।। দেবশংকর ।।
সকাল হলেই মন আপনা—আপনি খুশি হয়ে যায়। কেন যে, কী জন্যে যে, সেটা কখনও ভাবিনি। মনে হয় এই যে আলো, এই যে কলুষনাশিনী ঊষা, এইখানে ঈশ্বরের স্পর্শ। ছোটবেলা থেকেই এরকমটা হয়ে আসছে—এ বছর আমার আশি বছর পূর্ণ হবে। এখনও বুকের ভেতরকার সেই নেচেওঠার অভ্যেসটা গেল না। বৌদি বলেন পাখির স্বভাব আমার। পাখিরা যেমন ভোর হলেই উঠে পড়ে, কিচিরমিচির শুরু করে দেয়, আমিও তেমনি ভোর হলেই উঠে পড়ি, আর পিড়িং পিড়িং শুরু করে দিই। সকালবেলা আমার রেওয়াজ করার সময়। ছাদের ঘরটা এজন্য আমার। বাড়ির কেউ ডিস্টার্বড হবে না। পুজোর ঘরটাও পাশেই। এ বাড়ি তৈরির সময় পুজোর ঘর তৈরি হয়েছিল তেতলার ছাদে, যাতে রাধামাধবের মাথার ওপর দিয়ে কেউ হাঁটাচলা করতে না পারে। সকলের মাথার ওপরে থাকবে ঠাকুরের আসন। তাই আছে। বড়বৌঠান এখনও তেতলায় ঠাকুরঘরে উঠে এসে নিত্যিপুজো দিতে পারেন। কিন্তু ঠাকুরঘর আর এস্রাজটি নিয়েই তো জগৎটা নয়। এই যে একটু কাগজটা নিয়ে বসি—আজকাল আর সেটাও পারি না। চোখ যে ভালো নেই , তা নয়। জগৎটাই আর ভালো নেই। যেসব খবর রোজ কাগজে বেরুচ্ছে সেসব পড়লে আর তো রাতে দু’চোখের পাতা এক হয় না। কেবল মানুষের পশুত্বের কথা, মানুষ বলতে এতকাল যা বুঝেছি,তার বদলে অন্য কিছু এখন মানুষের নামে চলছে। প্রত্যেকদিনই দেখি কেবলই খুন, জখম, ডাকাতি আর ধর্ষণের খবর। সরস গল্প বলার মতন করে সেই সব খবর রসিয়ে রসিয়ে কাগজ জুড়ে পাতার পর পাতা ভর্তি করে ছাপা হচ্ছে, ছবি দিয়ে, ডায়াগ্রাম দিয়ে, ফটোগ্রাফ দিয়ে। সেই সব হতভাগিনী মেয়েদের বাবা—মায়ের কান্নামুখের চেহারাও কাগজে বেরুচ্ছে। টিভি খুললেও একই। গাড়িবোমা, মানুষবোমা, রক্তারক্তি। আমাদের জন্ম হয়েছিল পরাধীন ভারতবর্ষে। আমরা স্বাধীনতা আন্দোলন দেখেছি, টেরটিস্ট মুভমেন্ট দেখেছি—সে ছিল অন্য এক জগৎ। এভাবে নির্বিচারে, নির্বিকারে, নিরপরাধ মানুষ, কালজয়ী শিল্পকর্ম, ধর্মস্থল, সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়ার উন্মত্ত হিংস্রতা ছিল না তাতে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধও দেখেছি আমরা। হিটলারের প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতার কথা জেনেছি। ইহুদীদের ওপর অকথ্য অমানুষিক অত্যাচার চালানোর জন্যে সারা বিশ্ব হিটলারকে ঘৃণা করেছে। আর এখন? কিসের জন্য যে কাকে মারছে, কে মারছে, কিছুই টের পাই না, কিছু বুঝতেই পারি না।
দাদার শ্বশুরমশাই আন্দামানে প্রায় সারাজীবনটা কাটিয়ে, যখন ১৯৪৭—এ বেরিয়ে এলেন, তখন তাঁর মাথার ঠিক ছিল না, হাত—পায়েরও ঠিক ছিল না। তিনি অন্ধকার ঘরে একলা বসে থাকতেন। আপন মানুষের সঙ্গও সহ্য করতে পারতেন না। বেশিদিন অবশ্য বাঁচেননি ফেরার পরে। তখন মনে হয়েছিল কী অসহনীয় নিষ্ঠুর এই আপাতদৃষ্টিতে সুসভ্য ইংরেজ প্রশাসন। কিন্তু এখন? এখন সারা বিশ্বই নিষ্ঠুর। এখানে কেউ নিরপরাধকে সম্মান করে না। অপরাধীকেও অসম্মান করে না। খবরে পড়ি, জেলে বসে বসেই বড় বড় দাগী অপরাধীরা আরও বড় অপরাধের পরিকল্পনা করে। আমাদের স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক সরকার তাদের আটকাতে অপারগ। অবিশ্যি আমরাই কি পারি? ঘরের মধ্যে, চোখের সামনে অন্যায় হচ্ছে দেখেও আটকাতে পারি না আমরা। অসহায়ভাবে সহ্য করে যাই—চোখ বন্ধ করে থাকি। এই বীভৎস একটা পৃথিবীতে আরো কতকাল বাঁচতে হবে কে জানে? আশি বছর তো হল, আরও কেন? এরকমও মনে হয় মাঝে মাঝে—মনে হয় আমি বেঁচে থেকে জগতে কারুর কোনও উপকারে লাগছি না, এতটুকুও কষ্ট লাঘব করতে পারছি না কারুর। চতুর্দিকে কত যন্ত্রণা, কত হাহাকার। বাড়ির বাইরেও তাকাতে হবে না। বাড়ির ভেতরেই কি কম? কম অন্যায়? কম অবিচার? কম অত্যাচার? কত যে অমানবিক আচরণ ঘটে চলেছে এই সংসারে? বড় বৌঠান আর আমি তার সাক্ষী—নীরব সাক্ষী। কেন নীরব? কেন কথা বলিনি? কেন আপত্তি করিনি? শুধু অশান্তির ভয়ে। এখন অবশ্য দিনকাল পালটেছে, অশান্তিকে আর ভয় করে না কেউ। আমরা ভীতু। মেরুদণ্ডহীন ছিলুম বললেও ভুল হবে না। মেজোবৌঠানকে এতটা বেড়ে উঠতে দিয়েছি আমরাই। বড়বৌঠান আর আমি গোড়া থেকে শক্ত হলে মেজোবৌঠান এতটা অন্যায় করতে পারতেন না—কে জানে হয়তো তুষারকেও বাঁচানো যেতো। হয়তো সূয্যিটাও আজ থাকতো আমাদের মধ্যে। দোষ আমার। এ বাড়ির একমাত্র পুরুষ অভিভাবক হিসেবে আমারই উচিত ছিল রাশ টেনে ধরা। হ্যাঁ, আমি ভীতু। স্বীকার করছি আমি গা বাঁচিয়ে চলতে ভালোবাসি। এই গা বাঁচানো, দায়িত্ব এড়ানোর জন্যেই আমি বিয়ের পিঁড়িতে বসিনি। আমার এস্রাজটি ছাড়া আর কারুর দায়িত্ব নেওয়ার শক্তি আমার নেই। যদি বলো, বড়বৌঠান? বড়বৌঠান নিজেই তো আমার দায়িত্ব নিয়ে রয়েছেন এই পঁয়ষট্টি বছর ধরে—আমি বড়বৌঠানের দায়িত্ব নেব এত কপাল করিনি।
ওই মহিলার অসামান্য ক্ষমতা আছে দায়িত্ব গ্রহণের। বিশ—বাইশ বছর বয়েস থেকে একা এই সংসার মাথায় করে টানছেন। আমার মা যখন মারা গেলেন দুই বউ প্রায় সমান বয়সী। মেজদা বেঁছে—তিনিই কর্তা—কিন্তু তবু বড় বৌঠানই হাল ধরলেন সংসারের—তিনিই এগিয়ে এসে বাড়ির সকলের মা হয়ে বসলেন। শাশুড়ির বদলে এতবড় সংসারের ভার মাথায় তুলে নিলেন তাঁর বড়বৌ অসময়ে বিধবা হয়েই যেন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছিলেন বাড়ির সবার চেয়ে। মেজোবৌঠান যেভাবে মেজদাকে ব্যবহার করতে শুরু করে দিলেন, সংসারে একটা প্রচণ্ড ভাঙন ধরতোই—যদি আমিও বিয়ে করে আরেকটা বৌ ঘরে আনতুম। এই বাড়িতে দেওয়াল উঠতো। তাছাড়া বড়বৌঠানকে দেখেছি তো? কোনো মেয়েকেই আর আমার চোখে ধরেনি। দাদা—মেজদা আমার চেয়ে অনেকটা বড়। মাঝে নাকি দুটি মেয়ে হয়েছিল, যাদের মুখে নুন দিয়ে ধাইমা সুব্যবস্থা করে দিয়েছিল, তাদের পরে আমি। এই বংশে মেয়ে জন্মায় না, এইটে বলতে সবাই ভালোবাসতো। মেজোবৌঠান তাই পদ্মাকে নিয়ে খুব বিব্রত, যমুনাকে নিয়ে তো আরও। সে একে মেয়ে, তায় কালো। ভাগ্যিস সেই ধাইমা বুড়ি বেঁচে ছিল না, পদ্ম—যমুনার জন্মের সময়ে। বাবা মেজোবৌয়ের জন্য প্রত্যেকবার স্পেশাল যত্নে ডক্টর নন্দীকে আনাতেন।—তিনি নিজে বেবি ডেলিভারি করাতেন বলেই এ বাড়ির মেয়েগুলো বেঁচে গেল। বাঁচলো বটে, কিন্তু মেজোবৌঠানের মনের ওপর বোঝাস্বরূপ হয়ে রইলো—তিনটে ছেলে, দুটো মেয়ে বলতে মেজোবৌঠান লজ্জা পেতেন। আমাদের কোনো পিসিমা নেই, ওই ধাইমার নুনের কল্যাণে। —কিন্তু মাসিরা তো ছিলেন। —ছোটমাসি খুশি হয়ে নাকি মেজোবৌঠানকে বলেছিলেন—’একেই বলে ”মালাবিয়ানী”—একটি ছেলে একটি মেয়ে পরপর ফুলের মালা গাঁথার মতো, এ তো খুব সুলক্ষণ!!’—তাতেও ভেজেনি মেজোবৌঠানের প্রাণ। ছোট্ট থেকে হেনস্থা করেছেন দুটো মেয়েকে, এখনও করে চলেছেন। যমুনা তবু বিয়ে করে এ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে বেঁচেছে। পদ্মরানির তো সেই সৌভাগ্য ছিল না।
এই বাড়িতে এসে পিতৃ—মাতৃহীন তুষার, যুদ্ধে পা খুইয়ে—আমরাই ডেকে আনলুম, ওর তো ঘরদোর ছিল না। আর শুরু হল মেজোবৌঠানের অকথ্য অত্যাচার পদ্ম আর তুষারের ওপর। সে অত্যাচার শেষপর্যন্ত সহ্য করতে পারেনি তুষার। রেললাইনের আশ্রয় নিয়েছিল সে। সূয্যিকে অপমান করতে করতে মেজোবৌঠান এমনই অবস্থা করেছিলেন যে সূয্যিটা পালিয়েই গেল জন্মের শোধ। সূয্যিটা হারিয়ে যাওয়ার পর পরই তুষারের মৃত্যু, পদ্মকে পাগল করে ফেলেছিল। কিন্তু মেজোবৌঠানকে মানুষ করতে পারেনি। তবে হ্যাঁ, আমাদের সুদিদি মানে সুব্রতাদিদি একটা আশ্চয্যি মেয়ে বটে। মুন্নুদিদির যত্নে, আদরেই তার পদ্ম এখনও বেঁচে আছে। নিজের সন্তানকে, নিজের জামাইকে, নিজের নাতি—নাতনিকে কেউ যদি এত অবহেলা, এত হতচ্ছেদা করতে পারে তা আমার চিন্তাভাবনার বাইরে। পদ্ম তার বাড়িতে আছে, তার মায়ের জোরে নয়, তার জেঠির, আর হয়তো খুড়োটিরও জোরে। বড়বৌঠান আর আমিই পদ্মর ভার নিয়েছি। মেজোবৌঠান যখন এ বাড়ি আসেন, ছেলের কাছে ওঠেন, সোম আর বরুণার কাছে। ও বেচারিদের তখন মহাসংকট উপস্থিত হয়। মেজোবৌঠানকে তুষ্ট রাখা তো সোজা কথা নয়? সুখের বিষয় ওরা তিনজনেই বেরিয়ে যায় যে যার কাজে, সারাদিন কেউ বাড়িতে থাকে না এই রক্ষে। দিনভর থাকি শুধু বড়বৌঠান আর আমিই—মেজোবৌঠানের দুই আদ্যিকালের সঙ্গী। আর থাকে পদ্ম। মেজোবৌয়ের মেয়ে। আমরা টের পাচ্ছি মেজোবৌঠান দিনকে দিন বদলে যাচ্ছেন। আগেকার মতো ওলড ফ্যাশানড কুটিলতা করেন না, এখনকার সময়োপযোগী কুটিলতা রপ্ত করেছেন—বরুণাকেও কষ্ট দিতে ছাড়েন না। অমন চুপচাপ, সাতচড়ে রা—না—কাটা বৌটাকেও শান্তি দেবেন না। বরুণাকে তুলনা করেছেন ললিতার সঙ্গে। ললিতা কত গোছানো, কত সংসারী। বরুণা বেচারী সরকারি চাকুরে—তার তো ললিতার মতো ঘরগেরস্থালী নিয়েই বসে থাকলে চলবে না? আবার ইদানীং দেখছি টেকসাস ঘুরে এসে জুডি—ই হয়েছে ওঁর শ্রেষ্ঠ বৌমা। কী কী দামি বস্তু তার আছে, আর কী কী দামি বস্তু সে তার শাশুড়িকে উপহার দিয়েছে, কোথায় কোথায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছে, তারই ফর্দ শুনতে শুনতে আমাদের প্রাণান্ত।
এ তো চলছিল দিব্যি, হঠাৎ কাগজে সেদিন ইমরানাকাণ্ড পড়েই মেজোবৌঠান কেমন খেপে গেলেন। বরুণাকে ডেকে হেসে হেসে বললেন—”বরুণা, খুব সাবধান। তোমার ঘরেও আইবুড়ো শ্বশুর রয়েছে কিন্তু! এ বাড়ির শ্বশুররাও খুব গোলমেলে বাছা—সর্বক্ষণ ছোঁক ছোঁক, সর্বক্ষণ তক্কে তক্কে থাকবে, সর্বক্ষণ ছুঁতো খুঁজছে, সংসারে শ্বশুর, ভাসুর, কেউ বাদ নেই—সব পুরুষমানুষের এক রা”—বরুণা বেচারি অ্যাদ্দিন ধরে শুনে আসছিল বড়বৌঠান আর আমার নিন্দেটাই—মেজোবৌঠানের ফেভারিট কেচ্ছা—এই একেবার নতুন দৃষ্টিকোণ তাকে এবার সত্যি সত্যি কাঁদিয়ে ছাড়লে। —”কী করে আপনি এমনধারা কুচ্ছিত কথা বলছেন মা? রাধামাধব যে একথা শুনলে মহাপাপ দেবেন? দেবতার মতো কাকুর নামে এমন কথাও কেউ ভাবতে পারে?”
মেজোবৌঠান হেসেই উড়িয়ে দিলেন। —”রাধামাধব? দূর দূর—রাধামাধব অমনধারা ঢের দেখেছে এ বাড়িতে—সে তো নিজেও পুরুষমানুষ রে! পুরুষ কখনো দেবতা হয়?”
বরুণা স্তম্ভিত হয়ে গেছে। কিন্তু আমি জানি। জানি মেজোবৌঠান কেন বলছেন ওকথা। অনেক দুঃখেই। একথা বলার পেছনে মেজোবৌঠানের কতটা দোষ, আর কতটা আমাদের বাবার—আমাদের বাবা শিবশংকর দত্ত চিরকাল বারমুখো মানুষ—ছেলেদের বিয়ে দিয়ে দুটি সুন্দরী কচি বৌ আনলেন ঘরে। আমাদের মা তখনও ভারী রূপসী। বাবা নিজেও সমর্থ পুরুষমানুষ। দুই বৌ প্রায় সমান বয়সী। সদ্য কিশোরী। মেজোর প্রতি বাবার গোড়া থেকেই নেকনজর লেগেছিল। বড়বৌটি গম্ভীর—শাশুড়ির সঙ্গে সঙ্গে রান্না—ভাঁড়ারে কাজকর্ম করতেন। আর মেজোবৌ রূপসচেতন। শুধু পান সাজতেন। আর সেজেগুজে মল ঝমঝমিয়ে হেসে হেসে বাড়িময় ঘুরতেন। বাবাকে আমরা ভয়ভক্তি করতুম বটে, কিন্তু ধারে কাছে ঘেঁষতুম না তাঁর, সেটি পেরেছিলেন একমাত্র মেজোবৌঠান। বাবার ছিল অনিদ্রা রোগ। দুপুরবেলায় বাবা একটু শুতেন। বাবার আদেশ ছিল, বাবা শুতে গেলে, দুপুরবেলায় মেজবৌমা যাবেন শ্বশুরের জন্যে পান সেজে নিয়ে। তারপরে তাঁর পা টিপে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আসবেন। ততক্ষণ বাবার ঘরে যাওয়ার, বাবাকে ডিস্টার্ব করায় কড়া নিষেধ ছিল। এসময়টা মা থাকতেন বড়বৌয়ের ঘরে, বাচ্চা নাতিটাকে ঘুম পাড়াতেন। ওর অন্নপ্রাশনের পরপরই দাদার মৃত্যু হল। বাড়ির আবহাওয়া পালটে গেল। বড়বৌমা এখন নিরলঙ্কারা সর্বশুক্লা দেবীমূর্তি। ধীরস্থির শান্ত। স্বয়ং ইন্দ্রও তাঁর পবিত্র মূর্তিকে স্পর্শ করতে ভয় পাবেন। আর শাঁখায়—সিঁদুরে ঝলমল করে, রঙিন ডুরে শাড়িতে, একগা গয়নায় সেজেগুজে আলতাপরা পায়ে মল—চুটকি বাজিয়ে, দুপুরবেলায় খাবার পরে বিশ্রামের সময়ে শ্বশুরমশাইয়ের পানটি দিতে যেতেন মেজোবৌমা। এ নিয়ে ভৃত্যমহলে গুঞ্জনও ছিল। সেকথাটা আমরা জানতুম, কিন্তু মেজদা জানতেন কিনা জানি না। কেনোদিনই তো বাধা দেননি। পর পর পাঁচটি সন্তানের জন্ম দিয়ে মেজদা—মেজোবৌঠান দত্তবংশের প্রতি পূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। আমি তো ফাঁকিবাজ। আর দাদা তো মাত্র একবার খেল দেখিয়ে নিজেই খতম হয়ে গেলেন। —মণি রইল, দত্তবংশের বড়ছেলে। মেজদার যখন মৃত্যু হয়, ততদিনে তাঁর রেস খেলে বাড়ির টাকাকড়ি সব উড়িয়ে দেওয়ার খবরটা বাবা জানতে পেরেছেন। বিষম ধাক্কা খেলেন খরবটায়। —তার ওপরে দুই জোয়ান ছেলের বিয়োগব্যথা সইতে পারলেন না বাবা। মা তো আগেই গত হয়েছেন। বাবাও এবার বিছানা নিলেন। ক্যানসার ধরা পড়ল গলাতে। অলরেডি মেটাস্টেসিস হয়ে সর্বাঙ্গে (ফুসফুসে, যকৃতেও) ছড়িয়েছে রোগ। বাবাকে বাঁচিয়ে তোলার আর প্রশ্ন নেই। উপায় ছিল না আর তার। শেষ বেলায় শুধু মেজবৌই নয়, বড়বৌয়েরও হাতের নিপুণ সেবা পেয়ে গিয়েছেন বাবা। মেজবৌকে যতই বিশেষ চোখে দেখুন, যাবার সময় দেহমনে বিধ্বস্ত বাবা সমান তিনভাগেই লিখে দিয়ে গেলেন তাঁর সম্পত্তি—বিধবা দুই বৌমার আর অবিবাহিত কনিষ্ঠ পুত্রের সমান অংশ রইল। কিন্তু এ ব্যবস্থা মেজোবৌয়ের পছন্দ হল না। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। ঐ উইলে প্রচুর অসাম্য আছে। ভ্রান্তিপূর্ণ এই উইল নিশ্চয় বাবার তৈরি করা নয়। বাবার উচিত ছিল সম্পত্তি সব চার নাতি, আর এক ছেলে—এই পাঁচ ভাগে ভাগ করা। বৌরা কী করবে সম্পত্তি নিয়ে? ছেলেদের কাছেই তো থাকবে। তিনটে সমান ভাগে কেন? এতেই সমদৃষ্টির অভাব হয়েছে—কেননা পাঁচভাগ চাই মেজর। তিন পুত্র, অথচ আমি অপুত্রক, বড়র একটিই মাত্র ছেলে। যথার্থ সুবিচার এই ভাগাভাগিতে হয়নি—শুনে বড়বৌ বললেন—”ঠিক কথাই বলছিস। কিন্তু তিন কেন? পৈতৃক সম্পত্তিতে তোর মেয়েদেরও তো ভাগ আছে মেজো? সুবিচারই যদি চাস, তবে সমান সমানই কর। তোর তো পাঁচটা সন্তান। আমার মোটে একটা। ঠাকুরপো একলাটি। বাড়ি সাতভাগেই সমান ভাগ করা উচিত। পাঁচ—এক—এক। আমার তাতে মত আছে। মিছিমিছি মেয়ে দুটো পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বাদ যাবে কেন?”—একথা ঠিকই যে, মেয়ে দুজনের কারুরই নিজস্ব ভূসম্পত্তি নেই। সেই শুরু হয়ে গেল গৃহবিবাদ। তিন—এক—এক ভার্সেস পাঁচ—এক—এক। মেজোর সঙ্গে মেজোরই দুই মেয়ের লিগাল রাইটস নিয়ে লেগে পড়লেন ওদের জেঠিমা। —ওদের ঠকানো চলবে না। মেয়ে সন্তান বলে কি ওরা সন্তান নয়? মেয়ে বলে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে ওদের বঞ্চিত করা হবে কেন? আমিও এ ব্যাপারে ওদের ফুল সাপোর্ট দিচ্ছি। বড়বৌদির সঙ্গে আমি সর্বদাই আছি। চোখ বুজে নিশ্চিন্দি হয়ে আছি। তাঁর আবাল্যোর মুগ্ধ ভক্ত। বৈধব্যের পর মা বড়বৌয়ের চুল কেটে ফেলতে দেননি মায়া করে। সেই মেঘবরণ কেশের মায়াতেই আমার দু’চোখ এখনও ছেয়ে আছে। যদিও বড়বৌয়ের চুল এখন কাঁচায় পাকায় মিশে গেছে,—আমার মতো দুগ্ধ—ধবল হয়ে যায়নি। আর মেজোবৌঠানের তো চিরকালই রূপচর্চায় নজর আছে, এখনও মালিশউলিটা আসে। মেজোবৌঠানের চুলটাকে ওই কবজায় রাখে—ওঁর চুলটিকে তো পাকতেই দেয়নি কোনোদিন।
এখন দীপু, মণি ওরা বিদেশ থেকে আমাদের নিত্যি কতো কি কসমেটিকস এনে দেয়। ক্রিম, পাউডার, লোশন, সাবান, চুল কালো করবার শ্যাম্পু। আমাদের এই পুরোনো বাড়িটাকে বিলিতি জিনিস দিয়ে মডার্ন করতে ওদের সকলেরই অদম্য উৎসাহ। এত জিনিসের মধ্যে আমার সবচেয়ে কাজে লাগে ওই ডিজিটাল প্রেশার মাপার যন্তরটা। আর সুগার মাপবার কিটটাও আছে,—আমি যদিও ব্যবহার করি না। সেবার ঠাকুরঘরের জন্যে ইলেকট্রিক দীপদান দিয়ে গেল মণির বউ। সলতে পাকাতে হয় না। পঞ্চপ্রদীপ জ্বলতে থাকে প্লাগটি লাগালেই। রাধামাধবের ঘরে সেটি জ্বালানো হচ্ছে। তুলসীতলায় সন্ধে দেওয়া হচ্ছে অবশ্যি তেলের প্রদীপ জ্বেলেই। —বড়বৌ বলেন—”শাঁখ বাজানোর টেপ চালিয়ে দিয়ে কি সন্ধে দেওয়া যায়?” তুলসীতলাটাও তো এবার ভেঙে যাবে। ওটাকেও অবিশ্যি ছাদে তুলে দেবে বলেছে, বাচাল প্রোমোটার। ছোকরার মুখেচোখে খই ফুটছে।
।। বিনি ।।
”বিনি, বিনি, কখন থেকে ডাকছি, হাত খালি হল?” সরমা কুটনো কুটতে বসেছেন। সামনে বড় একটা বারকোশ আর কাঁসার কানা—উঁচু থালা, একটা পেতলের গামলায় বেগুনী রঙের জল। বিলিতি ছেলেদের ব্যবস্থা। রান্নাঘরে অ্যকোয়াগার্ড লাগানো, কুটতে কুটতে জলে পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট গুলে নেওয়া। সবজির ঝুড়ি একধারে। আগে আগে পদ্মও বসতো বঁটি নিয়ে। ছুটির দিনে বরুণাও আসে। সরমা বরুণাকে আসতে দেন না এদিকে—তুই ওদিকটা দ্যাখ, অনেক কাজ আছে। হেঁশেলটা আমি পারবো। নিরিমিষ্যি রান্না আজও সরমার হাতে। মাছ—মাংস যেটা হয়, সেটা বরুণা রাঁধে। যোগাড় দেয় বিনি। বিনিরও বয়েস হয়েছে কম নয়—প্রায় গিন্নিদের কাছাকাছিই হবে—কাজে ঢুকেছিল যখন সেবছর প্রচণ্ড মন্বন্তর, বিনিরা কলকাতায় চলে এল ভাতের খোঁজে। ওর বাবা—মা রাস্তায় মারা গেল। একলা বারো—তেরো বছরের রোগা হাড়—জিরজিরে মেয়েটা রাস্তায় বসে বসে কাঁদছিল। ইন্দুমতী ওকে ঘরে নিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকেই বিনি আছে। ইন্দুমতী ওর বিয়েও দিয়েছিলেন প্রভাতের সঙ্গে। প্রভাত ছিল এদের মালী। বিনির দুটো ছেলে হয়েছিল। প্রভাত অনেক দিন মারা গেছে। ছেলে দুটোর একটা, যদু রেশন দোকানে সকালে কাজ করে। আরেকটা ছেলে, মধু, রবির আপিসে বেয়ারা। সে রবির ওখানেই থাকে। বিনির বড় ছেলেটা, যদু, এত বড় বাড়ির সব কিছুর ইন—চার্জ। যদুর বৌ মিনতি সংসারের কাজকর্ম সামলায়। বিমিমাসি বুড়ো হয়েছে, চশমা পরে। কোমর ভেঙেছে, ওপরে—নীচে বেশি ওঠানামা করতে পারে না। কিন্তু সরমার বিনিকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না। অন্যমনা পদ্মকেও যত্ন করে বিনিমাসি স্নান করতে পাঠায়, ভাত খেতে বসায়, পুজোর ঘরেও পাঠায়। ওই মন্বন্তরের সময়েই তো বৌ হয়ে এ বাড়িতে এসেছিলেন সরমা, ঠিক মন্বন্তরের আগেই। তখন যুদ্ধ চলছিল, বর্মায় বোমা পড়ছিল, জাপানিরা কলকাতাতেও বোমা ফেলেছিল—সরমা আর প্রভাবতী এক সঙ্গে বিয়ে হয়ে এসেছিলেন এ বাড়িতে, দু’এক বছরের ছোটবড় দুজনে—পিঠোপিঠি দুই ভাইয়ের বৌ হয়ে।
প্রথমে মণি এল সরমার কোলে।
তারপরে রবি প্রভাবতীর।
তারপরেই মণির বাবা হঠাৎ চলে গেলেন। মণির তখন সদ্য অন্নপ্রাশন হয়েছে—রবি আঁতুড়ে। ক’টা দিনই বা স্বামীর ঘর করতে পেরেছেন সরমা? শ্বশুরবাড়ির চাবিটি কিন্তু শাশুড়ি তুলে দিয়ে গেলেন তাঁরই হাতে। সেই থেকে তাঁর আর ছাড়ান নেই। এত বড় সংসারের চাকা ঘুরছে তো ঘুরছেই। বড় থেকে ক্রমশ ছোট হচ্ছে। প্রথমে রবি বিলেতে গেল ব্যারিস্টারি পড়তে। তারপর দীপ গেল ডাক্তারি পড়তে। মণি এরপরই দুবাই গেল ব্যবসা করতে। কেউই ফিরল না। দূর থেকে দূরে চলে গেল দীপ। ইংলন্ড থেকে আমেরিকায়। রবি ফিরল, কিন্তু বাড়ি—সংসার ক্রমে ছোট হয়েই চলল। পদ্মা—যমুনার বিয়ে হয়ে গেল—যমুনা শ্বশুরবাড়ি গেল। পদ্মার স্বামী তুষার আর্মিতে ডাক্তার ছিল। শ্বশুর—শাশুড়ি নেই বলে, আর সংসার না পেতে, পদ্মা বাপের বাড়িতেই থেকে গেল। স্বামী তো কলকাতায় থাকে না, সে তো তখন লাদাখে পোস্টেড। যমুনা একটা প্রাইভেট কলেজে পড়াচ্ছে, ওর বর অরণি খুব বড় অফিসার, একটা মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিতে কাজ করে। অরণি দেখতে ভালো, স্মার্ট, ভদ্র, কিন্তু হঠাৎই ছেলের একটা বাজে সম্পর্কের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে। বম্বের অফিসে জেনিফার বলে একটা মেয়ে কাজ করে। তারই সঙ্গে। যমুনা খুব বিচলিত। বিশেষ করে ওদের একমাত্র সন্তান শ্রীময়ীর জন্য। শ্রীময়ীর কথা ভাবলেই সরমার বুকের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগে। এত মিষ্টি, এত গুণী মেয়েটা—লেখাপড়ায় ভালো, অপূর্ব কত্থক নাচে—ভারি সুন্দর গানের গলাটিও। প্রেসিডেন্সি থেকে বি. এ. পাশ করে যাদবপুরে এম. এ. পড়ছিল। হঠাৎ একটা বিদঘুটে রোগ ধরল ওকে—নাম MS—মালটিপল স্ক্লেরোসিস, তাতে শরীরের যত নার্ভ, সব আস্তে আস্তে শুকিয়ে আসে। সব পেশিও অচল হয়ে পড়ে, শেষে রুগির অচলাবস্থা হয়—সেই ভয়ঙ্কর সর্বনেশে রোগই হয়েছে ঐ সুন্দর ফুলের মতো মেয়েটার।
শ্রীময়ী—যমুনা অরণি। ওরা একটি পরিবার। পদ্ম আর সুব্রতা। এরা আর একটি। পদ্ম—যমুনা দুজনে মেজোবাবুর দুই মেয়ে। পদ্মর একটি ছেলে হয়েছিল। নাম দেওয়া হয়েছিল সূর্যশংকর। এ বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে মিলিয়ে। ওর বাবা তুষারের নামের সঙ্গে মেলেনি বলে তুষার মাঝে মাঝে দুঃখু করত। এ বাড়ির প্রথম নাতি—আমাদের বড্ড আদরের ছিল সে। বারোক্লাস পাশ করে ছেলেটা একদিন হারিয়ে গেল। কোথাও তাকে খুঁজে পায়নি কেউ। পুলিশও না।—”কোনও সুস্থ সবল, নিরপরাধ পূর্ণবয়স্ক মানুষ যদি ইচ্ছে করে হারিয়ে যায়, তাকে ধরে আনা খুব কঠিন—” বলেছিল পুলিশ। পদ্ম তবু হাল ছাড়েনি। সূর্য কিন্তু সত্যিই আর ফেরেনি। ফিরবেও না। গত বছর তার খবর এসেছে।
সংসারটা গুটিয়ে যাচ্ছে।
ছোট হতে হতে কত্তোটুকুনি।
সোমু, বরুণা আর সুমন। দত্তবংশের এরাই শুধু এ বাড়িতে আছে, ছোটবাবু বাদে। সেই বা মন্দ কী? তিনপুরুষ তো বটে? তার কমে কি এত বড় বাড়িকে মানায়? পাঁচপুরুষ হলেই ঠিক হত।
সরমা কুটনো কুটতে কুটতে হিসেব করছেন।
ছোটবাবু। আর আমি। আর মেজো। একপুরুষ।
সোমু। বরুণা। পদ্ম। আর এক পুরুষ।
সুমন। সুব্রতা। তৃতীয় পুরুষ।
আমাদের মাথার ওপরে ছিলেন বাবা—মা। চার পুরুষ। আমি এতদূরই দেখেছি। তার ওপরের ওঁদের তো আমরা দেখিনি। জ্ঞাতিগুষ্টি খুব বেশি ছিল না বাড়িতে, বাড়ির তুলনায়—ছোটমাসি, আর ওদিকে মেজোর অকম্মা ভাইটা দিদির কাছে থাকত।
বিনি, প্রভাত। প্রভাত আর নেই অবিশ্যি। ওদের ছেলে দুটো, যদু—মধু। আর তাদের বৌ—বাচ্চারা। আমাদেরই সংসারের লোক তো তারাও। ফ্ল্যাট হলে ওদের কী হবে, সেটা ভাবতে হবে আমাদের। ওরাও তিনপুরুষ ধরেই এই রামধন মিত্তির লেনে। এখন তো রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি না!
মধু থাকে রবির বাড়িতে, কিন্তু বৌ—বাচ্চা এখানেই। ওদের মধুর কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। রবিকেই ব্যবস্থা করে দিতে হবে ওদের জন্যে। আর যদু তো আমাদের বাড়ির সর্বময় হর্তাকর্তা। ফ্ল্যাটই হোক আর তাঁবুই হোক, বিনি, যদুর বৌ মিনতি, আর মেয়ে পিংকিকে ঠাঁই দিতেই হবে—সেখানে। বিনি না হয় আমার ঘরেই শুল, তাই তো শোয়, আর যদু ছোটবাবুর দোরগোড়ায়। একটা ঘরেই দিব্যি চলবে ওদের। সার্ভেন্টস কোয়ার্টারও হচ্ছে শুনছি, আলাদা বেডরুম, কিচেন, বারান্দা সমেত। বারান্দায় রান্নার ব্যবস্থা। শুধু কমন বাথরুম থাকবে ওদের প্রত্যেক তলায় দুটো করে। মন্দ বন্দোবস্ত নয়। পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন রাখলেই হল। ফ্ল্যাট মানেই তো দশভূতের ঠাঁই—এক মালিকের মালিকানা থাকলে অন্য ব্যাপার হয়। রামধন মিত্তির লেনের বাড়িটা ছেলেরা আর ক’বছর পরে ভাঙলেই পারতো—আমরা আর ক’টা দিন?
।। সোমশংকর ।।
ওঃ, বাড়ি—বাড়ি করেই মাথা খারাপ হয়ে গেল দেখছি সকলের। যে বাড়ি নিয়ে জন্মে কখনও কোনো চিন্তাভাবনা করতে হয়নি কাউকেই, পাঁচপুরুষের ভিটে বাড়ি বেচতে বসে আজ সকলেরই বাহানা উঠেছে নানারকমের। আমি চাইনি ফ্ল্যাট, যেমন তেমন করে ভাড়াবাড়িতেই কেটে যেত জীবন আমার—সুমন তো চাকরি বাকরি করছে, আমরা দুজনেও রোজগার করি যথেষ্ট, ভাড়াবাড়িতেই থাকাই যেত। কিন্তু মা তো তিন ছেলেকে তিনটে ফ্ল্যাট দেবেই দেবে। তিনটে কোথা থেকে আসবে তার ঠিক নেই—প্রত্যেকে পাচ্ছে দুটো। পদ্মদিদিকে দেবে না। যমুনাকেও না। আমারটা আমি পদ্মদিদিকে দিতে চাইছি। সে বেচারি যাবে কোথায়? মুন্নুর বিয়ে—থা হয়ে যাবে, সে তার নিজস্ব সংসারে চলে যেতে বাধ্য হবে। কিন্ত মা দিতে দেবেন না। স্ট্রেঞ্জ উওম্যান। মামণি অবশ্যি বলছেন, মামণিরটা উনি দাদা আর পদ্মদিদি দুজনকেই ভাগ করে দেবেন। ছোটকাও বলছেন ওঁর ফ্ল্যাটটা উনি পদ্মা—যমুনা দুই বোনকে দিয়ে যাবেন, তারপরে সুব্রতা—শ্রীময়ী দুই বোন পাবে। আমাকে মাথা ঘামাতে বারণ করছেন দুজনেই। কিন্তু আমার আর সহ্য হচ্ছে না। সহোদর ভাইবোনেদের মধ্যে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ হয় সে একরকম। কিন্তু গর্ভধারিণী জননী যে পুত্র—কন্যা দু’জাতের সন্তানের মধ্যে এরকম তফাৎ করবেন সেটা ভাবা যায় না। আমাদের কাগজে দারুণ একটা ফিচার হতে পারে। যখন জয়েন্ট ফ্যামিলি ব্রেক আপ করে তখন কতরকমের পোকামাকড়—কীট—সরীসৃপ বেরিয়ে আসে রিলেশনসিপের মেঝে ফুটো করে। মার মুখে সর্বক্ষণ টেকসাসের গল্প শুনতে শুনতে রামধন মিত্তির লেন তো পাগল হয়ে উঠেছে—সেজদা অবশ্য যথাসাধ্য মনিটরিং করছে যখনই সামনাসামনি থাকছে। নইলে বলগাছাড়া হয়ে উঠছে মার ওয়াইলড ডেসক্রিপশন অফ দা প্যারাডাইস অন আর্থ কলড হুস্টন। এই রামধন মিত্তির লেনের বাড়িটাই তো প্যারাডাইস অন আর্থ হতে পারতো—একটুও যদি মা নরম্যাল বিইং হত, আর তুষারদা সুইসাইড না করত। আর সূয্যিটা—ওয়েল, সবই ফিরে যায় সেই মার দরজাতে। আর আই ডোন্ট লাইক ব্লেমিং পিপল। মাকে ডাক্তার দেখানো উচিত ছিল। শি নীডেড কাউন্সেলিং ব্যাডলি। তখন তো এসব ছিল না। এখন আছে। আছে বলে আমার তো সী—চেঞ্জ হয়েছে। আমি একটা আনবেয়ারেবল লাইফের মধ্যে চলে গিয়েছিলুম—মদ ছাড়া আর কিছুই ছিল না জীবনে—অ্যালকোহলিক শব্দটা শুনেছিলুম, তার ভয়াবহতা, তার বিনাশী শক্তি আমি নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি। কি ভাগ্যি বরুণার মতো বৌ জুটেছিল আমার। আর মামণি—ছোটকার মতো গার্জেন—গুরুজন। ওদের চেষ্টায় আজ আমি আবার মানুষের মতো বাঁচছি। নিজের কাজ করছি, সংসার করছি, অন্যের বিষয়ে চিন্তা করছি, নরম্যাল সোশ্যল বিইং—এর জীবনযাপন করতে পারছি। সুমন এসে পাশে বসে, বসে ওর কাজের গল্প করে আমার সঙ্গে। অথচ যতদিন কলেজে পড়েছে আমাকে ঠিক বিষবৎ অ্যাভয়েড করে চলত। কত ঘেন্না করত আমাকে ছেলেটা তখন? নেশাড়ু, পাঁড় মাতাল একটা লোককে বাপ বলে মানতে মন চায় কারুর! আমরাই তো বাবাকে শেষ দিকে মাঝে মাঝেই বেশ আউট দেখেছি। নো ওয়ান্ডার হি ওয়াজ ড্রিংকিং। রেস খেলে ফ্যামিলি রিসোর্সেস সব উড়িয়ে দিলে, সে ড্রিংক করবে না তো কী করবে? কিন্তু হোয়াই মি? আমি কেন খাচ্ছিলুম ওভাবে? আমার তো জীবনে কোনও অভাব রাখেননি ঈশ্বর। এত সুন্দর পরিবার ক’জনে পায়? সুব্রতার মতো মেয়ে। —হোক সে বোনঝি, আমাদের কোলেই বেড়েছে—আমাদের সকলেরই মেয়ে সে। —শ্রীময়ী মতো বোনঝি, ক’জনের ভাগ্যে জোটে। জিয়া—দিয়া মেয়ে দুটোও ভারি চমৎকার হয়েছে—মেজোবৌদির হাতে মানুষ তো? ছেলে হলে কেমন হত কে জানে? মেজদার পাল্লায় পড়ে যেতো তারা। রবি দত্তর জন্যেই অবশেষে এ বাড়ি এবার টুকরো হচ্ছে। ঘর ভাঙছে। বরুণা বলছে আমি নাকি ভীষণ সেন্টিমেন্টাল, এত ন্যাকামি ভাবের পুরুষ বলেই আমার অ্যালকেহলিজমের ফাঁদে পা পড়তে সময় লাগেনি। শক্তপোক্তরা মদ খায়, মদ তাদের খেয়ে ফেলে না। যাক, ঈশ্বরকৃপায় আমি তো মদ্যপানের আসক্তি থেকে মুক্তি পেয়েছি। এখন অফিসেরও পোজিশনটা অনেক বেটার হয়েছে। বাড়িতেও। মামণি আমাকে ডেকে নিয়ে একসঙ্গে বসে টিভি দেখেন। আগে আমি গিয়ে বসলে ওঁরা উঠে যেতেন। মদের দুর্গন্ধে ওঁদের গা গুলিয়ে উঠত। ঠাকুর্দার শুনেছি মদ—টদ চলতো। কিন্তু কাকুকে কদাচ দেখিনি। অথচ আর্টিস্ট মানুষ। মাঝরাত্তির অবধি রেওয়াজ করেন। আবার ভোরে উঠে রেওয়াজ। কিন্তু কদাচ ড্রিংক করতে দেখিনি তাঁকে। গাইয়ে—বাজিয়ে মানুষরা তো হামেশাই ড্রিংক—করিয়ে লোক হন। নইলে মেজাজই আসে না কত সময়ে। কাকুর জীবন ভীষণ নিয়মিত। ধ্যানধারণার জীবনযাপন করেন। যন্ত্র বাজানো তাঁর কাছে সাধনা। কাকু আর মামণি দুজনেই খুব স্পেশ্যাল মানুষ। জেঠুকে দেখিনি। আর বাবাকে শেষদিকে যা দেখেছি, তা খুব কমেন্ডেবল নয়। ঠাকুর্দার বিষয়ে নানা কথা কানে এসেছে—সব কথা বিশ্বাস করা উচিত কিনা জানি না। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় মামণিকে জিগ্যেস করি। মার কাছে তো সত্যি উত্তর মিলবে না। কিন্তু এ প্রশ্নের সত্যি উত্তর কি মামণির কাছেও মিলবে? অথচ নিজের জন্মকথা জানবার অধিকার তো সবারই আছে।
সেদিন পড়ছিলুম সম্প্রতি ”নিউ সায়েন্টিস্ট” কাগজে একটা রিপোর্ট বেরিয়েছে, বৈজ্ঞানিকরা একটা স্পেশ্যাল ‘জিন’ আইডেন্টিফাই করেছেন রক্তে, যা থেকে বংশ পরম্পরায় মানুষের মাতলামিতে আসক্তি হয়। ওই দ্যাখো! আমি তো এটা কবে থেকেই বলছি। ঠাকুর্দা মদ্যপ ছিলেন। পিতাঠাকুর মদ্যপ ছিলেন। ভাইদের মধ্যে অন্তত একজনও যদি সেই মহাজনদের ব্যবহৃত পন্থায় পদক্ষেপ না করে তো বংশের মুখে কালি পড়ে! অগত্যা আমি সেই ট্র্যাডিশন রক্ষার চেষ্টাটাই চালাচ্ছিলুম। তো, বরুণা সেটা অ্যালাউ করলে না। ” নেচার” ম্যাগাজিনের আর্টিকলটায় অবশ্য আঁবের নীল মাছিগুলোর ওপরে পরীক্ষার কথা লিখেছে। ঐ ‘জিনের’ জন্যে তারাও চট করে ‘মাতাল’ হয়ে পড়ে। মানুষের বেলায় ওটাই রূপ নেয় কোহল নির্ভরতায়। আমার যেমন হয়েছিল। আমার পিতা—ঠাকুরেরও যেমন। একটা ব্যাপারে মানুষ যে একটা মাছির চেয়েও দুর্বল, কে জানত? সবই ঐ ‘জিন’—টির দৌলতে! নীল মাছিদের Stress-response ও নাকি ওই জিন—টাই কন্ট্রোল করে—মানুষের বেলাতেও বোধহয় তাই—সেই কারণে Stress-এ পড়লে মানুষ মদের কাছে ছোটে। …বরুণা আমাকে ফিরিয়ে এনেছে। আমার মা বাবাকে ফেরাতে পারেননি। মা কি চেষ্টা করেছিলেন? অবশ্য তখন তো এসব ব্যবস্থাও ছিল না, AA-র মতন সংস্থা? দিদির দিকে তাকালে বুকের মধ্যেটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেতে থাকে। মার ওই প্রবল বাক্যশেল থেকে আমি তো কোনওভাবে রক্ষা করতে পারিনি। বাঁচাতে পারিনি সূয্যিকে, বাঁচাইনি তুষারকেও। নিজের স্ত্রী—পুত্র নিয়ে আমি শান্তিতে বসবাস করছি—তুষারদা পারল না।—দিদিটাও স্বামী—পুত্র—কন্যা নিয়ে ঘর করতেই পারত। কেবল মার অত্যাচারে সেটা হল না। অথচ মা কিন্তু ছেলে—বউ—নাতি—নাতনি সহকার হিল্লি দিল্লি বিলেত আমেরিকা করে দিব্যি আছে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে বিচার—বিবেচনা কীদৃশ আমি বুঝি না। মামণি একবারও দুবাইতে তার ছেলের সংসারে গেল না,—অথচ আমার মা দু’বার দাদার কাছে ঘুরে এল। গ্রেট লাইফ! নো জাস্টিস এনিহোয়্যার। —ইনসিডেন্টালি—একটা মেয়ে নাকি এসেছিল কাল এ বাড়িতে। ঢাকা থেকে এসেছে। কাকুর নাম করছে, দেখা করতে চায়। বাড়িতে খুব একসাইমেন্ট তাই নিয়ে। ঢাকা থেকে যুবতী কন্যা, জিনস—গেঞ্জি সুশোভিতা, প্রচণ্ড বাঙাল ভাষায় ইংরেজি মিশিয়ে বলেছে, মিস্টার দ্যাবশংকর দত্তরে মিট করার লেইগ্যা আইসি। সুমন তাকে দেখে বেশ ইমপ্রেসড—বলল, বেশ সুন্দরী, একটু এলোমেলো মতন। চুল নাকি মাথার ওপর কাগের বাসার মতো করে তুলে রাখা। মনে হল, ওর দাদুভাই যদি অগ্রিম ক্লেইম পেশ না করেন, তাহলে তাঁর নাতি গুটি গুটি এগোবে ওর দিকে। বাড়িতে দারুণ উত্তেজনা চলেছে—মেয়েটাকে নিয়ে। কে সে! কেন এসেছে? বলেছে নাকি আজ আবার আসবে—কিন্তু ঠিক ওই সময়েই আমার আজ ডিউটি পড়েছে প্রেস ক্লাবে—একটা বাজে বই ওপেন করবেন মুখ্যমন্ত্রী। কেন যে করছেন? কভার করতে যেতেই হবে। মুন্নুটা যদি আমার মাকেও এখনও নিমহ্যান্সে ভর্তি করতে পারতো, সংসারে অনেক সুরাহা হত—বলছে তো দিদিকে ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে যাবে ওর সঙ্গে। হাসপাতালে দেবে। শি ডাজ নীড হেলপ। বাট সো ডাজ মাই মাদার। শি ইজ ডিপলি ডিস্টার্বড। নইলে এমনভাবে কেউ নিজের মেয়েদের সঙ্গে শত্রুতা করে? দুঃখী মেয়েটাকে আরো দুঃখী বানিয়ে দেয়? আমি কাউন্সেলিং করিয়ে, তার মূল্য বুঝেছি।
Good