রানি হাটশেপসুটের মমি – ৮

ভোর ছ-টার মধ্যেই ঘুম থেকে উঠে পড়লাম আমরা৷ স্নান সেরে, ব্রেকফাস্ট খেয়ে যখন আমরা হোটেলের বাইরে পা রাখলাম, তখন ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় সাতটা বাজে৷ সঙ্গে দুটো ছোটো ব্যাগে হালকা কিছু জিনিসপত্র নিয়েছি৷ কারণ, রাতে আর হোটেলে ফিরব না আমরা৷ কার্নাক মন্দির থেকে হোটেলে ফিরে আসার পর আমাদের সঙ্গে ডা. হান্সের পরিচয় হয়েছে৷ হান্স হলেন সেই জার্মান প্রত্নবিদ, যাঁর নেতৃত্বে হাটশেপসুটের মরচুয়ারির কাছে খননকার্য চলছে৷ তাঁকে না দেখার আগে আমার ধারণা ছিল, তিনি মনে হয় প্রবীণ মানুষ হবেন৷ কিন্তু দেখলাম, তিনি একজন বছর তিরিশের তরতাজা যুবক৷ চেহারাটাও খুব সুন্দর৷ দীর্ঘ শরীরে কোথাও একফোঁটা বাড়তি মেদ নেই৷ মাথায় একরাশ সোনালি রঙের ঝাঁকড়া চুল, নীল রঙের উজ্জ্বল চোখ, নাক-মুখ সব কিছুই যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা৷ কথাবার্তাতেও বেশ একটা সপ্রতিভ ভাব আছে৷ তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়ে আমাদের সকলেরই বেশ ভালো লেগেছে৷ হান্স মাঝে মাঝে রাতে থেকে যান মরচুয়ারির কাছে ফেলা তাঁবুতে৷ খননকার্যের শ্রমিকরা ওখানেই থাকে৷ আগামীকাল পূর্ণিমা, জ্যোৎস্নার আলোয় নাকি আশ্চর্য সুন্দর লাগে সেই রহস্যময় উপত্যকা৷ তাই তাঁরই আমন্ত্রণে আমরা দুটো রাত কাটাতে চলেছি সেখানে৷ তিনি অবশ্য আরও ভোরে সেদিকে রওনা হয়ে গিয়েছেন৷ ওখানেই তাঁর সঙ্গে আমাদের আবার দেখা হওয়ার কথা৷

হোটেলের বাইরে মিনিট দশেক আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হল গাড়ির জন্য৷ গাড়ি আসার পর ড্রাইভার জানাল, তার নাকি টায়ার পাংচার হয়ে গিয়েছিল৷ তাই আসতে দেরি হল৷ যাই হোক, আমরা চেপে বসলাম গাড়িতে৷ আমাদের গন্তব্য নীলনদের পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চল৷ গাড়ি শহর ছাড়িয়ে নীলনদের ব্রিজ পেরিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়ল এক অজানা প্রান্তরে৷ তার বুক চিরে চলেছে মসৃণ কালো রাস্তা৷ সবেমাত্র আটটা বাজে৷ কিন্তু এর মধ্যেই রোদের তেজ বাড়তে শুরু করেছে৷ বেশ গরম লাগছে৷ অনেক দূরে আকাশের কোলে একটা কালো রেখা৷

ডা. নাসের বললেন, আমরা নাকি যাচ্ছি ওখানেই৷ কালো রেখাটা আসলে পাহাড়শ্রেণি৷ ওই পাহাড়ি উপত্যকাতেই শায়িত আছেন প্রাচীন মিশরের ফ্যারাও এবং তাঁদের রানিরা৷ আর তার কাছেই রয়েছেন রানি হাটশেপসুটের মরচুয়ারি মন্দির৷

আমি ডা. নাসেরকে রানি হাটশেপসুটের সম্বন্ধে বলতে অনুরোধ করলাম৷ তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে বেশ কয়েকজন রানির নাম শোনা যায়, যাঁরা বিভিন্ন কারণে বিখ্যাত৷ তাঁদের মধ্যে নেফারতিতি ও ক্লিওপেট্রার নাম প্রায় সকলেই জানে৷ গল্প-কাহিনির দৌলতে তাঁদের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে৷ রানি নেফারতিতি বা রানি ক্লিওপেট্রা বিখ্যাত ছিলেন তাঁদের অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য৷ রানি হাটশেপসুট কিন্তু মিশরের ইতিহাসে বিখ্যাত অন্য কারণে৷ হাটশেপসুটই একমাত্র রানি, যিনি একটানা প্রায় পঁচিশ বছর ফ্যারাও হিসেবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মিশরের শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন৷

‘বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মহিলাকে মিশরের সিংহাসনে বসতে হয়েছে, সাধারণত তাঁদের সিংহাসনে বসতে হয়েছিল নানা সংকটের কারণে৷ যেমন, হঠাৎ ফ্যারাওয়ের মৃত্যু বা তাঁর উত্তরাধিকারী না থাকা ইত্যাদি৷ কিন্তু তাঁদের মধ্যে কেউই হাটশেপসুটের মতো স্থায়ীভাবে ফ্যারাওয়ের সিংহাসনে নিজের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি৷ কয়েক বছর আনুষ্ঠানিকভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করার পর তাঁদের দায়িত্ব তুলে দিতে হয়েছে অন্যের হাতে৷ তাঁরা শাসনকার্য পরিচালনা করলেও কেউই কিন্তু নিজেদের ফ্যারাও হিসেবে ঘোষণা করেননি৷ তাঁরা মূলত রানি হিসেবেই থেকে গিয়েছিলেন৷ ব্যতিক্রম শুধু হাটশেপসুট, যিনি নিজেকে ফ্যারাও হিসেবে ঘোষণা করেন এবং দক্ষতার সঙ্গে আমৃত্যু শাসনকার্য পরিচালনা করেন৷

‘মিশরের প্রথম মহিলাশাসকের নাম সেবেকনেফ্রু৷ তিনি ছিলেন ফ্যারাও চতুর্থ আমনক্রমহেটের স্ত্রী৷ তাঁর মৃত্যুর পর ১৭৮৭ থেকে ১৭৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ মাত্র চার বছর রানি হিসেবে মিশরের শাসনকার্য পরিচালনা করেন৷ তবে তিনি মূলত পুরোহিতদের নির্দেশেই শাসনকার্য পরিচালনা করতেন৷ হাটশেপসুট ছিলেন ফ্যারাও প্রথম টুথমোসিসের মেয়ে৷ একথা আমি আপনাদের আগে বলেছি৷ সেকালের প্রথা অনুযায়ী হাটশেপসুটের বিয়ে হয় তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই প্রথম টুথমোসিসের ছেলে দ্বিতীয় টুথমোসিসের সঙ্গে৷ প্রথম টুথমোসিসের মৃত্যুর পর ফ্যারাও হন দ্বিতীয় টুথমোসিস, আর প্রধান রানি হন হাটশেপসুট৷ ১৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যখন দ্বিতীয় টুথমোসিসের মৃত্যু হয়, তখন তাঁর আর এক রানির সন্তান, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী তৃতীয় টুথমোসিস ছিলেন শিশু৷ হাটশেপসুটের কোনো ছেলে ছিল না৷ তাঁর ছিল একটিমাত্র মেয়ে, নাম নেফ্রুর৷ সেও তখন ছিল নাবালিকা৷ এরকম অবস্থায় মিশরের শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন হাটশেপসুট৷ কিন্তু তাঁর এই দায়িত্ব গ্রহণ ছিল তৃতীয় টুথমোসিসের প্রতিনিধি হিসেবে৷ কার্নাক মন্দিরের গায়ে এক চিত্রলিপিতে এর সপক্ষে প্রমাণও মিলেছে৷ সেই ছবিতে দেখা যায়, প্রথমে রাজছত্র মাথায় দাঁড়িয়ে আছেন তৃতীয় টুথমোসিস আর তাঁর এক-পা পিছনে রানির মুকুট পরে দাঁড়িয়ে আছেন হাটশেপসুট৷ এই ছবি থেকেই বোঝা যায় প্রাথমিক অবস্থায় তিনি ছিলেন নাবালক ফ্যারাওয়ের প্রতিনিধি৷

‘কিন্তু দু-বছর শাসনকার্য এভাবে পরিচালনার পর ১৪৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সূর্যদেব আমনরার উৎসবের দিনে সমবেত জনতার সামনে হঠাৎই হাটশেপসুট নিজেকে ফ্যারাও হিসেবে ঘোষণা করেন৷ এবং তার সঙ্গেসঙ্গে নিজেকে ঘোষণা করেন আপার ইজিপ্ট ও লোয়ার ইজিপ্টের অধীশ্বর হিসেবে৷ আমি কী বলছি তা লক্ষ করবেন, অধীশ্বরী নন কিন্তু, অধীশ্বর৷ অর্থাৎ একই সঙ্গে তিনি নিজেকে পুরুষ হিসেবেও চিহ্নিত করেন৷ কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় একজন মহিলাকে কেউ ফ্যারাও বলে মেনে নেবে না৷ তাই তাঁর এই ঘোষণা৷ তিনি বলেন যে, তিনি আসলে আমনরার সন্তান এবং তিনি পুরুষ৷ এর পর তাঁর সাজপোশাকও পালটে যায়৷ ফ্যারাওদের অর্থাৎ পুরুষদের মতো পোশাক পরতে শুরু করেন তিনি৷ এমনকী, ফ্যারাওদের মতো নকল লম্বা দাড়িও পরতে থাকেন৷ যে কারণে কার্নাক মন্দিরে বা মরচুয়ারি মন্দিরে তাঁর যেসব ছবি বা মূর্তি দেখা যায়, তা দেখে প্রাথমিক অবস্থায় সকলেই তাঁকে পুরুষ বলে ভুল করে৷

‘এ তো গেল হাটশেপসুটের সিংহাসনে বসার গল্প৷ কিন্তু শাসক হিসেবেও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেন৷ আশপাশের রাজ্যগুলোর সঙ্গে তিনি বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপন করে তাঁর সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সুদৃঢ় করেন ও ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতিসাধন করেন৷ ইথিওপিয়ায় তাঁর বাণিজ্যতরী বাণিজ্য করতে যেত৷ সোনা ও সম্পদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সুদানে এক সামরিক অভিযানও করেন তিনি৷ তবে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল, নিজের মরচুয়ারি মন্দির তৈরি, যা দেখে আজও আমাদের বিস্মিত হতে হয়৷’

তন্ময় হয়ে ডা. নাসেরের কথা শুনছিলাম৷ হঠাৎ অংশু বলল, ‘আমরা কি পাহাড়ে উঠছি?’

বাইরে তাকিয়ে দেখি, সত্যিই এক রুক্ষ পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করেছি আমরা৷ চারদিকে কোনো সবুজের চিহ্ন নেই৷ সর্বত্র শুধু হলদেটে রঙের পাথরের স্তূপ৷ তার মধ্যে দিয়ে রাস্তা ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গিয়েছে৷ গাড়ির গতি ধীর হয়ে আসতে লাগল৷ পাকদণ্ডীর কোনো কোনো বাঁক বেশ সংকীর্ণ৷ একটু এদিক-ওদিক হলে নীচে আছড়ে পড়তে হবে৷ যত আমরা উপরে উঠছি ততই যেন পাল্লা দিয়ে রোদের তেজ বাড়ছে৷ গাড়ির মধ্যে ঘেমে উঠতে লাগলাম আমরা৷ বেশ খানিকটা উপরে ওঠার পর একটা পাথুরে টিলায় চোখে পড়ল একটা ছোট্ট বাড়ি৷

সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ডা. নাসের বললেন, ‘ওটা হল হাওয়ার্ড কার্টারের বাড়ি, যিনি তুতানখামেনের সমাধি আবিষ্কার করেন৷ ওই বাড়িতেই থাকতেন তিনি৷’

একসময় আমরা উঠে এলাম পাহাড়ের উপর এক চত্বরে৷ বেশ কয়েকটা রাস্তা বেরিয়েছে সেখান থেকে৷ ঢালু হয়ে তারা আবার পাথুরে দেওয়ালের গা ঘেঁষে নীচের দিকে অদৃশ্য হয়েছে৷ চত্বরের এক পাশে বিরাট এক সাইনবোর্ডে একটা ম্যাপ আঁকা আছে৷ আর ম্যাপের মাথার উপর ইংরেজিতে বড়ো বড়ো হরফে লেখা আছে, ‘ওয়েলকাম টু ভ্যালি অফ কিংস’৷ বুঝতে পারলাম, আমরা এসে গিয়েছি ফ্যারাওদের সেই প্রাচীন সমাধিস্থানে৷

ডা. নাসের বললেন, ‘আমরা কিন্তু এখানে এখন থামব না৷’ তারপর একটু দূরে এক উপত্যকার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘ওটা হল, ‘ভ্যালি অব কুইনস’৷ এর মধ্যে দূরত্ব তিন কিলোমিটার৷ এই ভ্যালি অব কিংসের পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছড়িয়ে রয়েছে ফ্যারাওদের অসংখ্য টুম বা সমাধি৷ এই ফ্যারাওরা প্রত্যেকেই ১৫৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ মধ্যবর্তী সময়ে মিশরের সিংহাসনে বসে ছিলেন৷ তবে তাঁদের সমাধিগুলোয় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই বললেই চলে৷ যুগ যুগ ধরে চোরের দল লুন্ঠন করে নিয়েছে সমাধির মধ্যে রাখা ফ্যারাওদের অতুলনীয় সম্পদ৷ আর তাঁদের মমিগুলো অধিকাংশই এখন রাখা আছে কায়রো মিউজিয়ামে৷ তুতানখামেনের মমি অবশ্য এখনও এখানেই আছে৷ এ প্রসঙ্গে আপনাদের একটা কথা বলি৷ যেহেতু রানি হাটশেপসুট নিজেকে ফ্যারাও এবং পুরুষ বলে ঘোষণা করেছিলেন, তাই তাঁর মমি প্রাথমিক অবস্থায় ভ্যালি অফ কুইনসের বদলে এখানেই রাখা হয়৷ পরবর্তীকালে নাকি তাঁর মমি এখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নুবিয়ান মরুভূমিতে পুঁতে ফেলা হয়৷ সম্ভবত এ কাজ হয় ফ্যারাও তৃতীয় টুথমোসিসের নির্দেশে৷ তিনি মিশরের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন হাটশেপসুটের নাম৷’

ডা. ঘটক জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’

ডা. নাসের বললেন, ‘প্রথমত, হাটশেপসুটের জন্য তাঁর সিংহাসনে বসা বিলম্বিত হয়েছিল৷ ফলে তাঁর প্রতি তৃতীয় টুথমোসিসের একটা স্বাভাবিক আক্রোশ ছিল৷ দ্বিতীয়ত, পুরুষতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় একজন মহিলাকে ফ্যারাওয়ের মর্যাদা দিতে কেউ চাননি৷ শুধু তৃতীয় টুথমোসিসই নন, তাঁর পরবর্তীকালে কোনো রাজাই তাঁকে ফ্যারাও হিসেবে চিহ্নিত করতে চাননি৷ অথচ হাটশেপসুট বিদ্যা, বুদ্ধি, রাজ্যশাসনের ব্যাপারে অন্যদের চেয়ে কোনো অংশে কম ছিলেন না৷’

ডা. নাসেরের কথা শুনতে শুনতে আমরা উপত্যকার ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলাম৷ বেশ কিছুটা নীচে নামার পর আবার উপরে ওঠার পালা৷ এবড়োখেবড়ো রাস্তা বলে গাড়িও চলছে খুব ধীর গতিতে৷ ভ্যালি অফ কিংস থেকে নীচে নেমে ভ্যালি অফ কুইনসের গা বেয়ে চলতে লাগলাম আমরা৷ রাস্তার পাশে পাহাড়ের গায়ে হঠাৎ চোখে পড়ল একটা গুহামুখ৷ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন স্থানীয় মানুষ৷ সাদা চামড়ার পর্যটকদের কয়েকটা গাড়ি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে৷ একটা সাইনবোর্ডও টাঙানো রয়েছে গুহামুখের মাথায়৷ কিন্তু তাতে এত ছোটো হরফে লেখা আছে যে, চলন্ত গাড়ি থেকে তা পড়া সম্ভব নয়৷ আমাদের গাড়ি গুহার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বেশ কয়েকজন স্থানীয় মানুষ গাড়ির দিকে এগিয়ে এল৷ ডা. নাসের হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন যে, আমরা এখানে থামব না৷ এর পর তিনি আমাদের উদ্দেশে বললেন, ‘এটা হল রানি নেফারতিতির সমাধিতে ঢোকার পথ৷ যে লোকগুলো গাড়ি থামাবার চেষ্টা করেছিল তারা হল গাইড৷ নেফারতিতির গুহায় বেশ কিছু সুন্দর চিত্রলিপি আছে৷ তবে গুহার শেষ প্রান্তে যেখানে রানির সমাধিকক্ষ আছে, সে পর্যন্ত কাউকে যেতে দেওয়া হয় না৷ কারণ, সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে৷’

নেফারতিতির গুহা ছাড়িয়ে আরও একটু এগোবার পর আমরা হাজির হলাম আরও রুক্ষ এক অঞ্চলে৷ রাস্তার দু-পাশে শুধু বিরাট বিরাট পাথরের স্তূপ আর দিগন্ত বিস্তৃত বালিয়াড়ি৷ সূর্যকিরণে তারা যেন দাউদাউ করে জ্বলছে৷ চারদিকে কোথাও কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই৷ সম্পূর্ণ অচেনা এ জগৎ! দেখে মনের মধ্যে কেমন যেন ভয় করে৷ কাউকে যদি এখানে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে তার মৃত্যু একদম নিশ্চিত৷ অংশু আর ডা. ঘটককেও দেখলাম, চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে৷ মনে মনে এ জায়গার একটা নামকরণ করে ফেললাম আমি, ‘দ্য ভ্যালি অফ ডেথ’ বা ‘মৃত্যুউপত্যকা’৷

আমার মনের ভাব পাঠ করেই কি না জানি না, ডা. নাসের হঠাৎ বললেন, ‘এই রুক্ষ-শুষ্ক প্রান্তরেও কিন্তু প্রাণের স্পন্দন আছে৷ শিয়াল ও বেশ কয়েক ধরনের ছোটোখাটো মাংসাশী প্রাণী আছে এখানে, আর আছে স্যান্ড ভাইপার সহ বেশ কয়েক ধরনের বিষধর সাপ! দিনের বেলায় রোদের প্রচণ্ড তাপ থেকে বাঁচতে তারা লুকিয়ে থাকে পাথরের ফাটলে অথবা বালির নীচের গর্তে৷ রাত হলেই তারা বাইরে বেরিয়ে আসে৷ তারপর সারা রাত ধরে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে বয়ে চলে তাদের জীবনমৃত্যুর খেলা৷ ভোরের আলো ফোটার সঙ্গেসঙ্গেই আবার তারা লুকিয়ে পড়ে নিজেদের আস্তানায়৷’

আমাদের গাড়ি একসময় লম্বা বাঁক নিল, আর তখনই চোখে পড়ল কিছু দূরে এক পাহাড়ের ঢালের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক প্রাচীন স্থাপত্য৷ তার বিরাট বিরাট সাদা থামগুলো দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ মিনিট খানেকের মধ্যে গাড়ি এসে থামল সেই পাহাড়ের ঢালে এক চত্বরে৷ ডা. নাসেরই প্রথম নামলেন গাড়ি থেকে৷ তারপর নামলাম আমরা৷ বাইরে প্রচণ্ড রোদ থাকলেও গাড়ির ভিতরের গুমোট ভাব থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলাম৷ ডা. নাসের বললেন, ‘আমাদের ব্যাগগুলো সব নামিয়ে ফেলতে হবে৷ গাড়ি আর যাবে না, বাকি পথটা আমাদের হেঁটেই উঠতে হবে৷’

ব্যাগ, জলের বোতল ইত্যাদি গাড়ি থেকে নামিয়ে ফেললাম আমি৷ কিছু দূরে বেশ কয়েকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ তার মধ্যে পাশাপাশি রাখা দুটো ধুলোমাখা জিপগাড়ি দেখে আমি চিনতে পারলাম৷ সে দুটোকে আমি গতকাল সন্ধ্যের সময় হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি৷ নিশ্চয়ই ওগুলো ড. হান্সের৷ পাহাড়ের উপর ওঠার জন্য যেখান থেকে সিঁড়ি শুরু হয়েছে, সেখানে একটা লোহার গেট আছে৷ তার পাশে একটা টিকিট কাউন্টার৷ আমি টিকিট কাউন্টারের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ডা. নাসের বললেন, তার দরকার হবে না৷ কারণ, মরচুয়ারি মন্দিরে যাওয়া ও এই অঞ্চলে থাকার জন্য তিনি বিশেষ অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে এনেছেন কায়রোর সরকারি দপ্তর থেকে৷

ডা. নাসের ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন, সে যেন তার গাড়িটা নিয়ে পাহাড়ের উলটো দিকে অর্থাৎ মরচুয়ারির পিছন দিকে চলে যায়৷ ওখানে বেশ কিছু তাঁবু ফেলা আছে৷ তার কাছাকাছি যেন সে গাড়ি পার্ক করে৷ সেখানেই তার সঙ্গে আমাদের দেখা হবে৷ আমরা আমাদের জিনিসপত্র নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম উপরে ওঠার সিঁড়ির মুখে৷ ডা. নাসের তাঁর সেই অনুমতিপত্রটা উপরে ওঠার গেটের মুখে টিকিট পরীক্ষককে দেখাতেই সে সম্ভ্রমে গেট খুলে দিল৷ পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলাম আমরা৷ সকলের আগে উঠতে লাগল অংশু৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *