রামধন মিত্তির লেন – ৪

।। জারিনা-২ ।।

দেবশংকর ঘরে এলেন।

সদ্য স্নান করে এসেছেন, গা থেকে অভিজাত পাউডারের মৃদু সুগন্ধ আসছে। শাদা পাজামা—পাঞ্জাবি, পায়ে শুঁড়তোলা লাল বিদ্যেসাগরী চটি। দেবশংকরকে দেখে মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। দুই হাত জুড়ে নমস্কার করল। একটু কি নার্ভাস?

দেবশংকরও প্রতিনমস্কার করলেন।

স্পষ্টই বিচলিত। —”বসুন, বসুন।”

পিছনে পিছনে সরমাও এসেছেন। শান্ত মুখের ভাবে কিছু বোঝা যাচ্ছে না তাঁর মনের কথা। তাঁকেও নমস্কার করে মেয়েটি। মুখে—বিষণ্ণতার ছায়া।

”বোসো মা, বোসো।”

জারিনা বসে।

”আমি দেবশংকর দত্ত। ইনি আমার বড়বৌদি সরমা দত্ত। আপনার—”

”আমি জারিনা।”

”আপনিই বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?”

”জী। আপনেগো কথা আমি খুব শুনসি বড়মা? আর দাদুভাই তো?”

স্তম্ভিত মুখচ্ছবি দুজনেরই। জারিনা সেটা খেয়াল করল না—”দেইখ্যাই চিনসি।” বলে মৃদু হাসল। একটু যেন আত্মবিশ্বাসী হয়েছে।

 মেয়েটা দাদার বন্ধু? কী রকমের বন্ধু ও দাদার? বাড়ি বয়ে কী বলতে এসেছে? সুব্রতার ভ্রূ কুঞ্চিতই থাকে।

 দেবশংকর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা বলেন।

”শুনলুম আপনি আমার সঙ্গে কিছু জরুরি আলোচনা করতে চান। তা বলুন, কী বলবেন। আমার বড়বৌদির সামনেই বলতে পারেন। মুন্নু, তুই ওদিকে যা।”

”না না, মুন্নু থাকুক, থাকুক মুন্নু।”

একটু সচকিত হলেন দেবশংকর।

—”আমার নাম জারিনা, দাদুভাই। সূর্যর সাথে আমার শাদীর দিন হইয়া গেসিল। কিন্তু শাদীডা আর হয় নাই। সূর্য—”

দেবশংকর সামনের চেয়ারটিতে ধূপ করে বসে পড়লেন। সরমা সেটি লক্ষ করে চঞ্চল হয়ে উঠে আলোচনার রাশটা নিজের হাতে নিলেন। সরমা বললেন—

”জারিনা, মা, তুমি একটু বোসো, এই যে, এখানে এসে আমার কাছে বোসো। আস্তে আস্তে সব কথা হবে।” নিজেও বসলেন সোফায়, একটু সরে গিয়ে নিজের পাশেই জারিনাকে ডেকে নিয়ে বসলেন সরমা। খুব আস্তে তার পিঠে হাত রেখে বললেন—”সূয্যির সঙ্গে তোমার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল বলছিলে?”

”জী।”

”কোথায় দেখা হল তোমাদের?”

”জী, চিটাগাংয়ে।”

দেবশংকরের এতক্ষণে বাক্যস্ফূর্তি হয়েছে।

”সূয্যি কী করছিল চিটাগাংয়ে?”

”তার জাহাজ আইছিল চিটাগাং পোর্টে। আমার এট্টা ইন্টারন্যাশনাল আর্টিস্টস ক্যাম্প হইতেছিল সমুদ্রের কিনারে—সেইখানে আলাপ। আমি ছবি আঁকি, বড়মা।”

‘বড়মা’ ডাক শুনে সরমার অবাক হওয়া বুঝে নিয়ে ও বলে—”আমি জানি তো। দাদুভাই, বড়মা, দিদামা সক্কলের কতাই কইত শুভম। তাই তো রামধন মিত্তের লেনে আইলাম, চান্দের লেইগ্যা।”

”চাঁদ কে?”

”আমাগো মাইয়া। শুভমের আর আমার।”

ঘরে বাজ পড়লেও বোধ হয় এই মুহূর্তে তার শব্দটাও ডুবে যেতে এই স্তব্ধতায়।

স্তব্ধতা ভেঙে সুব্রতা বলে ওঠে—”তার মানে?”

”নামও সেই দিসে। প্রেগন্যান্সির খবরখান শুইন্যাই তো আহ্লাদে অস্থির হইয়া ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে ছুট লাগাইল—শাদীর ডেট ঠিক কইরা নোটিশ দিয়া আইলাম আমরা। কইল, পোলাই হউক, আর মাইয়াই হউক, নাম দিব নে চান্দ! সূর্যের বাচ্চা চান্দ।” এবারে খোলামুখে হাসে মেয়েটা। হাসলেই ওর সমস্ত শরীরে আলো জ্বলে ওঠে।

”কইল, আব্বুর নাম তুষার, আমাগো পোলা হইলে নাম দিমু তুহিনশংকর। আর আম্মার নাম পদ্মাবতী, মাইয়ার নাম দিমু চন্দ্রাবতী। তাই দিসি নাম চান্দ। আর চন্দ্রাবতী। সে তো আর ওরে দেখেও নাই, নাম শুনেও নাই।”

সরমা হঠাৎ বললেন, —”তোমার নিজের মায়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে বাচ্চার নাম দিলে না কেন, মা?”

”আম্মীর যে আরবী নাম, জিন্নৎ আরা? তার সাথে মিলাইয়া, বাংলা নাম পামু কনে? আরবী নাম আমার একটুও পসন্দ হয় না। আমি তো আমার নামও জারিনা কই না। রিনা কই। বাঙ্গালি মাইয়ার আরবী নাম কি মানায়, বড়মা?”

”তোমার মায়ের কাছেই ওকে রেখে এসেছ বুঝি?”

”হেইডাই তো কথা—আম্মীর এন্তেকাল হইয়া গেসে। তাও ছয়মাস হইল।” মেয়েটির মুখে মুহূর্তে কালো ছায়া ঘনিয়ে এল। এত স্পষ্ট? এত স্বচ্ছ ওর মুখ? এই রহস্যময়ীর?

সরমা সরে এসে জারিনার পিঠে হাত রাখলেন।

।। জারিনা-৩ ।।

আস্তে আস্তে জানা গেল জারিনার ইতিবৃত্ত। সে একজন শিল্পী। সমুদ্রতীরে আর্টিস্টস ক্যাম্প হচ্ছিল দেশি—বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে—চট্টগ্রামের সেই সমুদ্রতীরেই জারিনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল শুভম জনাথন দত্ত নামের এক তরুণ ভারতীয় নাবিকের।

তারপর রূপকথার মতো সময়—বিয়ের তারিখ স্থির হয়ে গেল, জারিনার মা হবার সম্ভাবনা জেনেই। মহানন্দে পরিকল্পনা চলছিল—বহু বছর বাদে নাবিক ছেলেটি তার দেশে ফিরবে—বৌ নিয়ে। বাচ্চার জন্ম হওয়া চাই রামধন মিত্তির লেনের বসতবাড়িতে। রামধন মিত্তির লেনের সবাই কেমন আনন্দ করবেন সূয্যির বাচ্চাকে নিয়ে। সেটা নিয়েও আলোচনা হত তাদের। জারিনার শিকড় নেই, তার নিজস্ব কোনো পরিবার নেই—শুধু মা ছিলেন, তাই রামধন মিত্তির লেনের বাড়িটা তার কাছে স্বপ্ন। বিয়ের দিন স্থির হবার পরেই হঠাৎ শুভমের ডিউটি এসে পড়ল। ওদের জাহাজ দু’মাসের জন্য সমুদ্রযাত্রা করবে। ঠিক হল ফিরে এসে বিয়েটা হবে—দু’মাস পিছিয়ে। কিন্তু শুভম যে সেই গেল, আর শব্দটিও নেই। না ফোন, না চিঠি, না ই মেল—কোনও যোগাযোগই রইল না ওদের মধ্যে—জারিনা উদ্বেগে পাগল হয়ে যাচ্ছে—ওর মনে হচ্ছে ওর বাবার মতোই, ওর হবু স্বামীও ওকে পরিত্যাগ করল। অনেকরকম নীচ কথা, মন্দ ভাবনা মনে আসতে থাকে। নানান দুর্ভাবনায়, বিশ্বাস—অবিশ্বাসের দোলাচলে যখন পাগল হয়ে যাচ্ছে জারিনা, তার মা তখন তাকে বোঝাচ্ছেন, পুরুষমানুষ এরকমই হয়। মজা লুটে পালিয়ে যাওয়াই তাদের স্বভাব। শুভমও আলাদা নয়। সে নির্ঘাৎ ইনডিয়াতে বৌবাচ্চা রেখে এসেছিল। হিন্দুদের তালাক হয় না। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, দুঃখেরও কিছু নেই, তার মাও তো তাকে একা হাতেই মানুষ করেছেন। সেও পারবে বাচ্চাকে গড়ে তুলতে। শুভমের কোনও খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না। আর মা এই রকম সান্ত্বনাবাক্য শোনাচ্ছেন—সমুদ্রে ভেসে—বেড়ানো একটা ঠিকানাবিহীন ছেলেকে কেউ খুঁজে বের করতে পারে? সে তোর বাচ্চার দায়িত্ব নেবে কেন? ওর কথা ভুলে যা—জগতে অনেক পুরুষ মানুষ আছে। বাচ্চার দিকে নজর দে।”

জারিনার বিপর্যস্ত মনকে সান্ত্বনা দিতে এসব কথা কার্যকরী ছিল না। সে ক্রমশই গাঢ়তর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল। ঢাকাতে মায়ের কাছেই তার সন্তান হল। অসুস্থ মেয়েকে ও নাতনি শুশ্রূষা করতে লাগলেন সাধ্যমতো মা—ই। বাচ্চার ভার নেওয়ার শক্তিও জারিনার তখন ছিল না। শুভম না ফিরে আসায় চূর্ণ চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল জারিনার বিশ্বসংসার।

অবশেষে নেহাত কাকতালীয়েই দুঃসংবাদটা শুনতে পেল ওরা। শুনেও বিশ্বাস করতে পারেনি, উড়ো খবর বলে উড়িয়ে দিয়েছে—শুভম নামে ঐ হাসিখুশি লম্বাচওড়া ছেলেটা, যে সাতসমুদ্রে দাপিয়ে বেড়ায়, সে নাকি ইহলোকে আর নেই। এও বিশ্বাস করতে হবে জারিনাকে? বাচ্চার তখন মাত্র মাস ছয়েক, ডিপ্রেশন থেকে ডিপ ডিপ্রেশনে চলে গেল সে—ইতিমধ্যে হঠাৎ একটা ঘটনা তাকে চুলের মুঠি ধরে বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিল। মা দু’দিনের জ্বরে হঠাৎ মারা গেলেন জারিনার কোলে তার কচি মেয়েকে তুলে দিয়ে। ডিপ্রেশন বাপ বাপ বলে ছুটে পালাল। মায়ের মৃত্যু জারিনাকে শক্ত মাটিতে দাঁড়াতে বাধ্য করল। শিশুর দাবি অনেক। শোক—বিলাসের সুযোগ দেয় না সে। আস্তে আস্তে আবার কাজকর্ম শুরু করেছে জারিনা, উপার্জন করা দরকার। তার বান্ধবী সিলভিয়া এসেছে ফ্রান্স থেকে, চমৎকার একটা প্রজেক্ট নিয়ে—একবছরের প্রজেক্ট—দক্ষিণ ফ্রান্সে কাজ করতে যেতে হবে। জারিনার সাতকুলে কেউ নেই—বাচ্চাকে কার কাছে রেখে যাবে? তাই সে ব্যবস্থা করেছে বাচ্চাকে একটা ভালো অনাথ আশ্রমে রাখার—আশ্রমে মেয়েকে রেখে, ইউরোপ চলে যাবে সে। মাঝে মাঝে আসবে। যদি কখনো আবার সংসার পেতে বসতে পারে, তখন চাঁদকে নিয়ে যাবে নিজের কাছে। আপাতত চাঁদের দায়িত্ব গ্রহণের মতো পরিস্থিতি নয় তার জীবনের। কিন্তু হঠাৎ মনে হয়েছে ওর, শুভম খুব রামধন মিত্তির লেনের যৌথ পরিবারের গল্প করত, বড়মা সকলের মা, দাদুভাই সকলের গার্জেন—জারিনার মনে হল, চাঁদকে অনাথ শিশু বলে ঘোষণা করার আগে একবার সূর্যের বাড়িতে খোঁজ নিলে কেমন হয়? যদি তাঁরা ওকে ঠাঁই দেন, আদর করে বুকে তুলে নেন সূর্যের সন্তান বলে? জারিনা যে বাংলাদেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে, সেটা জন্মের মতোই। বাংলাদেশে ওর কোনো শিকড় নেই, যার টানে ফিরতে পারে আবার। ওর টান থাকবে সেখানেই, যেখানে চাঁদ বড় হবে। কলকাতা শহরেই চাঁদকে রাখতে এসেছে জারিনা। সূয্যির শহরে। মা চলে যাবার পরে, ওর পিছুটান একমাত্র চাঁদ। চাঁদই ওর অতীত, চাঁদই ভবিষ্যৎ। কিন্তু চাঁদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হলে ওকে নিজের বর্তমানটাকে গড়বার দিকে নজর দিতে হবে।

”আমার চাল নাই, চুলা নাই, চিরকালের বোহেমিয়ান স্বভাব!”—জারিনার মায়েরও ঠিকঠাক সংসারজীবন ছিল না। বাচ্চা মানুষ করার জন্য আইডিয়াল পরিমণ্ডল কোনও আর্টিস্টের স্টুডিওতেই থাকে না। আর্টের ডিসিপ্লিন এক জাতের, আর শিশুপালনের ডিসিপ্লিন একেবারে অন্যজাতের—দুটোকে মেলানোর মতো প্রতিভা জারিনা নিজের মধ্যে আছে বলে মনে করে না।

”শিশুর প্রতিও টুয়েন্টিফোর আওয়ার্স ডেডিকেট করা লাগে, আর্টের প্রতিও টুয়েন্টিফোর আওয়ার্স উৎসর্গ করা প্রয়োজন—দুইটার প্রতি সুবিচার করা সম্ভব না।” তাই সে ভেবেছে সূর্যকে যাঁরা অত স্নেহ করেছেন, অত ভালোবেসেছেন, তার সন্তানকেও তাঁরা হয়তো ভালোবেসে কোলে তুলে নেবেন। সে বাড়িতে অনেক মানুষ, চাঁদের তাঁরা আপনজন, চাঁদ তো জারিনার মতো নিঃসহায় নয়। জারিনার বাপের বাড়ি বলে কিছু ছিল না। কিন্তু এখানে দেবশংকর দত্ত এখনও আছেন—চাঁদের সুরক্ষা, তার নিরাপত্তা অসম্ভব নয় সেই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানেই সে এসেছে।

দীপশংকর ইতিমধ্যে ঘরে ঢুকে এককোণে বসে পড়ছিলেন। বিনি গিয়ে তাঁকে ডেকে এনেছে। এবার দীপশংকর বলে উঠলেন, —”আমি দীপশংকর। সূর্যের মামা। আমরা কেমন করে জানবো আপনি যে শিশুটিকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চান সেটি সত্যিই সূর্যের সন্তান কিনা? নিজেই তো বলছেন বিয়ে হয়নি। ও—বাচ্চার দায়িত্ব আমরা নেবো কেন? ঐ সময়ে আপনার অন্য কোনও পার্টনার ছিল কিনা, তাই বা জানবো কেমন করে? বাচ্চার ভার নিলেই হল? আজকাল Parenthood prove করা কোনও সমস্যা নয়, DNA test করাতে হয়! But it is very expensive–’’

”কত expensive?” মেয়েটা ফোঁস করে ওঠে, ‘‘DNA test-এর expenses আমিই দিমু নে। আপনারা arrangements কইরা দেন—চান্দেরে লইয়া আসুম। আর অন্য partner আছিল কিনা তাইতে আপনের কাম নাই। আমার বাচ্চাটা সূর্যের বাচ্চা নাকি হেইটুকই দ্যাখেন।”

দেবশংকর মৃদু ধমকে ওঠেন—”দীপু, কী বলতে কী যে বলিস তার ঠিক নেই। এ কি তোর আমেরিকা?”

দীপশংকর দমলেন না। ”ধরুন যদি সূর্যের মেয়েই হয়। অত কথায় কাজ কী? কত টাকায় রফা করতে চান সেটা বলুন। চাইলড সাপোর্টের জন্য কত টাকা চান, আপনি? হাউ মাচ?”

”টাকা? কী হইব টাকা দিয়া? আমিও তো দিমুনে আমার চাইলড সাপোর্ট—আপনারা বাচ্চারে যত্ন—আদর করবেন। আমি বাইরে থিক্যা টাকা পাঠাইমু। তবে রেগুলারলি পারুম না—মাঝেমধ্যে থোক টাকা দিমু—যখন যেমন পারুম”—মেয়েটার চোখেমুখে তীব্র ব্যাকুল আন্তরিকতা। ঘরে ছুঁচ পড়লে শোনা যাবে।

।। জারিনা-৪ ।।

বিনি ইতিমধ্যে গিয়ে পদ্মাবতীকে ধরেছে—”অ পদ্মদিদি, তুমি এখানে বসে আচো? উদিকে বৈঠকখানা ঘরে যে ধুন্দুমার বেধে গেচে—একটা মেয়ে এসে বলচে সে সূয্যির বউ হয়—আবার বলচে ওদের একটা মেয়েও হয়েচে—কিন্তু সঙ্গে মেয়েটাকে আনেনি— সেজদাদাবাবু ওকে তাইড়ে দিচ্চে—বলচে, টাকা চাও তো দিচ্ছি, কিন্তু তুমি তোমার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে চলে যাও—এখেনে তুমি বসে বসে চিঠির পুঁটুলি ঘাঁটো গে, উদিগে সূয্যির বউটাকে ওরা বুঝি ভাগিয়ে দিলে গা—”

বলতে—না—বলতে চিঠির বাণ্ডিল ফেলে রেখেই পদ্মা উন্মাদিনীর মতো বৈঠকখানা ঘরে উপস্থিত।

”কৈ? কৈ সূয্যির বউ? কোথায় সে?”

জারিনা এগিয়ে এসে নমস্কার করে।

”তোমার নাকি একপিঠ চুল, আর রাগ করলেই চোখ দুটো মা দুগগার মতন বড় বড় হয়ে যায়?”

জারিনা এত চাপের মধ্যেও হেসে ফ্যালে।

”এইসব আপনারে কইল কেডা?”

”আবার কে বলবে। সূয্যি লিখেচে তো তার চিঠিতে। চট্টগ্রাম থেকে। কৈ? দেখি, চুল দেখি?”

পদ্ম ব্যস্ত হয়ে তাকায়।

”লিখসিল? আমার কথা লিখসিল সে? কী লেখসে এট্টু কননা?” বলতে বলতেই একটানে ক্লিপটা খুলে নিল আর জলপ্রপাতের মতো পিঠ বেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল দীর্ঘ কালো কেশরাশি। সুব্রতা বলল—”আমার মা!”

তারপর—”মা, এই হল জারিনা।”

সুব্রতাকে থামিয়ে দিয়ে পদ্ম বলে—”জারিনা নয়। রিনা। ওর নাম রিনা। আমি জানি। ও তো চট্টগ্রামে সমুদ্রের তীরে ছবি আঁকে। তাই না?”

জারিনা দৌড়ে পদ্মার কাছে গিয়ে তার দুটি হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল—”পদ্মমা? আমিও আপনার চিনি তো। আমাগো পদ্মানদীর নামে নাম—শুভম ইয়ার্কি কইর‍্যা কইত, তুমি তো পদ্মানদীর মাইয়া। আমিও পদ্মানদীর সন্তান।”

”পদ্মমা বলে ডাকলি? তুইও আমার নাম জানিস?” পদ্মাবতী জারিনাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেন।

”আমার সূয্যির বৌ। আমার সূয্যির বউ এসেছে। ওরে শাঁখ বাজা, উলু দে—”পদ্মা অস্থির হয়ে পড়েন—”মামণি, দ্যাখো কে এসেছে—ছোটকা, দ্যাখো—চলো মা চলো তুমি আমার কাছেই থাকবে। ওরা তোমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছিল—”

জারিনাই ওঁকে শান্ত করতে চেষ্টা করে—”না, পদ্মমা, আমারে কেউ তাড়ায় নাই, আমি কাইল আসুম, চান্দেরে লইয়া। আমাগো ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশনের নোটিশের কপি লইয়া—সেজমামুরে প্রুফগুলি দেখাইতে লাগবো—কাইলই অ্যাইস্যা পড়ুম, পদ্মমা—আইজ যাই? বাচ্চাটা যে ঘরে আছে।”

পদ্মাবতীর দিকে এক অদ্ভুত মায়াভরা চোখে তাকিয়েছিলেন সরমা। এবার কথা বললেন—’হ্যাঁরে পদ্ম, ঠিকই বলেছিস। ওকে আমরা ধরেই রাখবো—আজ ছেড়ে দে। কাল বাচ্চাটাকে নিয়ে আসুক?”

”আমার সূয্যির বাচ্চা!” শিশুর মতো শোনায় পদ্মর গলা।

”তাই তো বলছে!” দীপশংকর বলেন। দেবশংকর দীপের দিকে তাকালেন। তারপর পদ্মার দিকে। দীপের চোখে অবিশ্বাস কুঁচকে আছে। পদ্মার দুই চোখ আনন্দে ভাসছে, পরিপূর্ণ আহ্লাদ—এমন খুশি পদ্মার চোখে শেষ কবে দেখেছেন স্মরণেই এল না দেবশংকরের। দেবশংকর মনস্থির করে ফেললেন।

”কাল আপনি আপনার মেয়েটিকে নিয়ে আসুন, জারিনা।”

”আমাকে আপনি কইর‍্যা কইবেন না তো দাদুভাই। প্রেগন্যান্ট ছিলাম তো, তাই চিটাংগাং—এর ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিস থিক্যা আমাগো নোটিসের সার্টিফায়েড কপি লইয়্যা আইসি। চান্দের বার্থ সাটিফিকেটেও ফাদার্স নেম দ্যাওয়া আসে। আমি কাইলই সব আনুম।”

দেবশংকর বাধা দেন—”অত প্রমাণপত্তর লাগবে না। পদ্মামাই তো তোমার প্রমাণ দাখিল করলেন। বাচ্চাটাকে তাড়াতাড়ি আনো দিকিনি, আমরা একটু তাকে কোলে নিয়ে আনন্দ করি?”

”একটু হেস্টি ডিসিশান হয়ে যাচ্ছে না, কাকু?” দীপশংকরের উদ্বেগে সরমা হাসলেন—”যা ঠিক হয়েছে, সেটাই ঠিক। সেটাতেই মঙ্গল হবে। দীপু, তুই ভয় পাসনি শুধু শুধু। একটা বাচ্চাই তো? এত বড় বাড়িতে!”

।। পার্টি-২ ।।

দিয়া মন দিয়ে টেবিলে ঝুঁকে সারি সারি পাত্রের ওপর কীসব খাবার সাজাচ্ছে। অভিষেক গিটার নিয়ে পিড়িং পিড়িং করে ওর পিছু পিছু ঘুরছে আর খুনসুটি করছে—দিয়া মাঝে মাঝে চেঁচাচ্ছে, কিল মারছে, ”জিয়া, দ্যাখ না, অভি ভীষণ ডিস্টার্ব করছে—একদম কাজ করতে দিচ্ছে না!”

জিয়ার ফুল সাজানো প্রায় হয়ে এসেছে, সে নকল ধমক দেয়—”অভি! বিহেভ ইওরসেলফ!’ উত্তরে অভিষেক গেয়ে ওঠে—’ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বঁধু ওইখানে থাকো”—আবার বেল বাজে।

এবারে অতিথি সুমন। হাতে হেলমেট ঝুলছে, কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ।

”এইটেই কি তোর নতুন নাকি রে? জেঠুর এনে দেওয়া? দ্যাখা, দ্যাখা।” হাতর কাজকর্ম ফেলে দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে জিয়া—দিয়া—”শো আস, শো আস।’

সুমন বলে, ”দাঁড়া, দাঁড়া, আরেঃ? বসতে দে?”

বুম্বা এসে অফার করে স্টুয়ার্ডের স্টাইলে নত হয়ে—”বিয়র? ভদকা? হুইস্কি? ইউ নেম ইট, আই হ্যাভ ইট, স্যার।”

”ও বাবা! অতয় কাজ নেই, হুইস্কিও? আমরা বরং একটা চিলড পেপসি দে।” সুমন হাসে।”

”পেপসি! মাই গড! এখানে দেখি সকলেই সফট পার্টি—অভিও বিয়র, কেবল আমি একাই হুইস্কি? দি ওনলি মেচিওর ড্রিংকার?”

দিয়া হৈ হৈ করে ওঠে—”আর আমরা? আমরা যে ভদকা দিয়ে লিমকা খাচ্ছি? এই যে, গেলাস?”

”দূর, ওতে আর ভদকা কোথায়, জাস্ট লিমকাই বলতে পারিস—”

”কুছ নহী তো থোড়া থোড়া! আমরা আসলে ওয়াইন খাই—আজ ওয়াইন আনা হয়নি। তাই চয়েস হয় ভদকা + লিমকা ‘বা অরেঞ্জ জুস। নইলে শ্যান্ডি মানে বিয়র + লিমকা! দিয়ার জবাব।

”বিয়রের গন্ধের চেয়ে আমার ভদকার গন্ধটা বেশি রিফাইনড লাগে।” জিয়া বলল।

বুম্বা মাথা নেড়ে সায় দিল—”বিয়র তো ওয়ার্কিং ক্লাসের ড্রিংক কিনা?”

দিয়া হেসে উঠল—”রাশিয়ায় যাও না। সেখানে ভদকাও ঠিক তাই, মশাই।”

”শ্রীময়ী দিদিরা আসেনি?” সুমন বিয়রে চুমুক দিয়ে বলে।

”আসবে। ওরা সিদ্ধার্থদার বাড়ি থেকে আসছে তো? সেই সলট লেক।”

”আর দিদি? দিদি তো কখন বেরিয়ে গেছে বাড়ি থেকে এখানে আসবে বলে। ওকে একটা ফোন করি।” সুমনের পকেট থেকে সেলফোন বেরোয়।

”দিদি? কি ব্যাপার তোদের? রাত কাবার করে আসবি? ও কে। ও কে—”

”কোথায় তারা?”

সুমন উত্তর দেয় না, হাসে।

বাইরে বেল বাজে। দিয়া নয়, এবারে খোল বুম্বা। ঘরে ঢোকে সুব্রতা—পদ্মাবতীর মুখের আদলে মুখটি মিষ্টি, লাবণ্যময়ী।

সুব্রতার পিছনে একটি মেয়ে ঢোকে—বছর উনিশ—কুড়ি হবে, শাড়ি পড়েছে একটা লম্বা বেণী। ঝলমলে হাসিমুখ। তার সঙ্গে একটি লম্বা ছেলে—ব্লু জিনস আর শাদা শার্ট, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা—একটু সলজ্জ হাসি তার মুখে। সুব্রতা ঘরে ঢুকে এসে দুজনকে সামনে টেনে এনে পরিচয় করিয়ে দেয়।

”সৌরভ, আমার ব্যাঙ্গালোরের বন্ধু। আর এ হল বুবলী, ওর বোন, ব্রেবোর্নে পড়ছে, ফাস্ট ইয়ার জিওগ্রাফি।”

”বুবলী নয়, সৌমিকী। দাদার ডাকনামে তো কেউ ডাকে না, বাবুসোনা বলে? আমি কেন বুবলী?” সবাই হেসে ওঠে। এই ছোটদের পাটিতে বুবলীই কনিষ্ঠতমা।

”বেশ বেশ আপনি বুবলী নন, আপনি সৌমিকী। তা ম্যাডাম সৌমিকী, আপনি কী খাবেন, হইস্কি, না রাম?”

বুবলীর চোখমুখে স্পষ্ট ভীতির ছায়া পড়ে। সে দাদার দিকে চোখ তুলে তাকায়। সৌরভ হেসে ফেলে।

”অত ভয় পাবার কিছু নেই। তুই কোলড ড্রিংক কী নিবি, বলে দে।”

”তোমাকে খ্যাপাচ্ছে বুম্বা। এসো, আগে তো বোসো—” জিয়া বুবলীর হাত ধরে এনে সোফায় বসিয়ে দেয়। সৌরভদের সঙ্গে একে একে পরিচয় হতে থাকে জিয়া, দিয়া বুম্বা, অভিষেকের। সুমনের সঙ্গেও এই প্রথম দর্শন—যদিও ফোনে পরিচয় হয়েছে। বুবলীকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে পার্টির প্রাণী নয়। খুব মিষ্টি, কচি মেয়েটা—প্রথমে সসঙ্কোচে থাকলেও জিয়া—দিয়া—সুমন—বুম্বা—অভিষেকের কল্যাণে সহজ হয়ে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই। গিটার হাতে অভিষেককে তার বেশ পছন্দ বলে মনে হচ্ছে। যদিও অভিষেকের আগ্রহ নেই সৌমিকী—বুবলীর প্রতি।

”মুন্নুদিদি, দেখবি আয়, কি দারুণ সব ‘কানাপে’ তৈরি করেছি, খেতে তো দারুণ হবেই, কিন্তু তার আগে, দেখতে অপরূপ। অ্যাই সুমনদাদা, আগে ক্যামেরা বের করো, এক্ষুনি ফটো তুলে রাখো আমাদের কানাপেগুলোর। একদম স্প্যানিশ স্টাইলে ‘তাপাস—বার’ বানিয়েছি বুঝেছো? কোথাও পাবে না। দারুণ একটা রেসিপিবুক এনে দিয়েছে আমাদের দিদা, জুডি পাঠিয়েছে টেকসাস থেকে।”

 ”গ্রেট! সুমন চটপট ছবি তুলে নে দিকি? তারপর লেট আস ট্রাই দেম!” সুব্রতা হৈ হৈ করে ওঠে।

সৌরভের হাতে কাগজে মোড়া একটা বোতল ছিল। এতক্ষণ পরে সেটা এগিয়ে দেবার কথা মনে পড়ল তার। জিয়ার হাতেই দিল সৌরভ। সঙ্গে সঙ্গেই খুলে ফেলল দিয়া। খুলেই চেঁচাল, ”গুড! সুলারেড! জাস্ট দ্য ওয়াইন ফর আস। জিয়া—টেক দ্য গ্লাসেস আউট!”

 সুমন টেবিলে সুসজ্জিত কানাপেগুলোর ছবি তুলছে, জিয়া দীর্ঘ ডাঁটাওলা, ঠিক মৃণালের ওপর পদ্মের কলির মতো, ক্রিস্ট্যালের ওয়াইন গ্লাসে রেড ওয়াইন ঢালতে শুরু করে—গুনে গুনে—

”সুব্রতা, জিয়া, দিয়া—বুবলী অরেঞ্জ জুস খাবে—”

 ডোরবেল বাজল।

”শ্রীদিদি!” চেঁচাল দিয়া! দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে সুমন। হুইলচেয়ার ঠেলে ঘরে ঢুকল সিদ্ধার্থ। চেয়ারে বসে হাসছে শ্রীময়ী। শ্রীময়ীর পরনে কালো ট্রাউজার্স আর প্রিন্টেড নীল—শাদা শার্ট। ঝাঁকড়া চুলে মুখখানি ঘেরা। হাতে একগোছা হলুদ গোলাপ। সিদ্ধার্থর নুন—গোলমরিচ রঙা একমাথা চুল চোখের ওপর ঝামরে পড়ছে—সোনালি চশমায়, গোঁফ—দাড়িতে, একটু বিদেশি ছাপ। পরনে সবুজ পাঞ্জাবি, শাদা পাজামা, মুখে প্রসন্নতা।

।। পার্টি-৩ ।।

মুহূর্তের মধ্যে জমে ওঠে আড্ডা। বুম্বা, অভিষেক, সৌরভ, বুবলী, সিদ্ধার্থ—এরাই নতুন, এ পরিবারে বহিরাগত—বাকিরা তো ভাইবোন। একসঙ্গেই বেড়ে উঠেছে শ্রীময়ী, সুমন, সুব্রতা, জিয়া, দিয়া। সামনের উইক—এনডে রামধন মিত্তির লেনের বাড়িতে যে গেট টুগেদারটা হবে দাদুভাইয়ের আশি বছরের বার্থডে সেলিব্রেট করতে, তার ফাইন্যাল প্লানিংও এখানে হচ্ছে। অভিষেক তার ব্যান্ড নিয়ে আসবে। দু’খানা গান বেঁধেছে, ”দাদুভাইয়ের আশি বছর”, আর ”তিন নম্বর রামধন মিত্তির লেন”—এটাই হচ্ছে এবারের স্পেশ্যাল সারপ্রাইজ গিফট নাতি—নাতনিদের তরফ থেকে। তাছাড়া সুমন, একটা ডকুমেন্টারি ফিচার ছবি তৈরি করছে, রামধন মিত্তির লেনের বাড়িটাকে নিয়ে, তার বাসিন্দাদের নিয়ে—সেটা শেষ হতে দেরি আছে। এ বাড়ি ভাঙা ও নতুন বাড়ি তৈরি হবার পরে সেই ডকুমেন্টারি কমপ্লিটেড হবে। কিন্তু তিনটে পার্টে বানাচ্ছে ছবিটা ও। প্রথম পার্টটা শুরু হয়েছে কেয়াতলার বাড়িতে রবিদের বিবাহজয়ন্তী উৎসবের ফ্যামিলি রি—ইউনিয়ানে—সেখানে আছে দেবী ও নীলের সঙ্গে এই পরিবারের প্রথম পরিচয়—তাদেরও প্রথম পদক্ষেপ কলকাতা শহরে। সেই ফিল্মে ধরা আছে সিদ্ধার্থরও প্রথম সশরীরে আবির্ভাব, শ্রীময়ীর জীবনে। তার আগে ওদের কেবল ই—মেলে, আর টেলিফোনেই চেনা ছিল। সেই ফিল্ম তোলা হয়েছিল এই কেয়াতলার বাড়িতেই—তারপর সুমন ফিরে গেছে রামধন মিত্তির লেনের উঠোনে, দালানে, ছাদে, ঠাকুরঘরে—দাদুভাইয়ের এস্রাজ, বড়মার নিরিমিষ হেঁশেল, পদ্মমার বসে বসে চিঠির বাক্সো ঘাঁটা, সোমশংকরের গান গাওয়া, কবিতা আওড়ানো, বরুণার অফিস থেকে ফিরে আমিষ হেঁশেলে রান্না করা—কিছুই বাদ নেই। বাদ নেই আমেরিকা ফেরত উত্তেজিত প্রভাবতীর গল্পগাছা এবং দীপশংকরের মনিটারিংও। আজ সুমন আবার ক্যামেরা খুলেছে—টেবিলে জিয়ার ফুল সাজানো, দিয়ার স্ন্যাকস সাজানো, সৌরভের সুলারেড—এর উদ্বোধন—শ্রীময়ী—সিদ্ধার্থর স—গোলাপ আবির্ভাব—সবই ধরে রাখছে। আগামী উৎসব সন্ধ্যায় এগুলো সবই দেখানো হবে বড় স্ক্রিনে। এর পরে যে নাচাগানা হবে, তাও। সেবারের উৎসবে, দেবশংকরের এস্রাজের সঙ্গে তবলা সঙ্গত, সোমশংকরের কবিতা আবৃত্তি, শ্রীময়ীর গান, সমস্তই ধরে রেখেছে সুমনের ভিডিও ক্যামেরা। রামধন মিত্তির লেনের বাড়ির উঠোন, বৈঠকখানা, দরদালান, সবই ভারী চমৎকারভাবে তোলা হয়েছে—এখন তো বাড়ি ভাঙবে। তাই সুমন প্রতিটি ঘর, প্রতিটি দোর—জানলা, কড়ি—বরগা আসবাবপত্তর ছবিতে তুলে রাখতে বদ্ধপরিকর। প্রবল একটা অনুভূতি শুরু হয়েছে ছোটদের মনে, যা হারিয়ে যাচ্ছে তা আর কোনোদিনই ফিরবে না—সাতপুরুষের ভিটে বলে কথা—না হয় সাত নয়। পাঁচপুরুষ তো বটে?

।। পার্টি-৪ ।।

শ্রীময়ীকে আলাদা দেখে সুব্রতা বলল—”একটু বারান্দায় আসবি? কথা আছে—”

”ভালো ছেলে, বিয়ে করে ফেল!” শ্রীময়ী চোখ টিপে হাসল।

”আঃ। সৌরভের কথা বলছি না। বিয়ে হয়তো আমরা করবো—তুই একটু কথা বলে দেখিস? সিদ্ধার্থদার সঙ্গে তো ভালোই জমেছে দেখলাম। কিন্তু এখন তোকে অন্য কথা বলছি—একটু চল না, খুব জরুরি—”

শ্রীময়ীর হুইলচেয়ার ঠেলে সুব্রতা বারান্দায় নিয়ে যায়। নিজে বেতের চেয়ার নিয়ে বসে।

”আজকে একটা মিস্টিরিয়াস মেয়ে এসেছিল। বাংলাদেশী।”

শ্রীময়ীর ভুরু কুঁচকে যায়। —”কে সে?”

”বলছি, বলছি। একটা মেয়ে ক’দিন ধরেই দাদুভাইয়ের খোঁজ করছিল। আজ এসেছিল—এসে যা বললো, তা শুনলে—!”

”কী বললো? তাড়াতাড়ি বল!” শ্রীময়ীর কণ্ঠে অধৈর্য।

”বললো সে নাকি দাদার গার্লফ্রেন্ড ছিল!”

শ্রীময়ী বিস্মিত। —”গার্লফ্রেন্ড?”

”ইয়েস, অ্যান্ড মোর! ফিঁয়াসে।”

”এক সেকেন্ড! বাংলাদেশী মেয়েটা কি পেন্টার? মুসলমান মেয়ে?”

”তুই কী করে জানলি?” সুব্রতার চোখ বিস্ময়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে।

”ঠিক বলছি কি না বল?” শ্রীময়ী মৃদু মৃদু হাসছে।

”হ্যাঁ, ঠিক তাই—নাম বলল জারিনা।”

”সূর্যদা আমাকে ই—মেলে লিখেছিল মেয়েটার কথা। দে ওয়্যার ইন লাভ। হি ওয়ন্টেড টু ম্যারি হার।”

”সত্যি? রিয়্যালি? মেয়েটাও তাই বললো, কিন্তু সেজমামা কিছুতেই বিশ্বাস করছিল না ওর কথা—বলছিল ঠকাতে এসেছে। আসলে ওদের একটা বাচ্চা হয়েছে, বলছে তো তাই।”

”বাচ্চা হয়েছে? কেন ও কি কিছু ক্লেইম করছে?”

”একেবারেই না।”

”তবে? মুসলমান মেয়ে বলে সূর্যদার একটু অস্বস্তি ছিল, তাই—হি ওয়জ প্ল্যানিং টু কাম ব্যাক। মেজমাকেই যা ভয় পাচ্ছিল। সেই শেষ। তারপর আর কথা হয়নি। এখন মেয়েটা কী বলছে?”

”আমার তো ওকে জেনুইন বলেই মনে হল—। আর দাদা তোকে যখন বলেইছিল— ও সঙ্গে করে চিটাগাংয়ের ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অফিসের নোটিসও এনেছিল। দাদা মারা যাবার দু’মাস আগের ডেটের নোটিস! ওদের বিয়েটা হয়নি, কিন্তু ও প্রেগন্যান্ট ছিল তখনই।”

”এখন কী চাইছে? বাচ্চার ভরণ—পোষণ?”

”না না। কিছুই চাইছে না। বরং বাচ্চাটাকেই আমাদের দিতে চায়। ওর ভরণপোষণের জন্য খরচও দিতে চায়।”

”স্ট্রেঞ্জ! না রে?”

”খুবই। কিন্তু সব থেকে স্ট্রেঞ্জ কি জানিস—মাও ওকে তক্ষুনি আইডেনটিফাই করতে পেরেছে—বলছে সেই বাক্সের চিঠিগুলোতেও নাকি দাদা ওর কথা লিখেছে মাকে—ঈশ! মা দৌড়ে এসে ওকে নিয়ে কি কাণ্ডই না আরম্ভ করে দিল। চিন্তা করতে পারবি না। ওর নাম—ধাম সবই দেখি মা জানে। আর সে—ও আমাদের ফুল ফ্যামিলি হিস্ট্রি জানে—আমাকে মুন্নু বলে ডাকল। বড়মাকে বড়মা, দাদুভাইকে দাদুভাই। দেখেই চিনতে পারল ওদের। পদ্মমাকে পদ্মমা ডাকল। বললে বিশ্বাস করবি না আলমারির মধ্যে রুপোর ফিলিগ্রি করা সোফাসেটটার খবরও জানে এই মেয়ে!”

”সূর্যদার কতোটা অ্যাটাচমেন্ট ছিল ভাব বাড়ির সঙ্গে—আর সেই ছেলে…।” শ্রীময়ীর গলা ধরে আসে।

দুজনেই নিঃশব্দ কিছুক্ষণ।

সুব্রতাই নীরবতা ভাঙে—”বাচ্চাটার বার্থ সার্টিফিকেট এনেছিল। ফাদার্স নেমের জায়গায় দাদার নাম দিয়েছে DNA টেস্টও করাতে চায় সেজোমামার জন্যে।”

”দাদুভাইয়ের কী রি—অ্যাকশন?”

”দাদুভাই, বড়মা দুজনেই বললেন, বাচ্চাটাকে নিয়ে আসতে বাড়িতে।”

”সে কোথায়?”

”কলকাতাতেই, একটা হোটেলে উঠেছে ওরা, জারিনার এক বিদেশি আর্টিস্ট বান্ধবী এসেছে, তার কাছেই রেখে এসেছিল।”

”কতো বড়ো হয়েছে সে?”

”বছর দেড়েক হয়েছে। জারিনার মার কাছেই ছিল, তিনি হঠাৎ মারা গেছেন। ও একটা প্রজেক্ট নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। তাই এসেছে বাচ্চাটাকে নিয়ে, যদি আমরা রাখি। আমাদের প্রেশারাইজ করছে না। জাস্ট চেকিং আমরা ওকে রাখতে চাইব কিনা। এ বাড়ির বাচ্চা তো? তাই।”

”নাম কী?”

”সূর্যের সন্তান, তাই চাঁদ। দাদাই নাকি বলেছিল। আমরা না নিলে ওকে একটা ভালো অরফ্যানেজে রেখে আসবে। তাদের সঙ্গেও কথা বলেছে বলছিল—”

”ঈশ, অনাথ আশ্রমে যাবে কেন? আমরা সবাই বাড়িসুদ্ধু থাকতে? আফটার অল সূর্যদার মেয়ে!”

”সত্যি রে! আমি তো প্রায় মনস্থির করেই ফেলেছি, ওকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে যাবো মার সঙ্গে—একটা আয়া রেখে দেবো।”

”তুই কিন্তু আটকে পড়বি একদম—পদ্মমার তো ভালোই হবে—কিন্তু তোর অস্ট্রেলিয়া?”

”ও একটু বড় হলে ভাববো, এখন না।”

শ্রীময়ী হেসে ফেলে।

”তুই তো অনেকদূর ভেবে নিয়েছিস রে—সৌরভের সঙ্গে কথা বলেছিস?”

”বলিনি, বলবো। ও মনে হয় না আপত্তি করবে।”

”আর ইউ শিওর?”

”ও এমনিই ঠিক করে রেখেছে আমরা নাকি চারটে বাচ্চা অ্যাডপ্ট করবো দুটো মেয়ে, দুটো ছেলে—দাদার মেয়েকে দিয়েই নয় শুরু করবো।”

দুজনেই হেসে ওঠে।

”ওরা জানে? সুমন?”

”আজকের ঘটনা জানে না—সুমন তো ছিল না বাড়িতে। সেদিনের কথা জানে। আসবে, জানতো।”

”তাহলে চল, সবাইকে বলে দিই, এত বড় খবর—সূয্যিদাদার একটা মেয়ে আছে, একটা বৌও আছে— গ্রেট নিউজ! দাদুভাইয়ের আশিবছরে দারুণ গিফট এনেছে তো রে মেয়েটা?”

”হ্যাঁ, একটা নতুন জেনারেশন, অ্যান্ড সূয্যিদাদার জ্যান্ত স্যুভিনির!”

”বাচ্চাটা কবে আসবে।”

”কালকেই আসতে বলেছি আমরা। নো ওয়ান ক্যান বেয়ার টু ওয়েইট এনি লংগার।”

”চল ভেতরে যাই—খবরটা বলবি চল,—ওদের সকলকে—”

।। পার্টি-৫ ।।

শ্রীময়ী সিদ্ধার্থকে নিয়ে বারান্দায় বসে থাকে। ভিতরে যায় না। সামনে বিবেকানন্দ পার্কের আলো—আঁধারি মাঠ।

শ্রীময়ী সিদ্ধার্থকে সূর্যের কথা বলে। জারিনার কথা। বাচ্চা কোথায় থাকবে, কার হেপাজতে, সে কথা। জারিনা মেনটেনান্স চায় না, সেই কথাও। ঘর চায় কেবল, নিরাপদ কোল চায় একটা তার শিশুর জন্যে।

একসময়ে শ্রীময়ী বলেই ফ্যালে—”আচ্ছা আমরাই নিয়ে যেতে পারি না ওকে? আমার তো বাচ্চা হবে না কোনোদিনই! সূয্যিদাদার মেয়েকে আমিই তো বড় করতে পারি বস্টনে। মা ওকে দেখবেন এখন, আমি যদি বা নাও পারি এখনই, পরে তো পারবো? পারবো না?”

সিদ্ধার্থর একটু ভাবনা হল কি? চুপ করে রইল সে। চুপ করে শ্রীমতীর হাতে হাত বুলোতে থাকে সিদ্ধার্থ।

”আমিই অবশ্য তোমার ওপরে বোঝা। বাচ্চা আনলে সে আরো একটা বোঝা হবে তোমার। আমার কিন্তু রোজগার করা শুরু হয়ে গেছে—দেখো, আমি ঠিক বাচ্চার ভরণপোষণটা রোজগার করতে পারবো—আর আমারটা তো তুমিই দেবে—জন্মের ভাত—কাপড়—”

সিদ্ধার্থ এবারে শ্রীময়ীকে বুকে জড়িয়ে ধরে। এমনধারা ছেলেমানুষি শ্রীময়ীর দেখেনি ও। শ্রী গম্ভীর মেয়ে। মেচিওর। সিরিয়াস। এমন আদুরেপনা, আহ্লাদেপনা তার স্বভাবে নেই। এত ইচ্ছে ছিল তার মা হতে? এতদিন তো প্রকাশ করেনি?

কিন্তু ব্যাপারটা কি বাস্তবসম্মত হবে? বস্টনে গিয়ে যেখানে সাহায্যকারিণীর অভাব—শ্রীময়ীর নিজেরই। মায়ের সাহায্য লাগে—সেখানে ছোটোবাচ্চা মানুষ করার দায়িত্ব নেওয়া… সিদ্ধার্থ ভাবতে থাকে। শ্রীময়ীর অবশ্য প্রচণ্ড মনের জোর। সেই হুইল—চেয়ারে বসে বসেই সমস্ত ঘরের কাজ করে। রান্নাবান্না করে, ওয়াশিং মেশিনে কাপড় কাচে, ডিশ—ওয়াশারে বাসন মাজে। এখন তো ওয়াকার ঠেলে ঠেলে এঘর—ওঘর হাঁটে। কলেজেও যাচ্ছে এই সেমিস্টার থেকে। হুইলচেয়ারে এই বিল্ডিং থেকে ওই বিল্ডিং অনায়াসে একা একাই ঘোরে। যমুনা অবশ্য থাকেন সঙ্গে সঙ্গে। বাচ্চার দেখাশুনোটা কিন্তু একেবারে অন্য ব্যাপার। আরেকটু বড় বাচ্চা হলেও কথা ছিল। দেড় বছরের অবোধ শিশু তো দৌড়োদৌড়ি করবে, টলে পড়ে যাবে, আগুনে হাত দেবে—পঙ্গু মা তো ওকে সামলাতে পারবে না। তাছাড়া, পদ্মাবতী? সিদ্ধার্থ বলে—”একটু ভেবে দেখতে দাও, শ্রী। ওর ঠাকুমার কথাটাও ভাবো। সূর্যের সন্তানটিকে কি তিনি ছাড়তে চাইবেন? এতদিন পরে এভাবে কুড়িয়ে পাওয়া ধন? তুমি তো বললে উনি নাকি তার মাকেও ছাড়তে চাইছেন না। ওই শিশুটি ওঁকে হয়তো নতুন জীবন এনে দেবে—a new lease on life—উনি তো বিতৃষ্ণ হয়ে গিয়েছিলেন বর্তমানের প্রতি, শুধু অতীত নিয়ে বেঁচেছিলেন—এবারে হয়তো ভবিষ্যতের দিকেও হাত বাড়াবেন, এই শিশুকে আশ্রয় করে—ওকে কি সাত—সমুদ্রের পারে সরিয়ে নেওয়া উচিত হবে আমাদের?”

এবারে অনেকক্ষণ ধরে শ্রীময়ী চুপ করে থাকে। তারপর বলে—”তোমাকে যত দেখি তত আশ্চর্য হই, জানো, সিদ্ধার্থ? এই কথাগুলো তো ভাববার কথা ছিল আমারই—কিন্তু হঠাৎ কেমন যেন লটারি পাওয়ার মতো প্রবল একটা লোভে পড়ে ভুলে গিয়েছিলুম—তুমি মনে করিয়ে দিলে। পদ্মমার প্রতি প্রচণ্ড অবিচার করা হত ওকে ছিনিয়ে নিলে। ঈশ, ভাবলুম কেমন করে ওকথা?”

”দেখা যাক না,” সিদ্ধার্থ ওকে আদর করে বলে—”আমরা অন্য একটা বাচ্চা বরং অ্যাডপ্ট করবো আরেকটু বড়ো দেখে, বছর তিন—চারের? পৃথিবীতে বে—ঘর শিশু অগুনতি—এমন বাচ্চা আনবো আমরা, যাকে স্কুলে দেওয়া যাবে। তোমার মার পক্ষে দেখাশুনো করাও সহজ হবে। ও.কে.! আমরা এবারেই উঠে পড়ে খোঁজখবর নিতে শুরু করি, নেক্সট টাইম এলে, আমাদের যাতে একটা বড়সড়, শান্তশিষ্ট বাচ্চা হয়। অ্যাপ্লাই করতে হয় শুনেছি অনাথ আশ্রমে নিজেদের সব বর্ণনা সমেত। বিদেশ থেকেও নিতে পারে, ওখানেও বহু অনাথ শিশু আছে।”

”না না, বাঙালি বাচ্চা চাই—কলকাতার বাচ্চাই নেবো আমরা। নইলে আমার তাকে নিজের বাচ্চা বলে মনেই হবে না—অত উদার কি হতে পারবো? চীনে—জাপানি, আফ্রিকান, কি সাহেব—মেম বাচ্চাদের নিজের ছানা বলে ভাবা সোজা? গ্লোবালাইজেশনের ঐ পর‍্যায়ে আমি পৌঁছুইনি এখনও গো—আমার মা—মামি—মামাদেরও তো তাকে নাতনি বলে মনে হওয়া চাই? কিংবা তোমার বাবা—মায়ের?”

”নাতনিই? নাতি হলে চলবে না? এখানেও ফেমিনিজম?”

”দূর—যতো বাজে বকে! চলো, ভিতরে যাই!”

সিদ্ধার্থকে ছোট্ট করে একটা ঠেলা দেয় শ্রীময়ী—উত্তরে খুব আদর করে শ্রীময়ীর মাথায় একটি চুমু খেয়ে, সিদ্ধার্থ হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নেয় ঘরের দরজার দিকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *