রানি হাটশেপসুটের মমি – ২

ঠিক সাড়ে চারটেয় আমরা ডা. নাসেরের গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম আল-তাহরির স্কোয়ারের কায়রো মিউজিয়ামের উদ্দেশে৷ নির্দিষ্ট সময়ের মিনিট দশেক আগেই আমাদের ঘরের দরজায় টোকা দিয়েছিলেন ডা. নাসের৷ আমরাও তৈরি হয়েছিলাম, কাজেই বেরিয়ে পড়তে কোনো অসুবিধে হল না৷ মিনিট পনেরোর মধ্যেই আমরা এসে পৌঁছোলাম কায়রো মিউজিয়ামের সামনে৷ বিরাট লাল রঙের বাড়ি, তার সাদা তোরণ৷ ডা. নাসের বললেন, তাঁর নিজের ভিতরে প্রবেশের জন্য বিশেষ অনুমতিপত্র আছে৷ তাই তাঁর কোনো টিকিট লাগবে না৷ মিউজিয়ামে মাথাপিছু প্রবেশ মূল্য ২০ ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড৷ আর ক্যামেরার জন্য ১০ ইজিপ্সিয়ান পাউন্ড৷ আমাদের তিন জনের টিকিটের দাম সৌজন্য দেখিয়ে ডা. নাসের দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমরা দিতে দিলাম না৷

টিকিট কাটার পর আমরা ঢুকলাম মিউজিয়ামে৷ ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে ডা. নাসের বললেন, ‘আপনাদের যে রোসেটা স্টোনের কথা বলছিলাম তখন, তার একটা প্রতিলিপি এখানে রাখা আছে৷ আছে আরও বেশ কয়েক হাজার প্রত্নবস্তু৷ সেসব মোটামুটিভাবে দেখতে হলে অন্তত ঘণ্টা পাঁচেক সময় লাগে৷ আজ হাতে সময় অল্প, ঘণ্টা দুয়েক পরেই মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবে৷ তাই আজ আমি আপনাদের মিউজিয়ামের বিশেষ কিছু দেখার জিনিস আর মিউজিয়ামের প্রধান আকর্ষণ তুতানখামেনের গ্যালারি দেখাব৷ পরে একদিন হাতে সময় নিয়ে এসে বিভিন্ন খুঁটিনাটি জিনিস দেখিয়ে নিয়ে যাব৷’

ভিতরে ঢোকার আগে কাপড়ের জুতো পরতে হল৷ একতলার বিশাল হলঘরে ঢুকে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম৷ মনে হল, হঠাৎ যেন একটা অন্য জগতে এসে হাজির হয়েছি৷ চারপাশে ছড়িয়ে আছে অজস্র প্রাচীন মূর্তি, পাথরের ফলক, নানা ধরনের ছবি৷ মিউজিয়ামের বিরাট এই প্রদর্শনী-কক্ষে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে৷ চারপাশে কীরকম একটা গা ছমছমে পরিবেশ৷ হাজার হাজার বছরের প্রাচীন মূর্তিগুলি যেন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আমাদের৷ অংশু ভিতরে ঢুকবার পর আমার হাতটা জড়িয়ে ধরল৷ মনে হল, ও যেন মনে মনে ভয় পেয়ে গিয়েছে৷ ডা. নাসের বললেন, ‘আপনারা আমার সঙ্গে থাকুন, আমি আপনাদের সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছি৷’

ডা. নাসের প্রথমে গিয়ে দাঁড়ালেন বিরাট এক পাথরের মূর্তির সামনে৷ পাথরের সিংহাসনের উপর বসে আছে মূর্তিটি৷ সেটা দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘এটা হল প্রাচীন মিশরের বিখ্যাত রাজা বা ফারাও খিওপিসের মূর্তি৷ যিনি ফারাও খুফু নামেই বেশি পরিচিত৷ প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে অর্থাৎ যে সময়কালকে মিশরের ইতিহাসে ওল্ড কিংডম বলে চিহ্নিত করা হয়, সেই সময় তিনি রাজত্ব করতেন মিশরের বুকে৷ খুফুকেই পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য গিজার গ্রেট পিরামিডের নির্মাণকর্তা বলে মনে করা হয়৷’

এর পর তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন একটু দূরে রাখা এক আবক্ষ মূর্তির সামনে৷ তার অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেলেও সেটা যে নারীমূর্তি ছিল তা বুঝতে কোনো অসুবিধে হয় না৷ ডা. নাসের বললেন, ‘মনে করা হয়, এটা মিশরের বিখ্যাত রানি ক্লিওপেট্রার মূর্তি৷ যুগ যুগ ধরে যাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক গল্প-কাহিনি, যদিও তার মধ্যে প্রমাণের বদলে অনুমান বা কল্পনার পরিমাণই বেশি৷’

একের পর এক তিনি আমাদের দেখাতে লাগলেন নানা মূর্তি৷ তার কোনোটা আমেনহোটেপের, কোনোটা দ্বিতীয় রামেসিসের, কোনোটা অন্যান্য ফারাও বা রানিদের, আর তার সঙ্গে বলে যেতে লাগলেন ওঁদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য৷ প্রদর্শনীকক্ষে রাখা আছে অনেক মমি৷ সেগুলোর পাশে রাখা আছে বিরাট বিরাট পাথরের বাক্স৷ তার গায়ে আবার নানা ধরনের চিত্রলিপি খোদাই করা আছে৷ ডা. নাসেরের মুখে শুনলাম, এই বিরাট বিরাট পাথরের বাক্সকে বলা হয় ‘সারকোফ্যাগাস’৷ মমির কাঠ বা ধাতুর তৈরি আধার সারকোফ্যাগাসের মধ্যে ভরে রাখা হত, যাতে যুগ যুগ ধরে মমিটাকে অক্ষয় রাখা যায়৷

একটা সারকোফ্যাগাসের গায়ে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ডা. নাসের বললেন, ‘ভালোভাবে লক্ষ করুন এই খোদাইকরা ছবিগুলো৷ এটা মৃত ব্যক্তির অন্তিম যাত্রার বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ছবি৷ এই দেখুন, প্রথমে ক্রীতদাসের দল মৃত ব্যক্তির জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তারপর যাচ্ছে পেশাদার ক্রন্দনরত রমণীর দল৷ তারপর চলেছে পুরোহিতের দল স্লেজ গড়িতে কফিন নিয়ে৷ তারও পর বলদে-টানা স্লেজ গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একটা নৌকো৷ আর সব শেষে চলেছে মৃতের পরিবার-পরিজনেরা৷ ঠিক এই ভাবেই সেই সময় শেষ যাত্রা করা হত৷ এ জাতীয় অনেক ছবি নানা জায়গায় দেখতে পাওয়া যায়৷’

আমি ডা. নাসেরকে প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা, শবযাত্রায় নৌকো কেন? এখানে আরও বেশ কয়েকটা অন্য ছবিতে নৌকো লক্ষ করলাম৷ তা ছাড়া এই সংগ্রহশালাতেও দেখলাম বেশ কয়েকটা নৌকো রাখা আছে৷ এর কি কোনো বিশেষ কারণ আছে?’

ডা. নাসের বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আছে৷ প্রাচীন মিশরবাসীরা মনে করতেন যে, আত্মার মৃত্যু হয় না৷ ঘুমন্ত দেহ থেকে আত্মা অন্য এক জগতের দিকে যাত্রা করে৷ সেখানে যেতে হয় নদী পার হয়ে৷ তাই প্রত্যেক সমাধিস্থানে একটা করে সোলার বার্জ বা একটা করে নৌকো রেখে দেওয়া হত৷ এই মিউজিয়ামে যেসব নৌকো সংরক্ষিত আছে, সেগুলো সবই বিভিন্ন সমাধিস্থানে থেকে উদ্ধার করা হয়েছে৷ মৃত ব্যক্তির ক্ষমতা বা পদমর্যাদা অনুযায়ী সমাধিস্থানে রাখা হত কাঠ, রুপো বা সোনার তৈরি নৌকো৷’

ডা. নাসেরের কথা শুনে ডা. ঘটক তাঁকে বললেন, ‘আমাদের শাস্ত্রেও মৃত্যুর পর নদী পার হওয়ার একটা ব্যাপার আছে৷ সে নদীর নাম বৈতরণী৷ পবিত্র ষাঁড়ের লেজ ধরে সে নদী পার হতে হয়৷’

ডা. ঘটকের কথা শেষ হতেই ডা. নাসের বললেন, ‘আপনাদের শাস্ত্রের সঙ্গে প্রাচীন মিশরের রীতিনীতির বেশ মিল ছিল দেখছি! শুধু নদী পার হওয়ার ব্যাপারটা নয়, প্রাচীন মিশরীয়রা ষাঁড়কে খুব পবিত্র প্রাণী মনে করত৷ তাদের পুজো করত৷ এমনকী মৃত্যুর পর তাদেরও মমি তৈরি করে ঘটা করে সমাধি দেওয়া হত৷ বেশ কয়েকটি অতি প্রাচীন সারকোফ্যাগাসে ষাঁড়ের মমি পাওয়া গিয়েছে৷’

এর পর আমরা দেখলাম সেই রোসেটা স্টোনের প্রতিলিপি৷ একতলায় মিউজিয়ামের প্রধান দেখার জিনিসগুলো দেখে এবং কিছু ছবি তুলে আমরা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চললাম৷ দোতলায় রয়েছে বালক রাজা তুতানখামেনের গ্যালারি৷ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে আমার হঠাৎ মনে পড়ল, তুতানখামেনের অভিশাপের সেই মিথের কথা৷ আমি ডা. নাসেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুতানখামেনের অভিশাপের ব্যাপারে আপনি কী বলেন?’

ডা. নাসের বললেন, ‘মিশরবাসীরা মনে করতেন, কফিনের মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় অনন্তলোকে যাত্রার প্রতীক্ষা করতেন ফারাওরা৷ তুতানখামেনের সমাধি যেখানে রাখা ছিল তার প্রবেশদ্বারের মাথায় একটা পাথরের ফলকে হাইয়ারোগ্লিফিক ভাষায় কয়েকটা কথা লেখা ছিল৷ মোটামুটি তার মূল কথা হল, রাজা এখানে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন, তাঁকে বিরক্ত কোরো না৷ আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে তিনি তোমাকে অভিশাপ দেবেন৷ এই ফলক এবং যারা তুতানখামেনের সমাধিস্থানে প্রথম প্রবেশ করেছিলেন, তাঁদের পরবর্তীকালে অস্বাভাবিক মৃত্যু তুতানখামেনের অভিশাপের ব্যাপারে মানুষের মনে একটা বিশ্বাসের জন্ম দেয়৷’

ডা. ঘটক এবার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি নিজে কি বিশ্বাস করেন অভিশাপের ব্যাপারটা?’

প্রশ্নটা শুনে গ্যালারিতে ঢোকার মুখে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন ডা. নাসের৷ কয়েক মুহূর্ত যেন নিজের মনে কী একটা চিন্তা করলেন৷ তারপর বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না করি তাতে কিছু যায়-আসে না৷ তবে এখানকার অধিকাংশ মানুষ কিন্তু এসব ব্যাপার খুব বিশ্বাস করেন৷ তাঁদের সঙ্গে কথা বললেই আপনারা বুঝতে পারবেন৷’

আমরা ঢুকলাম তুতানখামেনের গ্যালারিতে৷ বিশাল গ্যালারিতে রয়েছে তাঁর সমাধি থেকে পাওয়া কয়েক হাজার প্রত্নবস্তু৷ ডা. নাসেরের মুখ থেকে শুনলাম, সমাধিচোরের দল ফারাও খুফুসহ অন্যান্য রাজার সমাধির যাবতীয় সম্পদ লুন্ঠন করলেও তুতানখামেনের সমাধির সারকোফ্যাগাস অর্থাৎ কফিন রাখার আধারসহ সমস্ত জিনিসই কিন্তু অবিকৃত অবস্থায় ছিল৷ এর দুটো কারণ থাকতে পারে৷ এক, কুসংস্কারের জন্যে তারা তুতানখামেনের সমাধিতে হাত দেয়নি অথবা তারা এই সমাধির সন্ধান পায়নি৷ তুতানখামেনের সমাধি খুঁজে বের করতে ইংরেজ প্রত্নবিদ হাওয়ার্ড কার্টারের সময় লেগেছিল দীর্ঘ ছ-বছর৷ সামান্য প্রমাণ সম্বল করে খড়ের গাদায় সুচ খুঁজতে নেমেছিলেন কার্টার এবং শেষ পর্যন্ত তিনি সফল হন৷ আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম গ্যালারি৷ দেখলাম, অংশুর চোখে-মুখে ঝরে পড়ছে বিস্ময়৷ সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে সে৷

ডা. নাসেরের কাছ থেকে আরও জানলাম, তুতানখামেনের পিতা ছিলেন ফারাও এখেনাতেন৷ তাঁর নাবালিকা রানি আমেনাতেনের গর্ভে জন্ম হয় তুতানখামেনের৷ এই ফারাও এখেনাতেনের আর এক রানি ছিলেন নেফারতিতি৷ গ্যালারিতে সাজানো আছে বালক রাজার সোনার সিংহাসন, তাঁর ব্যবহৃত সোনা, রুপো, পাথরের তৈরি নানা জিনিসপত্র৷ তবে সবচেয়ে আকর্ষক সোনা ও বহুমূল্য পাথর দিয়ে তৈরি তুতানখামেনের মুখোশ ও তাঁর কফিন৷ পরপর চারটে অলংকৃত কাঠের বাক্সর মধ্যে একটা পাথরের সারকোফ্যাগাস, তার মধ্যে আবার পরপর তিনটে সোনার কফিন, তার মধ্যে শায়িত ছিল বালক রাজার দেহ৷ পণ্ডিতদের অনুমান, দশ বছর বয়সে তিনি সিংহাসনে বসেন৷ বারো বছর বয়সে এক বালিকাকে তিনি বিয়ে করেন ও মাত্র আঠারো বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়৷ আমার ফোটো তোলার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এই গ্যালারিতে ফোটো তোলা নিষেধ৷ কারণ, ফ্ল্যাশের ঝলকানিতে হাজার বছরের প্রাচীন চিত্রলিপির ক্ষতির আশঙ্কা আছে৷ ডা. নাসের আমাদের উদ্দেশে বললেন, ‘জানেন তো, আধুনিক গবেষকদের অনুমান, মিশরের এই বালক রাজাকে হত্যা করা হয়েছিল৷ তুতানখামেনের খুলিতে একটা দাগ পাওয়া গিয়েছে৷ সম্ভবত মাথায় আঘাত করে তাঁকে হত্যা করা হয়৷ এ ছাড়া কয়েকটা হাইয়ারোগ্লিফিকেও এর ইঙ্গিত মিলেছে৷ তবে অধুনা মৃত্যুর আরও অন্য কারণের কথাও বলা হচ্ছে৷’

তুতানখামেনের গ্যালারিতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় কেটে গেল৷ হঠাৎ ঘণ্টার শব্দ শোনা গেল৷ ডা. নাসের বললেন, ‘এবার নীচে নামতে হবে৷ মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে৷ মমির গ্যালারিটা দেখা কিন্তু বাকি রয়ে গেল৷’

একতলায় নেমে এলাম আমরা৷ তারপর যখন মিউজিয়ামের লম্বা হলঘর পেরিয়ে বাইরে পা রাখতে যাব, ঠিক তখন ডা. ঘটক বললেন, ‘অংশু কোথায় গেল?’

সত্যিই তো! অংশু আমাদের সঙ্গে নেই! কিন্তু এই একটু আগেই তো সিঁড়ি দিয়ে আমার পাশে পাশে নীচে নামল! তাহলে সে গেল কোথায়? অংশুকে খোঁজার জন্য আমরা আবার পিছনে ফিরলাম৷ একতলার বিরাট হলঘরের কোথাও তাকে পাওয়া গেল না প্রথমে৷ তারপর আমরা দোতলায় উঠবার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলাম তাকে৷ সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার মুখে সে আমাদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে, এক কোনায় আধো অন্ধকারে টেবিলের উপর রাখা একটা কাচের বাক্স দেখছে৷ ডা. নাসের আমাদের ইশারায় চুপ করতে বলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন সেদিকে৷ তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আমিও গেলাম৷ দেখলাম, কাচের বাক্সটার গায়ে প্রায় মুখ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অংশু৷ বাক্সটার মধ্যে রাখা আছে পাথরের লম্বা ফুলদানির মতো দেখতে মুখবন্ধ কয়েকটা পাত্র৷ কয়েক সেকেন্ড সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর বুঝতে পারলাম, ভিতরের জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে অংশু যেন বিড়বিড় করে কী বলছে! তার মধ্যে একটা শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম, ‘জেসের-জেসেরু’৷ ডা. নাসের এর পর সম্ভবত অংশু কী বলছে তা ভালো করে শোনার জন্য আর এক পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন৷ কাচের বাক্সর গায়ে তাঁর ছায়া পড়তেই চমকে পিছন ফিরে তাকাল অংশু৷ তার মুখে ফুটে উঠল অপ্রস্তুত ভাব৷ ডা. নাসের তার কাঁধে হাত রেখে সস্নেহে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি জেসের-জেসেরু কাকে বলে জানো?’

অংশু বলল, ‘না৷’

ডা. নাসের বললেন, ‘তাহলে তুমি এইমাত্র কথাটা বলছিলে কেন? কথাটা তুমি কোথায় শুনলে?’

অংশু কোনো উত্তর দিল না৷ যেন ডা. নাসেরের কথা সে বুঝতেই পারল না৷ সে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে৷ আমি একবার তাকালাম বাক্সটার দিকে৷ তার গায়ে কোনো কিছু লেখা নেই৷ মনে হয় সদ্য তৈরি করা হয়েছে বাক্সটা৷ তার কাঠের ফ্রেমের গা থেকে এখনও বার্নিশের মৃদু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে৷ সম্ভবত বাক্সটা সাময়িকভাবে সেখানে রাখা হয়েছে৷ পরে মিউজিয়ামের অন্য কোথাও ভালো করে রাখা হবে৷ ডা. নাসের আর অংশুকে কোনো প্রশ্ন করলেন না৷ ঢং করে মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার শেষ ঘণ্টা বাজল৷ আর আমরাও বাইরে বেরিয়ে চেপে বসলাম গাড়িতে৷ কায়রো শহরের রাস্তা, দোকানপাট তখন ঝলমলে আলোর মেলায় সেজে উঠেছে৷ সেসব দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম হোটেলে৷

গাড়ি থেকে আমাদের সঙ্গে ডা. নাসেরও নামলেন৷ গাড়ি চালাতে চালাতে তিনি যেন গভীরভাবে কী চিন্তা করছিলেন৷ নিজে থেকে একটা কথাও বলেননি৷ আমরা যখন হোটেলে ঢুকতে যাচ্ছি, তখন হোটেলের কাচের দরজা ঠেলে বাইরে বের হল মাঝারি উচ্চতার বেশ মোটা একটা লোক৷ কালো রঙের সুট পরা, মাথার চুল খুব ছোটো ছোটো করে ছাঁটা৷ তাঁর এক কানে আবার একটা বড়ো সোনার মাকড়ি৷ আমি ছিলাম সকলের প্রথমে৷ আমার পিছনে ছিল অংশু, আর তার পিছনে ডা. ঘটক ও ডা. নাসের৷ আমাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা৷ তারপর বলে উঠল, ‘আরে ডাক্তার নাসের যে! তা হঠাৎ এখানে কী মনে করে? আজকাল হোটেলে থাকছেন নাকি?’ কথাগুলো সে ইংরেজিতে বলল৷

তার কথা শুনে আমি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ দেখলাম, ডা. নাসেরও দাঁড়িয়ে পড়েছেন লোকটিকে দেখে৷ ডা. নাসের খুব রুক্ষ স্বরেই এবার লোকটির কথার উত্তর দিলেন, ‘আমি কোথায় থাকছি না থাকছি তা জেনে তোমার দরকার কী?’

লোকটি আকর্ণ বিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘জেনে রাখা ভালো, আপনি তো আবার অনেক কিছুর খোঁজখবর রাখেন! এখানে-ওখানে যাওয়া-আসা করেন৷ নতুন কিছুর সন্ধান পেলে বলবেন, ভালো দাম পাবেন৷’

ডা. নাসের কোনো জবাব দিলেন না৷ দেখলাম, তাঁর চোখ-মুখ রাগে লাল হয়ে গিয়েছে৷ লোকটা কিন্তু তখনও হাসছে৷ লোকটির দাঁতগুলো সোনা দিয়ে বাঁধানো৷ হাসি শেষ করে সে গিয়ে উঠে বসল আমাদের গাড়ির ঠিক পাশেই রাখা একটা ছাই রঙের কন্টেসায়৷ গাড়িটা তাকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল হোটেল ছেড়ে৷ সেদিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ডা. নাসের বললেন, ‘স্কাউন্ড্রেল৷’

লিফটে উঠতে উঠতে ডা. ঘটক জিজ্ঞেস করলেন, ‘লোকটি কে?’

ডা. নাসের বললেন, ‘ওর নাম আলতুনিয়া৷ একেবার পাকা শয়তান৷ কায়রোয় একটা সুভেনিরের দোকান আছে ওর৷ কিন্তু সেটা হল একটা লোক-দেখানো ব্যাবসা৷ ওর আসল কারবার হল প্রাচীন দুঃস্প্রাপ্য জিনিসপত্র বিদেশে পাচার করা৷ এই লোকদের জন্য কত দুর্মূল্য জিনিস যে এদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই৷ এসব ব্যাপারে বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছিল আলতুনিয়া৷ কিন্তু প্রত্যেকবারই টাকার জোরে আর প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে৷ ওর ধারণা, আমার কাছে কিছু অতি মূল্যবান হাইয়ারোগ্লিফিক আছে৷ তাই সেগুলো হাতাবার জন্য কিছুদিন হল ও আমার পিছনে লেগে আছে৷’ এর পর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ডা. নাসের বললেন, ‘তবে ওর একটা গুণ সকলেই স্বীকার করে৷ ওর মতো ভালো হাইয়ারোগ্লিফিক পড়তে খুব অল্প লোকই পারে৷’

উপরে ওঠার পর আরও মিনিট দশেক আমাদের সঙ্গ দিলেন ডা. নাসের৷ তার মধ্যে তিনি ডা. ঘটকের সঙ্গে সেরে ফেললেন কিছু কাজের কথা৷ ঠিক হল, আগামী কাল সকাল দশটা নাগাদ তিনি আমাদের নিয়ে যাবেন গিজায় পিরামিড ও স্ফিংক্স দেখাতে৷ ফিরে এসে তিনি আমাদের সঙ্গেই মধ্যাহ্নভোজন সারবেন৷ তারপর ডা. ঘটকের সঙ্গে কিছু কাজের কথা আলোচনা করতে বসবেন৷ কাজের কথা বলতে যে অংশুর ব্যাপার, তা বুঝতে আমার অসুবিধা হল না৷ অংশু সোফায় বসে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল৷ ডা. নাসের উঠবার সময় তাকে বললেন, ‘আজ তাহলে আমি যাই বন্ধু!৷ কাল তোমাকে আমি মজার একটা খেলা দেখাব৷’

অংশু হেসে বলল, ‘আচ্ছা!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *