৩
সকাল বেলা একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙল আমার৷ ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে৷ আসলে অনেক রাত পর্যন্ত ‘দ্য আইজ অব দি স্ফিংক্স’ বইটা আমি পড়ে শেষ করে, রাত দুটো নাগাদ ঘরের বাতি নিভিয়েছি৷ তা ছাড়া আসবার সময় প্লেনেও আমি ঘুমোইনি৷ তাই সকালে আমার উঠতে দেরি হয়ে গেল৷ অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছিলেন ডা. ঘটক আর অংশু৷ আমি ঘরের বাইরে আসতেই ডা. ঘটক বললেন, ‘বেশ ভালোই একটা ঘুম দিলে দেখছি! তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, আমি ব্রেকফাস্টের অর্ডার দিচ্ছি৷’
আমার বেশ লজ্জা করল তাঁর কথা শুনে৷ সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে অথচ আমার জন্য তাঁর আর অংশুর ব্রেকফাস্ট করা হয়নি এখনও! অংশুর হয়তো খিদে পেয়েছে৷ তাকে দেখলাম খাবার টেবিলে বসে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে বসলাম আমি৷ ততক্ষণে ইন্টারকমে ব্রেকফার্স্টের অর্ডার দিয়ে ডা. ঘটকও টেবিলে এসে বসেছেন৷ আমি তাঁর পাশে বসবার পর তিনি বললেন, ‘জানো তো সৌরভ, ভোররাতে আমি একটা খুব মজার স্বপ্ন দেখেছি! দেখলাম, একটা বিরাট বড়ো পিরামিডের একদম মাথায় চড়ে বসেছি আমি৷ সেখান থেকে নীচে নামার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই নীচে নামতে পারছি না৷ শুধু চিৎকার করছি, আমাকে নীচে নামিয়ে দাও, নীচে নামিয়ে দাও বলে৷ শেষে চিৎকার শুনে আমার পাশে আবির্ভূত হলেন একজন ফারাও৷ ঠিক যেমন ফারাওয়ের বেশ কয়েকটা ফটো কাল আমি মিউজিয়ামে দেখেছি৷ তিনি আমাকে বললেন, নামতে হলে উপর থেকে নীচে লাফ দাও৷ আমি বললাম, এত উঁচু থেকে নীচে লাফ দেব কী করে! তিনি তখন বললেন, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরো, আমি তোমাকে নীচে নামিয়ে দেব৷ তাঁর কথা শুনে আমি তাঁকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম৷ আর তিনি আমাকে নিয়ে লাফ দিলেন নীচে৷ তাঁকে নিয়ে আমি আছড়ে পড়লাম নীচে৷ সঙ্গেসঙ্গে ঘুমটা ভেঙে গেল আমার৷ ঘুম ভেঙে আমি কী দেখি জানো? দেখি, খাট থেকে নীচে পড়ে গিয়েছি! আর যাকে আমি ফারাও ভেবে জড়িয়ে ধরেছিলাম, সেটা আসলে একটা পাশবালিশ!’
ডা. ঘটকের কথা শুনে আমি আর অংশু হো হো করে হাসতে লাগলাম৷ ডা. ঘটক নিজেও যোগ দিলেন তাতে৷ একটু পরেই ব্রেকফাস্ট এসে গেল৷ ব্রেকফাস্ট সারার পর আমরা স্নানের জন্য তৈরি হলাম৷
ঠিক দশটায় নীচের রিসেপশন থেকে ফোন এল, ডা. নাসের এসেছেন৷ আমরা তিন জন তৈরি হয়েছিলাম৷ ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নীচে নেমে গেলাম৷ কিন্তু রিসেপশনে তো তিনি নেই! একটা ঢিলেঢালা পোশাকপরা মাথায় পাগড়িবাঁধা লোক কথা বলছে রিসেপশন কাউন্টারে বসে-থাকা আল মামুনের সঙ্গে৷ লোকটি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ আমাদের পায়ের শব্দ শুনে লোকটি ফিরে তাকাতেই আমরা চমকে উঠলাম৷ আরে, ইনি তো ডা. নাসের! পিছন থেকে তাঁকে এ পোশাকে চিনতেই পারিনি৷ ডা. নাসের মনে হয় বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা৷ তাই তিনি আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘এ পোশাকের নাম ব্যালিবিয়া, স্থানীয় পোশাক, খুব আরামদায়ক৷ আমাকে অবশ্য পেশার কারণে অধিকাংশ সময় কোট-প্যান্টই পরতে হয়৷’
হোটেল ছেড়ে আমরা রওনা দিলাম গিজার দিকে৷ গল্প করতে করতে আমরা একসময় নীলনদের ব্রিজ পেরিয়ে হাজির হলাম শহরের শেষ প্রান্তে৷আস্তে আস্তে পালটে যাচ্ছে দু-পাশের দৃশ্যপট৷ আরও কিছুক্ষণ চলার পর ডা. নাসের হঠাৎ বললেন, ‘ওই যে, দেখতে পাচ্ছেন?’
তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, দূরে আকাশের বুকে দেখা যাচ্ছে পিরামিডের চুড়ো! প্রথমে একটা, তারপর আস্তে আস্তে আরও দুটো চোখে পড়ল৷ আমরা এসে হাজির হলাম পিরামিড চত্বরে৷ ঊষর প্রান্তরে গর্বিত ভঙ্গিতে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম ‘গ্রেট পিরামিড’৷
গাড়ি থেকে নামতেই একদল লোক দৌড়ে এল আমাদের কাছে৷ তাদের কেউ ব্যালিবিয়া বিক্রেতা, কেউ সুভেনির বিক্রেতা, কেউ বা আবার উটের মালিক৷ পর্যটকদের মধ্যে অনেককেই দেখলাম উটের পিঠে চেপে পিরামিড চত্বরে ঘুরে বেড়াতে৷ যে লোকগুলো আমাদের কাছে এসেছিল ডা. নাসের আরবিতে তাদের উদ্দেশ্যে কী একটা বলতেই তারা দূরে চলে গেল৷ হাঁটতে হাঁটতে আমরা দাঁড়ালাম গ্রেট পিরামিডের সামনে৷
ডা. নাসের বললেন, ‘এই গ্রেট পিরামিডের নির্মাতা মিশরের ইতিহাসের অন্যতম বিখ্যাত রাজা খিওপিস বা খুফু৷ যিশু খ্রিস্টের জন্মের দু-হাজার দু-শো নব্বই বছর আগে তিনি গ্রেট পিরামিড তৈরি করেন৷ এর মাথাটা একটু ক্ষয়ে গিয়েছে৷ আগে এর উচ্চতা ছিল একশো ছেচল্লিশ মিটার৷ এখন একশো সাঁইত্রিশ মিটার৷ এর পাশেরটা তাঁর ছেলে খ্রুফুর পিরামিড৷ উচ্চতা একশো ছত্রিশ মিটার৷ আর ওই যে দূরে ছোটো পিরামিডটা দাঁড়িয়ে, সেটা নাতি মেনকুরুর পিরামিড৷’
আমরা প্রথমে সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নীচে নেমে ঢুকলাম গ্রেট পিরামিডের সেই কক্ষে, যেখানে একসময় শায়িত ছিলেন ফারাও খুফুর মরদেহ৷ কিন্তু সেখানে এখন কিছু নেই৷ শুধু আছে মিশরের পুরাতত্ত্ব বিভাগের একটা বোর্ড৷ তাতে এই পিরামিড বা ফারাও খুফুর সম্পর্কে গুটিকয় কথা লেখা৷ ডা. নাসেরের মুখে শুনলাম, এই তিনটি পিরামিডের সব কিছু অনেক আগেই সমাধিচোরের দল হাতিয়ে নিয়েছিল৷ পরবর্তীকালে অতি সামান্য যা কিছু উদ্ধার হয়, তা কায়রো মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে৷
গ্রেট পিরামিড দেখার পর আমরা একে একে দেখলাম, অন্য দুটো পিরামিডও৷ তবে সবচেয়ে ভালো লাগল মেনকুরুর পিরামিড৷ এই পিরামিডে ঢোকার পথ অদ্ভুত৷ মাটি থেকে বেশ কিছুটা উঁচুতে পিরামিডের গায়ে সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ৷ লোকজনকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছিল৷ বেশ একটা রোমাঞ্চ হচ্ছিল সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে মেনকুরুর পিরামিডের নীচে নামতে৷
এসব দেখতে আমাদের ঘণ্টাখানেক সময় কেটে গেল৷ সব শেষে আমরা এসে দাঁড়ালাম স্ফিংক্সের সামনে৷ বালুকাময় প্রান্তরে যুগ যুগ ধরে এই তিনটি পিরামিডকে পাহারা দিয়ে চলেছে মানুষের মুখ আর সিংহের দেহধারী এই স্ফিংক্স৷ নীল নদের তীরে এই প্রাচীন সভ্যতার দেশে অনেক কিছু গড়ে উঠেছে৷ ধ্বংস হয়েছে তার চোখের সামনে৷ বহু সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের সাক্ষী সে৷ কতবার বইয়ের পাতায় দেখেছি তার ফটো! তার সামনে এসে আমি কোনোদিন দাঁড়াতে পারব, তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি! আবেগ কাটিয়ে ওঠার পর আমি বেশ কয়েকটা ফোটো তুললাম তার৷
ডা. নাসের বললেন, ‘একসময় এর নাম ছিল, হোর-এম-আখেট অর্থাৎ দিগন্তে অবস্থিত হোরাস৷ হোরাস এক দেবতার নাম৷ আর আরবি ভাষায় একে বলা হয় আবু-এল-হোল, যার মানে হল, ত্রাসের পিতা৷’
অংশু অবাক হয়ে দেখছিল বিশাল এই মূর্তিটাকে৷ হঠাৎ সে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, ওর নাকটা ভাঙা কেন?’
প্রশ্নটা আমার মনেও এসেছিল৷ উত্তরটা শোনার জন্য আমিও তাকালাম ডা. নাসেরের দিকে৷ তিনি বললেন, ‘আসলে কয়েক হাজার বছর ধরে ও একভাবে এখানে বসে পাহারা দিয়ে চলেছে মিশরের সভ্যতাকে৷ সেই প্রাচীনকাল থেকে ওর উপর দিয়ে বয়ে চলেছে মরুঝড়৷ তা ছাড়া রোদ-বৃষ্টি ইত্যাদি তো আছেই৷ এসব কারণে ওর নাকসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ আর একসময় স্ফিংক্সের নাক লক্ষ করে গুলি ছুড়ে নিশানা পরীক্ষা করত বন্দুকবাজরা৷’
ডা. নাসেরের কথা শুনে অংশু বলল, ‘এখন করে না?’
ডা. নাসের হেসে বললেন, ‘না, এখন আর কেউ তা করে না৷ কেউ করলে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাবে৷’
দানিকেনের বইটায় পড়ছিলাম বিশাল এই স্ফিংক্সের উচ্চতা বাইশ মিটার, দৈর্ঘ্য আশি মিটার৷ আলেকজান্ডার, নেপোলিয়নের মতো মহাবীরেরা একদিন এসে দাঁড়িয়েছিলেন এই মূর্তির পদতলে৷ শ্রদ্ধায় মাথা নত করে ছিলেন এর সামনে৷
ডা. ঘটকের মধ্যে এমনিতে আবেগের বহিঃপ্রকাশ কম৷ তিনি দেখলাম, বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে ডা. নাসেরের হাত জড়িয়ে ধরে আবেগঘন কন্ঠে বললেন, ‘আজ আপনি আমাকে যা দেখালেন তার কোনো তুলনা নেই! যদি মিশরের আর কিছু দেখা না-ও হয়, তাহলেও আমার কোনো আপশোস থাকবে না৷’
ডা. নাসেরের কাছ থেকে এর পর বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করে লিখে নিলাম পকেট ডায়েরিতে৷ পিরামিড চত্বরের ফুটপাথে অনেক সুভেনিরের দোকান৷ আমি একটা দোকান থেকে ইঞ্চি ছয়েকের একটা বেলে পাথরের স্ফিংক্সের মূর্তি কিনলাম৷ দাম নিল দশ ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড৷ এক ইজিপ্সিয়ান পাউন্ডের মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় সাত টাকা৷ এর পর আমরা ফেরার জন্য গাড়িতে উঠলাম৷ বেলা দেড়টা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের হোটেলে৷
হোটেলে পৌঁছে আমরা একসঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করলাম৷ একটা জিনিস লক্ষ করলাম, আগের দিন দুপুরে যে নিরামিষ তরকারি আমরা খেয়েছিলাম, সেটা কিন্তু প্রতিবারই খাবার সময় দেওয়া হচ্ছে৷ জিনিসটা কী, তা ডা. নাসেরকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, ‘এর নাম মোলোখিয়া৷ মিশরীয়দের খুব প্রিয় খাবার৷ মোলোখিয়ার পাতা খুব রসালো আর সুস্বাদু হয়৷ মিশরে প্রচুর পরিমাণে এর চাষ হয় এবং এর জন্য অন্য চাষও মার খায়৷ মিশর সরকার অনেকবার এর চাষ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তা সম্ভব হয়নি৷’
খাওয়া শেষ করে হাত-মুখ ধোওয়ার পর ডা. নাসের অংশুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাল আমি তোমাকে যে খেলা দেখাব বলেছিলাম, সেটা কিন্তু আমি ভুলিনি৷ আমি একটু পরেই তোমাকে সে খেলা দেখাব৷ তার আগে আমি খেলা দেখাবার জিনিসগুলো সংগ্রহ করি৷’
অংশু প্রশ্ন করল, ‘কী জিনিস?’
ডা. নাসের বললেন, ‘আর দু-মিনিট অপেক্ষা করো৷ তাহলেই সব দেখতে পাবে৷’ ডা. নাসের ইন্টারকমে রিসেপশনে কী যেন বললেন৷
এর মিনিট দু-এক পরেই ডোরবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলে দেখলাম, হোটেলের একজন একগাদা ছুরি আর কাঁটাচামচ নিয়ে এসেছে৷ ডা. নাসেরের কথামতো লোকটার কাছ থেকে সেগুলো নিয়ে নিলাম৷ হোটেলের লোকটা টেবিলের উপর থেকে আমাদের খাবারের প্লেট নিয়ে চলে যাওয়ার পর ডা. নাসের সেই ছুরি-কাঁটাচামচগুলোকে গোল করে সাজালেন টেবিলের উপর৷ তাঁর কথামতো চেয়ারগুলো টেবিলের পাশ থেকে সরিয়ে রেখে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা তিন জন৷ ডা. নাসের অংশুর দিকে তাকিয়ে একবার হাসলেন৷ তারপর টেবিল থেকে দুটো ফোটো তুলে নিয়ে শূন্যে ছুড়ে দিলেন৷ সে দুটো উপরে ওঠার পর তাঁর হাত পর্যন্ত নামতে যতটা সময় নিল তার মধ্যেই তিনি টেবিল থেকে দুটো কাঁটাচামচ তুলে নিয়ে সে দুটোকেও শূন্যে ছুড়ে দিলেন৷ এর পর তাঁর হাতের অদ্ভুত কৌশলে ছুরি-কাঁটাচামচগুলো শূন্যে লাফালাফি করতে লাগল৷ আমরা অবাক হয়ে দেখছি তাঁর জাগলিং৷ এর পর আরও দুটো, তারপর আরও দুটো, এইভাবে আরও বাড়তে লাগল শূন্যে লাফালাফি করা ছুরি আর কাঁটাচামচের সংখ্যা৷ একসময় সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে গেল টেবিল৷ সব ছুরি-কাঁটাচামচই শূন্যে ভাসতে লাগল৷ মিনিট দশেক পর খেলা শেষ করলেন ডা. নাসের৷ খেলা শেষ হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই আমরা হাততালি দিয়ে উঠলাম৷
ডা. ঘটক তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি এই খেলা শিখলেন কোথায়?’
তিনি বললেন, ‘অনেক বছর আগে আবুসিম্বলে একটা গবেষণার কাজে বেদুইনদের তাঁবুতে মাস ছয়েক কাটাতে হয় আমাকে৷ তখন তাদের কাছ থেকেই শিখি৷’
অংশু এতক্ষণ চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে ছিল ডা. নাসেরের দিকে৷ সে হঠাৎ বলল, ‘আর কী খেলা জানেন আপনি?’
ডা. নাসের বললেন, ‘জানি নয়, জানতাম৷ একসময় আমি খুব ভালো বন্দুক ছুড়তে পারতাম৷ তবে সে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা৷ আমরা বন্ধুরা মিলে দলবেঁধে মরুভূমিতে হুবার পাখি শিকার করতে যেতাম৷’
অংশু আবার গোল গোল চোখে প্রশ্ন করল, ‘আপনিও কি তাহলে স্ফিংক্সের নাক লক্ষ করে বন্দুক ছুড়েছেন?’
ডা. নাসের বললেন, ‘হ্যাঁ, ছুড়েছি তো! তখন ওটাই তো ছিল আমাদের লক্ষ্যভেদের জায়গা৷ তখন কায়রোয় এত লোকজন, দোকানপাট কিছুই ছিল না৷ এত ট্যুরিস্টও আসত না এখানে৷ গিজার চারদিক প্রায় সবসময় ফাঁকা থাকত৷ কায়রোর তামাম বন্দুকবাজের দল জমায়েত হত সেখানে তাদের নিশানা পরীক্ষার জন্য৷ আমিও যেতাম সেখানে৷ ওখানেই একবার একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যায় এই খেলাকে কেন্দ্র করে৷ আর তার পরেই বন্দুক ছোড়া বন্ধ করে দিলাম আমি৷ অবশ্য বাবার আমলের সেই ইংলিশ রিপিটার রাইফেলটা এখনও আমার ঘরের কোনায় ধুলোমাখা অবস্থায় পড়ে আছে৷’
আমি একবার ভাবলাম ডা. নাসেরকে জিজ্ঞেস করি যে, অ্যাক্সিডেন্টটা কী ঘটেছিল? যে কারণে তাঁকে বন্দুক ছোড়া ছেড়ে দিতে হল! কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, প্রশ্নটা হয়তো একান্তই ব্যক্তিগত হয়ে যাবে৷ তাই আর জিজ্ঞেস করলাম না৷
ডা. নাসের এবার ডা. ঘটককে বললেন, ‘আমি আপনাকে বলেছিলাম যে, আপনার সঙ্গে সেই বিশেষ ব্যাপারে আলোচনা করব আজ৷ কিন্তু তার আগে আমার একবার কায়রো মিউজিয়ামে যাওয়া বিশেষ প্রয়োজন৷ একটা জরুরি কথা মিউজিয়ামে কিউরেটরের কাছ থেকে আমাকে জানতে হবে৷ তারপর সন্ধ্যে বেলা এসে আমি আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে বসব৷ এখন আপাতত আপনারা বিশ্রাম নিন৷’ এ কথা বলার পর তিনি অংশুকে হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা অংশু, তুমি কি আরবি ভাষা পড়তে বা লিখতে জানো? অথবা আরবি ভাষা বুঝতে পার?’
অংশু প্রশ্নটা শুনে প্রথমে বুঝতে পারল না৷ সে তাকিয়ে রইল ডা. নাসেরের দিকে৷ ডা. নাসের এবার একটু অন্যভাবে তাকে প্রশ্নটা করলেন, ‘তুমি কী কী ভাষা জানো?’
অংশু বলল, ‘ইংরেজি আর বাংলা৷’
অংশুর উত্তর শোনার পর ডা. নাসের আর কিছু বললেন না৷ আমাদের কাছে বিদায় নিয়ে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন৷ তিনি চলে যাওয়ার পর ডা. ঘটক চলে গেলেন নিজের ঘরে, আর আমি অংশুকে নিয়ে আমার ঘরে চলে এলাম৷ খাটে শোওয়ার পর অংশু আমাকে বলল, ‘জানো তো, কাল রাতে আমি আবার সেটা দেখতে পেয়েছি৷’
আমি বললাম, ‘কোনটা?’
অংশু বলল, ‘ওই যে স্বপ্নটা, আমি অসুখ হলে দেখতে পাই৷ একটা অন্ধকার ঘরে শুয়ে আমি, আর কে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার সামনে৷ অন্ধকারের মধ্যে তার জ্বলন্ত চোখ দুটো শুধু দেখতে পাচ্ছি৷ আমি উঠে বসবার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না৷ কে যেন বেঁধে রেখেছে আমাকে৷ আমার খুব ভয় করছে৷’
আমি অংশুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘তুমি ভয় পেয়ো না, তোমার অসুখ ভালো হয়ে যাবে৷ ডা. ঘটক আর ডা. নাসের ভালো করে দেবেন তোমাকে৷ তোমার শরীর খারাপ লাগলে তুমি সঙ্গেসঙ্গে বলবে আমাদের৷ এখন তুমি ঘুমোও৷’
অংশু অন্য দিকে পাশ ফিরল আমার কথা শুনে৷ আমি মনে মনে ঠিক করলাম, অংশুর স্বপ্ন দেখা যে শুরু হয়ে গিয়েছে তা বিকেল বেলায় জানিয়ে দিতে হবে ডা. ঘটককে৷