রানি হাটশেপসুটের মমি – ৫

ভোর পাঁচটা নাগাদ টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল৷ অংশু তখন আমার পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছে৷ টেলিফোনটা ডাইনিংয়ে রাখা৷ আমি বিছানা ছেড়ে উঠতে যাওয়ার আগেই বুঝতে পারলাম, ডা. ঘটক গিয়ে ফোনটা ধরলেন৷ মিনিট পাঁচেক পর ডা. ঘটক এসে টোকা দিলেন আমার ঘরে৷ বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজা খুললাম৷ দেখলাম, তাঁর চোখে-মুখে কেমন একটা উত্তেজনার ভাব৷ তিনি বললেন, ‘ডা. নাসের ফোন করেছিলেন, তিনি বললেন কাল সন্ধ্যেয় তাঁর বাড়িতে নাকি একটা সাংঘাতিক চুরি হয়ে গিয়েছে! বেশ কয়েকটা মূল্যবান জিনিস নিয়ে গিয়েছে চোরের দল৷ তিনি বেলা বারোটা নাগাদ আমাদের এখানে আসবেন৷ আর একটা কথা তিনি জানালেন, আজ সন্ধ্যের ট্রেনে তিনি আমাদের নিয়ে লাক্সরের উদ্দেশে রওনা হবেন৷ যদিও কারণটা তিনি আমাকে টেলিফোনে জানাননি৷’

ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে এই খবর পেয়ে আমিও খুব আশ্চর্য হয়ে গেলাম৷ এর পর আমি আর বিছানায় শুলাম না৷ মুখ-হাত ধুয়ে, ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ আস্তে আস্তে জেগে উঠছে কায়রো শহর৷ বাতাসে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব৷ বেশ ভালোই লাগছিল ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে৷

ছ-টা নাগাদ অংশুর ঘুম ভাঙল৷ ডা. ঘটকও ইতিমধ্যেই ফ্রেশ হয়ে নিয়েছিলেন৷ কিন্তু ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে সাতটা বেজে গেল৷ ডা. ঘটক বললেন, ইচ্ছে হলে আমি সকাল বেলা কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসতে পারি৷ তবে তিনি যাবেন না৷ ডা. নাসের যদি আবার ফোন-টোন করেন বা হঠাৎ চলে আসেন, তাই তিনি হোটেলেই থাকবেন৷

আমিও চিন্তা করলাম হোটেলে না বসে থেকে শহরটা দেখে নেওয়াই ভালো৷ ডা. নাসের তো আর বারোটার আগে আসবেন না! ঘণ্টা চারেক অন্তত বেড়াবার সময় পাওয়া যাবে৷ আমি শহর দেখতে যাব শুনে অংশুও বলল, সেও আমার সঙ্গে যাবে৷ ডা. ঘটক সম্মতি দিলেন৷ আটটা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম হোটেল ছেড়ে৷ কিন্তু হোটেল কম্পাউন্ড ছেড়ে বড়ো রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই মনে হল, কোথায় যাব! কায়রো শহরের কিছুই তো আমাদের জানা নেই৷ কাছে যে বাজারটা আছে, তার কী নাম, কোনদিকে সেটা, তাও জানা নেই! ভাবলাম, হোটেলের রিসেপশন থেকে জেনে আসি৷ ঠিক তখনই আমার মনে পড়ে গেল কায়রো শহরের একটা জায়গার নাম, ‘মাইদান তহরির’৷ ডা. নাসেরের মুখে শুনেছি এই নামটা৷ জায়গাটা নাকি শহরের প্রাণকেন্দ্র, অনেকটা কলকাতার ধর্মতলা বা বিবাদি বাগের মতো৷

একটা ট্যাক্সি থামিয়ে আমরা উঠে পড়লাম৷ ড্রাইভার ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে অবিশ্রান্ত বকবক করতে করতে আমাদের নিয়ে ছুটে চলল মাইদান তহরির দিকে৷ পথে যেতে যেতে বিশাল বড়ো একটা বিল্ডিং চোখে পড়ল৷ বেশ কয়েকটা দেশের পতাকা উড়ছে সেখানে৷ তার প্রবেশ তোরণের সামনে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে বিরাট পুলিশবাহিনী৷ ড্রাইভার জানাল এই বাড়িটাই হল আরব লিগের হেড কোয়ার্টার৷ আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম মাইদান তহরিতে৷ গাড়ি থেকে নেমেই জায়গাটার মাহাত্ম্য বুঝতে পারলাম৷ চারদিকে সব চোখ-ধাঁধানো বড়ো বড়ো বাড়ি, অফিস, শপিংমল৷ ন-টা এখনও বাজেনি, কিন্তু লোকজনের ভিড় ভালোই৷ রাস্তায় যান চলাচলও করছে প্রচুর৷ যেখানে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম তার সামনেই একটা পিৎজার দোকান৷ যদিও প্রাতরাশ সেরে এসেছি তবুও ঢুকলাম দোকানটায়৷ কাউন্টারে টাকা জমা দিয়ে ল্যাম্ব পিৎজা আর দু-রকম পানীয় নিলাম৷ আমার জন্য কফি আর অংশুর জন্য মিল্কশেক৷ দোকানের ভিতরটা বেশ বড়ো৷ অনেক লোক বিভিন্ন টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে খাচ্ছে৷ কোনার দিকে একটা টেবিলে বসলাম আমি আর অংশু৷ খেতে খেতে দু-জন গল্প করতে লাগলাম৷ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তার কেমন লাগছে বেড়াতে?

সে বলল, খুব ভালো৷ কিন্তু সে একটা আক্ষেপও করল৷ তার হোমের বন্ধুরা নাকি কিছুতেই বিশ্বাস করবে না সে পিরামিড দেখেছে! আমি তখন তাকে বললাম, আমি যে ফোটোগুলো তুলছি তার একটা করে কপি তাকে উপহার দেব৷ সেগুলো দেখার পর তার বন্ধুরা নিশ্চয়ই তার কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে৷ কথাটা শোনার পর আশ্বস্ত হল সে৷ কথা বলতে বলতে আমাদের খাওয়া যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে ঠিক তখনই অংশু হঠাৎ কথা বন্ধ করে আমার পিছন দিকে তাকাল৷ আর তার পর মুহূর্তেই একটা প্রশ্ন আমার কানে এল, ‘আপনারা কি ইন্ডিয়ান?’

আমি বসে ছিলাম দরজার দিকে পিছন ফিরে৷ কথাটা কানে আসার সঙ্গেসঙ্গে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম, আমার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে একজন লোক৷ কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আমি চিনে ফেললাম লোকটিকে৷ লোকটা হল পরশু সন্ধ্যের সেই আলতুনিয়া৷ আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে তার প্রশ্নটা আবার করল৷ আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, আমরা ইন্ডিয়ান৷’

এবার সে প্রশ্ন করল, ‘নাসেরকে আপনারা চেনেন?’

লক্ষ করলাম, নাসের শব্দটা উচ্চারণ করার সময় তার গলায় কেমন একটা তাচ্ছিল্যের ভাব ফুটে উঠল৷ সে কী বলতে চাইছে বুঝতে না পেরে আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে৷

আলতুনিয়া তার সোনা-বাঁধানো দাঁতগুলো বের করে হাসল৷ তারপর বলল, ‘নাসেরকে আপনারা চেনেন না, ও একটা খুনি৷ কায়রো শহরের যেকোনো পুরোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করলেই আপনারা বুঝতে পারবেন, আমি সত্যি বলছি কি না৷’

এই বলে আর একবার দাঁত বের করে হেসে কাচের দরজা ঠেলে দোকানের বাইরে বেরিয়ে গেল৷ আমি বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম খোলা দরজাটার দিকে৷ তারপর হাত ধুয়ে অংশুকে নিয়ে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ালাম৷

আমার মনের মধ্যে শুধু ঘুরতে লাগল আলতুনিয়ার কথাটা৷ ডা. নাসেরের মুখে লোকটার সম্বন্ধে যতটুকু শুনেছি, তাতে এ জাতীয় লোকের মুখে মিথ্যে কথা খুব সামান্য ব্যাপার৷ আর ডা. নাসেরকে দেখে কখনোই মনে হয় না, তিনি একজন খুনি৷ হয়তো ডা. নাসেরের প্রতি বিদ্বেশবশতই সে কথাটা বলে গেল আমাকে৷

এসব ভাবতে ভাবতে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম আমরা৷ রাস্তার পাশে বড়ো বড়ো সব দোকান, তার অধিকাংশই জামা-জুতোর৷ আর আছে বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন সামগ্রী বা অ্যান্টিকের দোকান৷ দুটো বহুতল শপিং মলের মধ্যে দিয়ে একটা লম্বা সরু গলি চলে গিয়েছে৷ আমরা ঢুকে পড়লাম সেই গলির মধ্যে৷ গলির দু-পাশে সারি সারি প্যাপাইরাস আর মিশরীয় চিত্রশিল্পের দোকান৷ ‘প্যাপাইরাস হাউজ’ নামের একটা দোকানের ভিতর ঢুকলাম আমি আর অংশু৷ বেশ বড়ো দোকান, ভিতরে টাঙানো রয়েছে প্যাপাইরাসের উপর আঁকা মিশরীয় চিত্রকলার অপূর্ব সব সম্ভার৷ ফ্যারাওদের জীবনযাত্রা, প্রাচীন মিশরের নানা দেবদেবী, বিভিন্ন ফ্যারাওদের ফোটো, পিরামিড তৈরির দৃশ্য, কী নেই সেই ফোটোর মধ্যে! নিপুণ হাতে সব কিছু আঁকা হয়েছে৷ একটা জিনিস লক্ষ করলাম, সব ফোটোতেই নীল রঙের ব্যবহার খুব বেশি৷

কায়রো মিউজিয়াম বা গিজার পিরামিডের সুড়ঙ্গেও এই একই জিনিস লক্ষ করেছি৷ দোকান থেকে প্যাপাইরাসের উপর আঁকা দশটা গ্রিটিংস কার্ড কিনলাম, দেশে ফিরে তা পরিচিতজনদের উপহার দেব বলে৷ প্রত্যেকটা কার্ডের দাম নিল পাঁচ ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড৷ দোকানের মালিক একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক৷ কীভাবে প্যাপাইরাস থেকে কাগজ তৈরি করা হয় তা জানতে চাই শুনে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন দোকানের পিছনে কারখানায়৷ সেখানে জনাদশেক লোক কাজ করছে৷ প্রথমে প্যাপাইরাসের ডাঁটাগুলোকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে জলে ভিজিয়ে রাখা হয়৷ তারপর সেগুলোকে আবার লম্বালম্বিভাবে চিরে কাঠের ভারী ব্লকের নীচে চেপে কাগজ তৈরি করা হয়৷ দোকানের মালিক সব কিছু ঘুরিয়ে দেখালেন আমাদের৷ অংশুকে তিনি বেশ বড়ো এক খণ্ড কাগজও উপহার দিলেন৷ ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে যখন আমরা দোকানের বাইরে বেরোতে যাব তখন অংশু দরজার কোনে টাঙানো একটা ফোটোর দিকে এগিয়ে গেল৷ তারপর ভালো করে দেখতে লাগল ফোটোটা৷ আমিও গিয়ে দাঁড়ালাম তার পিছনে৷ ফোটোটা বেশ বড়ো৷ আনুবিসের ফোটো, প্রাচীন মিশরের এই শিয়ালদেবতা ছিলেন মমি তৈরির দেবতা, কেউ কেউ বলেন, ‘মৃত্যুর দেবতা’৷ ফোটোতে সে থাবা বাড়িয়ে বসে আছে৷ ছুঁচলো মুখ, সোনালি রঙের খাড়া কান, গলা আর মাথা কালচে নীল বর্ণের৷ বেশ কিছুক্ষণ ফটোটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর অংশু আমার দিকে ফিরে বলল, ‘ওকে আমি চিনতে পেরেছি৷’

আমি বললাম, ‘কাকে?’

প্রথমে সে ফোটোটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল৷ তারপর বলল, ‘কাল রাতে স্বপ্নের মধ্যে আমি ওকে চিনতে পেরেছি৷ অন্ধকারের মধ্যে আমি শুয়ে ছিলাম আর দেখতে পাচ্ছিলাম ওর জ্বলন্ত চোখ দুটো৷ ও আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল, আমি উঠে বসতে পারছিলাম না৷ তারপর একসময় আস্তে আস্তে অল্প আলো ফুটে উঠল ঘরের মধ্যে৷ অনেক উঁচু থেকে আসছিল আলোটা৷ সেই আলোয় আমি দেখতে পেলাম, ও আমার সামনে বসে আছে৷’

এই বলে অংশু চুপ করে গেল৷ আমি প্রশ্ন করলাম, ‘তারপর?’

অংশু বলল, ‘ওকে দেখে আমি আরও ভয় পেয়ে উঠে বসতে গেলাম৷ তাই দেখে ও এগিয়ে আসতে লাগল আমার দিকে৷ আমি উঠতে পারলাম না, ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম৷ তারপর কী হল আমার মনে নেই৷ যখন চোখ খুললাম তখন দেখি, আমি বিছানায় শুয়ে আছি৷ ভোর হয়ে গিয়েছে৷’

এর পর আর একমুহূর্ত দোকানের মধ্যে দাঁড়াল না অংশু৷ প্রায় ছুটেই দোকানের বাইরে বেরিয়ে রাস্তার নেমে দাঁড়াল৷ সেখান থেকে ট্যাক্সি ধরে সাড়ে এগারোটা নাগাদ হোটেলে পৌঁছে গেলাম আমরা৷ হোটেলে পৌঁছোবার পর ডা. ঘটক আমাদের জানালেন, ডা. নাসের আবার টেলিফোন করেছিলেন৷ গোছগাছ সব করে রাখতে হবে৷ সন্ধ্যে সাতটায় লাক্সরের ট্রেন৷ হোটেল ছেড়ে চেক আউট করতে হবে আমাদের৷ আমি ঘরে টুকিটাকি জিনিস ব্যাগের মধ্যে গুছিয়ে রাখতে শুরু করলাম৷ কিছুক্ষণ পর ডোরবেলের শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম ডা. নাসের এসে গিয়েছেন৷ ডা. ঘটকই গিয়ে দরজাটা খুললেন৷ আমি বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে৷ ডা. নাসেরকে দেখেই বুঝলাম, তাঁর চোখে-মুখে কেমন একটা ক্লান্তির ছাপ৷ কালকের পোশাকটাই রয়েছে তাঁর পরনে৷ দেখে মনে হল, পোশাক পরিবর্তনের সময়ও তিনি পাননি৷ ভিতরে ঢুকেই তিনি প্রথমে ঢকঢক করে এক গ্লাস জল খেলেন৷ এর পর অংশুর জন্য টিভি সেটটা চালিয়ে আমরা গিয়ে বসলাম ডা. ঘটকের ঘরে৷

কোনোরকম ভূমিকা না করেই ডা. নাসের বললেন, ‘কাল রাতে আপনাদের এখান থেকে বেরিয়ে প্রথমে ভাবলাম, বাড়ি চলে যাই৷ তারপর আবার ভাবলাম, রাত তো খুব একটা বেশি হয়নি, বরং একটা অনুসন্ধানের কাজ সেরে যাই৷ তাই কাল অংশুর মা-র চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কাগজটা আপনাদের কাছ থেকে পেলাম, তাতে যে নার্সিংহোমের ঠিকানা লেখা ছিল, গিয়ে হাজির হলাম সেখানে৷ নার্সিংহোমটা নীলনদের দ্বিতীয় সেতুর কাছে পিরামিড রোডে৷ নার্সিংহোমের মালিক আমার বিশেষ পরিচিত৷ পেশার সূত্রে আগে বেশ কয়েকবার আমি সেখানে গিয়েছি৷ সেখানে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল, তাদের রেকর্ড দেখে কায়রোয় অংশুর মা-বাবার ঠিকানা ইত্যাদি সংগ্রহ করা যায় কি না৷ মালিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে সব তথ্য আমি সংগ্রহ করলাম৷ এবং বলা যেতে পারে যেটুকু তথ্য আমি পাব বলে ভেবেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি তথ্য পেলাম৷ তবে সেসব ব্যাপার আমি আপনাদের পরে বলব, শুধু এটুকু বলে রাখি, সেখানে গিয়ে আমি জানতে পেরেছি, সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর অংশুর বাবাকেও তার মা-র সঙ্গে আনা হয় ওই নার্সিংহোমে৷ সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়৷ এবং দুর্ঘটনা ঘটার সময় অংশুও তার বাবা-মার সঙ্গে ছিল৷ যাই হোক, নার্সিংহোম থেকে বাইরে বেরোতে বারোটা বেজে গেল৷ সাড়ে বারোটা নাগাদ আমি গিয়ে পৌঁছোলাম আমার আস্তানায়৷ আমার ফ্ল্যাটটা তিনতলায়৷ গত দু-দিন ধরে কী একটা কারণে আমাদের অঞ্চলে সন্ধ্যের পর থেকেই বিদ্যুৎ থাকছে না৷ আসছে সেই গভীর রাতে৷ কালও তার ব্যতিক্রম হয়নি৷

‘অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে আমি উপরে উঠলাম৷ তারপর পকেট থেকে চাবি বের করে তালাটা খুলতে যেতেই দেখি, তালাটা খোলা! ভাবলাম, হয়তো তালাটা ঠিকমতো বন্ধ করে যাইনি৷ কারণ, তাড়াহুড়োয় এর আগে এ-ধরনের ঘটনা দু-একবার ঘটেছে৷ দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম, আর সেই মুহূর্তেই বিদ্যুৎ চলে এল৷ আর তার সঙ্গেসঙ্গে যা দেখলাম, তাতে আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ দেখলাম, আমার বসবার ঘরের সব কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে৷ ছুটে গেলাম শোওয়ার ঘরে৷ সেখানেও একই অবস্থা৷ আমার আলমারি, দেরাজ সব কিছু হাট করে খোলা! বেশ কয়েক মিনিট আমার সময় লাগল ব্যাপারটা কী হয়েছে বুঝে উঠতে৷ তারপর বুঝলাম, চোর ঢুকেছিল ঘরে৷ তবে তারা সাধারণ চোর নয়৷ আলমারিতে হাজার দশেক ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড ছিল৷ সেগুলো তারা হাতে পেয়েও নিয়ে যায়নি৷ কাগজপত্রগুলো তারা বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেছে৷ পরে বুঝতে পারলাম, তারা কী নিয়ে গিয়েছে৷ নিয়ে গিয়েছে এক দুর্মূল্য প্যাপাইরাসের খণ্ডিতাংশ৷ বাকিটা ভল্টে রাখা ছিল বলে বেঁচে গিয়েছে৷ আর নিয়ে গিয়েছে অংশুর ভয়েস রেকর্ড করা সেই অডিও ক্যাসেটটা৷’ এই বলে থামলেন তিনি৷

ডা. ঘটক প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি পুলিশে খবর দিয়েছেন?’

তিনি বললেন, ‘না৷ কারণ, আমার ধারণা, তারা এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবে না৷ শুধু শুধু ঝামেলা বাড়বে৷’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?’

ডা. নাসের বললেন, ‘হ্যাঁ হয়, আলতুনিয়াকে৷ কিন্তু আমার হাতে কোনো প্রমাণ নেই৷ বেশ কিছুদিন ধরেই ও এই প্যাপাইরাসটা হাতাবার চেষ্টা করছিল৷’

ডা. নাসের আলতুনিয়ার কথা বলায় আমি একবার ভাবলাম, সকাল বেলার ঘটনাটা তাঁকে বলি৷ কিন্তু আলতুনিয়া বলেছে তিনি খুনি, এ কথাটা তাঁকে বলতে কেমন যেন বাধল আমার৷ তাই আর কথাটা তুললাম না৷ মনে মনে ভাবলাম, পরে ডা. ঘটককে বলব ব্যাপারটা৷ ডা. নাসের এর পর বললেন, ‘আমি আর এখন বসব না৷ কায়রো ছাড়ার আগে আমাকে আরও বেশ কিছু কাজ সেরে নিতে হবে৷ ঠিক সময় আমি আপনাদের নিতে আসব৷’

এই বলে তিনি যখন চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছেন তখন ডা. ঘটক তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আপনাকে একটা প্রশ্ন করব?’

ডা. নাসের বললেন, ‘না না৷ মনে করব কেন! আপনি বলুন কী জানতে চান?’

ডা. ঘটক বললেন, ‘আমরা যে আজ লাক্সর যাত্রা করব তা কি নিছকই ভ্রমণের জন্য, নাকি অন্য কিছু ব্যাপার আছে?’

ডা. নাসের বললেন, ‘প্রথমত, মিশরের পুরাতত্ত্বের ভাণ্ডার বলতে লাক্সরকেই বোঝায়৷ আইফেল টাওয়ার না দেখলে যেমন ফ্রান্স ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না, মিশরের ক্ষেত্রে তেমনই হল লাক্সর৷ এটা হল ওখানে যাওয়ার একটা কারণ৷ আর দ্বিতীয়টা হল, আমার ধারণা লাক্সরের সঙ্গে অংশুর ব্যাপারটার কোথাও একটা যোগসূত্র আছে৷ এটাই আমার লাক্সর ভ্রমণের প্রধান কারণ৷ হয়তো লাক্সরে গেলে অংশুর অদ্ভুত অসুখের কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া গেলেও যেতে পারে৷ আমার এ ধারণা কেন হয়েছে তা আপনাদের আমি রাতে ট্রেনে যেতে যেতে বলব৷’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *