।। প্রভাবতী ।।
চাঁদ নামটি যথাযথই হয়েছে। সূয্যির মেয়ে চাঁদ ”আমারো সোনা, চাঁদেরো কণা” এই বাচ্চাকেই বলা যায়। হুবহু মুন্নু বসানো, সূয্যির মেয়ে বলে দিতে হয় না। পিসির মতনই দেখতে। পদ্মকে এমন ধারা হাসিখুশি দেখিনি অনেক বছর। আজ দেখি পদ্ম এক্কেবারে ঠিকঠাক। কোথায় গেল তার সেই ছিটকেলপনা? পদ্ম একগাল হেসে আমাকে এসে বললে—”মা, এই দ্যাখো তোমার পুতনি—সূয্যির মেয়ে, চাঁদ!’ বলেই চাঁদকে আমার কোলে তুলে দিলে। মেয়েটাও তেমনি! একটুও ভয় পেলে না ? আমার গলাটা জড়িয়ে ধরল সঙ্গে সঙ্গে? থাকে তো থাকুক। ছোট একটা কচি বাচ্চা বৈ তো নয়। জায়গায় কুলিয়ে যাবে ঠিক। ছোটবাবু, বড়ও চাইছে।
।। সোমশংকর ।।
বাড়ির ব্যবস্থা নিয়ে আর কেউ কিছু ঝামেলা করছে না—কুন্দুলিয়ার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে দাদার। —বাঁচা গেল। মা—ও মেয়েদের বিপক্ষে সওয়াল করা বারণ করেছেন— বোধহয় চাঁদনি বাঈকে দেখে হঠাৎ মার একটা চেঞ্জ অফ হার্ট হয়েছে। দাদা মেজদা সেজদা দুই বোনকে অ্যাকোমেডেট করেই বাড়ির ব্যবস্থাপনা করছে—মামণির অংশটা দাদা আর আমি পাবো। মায়েরটা মেজদা, সেজদা। কাকুরটা পদ্মা—যমুনা দুই বোনের। হিসেব ঠিক আছে। চলতা হ্যায়। দাদা বলছে, ওদের যেহেতু ইস্যু নেই, ওদের অংশটা ওরা চাঁদকে লিখে দেবে। ফাইন উইথ অল অফ আস।
আমার যেন রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল এই বাড়ি বিভাগের অঙ্ক।
মামণির ভাষায় বললে, রাধামাধব হ্যাজ টেকন কেয়ার অব ইট। রাধামাধবকুঞ্জ—রাধামাধবেরই বাড়ি তো, আফটার অল?
।। সরমা ।।
খুব পরিশ্রম গেছে সারাদিন, তবু ক্লান্তি বোধ করচি না। আজ অনেকদিন পরে আবার আমাদের রামধন মিত্তির লেনের বাড়িতে এতগুলো আলো জ্বলছে, এত হাসিগান, এত লোকজন, এত আনন্দ উৎসব হয়েচে—অনেক বছর পরে আবার এভাবে এই বাড়িতে জড়ো হলুম আমরা। রবি—ললিতা আজ আমেরিকা থেকে টেলিফোন করেছিল। বিবিও টেলিফোন করেছিল। মণি তো আবার হুট করে আজ সকালবেলাতেই এসে উপস্থিত হয়েচে, ঠিক সেবারের মতন। বিবির ইশকুল খোলা বলে তার আর আসা হয়নি। একা এসেচে বলে মণি এ বাড়িতেই উঠেচে।
দিয়া—জিয়াকে নিয়ে মেজোও চলে এসেচে—এ বাড়িতেই আছে ওরা—খুব আনন্দ, হৈ চৈ করচে নাতি—নাতনিরা ছোটবাবুকে নিয়ে। যমুনাও এসেছে, আছে আমার কাছে। শ্রীদিদি সিদ্ধার্থদার সঙ্গে রাতে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গেছে, আবার কাল আসবে। বাড়িটা খালি হয়ে যাবার আগে আর একবার ভরে উঠেছে—ছোটবাবুর আশি বছরের জন্মদিনে। আমি ভিয়েন বসিয়েছি, ছাদে ম্যারাপ বেঁধেছি, পাড়া—প্রতিবেশীদের নেমন্তন্ন করে এসেছে বরুণা আর সোমু। আজ শুধু আমরাই—পরিবারের সবাই খাওয়া দাওয়া করছি, কাল পাড়ার লোকেরা আসবেন। কিন্তু চাঁদবুড়িকে নিয়েই প্রধানত উৎসবটা দাঁড়িয়ে গেল আজ আমাদের বাড়িতে। ছোটবাবুর জন্যে যারা আজ একত্র হয়েছিলুম তারা সবাই নৈবেদ্যর ওপরে সন্দেশের মতন চাঁদবুড়িকে পেয়ে গেলুম উপরি—আর সেইসঙ্গে তার অভাগী মা—কেও। হে রাধামাধব, মেয়েটাকে রক্ষে কোরো ঠাকুর, বড্ড দুঃখী মেয়ে আমাদের নাতবৌটি, জারিনা, বড় ভালো মেয়ে গো।
আজ ছোটবাবুর আশি বছর পূর্ণ হল! রাধামাধবের দয়ায় ভালোয় ভালোয় বাকি দিনগুলো যেন এমনি হেসেখেলেই কেটে যায়। ছোটবাবু তো ছোটই রয়ে গেলেন আশি বছর ধরে। এই বাড়ি ভাঙার ব্যাপারটা তাঁর বুকে লেগেছে—আমি খুব ভয় পাচ্ছিলুম। ওঁর বাবা, দাদা, মেজদা—সকলেই তো হঠাৎ করে বিনা নোটিসে চলে গেছেন, এ বাড়ির পুরুষমানুষরা বিছানায় গড়াগড়ি করে যমের দুয়োরে যায় না। মনে হচ্ছে সেই ভয়টা যেন আর নেই—চাঁদের আলোর ওষুধ পাঠিয়ে দিয়েছেন যে রাধামাধব! চাঁদনী, আমাদের চন্দ্রাবতী, নাতির মেয়ে পুতনি—আমাদের কোলে চলে এসেছে। স্বপ্নেও যা ভাবিনি কোনোদিন। আহা, পদ্ম আমার যে কী যে সুখী হয়েচে—তার আহ্লাদ যেন অঙ্গে ধরে না। মুন্নু আর সৌরভ বলছে ওকে ওরা দত্তক নেবে—বলচে পদ্মও চলুক ব্যাঙ্গালোরে ওদের সঙ্গে, চাঁদবুড়ির দেখাশুনো করবে।
আমরা বলচি, তা কেন, তা কেন, ও এখানেই থাক—ঠাম্মার কাছেই বড় হোক না?
আমরাও তো তাহলে ওকে পাবো! এ বাড়িতেই তো ওকে এনেচে ওর মা? মেজোর মস্ত একটা বদল হয়েচে বলে মনে হচ্ছে। সেও চাঁদের চাঁদমুখটি দেখে ভুলেচে বোধ হয়। এ বাড়িটা যখন ভেঙেচুরে খান খান হতে চলেছে, হঠাৎ তখন কোথা থেকে উদয় হল চাঁদবুড়ি, এক মুহূর্তে আমাদের সব্বাইকে যেন মালার মতন করে একসুঁতোয় গেঁথে তুললে। —যে যেখানে থাকি না কেন, বুকের মধ্যে রামধন মিত্তির লেনের সুতোর টানটা টের পাবো—যে—টানে চাঁদ সুদ্ধু এসে পড়েচে সেই বাংলাদেশ থেকে। জারিনা এখন মাসখানেক এখানেই থাকবে, চাঁদবিবি আমাদের চিনে গেলে, তারপরে ওর বিদেশযাত্রা। ওর বন্ধুটি, ঐ সিলভিয়াও থাকচে। বেশ মেয়েটি। কী মিঠে মিঠে করে ভাঙা ভাঙা বাঙাল ভাষায় কথা বলে একটু একটু! ভারী মিষ্টি লাগে, দিয়া—জিয়ার সঙ্গে জমে গেছে।
সূয্যির ঘরটাই ওদের জন্যে গুছিয়ে দিয়েছে পদ্ম। পদ্মর খুশিটি যত দেখচি ততই, আমি জারিনাকে মন—প্রাণ ঢেলে আশীর্বাদ কচ্চি। আহা দুঃখী মেয়েটা, নিজের শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই পেল। রাধামাধবের কী যে লীলা, কে বুঝবে?
আজ শনি, কাল রোববার। —দু’দিনই ধরেই এ বাড়ি উৎসবের বাড়ি, যজ্ঞিবাড়ি হয়ে উঠেচে। কাল গানবাজনা আছে—ব্যান্ডপার্টি আসবে শুনছি—এই বাড়িতে এই তো শেষ বড় উৎসব? ছোটবাবু অবিশ্যি ভীষণ আপত্তি করছেন, ‘না না, এটা শেষ নয়। বাড়ি ভাঙতে এখনও দেরি আছে ক’মাস। তার আগে আমরা এখানে চাঁদবুড়িকে নিয়ে উৎসব করবো—এ বাড়িতে তাকে আর তার মাকে শুভ অভ্যর্থনা জানাতে হবে না? ওর তো অন্নপ্রাশনও হয়নি। জন্মদিনও হয়নি—ওকে নিয়ে, ওকে ঘিরে, ওর মাকে নিয়ে বড় করে একটু উৎসব করতেই হবে। এইখানে রামধন মিত্তির লেনের পুরোনো বাড়িতে। ওর মা যার টানে এসে পড়েছে।” ছোটবাবু বলছিলেন, ”চাঁদবিবি এ বাড়ির ষষ্ঠ প্রজন্ম। বৌঠান, প্রাণশংকর, শিবশংকর, ভবশংকর, পদ্মাবতী, সূর্যশংকর, তারপরে চন্দ্রাবতী। ওকে নিয়ে একটা উৎসব করতেই হবে, আমাদের পৈতৃক ভিটে বাড়িটা পাঁচভূতের হাতে চলে যাবার আগে।” সকলেই তো ছড়িয়ে রয়েছে এখানে—ওখানে। আবার নতুন করে জড়ো করা। দেখি কত তাড়াতাড়ি সেটা হয়?
।। উপসংহার ।। ।। দেবশংকর ।।
আজ মুন্নুদিদির ফোন এসেছিল। পদ্ম খুবই খুশিতে আছে চাঁদকে নিয়ে। ওরা একটা বড়সড় ফ্ল্যাটের চেষ্টা করছে। আমি ভাবছি এখান থেকে আমরা ওদের ফ্ল্যাটের ভাড়াবাবদ কিছু কিছু টাকা পাঠাবো। মুন্নুর একলার ফ্ল্যাটে এখন তিনজন। সৌরভের ফ্ল্যাটটাও ছোটই, সিংগল মানুষের ফ্ল্যাট। ওদের বিয়ের রিসেপশন পরে এখানেই হবে, এখন ওখানে রেজিস্ট্রেশনটা হয়ে যাচ্ছে আগামী সোমবার। বিয়ের পরে ওরা বড় ফ্ল্যাটে উঠে যাবে সবাই মিলে—এমনি ইচ্ছে। আজ পদ্মও ফোনে কথা কইল।
অবিকল সেই আগেকার পদ্মমা। বড় বৌঠানের ভাষায়, রাধামাধবের লীলা, কে কবে বুঝেছে! ওদের রেজিস্ট্রেশন আমাকে যেতে বলছে মুন্নুদিদি, সাক্ষী হতে। আমি বলছি সুমন যাক এ বাড়ি থেকে। ইয়ংম্যান। দেখি, কে যায়। সুমনের শুটিং চললে ও যেতে পারবে না—তখন হয়তো আমাকেই যেতে হবে—বুড়োদের হাতে তো অনিঃশেষ অবসর। আমারও যে একটু আগ্রহ নেই, তা বলবো না অবিশ্যি—চাঁদবিবিকে এই সুযোগে আরেকটু দেখে আসা হবে। পুতনি বলে কথা? আমাদের পরিবারের ষষ্ঠ প্রজন্ম—এই ফাঁকে ওর সঙ্গে আরো একটুখানি ভাব জমিয়ে আসা যাবে। সেটা খুব অল্প আকর্ষণ নয়। বড়বৌঠান ওকে শিখিয়েছেন আমাকে ‘ছোটবাবু’ বলে ডাকতে—খুব ‘ততবাবু’ ‘ততবাবু’ করছে নাকি ওখানে গিয়ে।
***
thanks majk