রানি হাটশেপসুটের মমি – ৭

লাক্সর আধুনিক শহর৷ তার গা ছুঁয়ে বয়ে চলেছে নীলনদ৷ নীলনদের জল এখানে সত্যিই ঘন নীল৷ নদীর তীরে উর্বর পলিমাটিতে উন্মেষ হয়েছিল এক প্রাচীন সভ্যতার৷ তখন তার নাম ছিল ‘থিবস’৷ দু-হাজার বছরের বেশি সময় ধরে থিবসই ছিল ফ্যারাওদের লীলাভূমি৷ মৃত্যুর পরেও হাজার হাজার বছর ধরে তাঁরা শায়িত ছিলেন এই থিবসের মাটিতেই৷ লাক্সরের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা বিরাট বিরাট স্থাপত্যশিল্প আজও সাক্ষ্য বহন করে চলেছে প্রাচীন ফ্যারাওদের গৌরবোজ্জ্বল দিনের৷ তবে শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে সেসব কিছুর চিহ্নমাত্র দেখতে পাওয়া যায় না৷ তার জন্য যেতে হয় শহরের বাইরে৷ ঝকঝকে রাস্তাঘাট, বড়ো বড়ো বাড়িঘর, শপিং মল, এয়ারপোর্ট, সব মিলিয়ে যেকোনো আধুনিক শহরের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে লাক্সর৷

ট্রেন থেকে নামার পর সকাল ন-টা নাগাদ আমরা পৌঁছোলাম শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত হোটেল ক্লিওপেট্রায়৷ ডা. নাসের কায়রো থেকে টেলিফোনে আগেই হোটেল বুকিং করে রেখেছিলেন৷ স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে হোটেলে আসবার পথে ড্রাইভারের সঙ্গে একটা চুক্তি করে ফেললেন৷ চুক্তিটা হল, যত দিন আমরা লাক্সরে থাকব তত দিন সে আমাদের সঙ্গে থাকবে৷ তার জন্য তাকে প্রতিদিন একশো পাঁচ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড দিতে হবে৷ ডা. নাসের আমাদের জানালেন, লাক্সরে নাকি সব কিছুর দাম মার্কিন ডলারের হিসেবে ঠিক করা হয়৷ সম্ভবত অনেক আমেরিকান আর ইউরোপীয় পর্যটক এখানে আসেন বলেই এই নিয়ম৷ ক্লিওপেট্রা, কায়রোর হোটেল রোসেটার মতো বিশাল না হলেও, মন্দ নয়৷ অনেকটা বাংলো প্যাটার্নের তৈরি দোতলা হোটেল৷ আমরা দোতলায় দুটো পাশাপাশি ঘরে জায়গা পেলাম৷ ঠিক হল, তার একটায় থাকবেন দুই ডাক্তার, অন্যটায় আমি আর অংশু৷ ডা. নাসেরের মুখে শুনলাম, দুটো ঘরের বেশি পাওয়া যায়নি৷ কারণ, যে জার্মান দলটা হাটশেপসুটের মন্দিরের কাছে খননকার্য চালাচ্ছে, তারা গত তিন মাস ধরে এই হোটেলেই আছে৷ তাদের দলনেতার নাম হান্স, বললেন ডা. নাসের৷ খবরের কাগজ পড়েই তিনি তাঁর নামটা জেনেছেন৷ তবে এও বললেন যে, একই হোটেলে যখন উঠেছেন তখন তাঁর সঙ্গে পরিচয় হতে নিশ্চয়ই খুব একটা দেরি হবে না৷

হোটেলে পৌঁছোবার ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে স্নান-খাওয়া সেরে বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম আমরা৷ অংশুকে নিয়ে আমি যখন ঘরের বাইরে পা রাখতে যাব তখন আমার ঘরে ঢুকলেন ডা. নাসের ও ডা. ঘটক৷ তাঁরা দু-জনেই বাইরে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি৷ ঘরে ঢোকার পরই ডা. নাসের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলেন৷ আমি কিছু বুঝতে না পেরে তাকালাম ডা. ঘটকের দিকে৷ তিনি বললেন, ‘ডা. নাসের তোমার জিম্মায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস রাখতে চান৷’

আমি বললাম, ‘কী জিনিস?’

ডা. নাসের এবার তাঁর পকেট থেকে বের করলেন একটা লম্বা কৌটো৷ কৌটোটা দেখতে ঠিক ঠান্ডা পানীয়ের ক্যানের মতো৷ ডা. নাসের তার মধ্যে থেকে বের করে আনলেন রোলকরা কাগজের মতো জিনিস৷ তারপর তিনি সেটা মেলে ধরলেন খাটের উপর৷ দেখলাম, সেটা আসলে একটা প্যাপাইরাস৷ দৈর্ঘ্যে ইঞ্চি পাঁচেক হলেও প্রস্থে প্রায় তিন ফুট৷ জিনিসটা যে অতি প্রাচীন তা দেখলেই বোঝা যায়৷ জিনিসটার মধ্যে ছোটো ছোটো ছবির মতো হাইয়ারোগ্লিফিক্স আঁকা রয়েছে৷ কিছু জায়গা তার অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে৷ সম্ভবত বয়সের জন্যেই এমন হয়েছে৷ জিনিসটা কিছুক্ষণ খাটের উপর মেলে ধরার পর ডা. নাসের আবার সেটা আগের মতো গুটিয়ে ফেলে বললেন, ‘এটা আরও লম্বা ছিল৷ বলতে পারেন এটা অর্ধেক মাত্র৷ বাকি অর্ধেকটা সেদিন আমার বাড়ি থেকে চুরি হয়ে গিয়েছে৷ এটাও যেত৷ কিন্তু ব্যাঙ্কের ভল্টে ছিল বলে বেঁচে গিয়েছে৷ এই প্যাপাইরাসের বয়স তিন হাজার বছরেরও বেশি৷ এর অর্ধেকটা আমার বাড়ি থেকে কে হস্তগত করেছে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত৷ আমার ধারণা সে এটাও হাতাবার চেষ্টা করবে৷ তাই এটা আপনার কাছে লুকিয়ে রাখতে চাই৷’ এই বলে তিনি আমার দিকে তাকালেন৷

আমি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আমার কাছে! কিন্তু কোথায়?’

ডা. নাসের আঙুল তুলে খাটের উপর রাখা আমার ক্যামেরার ব্যাগটা দেখিয়ে দিলেন৷ আমি বললাম, ‘ওর মধ্যে? যে কেউই তো ওর মধ্যে থেকে জিনিসটা ছিনিয়ে নিতে পারে৷’

ডা. নাসের বললেন, ‘প্যাপাইরাসটা ওর মধ্যে থাকবেও, আবার থাকবেও না৷’

আমি তাঁর অদ্ভুত কথা শুনে বললাম, ‘মানে?’

তিনি হেসে বললেন, ‘আপনি ব্যাগটার মধ্যে থেকে আগে সব জিনিসপত্র বের করুন৷’

তাঁর কথামতো ব্যাগটার মধ্যে থেকে সব কিছু বের করে ফেললাম৷ সব কিছু বলতে ক্যামেরা, দুটো টেলিলেন্স আর গোটাকতক রঙিন ফিলটার, ইউ ভি ফিলটারের চাকতি৷ ডা. নাসের একটা টেলিলেন্স হাতে নিয়ে বললেন, ‘এর মাথার দিকের কাচটা খোলা যায় তো?’

আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ৷’

সঙ্গেসঙ্গেই বুঝতে পারলাম তিনি কী বলতে চাইছেন৷ কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল কাজটা৷ রোলকরা প্যাপাইরাসটা দিব্যি ঢুকে গেল টেলিলেন্সের ভিতরে৷ বাইরে থেকে যাতে বোঝা না যায়, তার জন্য আমি তার মুখে পরিয়ে দিলাম একটা নীল রঙের কাচের ফিলটার৷ ব্যস, আর কোনো কিছু বোঝার উপায় রইল না৷ অংশু অবাক হয়ে সব কিছু দেখল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না৷

কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম৷ অংশু বসল ড্রাইভারের পাশে, আর আমরা তিন জন বসলাম পিছনে৷ আমি ভেবেছিলাম, আমরা নিশ্চয়ই হাটশেপসুটের মরচুয়ারিতে যাব৷ কিন্তু ডা. নাসের ড্রাইভারকে কার্নাক যাওয়ার নির্দেশ দিলেন৷ যদিও কার্নাক আর হাটশেপসুটের মন্দির একই পথে না আলাদা পথে, সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা ছিল না৷ নীলনদের গা বেয়ে ঝকঝকে রাস্তা ধরে গাড়ি চলতে শুরু করল৷ স্টেশন থেকে হোটেলে আসার পথে বা কার্নাক যাওয়ার পথে একটা জিনিস লক্ষ করলাম, লাক্সরের প্রধান রাস্তাগুলো সবই প্রায় নীলনদের পার ধরে তৈরি হয়েছে৷ রাস্তায় চলতে চলতেই গাড়ির ভিতর থেকে দেখা যাচ্ছে নীলনদের বুকে ভেসে চলা সাদা রঙের বিরাট বিরাট ক্রুজ জাহাজ বা প্রমোদতরী আর পালতোলা নৌকোগুলোকে৷ এমনকী প্রমোদতরীর ডেকে দাঁড়ানো মানুষদেরও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷

ডা. নাসের বললেন, ‘লাক্সরের তিনটে অংশ৷ এক, লাক্সর শহর, দুই, নীলনদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত ফ্যারাও এবং তাঁর রানিদের প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র ভ্যালি অব কিংস ও ভ্যালি অব কুইনস এবং তিন, শহরের উত্তর-পূর্ব কোনে অবস্থিত কার্নাক৷ কার্নাক হল আসলে একটা গ্রাম৷ ওখানে আজও প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিশরীয় স্থাপত্যকলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কার্নাক মন্দির৷ আমি অন্তত তিরিশবার গিয়েছি ওখানে৷ কিন্তু প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে, যেন প্রথমবার পা রাখলাম কার্নাকের মন্দির চত্বরে৷ এমনই বড়ো, এমনই তার সৌন্দর্য, তার প্রতিটি সোপানশ্রেণি, প্রতিটি পাথর, স্তম্ভমূর্তি যেন স্মরণ করিয়ে দেয় ফ্যারাওদের গৌরবোজ্জ্বল নানা অধ্যায়ের কথা৷’

মন্দিরে ঢোকার দু-পাশে সার সার ভেড়ামুখো স্ফিংক্স বসানো আছে৷ প্রত্যেক স্ফিংক্সের সামনের দুই থাবার মাঝে একজন করে ফ্যারাওয়ের মূর্তি৷

ডা. নাসের আমাদের এই ভেড়ামুখো স্ফিংক্সগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘আপনারা জানেন যে, প্রাচীন মিশরের প্রধান দেবতা ছিলেন সূর্যদেব৷ ফ্যারাওরা নিজেদের তাঁর অংশ বা সন্তান বলে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন৷ আসলে ঐশ্বরিক ব্যাপারটা ফ্যারাওদের নামের সঙ্গে যুক্ত রাখা হত ধর্মভীরু প্রজাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য৷ ভেড়ামুখো স্ফিংক্স আসলে হচ্ছে সূর্যদেব বা আমনের প্রতিমূর্তি৷ আর ওঁদের থাবার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিগুলো সবই আসলে ফ্যারাও দ্বিতীয় রামেসিসের মূর্তি৷ এর মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে যে, পিতা সূর্যদেব বা আমন রক্ষা করছেন তাঁর পুত্র দ্বিতীয় রামেসিসকে৷ আর একটা কথা আমি আপনাদের বলি, ফ্যারাওদের ঐশ্বরিক ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি প্রচার করতেন সমাজের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিবর্গ অথবা পুরোহিতরা৷ নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্যই তাঁরা এসব করতেন৷ লুকোনো মাটির নীচের সুড়ঙ্গপথে তাঁরা হাজির হতেন আমনের মূর্তির পিছনে৷ সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁরা বক্তব্য রাখতেন৷ মূর্তির সামনে জড়ো-হওয়া মানুষরা ভাবত স্বয়ং আমনই বলছেন ওইসব কথা৷ কার্নাক মন্দিরের নির্মাতা আমেনহোটেপের যখন জন্ম হয় তখন তাঁর বাবার মৃত্যু হয়েছিল৷ কেউ যাতে সদ্যোজাত আমেনহোটেপের কোনো ক্ষতি করতে না পারে তাই কৌশলী প্রধান পুরোহিত আমনের মূর্তির পিছনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, যে শিশু জন্ম নিয়েছে সে আমার সন্তান৷ শুনে সকলে ভেবেছিল স্বয়ং সূর্যদেবই ঘোষণা করলেন কথাটা৷’

ডা. নাসেরের কথাগুলো ভবিষ্যতে আমার কাজে আসতে পারে ভেবে পকেট ডায়েরিতে নোট করে নিলাম৷ পাথর-বাঁধানো পথ বেয়ে এসে দাঁড়ালাম কার্নাক মন্দিরের প্রথম তোরণের সামনে৷ চল্লিশ ফুটেরও বেশি উঁচু হবে এই তোরণ, ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয়৷ তবে তার কাজ অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে৷ প্রথম তোরণ অতিক্রম করে আমরা এসে দাঁড়ালাম চারদিক প্রাচীর দেওয়া একটা খোলা জায়গায়৷ প্রাচীরের গায়ে আঁকা ও খোদাই করা নানাধরনের ছবি৷

ডা. নাসের বললেন, ‘এ ছবিগুলো মিশরের চলন্ত ইতিহাস! নানাধরনের ছবি আছে৷ তাতে ফ্যারাওদের রাজ্যাভিষেকের দৃশ্য, তাদের বিচারালয়, ফ্যারাও এবং সেই সময়ের মিশরবাসীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, উৎসব থেকে শুরু করে একদম শেষযাত্রার দৃশ্য পর্যন্ত নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ লক্ষ করলাম, অংশু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সেগুলো৷ এতটাই মনোযোগ দিয়ে সে ছবিগুলো দেখার চেষ্টা করছে যে, মাঝে মাঝে সে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে৷ আর একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, ডা. নাসের আমাদের বোঝার সুবিধের জন্য নানা কথা বলছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি আসলে অংশুর মুখের উপর নিবদ্ধ৷ মনে হল, তিনি যেন ছবিগুলো দেখার সময় অংশুর মুখের অভিব্যক্তি পড়ার চেষ্টা করছেন৷ হাঁটতে হাঁটতে আমরা হাজির হলাম দ্বিতীয় তোরণের সামনে৷ এরই মধ্যে বেশ কয়েকটা ফোটোও তুলে নিলাম৷ দ্বিতীয় তোরণের একটু আগে দাঁড়িয়ে ফ্যারাও দ্বিতীয় রামেসিসের বিশাল দুটো মূর্তি৷ দ্বিতীয় তোরণ পেরিয়ে আমরা ঢুকলাম বিরাট একটা হলঘরে৷ এত বড়ো হলঘর আমি এর আগে কখনো দেখিনি৷ দানবাকৃতির অসংখ্য স্তম্ভ ধরে রেখেছে মাথার উপরে পাথুরে ছাদকে৷ হলঘরের মধ্যে আলোআঁধারি খেলা করছে৷ একটু জোরে কথা বললেই সেই শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে কানে৷ বেশ মজা লাগছে শুনতে৷ ডা. ঘটককেও দেখলাম, তাঁর স্বাভাবিক গাম্ভীর্য ভুলে দু-বার জোরে জোরে ‘অংশু অংশু’ বলে ডাকতে৷ সঙ্গেসঙ্গেই অংশু ডাকটা প্রতিধ্বনিত হতে লাগল৷ অংশুও হাততালি দিতে লাগল৷ ডা. নাসেরের মুখে শুনলাম, এর নাম ‘হাইপোস্টাইল হল’৷ অসংখ্য ছোটো-বড়ো মূর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে বিভিন্ন জায়গায়৷ ডা. নাসের আমাদের সব কিছু বুঝিয়ে দিতে লাগলেন৷ হাইপোস্টাইল হল থেকে বেরিয়ে একের পর এক তোরণ পেরিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম অপেক্ষাকৃত ছোটো মাপের ষষ্ঠ তোরণের সামনে৷ ডা. নাসের জানালেন, এই ষষ্ঠ তোরণ তৈরি করান ফ্যারাও তৃতীয় টুথমোসিস এবং আগের পঞ্চম তোরণটি তৈরি করান ফ্যারাও প্রথম টুথমোসিস, যিনি ছিলেন রানি হাটশেপসুটের বাবা৷

হাটশেপসুটের কথা শুনে আমি আগ্রহী হয়ে ডা. নাসেরকে প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা, হাটশেপসুটের তৈরি কিছু নেই এখানে?’

ডা. নাসের বললেন, ‘আছে৷ আপনি দেখতে চান? তাহলে আমার সঙ্গে আসুন৷’ এই বলে তিনি আবার পিছনে ফিরলেন৷

কিছুটা অক্ষত একটা ফ্যারাও মূর্তি দেখিয়ে ডা. নাসের বললেন, ‘এটাই হল হাটশেপসুটের মূর্তি৷ রানি হাটশেপসুট পুরুষদের মতো পোশাক পরতেন৷ এখানকার দেওয়ালে খোদিত ফ্যারাও মূর্তিগুলো সবকটাই হাটশেপসুটের৷ তবে মূর্তিগুলোকে যে আপনারা ভাঙা দেখছেন, তা কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে নয়৷ আসলে মূর্তিগুলোকে ভেঙে ফেলা হয়েছিল৷ রানি হাটশেপসুট তাঁর পঁচিশ বছরের রাজত্বকালে কার্নাক মন্দিরের বিভিন্ন দেওয়ালে এ জাতীয় অনেক মূর্তি খোদাই করান৷ কিন্তু হাটশেপসুটের মৃত্যুর পর তৃতীয় টুথমোসিস সিংহাসনে বসে লাক্সর সহ মিশরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা তাঁর সমস্ত কীর্তি ধ্বংস করার নির্দেশ দেন৷ আসলে একজন মহিলাকে তিনি তাঁর পূর্বসূরি বলে মানতে চাননি৷ একমাত্র মরচুয়ারি মন্দিরই এই ধ্বংসলীলা থেকে রক্ষা পায়৷ সম্ভবত কোনো ধর্মীয় কারণেই ফ্যারাও তৃতীয় টুথমোসিস মরচুয়ারি মন্দিরে হাত দেননি৷’

কার্নাক মন্দির দেখতে আমাদের ঘণ্টা তিনেক কেটে গেল৷ তারপর বেশ কিছুক্ষণ মন্দির চত্বরে বসে গল্প করলাম আমরা৷

কথা প্রসঙ্গে ডা. নাসের বললেন, ‘আমি আপনাদের প্রথমে এখানে নিয়ে এলাম দুটো কারণে৷ প্রথমত, কার্নাক মন্দির মিশরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দর্শনীয় স্থান৷ পরে যদি কোনো কারণে আপনাদের দেখাতে না পারি তাই আগেই দেখিয়ে রাখলাম৷ দ্বিতীয়ত, আলতুনিয়া যদি সত্যিই পিছু নিয়ে এখানে এসে থাকে তাহলে আমাদের এখানে আসায় সে কিছুটা বিভ্রান্ত হবে৷ কারণ, সে নিশ্চয়ই হাইয়ারোগ্লিফিকটা পড়েছে, এ ব্যাপারে তাকে বিশেষজ্ঞও বলা যেতে পারে৷ কাজেই তার নিশ্চয়ই ধারণা ছিল যে, লাক্সরে নেমেই আমরা প্রথমে ছুটব হাটশেপসুটের মরচুয়ারির দিকে৷ হয়তো সে এখন গিয়ে বসে আছে হাটশেপসুটের মরচুয়ারি মন্দিরে৷ আমরা কাল ভোরে রওনা হব সেদিকে৷’

অংশু একসময় আমাদের চেয়ে একটু দূরে গিয়ে একটা স্ফিংক্সের থাবার উপর চড়ে বসল৷ সেই সুযোগে আমি আমার মনের মধ্যে জমে থাকা বেশ কয়েকটা প্রশ্ন ডা. নাসেরকে একসঙ্গে জিজ্ঞেস করে ফেলাম, ‘আচ্ছা প্যাপাইরাসে ঠিক কী লেখা আছে? তার সঙ্গে অংশুর কথার কোথায় মিল আছে? হাটশেপসুটের মরচুয়ারির সঙ্গে সেসবের সম্পর্কটাই বা কী?’

ডা. নাসের হয়তো উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অংশু স্ফিংক্সের উপর থেকে নেমে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল৷

ডা. নাসের বললেন, ‘একথা এখন থাক, পরে আপনাদের সব বুঝিয়ে বলব৷’

কার্নাক মন্দির ছেড়ে আমরা যখন হোটেলে ফেরার জন্য গাড়িতে উঠে বসলাম, সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে৷ তার লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে কার্নাক মন্দিরের পাথুরে স্তম্ভে৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *