৬
ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে রাত আটটা বেজে গেল৷ স্টিম ইঞ্জিনে টানা কাঠের বগি৷ একটা কুপ আমরা সম্পূর্ণ বুক করে নিয়েছি৷ চার জনের শোওয়ার ব্যবস্থা আছে তাতে৷ শহর ছাড়িয়ে ট্রেন ছুটতে শুরু করল উঁচু-নীচু উন্মুক্ত প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে৷ ডা. নাসের জানালেন, মাঝরাতে একটা জংশন স্টেশন ছাড়া ভোরের আগে ট্রেন অন্য কোথাও দাঁড়াবে না৷ মধ্যে মধ্যে কয়েকটা ছোটোখাটো স্টেশন আছে অবশ্য৷ কিন্তু নির্জন স্থানে মরু-ডাকাতদের ভয় থাকায় এই ট্রেন আর আজকাল সেসব স্টেশনে দাঁড়ায় না৷ কায়রো থেকে লাক্সরের দূরত্ব হল, ছ-শো ছিয়াত্তর কিলোমিটার৷ ট্রেনে যেতে সময় লাগে বারো ঘণ্টার মতো৷ এর মধ্যে বেশ কিছু অংশ যেতে হয় মরুভূমির মধ্যে দিয়ে৷ আমি আর অংশু মুখোমুখি বসে ছিলাম জানলার পাশে৷ বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালোই লাগছিল৷ কয়েক দিন পরেই মনে হয় পূর্ণিমা৷ প্রায় গোল চাঁদ আকাশে৷ তার আলোয় প্লাবিত বিস্তীর্ণ জনহীন প্রান্তর৷ মাঝে মাঝে নীলনদের ক্যানেলের উপর ছোটো ছোটো সেতু৷ ঘটাং ঘটাং শব্দে তার উপর দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন৷ ডা. ঘটক আর ডা. নাসের নিজেদের পেশার ব্যাপারে নানা গল্প করছেন৷ একসময় ডা. ঘটক প্রসঙ্গ পালটে ডা. নাসেরকে বললেন, ‘প্রাচীন মিশর সম্বন্ধে আমার খুব একটা ধারণা নেই৷ আপনি যদি এ ব্যাপারে আলোকপাত করেন তাহলে ভালো হয়৷’
ডা. নাসের বলতে শুরু করলেন মিশরের ইতিহাস৷ আর আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে শুনতে লাগলাম তাঁর কথা৷ পাঁচ হাজার বছর আগে নীলনদের তীরে যে প্রাচীন সভ্যতার পত্তন হয়েছিল, তার এক সংক্ষিপ্ত ধারাবিরণী বলে চললেন ডা. নাসের৷ এত সুন্দর তিনি বলছিলেন বিভিন্ন ফারাওয়ের কাহিনি, পিরামিড তৈরির কাহিনি, মনে হচ্ছিল যেন তিনি সব কিছু নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন৷ আমার খুব কৌতূহল ছিল কীভাবে মমি তৈরি করা হত, সে ব্যাপারে৷
ডা. নাসেরকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, ‘আগে বলে নিই কেন মমি তৈরি করা হত৷ মিশরীয়রা মনে করতেন আত্মা অবিনশ্বর৷ জাগতিক মৃত্যুর অর্থ ছিল তাঁদের কাছে শরীরের ঘুমিয়ে পড়া৷ তাঁরা বিশ্বাস করতেন, শরীরকে যদি সংরক্ষিত করা যায়, তাহলে ঘুমিয়ে-পড়া শরীর আবার একদিন জেগে উঠবে৷ তারপর সমাধির মধ্যে রাখা নৌকোয় পাড়ি দেবে শেষ বিচারের জন্য অনন্তলোকের উদ্দেশ্যে৷ আর যাঁরা ফ্যারাও, তাঁরা মিশে যাবেন সূর্যদেবের সঙ্গে৷ মমি তৈরির পদ্ধতি বিভিন্ন চিত্রলিপির মাধ্যমে জানা গিয়েছে৷ পিরামিডের ভিতরে বিভিন্ন দেওয়ালে, বিশেষত যেখানে সমাধি দেওয়া হত সেই কক্ষে এ জাতীয় বহু চিত্রলিপির সন্ধান মিলেছে৷ মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তি পুরুষ মানুষ হলে তার মাথার সব চুল কামিয়ে ফেলা হত, স্ত্রীলোকদের ক্ষেত্রে অবশ্য তা করা হত না৷
‘মমি তৈরি করতেন এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা৷ শরীরের ভিতরে যেসব অতি পচনশীল অংশ আছে, প্রথমে তা শরীরের বাইরে বের করে ফেলা হত৷ যেমন বঁড়শি জাতীয় বাঁকানো যন্ত্রের সাহায্যে নাকের ফুটোর মধ্যে দিয়ে বের করে আনা হত মস্তিষ্ক৷ সেই ফাঁকা গহ্বরে কানের ফুটো দিয়ে ভরে দেওয়া হত তরল বিটুমিন৷ যা ঠান্ডা হলে জমে শক্ত হয়ে যেত৷ পেটের বাঁ দিকে ছিদ্র করে অন্ত্র, পাকস্থলী ইত্যাদি বের করে এনে উদরগহ্বর ভালো করে সুরা দিয়ে পরিষ্কার করে তাতে ভরে দেওয়া হত ধূপ মিশ্রিত কাঠের গুঁড়ো৷ এভাবে সম্পূর্ণ হত মমি তৈরির প্রাথমিক কাজ৷ এর পর লবণে দশ সপ্তাহ চুবিয়ে রাখা হত ওই শরীর৷ ফলে মাংস গলে গিয়ে হাড়ের উপর পড়ে থাকত শুধু চামড়া৷ ওই শরীরকে দ্রবণ থেকে তুলে প্রথমে মসলিন জাতীয় সূক্ষ্ম কাপড়ে রঞ্জন মাখিয়ে সেই কাপড় জড়ানো হত মাথা ও মুখে৷ আর ব্যান্ডেজের মতো লম্বা কাপড়ের ফালি জড়ানো হত সারা দেহে৷ একেবার গলা থেকে হাত-পায়ের আঙুল পর্যন্ত৷ বিত্তশালী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হাত-পায়ের আঙুলে পরানো হত সোনার তৈরি খাপ, মুখে মৃত ব্যক্তির মুখাবয়বের আদলে তৈরি সোনার মুখোশ৷ শরীর থেকে বের করে নেওয়া অঃন্তযন্ত্রগুলোকে তরল বিটুমিনে ফুটিয়ে ধাতু বা পাথরের তৈরি ফুলদানির মতো দেখতে পাত্রে ভরে রেখে দেওয়া হত সমাধিক্ষেত্রে৷’
এসব নানা গল্প শুনতে শুনতে রাত দশটা বেজে গেল৷ ডা. নাসের সঙ্গে করে খাবার এনে ছিলেন৷ খাওয়া-দাওয়ার পর অংশুর হাই উঠতে লাগল৷ উপরের বার্থে শুয়ে পড়ল অংশু৷ তার কিছুক্ষণ পরই দেখলাম, সে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ট্রেন ছুটে চলেছে৷ বাইরে থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাসে বেশ শীত শীত করতে লাগল৷ জানলার কাচের শার্শিগুলো নামিয়ে দিয়ে আমি ডা. নাসেরের মুখোমুখি বসলাম তাঁর কথা শোনার জন্য৷
ডা. নাসের মনে হয় বুঝতে পারলেন, এর পর আমরা তাঁর কাছ থেকে কী শুনতে চাইব৷ তাই তিনি নিজেই বলতে শুরু করলেন, ‘এবার আমি আপনাদের বলব কেন আমি আপনাদের লাক্সরে নিয়ে চলেছি৷ যদিও যে কথাগুলো আমি আপনাদের বলব তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে আমি অপারগ৷ প্রথমত, আমি আগেই আপনাদের বলেছি যে, অংশুর প্রলাপের কিছু কথার সঙ্গে এক প্রাচীন হাইয়ারোগ্লিফিক্সের বক্তব্যের যোগসূত্র আছে বলে মনে হয়৷ ওই হাইয়ারোগ্লিফিক আমি সংগ্রহ করি লাক্সর থেকেই৷ তাতে রানি হাটশেপসুটের মরচুয়ারি মন্দিরের এক কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে৷ ওই মরচুয়ারি মন্দির লাক্সরের কাছেই অবস্থিত৷
‘দ্বিতীয়ত সেই মিউজিয়ামের ঘটনাটা! অংশু কী করে জানল? ওই পাত্রগুলো দেখে হঠাৎ ওই কথাটা বলল কেন? জেসের-জেসেরু? ও তো ওই শব্দের মানে জানে না! মিউজিয়ামের কিউরেটরের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে আমি জেনেছি, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে জার্মান প্রত্নবিদ ড. হান্স হাটশেপসুটের মরচুয়ারি মন্দিরের নীচ থেকে ওগুলো আবিষ্কার করেছেন!
‘আর তৃতীয়ত, তথ্যটাও বেশ চমকপ্রদ৷ অংশুর বাবা কিন্তু আদতে লাক্সরেরই মানুষ ছিলেন৷ লাক্সরের আখুম নামের একটা ছোট্ট গ্রামে তিনি বড়ো হয়ে ওঠেন৷’ এর পর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ডা. নাসের, তারপর বললেন, ‘এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কেন আমি লাক্সরে যাচ্ছি৷ আমার ধারণা, লাক্সরের মরচুয়ারি মন্দিরের সঙ্গে অংশুর একটা সম্পর্ক আছে৷’
ডা. ঘটক প্রশ্ন করলেন, ‘তৃতীয় তথ্যটা আপনি পেলেন কোথা থেকে?’
ডা. নাসের বললেন, ‘দুর্ঘটনার পর অংশুর বাবা-মা যে নার্সিংহোমে ভরতি হন, সেই নার্সিংহোমে এক বৃদ্ধা নার্স আছেন৷ তিনিও একসময় আখুম গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন৷ তিনিই তথ্যটা দিলেন আমাকে৷ গতকাল আমি সেখানে গিয়েছিলাম সেকথা তো আপনারা জানেনই৷ আরও বেশ কিছু তথ্যও আমি সংগ্রহ করেছি তাঁর কাছ থেকে৷’
ডা. ঘটক আবার প্রশ্ন করলেন, ‘কী সেই তথ্য!’
ডা. নাসের বললেন, ‘প্রথমত, অংশুর বাবার পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য৷ যেমন তাঁর বাবা-মার কোনো পরিচয় জানা যায় না৷ আখুম গ্রামের এক বৃদ্ধ তাঁকে কুড়িয়ে পেয়ে মানুষ করেছিলেন৷ সেই বৃদ্ধের মৃত্যুর পর জীবিকার সন্ধানে আমন অর্থাৎ অংশুর বাবা কায়রো চলে আসেন৷ কায়রোয় এসে তিনি তেলের কোম্পানিতে চাকরি নেন ও অংশুর মাকে বিয়ে করে ওল্ড কায়রো অঞ্চলে থাকতে শুরু করেন৷
‘দ্বিতীয়ত, দুর্ঘটনা প্রসঙ্গেও আমি বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি ওই বৃদ্ধার কাছ থেকে৷ ওই দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বৃদ্ধা আমাকে যেসব কথা জানিয়েছেন তা হল, দুর্ঘটনার পর অংশুর বাবা-মাকে যখন নার্সিংহোমে আনা হয়, তখন অংশুও তাঁদের সঙ্গে ছিল৷ তবে সে ছিল সম্পূর্ণ অক্ষত৷ ঘটনাচক্রে সেদিন রাতে নার্সিংহোমের ডিউটিতে ছিলেন ওই বৃদ্ধা৷ অংশুর বাবাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আনা হয়৷ সারা শরীর ছিল রক্তাক্ত৷ বিশেষত তাঁর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিল৷ নার্সিংহোমে আনার পর একসময় কিছুক্ষণের জন্য তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে৷ তখন তিনি দুর্ঘটনার কারণ সম্বন্ধে যা বলেছেন তা হল, তিনি তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে লাক্সর থেকে বেরিয়ে কায়রোয় ফিরছিলেন৷ গাড়িটা তিনি এক বন্ধুর থেকে নিয়েছিলেন৷ দুর্ঘটনার সময় গাড়িটা তিনিই চালাচ্ছিলেন৷ অংশু তার মার সঙ্গে পিছনের আসনে ঘুমোচ্ছিল৷ রাত আটটা নাগাদ তিনি নীলনদের দ্বিতীয় সেতুর কাছাকাছি চলে আসেন ওই সেতু পার হয়ে কায়রোয় প্রবেশ করার জন্য৷
‘সেতুতে উঠবার আগে দু-পাশে ঘন জঙ্গলময় রাস্তায় যখন তিনি ঢুকলেন তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ ফাঁকা রাস্তা, অন্য কোনো যানবাহন নেই৷ কাজেই বেশ জোরেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন তিনি৷ হেডলাইটের আলোয় হঠাৎই আমন দেখতে পান, বাঘের চেয়েও বিরাট আকৃতির কুকুর জাতীয় প্রাণী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়াল৷ তিনি তখন ওই প্রাণীটার খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন৷ ভয় পেয়ে ব্রেক কষতেই সঙ্গে সঙ্গে উলটে গেল গাড়ি৷ এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারেননি আমন৷ ওই দিন রাতেই তাঁর মৃত্যু হয়৷ যে ট্রাকড্রাইভার তাঁদের দুর্ঘটনাস্থলে প্রথম দেখতে পেয়ে নার্সিংহোমে পৌঁছে দিয়েছিল, নার্সিংহোমের রেকর্ডে তার যে জবানবন্দি আছে তাতেও কিন্তু একটা কুকুর জাতীয় প্রাণীর উল্লেখ আছে৷ উলটে যাওয়া গাড়িটা দেখতে পেয়ে ট্রাক থেকে নেমে পড়েছিল ড্রাইভার আর তার এক সঙ্গী৷ দুমড়েমুচড়ে যাওয়া গাড়ির ভিতর থেকে অনেক কষ্টে তারা বের করে আনে অংশুর বাবা-মাকে৷ তাঁরা দু-জনেই ছিলেন সংজ্ঞাহীন৷ অংশু কিন্তু গাড়ির মধ্যে ছিল না৷ হঠাৎ রাস্তার পাশে একটা ঝোপের মধ্যে থেকে শিশুকন্ঠের কান্নার শব্দে সেদিকে এগিয়ে যায় তারা৷ ট্রাকের হেডলাইটের একটা অস্পষ্ট আলো তেরছাভাবে গিয়ে সেখানে পড়েছিল৷
‘ঝোপের কাছাকাছি গিয়ে সেই আলোয় তারা দেখতে পায়, ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে একটা শিশু৷ আর তার মাথার কাছে বসে রয়েছে একটা কুকুর বা শিয়ালজাতীয় প্রাণী৷ অন্ধকারে তার চোখ দুটো জ্বলছে৷ তারা আরও কয়েক পা সেদিকে এগোতেই হঠাৎই প্রাণীটা যেন অদৃশ্য হয়ে গেল৷ অবশ্য সেই প্রাণীটার আকৃতির ব্যাপারে ট্রাকড্রাইভার বিশেষ কিছু বলেনি৷ হতে পারে সেটা নিতান্তই সাধারণ কুকুর বা শিয়াল৷ আসলে দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চালিয়ে আসার ফলে ক্লান্তিতে ওই কুকুর বা শিয়াল দেখে দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছিল অংশুর বাবার৷ যাই হোক, এর পর তিন জনকেই উদ্ধার করে ট্রাকড্রাইভার ও তার সঙ্গী নার্সিংহোমে পৌঁছে দিয়েছিল৷’ ডা. নাসের এবার একটু থামলেন৷ তারপর বললেন, ‘আশা করি এবার কেন আমরা লাক্সরে যাচ্ছি এবং অংশুর ব্যাপারটার মধ্যে যে অন্যরকম রহস্য লুকিয়ে আছে সে সম্বন্ধে আমি আপনাদের মোটামুটি ধারণা দিতে পারলাম৷’ এরপর ডা. নাসের একদম চুপ করে গিয়ে উপরে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত অংশুর মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন চিন্তা করতে লাগলেন৷
আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে৷ ডা. নাসের নিজের জায়গায় একইভাবে বসে রইলেন৷ আর ডা. ঘটক অংশুর নীচের বার্থে শোওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলেন৷ আমিও শুয়ে পড়ব, কিন্তু তার আগে একবার বাথরুম যাওয়ার জন্য কুপ থেকে করিডোরে এসে দাঁড়ালাম৷ সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা বাতাস এসে লাগল আমার গায়ে৷ করিডোরের উজ্জ্বল আলোগুলো সব নিভে গিয়েছে৷ শুধু হালকা একটা নীল আলো ছড়িয়ে আছে৷ আমি সামনের খোলা জানলাটা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম৷ চোখে পড়ল অপূর্ব এক দৃশ্য৷ সম্ভবত মরুভূমির মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে৷ যত দূর চোখ যায় চারদিকে জ্যোৎস্না ভেজা উঁচু-নীচু নির্জন বালিয়াড়ি, কেমন যেন একটা মায়াবি পরিবেশ৷ পৃথিবী ছাড়িয়ে আমরা যেন ছুটে চলেছি অন্য কোনো জগতের উদ্দেশে৷ বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে৷ বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়ালে ঠান্ডা লেগে যাবে৷ তাই এর পর করিডোর দিয়ে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম কম্পার্টমেন্টের শেষ প্রান্তে, বাথরুমের সামনে৷
দু-পাশে দুটো বাথরুম আর তার পরেই অন্য কম্পার্টমেন্ট যাওয়ার ভেস্টিবিউল৷ আমি প্রথমে ডান দিকের বাথরুমের দরজাটা ঠেললাম৷ কিন্তু সেটা খুলল না৷ বুঝতে পারলাম লোক আছে, কারণ দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ৷ তারপর আমি বাঁ-দিকের বাথরুমে ঢুকে পড়লাম৷ মিনিট দু-এক পর আমি বাথরুম থেকে বেরোলাম৷ দেখি, উলটো দিকের বাথরুমের দরজাটা খোলা৷ সম্ভবত যে এতক্ষণ বাথরুমে ছিল দরজা বন্ধ করতে সে ভুলে গিয়েছে৷ বাথরুম থেকে করিডোরে ঢুকতেই আমার চোখে পড়ল, একটা লোক কম্পার্টমেন্টের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ আমিও নির্জন করিডোর দিয়ে আমার কুপের দিকে এগিয়ে গেলাম৷
কুপগুলো সব নিস্তব্ধ৷ সকলেই শুয়ে পড়েছে৷ আমাদের কুপের আলোটাও নিভে গিয়েছে৷ আমাদের কুপের ঠিক সামনে যখন চলে এসেছি, ঠিক তখনই আমার সামনের লোকটা কম্পার্টমেন্টের শেষ প্রান্তে পৌঁছে একটা বাঁক নিল৷ সেখানে একটা মৃদু আলো জ্বলছিল৷ লোকটা বাঁক নিয়ে কুপের আড়ালে অদৃশ্য হওয়ার আগের মুহূর্তে আলোটা এসে পড়ল তার মুখের উপর৷ তার মুখের এক পাশ আমি দেখতে পেলাম৷ আর কেন জানি না, সঙ্গে সঙ্গেই আমি তাকে চিনে ফেললাম৷ লোকটা হল আলতুনিয়া! তাহলে কি সেও আমাদের সঙ্গে লাক্সরে চলেছে! কিন্তু কেন? কুপের ভিতর ঢুকে দেখি, ডা. ঘটক আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছেন৷ আর ডা. নাসের একইভাবে বসে বসে কী চিন্তা করছেন৷ তাঁকে দেখে আমি উত্তেজনা চাপতে না পেরে বলেই ফেললাম আলতুনিয়াকে দেখার ব্যাপারটা৷ কথাটা শুনেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে তিনি বললেন, ‘কোন দিকে?’
আমি আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলাম৷ ডা. নাসের সঙ্গে সঙ্গে কুপ থেকে বেরিয়ে সেদিকে এগোতে লাগলেন৷ আমিও তাঁর পিছু নিলাম৷ কম্পার্টমেন্টের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম আমরা৷ কিন্তু সেখানে কেউ নেই! চোখে পড়ল ভেস্টিবিউলের দরজাটা কে যেন উলটো দিক থেকে বন্ধ করে দিয়েছে৷ হয়তো সে-ই পাশের কম্পার্টমেন্টে চলে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে৷ ডা. নাসের বেশ কয়েকবার দরজাটার গায়ে ধাক্কা দিলেন৷ কিন্তু সেটা কেউ খুলল না৷ অগত্যা আমরা আবার ফিরে এলাম নিজেদের কুপে৷ কুপে ঢোকার পর ডা. নাসের শুধু একবার বললেন, ‘আমার দৃঢ় ধারণা, আমার বাড়িতে যে চুরিটা হয়েছে সেটা ওরই কাজ৷ প্যাপাইরাস ও অংশুর ক্যাসেটটার মর্মবস্তু কিছুটা হলেও ও নিশ্চিত উদ্ধার করেছে, যে-কারণে ও আমাদের পিছু নিয়েছে৷’
আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ কুপের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ তারপর বার্থে উঠে শুয়ে পড়লাম৷ আলতুনিয়া সত্যিই কি চুরি করেছে? সে কি সত্যই আমাদের ফলো করছে? অংশুর ব্যাপারটা আসলে কী? এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে ট্রেনের দুলুনিতে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম৷