রানি হাটশেপসুটের মমি – ১৬

১৬

নীলনদের এক ক্যাটারাক্টের ধারে পার্কের মধ্যে বসে ছিলাম ডা. নাসের, আমি আর ডা. ঘটক৷ কিছু দূরে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নীলনদের দিকে তাকিয়ে ছিল অংশু৷ জলপ্রবাহ যেখানে পাথর কেটে উপর থেকে নীচে নেমেছে তাকে বলা হয় ‘ক্যাটারাক্ট’৷ নীলনদে বেশ কয়েকটা ক্যাটারাক্ট আছে৷ আসোয়ান বাঁধ তৈরি হওয়ার আগে এই ক্যাটারাক্ট পেরিয়ে কেউই নদীপথে আসোয়ানের দক্ষিণে যেতে পারেনি৷

আমরা আজ লাক্সর থেকে নদীপথে তিন দিনের জন্য যাত্রা করব৷ এ ভ্রমণকে বলা হয় ‘নীলনদ ক্রুজ’৷ দেখব, নীলনদের তীরে অবস্থিত গ্রিকদের দু-হাজার দুশো বছরের প্রাচীন এসনার মন্দির, খ্রিস্টজন্মের অনেক আগের তৈরি এডফু মন্দির, ফিলের মন্দির ইত্যাদি৷ আমাদের জাহাজ ছাড়তে বেশ কিছুটা দেরি ছিল, তাই আমরা পার্কে বসে গল্প করছিলাম৷ ডা. ঘটকই তুললেন ব্যাপারটা৷ তিনি ডা. নাসেরকে বললেন, ‘আজ আপনি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা খুলে বলুন৷ অংশুর অসুখের সঙ্গে কী সম্পর্ক ছিল ওই সমাধির? আপনার কাছে রাখা প্যাপাইরাসেই বা কী লেখা ছিল? অংশুর প্রলাপের মধ্যে এমন কী শব্দ ছিল, যাতে আপনার ধারণা হয়েছিল ওই সমাধির সঙ্গে অংশুর সম্পর্ক আছে?’

ডা. নাসের বললেন, ‘আমি বলছি সেকথা, তবে তার কতটা আপনারা বিশ্বাস করবেন সে সিদ্ধান্তের ভার আমি আপনাদের উপর ছেড়ে দিচ্ছি৷’

এই বলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন তিনি৷ তারপর বলতে শুরু করলেন, ‘রানি হাটশেপসুট আর তাঁর মন্ত্রী সেনমুটের কাহিনির একটা অধ্যায় আপনারা ইতিপূর্বে আমার মুখ থেকে শুনেছেন৷ এবার আমি বলব ওর পরবর্তী এক অজানা কাহিনির কথা৷ যার সন্ধান আমি পাই আমার কাছে থাকা হাজার বছরের প্রাচীন প্যাপাইরাস থেকে৷ প্রসঙ্গত আপনাদের বলে রাখি যে, ড. হান্সও অনুরূপ কাহিনির সন্ধান পান ফ্রান্সের লুভর মিউজিয়ামে রাখা এক শিলালিপিতে৷ কিন্তু কী সেই কাহিনি? তা হল, হাটশেপসুটের হাত থেকে বাঁচবার জন্য মরচুয়ারি মন্দির থেকে সুড়ঙ্গপথে সেনমুট পালিয়ে গেলেন ঠিকই কিন্তু সেনমুটের একমাত্র বংশধর তাঁর বারো বছরের নাতি আখটুম ধরা পড়ে গেল রানির সেনাদের হাতে৷

‘আখটুমের বাবা ছিলেন সেনমুটের একমাত্র সন্তান৷ হাটশেপসুটের নির্দেশে সুদানে সামরিক অভিযানে গিয়ে তিনি মরু-যাযাবরদের হাতে নিহত হন৷ আর সেনমুটের পুত্রবধূ আখটুমের জন্ম দিয়েই মারা যান৷ ভ্যালি অফ কিংসের কাছে এক গ্রামে সেনমুটের ছোট্ট প্রাসাদে বড়ো হয়ে উঠেছিল আখটুম৷ সেনমুট মরচুয়ারি মন্দির থেকে পালাবার সময় তার এক পার্শ্বচরকে নির্দেশ দিয়ে যান যে, সে যেন প্রাসাদ থেকে আখটুমকে নিয়ে মরুভূমির এক গোপন স্থানে তাকে সেনমুটের হাতে তুলে দেয়৷ এক জ্যোৎস্না রাতে সেনমুটের সেই সঙ্গীর সঙ্গে উটপাখির পিঠে চেপে নুবিয়ান মরুভূমি পার হওয়ার সময় দুর্ভাগ্যবশত ধরা পড়ে যায় আখটুম৷ সেনমুট এ খবর পাওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই মরুভূমির আরও গভীরে চলে যান, মিশে যান এক যাযাবর গোষ্ঠীর সঙ্গে৷ বৃদ্ধ বয়সে তিনি সেখানে নাকি আবার সংসার পাতেন বলেও শোনা যায়৷

‘তবে সেসব কথা থাক, আমরা ফিরে আসি আখটুমের প্রসঙ্গে৷ আখটুমকে বন্দি করে হাজির করা হল হাটশেপসুটের সামনে৷ রানি পুরোহিতদের কাছে জানতে চাইলেন এই বালককে কী শাস্তি দেওয়া যায়? রানি পুরোহিতদের চেয়ে মন্ত্রী সেনমুটকে বেশি গুরুত্ব দিতেন বলে তাঁরা সেনমুটের উপর চটা ছিলেন৷ তাই তাঁরা সেনমুটের চরম ক্ষতি করার সুযোগ হাতছাড়া করলেন না৷ নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করার পর রানিকে জানালেন, তিনি যেন আমনরার মন্দিরে হাজির হয়ে স্বয়ং তাঁর থেকেই নির্দেশ গ্রহণ করেন৷ রানি হাজির হলেন মন্দিরে৷ কিন্তু তার আগেই একজন পুরোহিত গোপনে সুড়ঙ্গপথ বেয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমনরার মূর্তির পিছনে৷ হাটশেপসুট মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে বলল, আখটুমের কা-ই সেনমুটকে প্ররোচিত করেছে মরচুয়ারি মন্দিরে সেনমুটের ছবি আঁকতে৷ এই কা-র দেহধারী আখটুমকে হত্যা করতে হবে৷ না হলে তোমার সমূহ বিপদ৷ এই কা তোমাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসবে৷

‘হত্যা করার পদ্ধতিও বাতলে দিলেন নিষ্ঠুর পুরোহিতের দল৷ হাটশেপসুট নিজের হাতে আখটুমের হৃৎপিণ্ডে তীক্ষ্ণ শলাকা বসিয়ে দেবেন৷ এবং সেই অবস্থাতেই তাকে মমি করে শায়িত রাখা হবে মরচুয়ারি মন্দিরের নীচে৷ রানি তাকে দেবেন এক কঠিন অভিশাপ, যাতে সে তার পাপের শাস্তি পায়৷ তারপর তাকে সমর্পণ করতে হবে মৃত্যুর দেবতা আনুবিসের হাতে৷

‘হাটশেপসুট পালন করলেন আমনরার নির্দেশ৷ সেই হতভাগ্য নিষ্পাপ বালককে নিয়ে যাওয়া হল মরচুয়ারি মন্দিরের নীচে এক গোপন কক্ষে৷ তারপর রানি তার হৃৎপিণ্ডে বসিয়ে দিলেন জেড পাথরের সুতীক্ষ্ণ শলাকা৷ অসহায় আখটুমের আর্তনাদ শুষে নিল কঠিন পাথরের দেওয়াল৷ রানি তাকে দিলেন এক ভয়ংকর অদ্ভুত অভিশাপ, তোমার কা-র কোনোদিন চিরমুক্তি ঘটবে না৷ সে মিশে যেতে পারবে না তোমার বা-র সঙ্গে৷ প্রতি যুগে সে নতুন শরীর ধারণ করবে তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য৷ মৃত্যু জগতের প্রধান দেবতা হাথোরের ইচ্ছেয় যখন ছিদ্রপথে চাঁদের আলো এসে পড়বে তোমার শরীরে, নীলনদের জোয়ার আসবে, ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার কা নতুন দেহ ছেড়ে ঢুকবে তোমার পুরোনো শরীরে৷ তোমার শলাকাবিদ্ধ হৃৎপিণ্ড আবার সচল হবে৷ তখন ভীষণ যন্ত্রণায় কষ্ট পাবে তুমি৷ এভাবে হাজার হাজার বছর ধরে তুমি তোমার কৃতকর্মের ফল ভোগ করবে৷ তুমি কোথাও পালাতে পারবে না৷ তোমাকে আমি সমর্পণ করলাম মৃত্যুর দেবতা আনুবিসের হাতে৷ আদি-অনন্তকাল ধরে তিনি তোমাকে পাহারা দেবেন৷’

আমি ডা. নাসেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বা আর কা কী?’

ডা. নাসের বললেন, ‘প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন যে, ভেড়ার মাথাওলা দেবতা খুনুম মানুষের সৃষ্টিকর্তা৷ শরীর নশ্বর কিন্তু কা হল অবিনশ্বর, সে শরীর পরিবর্তন করতে পারে ও সর্বত্র বিরাজমান৷ অনেকটা আপনাদের দেশের আত্মার মতো কিন্তু আত্মার সঙ্গে কা-র একটা পার্থক্য আছে৷ তার দ্বৈত সত্তা কা ও বা৷ বা-ও অবস্থান করে শরীরের মধ্যে৷ সে নিয়ন্ত্রিত হয় কা-র দ্বারা৷ মিশর গবেষক পণ্ডিত রাইনহার্ড কা ও বা-কে যম হিসেবে বর্ণনা করেছেন৷ সে সময়কার মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন, শরীরের মৃত্যুর পর কা-র সঙ্গে বা মিশে গিয়ে অন্য লোকের উদ্দেশে পাড়ি জমায়৷ আর তার সঙ্গেসঙ্গেই মৃত ব্যক্তির মুক্তি ঘটে৷’

কথাগুলো বলে কয়েক মুহূর্ত দম নিলেন ডা. নাসের৷ তারপর বললেন, ‘প্যাপাইরাসে কী লেখা ছিল তা তো আপনারা শুনলেন! এবার বলি আমি অংশুর রেকর্ড করা ভয়েস শুনে তা থেকে এমন কী কথা উদ্ধার করেছিলাম, যাতে আমার মনে হয়েছিল তার সঙ্গে মরচুয়ারি মন্দির সম্পর্কিত প্যাপাইরাস বর্ণিত ঘটনার মিল আছে৷ অংশুর বক্তব্য আমি সম্পূর্ণ বুঝতে না পারলেও টুকরো টুকরো শব্দ মিলিয়ে দুটো বাক্য আমি বুঝতে পারি৷ এক, আমি বা-র কাছে ফিরে যাব, সে ডাকছে আমায়৷ দুই, রানি তুমি অভিশাপ ফিরিয়ে নাও, আনুবিসকে চলে যেতে বলো৷ আশা করি, এবার আপনারা আপনাদের যাবতীয় প্রশ্নে উত্তর পেয়ে গিয়েছেন৷’ এই বলে তিনি চুপ করে গেলেন৷

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ডা. নাসেরকে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, ‘তাহলে অংশু সত্যিই কি…৷’ কিন্তু তার আগেই অংশু ফিরে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ওখানে একটা লোক মূর্তি বিক্রি করছে৷ আমাকে একটা কিনে দেবে?’

পার্কের এক কোনায় রেলিংয়ের ধারে বসে একটা লোক নানারকমের ছোটো ছোটো পাথরের মূর্তি বিক্রি করছে৷ অংশুকে নিয়ে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম তার সামনে৷ অংশু সাজিয়ে রাখা মূর্তিগুলোর মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট মূর্তি তুলে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘আমি এটা নেব৷’

মূর্তিটা খুব সুন্দর, কালো পাথরের তৈরি৷ সেটা দেখে আমি বললাম, ‘এটা তো আনুবিসের মূর্তি, তোমার ভয় করবে না তো?’

আমার কথা শুনে অংশু কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আমার দিকে৷ তারপর হেসে বলল, ‘ভয় করবে কেন! আনুবিসের মূর্তি তো আমি মরচুয়ারি মন্দিরে অনেক দেখেছি৷’

তার কথা শুনে আমিও হেসে পকেটে হাত ঢোকালাম আনুবিসের দাম মেটাবার জন্য৷

পুনশ্চ : অংশু এখন অনেক বড়ো৷ সামনের বছর সে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে৷ ডা. ঘটকের বাড়িতেই এখন সে থাকে, মিশর থেকে ফিরে আসার পর৷ তার আর কোনোদিন ওই অসুখ হয়নি৷ ডা. ঘটকের বাড়িতে আমার আড্ডাও যথারীতি আগের মতোই চলছে৷ ডা. ঘটক বলেছেন, অংশুর মাধ্যমিক পরীক্ষার পর তিনি আবার আমাদের নিয়ে মিশর বেড়াতে যাবেন৷ সেখানে যাওয়ার জন্য মাঝে মাঝেই পত্রাঘাত করেন ডা. নাসের৷ আমার কিনে দেওয়া সেই পাথরের ছোট্ট আনুবিসের মূর্তিটা এখন শোভা পায় অংশুর পড়ার টেবিলে৷ সে মূর্তিটাকে পেপারওয়েট হিসেবে ব্যবহার করে৷

***

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *