্টটাই আমার মুখস্ত হয়ে গেছে৷ কোথাও বাঁধবে না৷’

সতীনাথ শুনে বললেন, ‘বাঃ বেশ৷ আমাদের মিউজিক কম্পোজিটর রাজাবাবু মিউজিকটা করে এনেছেন৷ অন্য একজনকে দিয়ে শ্রীকান্তর পার্টটার প্রক্সি দেওয়ানো হয়েছিল আমার সাথে৷ রাজাবাবু আমাদের ডায়ালগের জায়গা ফাঁকা রেখে মিউজিকটা করেছেন৷ আমাদের কাজ শুধু মিউজিক ট্র্যাকের সেই শূন্যস্থান ভরানো৷ আশা করি ব্যাপারটা আপনি বুঝতে পারছেন৷ আজ রিহার্সাল এবং সেমিফাইনাল৷ পরশু ফাইনাল৷ তারপর দিনতো রোববার৷ ওই রোববার দুপুরেই নাটকটা সম্প্রচারিত হবে৷’

বামাপদবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, বুঝতে পারলাম৷ এ সব ব্যাপারে আজকাল কত যে উন্নতি হয়েছে ভাবাই যায় না৷ আমাদের সময় ডায়ালগ, গান, মিউজিক একসাথে রেকর্ড করা হত৷ কেউ অনুপস্থিত থাকলে রেকর্ডিং-ই বন্ধ হয়ে যেত৷’

সতীনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ, প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে৷ আমাদের কাজেরও অনেক সুবিধা হয়েছে এতে৷ নিন, এবার রিহার্সাল দিয়ে নেওয়া যাক৷’

স্ক্রিপ্টটা শুরু হয়েছে যেখান থেকে, উপন্যাসে সেখানে ‘আঁধার রাতে ইন্দ্রনাথের আহ্বানে শ্রীকান্ত তার সঙ্গী হয়ে মাছ ধরতে চলেছে৷ রিহার্সাল শুরু হল৷ প্রথম ডায়ালগ ইন্দ্রনাথ রূপী সতীনাথের৷ তিনি শুরু করলেন— ‘তুই বুঝি এ বাড়িতে থাকিস শ্রীকান্ত?’

শ্রীকান্তর ভূমিকায় বামাপদবাবু জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, তুমি এত রাত্তিরে কোথায় যাচ্ছ?’

‘রাত্তির কোথায়রে, এই তো সন্ধ্যা৷ আমি যাচ্ছি আমার ডিঙিতে— মাছ ধরে আনতে৷ যাবি?’

‘এত অন্ধকারে ডিঙিতে চড়বে?’

শুরু হয়ে গেল রিহার্সাল৷ সতীনাথ আর বামাপদবাবুর কথোপকথন৷

দুটোই কিশোর চরিত্র৷ সতীনাথ নিজে নানা বয়সী মানুষের গলা করতে পাবেন, কিন্তু বৃদ্ধ বামাপদবাবুর স্বরক্ষেপ শুনে অবাক হয়ে গেলেন তিনি৷ কিশোর শ্রীকান্ত নিশীথ অভিযানের উৎকণ্ঠা, ভয়, রোমাঞ্চ সবই যেন নিখুঁত ভাবে ফুটিয়ে তুলছেন বামাপদবাবু৷ এবং তা সতীনাথের থেকে ভালো ভাবেই৷

প্রাথমিক রিহার্সালটা শেষ হলে মিউজিক ট্রাকটা শোনা এবং বোঝার জন্য চালিয়ে দিলেন রাজাবাবু৷ যদিও আগে ভয়েস রেকর্ড করে পরে মিউজিক বসানো হয়৷ কিন্তু এক্ষেত্রে আগে মিউজিক বানিয়ে এবার একটা এক্সপেরিমেন্ট করছেন রাজাবাবু আর সতীনাথ৷

মনোযোগ দিয়ে ট্র্যাকটা শোনার সাথে সাথে খুঁটিনাটি কয়েকটা ব্যাপার বামাপদবাবু জেনে নিলেন৷ সতীনাথ বললেন, ‘তাহলে ট্র্যাকটা বাজিয়ে এবার রিহার্সাল করা যাক মাইক্রোফোনে৷’

কিছুক্ষণ সময় লাগল যন্ত্রপাতি সব ঠিক করতে৷ তারপর কানে হেডফোন লাগিয়ে সতীনাথ আর বামাপদবাবু শুরু করলেন মিউজিক ট্র্যাকের ওপর রিহার্সাল৷ আর একটা হেডফোন কানে যান্ত্রিক ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলেন রাজাবাবু৷

সতীনাথের একটা মৃদু সন্দেহ ছিল এই নতুন ব্যাপারটার সাথে বামাপদবাবু নিজেকে মেলাতে পারবেন কিনা তা নিয়ে৷ এমনি ডায়লগ থ্রো করা আর মিউজিক ট্র্যাকে সেকেন্ড মিলিয়ে ডায়ালগ থ্রো করার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে৷ সতীনাথ তাঁর অভিজ্ঞতায় দেখেছেন যে হয়তো মঞ্চে অনেক বড়ো অভিনেতা, কিন্তু রেকডিং-এর এ ব্যাপারে সময় মিলিয়ে ডায়ালগ বলতে পারেন না৷

দুজনের পার্ট বা পাঠ শেষ হল এক সময়৷ কান থেকে হেডফোন খুলেই রাজাবাবু বলে উঠলেন, ‘অসাধারণ! অসাধারণ হয়েছে! বামাপদবাবু আপনি এর আগে রেডিওতো কি কি নাটক করেছেন? সি.ডি. থাকলে দেবেন, শুনব৷ এত ভালো ভয়েস আপনার৷’

বামাপদবাবু স্বলজ্জ হেসে সতীনাথের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘ওনাকে বলেছি, সিরাজদৌল্লা, হলদীঘাট এ সব নাটক৷ তবে যে সব বহু যুগ আগের কথা৷ এখন সব বাড়িতে রেডিয়ো ছিলনা৷ জানেন, হলদীঘাট নাটকে পার্ট করে আমি আর্টিস্ট হিসাবে পাঁচ টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম৷’ বামাপদবাবুর চোখদুটো বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ সতীনাথ জানতে চাইলেন, ‘কী করেছিলেন সে টাকা দিয়ে?

‘কী করেছিলাম? দাঁড়ান দেখাচ্ছি৷’ পাশে রাখা ঝোলাব্যাগের ভিতর থেকে বামাপদবাবু একটা সেলোফোন কাগজের প্যাকেট খুলে তার ভিতর থেকে সাবধানে একটা লম্বাটে কাগজের টুকরো বার করে সেটা এগিয়ে দিলেন সতীনাথের দিকে৷ বিবর্ণ হয়ে যাওয়া অতি প্রাচীন ঈষৎ সবুজাভ একটা চেক বইয়েরর পাতা৷ তাতে বামাপদবাবুর নাম লেখা আছে৷ কাগজটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটা আবার ভদ্রলোকের হাতে তুলে দিয়ে সতীনাথ বিস্মিত ভাবে বললেন, ‘চেকটা আপনি ভাঙাননি?’

বামাপদবাবু পরম মমতায় সেই বিবর্ণ কাগজটার দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, ‘না, ভাঙাতে পারিনি৷ তাহলে ব্যাঙ্ক এটা নিয়ে নিত যে৷ তখন তো আর পাড়ায় পাড়ায় জেরক্স মেশিন ছিল না যে জমা দেবার আগে চেকটা জেরক্স করে রেখে দেব৷ জানেন, সে সময় আমি পাঁচটাকা ফি-এর জন্য বি. এ. পরীক্ষা দিতে পারিনি, কিন্তু এ চেক ভাঙাইনি৷’

এরপর তিনি একটু হেসে ফেলে বললেন, ‘এই কাগজের টুকরোটা না থাকলে আমার গিন্নিও বিশ্বাস করতেন না যে আমি রেডিয়োতে পার্ট করেছিলাম৷’

সতীনাথও মৃদু হেসে বললেন, ‘পারিশ্রমিকের কথা যখন উঠল, তখন বলি, এ কাজের জন্য আপনি হাজার দুয়েক টাকা মতো পারিশ্রমিক পাবেন৷’

‘দু-হা-জা-র টাকা;’ ভদ্রলোক চমকে উঠে বললেন, ‘সত্যি কথা বলছি এই শেষ বয়সে অন্য একটা কারণে রেডিয়োতে পার্ট করব বলে আপনার দারস্থ হয়েছিলাম৷ টাকা পয়সার কথা আমি ভাবিনি৷ আপনাকে যে কী করে কৃতজ্ঞতা জানাব…৷’

সতীনাথ বললেন, ‘না, এ টাকা তো আপনার প্রাপ্য৷ ধন্যবাদ জানাবার মতো কোনো ব্যাপার নয়৷ এ চেকটা আপনি কী করবেন? ভাঙাবেন?’

বামাপদবাবু জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, ভাঙাবো৷ এ টাকাটা আমি টুনিকে দেব৷’

‘টুনি কে?’ রাজাবাবু জানতে চাইলেন৷

‘টুনি আমার নাতনি৷ আমার একটি ছেলে, তার মেয়ে, বারো বছর বয়স, ভালো নাম পারমিতা৷’ নাতনির কথা বলতে বলতে ঊজ্জ্বল হয়ে উঠল ভদ্রলোকের চোখ৷

সতীনাথ এরপর বললেন, ‘তাহলে আজকের মতো আমাদের এখানকার কাজ শেষ৷ আগামীকাল সন্ধ্যা ছ-টায়, ঠিক এখানে চলে আসবেন, চলুন যাবার পথে আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাব৷’

বামাপদবাবু বললেন, ‘আচ্ছা, রোববার আমাদের অনুষ্ঠানটা সম্প্রচারিত হবে তো?’

সতীনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, রোববার ঠিক বেলা বারোটাতে৷ চ্যানেল থেকে আজই আমাকে ফোন করেছিল৷’

বামাপদবাবু বেশ উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘তাহলে টুনিকে খবর পাঠাই?’

সতীনাথ বললেন, ‘আপনার নাতনি কোথায় থাকে?’

বামাপদবাবু এবার একটা ইতস্তত করে বললেন, ‘এই কলকাতাতেই থাকে৷ আসলে সে একটা বড়ো স্কুলে পড়ে৷ আমার বাড়ি থেকে তার স্কুলটা, বেশ একটু দূরে হয় তাই…৷ বামাপদ বাক্যটা আর শেষ করলেন না৷ স্টুডিয়ো থেকে বেড়িয়ে বামাপদবাবুকে তাঁর সুবিধা মতো বড়ো রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেন সতীনাথ৷

পরদিন ঠিক সন্ধ্যা ছ-টায় সতীনাথ, মিউজিক কম্পোজার রাজাবাবুকে স্টুডিওর সামনে হাজির হলেন৷ সদর দরজায় বামাপদবাবু নেই৷ তিনি নিশ্চই চলে আসবেন৷ স্টুডিওতে ঢুকতেই হঠাৎই যেন বামাপদবাবুর দেওয়া সেই বুনো ফুলের গন্ধ এসে লাগল সতীনাথের নাকে৷ তবে কোথাও কোনো ফুল নেই৷ যন্ত্রপাতি ঠিক করতে লাগলেন রাজাবাবু৷ এক সময় সাড়ে ছটা বাজল৷ ‘ফাইনাল রেকর্ডিং’-এর জন্য প্রস্তুতি শেষ৷ সতীনাথ ঘড়ি দেখে বলেন, ভদ্রলোক নিশ্চই জ্যামেট্যামে আটকে পড়েছেন৷

নিজের স্ক্রিপ্টটাতে চোখ বোলাতে শুরু করলেন সতীনাথ, ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে লাগল৷

এক সময় রাজাবাবু বললেন, ‘সাতটাতো বেজে গেল দাদা; ভদ্রলোক তো এখন তো এলেন না?’

সতীনাথ এবার বেশ চিন্তন্বিত হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, তাইতো; ভদ্রলোককে তো অবিবেচক বলে মনে হয় না৷ তাছাড়া, আমাদের চেয়ে ওনার আগ্রহ-উৎসাহ অনেক বেশি৷ আমি তো ভেবেছিলাম আমাদের আগেই উনি চলে আসবেন৷ ভদ্রলোকের কোনো ফোন নম্বরই নেই যে ওনাকে ফোনে ধরব৷ আর একটু অপেক্ষা করে দেখি৷ বরং একটা কাজ করা যাক, আমি স্ক্রিপ্টটা একবার পড়ি, তুমি একটা ট্রায়াল করো৷ ভয়েসটা কেমন আসছে দেখি৷’

স্ক্রিপ্টটা পাঠ করতে শুরু করলেন সতীনাথ৷ রেকর্ডিং শুরু হল৷ দেখতে দেখতে সময়ও এগিয়ে চলল, তাঁর পাঠ যখন শেষ হল, তখন প্রায় আটটা বাজে কিন্তু বামাপদবাবু হাজির হলেন না!

সতীনাথ বেশ হতাশ হয়ে স্ক্রিপ্টটা ভাঁজ করে বললেন, ‘না, ভদ্রলোক মনে হয় আর আজ আসবেন না৷’

রাজাবাবু বললেন, ‘কী হল বলুনতো? কী করবেন এখন?’

সতীনাথ বললেন, ‘বৃদ্ধ মানুষ, আমার মনে হয় তিনি হয়তো অসুস্থ হযে পড়েছেন৷ নইলে অত যাঁর উৎসাহ, যিনি এ ব্যাপারটার জন্য এত ছোটোছুটি করলেন তিনি ফাইনাল রেকর্ডিং-এর দিনই এলেন না! ওনার বাড়ির সঠিক ঠিকানাটাও আমার জানা হয়নি৷ মুস্কিল হল কাল সকাল দশটার সময় চ্যানেলের লোক বাড়িতে আসবে সিডিটা নিতে, হাতে কিছুটা সময় থাকলে অন্য কিছু ভাবা যেত৷’

রাজাবাবু বললেন, ‘একটা কাজ করতে পারেন৷ আপনি মিহির মজুমদারের সাথে কথা বলুন৷ ওঁনার সাথে তো আপনার খুব ভালো সম্পর্ক৷ উনি রেডিয়োর সিনিয়ার আর্টিস্ট৷ স্ক্রিপ্ট একবার চোখ বুলিয়েই মিহিরদা রেকর্ডিংটা নামিয়ে দিতে পারবেন৷ যদি কাল ভোরে উনি স্টুডিওতে চলে আসতে পারেন তবে সকাল দশটার মধ্যে রেকর্ডিং-এর সিডিটা রেডি হয়ে যাবে৷

সতীনাথ বললেন, ‘সাজেশনটা মন্দ নয়৷ দেখি ওঁনাকে বলে রাজি করানো যায় কিনা? কিন্তু তার আগে প্রসাদবাবুকে একবার ফোন করে দেখি৷ উনি যদি বামাপদবাবুর কোনো খোঁজ দিতে পারেন? সেই তো আমার কাছে তাঁকে পাঠিয়েছিল৷’

সতীনাথ এরপর তার মোবাইল থেকে ফোন করলেন প্রসাদবাবুকে৷ কিন্তু তাঁর মোমাইলের সুইচড অফ৷

সতীনাথের গাড়ি যখন স্টুডিও ছেড়ে বেরোলেন তখন রাত প্রায় ন-টা৷ বাইরে তখন শীতের কুয়াশা নামতে শুরু করেছে৷ বড়ো রাস্তার একপাশে জনশূন্য মাঠ, অন্য দিকের জলাভূমি ঢেকে গেছে ঘন কুয়াশার আড়ালে৷ রাস্তার কিছুটা তফাতে তফাতে দাঁড়িয়ে থাকা ভেপার ল্যাম্পগুলো ক্ষয়াটে হলদেটে আলো ছাড়াচ্ছে৷ চিন্তাক্লিষ্ট সতীনাথ ধীরে ধীরে গাড়ি চালাতে লাগলেন৷ ফাঁকা রাস্তা, অন্যকোনো গাড়িঘোড়াও নেই৷

কিছুটা এগোবার পরই সতীনাথ গাড়ির হেডলাইটের আলোতে দেখলেন সামনে জলার দিক থেকে কুয়াশার চাদর ভেদ করে রাস্তার ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়াল অস্পষ্ট এক ছায়ামূর্তি৷ সতীনাথের গাড়ি লক্ষ্য করেই যেন সে রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু-হাত তুলল৷

কয়েক মুহূর্তর মধ্যেই লোকটার কাছাকাছি চলে এল সতীনাথের গাড়ি৷ আরে এযে বামাপদবাবু! গাড়ি থামিয়ে দিলেন সতীনাথ৷

গাড়ির জানলার কাছে এগিয়ে এলেন ভদ্রলোক৷ সতীনাথ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরে বামাপদবাবু কী ব্যাপার? আমরা সন্ধ্যা ছ-টা থেকে আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম৷ আপনি এলেন না৷ কী হয়েছে ব্যাপারটা?’ বামাপদবাবু জবাব দিলেন, ‘আমি আসিনি আবার এসেও ছিলাম বলতে পারেন৷’

সতীনাথ বললেন, ‘এত পরে এসেতো কোনো লাভ হল না৷ স্টুডিওতো আমাদের জন্য সারারাত খোলা থাকবে না৷ আপনি আমাকে কি বিপদে ফেললেন বলুন তো; কাল সকালে চ্যানেলের লোক আসবে সিডিটা নিতে৷ এমন হবে জানলে আমি আপনাকে এ কাজের সুযোগ দিতাম না৷ আমাকেও তো প্রডিউসারের কাছে কৈফিয়ত দিতে হবে৷ এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, প্রফেশনের ব্যাপার৷’ বেশ একটু ক্ষোভের সাথে বললেন সতীনাথ৷

বামাপদবাবু এবার বললেন, ‘সত্যি, আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই, কত দরজায় দরজায় ঘুরেছি রেডিওতে একটা চান্স পাবার জন্য৷ কেউ দেয়নি, আপনি দিলেন৷ আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন না যে কেন আমি তে বছর পর আবার রেডিওতে অভিনয় করার জন্য ছুটছি? কারণটা এবার আপনাকে বলি৷ সে ওই টুনির জন্য৷ টুনি নামকরা স্কুলে পড়ে৷ তার সহপাঠিদের দাদু-ঠাকুমা, আত্মীয় স্বজনরা কেউ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গায়ক, অভিনেতা বড়ো বড়ো সব মানুষ৷ টুনি অনেকদিন আমাদের বাড়ি আসে না৷ আসবে কী করে? আমি তো নামগোত্রহীন মানুষ৷ বন্ধুরা তাকে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সে কী উত্তর দেবে? সে আমাকে বলেছিল, আমি যদি বড়ো কিছু করতে পারি, যখন সে তার জন্য অন্যদের কাছে পরিচয় দিতে পারবে তখন সে আসবে৷ বলা বাহুল্য, এ কথাগুলো আসলে টুনির নয়, তাকে দিয়ে বলানো হয়েছে৷ আসলে এ কথা গুলো তার অভিভাবক-অভিভাবিকার…৷’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বামাপদবাবু এরপর বললেন, ‘আসবে, এবার সে আসবে, ফিরে গিয়ে সে সবাইকে বলতে পারবে তার ‘গ্র্যান্ড পা’ একজন ‘রেডিয়ো আটিস্ট’, এফ. এম. এ তাঁর গলা শোনা যায়৷’ এই বলে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি৷

ব্যাপারটা অনুধাবন করে সতীনাথ বললেন, ‘সবই বুঝলাম৷ কিন্তু রেকর্ডিংই তো হল না, সে শুনবে কী করে?’

তবে শেষ একটা উপায় আছে৷ কাল ভোরে যদি রেকর্ডিংটা করা যায়৷ আপনি গাড়িতে উঠে আসুন৷ আপনার বাড়ি হয়ে আমার বাড়িতে গিয়ে আজ রাতে থাকবেন৷ কাল ভোরে আমরা একসাথে স্টুডিওতে আসব৷ আসুন, উঠে পড়ুন৷’

বামাপদবাবু এবার তাকালেন সতীনাথের দিকে৷ তিনি বললেন, ‘তা সম্ভব নয়৷ তবে আপনার কোনো অসুবিধা হবে না৷’

সতীনাথ তাঁর কথা শুনে এরপর স্পষ্টতই ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘অসুবিধা হবে না মানে? আপনার জন্য প্রোডাকশানটাই তো আটকে গেল৷’

বামাপদবাবু ঠোঁটের কোণে একটা ক্ষীণ হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘কাজ আটকে থাকবে না৷ নিশ্চই হয়ে যাবে৷ আমাকে এই সুযোগ দেবার জন্য আমি কৃতজ্ঞ৷ আচ্ছা চলি তাহলে, নমস্কার৷’— এই বলে, সতীনাথকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি রাস্তা ছেড়ে হাঁটতে শুরু করলেন জলার দিকে৷

সতীনাথ হাঁক দিলেন, ‘ও বামাপদবাবু কোথায় যাচ্ছেন? শুনুন, শুনুন…

কিন্তু বামাপদবাবু আর ফিরলেন না, জলার কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গেলেন তিনি৷

সতীনাথ আক্ষেপের স্বরে বললেন, ‘সম্ভবত বৃদ্ধ বয়সে ভদ্রলোকের মাথায় কোনো সমস্যা হযেছে, ওনাকে দিয়ে আর কাজ হল না৷ বিকল্প উপায় ভাবতে হবে৷’ অ্যাক্সেলেটরে চাপ দিয়ে ফেরার পথ ধরলেন তিনি৷

সারারাত বেশ উদ্বেগের মধ্যে কাটালেন সতীনাথ৷ তবে আশার কথা মিহিরদাকে শেষ পর্যন্ত রাজি করানো গেছে৷ যদিও শরীরটা খারাপ যাচ্ছে বলে তিনি প্রথমে পাশ কাটাবার চেষ্টা করছিলেন৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সতীনাথের অনুরোধ ফেলতে পারেন নি৷ কথা হয়েছে সকাল আটটায় তিনি স্টুডিওতে পৌঁছে যাবেন৷ এক ঘণ্টার কাজ৷ দশটার মধ্যে রেকর্ডিং-এর সিডি রেডি হয়ে যাবে৷ সতীনাথ আর রাজাবাবু অবশ্য সকাল সাতটাতেই স্টুডিওতে পৌঁছে যাবেন প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য৷ স্টুডিওতে জানিয়েও দেওয়া হযেছে সে কথা৷

পরিকল্পনা মতো ভোরবেলা রাজাবাবুকে নিয়ে সকাল সাতটায় পৌঁছে গেলেন সতীনাথ৷ স্টুডিওতে ঢুকে সতীনাথ রাজাবাবুকে বললেন, ‘মিহিরদার আসতে তো কিছুটা দেরি আছে৷ একটা কাজ করো, গতকালের আমার রেকডিংটা বাজাও৷ দেখি আর একবার কোথাও কোনো ত্রুটি বিচচুতি আছে কিনা আমার?’

বামাপদবাবুর ব্যাপারটা মন থেকে সরিয়ে দিয়েছেন সতীনাথ৷ মিহিরদাকে দিয়ে নতুন ভাবে করা হবে বামাপদবাবুর অংশটা৷

আগের দিনের রেকর্ডিং-এর সিডিটা চালু করলেন রাজাবাবু৷ পল্লীগ্রামে রাতের বেলায় কথপোকথন ইন্দ্রনাথ আর শ্রীকান্তর৷ তাই ডায়লগ শুরুর আগে আবহ সঙ্গীত রাতের পরিবেশ ফুটিয়ে তোলার জন্য ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক৷ তারপর ইন্দ্রনাথ রূপী সতীনাথের গলা— ‘তুই বুঝি এ বাড়িতে থাকিস শ্রীকান্ত?’ কিন্তু এ প্রশ্নর পরই সতীনাথ আর রাজাবাবুকে চমকে দিয়ে শ্রীকান্ত ওরফে বামাপদবাবুর গলা শোনা গেল— ‘হ্যাঁ, তুমি এত রাত্তিরে কোথায় যাচ্ছ?’

কী হল ব্যাপারটা!

শুরু হল সতীনাথ আর বামাপদবাবুর কথোপকথন!

বিস্মিত সতীনাথ রাজাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মিউজিক ট্র্যাকের ওপর আমার আর বামাপদবাবুর রিহার্সলটা সেদিন তুমি রেকডিং করেছিলে নাকি?’

রাজাবাবু বিস্মতভাবে বললেন, ‘না, করিনি তো!’

নাটক এগিয়ে চলল৷ সতীনাথ আর রাজাবাবু বিস্মিতভাবে শুনে যেতে লাগলেন বামাপদবাবুর কণ্ঠস্বর! যেন ফাইনাল রেকর্ডিং শুনছেন তাঁরা৷

নাটক এক সময় শেষ হল৷ শেষ চমকটা তখনও বাকি ছিল৷ কয়েক মুহূর্ত নিস্তব্ধতার পর আবার শোনা গেল আবার বামাপদবাবুর গলা— ‘আজকের নাটকের কুশীলব— ইন্দ্রনাথ-সতীনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত-বামাপদ মজুমদার, আবহ সংঙ্গীত রাজা দাশগুপ্ত৷’ এ কথাগুলো সেদিন রিহার্সাল শেষ কখনই বলেননি বামাপদবাবু৷ পরিচিতির কাজটা করেন সতীনাথই ফাইনাল রেকর্ডিং-এর শেষে৷

রেকর্ডিং-এর সিডির শব্দ শেষ হয়ে যাবার পর নির্বাক হয়ে বসে রইলেন দুজন৷ আর এরপরই হঠাৎ সতীনাথের নাকে এসে লাগল সেই বুনো ফুলের গন্ধ; সতীনাথ বলে উঠলেন, ‘এমন হয়নি তো যে বামাপদবাবু কাল রাতে এখানে এসেছিলেন, তারপর ওনার ফাঁকা জায়গাতে কথাগুলো বসিয়ে রেখে গেছেন? নইলে এটা কী ভাবে হওয়া সম্ভব?’

রাজাবাবু বললেন, ‘ব্যাপারটা কঠিন হল্যে অসম্ভব নয়৷ একবার এখানকার লোকজনকে জিজ্ঞেস করে দেখা যাক৷’

রেকর্ডিং রুমের বাইরে টুল নিয়ে একজন বসেছিল৷ তাকে বলতেই সে কিছুক্ষণের মধ্যে সঙ্গে করে আনলেন গেটকিপারকে৷ লোকটা নাইটগার্ডের কাজ করে৷ সতীনাথ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাল আমরা চলে যাবার পর এই রেকর্ডিং-রুম বা স্টুডিওতে কেউ এসেছিল?’

লোকটা জবাব দিল, ‘না সাহেব, তবে…৷’

‘তবে কী?’

সে বলল, ‘কাল রাতে আমি পাহারা দিতে একবার এদিকে এসেছিলাম৷ বাইরে যেতে হঠাৎ একবার মনে হয়েচিল এই কাঁচের ঘরে ওই টেবিলটার সামনে কে যেন বসে আছে৷ আমি সঙ্গে সঙ্গে টর্চের আলো ফেললাম, কেউ কোথাও নেই৷ আসলে একটানা চারপাঁচ রাত ডিউটি দিচ্ছি তো৷ না ঘুমিয়ে চোখ ধাঁ ধাঁ লেগে যাচ্ছে৷’ সতীনাথ এগিয়ে গেলেন লোকটার দেখানো টেবিলটার দিকে৷ ওই চেয়ার-টেবিলে বসেই দু-দিন আগে স্ক্রিপ্ট পড়েছিলেন বামাপদবাবু৷ ঠিক এই সময় ভাইব্রেটিং মুডে রাখা সতীনাথের পাঞ্জাবীর পকেটে মোবাইল ফোনটা কেঁপে উঠল৷ কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল প্রসাদবাবুর গলা— ‘সতীনাথ খবরটা শুনেছেন? বামাপদবাবু বলে যে ভদ্রলোককে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলাম পরশু রাতে তিনি মারা গেছেন৷ খবরটা পেয়ে কাল সকালে তাঁর বাড়ি গেছিলাম৷ ফাইনাল রেকর্ডিং-এর ব্যাপারটা নিয়ে খুব উত্তেজিত ছিলেন তিনি৷ কিন্তু এ বয়সে উত্তেজনার চাপ নিতে পারেন নি৷ রাতে বাড়ি ফিরে স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তেই হার্ট ফেলিওর হয়৷ তারপর সব শেষ…’

প্রসাদবাবু এরপর কী বললেন তা আর কানে গেল না সতীনাথের৷ তাঁর মোবাইল ধরা হাতটা ধীরে ধীরে নীচের দিকে নেমে এল৷ ঠিক সেই সময় সতীনাথের নাকে এসে লাগল সেই বুনো ফুলের মিষ্টিগন্ধটা৷ ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে গন্ধটা৷ আর এরপরই তাঁর চোখ গেল কিছুটা তফাতে একটা টেবিলের ওপর, সেখানে বসে দুদিন আগে স্ক্রিপ্ট পড়েছিলেন বামাপদবাবু৷ সেই টেবিলের ওপর ছড়িয়ে আছে একমুঠো টাটকা সেই বুনোফুল৷ দুদিন পরও কি বুনোফুল এত টাটকা থাকে? এ ব্যাপারটা ঠিক জানা নেই সতীনাথের৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *