রানি হাটশেপসুটের মমি – ৪

সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ ডা. নাসের হোটেলে চলে এলেন৷ তিনি আসার সময় অংশুর জন্য ‘কিং কং অ্যালাইভ’ নামের একটা সিনেমার সিডি এনেছিলেন৷ সেটা চালিয়ে দেওয়ার পর অংশু দেখতে বসল৷ আর আমরা ডা. ঘটকের ঘরে বসলাম আলোচনার জন্য৷

ডা. নাসেরই প্রথম মুখ খুললেন৷ তিনি ডা. ঘটকের উদ্দেশে বললেন, ‘যদিও ব্রাসেলসে মেডিক্যাল কনফারেন্সে গিয়ে সারা রাত ধরে অংশুর অসুখ সম্বন্ধে আপনার মুখ থেকে পুরো ব্যাপারটাই শুনেছি এবং অসুস্থ অবস্থায় অংশুর যে কথাবার্তা আপনি ক্যাসেটবন্দি করে আমাকে পাঠিয়ে ছিলেন, তাও শুনেছি৷ তবুও আর একবার প্রথম থেকে আমি তা শুনতে চাই৷ কারণ, আমার বয়স হয়েছে তো! কোনো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আমি ভুলে গিয়ে থাকতে পারি৷ তা ছাড়া শুনতে শুনতে যদি মনের মধ্যে নতুন কোনো প্রশ্ন জাগে, তাহলে আমি তা এখনই জেনে নিতে পারব৷’

ডা. নাসেরের কথা শুনে ডা. ঘটক বললেন, ‘তাহলে একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করা যাক৷ অংশুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় বছর তিনেক আগে৷ একদিন সন্ধ্যে বেলা আমি আর আমার তরুণ বন্ধু দাবা খেলছিলাম আমার কলকাতার বাড়ির একতলার চেম্বারে বসে৷ সকাল থেকেই সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, বিকেলেও তার বিরাম নেই৷ ফলে অন্য দিনের মতো রোগী দেখার চাপ ছিল না৷ রাত আটটা নাগাদ সাদা পোশাকপরা এক ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন আমার চেম্বারে৷ নিজের পরিচয় দিলেন তিনি ফাদার ডিসুজা বলে৷ কলকাতার একটা অরফান হোম চালান তিনি৷ তাঁর হোমে একটা ছোটো ছেলে বুকের যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছে৷ তাই তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে যেতে এসেছেন৷ আমি তাঁকে বললাম, আপনাদের হোমের নিজস্ব কোনো ডাক্তার নেই? তিনি উত্তর দিলেন, ছিলেন৷ তিনি বৃদ্ধ হয়েছিলেন৷ মাত্র দিন কয়েক আগে মারা গিয়েছেন৷ অগত্যা খেলা বন্ধ করে আমাকে উঠে পড়তে হল৷ মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তৈরি হয়ে নিয়ে আমি চড়ে বসলাম ফাদার ডিসুজার সঙ্গে আনা গাড়িতে৷

‘আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম অরফ্যান হোমে৷ গাড়ি থেকে নামার পর ফাদার আমাকে নিয়ে গেলেন রোগীর ঘরে৷ ঘরটা ছোটো, তাতে সামান্য কিছু আসবাবপত্র আছে৷ ঘরে ইলেকট্রিক বালব ছিল না৷ টেবিলের উপর শুধু একটা মোমবাতি জ্বলছিল৷ তার মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ঘরে৷ সেই আলোয় দেখলাম, একটা বছর সাতেকের ছোটো ছেলে বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করছে৷ কাছে যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম, ও যেন মাঝে মাঝে কীসব বলছে৷ কিন্তু কী বলছে তা আমি বুঝতে পারলাম না৷ সে চোখ বুজে আছে, আর ডান হাত দিয়ে তার বাঁ দিকের বুকের কাছটা খামচে ধরে আছে৷ দেখে মনে হল, যন্ত্রণাটা বুকেই হচ্ছে৷

‘আমি প্রথমে তার খাটের পাশে বসলাম৷ তারপর হার্টবিট পরীক্ষা করার জন্য আমার পোর্টেবল ইকো-কার্ডিওগ্রাফ যন্ত্রটা বের করলাম ব্যাগ থেকে৷ যন্ত্রটা দেখতে অনেকটা ল্যাপটপের মতো৷ তাতে একটা এল সি ডি স্ক্রিন বা পরদা আছে৷ হৃৎস্পন্দনের রেখাচিত্র ফুটে ওঠে সেখানে৷ যন্ত্রের তারটা ছেলেটির বুকে লাগাতে একটু বেগ পেতে হল আমাকে৷ কিছুতেই ছেলেটি বুক থেকে হাত সরাতে চাইছিল না৷ শেষে জোর করে হাতটা সরাতে হল৷ ছেলেটির সারা শরীর যন্ত্রণায় মোচড় দিচ্ছিল৷ কোনোরকমে তারটা এয়ার ক্লিপের সাহায্যে লাগালাম৷ তারটা যাতে সে খুলে ফেলতে না পারে, তার জন্য একটা হাত আমি, আর অন্য হাতটা ফাদার চেপে ধরে রইলেন৷ যন্ত্রটা চালু করে দিতেই তাতে ফুটে উঠল তার হৃৎস্পন্দন রেখাচিত্র৷

‘দেখলাম উল্লম্ব রেখাগুলো তীব্র গতিতে উপর-নীচে ওঠা-নামা করছে৷ অর্থাৎ তার হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি৷ এই অবস্থায় যে-কোনো মুহূর্তে হার্টফেল করতে পারে ছেলেটা! কেন এমন হচ্ছে তা ভাবতে গিয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম৷ ফলে হাতের মুঠিটাও হয়তো আলগা হয়ে গিয়েছিল৷ সেই সুযোগে এক ঝটকায় ছেলেটি হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বুক থেকে খুলে ফেলল তারটা৷ তারপর বুকটা আগের মতো খামচে ধরে দুর্বোধ ভাষায় কী একটা বলে উঠে ছটফট করতে করতে কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ল৷ শুধু তার শরীরটা মৃদু কাঁপতে থাকল৷ আমি আবার তাড়াতাড়ি তারটা লাগিয়ে দিলাম তার বুকে৷ এবার কিন্তু সেটা লাগাতে খুব একটা বেশি বেগ পেতে হল না৷ তার হাতটা খুব শিথিল বলে মনে হল৷ যন্ত্রটা চালু হয়ে গেল সঙ্গেসঙ্গেই৷ কিন্তু পরদায় চোখ পড়তেই আমি দেখতে পেলাম, সেই দ্রুত উপর-নীচ করা উল্লম্ব রেখাগুলো উধাও হয়েছে৷ তার বদলে পরদা জুড়ে একটা সমান্তরাল সরলরেখা তিরতির করে কাঁপছে৷ হৃৎস্পন্দন থেমে গিয়েছে ছেলেটার! সম্ভবত হার্টফেল করেছে৷ আমি ফাদারের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি দুঃখিত, কিছু করতে পারলাম না! ফাদার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি নিশ্চিত যে, ও আর নেই! ওর আগে যখন বুকে ব্যথা হয়েছিল তখনও কিন্তু ও যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে এরকম নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল৷ তারপর আবার ধীরে ধীরে ওর চেতনা ফিরে এসেছিল৷ আমি বললাম, আগে কী হয়েছিল আমি বলতে পারব না৷ তবে এবার আর ও জেগে উঠবে না৷’

ডা. ঘটক একটু জল খেলেন, তারপর ডা. নাসেরের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন, ‘আমার আপনার যা পেশা তাতে চোখের সামনে মৃত্যু দেখাটা আশ্চর্য কিছু নয়৷ কিন্তু চোখের সামনে একটা ফুটফুটে ছোটো ছেলের মৃত্যু দেখে মনটা খারাপই লাগছিল৷ আরও খারাপ লাগছিল কিছু করতে পারলাম না বলে৷ বেশ কিছুক্ষণ তার খাটের পাশে মাথা নীচু করে বসে রইলাম আমি৷ হঠাৎ ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে ঘর সংলগ্ন একচিলতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷ ফাদারও আমার সঙ্গে এসে বারান্দায় দাঁড়ালেন৷ বৃষ্টিটা দেখলাম, থেমে গিয়েছে৷ মেঘের আড়াল থেকে উঁকি মারছে গোল চাঁদ৷ আজ মনে হয় পূর্ণিমা৷ ছেলেটির ডেথ সার্টিফিকেট আমাকেই লিখে দিতে হবে৷ তাই ছেলেটির নাম ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চাইলাম ফাদারের কাছে৷ তখনই শুনতে পেলাম, ওর নাম অংশু৷ বছর তিনেক ধরে আছে ফাদারের অরফ্যান হোমে৷ ও যখন ফাদারের কাছে এসেছিল তখন ও ছিল বছর চারেকের৷ ফাদারের কাছে এও জানতে পারলাম, এর আগে ও বারতিনেক এরকমই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল৷ আমি ফাদারকে জিজ্ঞেস করলুম, ওকে আগে কোনো ভালো ডাক্তার দেখেছিলেন কি না৷ ফাদার একটু ম্রিয়মাণ হয়ে বললেন যে, ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় আর্থিক কারণে তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না৷ সামান্য অনুদানের উপর নির্ভর করে অরফ্যান হোম চালাতে হয় তাঁকে৷ তা ছাড়া অংশুর অসুস্থতা কখনোই দিন দুয়েকের বেশি স্থায়ী হয়নি৷

‘যাই হোক, নানা কথাবার্তা বলতে বলতে মিনিট পনেরো কেটে গেল৷ তারপর আমি এসে বসলাম ছেলেটির খাটের পাশে৷ যদিও ঘণ্টা তিনেকের আগে নিয়মমতো ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া ঠিক নয়, তবুও ভাবলাম, ওটা ফাদারকে এখনই দিয়ে যাই৷ কী আর হবে তাতে৷ প্যাড বের করে লিখে ফেললাম সেটা৷ সার্টিফিকেটের উপর চোখ বুলিয়ে ফাদারের হাতে যখন সেটা তুলে দিতে যাচ্ছি, তখনই হঠাৎ আমার নজর পড়ল ছেলেটির বুকের দিকে৷ সার্টিফিকেটটা ফাদারের দিকে বাড়িয়ে দিয়েও আমার হাতটাকে কোলের কাছে গুটিয়ে আনলাম৷ মনে হল, ছেলেটির বুকের কাছটা যেন ক্ষীণভাবে ওঠানামা করছে৷ এর পর আমি ধীরে ধীরে ফিরে তাকালাম আমার যন্ত্রের পর্দার দিকে৷ কারণ, তারটা আমি তখনও ছেলেটার বুক থেকে খুলিনি৷

‘তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার নিজের হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়৷ দেখি, সেই উল্লম্ব রেখাগুলো আবার খেলা করতে শুরু করছে পর্দা জুড়ে৷ অর্থাৎ ছেলেটির হৃদযন্ত্র আবার চলতে শুরু করেছে৷ এরকম যে কখনো ঘটে না তা নয়৷ তবে কোটিতে বা লাখে একটা ঘটে৷ আরও এক ঘণ্টা পরে যখন আমি ফাদারের সঙ্গে তাঁর অরফ্যান হোম ছেড়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম, তখন ছেলেটি ঘুমিয়ে পড়েছে বিছানায়৷ এবং তার হৃৎস্পন্দন তখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক৷ ফাদার যখন আমার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলেন, তখন আমি তাঁকে বলে দিলাম যে, পরদিন আমি নিজেই আবার দেখতে যাব অংশুকে৷

‘কেন এরকম হল! সারারাত ভাবতে ভাবতে আমার ঘুম এল না৷ পরদিন সকাল বেলা আমি আবার গিয়ে হাজির হলাম সেখানে৷ ফাদার ডিসুজা অফিসঘরে ডেকে আনালেন অংশুকে৷ দেখলাম, ও প্রায় সম্পূর্ণ সুস্থ৷ শুধু শরীরটা সামান্য দুর্বল৷ এ ছাড়া তেমন কিছু লক্ষ করলাম না৷ ফাদারের সঙ্গে এর পর কিছু সৌজন্যসূচক আলোচনা করে আমি উঠে পড়লাম৷ আর তার আগে ফাদারকে আমি আমার টেলিফোন নাম্বার দিয়ে বলে এলাম যে, ভবিষ্যতে যদি অংশু আবার এরকম অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে তিনি যেন তৎক্ষণাৎ আমাকে খবর দেন৷

‘এর পর আমি আবার ডুবে গেলাম দৈনন্দিন কাজের ব্যস্ততায়৷ ঘটনাটা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম৷ কিন্তু মাস সাতেক পর হঠাৎই একদিন সন্ধ্যে বেলা ফাদারের টেলিফোন পেলাম৷ আর সেদিনই আমি সচেতনভাবে প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম সেই আশ্চর্য ঘটনা৷ যন্ত্রণাকাতর অংশুর হৃৎপিণ্ড মিনিট দশেকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল৷ তারপর হঠাৎই আবার তা নিজে থেকে কাজ শুরু করল৷

‘অংশুর ব্যাপারটা পেয়ে বসে আমাকে৷ ঘটনাটা এর পর বারকয়েক প্রত্যক্ষ করলেও এই অসম্ভব ঘটনা কীভাবে ঘটছে তার কোনো সমাধানসূত্র খুঁজে পাইনি আমি৷ তাই ব্রাসেলসে গল্প করতে করতে আপনাকে বলি ঘটনাটা৷ যদিও আমার ভয় ছিল যে, ঘটনাটা শোনার পর আপনি আমার মানসিক সুস্থতা সন্দেহ প্রকাশ করতে পারেন৷’

এর পর ডা. ঘটক কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ডা. নাসের তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখন বলুন অংশুর পিতৃপরিচয় বা পাস্ট হিস্ট্রি সম্পর্কে কতটুকু তথ্য আপনার জানা আছে?’

ডা. ঘটক বললেন, ‘বিভিন্ন সময় আলোচনা প্রসঙ্গে ফাদারের মুখ থেকে যতটুকু এ ব্যাপারে আমি শুনেছি তা হল, অংশুর বাবা ছিলেন মিশরীয় আর মা ভারতীয়৷ কায়রোয় একটা তেল কোম্পানিতে চাকরি করতেন ওর বাবা-মা৷ ওর মা এই চাকরির সুবাদেই মিশরে আসেন ও মিশরীয় ভদ্রলোককে বিয়ে করেন৷ অংশুর যখন মাত্র এক বছর বয়স তখন এক মোটর অ্যাক্সিডেন্টে অংশুর বাবার মৃত্যু হয় ও অংশুর মা মারাত্মকভাবে জখম হন৷ ভদ্রমহিলা সাময়িকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠার পর অংশুকে নিয়ে ফিরে যান ইন্ডিয়ায়৷ তারপর তিনি আশ্রয় নেন বেনারসের এক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের কাছে৷ ভদ্রমহিলার বাবা-মা, ভাই-বোন, নিকটাত্মীয় কেউ ছিলেন না৷ কিন্তু দেশে ফিরবার পর ভদ্রমহিলা আর কোনোদিন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি৷ বছর দেড়েকের মধ্যেই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে যান৷ যে ভদ্রলোকের কাছে অংশুকে রেখেছিলেন, বার্ধক্য এবং সম্ভবত আর্থিক কারণে তিনি আর অংশুর দায়িত্ব নিতে চাননি৷ তাকে তিনি তুলে দেন বেনারসের এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের হাতে৷ কিছুদিন পর তাঁরা আবার অংশুকে পাঠিয়ে দেন কলকাতায় ফাদার ডিসুজার অনাথালয়ে৷’

ডা. নাসের আবার প্রশ্ন করলেন, ‘অংশুর বাবা-মার নাম, কায়রোয় তাঁরা কোথায় থাকতেন, কোন কোম্পানিতে চাকরি করতেন এসব সম্পর্কে কিছু জানেন কি?’

ডা. ঘটক বললেন, ‘মা-র নামটা জানি, রুক্মিণী৷ এ ছাড়া অন্য কিছু বলতে পারব না৷ তবে আমার কাছে একটা কাগজের ফোটোকপি আছে, হয়তো আপনি সেটা পেলে আপনার কোনো কাজে আসতে পারে৷’ এই বলে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে ব্রিফকেসের ভিতর থেকে একটা কাগজ বের করে ডা. নাসেরের দিকে এগিয়ে দিলেন৷

কাগজটা খুলতে খুলতে ডা. নাসের জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী এটা?’

‘কায়রোয় অংশুর মা-র চিকিৎসা সংক্রান্ত একটা কাগজ, ফাদার ডিসুজা আমাকে দিয়েছিলেন৷ অংশু যখন অরফ্যান হোমে আসে তখন তার কাগজপত্রের মধ্যে এটা ছিল৷’ উত্তর দিলেন ডা. ঘটক৷

কাগজটার উপরে বেশ কিছুক্ষণ চোখ বোলালেন ডা. নাসের৷ তারপর বললেন, ‘কাগজটা সত্যিই আমার কাজে আসবে৷ একটা শেষ প্রশ্ন আমি এখন আপনাকে করতে চাই, অংশুর অসুস্থতার আগে বা পরে তার মধ্যে অন্য কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন কি?’

ডা. ঘটক বললেন, ‘না, এমনি কোনো পরিবর্তন দেখিনি৷ তবে ও অসুস্থ হওয়ার কয়েক দিন আগে রাতে নাকি ঘুমের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিল৷ তা হল, একটা অন্ধকার ঘরে নাকি একলা শুয়ে আছে ও৷ আর অন্ধকারের মধ্যে দুটো জ্বলন্ত চোখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে৷ ও সেখান থেকে উঠে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই উঠে বসতে পারে না৷ কেউ যেন ওর হাত-পা বেঁধে রেখেছে মাটির সঙ্গে৷ আর একটা কথাও বলেছিল ও৷ যেখানে ও শুয়ে থাকে সে জায়গাটা নাকি খুব ঠান্ডা৷ প্রত্যেকবারই ও এই একই স্বপ্ন দেখে৷’

আমি এতক্ষণ শ্রোতার ভূমিকা পালন করছিলাম৷ ডা. ঘটকের উদ্দেশে এবার আমি বললাম, ‘অংশু কিন্তু কাল রাতে আবার সেই একই স্বপ্ন দেখেছে৷ আজ দুপুর বেলা শুয়ে শুয়ে ও সেই কথাটা বলেছে আমাকে৷’

ডা. নাসের বললেন, ‘তার মানে ব্যাপারটা আবার ঘটতে চলেছে৷’

ডা. ঘটক বললেন, ‘অংশুর কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে আর দিন ছয়-সাতেকের মধ্যেই আপনি দেখতে পাবেন সেই আশ্চর্য ঘটনা৷ এর পর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ডা. ঘটক৷ তারপর ডা. নাসেরের উদ্দেশে বললেন, ‘অংশুর ব্যাপারে আপনার মতামত কী?’

প্রশ্নটা শুনে ডা. নাসের প্রথমে কী যেন একটু চিন্তা করলেন৷ তারপর বললেন, ‘এ ব্যাপারে এখনও মতামত দেওয়ার সময় আসেনি৷ তবে আমি আপনাদের কয়েকটা কথা বলি৷ ব্রাসেলসে যখন আমি অংশুর ব্যাপারটা প্রথম শুনি, তখন আমার মনে হয়েছিল, গ্রেট আর্টারিজে রক্ত সঞ্চালন সংক্রান্ত কোনো ত্রুটির জন্য এরকম হলেও হতে পারে৷ কারণ, এই সমস্যায় আক্রান্ত বছর ছয়েকের একটি ছেলের হৃৎস্পন্দন আমি মিনিট দেড়েকের জন্য স্তব্ধ হয়ে যেতে দেখেছিলাম একবার৷ অবশ্য দ্বিতীয়বার যখন তার হৃৎস্পন্দন থেমে যায়, তখন আর তা চালু করা যায়নি৷ মৃত্যু হয় তার৷ কিন্তু আপনার মুখ থেকে অংশুর ব্যাপার শোনার পর মনের মধ্যে দুটো খটকা তৈরি হয়৷ এক, গ্রেট আর্টারিজে ত্রুটির জন্যে বারবার এ ঘটনা ঘটা কি সম্ভব? দুই, অংশুর দুর্বোধ ভাষায় প্রলাপ বকার ব্যাপারটা আসলে কী? এইজন্যে অংশুর ব্যাপারে মনের মধ্যে একটা কৌতূহল তৈরি হয়৷

‘এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য আমি আমার পরিচিত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা চালাই৷ যদিও এ ব্যাপারে তাঁরা কোনো সমাধানসূত্র আমাকে দিতে পারেননি৷ তাঁদের মধ্যে কয়েকজন আবার নিছক গল্প ভেবে উড়িয়ে দিয়েছেন ব্যাপারটা৷ আর দ্বিতীয় প্রশ্নের অর্থাৎ দুর্বোধ প্রলাপ বকাটা আসলে কী, তা বোঝার জন্য সেটা রেকর্ড করে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলি আপনাকে৷

‘অডিও ক্যাসেটটা হাতে আসার পর সেটা আমি খুব ভালো করে শুনি এবং তার মর্মবস্তু আংশিক হলেও উদ্ধার করতে পারি৷ এবং তারপরেই বলতে গেলে অংশুর সম্পর্কে আমার আগ্রহ একশো গুণ বেড়ে যায়৷ কথাটা আপনাদের অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে৷ তবু বলি, আপনারা জানেন, প্রাচীন মিশর সম্পর্কে আমি একটু-আধটু চর্চা করি৷ বেশ কিছু দুর্মূল্য প্যাপিরাসও আমার সংগ্রহে আছে, তার একটার চিত্রলিপির সঙ্গে হঠাৎই অংশুর প্রলাপের টুকরো টুকরো শব্দের বেশ কিছু সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছি আমি৷ যা বলতে গেলে এক কথায় অসম্ভব ব্যাপার!’

এর পর ডা. নাসের আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাল আপনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, মমির অভিশাপের মতো যেসব গল্প শোনা যায় সেসব ব্যাপার আমি বিশ্বাস করি কি না? না, আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, কোনো অতিপ্রাকৃত ঘটনায় আমার বিশ্বাস নেই৷ কিন্তু অংশুর কালকের একটা ব্যাপার আমার বিশ্বাসে কোথায় যেন একটু নাড়া দিয়েছে৷’

আমি বললাম, ‘কোন ব্যাপারটা?’

ডা. নাসের বললেন, ‘কাল মিউজিয়ামের কাচের বাক্সর সামনে দাঁড়িয়ে বাক্সর ভিতরের পাত্রগুলোর দিকে তাকিয়ে জেসের-জেসেরু শব্দটা উচ্চারণ করছিল৷ এর অর্থ রানি হাটশেপসুটের মরচুয়ারি৷ পিরামিডের ভিতরে শবদেহ নিয়ে ঢোকার আগে যেখানে শবদেহ এনে রাখা হত বা মমি তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করা হত, সেই জায়গাকে বলা হয় মরচুয়ারি বা মরচুয়ারি মন্দির৷ মিউজিয়ামের কিউরেটরের কাছ থেকে আজ আমি শুনেছি ওই কাচের বাক্সর মধ্যে রাখা পাত্রগুলো সবে এক মরচুয়ারি থেকে সংগ্রহ করে মিউজিয়ামে এনে রাখা হয়েছে৷ মমি তৈরির সময় মৃতদেহের অঃন্তযন্ত্র শরীর থেকে বের করে ওই ফুলদানি-আকৃতির পাত্রের মধ্যে রাখা হত৷ পরবর্তী সময়ে মুখবন্ধ পাত্রগুলোকে একটা বাক্সে ভরে সেই বাক্সকে সমাধির মধ্যে মৃত ব্যক্তির অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে রেখে দেওয়া হত৷ প্রশ্ন হল, পাত্রগুলো যে মরচুয়ারি থেকে সংগৃহীত তা ওর জানার কথা নয়৷ যদি ও কোনোভাবে মরচুয়ারি সম্পর্কিত শব্দটা শুনেও থাকে, তাহলে পাত্রগুলো দেখে হঠাৎই কেন তার কথা মনে হল? অথচ অংশু কিন্তু আমাকে বলেছে, শব্দটার মানে ও জানে না৷’

ডা. নাসেরের কথা শুনে আমরা দু-জনেই অবাক হয়ে গেলাম৷ ডা. নাসের এবার তাঁর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রাত ন-টা বাজে, এখন আমাকে উঠতে হবে৷ কাল সকালে আমি আসব না, বিকেল বেলা আসব৷ সারাদিন ধরে আমাকে কাল বেশ কিছু খবর সংগ্রহ করতে হবে৷ আপনারা বরং সকালের দিকে কাছেই একটা বাজার আছে, সেখানে ঘুরে আসতে পারেন৷’ এই বলে ডা. নাসের আমাদের শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলেন৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *