রানি হাটশেপসুটের মমি – ৯

আমরা উঠে এলাম বিরাট এক পাথুরে চত্বরে৷ তারপর বেশ কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে৷ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রানি হাটশেপসুটের বিশাল মরচুয়ারি মন্দির৷ তার একতলা ও দোতলার বিরাট বিরাট পাথরের স্তম্ভগুলো কিছুটা ক্ষয়ে গেলেও এখনও প্রাচীন মিশরীয় শিল্পরীতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে৷ জনহীন রুক্ষ প্রান্তরে সে একাকী দাঁড়িয়ে আছে আপন গাম্ভীর্য নিয়ে৷ সেই কোন সুদূর অতীত সভ্যতার বিকাশ যখন সবে শুরু হয়েছে, তখন রানি হাটশেপসুট তৈরি করেছিলেন এই মন্দির৷ তারপর অনেক রাজবংশের উত্থানপতন হয়েছে, নীলনদ দিয়ে বয়ে গিয়েছে অনেক জল৷ সেসব কিছুর সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে এই মন্দির৷ হয়তো হাজার বছর পরেও দাঁড়িয়ে থাকবে, স্মরণ করাবে রানি হাটশেপসুটকে৷

আমরা উপরে ওঠার পর আমাদের দেখে ঢিলে পোশাকপরা কয়েকজন লোক ছুটে এল৷ বুঝতে পারলাম, তারা নিশ্চয়ই গাইড৷ তারা কাছে আসতেই ডা. নাসের আরবি ভাষায় কী যেন বললেন৷ তা শুনে লোকগুলো বিমর্ষভাবে ফিরে গেল৷ ডা. নাসের বললেন, ‘যেসব মিশর গবেষকরা এসব জায়গায় কাজ করতে আসেন তাঁদের কিন্তু এইসব গাইড একদম পছন্দ করে না৷ কারণ, অধিকাংশ সময়েই এরা সাধারণ পর্যটকদের ভুলেভরা অথবা মনগড়া তথ্য পরিবেশন করে৷ কিন্তু গবেষকরা সবসময় তথ্যপ্রমাণ খোঁজার চেষ্টা করেন৷ যুক্তি দিয়ে সব কিছু বিশ্লেষণ করেন৷ তাই আমি গবেষক পরিচয় দিতে ওরা বেজার মুখে চলে গেল৷ তা ছাড়া নতুন কোনো খননকার্য চলার সময় সেই অঞ্চলে সাধারণ মানুষের বা পর্যটকদের ঢোকা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়৷ তাতে অনেক সময় পেটে টান পড়ে গাইডদের ৷ গবেষক বা পুরাতত্ত্ববিদদের তারা এইজন্যেও অপছন্দ করে৷ ভাবে, এই বুঝি তারা এসে আবার খোঁড়াখুড়ি শুরু করল৷’

ডা. নাসের মনে হয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু তার আগেই কানে এল, ‘হাই ডা. নাসের!’

তাকিয়ে দেখলাম, ড. হান্স এগিয়ে আসছেন আমাদের দিকে৷ কাল হোটেলে তাঁকে দেখেছিলাম কোট-প্যান্টে, কিন্তু আজ তাঁর একেবারে অন্য পোশাক! পরনে খাকি রঙের শার্ট-প্যান্ট, কোমরে চওড়া বেল্ট, হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঢাকা জুতো, মাথায় শোলার টুপি৷ কাছে এসে তিনি টুপি খুলে আমাদের তিন জনের সঙ্গে করমর্দন করলেন৷ তারপর অংশুর দিকে টুপিটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখানে প্রচণ্ড রোদ, এটা তুমি নাও৷’

সেটা নেওয়া উচিত হবে কি না তা বুঝতে না পেরে অংশু তাকাল আমার দিকে৷ তাকে ইতস্তত করতে দেখে ডা. হান্স এবার টুপিটা নিজেই তার মাথায় পরিয়ে দিলেন৷ তারপর আমাদের উদ্দেশে বললেন, ‘চলুন, আগে একটু বিশ্রাম নিন৷ মরচুয়ারি দেখার জন্য তো সারাদিন রয়েছে৷ তা ছাড়া আমার কাজের জায়গাটাও তার আগে আমি আপনাদের দেখাব৷’

আমরা চত্বর পেরিয়ে মরচুয়ারি মন্দিরের গা ঘেঁষে তাঁর পিছুপিছু চলতে শুরু করলাম৷ চারপাশে ছড়িয়ে আছে নানাধরনের শিল্পকলা, বিশেষত নানাধরনের প্রাচীন মিশরীয় দেবদেবীর মূর্তি আর ফ্যারাওদের মূর্তি৷ যদিও তার মধ্যে বেশ কিছু মূর্তি আজ আর অক্ষত অবস্থায় নেই৷ তবে মরচুয়ারির দেওয়ালের গায়ে সার সার ফ্যারাওদের মূর্তিগুলো কিন্তু অক্ষত অবস্থায় আছে৷ ডা. নাসের আমাকে ওই ফ্যারাও মূর্তিগুলো দেখিয়ে বললেন যে, সেগুলো আসলে রানি হাটশেপসুটের মূর্তি৷

মন্দির বাঁ-পাশে রেখে চক্রাকার পথে চলতে চলতে আমরা এসে হাজির হলাম মন্দিরের পিছন দিকে৷ তারপর আবার ঢাল বেয়ে নীচের দিকে নামতে শুরু করলাম৷ যে পথ বেয়ে আমরা নীচের দিকে নামছি, তার পাশে প্রায় ভাঙা একটা পাথরের উঁচু প্রাচীর আছে৷ তাই রোদটা সরাসরি গায়ে লাগছিল না৷ বেশ একটা ছায়া ছায়া ভাব জায়গাটায়৷ প্রায় দেড়শো ফুট নীচে নামার পর আমরা এসে দাঁড়ালাম মরচুয়ারি মন্দিরের ঠিক নীচে পাহাড়ের ঢালে, কিছুটা সমতল জায়গায়৷ আরও অনেকটা নীচে একটা চওড়া জায়গায় চোখে পড়ল সার সার তাঁবু৷ বুঝতে পারলাম, ওখানেই রাতে থাকব আমরা৷ যেখানে আমরা এসে দাঁড়ালাম, সে জায়গায় কোদাল-বেলচার শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ তার ঠিক সামনেই পাহাড়ের ঢালে একটা সুড়ঙ্গে ঢোকার পথ৷ জনা কুড়ি লোক কাজ করছে সেখানে৷ জায়গাটার চারপাশে ছোটো ছোটো পাথরের টুকরো রাখা আছে৷ সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে মাথায় ঝুড়ি করে পাথরের টুকরো বাইরে এনে ফেলছে শ্রমিকের দল৷ সুড়ঙ্গে ঢোকার পথের একটু দূরে কীভাবে যেন গোটা তিনেক খেজুর গাছ জন্মেছে৷ অনেকক্ষণ পর এই শুষ্ক মরুময় পাথুরে অঞ্চলে গাছগুলো দেখে ভারি ভালো লাগল৷ গাছগুলোর নীচে একটা বড়ো তাঁবু খাটানো আছে৷ তার নীচে বসে আছে দু-জন শ্বেতাঙ্গ ও এক জন বিশালদেহী আফ্রিকান৷ তার কাঁধে একটা রাইফেল৷ আমাদের দেখতে পেয়েই তারা উঠে দাঁড়াল৷

ড. হান্স সুড়ঙ্গের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘ওটা আমিই আবিষ্কার করেছি৷ এখনও শেষ পর্যন্ত পৌঁছোতে পারিনি, ভিতরে কাজ চলছে৷ কিছুক্ষণ পর আমি আপনাদের ওর ভিতরে নিয়ে যাব৷’

সুড়ঙ্গের কাছ দিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম তাঁবুর সামনে৷ ড. হান্স তিন জনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ শ্বেতাঙ্গ দু-জনের নাম কার্ল এবং পাউল৷ ড. হান্সের এই দু-জন সহকারীও জার্মান৷ আর কৃষ্ণাঙ্গ লোকটির নাম ঘালি৷ আসলে সে কেনিয়ার লোক৷ কিন্তু বছর কুড়ি ধরে সে মিশরে আছে৷ এখানকার এক সিকিউরিটি এজেন্সিতে চাকরি করে৷ কাজের তাগিদে পর্যটক বা গবেষকদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় সে৷ ড. হান্সের মুখে শুনলাম, তাঁর আর একজন জার্মান সঙ্গী আছে, নাম হাইমুট৷ সে সুড়ঙ্গের ভিতর খননকার্যের তদারকি করছে৷ তাঁবুর নীচে একটা ক্যাম্পখাট পাতা৷ তার উপর বসলাম আমরা৷ তাঁবুর এক কোনায় বেশ কিছু জিনিসপত্র রাখা৷ আমরা তাঁবুতে বসবার পর ডা. হান্সের সহকারী কার্ল সেখান থেকে কফির পাত্র এনে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন৷ আর তার সঙ্গে দিলেন রুটির মতো দেখতে একধরনের খাবার৷ মুখে দিয়ে দেখলাম, খাবারটা বেশ সুস্বাদু৷ অংশু কফি খেল না৷ কিন্তু মনে হয় খিদে পেয়েছিল৷ কারণ, পাত্রে রাখা বাড়তি রুটিটা সে হাতে তুলে নিল৷ সেটা খাবার পর আমার কাছ থেকে জলের বোতল নিয়ে ঢকঢক করে বেশ অনেকটা জল খেল৷

ড. হান্স বললেন, ‘আশা করি এ অঞ্চলে রাত কাটাতে আপনাদের খুব একটা মন্দ লাগবে না৷ এখানে দিনের বেলা খুব গরম, কিন্তু সূর্য ডোবার পরেই ঠান্ডা নামতে শুরু করে৷ তখন খুব আরাম৷’

ডা. নাসের বললেন, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা আমি জানি৷ একসময় আমি এ অঞ্চলে অনেক রাত কাটিয়েছি৷ তখন অবশ্য আমার মাথায় এত বড়ো টাক ছিল না৷’

তাঁর কথা শুনে ড. হান্স সহ আমরা সকলে হেসে উঠলাম৷ ড. হান্স এরপর ডা. নাসেরের উদ্দেশে বললেন, ‘আপনি এখানে আসায় আমি হয়তো উপকৃত হব৷ কারণ, আমি জানি আমার চেয়ে আপনার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অনেক বেশি৷’

ডা. নাসের তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনাকে সাহায্য করতে পারলে আমি নিশ্চয়ই খুশি হব৷ তবে আমি কিন্তু পণ্ডিত নই৷ আপনার মতো এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও আমার নেই৷ আমার পেশা ডাক্তারি৷ মিশরের ইতিহাস ছেলেবেলা থেকেই আমাকে আকর্ষণ করে৷ তাই সময় সুযোগ পেলে এ ব্যাপারে একটু জানার চেষ্টা করি মাত্র৷ তার চেয়ে বেশি কিছু নয়৷’

অংশু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল খানিক দূরে একটা পাথরের কাছে৷

ডা. ঘটক এতক্ষণ আমার মতোই চুপচাপ বসে ড. হান্স আর ডা. নাসেরের কথাবার্তা শুনছিলেন৷ এবার তিনি ড. হান্সের উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি এখানে কীসের অনুসন্ধান করছেন? কোনো ফ্যারাওয়ের মমির?’

ড. হান্স বললেন, ‘না৷ ফ্যারাওদের সমাধি দেওয়া হত ওই দূরের ভ্যালি অফ কিংসে৷ আমি অনুসন্ধান করছি অন্য এক মমির৷ সে কোনো ফ্যারাও বা ক্ষমতাবান লোক ছিল না৷ কিন্তু নিয়তি তাকে জড়িয়ে দিয়েছিল রানির মরচুয়ারি মন্দিরের সঙ্গে৷ যদিও তার ব্যাপারটা আদপে সত্যি না-ও হতে পারে৷ কারণ, খুব সামান্য সূত্র ধরে আমি কাজ শুরু করেছি৷ জানি না শেষ পর্যন্ত আমি সফল হতে পারব কি না!’

ডা. নাসের তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘কার্টারও কিন্তু খুব সামান্য সূত্রের উপর ভিত্তি করে খুঁজে বের করেছিলেন তুতানখামেনের সমাধি৷ এরকম আরও অনেক উদাহরণ আমার জানা আছে৷ আশা করি আপনিও সফল হবেন৷ কিন্তু আপনি কার সমাধি খুঁজছেন?’

ড. হান্স উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই একটা আর্ত চিৎকার আমাদের কানে এল৷ চমকে আমরা তাকালাম সেই পাথরটার দিকে, যার দিকে গিয়েছে অংশু৷ ডা. ঘটকের ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিল ঘালি৷ চিৎকার শোনামাত্র সে বিদ্যুৎগতিতে ছুটল পাথরটার দিকে৷ আর তার পিছনে ছুটলাম আমরা সকলে৷ পাথরটা বেশ বড়ো৷ তার পিছনে গিয়ে দেখি, অংশু মাটির উপর পড়ে আছে৷ তার শরীর থরথর করে কাঁপছে, চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে৷ ঘালি তাকে মাটির উপর থেকে সঙ্গেসঙ্গে কোলে তুলে নিল৷ যেখানে অংশু পড়ে ছিল, সে জায়গাটা ছোটো ছোটো পাথরে ভরতি৷ তার হাত পঁচিশেক দূরে রয়েছে একটা গভীর খাদ৷ কোনো লোকজন নেই সেখানে৷

ডা. ঘটক অংশুকে দেখে বললেন, ‘মনে হচ্ছে হঠাৎ ও ভয় পেয়েছে কোনো কারণে৷’

ডা. নাসেরও একই মত জানালেন৷ কাঁধে ঝোলানো জলের বোতল থেকে জল নিয়ে তিনি ছেটাতে লাগলেন অংশুর মুখে৷ কয়েক মিনিটের মধ্যে সে ধীরে ধীরে কিছুটা স্বাভাবিক হল৷ যদিও তার মুখে-চোখে তখনও ভয়ের রেশ লেগে আছে৷ ঘালির কোল থেকে নীচে নেমে দাঁড়াল সে, তারপর ডা. ঘটকের কোমর জড়িয়ে ধরল৷ ডা. ঘটক সস্নেহে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘অংশু, তুমি কি ভয় পেয়েছ?’

অংশু মাথা নেড়ে জানাল, ‘হ্যাঁ৷’

ডা. ঘটক বললেন, ‘তোমার কোনো ভয় নেই, আমরা সকলেই তো তোমার সঙ্গে আছি৷ কিন্তু কেন ভয় পেলে তুমি?’

অংশু এবার ভয় ভয় চোখে আঙুল তুলে একটা জায়গা দেখিয়ে দিল৷ জায়গাটা একদম খাদের ধারে৷ ফণিমনসা জাতীয় গাছের একটা বড়ো ঝোপ রয়েছে সেখানে৷ দেখলাম, তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আছে একটা আনুবিসের মাথা৷ বুঝতে পারলাম, ওটা হঠাৎ দেখে ভয় পেয়েছে অংশু৷ আনুবিসের মাথাটা কুচকুচে কালো, মনে হয় শ্লেট পাথরে তৈরি৷ অন্য সকলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন৷ ডা. নাসের অংশুর উদ্দেশে বললেন, ‘ওটা তো একটা মূর্তি! কায়রো মিউজিয়ামে আগেও তুমি ওই মূর্তি দেখেছ, কার্নাক মন্দিরেও হয়তো দেখেছ৷ তাহলে ভয় পেলে কেন?’

অংশু আবার বিড়বিড় করে বাংলায় বলল, ‘ওটা নড়ছিল, আমি চিনতে পেরেছি ওকে৷’

সে কী বলল বুঝতে না পেরে ডা. নাসের আমার দিকে তাকালেন৷ আমি তাঁকে বললাম অংশু কী বলল৷ তিনি এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন মূর্তিটার দিকে৷ তারপর মূর্তির মাথায় হাত রেখে চিৎকার করে অংশুর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘এই দেখো, আমি ওর মাথায় হাত রাখলাম৷ এটা একটা পাথরের মূর্তি৷ তুমি কাছে এসে দেখে যাও৷’

অংশু কিন্তু গেল না৷ আমি শুনতে পেলাম সে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি ঠিক চিনতে পেরেছি ওকে৷ কাল রাতেও আমি ওকে ঘুমের মধ্যে দেখেছি৷’

অংশুর কথাটা মনে হয় ডা. ঘটকেরও কানে গেল৷ তিনি আমার দিকে তাকালেন৷ আমার মনে পড়ে গেল কায়রোর প্যাপাইরাসের দোকানে আনুবিসের ফোটো দেখেও একই কথা বলেছিল অংশু৷ আর বুঝতে পারলাম, এত ঘন ঘন যখন সে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে, তখন তার সেই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটতে আর বেশি দেরি নেই৷ হয়তো আজ বা কালই সেটা ঘটবে৷

অংশু মূর্তিটার কাছে না যাওয়ায় ডা. নাসের ফিরে এলেন আমাদের কাছে৷ আমরা তাঁবুতে গিয়ে মিনিট দশেক বসলাম৷ অংশু আরও কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর ডা. হান্স একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘এবার আপনাদের যদি অসুবিধে না হয় তাহলে সুড়ঙ্গের ভিতরটা দেখিয়ে আনতে পারি৷ তবে ভিতরে অক্সিজেনের পরিমাণ একটু কম, ছোটো ছেলেটির একটু কষ্ট হতে পারে৷’

তাঁর কথা শুনে ডা. ঘটক বললেন, ‘অংশুকে এই মুহূর্তে ভিতরে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না৷ ও আবার কোনো কারণে ভয় পেলে বিপত্তি ঘটতে পারে৷ আপনি বরং ডা. নাসের আর আমার তরুণ বন্ধুকে নিয়ে ভিতরে যান৷ আমি অংশুকে নিয়ে এখানেই বসি৷’

ডা. ঘটক ও অংশুকে রেখে সুড়ঙ্গের ভিতরে যেতে ইচ্ছে না করলেও শেষ পর্যন্ত ডা. নাসেরের অনুরোধে ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে আমিও তাঁর পিছনে পা বাড়ালাম৷

প্রথমে ড. হান্স তারপর ডা. নাসের ও সবশেষে আমি, এইভাবে আমরা ঢুকলাম সুড়ঙ্গের ভিতর৷ অন্যরা তাঁবুতেই রয়ে গেলেন৷ সুড়ঙ্গের ভিতর দু-জনে পাশাপাশি হাঁটা যায়৷ হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় মাথার উপর মসৃণ ছাদ৷ সুড়ঙ্গ প্রথমে ঢালু হয়ে তারপর আবার উপর দিকে উঠেছে৷ দেওয়ালের গায়ে মাঝে মাঝে আলো বসিয়ে অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করা হয়েছে৷ আলোগুলো হয়তো ব্যাটারি দিয়ে জ্বালানো হয়৷ বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর আমরা এসে দাঁড়ালাম একটা হলঘরে৷ তার সারা দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে আছে নানাধরনের ছবি৷ সে ঘর থেকে আবার বেশ কয়েকটা সুড়ঙ্গ নানাদিকে বেরিয়ে গিয়েছে৷ তারই একটা ধরে আরও কিছুক্ষণ উপর দিকে এগোবার পর আমরা হাজির হলাম আর একটা হলঘরে৷ ঘরটা সার্চলাইটের আলোয় আলোকিত৷ ঘরের এক কোনায় একটা পাথরের দেওয়ালের উপর গাঁইতি চালাচ্ছে শ্রমিকের দল৷ পাথরের উপর লোহার ফলকের আঘাতে আগুনের ফুলকি ছিটকে বেরোচ্ছে৷ একজন শ্বেতাঙ্গ তাদের কাজের তদারকি করছিলেন৷ আমাদের দেখতে পেয়ে তিনি সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ ড. হান্স তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন৷ তিনি ড. হান্সের সহযোগী, নাম হাইমুট৷ এ ঘরের দেওয়ালও নানাধরনের চিত্রলিপিতে সাজানো৷

ড. হান্স বললেন, ‘আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, বলা যেতে পারে এটা হাটশেপসুটের মরচুয়ারি মন্দিরের ঠিক নীচে অবস্থিত৷’

ডা. নাসের এতক্ষণ চুপ করেছিলেন৷ তিনি এবার প্রশ্ন করলেন, ‘ড. হান্স, এই সুড়ঙ্গের সন্ধান আপনি পেলেন কীভাবে?’

হান্স বললেন, ‘ফ্রান্সের লুভর মিউজিয়ামে রাখা এক শিলালিপি থেকে৷’

ডা. নাসের আবার প্রশ্ন করলেন, ‘কী লেখা আছে তাতে?’

‘লেখা আছে এক হতভাগ্য বালকের কথা, হাটশেপসুটের মন্দিরের নীচে যাকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল৷’

আমার মনে হল, তাঁর কথা শুনে ডা. নাসের যেন একটু চমকে উঠলেন৷ তিনি যেন আর একটা কী প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ড. হান্স চাপা স্বরে বললেন, ‘এ ব্যাপারে আর এখানে আলোচনা করা ঠিক হবে না৷ যেসব শ্রমিক এখানে কাজ করছে এরা ইংরেজি বোঝে৷ অনেক সময় এরা সমাধি-চোরদের কাছে পয়সার লোভে খবর পৌঁছে দেয়৷ সমাধিতে পৌঁছে দেখা যায় গবেষকদের আগেই সেখানে হানা দিয়ে সব কিছু নিয়ে গিয়েছে চোরের দল৷’

তাঁর কথা শুনে আর কোনো প্রশ্ন করলেন না ডা. নাসের৷ তিনি এর পর ঘরের দেওয়ালে আঁকা ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলেন৷ দেখতে দেখতে একটা জায়গায় বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়ালেন তিনি৷ খুব মনোযোগ দিয়ে চেয়ে রইলেন মাটি থেকে একটু উপরে আঁকা একটা ছবির দিকে৷ তারপর ড. হান্সের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘সম্ভবত ঠিক পথেই চলেছেন আপনি! শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা যাবে আমি আর আপনি একই জিনিস খুঁজতে এখানে এসেছি৷’

ড. হান্স তাঁর কথাটা বুঝতে না পেরে ডা. নাসেরের মুখের দিকে তাকালেন৷ ডা. নাসের কিন্তু আর কোনো কথা বললেন না৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা সেখান থেকে বাইরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালাম৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *