।। সরমা ।।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি বুঝি একটা অন্ধকার কুয়ো—কত মানুষের কত কথা, কত দুঃখু, কত যন্তন্না, কত লজ্জা যে আমার ভেতরে তারা ঢেলেছে, আমি সব শুনে, হজম করে বসে আছি। ঠিক ‘হজম করে’ বলব না, রাধামাধবের পায়ে ঢেলে দিয়ে বসে আছি। আমার কি শক্তি আছে এত বিষ ধারণ করি? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমারও কি কোনও কথা ছিল না? কোনও যন্তন্নার কথা? বলা হল না, এমন কোনও কথা? আমারও অবিশ্যি একটা ঠাঁই আছে—যেখানে কিছু খুলে বলতে হয় না। দেখলেই বুঝে নেয় ঠাকুরপো, আমার কিছু হয়েছে। রাধামাধবকেই শুধু বলি আমার মনের কথা। তার কাছে তো আমার লুকোনোর কিছুই নেই? আর ঠাকুরপোর কাছে তো লুকোনোর উপায় নেই, আমার বুকের খবরটা যে ঠিকই টের পেয়ে যায়।
এতদিনের সঙ্গী আমরা তিনজন, তবুও মেজোকে আমি বুঝে উঠতে পারি না অনেক সময়েই। ও যে কী কারণে কোনটা করছে, সে কি ও নিজেই জানে? দোষ দোব কাকে? ছেলেমানুষ মেয়ে বউ হয়ে একসঙ্গেই এ বাড়িতে এসেছিলুম আমরা দুজনে—দু’রকম লিপি লিখেছিলেন বিধাতাপুরুষ আমাদের দুজনের কপালে—শ্বশুরমশাই যে কী নজরেই দেখলেন মেজোকে, ওর জীবনটাই তছনছ হয়ে গেল। কতটুকুনি মেয়ে ছিল ও তখন? মেজোবাবুর কি উচিত ছিল না ওকে রক্ষা করা? আমার তো মনে হয় সেই থেকেই ওর মাথাটা বিগড়েছে। এই যে ওর পদ্মকে হিংসে করা, যমুনাকে রং নিয়ে খোঁটা দেওয়া,—এ সব কি স্বাভাবিক মায়ের ধর্ম? পদ্ম আর তুষারকে চোখের সামনে দেখা সহ্যই করতে পারতো না মেজো—ওদের স্বামী—স্ত্রীর মধ্যের ভালোবাসাটা চাঁদের আলোর মতন ছড়িয়ে পড়তো যে! আর যমুনা তো তার মায়েরই ছায়া। অমন সুন্দরী, অত সুশ্রী মেয়ে—কেবল রংটিই চাপা—মেজো তাকে সর্বক্ষণ দাঁতে কুটতো। কেলেকিষ্টি, পোড়ো হাঁড়ি, কেলটি, কত কি কুচ্ছিত নামে ডাকতো। —”যমুনার নামের সঙ্গে তো ওর মিষ্টি শ্যামলা রংটিই মানানসই—যমুনাও তো আমাদের কাজলরঙা নদী”—এটি বলেছিল বলে ঠাকুরপোর ওপরে কী রাগ মেজোর! যাকগে, আর আমি বৃথা এসব নিয়ে ভাবতে চাই না। সামলাতে পারিনি তো কিছুই। সুয্যিকেও আগলে রাখতে পারিনি আমি, তুষারকেও না। কেন? কেন পারলুম না? রাধামাধবের এই নির্মম লীলাটা আমার মাথায় ঢোকেনি। কর্মফল? কার কৃতকর্মের ফল? পদ্মের? সূয্যির? তুষারের? সুব্রতার? আমার? ছোটবাবুর? না মেজোর? ‘কর্মফল’ কথাটা বলতে যত সহজ, বুঝতে তত সহজ নয়। অনেকগুলো মানুষকে জড়িয়ে তো এক একজন মানুষের জীবন গড়ে ওঠে। সংসারে আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের একটা বাঁধন আছে। একটার পর একটা বাঁধন ছিন্ন হয়ে যায় যখন এমন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। —মুন্নুদিদি তো ছেলেমানুষ মেয়ে, তারই কাঁধে মানসিকভাবে অসুস্থ মায়ের পূর্ণ বোঝা পড়েছে—দাদার মৃত্যু, বাবার অপমৃত্যু—সেসবও তো বোঝা হয়েই রয়ে গেছে তার মধ্যে। হে রাধামাধব, এতকাল তো এত ভালোবাসলুম, এতপ্রাণঢালা সেবা করলুম, তুমি পদ্মটাকে এত যাতনা কেন দিচ্ছো? কী দোষ করেছিল মেয়েটা তোমার পায়ে, ঠাকুর? জ্ঞান পর্যন্ত কেড়ে নিচ্ছো? যখন থেমে মুন্নু বম্বে গিয়ে সূয্যির আপিস থেকে ওরা পাওনা টাকাকড়ি জিনিসপত্তর বুঝে নিয়ে এসেছে, তখন থেকেই পদ্ম কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। দিনভর খাটের ওপরে চুপচাপ বসে আছে, সামনে সূয্যির লেখা চিঠির বাক্সোটা—একটা চিঠিও ডাকে দেয়নি সূয্যি—এতগুলো বছর ধরে রোজই তার মাকে একটা করে চিঠি লিখেছে, রোজনামচার মতো করে। সেই চিঠিগুলো পড়তে পড়তে এক্কেবারে চুপ করে গেছে পদ্ম। মুখ খুলছে না—কোনো কথাই বলছে না কারুর সঙ্গে। খেতে ডাকলে এসে খাচ্ছে—নাইতে পাঠালে নেয়ে আসছে। অশান্তি করছে না, কোনো কান্নাকাটিও করছে না। ও জানে সূয্যি আর নেই। তবু কাঁদেনি। মাঝে মাঝে ভুল বকছে—ওর কথা বলা মানেই ভুল বকা। আর মেজো? মেজো যেই শুনলে সূয্যি কাজ করছিল জাহাজে, দীপুর কাছে গিয়ে দেখা করেছিল, অমনি মেজো ধরেই নিল দীপুর কাছে নিশ্চয় সূয্যি টাকা ধার করেছে। আর চেঁচাতে শুরু করে দিল। পদ্ম বেচারি আর কত সহ্য করবে? অবিশ্যি ঠাকুর ওকে একটা রক্ষে করেছেন। সূয্যির চিঠির বাক্সোটা পেয়ে অবধি পদ্ম আর কথা কয় না। কিছু কানেও শোনে বলে মনে হয় না। ও একদম নিজের ভিতরে ডুব দিয়েছে। নিজের মধ্যেই বাস করছে। জানি না এটা ভালো না মন্দ।
কিন্তু আমাদের তো কান আছে! মেজোর বাক্যবাণ আমার সহ্য হচ্ছে না। ঠাকুরপো ওকে বারণ করেছেন, ধমকও দিয়েছেন বারকয়েক—চোর না শোনে ধর্মের কাহিনী। তুষারের নামে মন্দ কথা বলাটা অবিশ্যি বন্ধ হয়েছে গতবারেই, যখন রবির বাড়িতে গিয়েছিলুম। তুষারের শেষ চিঠিটার কথা পদ্ম সেদিন বলে ফেলেছিল। যেখানে তুষার পদ্মকে লিখেছিল শাশুড়ির বাক্যবাণের অপমান আর সহ্য করতে পারছে না সে, এই পুরুষ—জন্ম আর বৃথা তার মনে হচ্ছে, তাই রেললাইনে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে—পদ্ম যেন তাকে মাপ করে দেয়। কিন্তু ঐ চিঠিটা থাকলে ইনসিওরেন্সের পাওনা টাকা দিত না। পুলিশ মেজোর নামে কেসও ঠুকে দিত। আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেবার কেস। ভেবেচিন্তে চিঠিটা ছোটবাবু তাই পুড়িয়ে ফেলেছিল—আর ঐ বিষয়ে কাউকেই কিছু বলিনি আমরা। সত্যি সত্যি কেউ যে নিজের মেয়ে—জামাইয়ের মধ্যে ভাব—ভালোবাসা দেখে এমন করতে পারে—সেদিন তো পদ্ম মুখে এনেই ফেলেছিল—’হিংসে’ শব্দটা—নিজের মেয়েকে বিধবা দেখে যে কেউ খুশি হয়… মেজোকে সত্যিই বুঝতে পারি নে। অমন মিষ্টি সূয্যিটাকে দাঁতে কেটে কেটে বাড়ি থেকে দূরই করে দিলে—সে ছেলের আর জীবনে এ বাড়িতে ফেরা হল না। কোন বিদেশ—বিভুঁইয়ে হার্ট অ্যাটাকে হঠাৎ স্বর্গে চলে গেল—আটাশ বছর বয়সে। তার আগে দশ বছর সে উধাও ছিল। সূয্যি আমাদের বাড়ির প্রথম নাতি—বেঁচে থাকলে তার আজ একত্রিশ হত। সুব্রতা যখন ওর মায়ের পেটে এল ওর বাবার যুদ্ধ থেকে পা হারিয়ে ফেরবার পরে, তখন আমাদের বাড়িতে উৎসব পড়ে গেল। অখুশি হল কেবল একজনই—মেজো। বৌ—ছেলেকে খাওয়াতে পারে না এত কম পেনশনে, তার আবার বৌয়ের কোলে বাচ্চা কেন আসবে? তুষারের ভালোই কমপেনসেশান মিলেছিল মিলিটারি থেকে। সেই টাকা ভুলভাল জায়গায় খাটাতে গিয়েই তো সর্বনাশ হল। রবির উপদেশেই তুষার ওখানে টাকাটা রেখেছিল। ঠিকমতো খাটাতে পারলে আজ ওদের কোনো অভাব থাকত না। সেজন্যে নিজের প্রতি ক্ষোভ ছিল বেচারার—রবির কথায় টাকাটা অন্যায়ভাবে নষ্ট করে ফেলেছে বলে। তাই সবটাই যে মেজোর দোষ, তা নয়। দোষ অনেকের। কিন্তু পদ্ম কি ওসব বুঝবে? দিনরাত্তির ওই চিঠির বাক্সো সামনে নিয়ে ঘট হয়ে খাটের ওপর বসে আছে, সূয্যির চিঠি পড়ছে। এত বছরের যত না—শোনা কথা, না—জানা খবর। কাউকে ছুঁতে দেয় না বাক্সোটা, মুন্নুদিদিকেও না। শালগ্রাম শিলার মতন একখানা নতুন লাল গামছা চাপা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। পুজোটুজো সব ছেড়ে দিয়েছে পদ্ম। শুধু বিড়বিড় করে। দেখলে মনে হবে জপ করছে। কিন্তু আমি জানি, ও সূয্যির সঙ্গে কথা বলে মনে মনে। ওই চিঠিগুলোর জবাব দেয়। মুখ দেখে মনে হয়, যেন পদ্ম আগের চেয়ে শান্তিতে আছে। অজানার অস্থিরতা ঘুচে গেছে। এখন জেনেছে সূয্যি কোথায়। কিন্তু বাড়ির ব্যবস্থাপনা নিয়ে তো মেজো বিষম ঝামেলা পাকিয়েছে। তার পাগলামি যেন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। আমেরিকায় দীপুর বাড়ি থেকে ফিরে এসে অবধি মেজো যেন আরও গোলমেলে হয়েছে। ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। রবির ওখানে আছে সে এখন, সেই ভালো। রবি অবিশ্যি বিদেশ বেড়াতে গিয়েছে ললিতাকে নিয়ে, জিয়া—দিয়া একা আছে বলে মেজো গিয়ে ও বাড়িতে আছে। জিয়া—দিয়া যদিও কেউই আর ছোট নেই। একজন আইন পাশ করে কোর্টে বেরুচ্ছেন, আরেকজন MBA পড়ছেন জোকাতে।
তবুও ললিতা শাশুড়িকে গার্জেন করে রেখে দিয়েছে। ললিতা এ বাড়ির মেজোবৌ বটে , কিন্তু বড়বৌয়ের সব গুণগুলিই তার মধ্যে ছিল। মণিই এ বাড়ির প্রথম ছেলে। কিন্তু আমার বৌমার তো ঠিক ঘরকন্না করায় মন ছিল না। বিবি এখন দুবাইতে থেকে থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে। শাড়ি টাড়ি পরেও না বিশেষ। ওই চুলে রং, সলমা—চুমকির সঙ্গে সিল্কের শালোয়ার—কামিজ, এক গা গয়না,সরু সরু হিল—তোলা জুতো, ছোট চুল, মুখের মেকআপ ঠিক মেমদের মতো—বিবিকে যেন এ বাড়ির বড়বৌ বলে আর ঠিক মানায় না। বিবি নিজেও জানে সেটা। তাই ওরা এসে এখানে ওঠে না, হোটেলে ওঠে। সাদার্ন অ্যাভিনিউতে নিজেদের ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে রেখেছে—সেখানে ইচ্ছেমতো ওঠা যায় না। একটা ভাড়ার গাড়ি ঠিক করে দেয় ওদের হোটেল থেকেই—ওরা ঘুরে যায়, এবাড়ি—ওবাড়ি। তারই মধ্যে বেড়াতে যায় দার্জিলিং, গোয়া, কখনো যায় শান্তিনিকেতনে। এখানে থাকে কতটুকু? এখানে ওর মন বসতে চায় না। বিবির মা—বাবা থাকেন দিল্লিতে—বেশি সময়টা ওরা তাই দিল্লিতেই কাটায়। মণিও যায়। যাবেই তো, শ্বশুরেরও তো বয়স হয়েছে। মণি—বিবির চেয়ে বরং সোমু—বরুণা আমার ঢের কাছের। ওরাই তো থাকে আমাদের সুখে—দুঃখে। সোমু মেজোর ছোট ছেলে। কিন্তু মেজোর আদুরে ছেলে, তার চোখের মণি বড় দুটি, রবি—দীপু। সোমু ছোট একটা কাগজে চাকরি করে। মাইনে খুব বেশি নয়। রবি ব্যারিস্টার বলে কথা। কাঁচা টাকা হাতে। দীপু থাকে আমেরিকায়। তার তো ডলারের কারবার। স্বামী—স্ত্রী দুজনেই ওরা ডাক্তার, বলতে নেই রোজগারপাতি বেশ ভালোই। মেজো তো ওইটেই বোঝে। পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনটিই ওর দুয়ো। সোমু—বরুণার এখানে থাকাটা জরুরি—এক সংসারে আছে বলেই চলে যাচ্ছে। সোমু এতদিন এর মাইনেটা বাড়ি পর্যন্ত আনতই না বলতে গেলে। বরুণার সরকারি চাকরির মাইনেতেই সংসারটা চলছে ওদের। সুমনদাদাটি বড্ড চমৎকার ছেলে হয়েছে। আমাদের বুকজোড়া ধন।
সোমু বলতে নেই, আজকাল আর তেমনধারা নেই। জয় রাধামাধব। এখন সকাল সকাল বাড়ি ফেরে, আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে বসে টিভিও দ্যাখে। অনেকটাই উন্নতি হয়েছে ছেলেটার। ঐ যে কোন ডাক্তারের কাছে ওকে নিয়ে যাচ্ছে বরুণা, নিয়ম করে। সুমনদাদা যে সক্কলের চোখের মণি। দত্তবাড়ির একমাত্র পুত্র সন্তান—প্রত্যেকেরই বুক জুড়ানো ধন সে। বংশে বাতি দিতে তো আর কেউ নেই। সব মেয়ে। গোত্রান্তর হয়ে যাবে তো সবাই!
মণির আমার বাচ্চার শখ ছিল, কিন্তু বিবির বাচ্চাকাচ্চায় ভীষণ ভয়। বিবি চায় নিজেদের জীবন নিয়ে নিজেরা বাঁচতে। মা—বাবা হলে আরো অনেক দায়িত্ব বর্তায় তো। দায়িত্ব নিতে ভালো লাগে না, ভয় করে অনেকেরই। আমাদের বিবি বৌমাও তাদেরই একজন।
কিন্তু আরেক দায়—ভীতু, সংসার এড়িয়ে বেড়ানো মানুষ আমাদের ছোটবাবু! মেজোবাবুর বিয়ের পর থেকেই ওর জন্যে সম্বন্ধ আসছিল, কিন্তু কিছুতেই তাকে রাজি করানো গেল না। ধনুর্ভঙ্গ পণ একবারে। আমি জোর করলেই হাসত আর বলত, ”অবিকল তোমার মতন একটা বৌ এনে দাও—তাহলে বিয়ে করব, এ বাড়িতে অন্যরকম বৌ মানায় না।” মেজো জোর করলে বলত, উরি বাব্বা! তোমরা কি তাকে টিকতে দেবে? জেনেশুনে একটা পরের মেয়ের সব্বোনাশ করব? এই তো বেশ আছি। কী দরকার ঝনঝাটে? আড়ালে ইয়ার্কি মেরে আমাকে বলত—”কেন? এই তো দিব্যি আছি তোমার পদতলে। আমাকে অন্যের কোর্টে ঠেলে দিয়ে তোমার কী লাভ হবে, বড় বৌঠান? ওসব বুদ্ধি ছাড়ো তো দেখি।” আর ও—প্রসঙ্গ ওঠে না, প্রায় তিরিশ—পঁয়তিরিশ বছর। শেষবার সম্বন্ধ এসেছিল নিঃসন্তানা বিধবা, বিরাট সম্পত্তির মালিক—শুনেই ছোটবাবু মারতে উঠেছিল ঘটককে। আমাকে বলেছিল—”তোমার হেঁশেলে ভাগ বসাই, সেটা বুঝি সহ্য হচ্ছে না? তাড়াতে চাও কেন?” আমিও আজকাল মনে মনে ভাবি —এই বোধহয় ভালো। এই যে ষাট—পঁয়ষট্টি বছর ধরে সংসারের সুখ—দুঃখ ভালোমন্দ দুজনে ভাগ করে নিচ্ছি, এই যে একসঙ্গে বুড়ো হচ্ছি দুজনে, এই বা কম কী? আমাদের তো কথা কওয়ারও দরকার হয় না। দুজনের কথা দুজনে আপনাআপনি বুঝতে পেরে যাই। একসঙ্গে বড় হয়েছি ভাইবোনের মতন— রাধামাধবের এটাই ইচ্ছে ছিল। আজ শুনলুম একটি মেয়ে এসেছিল ঠাকুরপোর কাছে। এই প্রথমবার ঠাকুরপোর খোঁজে এ বাড়িতে কোনও মেয়েছেলে এল। ঠাকুরপো বাড়ি ছিল না।
।। জিয়া ।।
আজ আমাদের বাড়িতে পার্টি আছে। দিয়া নানারকম কানাপে তৈরি করবে—কাল থেকে তার প্রিপারেশন চলছে। ঠাম্মুকে বলেছি, একদম ইন্টারফিয়ার করবে না—আমরা এখন বড় হয়েছি, এরকম পার্টি—ফার্টি দেবো, বন্ধুবান্ধব আসবে, মস্তি হবে, ফুর্তি হবে, ড্রিংকস আসবে। তুমি ওপরে থাকবে। তুমি ভুল করেও বৈঠকখানা ঘরে আসবে না, তাহলে ইউ’ল স্পয়েল দ্য পার্টি। সবাই অস্বস্তি বোধ করবে। ইউ’ল হ্যাভ দ্য সেম ফুড উইথ আস বাট উই’ল কল ইউ। ঠাম্মু খুব খুশি হয়নি বাট শি ডিডনট ফ্লাই ইনটু আ রেজ, অ্যাজ শি উড হ্যাভ ডান আর্লিয়ার। ঠাম্মু টেকসাসে গিয়ে বোধহয় পার্টিয়িং শিখে এসেছে—অর্থাৎ বাড়িতে পার্টি থাকলে যে নিজের ঘরে গিয়ে টিভি দেখতে হয়, এটা বুঝে গেছে। আনটিল ইউ আর কলড। আজকের পার্টটা অবশ্য তেমন নয়। ঠাম্মুকে আনাই যায়—কিন্তু ড্রিংক করার সময় কোনও গুরুজন থাকলে খুব অস্বস্তি লাগে, ইউ কান্ট রিল্যাক্স, সব সময়ে অ্যালার্ট থাকতে হয়, বেস্ট বিহেভিয়ারে থাকতে হয়, ইউ ক্যান নট লেট ইওরসেলফ গো। বন্ধুবান্ধবরাও স্টিফ হয়ে থাকে। তাই বলেছি ঠাম্মুকে খাওয়ার সময়ে আনব। Mainly জগদীশই রান্না করবে—আর রহমানিয়ার বিরিয়ানি। আজকে অবশ্য গেস্টরা প্রায় সকলেই ঠাম্মুর নাতি—নাতনি, নাতজামাই এই সব। —তাদের মধ্যে আমার বয়ফ্রেন্ডও আছে, আর আছে মুন্নুর বয়ফ্রেন্ড। ওদের কথা ভেবেই আমি ঠাম্মুকে পরে আসতে বলেছি। ওরা তো ঠাম্মুকে চেনে না। অবশ্য টেকসাস থেকে ঠাম্মু খুব স্মার্ট আর খুব উইথ—ইট হয়ে ফিরেছে। কে জানে, হয় তো বীয়র—টিয়র দিলে খেয়েও নেবে। কিংবা ওয়াইন।
বুম্বাকে বলেছি ড্রিংকসের দিকটা দেখতে। ও কিনেও আনবে বলেছে যা যা দরকার—বাবার সেলারে হাত দেব না আমরা। এটা আমাদের নিজেদের পার্টি। দাদুর জন্য শ্রী দেশে আসছে সিদ্ধার্থদাকে নিয়ে। সেই উপলক্ষেই পার্টি। মুন্নু এসেছে ব্যাঙ্গালোর থেকে। দাদুভাইয়ের আশি বছর হবে নেক্সট উইক এনডে। রামধন মিত্তির লেনে। দাদুভাই ওইখানে ছাড়া অন্য কোথাও সেলিব্রেট করতে রাজি নয়। ”চোদ্দ পুরুষ না হোক, এটাই তো আমার চারপুরুষের ভিটে?”—বলে জোর করছে। ইন ফ্যাক্ট হি ইজ স্যাড। আমার মনে হয়, ঠাম্মুর ভিতরে ভিতরে মন খারাপ। আফটার অল অনেক দিনের মেমারিজ তো? পুরোনো বাড়িটা বেচে ওখানেই চব্বিশটা ফ্ল্যাট হবে, ক্যান ইউ ইমাজিন? অল দ্যাট উঠোন অ্যান্ড খিড়কি বাগান ওইসব আর থাকবে না, চব্বিশটাই বেশ বড় বড়, স্পেশাস থ্রি—বেডরুম লাকশারি অ্যাপার্টমেন্টস উঠবে ওখানে। বাবা আর দীপুকাকু বোধহয় ওদের শেয়ারগুলো বেচে দিয়ে টাকাটা নিয়ে নেবে—সোমকাকু উইল লিভ দেয়ার। অ্যাজ দি ডাজ নাউ। কিন্তু ঠাম্মু পদ্মমাকে আর যমুনামাকে কিছুই দিচ্ছে না, ওরা নাকি ম্যারেড ডটার্স বলে প্রপার্টি পায় না। কিন্তু দে আর দ্য ওয়ানস হু নীড মানি, দে হ্যাভ নো প্লেস অফ দেয়ার ঔন। বাবার তো এই বাড়িটা আছে। দীপুকাকার টেকসাসে বিশাল বাড়ি, ওরা ওদের শেয়ারগুলো কিন্তু দুই বোনকে দিয়ে দিতেই পারত। দ্যাট উড হ্যাভ বিন দ্য রাইট থিং টু ডু—মর্যালি করেক্ট কাজ হত সেটাই।
দিয়া তার নতুন বয়ফ্রেন্ড, সেই বাংলা—ব্যান্ডের সং—রাইটারকে আজ আসতে বলেছে। অ্যালং উইথ হিজ গিটার—দ্যাট শুড বি ফান। হি ইজ ফানি, আর গায়ও ভালো। বুম্বা ইজ আ গ্রেট হেলপ ইন পার্টিজ—ক্যান টেক চার্জ অফ দ্য ড্রিংকস—আজ আমাদের নিজেদের পার্টি। মুন্নুদিদির বয়ফ্রেন্ড হয়েছে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে—ওর সঙ্গে সন্ধেবেলায় সেও আসছে আজকে, টু মীট অল অফ আস—হার এক্সটেনডেড ফ্যামিলি। আমার দারুণ এক্সাইটেড লাগছে—এটা সিনেমার আগে প্রিভিউ দেখাবার মতন। মুন্নুদিদির সঙ্গে ওর ফ্রেন্ডের পরিচয় ব্যাঙ্গালোরেই। দুজনেই বাঙালি, দুজনেই কলকাতিয়া, দুজনেই চাকরি করতে গেছে সুদূর ব্যাঙ্গালোরে। সিদ্ধার্থদার হাইট, ওর মুখখানা, ওর বিলড আমার খুব মনের মতো। হি ইজ অ্যান আইডিয়াল লাভার—অ্যান্ড আওয়ার দিদি গট হিম। আই অ্যাম হ্যাপি উই গট হিম ইন দ্য ফ্যামিলি। এবার দেখতে পাবো মুন্নুদিদির ক্যাচটা কেমন? না, ক্যাচ কথাটা ঠিক হল না। ওটা পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট—মুন্নুদিদি হারসেলফ ইজ নো লেস আ ক্যাচ। দেখা যাক। আজই তো সবার সঙ্গে দেখা হবে। বুম্বাকে দেখতে ভালো, স্মার্ট, দামি গাড়ি চালিয়ে ঘোরে, তবু কী যেন এটা মিসিং ওর মধ্যে। ঠিক কী যে সেটা, দ্যাট আই কান্ট টেল—ওর চালিয়াতিটাই বোধহয় পুটস মি অফ। দিয়া তো একদম পছন্দ করে না বুম্বাকে—বলে ওর কোনো ক্লাস নেই—বড়লোকিপনা মানেই তো ‘ক্লাস’ নয়, বরং উলটো। দিয়াটা এমনিতে এত ছেলেমানুষ, তবু ওর ভিতরে ভিতরে একটা ন্যাচারাল উইজডম কাজ করে। আগেও দেখেছি। ওর ব্যান্ডপার্টি বয়ফ্রেন্ডটা বেশ অন্যরকম—খুবই ডিফারেন্ট ফ্রম দ্য রেস্ট অফ আস—বাংলা কবিতা বলে। ওর সঙ্গে কাকুসোনার মিলবে। যতক্ষণ ওরা না আসছে আমি ততক্ষণে ঘরটা গুছিয়ে ফেলি। কেন যে বাবা—মা ঠিক এই সময়টাতে আলাস্কা ট্রিপে গেল! ওদিকে কাকামণি টেকসাস থেকে চলে এলো, দাদুভাইয়ের এইটিয়েথ বার্থডে সেলিব্রেট করতে, আর বাবা চলে গেল? ভেরি স্ট্রেঞ্জ। মা বারবার বাবাকে বারণ করেছিল। শেষকালে মা বলেছিল, মা যাবে না—দাদুভাই তো মাকে খুব ভালোবাসে। বাবা ইনসিস্ট করল—দারুণ একটা ডিল পেয়েছে, ওরা তিন বন্ধু, তিনটে কাপল একসঙ্গে যাচ্ছে, ফাটাফাটি একটা বোটট্রিপ নেবে, লাক্সারি লাইনারে। তিনটে কাপল না হলে ওই ডিলটা হবে না। বোথ দিয়া অ্যান্ড আই থট দিস ওয়াজ রং। দাদুভাইয়ের আশি বছর তো আবার হবে না? দুবাই থেকে জেঠীও আসছে না।—কিন্তু জেঠু একাই নাকি আসছে সেদিন, কাকি বলছিল। জুডি—দেবী—নীল ওরাও এবার আসতে পারবে না। নীলের ফাইন্যাল ইয়ার স্কুলে। কিন্তু কাকামণি তো চলেই এসেছে ঠাম্মুকে এসকর্ট করে—সেলিব্রেশনের জন্য। ওদেশে ডক্টরদের পক্ষে ছুটি পাওয়া খুব কঠিন, তাও এসেছে তো? বাবা—মাও ফিরবে এ মাসেই—আফটার দ্য সেলিব্রেশনস। কাকামণির সঙ্গে, জেঠুর সঙ্গে বাবার দেখা হবে বলে মনে হয় না। বাট দে টক ওভার দ্য ফোন অল দ্য টাইম। কাকুসোনা ইজ মাচ বেটার দীজ ডেজ—আফটার দ্য ব্রেকডাউন হি ডাজন্ট ড্রিংক দ্যাট মাচ। কাকি চাকরিতে প্রোমোশান পেয়ে দিল্লিতে ট্রান্সফারড হয়েছিল। কাকুকে একা ছেড়ে যেতে পারবে না বলে প্রোমোশানটা নিতে পারেনি। কোনো স্বামী এটা করত কখনো? কেরিয়ার আগে, না পরিবার আগে? ছেলেদের উত্তর, অলওয়েজ কেরিয়ার ফার্স্ট। মেয়েদের উত্তর অলমোস্ট অলওয়েজ, ঠিক উলটো। ফ্যামিলি ফার্স্ট। খুব ক্লিয়ার চয়েস। পুরুষের নজর ইনডিভিজুয়ালের অর্থাৎ নিজের ইন্টারেস্টের দিকে, আর মেয়েদের নজর পরিবারের কালেক্টিভ ইনটারেস্টের দিকে। কাকি চুপচাপ, ঠান্ডা মানুষ, বাট আই হ্যাভ গ্রেট রেসপেক্ট ফর হার। যেভাবে কাকুকে হ্যান্ডল করে, গ্রেসফুলি ইন্টেলিজেন্টলি, উইথ ডিগনিটি। সুমনকেও তো চমৎকারভাবে নিজের মতো করে বড় হতে দিয়েছে। সুমন ওর বাবাকে দেখেছে বলেই বোধহয়, ও এখনও স্ট্রিক্টলি আ টী টোটেলর। কত সব মিডিয়ার পার্টিতে ঘোরে। নেভার টাচেস অ্যালকোহল। মনের জোর আছে, পীয়র—প্রেশার গ্রাহ্য করে না। সুমন বলছিল, বাবাদের বাড়ি নিয়ে যেসব আলোচনা চলছে, সেটা ওরও পছন্দ হচ্ছে না। ও বাড়ি প্রোমোটারকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দ্য প্রপার্টি বিলংস টু থ্রি ঔনার্স—ঠাম্মু, বড়মা, দাদুভাই। ওদের পরে বড়মারটা জেঠু পাবে। ঠাম্মুরটা তাঁর পাঁচ ছেলেমেয়ে পাবে, দাদুভাইয়েরটা যাকে ওর খুশি তাকে দিয়ে যাবে। লিগ্যাল স্টেটাস এই—কিন্তু ঠাম্মু বলছে, ওর অংশটা পাঁচ ভাগ নয় তিন ভাগ করবে। —দু’ভাগ বাবা আর কাকামণি এখনই বিক্রি করে দেবে প্রোমোটরকে, আর থার্ড সেকশনটায় কাকু থাকবে। এই প্রোমোটারকে বিক্রি করে দেওয়ার ব্যাপারটা সুমনের খুব অবজেকশানেবল লাগছে। পুরো দোতলাটাই আমাদের থাকতে পারতো—দে আর বিলডিং টোয়েন্টিফোর ফ্ল্যাটস, অ্যান্ড গিভিং আস সিক্স। টু টু ইচ ঔনার। ঠাম্মু ঝামেলা করছে, শি ওয়ান্টস থ্রি ফ্ল্যাটস ওয়ান ফর ইচ সান। বড়মা অ্যান্ড দাদুভাই আর বিইং প্রেশারাইজড ইনটু গিভিং আপ আ পার্ট অফ দেয়ার শেয়ার্স ফর ওয়ান অফ ঠাম্মুজ সানস—সুমনের তাতে খুব আপত্তি। অ্যান্ড আই এগ্রি টোটালি উইথ হিম।
ইনসিডেন্টালি আজ সকালে নাকি ও বাড়িতে একটা মিস্টিরিয়াস মেয়ে অ্যাপিয়ার করেছে—সে বাংলাদেশ থেকে এসেছে, দাদুভাইয়ের কাছে। দু’বার ঘুরে গেছে। নামও বলেনি, কী দরকার তাও বলেনি। কেবল বলেছে, পার্সোনাল। সুমন বলছিল, বেশ ইন্টারেস্টিং দেখতে; একটু উইয়ার্ড মতো, আমাদেরই এজ গ্রুপ হবে। হঠাৎ দাদুভাইয়ের কাছে এরকম মেয়ে এল কেন, সেটাই মিস্ট্রি। আমার তো মনে হয় মিউজিক—রিলেটেড ইন্টারেস্ট—ওই এস্রাজ—টেসরাজ শিখতে চায় হয় তো? বাংলাদেশীরা তো খুব গানবাজনা শিখতে এদেশে আসে।
।। জারিনা-১।।
দরজা খুলে প্রশ্ন চোখে নিয়ে তাকায় সুব্রতা। ঘণ্টি দিয়েছে ওদেরই বয়সী একটি মেয়ে—পরনে জিনস, আর সিল্কের বেগুনীকুর্তা, শিফনের লালের মধ্যে শাদা ফুটকি ওড়নাটা মাথার ওপর দিয়ে গলায় জড়িয়ে পিঠের ওপর ফেলা। হাতে একগোছা নানারংয়ের চুড়ি। মাথায় অনেক উঁচু চুড়ো করে বাঁধা চুল মুখের চারপাশে এলোমেলো উড়ছে—প্রসাধন নেই—বড় বড় চোখদুটির দৃষ্টি অস্থির, কাঁধে একটা বড়সড় ঝোলা, পায়ে রানিং শুজ। আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে আছে। মুখখানা খুব মিষ্টি, মুখে, যদিও হাসি নেই।
”মিস্টার দ্যাবশংকর দত্তর রেসিডেন্স?”
সুব্রতা হ্যাঁ—সূচক মাথা নাড়ে।
”উনি আছেন তো? আমি বাংলাদেশ থিক্যা আইসি।”
”আছেন।”
”আমার নাম জারিনা। আপনি উনার কে হন?” দরজার বাইরে আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে। বেশ মিষ্টি চেহারা, কিন্তু একটা শান্ত জেদও আছে শরীরের ভাষায়।
”আমি ওঁর নাতনি। আপনার প্রয়োজনটা কী জানতে পারি? উনি স্নানে গিয়েছেন। দেরি হবে।”
”ওনারেই কমু। ওনার সাথেই প্রয়োজন। ঢাকার থিক্যা আসসি, টু হ্যাভ আ ডিসকাশ্যন অ্যাবাউট সামথিং ইমপর্ট্যান্ট।”
”মানে?”
”আপনি ওনার নাতনি কইলেন না? শুভমরে চিনেন? শুভম মান সূর্য।”
”শুভম?” এক মিনিট থমকে যায় সুব্রতা। তারপরেই বলে—”আমার দাদা।”
”দাদা হইত আপনের?”
মেয়েটা চোখ বড় বড় করে সুব্রতার মুখের দিকে স্থির হয়ে তাকাল। বড় বড় আয়ত দৃষ্টি। ঘনপক্ষ্ম চোখ দুটো একটু কটা—কিন্তু খুব গভীর। কী দেখছে ও? অস্বস্তি বোধ করে সুব্রতা। মেয়েটা কথা বলছে না। তারপর আস্তে করে যেন ঘুমের মধ্যে উচ্চারণ করল—”মুন্নু?”
চমকে উঠল সুব্রতা। কে মেয়েটা কেমন করে জানল ওর ডাকনাম?
”আমার ডাকনাম আপনি জানলেন কেমন করে?”
মেয়েটা এবার এগিয়ে এল দু’পা। সুব্রতার মুখের দিকে চেয়ে আধা হাসল। এতক্ষণে ওর গম্ভীর মুখে একচিলতে হাসি দেখল সুব্রতা।
”ঠিক কইসি না? মুন্নুই তো?”
”কে বলল নামটা আপনাকে? কোথায় শুনলেন?”
”গ্যেস কইরা কন দেহি, কে কইতে পারে?”
কণ্ঠস্বরে কি হাসি—হাসি ভাব? রহস্য একটুও ভালো লাগছে না সুব্রতার। বিরক্ত হয়ে বলে—”গ্যেস করতে পারবো না আমি। আপনিই বলুন।”
”রাগ করলেন?” মেয়েটা দরজায় হাত রাখল—”শুভম কইত কিনা। মুন্নুটার লেইগ্যাই তার ঘরে ফিরতে মন চায়—কত বড়টি হইল ছুটু বুনটা—শুনসি নামটা—তাই চিনলাম।” আবার অল্প হাসে।
”দাদাকে আপনি চিনতেন?”
উত্তর দিল না মেয়েটা। চেয়ে রইল। মেয়েটার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখল এতক্ষণে সুব্রতা। পাতলা ঠোঁট দুটো, পাতলা নাকের পাটা দুটি কাঁপছে তিরতির করে।
”আপনি ভেতরে বসবেন চলুন—”
এবার মেয়েটি চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভিতরে পা দিল। কথা বলতে বলতে সুব্রতা ওকে বৈঠকখানা ঘরে এনে বসাল।
”অনেক বছর আমরা দাদার কোনও খবর পাইনি—গত বছরে হঠাৎ এক্কেবারে আনপ্রিপেয়ার্ড—দাদার দুঃসংবাদটা পেলুম। মা সেই থেকে একেবারেই ভেঙে পড়েছেন।”
”আম্মা? পদ্মাবতী রায়? তিনি জীবিত আছেন? আব্বার তো পূর্বেই ডেথ হইসে, ট্রেনের অ্যক্সিডেন্টে?”
”এতসব খবর আপনি পেয়েছেন দাদার কাছেই?” সুব্রতার গলায় সন্দেহ।
উত্তর না দিয়েই জারিনা চতুর্দিকে তাকায়। ঝাড়লণ্ঠনটা দ্যাখে। বাইরে চকমেলানো উঠোনে তুলসীবেদী। একরাশ বাসন নিয়ে মাজতে বসেছে অন্যদিকে মধুর বউ। চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে জারিনা আপনমনে বলে, ”শুভমের বাড়ি। তার অ্যানসেসট্রাল হোম।” মুগ্ধ নয়নে দেখতে দেখতে হঠাৎ শোকেসের দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলে—”একটা ছোট্ট সিলভারের সোফাসেট আছে না ওইখানে? সেই যে বিলাইতী পিংক স্যাটিনের গদিওয়ালা সোফাসেট—সেন্টার টেবল, ঢাকাইয়া জার্ফির কাম, ফিলিগ্রিওয়ার্ক করা খাঁটি রূপার সোফাসেট—মিনিয়েচার পোর্সিলেইনের টী—সেটও সাথে আছে ট্রে—সুদ্ধ। আছে না, ওই কুট্টি টেবিলে সার্ভ করার মতো—আছে না অহনও? বাচ্চারা ক্যাবল সেইগুলি লইয়া খেলতে চায়।”
সুব্রতার গা ছমছম করে ওঠে।
কী ভীষণ ডিটেইলে রিসার্চ করে এসেছে এই মেয়ে। পুলিশে খবর দেওয়া উচিত? না আগে দেবশংকরকেই ডাকবে সে?
মেয়েটা কি থটরিডিংও জানে?
”ভয় পাইলেন? এত প্রাইভেট ডিটেইলস এই ছেমড়ি জানে কী কইর্যা? আইসে তো বিদেশ থিক্যা। আমাগো আলমারির ভিতরে কী আছে তার তো জানার কথা না। তাই না? তাই তো? ডেনজারাস?”
সুব্রতা চোখে চোখে তাকায়। মেয়েটা হাসছে। খুব একটা চতুর হাসি নয়। মজাপাচ্ছে। মাথা নেড়ে অভয় দেয় সে সুব্রতাকে—”আমি এই বাড়ির সবই জানি যে। তাও আসার আগে ভয় ভয় লাগসিল ঠিকই—মুসলমান তো—ঘরে ঢুকতে দিবেন কিনা? তাই সাহস কইর্যা ঢুকি নাই। যদিও জানি দ্যাবশংকর দত্তর মনে কোনও বাধা নাই—বড়মারও নাই, তাও তো সঙ্কোচ হয়?—আপনি ভিতরে ডাইক্যা আনলেন, বুঝলাম, ঠিকই কইসিল শুভম।”
কে এই মেয়েটা? কী বলতে এসেছে ও? সুব্রতার মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
একটু উঠে যেতেই হবে বাইরে। উঠে পড়ে সে বলল—”আপনি বসুন, আমি ওদিকে দেখি। একটু চা—কফি কিছু। কী এনে দেব বলুন?”
মেয়েটা ঝাঁকড়া মাথা ঝাঁকিয়ে বললো—”কিসসু না! কিসসু খামু না। আপনে এট্টু দ্যাবশংকর দত্তরে কাইনডলি ডাইক্যা দেন, প্লীজ? উনার সাথেই আলাপ করুম। উনার কি অহনও গোছল সারা হয় নাই?”
সুব্রতা বলল—”উনি আপনার আসার কথাটা জানেন না—আমি তো ভেতরে যাইনি। দেখি ওঁর স্নান হল কিনা—আপনি বরং একটু আমপোড়া শরবত খান।”
সুব্রতা পালিয়ে বাঁচল। আমপোড়া যদি নাও থাকে, অরেঞ্জ স্কোয়াশ তো আছে? এই রহস্য আর নিতে পারছে না সে। একটু বাইরে বেরিয়ে হাঁপ ছাড়ার দরকার।
।। জিয়া-দিয়ার পার্টি ।।
বেল বাজল দরজায়।
দিয়া দৌড়ে গিয়ে খুলতেই হুড়মুড় করে ঢুকে এল বুম্বা। দু’হাতে একটা চৌকো কাগজের কার্টন।
”হাই! হিয়ার আই অ্যাম! যা যা বলছিস সবই এনেছি। কিন্তু কী দরকার ছিল? তোর তো নিশ্চই বাবারই সেলার রয়েছে দারুণ? লক করে গিয়েছে নাকি?” বাক্সো মাটিতেই নামিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়ে বুম্বা। এসি চলছে, ঘর ঠান্ডা। বুম্বা রুমাল দিয়ে ঘাম মোছে।
”বাব্বাঃ। ভারী তো লিফটে করে তুলেছিস, একটুখানি এতেই দম ফুরিয়ে গেছে তোর?” দিয়া ঠেস দিয়েই কথা বলে বুম্বার সঙ্গে—এটা ওর স্বভাব। বুম্বাও ছাড়ে না। বুম্বা জিয়ার বন্ধু। ওর সঙ্গে MBA পড়ছে। জিয়ার ঠান্ডা স্বভাব।
”আমার বাবার তো দারুণ একটা কলেকশন আছে ফরেন লিকারের।” বুম্বা বলে। ”—ওয়াইনও আছে অনেকগুলো— ফ্রেঞ্চ, জার্মান, অস্ট্রেলিয়ান—আজকাল অস্ট্রেলিয়াও দারুণ ওয়াইন বানাচ্ছে। জানিস?”
” সে তো ক্যালিফোর্নিয়াও বানাচ্ছে—কিন্তু আমরা বাবার সেলর ইউজ করি না। স্পেশালি হোয়েন হি ইজ নট হিয়ার। এটা তো আমাদের পার্টি।” জিয়া বলল। আর সামনে কয়েকটা ফুলদানি, আর নানা গড়নের পাঁচমিশেলি ফুলের গোছায় পাতার গুচ্ছ। জিয়া ঘর গুছানোয় শেষ টাচটা দিচ্ছে। দিয়া ওদিকে খাবার—দাবারের দিকটা দেখছে। দিয়াটা চঞ্চল, বেল বাজলেই সব ফেলে ছুটছে দরজায়।
আবার বেল বাজল। আবার দিয়া দৌড়াল। এবার ঢুকল অভিষেক। বগলে গিটার। ওকে দেখেই দিয়া মুখভঙ্গি বদলে আহ্লাদে গদগদ হয়ে ওঠে।
”এসে গেছিস? গ্রে—ট! হয়ে গেল তোদের রিহার্সাল। নাকি ফাঁকি দিলি?”
”একটু ফাঁকি। একটু রিহার্সাল। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।”
”ওঃ, অভিষেকটা যে কত proverbs জানে বাংলায়—”
বুম্বার কথার ঘাড়ের ওপর দিয়া বলল—”তা কেন? আমিও জানি। একে বলে একুল—ওকুল দু’কুল রক্ষে। কি বল, জিয়া?
”আই সি—একুল—ওকুল দু’কুল মীনিং আ রিভার?”
”আজ্ঞে না। এ সে কূল নয়—হ্রস্ব—উ, বুঝেছ? কুল মানে ফ্যামিলি—শ্বশুরবাড়ি, বাপেরবাড়ি দুই কুলকেই খুশি করে চলতে পারা—দ্যাট ইজ একুল—ওকুল দু’কুল রক্ষে করা—রাধার প্রবলেম ওটা—”
”বাব্বাঃ। শি নোজ আ লব অব বেঙ্গলি স্টাফ! দিয়া উইল মেক আ গ্রেট ল’ইয়ার—” বুম্বা হঠাৎ সপ্রশংস হয়ে পড়ে।
জিয়া চোখ তুলে তাকায় বুম্বার দিকে—”আমরা রামধন মিত্তির লেনে বড় হয়েছি, বুম্বা। উই আর রুটেড ইন আওয়ার কালচার। আমরা তো ইশকুল, আর সংসার, দুটো জায়গাতেই শিক্ষা পেয়েছি কিনা? এতে অবাক হবার কিচ্ছু নেই, এসব প্রবাদ সকলেই জানে—তুই যে জানিস না, সেটাই অবাক কাণ্ড।”
”খুব লজ্জারও”—দিয়া যোগ দেয়।
”বা বা, বুম্বা তোদের জন্যে খেটেখুটে বাক্সো—বাক্সো ড্রিংকসের বোতল এনে দিলে কি এই জন্যে? তোরা দু’বোনে মিলে ওর পেছনে লাগবি বলে?” অভিষেক বুম্বাকে সাহায্য করতে এগোয়। বুম্বা এমনিতে অভিষেককে খুব একটা পাত্তা দেয় না—সে গাড়ি চড়ে ঘোরে না, বাংলা ব্যান্ডের গান লেখে এবং বাংলা ব্যান্ডের গান গায়, সে বাংলা স্কুলেই পড়েছে। কলেজে উঠে সবাই সমান। বুম্বা আসে একটা অ্যাকসেল্ট গাড়ি চালিয়ে। বুম্বা থাকে আলিপুরে। অভিষেকের হরিশ মুখার্জী রোডের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয় অবশ্য। অভিষেক নাকি উত্তমের সঙ্গে লতায় পাতায় জ্ঞাতি। বুম্বার বাবা বিখ্যাত ব্যারিস্টার এইচ. কে. চন্দ্র। আদালত পাড়ায় খুব রমরমা তাঁর। রবিশংকরের যেমন। রবির বন্ধুর ছেলে বলেই বুম্বার সঙ্গে চেনা—তারপর দুজনেই বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ছাত্র হয়েছে একই কলেজে, প্রচুর বেতন কবুল করে।
”বুম্বার বাবার এইচ. কে. হল হরেকৃষ্ণ। কেন অমন আলাদা আলাদা অক্ষর রে? কে জানে? বেশি ইমপ্রেসিভ শোনায় বোধহয়।” একদিন আলোচনা হয়েছিল জিয়া—দিয়াতে। বুম্বা বড্ড চালিয়াতি করে—কিন্তু জিয়ার প্রতি একান্ত অনুগত। জিয়াকে সে তার গার্লফ্রেন্ড বলে মনে করে—ঘোষণাও করে, কিন্তু জিয়া মনস্থির করে উঠতে পারেনি। পারেনি কেবল দিয়াটার জ্বালায়। দিয়া বুম্বাকে কিছুতেই সিরিয়াসলি নেয় না।
দিয়ার বন্ধু অভিষেককে অবশ্য জিয়ার বেশ লাগে। একটু অন্যরকম ছেলে। অভিষেক যাদবপুর থেকে হিস্ট্রি নিয়ে পাশ করেছে—কিন্তু গান নিয়ে মেতে আছে। তার একখানা চাকরিও আছে, একটা পরিচিত বাংলা কাগজে সাব—এডিটর হয়েছে সে। কিন্তু তার নিজস্ব পরিচয় বাংলা ব্যান্ডের গীতিকার, সুরকার, গায়ক বলেই। এটাতে রোজগার তেমন হয় না এখনও, তাই চাকরিটা করতেই হয়। দিয়ার সঙ্গে অভিষেকের প্রেমপর্ব ভালোই চলছে। সকলেরই তাই ধারণা। দিয়া—জিয়ার শ্যামবাজারী ঠাকুমা কেয়াতলার বাড়িতে এসে শিখেছেন, উঠতি বয়সের মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড থাকেই—এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তাতে পরে ভালো বিয়ে—থা আটকায় না। জিয়া—দিয়া দুজনেই ভালো মেয়ে, বুদ্ধিমতী মেয়ে। তাদের মা ললিতার তাদের নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। আর বাপ রবিশংকরের এসব কথা ভাবনার সময় নেই। যদিও সে শুনেছে বুম্বার সঙ্গে জিয়া ঘুরছে, তাতে রবির উদ্বেগের কারণ হয়নি। অভিষেক আর দিয়ার ব্যাপার রবির কানে তোলেনি ললিতা। প্রভাবতীর ধারণা, এটা রবির পছন্দ হবে না—অভিষেকের বাবা—মাকে তো চেনেন না তাঁরা? উস্কোখুস্কো চুল—দাড়ি, রোগা প্যাংলা হলে কি হবে, ছেলেটা ভারী সুন্দর গান করে, চাকরি—বাকরিও করে কী যেন একটা। জিয়া—দিয়া—বুম্বার চেয়েও নাকি একটু বড়োই, কিন্তু দেখলে মনে হবে বুম্বা ওর দাদা। আমেরিকাতেও একরম চুল—দাড়িওলা গিটার বগলে ছোকরা প্রচুর দেখেছেন প্রভাবতী—নীলও এই ধরনের চেহারা বানাতে চেষ্টা করেছিল, কচি দাড়ি রাখছিল— কিন্তু ওদের ইস্কুলের কড়া নিয়ম, গোঁফদাড়ি রাখতে দেবে না ছাত্রদের—তাই কামিয়ে ফেলেছে। আজ ওদের পার্টি হচ্ছে নীচের হলঘরে। তখন প্রভাবতীর নীচে নামা বারণ। ওরা নাচগান করবে, হৈ হুল্লোড় করবে, ড্রিংকট্রিংকও করবে বোধহয়। আজকাল তো ছেলে—বুড়ো সকলেই ড্রিংক করে দিব্বি খোলাখুলি। প্রভাবতীর মনে পড়ে, শ্বশুরমশাইয়ের বেলায় কত ঢাকাঢুকি ছিল। আর স্বামী তো বাড়িতে খেতেনই না, বাইরে থেকে খেয়ে ঢুকতেন। ভাসুর—দেওরের মদের নেশা ছিল না—এখন আবার সোমুটা পেয়েছে বাবা—ঠাকুর্দার নেশা। কিন্তু সেও বাড়িতে খায় না। জ্যাঠাইমা আছে। কাকা আছে। মা আছে। বড়দের মান্যি করে বাইরেই খেয়ে আসতো। মাঝে মাঝে বাড়াবাড়িও হয়ে যেত। পুরুষমানুষের ওরকম একটু—আধটু দোষ থাকেই—কিন্তু আজকাল বরুণা কী সব চিকিৎসা চালু করেছে—সিটিংয়ে নিয়ে যায়—সোমুর বোধহয় নেশাটা সম্প্রতি ছাড়িয়েই দিয়েছে। শব্দটব্দ পাওয়া যায় না নীচে। প্রভাবতী একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন—কী ভীষণ কন্ট্রোল স্বামীর ওপরে! নেশা পর্যন্ত ছাড়িয়ে দিতে পারলে। তিনি কি পেরেছিলেন? তিনি না পেরেছিলেন শ্বশুরের নেশা ছাড়াতে, না শ্বশুরের পুত্রের। বড় জাকে হিংসে হয় প্রভাবতীর—কী চোখেই যে দেখলেন প্রভাকে শ্বশুরমশাই। সারাজীবনটাই যেন রাহুগ্রাসে ঢুকে গিয়ে পিষে গেল তাঁর। অথচ বড়বৌমাকে তো মায়ের মতো চোখে দেখতেন। কেন, বড়বৌও তো ছোটো মেয়ে, কিশোরী মেয়েই বৌ হয়ে এসেছিলেন। তবে শুধু তাঁকেই কেন এভাবে যন্ত্রণা দিলেন শ্বশুরমশাই? যতদিন তাঁর মৃত্যু না হয়েছে, প্রভাবতী মুক্তি পাননি। বৈধব্যই কি তবে রক্ষা করেছিল বড়বৌকে? প্রভাবতীর সামনে টিভি খোলা, সেখানে একটা হিন্দি সিরিয়াল হচ্ছে। কিন্তু প্রভাবতীর মন আজ ছবিতে নেই।
ও বাড়ি ভাঙছে। লেগে গেছে ভাই—বোনেতে ঝগড়া—বড়বৌ, ছোটবাবু, পদ্ম আর যমুনাকে বাড়ির ভাগ দিতে ব্যস্ত। কিন্তু কিসের জন্যে অন্য বংশের লোকেদের দেওয়া হবে দত্তদের বনেদি ভিটেমাটির অংশ? তুষার নেই। তার ছেলেও নেই। অরণি তো থেকেও নেই। শুনেছেন ওদের নাকি ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে, আবেদন পেশ করা হয়ে গেছে কোর্টে। অরণি সেই ফিরিঙ্গি মেয়েটাকেই বিয়ে করবে ঠিক করেছে, বউ—মেয়েকে জলে ফেলে দিয়ে। বম্বেতে সেই মেয়েটার সঙ্গেই আছে গত একবছর ধরে, শ্রীময়ীর বিয়ের পর থেকেই অরণি ওই বম্বের অফিসে বদলি নিয়েছে। কথায় বলে না, রাখে হরি মারে কে? শ্রীময়ীটার গল্প হল ঠিক তাই। ওকে শ্রীহরি রক্ষা করেছেন বলে, যম হার মেনেছে। যে কালরোগে ধরেছিল মেয়েটাকে, একটা একটা করে নাকি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব পড়ে যাবার কথা এই অসুখে। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়বে সব। দেহের পর যাবে মন। যাবে সব কিছুই। কিন্তু কোথা থেকে একটা খবর যোগাড় করল ওই মেয়ে নিজে নিজেই—আমেরিকার কোন ইউনিভার্সিটিতে ডাক্তাররা রিসার্চ করেছে এই রোগ নিয়ে—তারপর তাদেরই একজন ডাক্তার এসে শ্রীময়ীকে বিয়ে করে সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেল আমেরিকায়। যমুনাকেও নিয়ে গেল। ওখানে কে দেখবে মেয়েকে? মেয়ে তো পঙ্গু। হুইলচেয়ার ছাড়া নড়তে পারে না।
প্রভাবতীকে দীপশংকর মেয়ের বাড়ি, নাতনির বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল, বস্টনে। দিব্যি প্লেনে চড়িয়ে দিলে এখানে—আর ওখানে শ্রীময়ী আর তার বর এসে নামিয়ে নিলে প্লেন থেকে। শ্রীময়ী এসেছিল তার হুইলচেয়ারে চড়ে। যমুনা বাড়িতে ছিল, মার জন্যে রান্নাবান্না করছিল। কি সুন্দর বাড়িঘর তাঁর নাতজামাইয়ের, কি সুন্দর স্বভাব ছেলেটার। তাঁর এই প্রথম নাতজামাইটি কিন্তু সত্যি মনের মতন হয়েছে প্রভাবতীর। যমুনা তার ঘর—বর, চাকরি—বাকরি, যথাসর্বস্ব ছেড়ে দিয়ে, কলেজের চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে ওখানে গিয়ে পড়ে আছে একমাত্র মেয়ের জন্যেই। মেয়ের অনেক উন্নতিও হয়েছে এই দু’বছরে। দিব্যি নিজে নিজে ওয়াকার ঠেলে ঠেলে হাঁটছে নাকি ঘরের ভেতরে। সিদ্ধার্থ বলেছে, বাইরেও পারবে ওয়াকার ঠেলে হাঁটতে। আস্তে আস্তে শিখে যাবে।
মানুষকে শুধুই ঝরে যেতে—পড়ে যেতে—মরে যেতে, নষ্ট হয়ে যেতেই দেখেছেন প্রভাবতী। এমন ভালো হয়ে জ্বলে উঠতে দেখলেন আর ক’টাই বা জীবন?—”আমার নাতনি—নাতজামাইকে রাধামাধব অসীম দয়া করেছেন—দৈব কৃপা ছাড়া কদাচ এমন ঘটনা ঘটে না!” আপনমনেই প্রভাবতী নমস্কার করেন রাধামাধবকে। শ্রীময়ী—সিদ্ধার্থ দেশে এসেছে, যমুনা সমেত ছোটবাবুর আশিবছরের জন্য—ওদের আজ এদের পার্টিতেও আসার কথা। পদ্মার মেয়ে সুব্রতাও আজ আসছে—সে এখন ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করে। ছোটবাবুর উৎসবে যোগ দিতে সেও এসেছে। দাদুভাই যে ওদের প্রাণ!