রামানুজের কথা
১।
তুর্বসুরা চলে যাবার পরেও আধঘণ্টা রামানুজ চুপচাপ খাটে বসে রইল। ঠিক যা যা হবার কথা ছিল, তাই হচ্ছে। দেওয়ালে ঘড়ির দিকে তাকাল রামানুজ। ভোর পাঁচটা বাজে। মোবাইলে একটা নম্বর ডায়াল করল। ফোনটা বেজে কেটে গেল। ঠিক দশ মিনিট বাদে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ফোন এল। “আননোন নম্বর” লেখা। কোনও নম্বর দেখা যাচ্ছে না। ফোন তুলতেই অন্য পাশে কোনও কথা নেই। অখণ্ড নীরবতা। শুধু নিঃশ্বাস নেবার একটা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
যা বলার রামানুজই বলল, “এক ডিঙুর ঠিকছে। সাথ মে এক টোলনা। দো মিলকে বড্ড বিলা চামনছে। মুঝে পোতনা হ্যায়। কব?” উত্তর এল না। রামানুজ আবার প্রশ্ন করল, “কব?” আবার উত্তর নেই। হতাশ হয়ে আবার সে বলা শুরু করল। “মেরা পারিক কো লোকান্তি হুয়া। ম্যায় চেতলা কা মাছিয়া খোল মে চলা যাঁউ কেয়া?” আবার উত্তর নেই। যেন দেওয়ালের সঙ্গে কথা বলছে। রামানুজ জানে উত্তর আসবে না। ফোনের অপর পারে যিনি থাকেন, তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতেই ভালোবাসেন। এই নিয়ে তিনবার তিনি ফোন করেছেন। কোনও বার কিছু বলেননি। শুধু শুনে গেছেন। রামানুজের কানে এসেছে জোরে জোরে শ্বাস নেবার শব্দ। হতাশ রামানুজ প্রায় চিৎকার করে বলে, “জ্যায়সে বোলা গয়া থা ম্যায়নে তো ও হি কিয়া। বরাবর। ওহ পড়চি ভি পুলিশকো দে দিয়া। লেকিন পুলিশ নে উসকে সাথ মেরা আধার কার্ড কা ফোটো ভি খিঁচ লিয়া। মুঝে কহা গয়া থা মেরা কুছ নেহি হোগা। পর ম্যায় তো পুরিতরহা ফাঁস চুকা হুঁ। বিশ্বজিৎ নে ভি তো সব বোল দিয়া থা, ফিরভি উসকো কতল কিউ কিয়া আপলোগোনে? আব ক্যায়া মেরি বারি হ্যায়?” বলতে বলতে ভয়ে কান্নায় ভেঙে পড়া রামানুজ বুঝতে পেরে গেল ওপাশের ফোন কেউ কেটে দিয়েছে।
উত্তেজনায় বড্ড ভুল করে ফেলেছে রামানুজ। তাদের নিজস্ব কোডের বাইরে গিয়ে কথা বলেছে। স্বাভাবিক ভাষায়। এ ভাষায় কথা বলার নিয়ম নেই। বিশেষ করে এমন গোপন কথা। রামানুজ জানে এবার কী হবে। ফোনের অপর পারে থাকা মানুষটা চেতলায় হিজড়েদের আস্তানার গুরুমাকে নির্দেশ দেবে। সরাসরি কিংবা কারও মাধ্যমে। ততক্ষণ অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। রামানুজ শুধু নির্দেশ পালন করতে জানে। সে জানে আর বেশিদিন নেই। তাকে বলা হয়েছে একবার হিলির ভূত জেগে উঠলে তার মুক্তি। তার মতো আরও হাজার হাজার মানুষের মুক্তি। মাঝে মাঝে তার মনে হয় তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হল। আবার ভাবে তার মতো না-চিজকে নিজের হাতে বেছে নিয়েছেন বড়ে মাস্টারজি। এক বিরাট বিপ্লবের জন্য। এটাও কম কথা না। রামানুজের পরিষ্কার মনে আছে বছর সাতেক আগের সেই দিনটার কথা।
শিউলি তাকে সোজা উঠিয়ে নিয়ে এসেছিল চেতলার হিজড়েদের মহল্লায়। গুরুমা সেখানে ছোটোখাটো জমিদারের মতো। তাঁকে তুষ্ট করতেই সবাই ব্যস্ত। তিনি রেগে গেলেই শাস্তি পেতে হবে। আবার তাঁর হাত মাথায় থাকলে সাত খুন মাফ। প্রথমে বোঝেনি রামানুজ। পরে বুঝল এদের ভিতরের সম্পর্ক ভয়ানক জটিল। গোলাপ নামের হিজড়েটা গুরুমায়ের প্রধান শিষ্য। দেখতে পুরো ছেলেদের মতো। পোশাক পরেও তেমনি। কিন্তু আসলে সে গুরুমায়ের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে। মায়ের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই সে খবর মায়ের কানে পৌঁছে যায়। তখন শাস্তি। সে শাস্তির শুরু বেতের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া অবধি যেতে পারে। এক গুরুমা কাউকে তাড়িয়ে দিলে অন্য কোনও হিজড়ে বাড়িতে তাকে নেবে না। ভিক্ষা করে খাবারও উপায় নেই। হিজড়েদের নেটওয়ার্ক ভয়ানক মজবুত। ঠিক পুলিশের সঙ্গে ষড় করে জেলে ঢুকাবে কিংবা জন হিজড়ে হয়ে এক মহল্লা থেকে অন্য মহল্লায় কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে হবে।
শিউলিদের মহল্লার গুরুমা জেনানা। মানে শারীরিকভাবে পুরুষ। নিজে ছিন্নি করায়নি। ফলে নতুন কোনও নাগিন এলেই প্রথমে কিছুদিন তার খিদে মেটাতে হয়। রামানুজকে দেখেই গুরুমা-র মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটেছিল। রামানুজের মনে আছে। গুরুমা শিউলিকে ডেকে বলেছিল রামানুজকে তৈরি করতে। নিজে রামানুজকে পরীক্ষা করে দেখবে সে।
সামনেই ছিল কালীপুজো। সেই রাতে হিজড়েরা ঢোলের আরাধনা করে। আতপ চাল, পান, সুপারি, প্রদীপ, বাতাসা দিয়ে পুজো। সকাল থেকে শিষ্য মেয়েরা বাজার থেকে তোলা তোলে। দোকান থেকে ইচ্ছেমতো জিনিসপত্র তুলে নেয়। দাম দেয় না। সন্ধে হতে না হতেই হিজড়ে বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। দেওয়ালে তেল সিঁদুর দিয়ে আঁকা হল ঊর্ধ্ববাহু তিনটে অদ্ভুত মূর্তি। অনেকটা লক্ষ্মীমূর্তির মতো। তার সামনে নতুন করে চামড়ায় ছাওয়া সবকটা ঢোল রেখে গুরুমা পুজোতে বসল। পুজোর মন্ত্র মনে মনে। গুরুমা ছাড়া কেউ জানে না। শুধু তার ঠোঁটদুটো নড়তে থাকে। পুজো শেষ হলে গুরুমা একটা ছাড়ানো নারকেল নিয়ে গোলাপের হাতে তুলে দিল। গোলাপ ঢোলের দিকে পিছনে করে ছুড়ে মারল জোরে। নারকেল ফেটে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। সবাই উদ্দাম হয়ে উঠল আনন্দে। ভগবান তাদের পুজো গ্রহণ করেছেন। এবারে নতুন সদস্য বলতে রামানুজ একাই। গুরুমা নিজের হাতে নারকেলের টুকরো রামানুজের মুখে পুরে দিলেন। ব্যস! রামানুজ গুরুমার শিষ্য হয়ে গেল। পরদিন থেকেই শুরু হল রামানুজকে তৈরির কাজ। শিউলি আর গোলাপ নিজের হাতে সে দায়িত্ব নিল।
আগের রাতেই কড়া জোলাপ খাইয়ে রামানুজের পেট পরিষ্কার করা হয়েছিল। শিউলি শক্ত, সরু একটা মসৃণ পাথরের দণ্ডতে ঘি মাখিয়ে ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে দিল রামানুজের পায়ুদেশে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতে চাইল রামানুজ। উপায় নেই। আগেই তার হাত দুটো উঁচু করে বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়া হয়েছে। দুই পা শক্ত করে চেপে ধরে আছে গোলাপ। দণ্ডটা আরও ভিতরে ঢুকছে। ব্যথা বাড়ছে। এবার পায়ু ছিঁড়ে যাবে। ছিঁড়ে গেল। ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়তে লাগল পায়ুদ্বার বেয়ে। শিউলির মুখে হাসি দেখা গেল। “এবারে এই চিলকা টোলনা খজ্জর হল”, বাচ্চা ছেলেটা হিজড়ে হল। পায়ুর এই রক্তকে হিজড়েরা মেয়েদের মাসিকের রক্ত বলে মনে করে। রক্ত না বেরোলে হিজড়ে হয় না। তারপর টানা সাতদিন ধরে চলল এই অনুষ্ঠান। প্রতিদিন একইভাবে একটু একটু করে সেই পাথর ঢুকিয়ে দেওয়া হত। শেষের দিকে মুখে আর কাপড় গোঁজা হত না। রামানুজের আর্ত চিৎকার যাতে বাইরে না যায়, তাই মহল্লার উঠোনে বসত নাচগানের আসর। গুরুমা নিজে এসে দেখত কাজ কেমন চলছে। রামানুজ যত চিৎকার করত, গুরুমা তত আনন্দ পেত। বলত আরও জোরে ঢুকাতে। সাতদিন পরে রামানুজকে চিত করে শুইয়ে পা উপরে তুলে দিল শিউলি। পায়ুনালী বড়ো হয়ে ফানেলের মতো হয়ে গেছে। পায়ুমুখ থেকে মলাশয় গোটা পথ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এবার রামানুজ গুরুমায়ের ভোগের জন্য তৈরি হয়েছে।
টানা সাতদিন গুরুমায়ের যৌন ক্ষুধা মিটিয়েছে রামানুজ। এই গুরুমা লোকটা ভয়ংকর। লম্বায় প্রায় ছয় ফুট। বিরাট চেহারা। দাড়িগোঁফ কামানো শরীরে পুরো পুরুষ। কিন্তু মহিলাদের মতো শাড়ি পরে থাকে। লাল শাড়ি। মাথায় বড়ো সিঁদুরের ফোঁটা। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। নানা বিকৃত যৌন বায়নাক্কা তার। সে রামানুজের গায়ে পেচ্ছাপ করে দেয়, মুখে বাতকর্ম করে, রামানুজের পায়ুমন্থনের সময় ক্রমাগত খিস্তি দিতে বলে। সে যত খিস্তি। তার নাকি ততই মস্তি বাড়বে। কাউকে নাকি ভয় পায় না গুরুমা। পুলিশকেও না। একবার কী একটা কেসে পুলিশ এসেছিল তাদের মহল্লায়। সেদিন একা দাঁড়িয়ে থেকে এক গাড়ি পুলিশের মোকাবিলা করেছিল সে। তার মুখখিস্তির সামনে ভয়ে একবার পুলিশও হিজড়া বাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারেনি।
অন্তত সবাই তাই ভাবে।
কিন্তু সত্যিটা রামানুজ জানে।
ততদিনে প্রায় মাস দু-এক কেটে গেছে। দুপুরে সব হিজড়েরাই কাজে বেরিয়েছে। আছে শুধু রামানুজ, গোলাপ আর গুরুমা। দুপুরে খাবার আগে তিনজন মিলে ‘মস্তি’ করে। সেই সময়ই বাইরে দুটো পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল। একজন জন হিজড়া বাগান পরিষ্কার করছিল। সেই খবর দেয় তড়িঘড়ি করে দোতলা থেকে নেমে তিনজন দ্যাখে পুলিশ ততক্ষণে ভিতরে ঢুকে গেছে। গুরুমার চোখে সেই প্রথম রামানুজ তীব্র ভয় দেখেছিল। পাগলের মতো সে কাউকে একটা ফোন করছে। ফোন বেজে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। পুলিশ উঠোন পেরিয়ে গেছে। ফোন বাজতে বাজতে কেটে গেল। তারপরেই গুরুমার হোয়াটসঅ্যাপে ফোন এল একটা। গুরুমা ফোন ধরেই প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “ডিঙুর ঠিকছে। পোতে যাই নারি। মোগাকে ঠিকতে বল।”
শেষ কথাটা কানে যেতে একটু চমকে গেল রামানুজ। প্রতি হিজড়ে মহল্লায় গুরুমায়ের এক স্থায়ী পুরুষ সঙ্গী থাকে। এরই কোডনাম মোগা। এই গুরুমায়ের মোগাকে কোনও দিন হিজড়ে মহল্লায় দেখেনি রামানুজ। শুনেছে সে আসে গভীর রাতে। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে। গুরুমা নিজে সদর দরজা খুলে দেয়। অন্য হিজড়েরা বলে এই লোকটাকেই নাকি একমাত্র ভয় পায় গুরুমা। লোকটা এসে সোজা গুরুমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। সকাল হবার আগেই চলে যায়। এই বাড়িতে এই প্রেতের মতো লোকটার নাম কেউ করে না। করলেও ফিসফিসিয়ে। গুরুমা পছন্দ করে না। একবার বাসন্তী এই মোগাকে নিয়ে কী একটা বলেছিল। গোলাপ সে কথা গুরুমায়ের কানে তুলে দেয়। গুরুমা কিচ্ছু বলেনি। পরেরদিন দুপুর থেকে বাসন্তীর ভেদবমি শুরু হল। সন্ধের মধ্যে সব শেষ। মাঝরাতে বাসন্তীর নগ্ন দেহ উপুড় করে শুইয়ে মিছিল করে শ্মশানে গেছিল সবাই। হিজড়াদের রীতি। নিয়ে যাবার আগে সবাই মিলে মৃতের মুখে জুতোর বাড়ি মেরেছিল, যাতে পরের জন্মে আর হিজড়া হয়ে জন্মাতে না হয়। সেই দিন থেকে এই বাড়িতে মোগা শব্দটা আর কেউ উচ্চারণ করেনি।
সেই মোগাকে ভরদুপুরে এই বাড়িতে ডাকছে গুরুমা নিজেই! কী এমন হয়ে গেল? থামের আড়ালে লুকিয়ে অফিসারকে লক্ষ করছিল রামানুজ। গুরুমার ফোনের পরই অফিসারের কাছে একটা ফোন এল। যেন জোঁকের মুখে নুন পড়েছে, এভাবে অফিসার থমকে গেলেন। বাকিদের বললেন ওখানেই দাঁড়িয়ে যেতে।
পনেরো মিনিট। আধ ঘণ্টা। উঠোনের একদিকে রামানুজরা, অন্যদিকে পুলিশ। রামানুজ বুঝতে পারছে না এখানে পুলিশ কী করছে? একটু বাদে একটা লোক এল। এমন লোক আগে কোনও দিন এই বাড়িতে দেখেনি রামানুজ। মাথায় উশকোখুশকো কাঁচাপাকা চুল, গোঁফ আছে দাড়ি কামানো। পরনে আদ্দির পাঞ্জাবি আর জিনসের প্যান্ট। কাঁধে একটা ঝোলা। চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা। লোকটা এসেই সোজা অফিসারের কাছে একটা কার্ড দেখিয়ে বলল, “আপনার যা বলার আমাকে বলতে পারেন। আমাদের একটা এনজিও আছে। রেজিস্টার্ড। এই যে কাগজ। আমরা এই হিজড়েদের নিয়ে কাজ করি শুনতে পেলাম আপনারা নাকি বিনা ওয়ারেন্টে রেইড করতে এসেছেন?”
অফিসার চুপ। বললেন, “আমাদের কাছে পাক্কা খবর আছে।”
“কী খবর?”
“সেটা এভাবে বলা যাবে না। আপনি জানলেন কীভাবে আমরা এখানে এসেছি?”
“যিনি আপনাকে ফোন করেছেন, তিনিই আমায় জানিয়েছেন।”
“ভালো কথা। আপনাকে তাহলে আমাদের সঙ্গে পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে।”
“অবশ্যই যাব।”
“ভালো কথা। আপনার নাম?”
“দেবাশিস গুহ। পেশায় আমি স্টেট আর্কাইভের কর্মচারী। এই যে আমার আই কার্ড।”
২।
সেদিনের পর থেকে রামানুজের উপরে গুরুমা আর গোলাপের ব্যবহার কেমন যেন বদলে গেল। যেন ভয়ানক কোনও গোপন কথা জেনে ফেলেছে। পুলিশ চলে যাবার পরে হিজড়াদের দেবী বহুচেরার কাছে রামানুজকে নিয়ে শপথ করাল গুরুমা। যা ঘটেছে তা যেন কেউ না জানতে পারে। খোলের হিজড়ারাও না। কিন্তু তারপরেও তার উপরে দুইজোড়া অদৃশ্য চোখ যেন নজর রেখে চলত চব্বিশ ঘণ্টা। তার বাইরে বেরোনো প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। গেলেও সঙ্গে কাউকে পাঠানো হত। এভাবে মাস ছয়েক চলার পরে গুরুমার বিশ্বাস কাউকে বলেনি বা বলবে না। এবার তাকে কাজ দেওয়া শুরু হল।
এই কাজ গুরুমা ধরতে যেত। কে তাকে বরাত দিত কেউ জানে না। একদিন গভীর রাতে গোলাপ ঘুম ভাঙিয়ে রামানুজকে গুরুমা-র ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে দুই-তিনজন অচেনা মানুষ। গুরুমায়ের সামনেই বসে একজন পায়ের উপরে পা তুলে অত রাতে চোঁ চোঁ করে চা খাচ্ছিলেন। সঙ্গের দুজনের চা শেষ। রামানুজ ঢুকতেই গুরুমা বলল, “ওলো দাশরথি, দেখে নাও গো। এই আমাদের নাগিন, যার কথা বলেছিলাম তোমাকে। ছেমড়িটা চিসা। তুমি বলছিলে টিংবাজের ভালো কাজ আছে। শিখিয়ে নিয়ো গো। কী? চলবে?”
দাশরথির নাম শুনেই চমকে উঠেছে রামানুজ। কলকাতার আন্ডারওয়ার্ল্ডে অঞ্চলে দাশরথি এক রূপকথার নায়কের মতো। কলকাতার সেরা কারিগর টালা থেকে টালিগঞ্জ, শিয়ালদা থেকে শালকে ট্রেনে উঠলে কারও পকেটের মানিব্যাগ থেকে এলাচদানা কিছুই তার হাত থেকে বাদ যায় না। ইদানীং সে নিজে কাজ করে না। তার চ্যালারা খাটে। কিছুদিন আগেই তার এক চ্যালা ট্রেনে চাপা পড়ে মরেছে। তাই সে এসেছে গুরুমার কাছে। নতুন চ্যালার সন্ধানে। রামানুজকে আগাপাশতলা দেখল দাশরথি। মরা মাছের মতো আবেগহীন চোখ। তারপর গুরুমাকে বলল,
“এর ছিন্নি করা আছে?”
“না। করাইনি।”
“ঠিক আছে। সমস্যা নেই। কাল সকালে আমার ডেরায় পাঠিয়ে দিয়ো। শিখিয়ে পড়িয়ে নেব।”
দাশরথি চলে যেতেই গুরুমা দুই হাত কপালে ঠেকাল।
.
পরের দিন সকাল সকাল মেয়েদের পোশাক পরে দাড়িগোঁফ কামিয়ে রামানুজ কলাবাগানের মোড়ে হাজির। সেখানে আগে থেকেই দাশরথির এক চ্যালা দাঁড়িয়ে ছিল। সে-ই রামানুজকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল আড্ডায়। বাইরে থেকে দেখলে অন্য দশটা বাড়ির সঙ্গে তফাত করা মুশকিল। ভিতরে রীতিমতো ক্লাস চলছে। দাশরথি এই স্কুলের মাস্টার কারিগর। সবাই ডাকে হেডমিস্তিরি বলে। তার আন্ডারে গোটা পাঁচেক কারিগর। মূল কাজটা এরাই করে। পকেট থেকে মোবাইল, মানিব্যাগ সবার অগোচরে তুলে নেওয়া বা ব্লেন্ড দিয়ে অবলীলায় পকেট কাটা, যাতে চামড়াতে দাগ অবধি না পড়ে, সেটাই এদের কাজ। এদের ঠিক পাশেই যে থাকে, তার কোড নাম ‘সেয়ানা’। কারিগর মালটা তুলেই এর হাতে পাচার করে দেয় আর সে সবার অলক্ষে সরে পড়ে। আর এই গোটা ঘটনা চলার সময় ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোককে চেপে ধরার দায়িত্ব টিংবাজদের, যাতে মানুষটা এই পকেটমারার সময় নড়াচড়া না করতে পারে। এই টিংবাজ
হিসেবে হিজড়েদের কদর বেশি। দলে হিজড়ে থাকলে এমনিতেই লোক একটু ভয়ে সিটিয়ে থাকে, মনোযোগ হিজড়ার দিকে চলে যায়। সেই ফাঁকে কাম তামাম। মাসখানেক ট্রেনিং-এর পর রামানুজকে ফিল্ডে নামানো হল। ছাত্র হিসেবে সে এককথায় অসাধারণ। দেখতে সুন্দর। গালি দেয় না, বরং মিষ্টি লাস্যে যাত্রীদের ভুলিয়ে রাখে। সে দলে থাকা মানেই কারিগরের এক্সট্রা আয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতে তার প্রমোশান হল ‘সেয়ানা’-তে। কারিগর তার হাতে মাল দিলে সাপের মতো কখন যে কেটে পড়ে বোঝা দায়। দাশরথি ঠিক এই জায়গায় একটা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিল। রামানুজকে মিস্তিরি বানাবে। প্রথম আপত্তি এল অন্য মিস্তিরিদের কাছ থেকেই। হিজড়ারা টিংবাজ, ঘেরা, এমনকি সেয়ানাও হতে পারে, কিন্তু একজন নপুংসক মিস্তিরি হলে অনর্থ ঘটে যাবে। কলকাতায় কেন, সারা ভারতে এই নজির নেই। সবচেয়ে বড়ো কথা, হিজড়া মিস্তিরি হলে কোনও পুরুষ তার অধীনে কাজ করবে না। কিন্তু দাশরথি একবগ্গা। সে রামানুজকে মিস্তিরি বানিয়ে ছাড়বেই। তাকে হাতসাফাইয়ের খেলা শেখানো শুরু হল। হাতের তালুতে মুদ্রা রেখে হাত খুললে খালি। লাউয়ের উপরে একটা পাতলা কাপড়ের সাপি ভিজিয়ে পেতে দিত। একটা ব্লেড আধটুকরো করে ভেঙে একটা অংশ মাঝখানের দুই আঙুলের ফাঁকে রেখে ন্যাকড়া চিরে দিতে হবে, কিন্তু লাউয়ের গায়ে আঁচড় লাগা চলবে না। তাও সে শিখে গেল একমাসের পরিশ্রমে। চেতলার হিজড়াদের খোলে এখন রামানুজের আলাদা সম্মান। রোজগার সবচেয়ে বেশি। মাঝে একবার দাশরথি নিজে এসে গুরুমার কাছে প্রশংসা করে গেছে। কিন্তু রামানুজ জানত সমস্যা বাধবে সেই দিন, যেদিন প্রথম তাকে মিস্তিরি হয়ে ফিল্ডে নামতে হবে। হলও তাই। একজনও তার শাগরেদ হয়ে যেতে রাজি না। দাশরথির ধমকধামক, অনুরোধ উপরোধ কিছুই কাজ করল না। অন্য কেউ হলে ফিল্ডে যাবার সাহসই করত না। একা ফিল্ডে যাওয়া আর জ্বলন্ত আগুনে হাত দেওয়া এক। দাশরথি প্রায়ই গল্প করত, সে নাকি বেশ কয়েকবার একা ফিল্ডে গেছে। রামানুজ ঠিক করল সেও যাবে। একাই। দাশরথি অনড়।
বাধা দিল। ভয় দেখাল। শেষে বলল যে ধরা পড়লে কেউ কিন্তু তাকে ছাড়াতে যাবে না। রামানুজ গড়িয়াহাটে সেদিন প্রচণ্ড ভিড়। সামনেই পুজো। গত চার-পাঁচ দিন টানা বৃষ্টি হয়েছে, তাই লোকজন কেনাকাটা করতে পারেনি। আজ আকাশ পরিস্কার হওয়াতে ভিড় উপচে পড়েছে। সেই ভিড়ের মধ্যেই মেয়েটাকে দেখতে পেল রামানুজ। বন্ধুদের সঙ্গে এসেছে। বোঝাই যাচ্ছে। আর এদিকের মেয়েও না। চোখের চাউনি দেখলেই ধরতে পারে রামানুজ। একেবারে আনাড়ি। হাতের পার্সটা আলগা করে ধরে বন্ধুদের সঙ্গে হাসাহাসি করছে। রামানুজ আজ পুরো মেয়ে সেজেছে। টাইট ওড়না, কুর্তি, বুকে উঁচু প্যাড, চট করে দেখলে ধরা মুশকিল। বেশ কিছুটা দূর থেকে তালি বাজাতে বাজাতে আর দোকান থেকে টাকা চাইতে চাইতে এগোতে শুরু করল সে। কেউ টাকা দিচ্ছে, আবার কেউ দিচ্ছেও না। না দিক, এটা তার ভেক। মেয়েটা যে দোকানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে এসেই রামানুজ এমন শুরু করল যেন তার শরীর বড্ড খারাপ লাগছে। দোকানিকে বলল, “এ বাবু, জারা পানি দেনা। মুঝে উলটি আ রহি হ্যায়”, বলেই বমি করার ভাব করল। দোকানি এসব দেখে অভ্যস্ত। সে “ভাগ হিঁয়াসে” বলে ভাগাতে যেতেই দোকানের ঠিক পাশে বিকট ওয়াক ওয়াক শব্দ তুলে বমি করার চেষ্টা করল রামানুজ। কিছুই বেরোল না। মেয়েটার এক বান্ধবী কুণ্ঠিত হয়ে নিজের জলের বোতল বাড়িয়ে দিল। সেটা না নিয়েই হনহনিয়ে হাঁটা দিল রামানুজ।
কলাবাগানে ফিরে টাকাভর্তি লেডিস পার্সটা যখন দাশরথির সামনে নিয়ে ফেলল, তখন দাশরথির চোখে অদ্ভুত বিস্ময়। কোনও হেল্পার ছাড়া প্রথম দিনেই এত টাকা! রামানুজের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “জিতে রহো বাচ্চে।” দাশরথি নিয়ম অনুযায়ী তার সব চ্যালারা যা কামায় সারাদিন ধরে তা তার কাছে জমা পড়ে। রাত হলে সেই টাকা সে ভাগ করে দেয়। কেউ বেইমানি করে ধরা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তাকে বার করে দেওয়া তো হয়ই, তার নাম, ছবি চলে যায় পুলিশের কাছে। কোনও দিন এই লাইনে আর তাকে কিছু করে খেতে হবে না।
রামানুজের কপাল খারাপ। প্রথম কামাইয়ের একটা পয়সাও সে ভাগে পায়নি। দুপুর নাগাদ একটা ফোন এসেছিল। দাশরথির কাছে। ফোনটা পেয়েই দাশরথির মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। ফোন রেখে খুব ধীরে ধীরে রামানুজের কাছে এসে বলল, “বুরা খবর হ্যায় এক। ভজহরি নে ফোন কিয়া থা। ইয়ে ব্যাগ তু গড়িয়াহাট সে উঠায়া কেয়া?”
রামানুজ মাথা নেড়ে স্বীকার করতেই দাশরথি বলল, “তব তো ইয়ে ভি দেনা পড়েগা। উস এরিয়া মে ভজহরিকা জান পেহচান যে কোই হ্যায়। উ ব্যাগ উঠায়া কোই। হো সকতা হ্যায় কে এহি ব্যাগ হো!”
“কিউ দু ম্যায়? মেরা পহেলা কামাই”, চোখ ফেটে জল আসছিল রামানুজের।
“বেটা দেনা পড়তা হ্যায়। লোকাল লিডার হ্যায় ও। গুন্ডাগদি করতে হ্যা। বহোত উপর তক হাত হ্যায় উসকা। তুঝে ফির মওকা মিলেকা আগর উপকে হাত শিরপে হোগা তো। নেহি তো উস এরিয়া মে হাম কভি নেহি ধুস পায়েঙ্গে। অউর দেখ, এইসা ভি হো সকতা হ্যায় কে ইয়ে ব্যাগ হো হি না।”
কপাল মন্দ রামানুজের। তার ব্যাগটাই। ভজহরির চেনা কোন প্রাইভেট ডিটেকটিভ আছে, তার লাভারের। মন ভেঙে গেল রামানুজের। দাশরথির আড্ডায় নিয়ম, যেদিন যে কোনও আয় করবে না, টাকাও পাবে না। কিন্তু সেদিন রামানুজকে পাঁচশো টাকা হাতে ধরে দিতে চেয়েছিল দাশরথি। সে নেয়নি। ভিক্ষার টাকা সে কেন নেবে? দাশরথি বুঝিয়েছিল কাল আরও বেশি হবে। কাল তার সঙ্গে একজন সেয়ানা আর তিনজন টিংবাজকে বাছাই করে সে নিজে দেবে। কারও ওজর আপত্তি শুনবে না।
পরের দিন আর দাশরথির ডেরায় যাওয়া হয়নি রামানুজের। পরের দিন কেন, আর কোনও দিন যাওয়া হয়নি।
চেতলার খোলায় ফিরেই বুঝেছিল কিছু একটা গণ্ডগোল। সব চুপচাপ। একটা ঘরেও আলো জ্বলেনি। সোজা চলে গেল গুরুমার ঘরে। ঘরে ভিড়। গুরু মা নেই। গোলাপ মাটিতে বসে হাউহাউ করে কাঁদছে। তাকে ঘিরে বাকি হিজড়েরা কেউ কাঁদছে, কেউ মাথা গুঁজে বসে আছে।
দুইদিন হল গুরুমা নেই। কোথায় গেছে, গোলাপ ছাড়া কেউ জানে না। কাঁদতে কাঁদতে গোলাপ যা বলল তার একটাই অর্থ। গুরুমা আর ফিরবে না।
গুরুমাকে ওরা খুন করেছে।
৩।
গুরুমা খুন হবার পরে গোলাপ চেতলার খোলার সর্বেসর্বা হয়ে উঠল। খুব স্বাভাবিকভাবেই রামানুজের ক্ষমতাও একধাপে বাড়ল অনেকটাই। এখন সে গোলাপের ঘরে থাকে, আর গোলাপ দখল নিয়েছে গুরুমার ঘর। গুরুমাকে পুলিশ গুলি করে মেরেছে। অন্তত এমনটাই গোলাপ সবাইকে বলেছে। বডি আসেনি।
এখন রামানুজকে আর দাশরথির দলে যেতে হয় না। তার অন্য দায়িত্ব পড়েছে। বিভিন্ন মেলায়, পিরের দরগায় হিজড়াদের নিলাম বসে। নানা বয়সের হিজড়াদের সাজিয়ে গুজিয়ে গুরুমা-রা বসেন নিলামের আশায়। নিলাম হয় তালি মেরে। এক তালি মানে এক হাজার, দুই তালি দুই হাজার। সাধারণত নাগিনরাই বিক্রি হয় এই বাজারে। সবচেয়ে বড়ো বাজার দিল্লির জামা মসজিদের ধারে হরে বাবা কা মাজার। গরিব নাগিনদের তৈরি করা হয় চেতলার খোলে, তারপর রামানুজ তাদের দিল্লি নিয়ে গিয়ে নিলামে বেচে দেয়। সুশ্রী নাগিনদের দর পনেরো থেকে কুড়ি হাজার। বদলে সেই নাগিনের মালিক তার দেহের উপরে পুরো অধিকার পায়। একদিন
সেই শখ মিটে গেলে আবার তাকে দাঁড়াতে হয় নিলাম বাজারে নতুন খদ্দেরের জন্য। এই গোটা র্যাকেটটাই পুলিশকে ঘুষ খাইয়ে চলে। রামানুজ এখন জেনে গেছে কোন দেবতা ঠিক কোন ফুলে তুষ্ট। জানে কোন নাগিনকে কম দামে কিনে নিয়ে পরে তিন গুণ দামে বিক্রি করা যাবে। বছর ঘুরতে না ঘুরতে হিজড়া খোলের আয় আগের প্রায় ডবল হয়ে গেল। আগের গুরুমা লাভের বেশিরভাগ অংশ নিজের জন্য রাখত। গোলাপ তা করে না। রামানুজও না। লাভের একটা বড়ো অংশ খোলের হিজড়াদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। আর বাকিটা যায় প্রশাসন আর হিজড়ে মাফিয়াদের মুখ বন্ধ রাখতে।
গুরুমা মারা যাবার ঠিক এক বছর বাদে একদিন রাতে আবার রামানুজের ঘরে টোকা পড়ল। গোলাপ। কিন্তু এই সময়? ফিসফিস করে গোলাপ বলল, “গুরুমা কা মোগা ঠিকছে। আয়।” গোলাপ এখন নিজে গুরুমা হয়ে গেছে। তাও সে আগের গুরুমাকে ভোলেনি। কিন্তু সেই গুরুমার মোগা এতদিন বাদে এখানে কী করছে? রামানুজ গোলাপের পিছন পিছন চলল প্রায় অন্ধকার বারান্দা দিয়ে। গুরুমার ঘরের দরজা ভেজানো। খুলতেই দেখল সামনে চেয়ারে বসে আছে সেই লোকটা, যাকে বছরখানেক আগে কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখেছিল রামানুজ। দেবাশিস না কী যেন নাম। লোকটার মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। এ হাসি এ পাড়ায় কেউ হাসে না। যেন বড্ড সরল, বড্ড বাচ্চাদের মতো, কোনও ঠাকুর দেবতার হাসি।
“তুমিই রামানুজ?”
“জি।”
“তোমার কথা খুব শুনতে পাই। তুমি এখন ফেমাস হে। এক বছরে চেতলা খোলের ভোল বদলে দিয়েছ।”
গোলাপ পাশ থেকে বলল, “এ আসার পরে আখখার একদম আরিয়ানে চলছে। বড়কা বড়কা দশ পাতিয়া নিয়ে আসছে এই চিলকাটা। গুরুমার লোকান্তির পরে এই চালাচ্ছে পুরো আখখার।”
“যাক ভালো খবর। বাচ্চা বয়সেই ব্যবসা ধরে নিয়েছে। এই তো চাই। কিন্তু গোলাপ আমার কাজের কী হল? এক বছর সময় দিয়েছিলাম। কোন খবর পেলে?”
জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমন হয় গোলাপ সেভাবে গুটিয়ে গেল। পাশাপাশি মাথা নাড়ল। পায়নি।
“তুমি খোঁজ করেছিলে? না ভেবেছিলে অভয় মরেছে আর তার সাঙ্গ আমিও সবকিছু ভুলে গেছি”, গলা চড়তে থাকে ভদ্রলোকের। “হাতে আর সময় নেই। বড়োজোর দুই বছর। এদিকে এখনও জিনিসটার কোনও পাত্তাই নেই!
গোলাপ মিনমিন করে একেবারে স্বাভাবিক গলায় বলে, “এত পুরানা খবর পেলেই বাক্সা। তাও কোন খোলের জানা নেই। হামি নজরে রাখছি। খবর যাই। কিন্তু কাম হয় না। বাক্সা আর ভূত একসঙ্গে গায়েব। ছে মাহিনে পহলে কা কিসসা শুনা আপনে?”
“কোন কিসসা?”
“খিদিরপুরওয়ালা। পেপার মে ভি তো আয়া থা।”
“শুনেছি। ঘটনা শুনে যা মনে হয় এ সেই ভূতের কীর্তি ছাড়া কিছু না। তুমি সেই খোলায় লোক পাঠিয়েছিলে?”
“হামি নিজে গিয়েছিলাম।”
“আচ্ছা, তারপর? কিছু পেলে?”
“কুছ নেই। সব সাফসফা। যো কুছ ভি থা, পুলিশ লে গয়া।”
“আমিও গেছিলাম। অনেক পরে…” খুব ধীরে ধীরে বলল লোকটা, “ঠিকই বলেছ। কিছুই পাওয়া যায়নি। বাকিরা এখন ওই খোলায় থাকতে ভয় পাচ্ছে।”
“উও তো হবেই বাবু। তিন-তিনটে মওত। তাও একদম অচানক।”
“শোনো, যে কারণে তোমার কাছে আসা, আমি আমার মতো করে খোঁজ চালাচ্ছি। একা না, একজন পুলিশ আর এক প্রাইভেট ডিটেকটিভকেও কাজে লাগিয়েছি। ওরা অবশ্য আসল জিনিস কিছু জানে না। তবে এবার যার জন্য এসেছি সেটা ওদের দিয়ে হবে না। ভালো নাগিন চাই তার জন্য। টোপ দিতে হবে।”
“কিউ? কেয়া হুয়া?”
“কিছুই তো খোঁজ রাখো না। সেদিন ওই ঘটনার সময়, ওই তিন হিজড়ে ছাড়া খোলায় আরও একজন ছিল। গুরুমা-র মোগা। সে যে কেমন করে বেঁচে গেল কে জানে। পুলিশকে একটা বয়ান দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমার ধারণা সে লোক এর বেশি অনেক কিছু জানে। ওর থেকে কথা বার করতে হবে। আমি খুঁজে বার করেছি লোকটাকে। এমনিতে বলবে না। ভালো নাগিন চাই ওকে বশ করতে।”
“তো ফিকর কী আছে? নিয়ে যান যাকে খুশি।”
“যাকে খুশি? বেশ, তবে ওকে দাও। আমার ওকেই চাই। ওকে নিতেই আমি এসেছি।”
এটা গোলাপ কল্পনাও করতে পারেনি। সে লোকটার পায়ে পড়ল, বুক চাপড়াল, বোঝাতে চেষ্টা করল রামানুজ চলে গেলে চেতলা খোল কানা হয়ে যাবে। লোকটা অনড়।
“তুমি জানো গোলাপ, যে কাজে নেমেছি, তাতে যদি সফল হই আমরা, তবে এই দুই-তিন মাসের ক্ষতির একশো গুণ লাভ করবে আপত্তি করে লাভ নেই। মেনে নাও।”
গোলাপ কিছুতেই মানবে না। রামানুজকে ছেড়ে দিলে তার চলবে না। এই এক বছরে রামানুজ তাকে আলসে করে দিয়েছে। গোটা খোলার ভার বকলমে রামানুজ সামলায়। সে চলে গেলে দুইদিন বাদে খোলাও উঠে যাবে। এবার সে কাঁদতে আরম্ভ করল। শেষে আর উপায় না দেখে লোকটা বলল, “ঠিক আছে। ছাড়তে হবে না। আমি তেত্রিশ নম্বরকে খবর পাঠাচ্ছি, তুমি আমার কাজে বাধা দিচ্ছ। তারপর দেখি তোমার খোলা আর কতদিন টেকে।”
এই তেত্রিশ নম্বর কী জিনিস রামানুজ জানে না। শুধু এটা জানে এর পর আর একটাও কথা বলেনি গোলাপ। শুধু হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে ছিল। সকাল হয়ে আসছে।
“মিনিমাম জামাকাপড় একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে আমার সঙ্গে চলো।” রামানুজের দিকে তাকিয়ে বেশ নরম গলাতেই বলল লোকটা।
চন্দননগরে লোকটার বাড়িতে দুজন যখন ঢুকল, ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে।
.
পেটভরে খেয়ে সারাদিন ঘুমোল রামানুজ। লোকটা অফিস গেছে। বলে গেছে বাইরে না বেরোতে। যতই দরকার হোক। সন্ধে হবার আগেই ঘরে ঢুকল লোকটা। রামানুজকে দেখে একগাল হেসে বলল, “ঘুমিয়েছ? পেট ভরা?” সে নিজে যে সারারাত জেগে, তার ক্লান্তি কোথাও নেই।
রামানুজ কথা না বলে ঘাড় নাড়ল।
“আমায় খুব বাজে লোক মনে হচ্ছে, তাই না? জানি। আমি তোমার থাকলে আমারও মনে হত। তোমায় সব খুলে বলি। বাংলা বোঝো তো?”
আবার ঘাড় নাড়ল রামানুজ।
“বেশ। শোনো, আমাদের একটা এনজিও আছে। আমরা হিজড়া আর বেশ্যাদের নিয়ে কাজ করি। তুমি বলবে সে তো সবাই করে। এমন পরে পরে এনজিও আছে। কিন্তু না, আমরা হিজড়াদের অধিকার আদায়ের জন্য পড়ি না। আমরা হিজড়াদের সমাজে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য লড়ি না। আমরা চাই লা কোনও হিজড়া সমাজের ভিক্ষায়, কৃপায় বেঁচে থাকুক। আমরা এমন একটা সমাজ গড়তে চাই, যেখানে গোটা সমাজ তোমাদের কৃপায় বেঁচে থাকবে। সব নেকুপুযুগিরি। এই পাইয়ে দাও। ওই পাইরে দাও। অনেক হয়েছে এইসব চোখের জল ফ্যালো। সম্মেলন করো। তাতে গুষ্টির মিষ্টি ধ্বংস করে শেষ অবধি লাভের বেলায় ঘণ্টা। ঘেন্না লাগে না তোমার?”
আবার মাথা নাড়ল রামানুজ। লাগে। কিন্তু কী করা?
“আমরা বিশ্বাস করি ডাইরেক্ট অ্যাকশানে। অনেক লোকভুলানো কথা হয়েছে। এবার কাজ। তোমাকে এখনই সবটা খুলে বলতে পারছি না, তবে এটা বিশ্বাস রেখো আমরা আসলে একটা যুদ্ধে নেমেছি। গোপন যুদ্ধ। তথাকথিত ভদ্র নারী পুরুষদের বিরুদ্ধে। আর আমরা যদি জিতি, তবে এমন দিন আসবে যখন সারে সারে নারী আর পুরুষদের দল আমাদের পায়ে এসে লুটিয়ে পড়ে বলবে, “ক্ষমা করো। এতদিনের অবিচার, অত্যাচার, অনাচারের জন্য ক্ষমা করো। আর আমরা বলব…না”
উত্তেজনায় গলার শিরা ফুলে উঠেছে লোকটার। চোখ লালচে। পাশে রাখা জলের বোতল থেকে এক ঢোঁক জল খেল লোকটা। আবার শুরু করল, “অভয়, মানে তোমাদের গুরুমা ছিল আমাদের বড়ো সৈনিক। জানি না তোমরা ওকে কতটুকু জানো। খুব বড়ো মনের মানুষ ছিল। একটাই সমস্যা ছিল। সেক্সের ব্যাপারে নিজেকে কনট্রোল করতে পারত না। তোমাদের খোলে সবাই জানত আমি ওর মোগা। ও-ই রটিয়েছিল। ভাবলে অবাক হবে, কোনও দিন আমার সঙ্গে কোনও ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ ছিল না ওর। আমি যেতাম আমাদের সমিতির কাজ আলোচনা করতে”।
সমিতির আলোচনা এত রাতে? এত গোপনে? কেন? কেন এই লোকটাকে সবাই এত ভয় করে? তেত্রিশ নম্বর কে? নানা প্রশ্ন জাগতে থাকে রামানুজের মনে। তার আগেই লোকটা বলে উঠল, “তোমার মতো ব্রাইটদের খুব দরকার আমাদের সমিতিতে। আমার খুব ইচ্ছে তোমায় দলে ঢোকাই। কিন্তু তার আগে তোমাকে একটা পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। বিশ্বাসের পরীক্ষা। আনুগাত্যের পরীক্ষা। আনুগত্য বোঝো?”
“হাঁ। নিষ্ঠা।”
“বলতে পারো। তোমাকে একটা কাজ দেব। কেউ জানবে না। গোলাপও না। খিদিরপুরের সেই মোগা, যার কথা বলেছিলাম, এখনও কোনও নতুন খোলায় যাচ্ছে না। ভয় পেয়েছে বোধহয়। কিন্তু বাঘ একবার রক্তের স্বাদ পেলে ভুলতে পারে না। ছেলেটা চন্দননগরের। কিন্তু কাজ করে কলকাতায়, এক শাড়ির দোকানে। সকালের যে ব্যান্ডেল লোকালটা সাড়ে নটায় হাওড়ায় ঢোকে, সেটাতে নামে। নেমেই সিধা টয়লেটে যায়। সেখান থেকে বেরিয়ে পাশেই রেলের ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে গোটা একটা সিগারেট শেষ করে তারপর কাজে যায়। তোমাকে কয়েকদিন সেখানে দাঁড়াতে হবে। ওর চোখে পড়বেই। তোমার খোলার নাম, ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে মিথ্যে বলবে না। ওর যা চ্যানেল, ধরে ফেলবে। চেষ্টা করবে ও যেন তোমার পারিক হয়ে যায়। বাড়িতে পাগল মা ছাড়া কেউ নেই। অসুবিধা হবার কথা না। ওর সঙ্গে মিশবে। প্রথমেই না, ধীরে ধীরে ও নিশ্চয়ই খিদিরপুরের কথা বলবে। যা বলবে শুনে যাবে। এমন প্রশ্ন করবে না, যাতে ওর মনে সন্দেহ হয়। পারলে মোবাইলে গোপনে রেকর্ড করে রাখবে। পরে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েই ডিলিট করে দেবে। আমার নম্বর সেভ করে রাখবে না। মুখস্থ করে রাখো আর বিপদে পড়লে আর-একটা নম্বর দিলাম। সেখানে কল করবে। কেউ ধরবে না। একটা আননোন নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ কল আসবে। যা বলার বলবে। কিছু শুনতে চাইবে না। লাভ নেই। উত্তর পাবে না। আর হ্যাঁ, কপালগুণে আমরা দুজনেই চন্দননগর থাকব। রাস্তাঘাটে দেখা হতেই পারে। স্রেফ না চেনার ভান করে চলে যাবে। ঠিক আছে? দ্যাখো, আমি জানি এই কাজে রিস্ক আছে। কিন্তু সফল হলে গোটা পৃথিবী তোমার পায়ের তলায়। একবার যদি ঠিকঠাক আমাদের হাতে এসে যায়, তবে দেখো সেই ভূত নিয়ে কেমন তাণ্ডব দেখাব সবাই মিলে। বলো, রাজি?”
“হ্যাঁ।”
.
রামানুজের সামনে মোবাইলের স্ক্রিনে একটা ছবি দেখিয়ে লোকটা বলল, “এই যে তোমার হবু পারিক। নাম বিশ্বজিৎ দে। বাড়ি চন্দননগরের বোড় পঞ্চাননতলায়। মুখটা ভালো করে দেখে রাখো। হাওড়া স্টেশনে হাজার লোকের মাঝে চিনে নিতে হবে তো!”
৪।
খিদিরপুরে তিন বৃহন্নলার নৃশংস হত্যাকাণ্ড
নিজস্ব সংবাদদাতা: গতকাল খিদিরপুরের “হিজড়া খোল” নামে পরিচিত বৃহন্নলাদের বসতিতে এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। খোলার গুরুমা ইউনুস হিজড়ে গতকাল দুপুর একটা নাগাদ আচমকা উন্মাদের মতো হয়ে খাটের তলা থেকে একটা বড়ো রামদা নিয়ে খোলের অন্য এক হিজড়া চামেলী হিজড়ানির দিকে তেড়ে যায়। কেউ কিছু বোঝার আগেই চামেলীর ধড় থেকে মুণ্ড আলাদা হয়ে যায়। তারপরেই সে বাকি দুইজন হিজড়া মাহামুদান আর জহরীকে আক্রমণ করে। তারা যথাসম্ভব নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করলেও শেষরক্ষা হয়নি। দেহের বিভিন্ন জায়গায় গভীর আঘাত লাগে তাদের। কলকাতার এক নামকরা বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরে তিনজনকেই মৃত ঘোষণা করা হয়। সেই সময় ওই খোলে এই চারজন ব্যতীত অন্য একজনও ছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই ব্যক্তি জানিয়েছেন উন্মত্তের মতো তিনটি খুনের পরই ইউনুস অজ্ঞান হয়ে যায়। পুলিশ অকুস্থলে এসে তাকে গ্রেপ্তার করলে ইউনুস গোটা ঘটনা অস্বীকার করে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ও অবস্থাগত প্রমাণের উপরে ভিত্তি করে পুলিশ ইউনুসকে গ্রেপ্তার করেছে। মৃতদেহগুলোকে পোস্ট মর্টেমে পাঠানো হয়েছে।