১৪
ঘণ্টাখানেক পরে আমরা থামলাম৷ অন্ধকারের মধ্যে চলতে চলতে কতবার যে সুড়ঙ্গের পাথুরে দেওয়ালে ঠোক্কর খেয়েছি তার কোনো হিসেব নেই৷ কপাল ফুলে গিয়েছে, বোধ হয় রক্তও বেরিয়েছে৷ অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারলাম না৷ কনুইয়ের কাছেও বেশ জ্বালা করছিল৷ অংশুও চলতে চলতে বেশ কয়েকবার ব্যথায় চিৎকার করে উঠেছে৷ কিন্তু তবুও থামিনি আমরা, পাছে আলতুনিয়া আমাদের ধরে ফেলে এই ভয়ে৷
থামবার পর ডা. নাসের বললেন, ‘যতটা পথ এসেছি তাতে আলতুনিয়া আর আমাদের নাগাল পাবে বলে মনে হয় না৷’
আমি তাঁর কথা শুনতে পেলেও অন্ধকারের মধ্যে তাঁকে দেখতে পেলাম না৷ জমাট অন্ধকারের মধ্যে এতটা পথ কীভাবে এলাম তা আমার বোধগম্য হচ্ছিল না৷ শুধু মনে হচ্ছিল সমস্ত ব্যাপারটাই একটা দুঃস্বপ্ন৷ আমি অংশুর হাতটা চেপে ধরে অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম৷ ঠিক সেই সময় অন্ধকারের মধ্যে থেকে ডা. নাসেরের কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ‘আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?’
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখান থেকে বের হব কী করে?’
ডা. নাসের বললেন, ‘একটু দাঁড়ান, আলোটা জ্বালিয়ে নিই৷’
আমি বললাম, ‘আলো! আপনি আলো পাবেন কোথা থেকে?’
অন্ধকারের মধ্যেই তিনি বললেন, ‘গুহার ভিতর পাথরের চাঁইটা আছড়ে পড়ার সময় কারোর হাত থেকে একটা মশাল ছিটকে আমার সামনে পড়েছিল৷ পালাবার সময় মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম৷ আমার পকেটে একটা দেশলাই সবসময় থাকে, সেটা দিয়েই এখন মশাল জ্বালাব৷’
কিছুক্ষণের পর একটা দেশলাইকাঠি ফস করে জ্বলে উঠল আর তারপরেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল মশালটা৷ অন্ধকার কেটে গিয়ে সুড়ঙ্গের বেশ কিছুটা অংশ আলোকিত হয়ে উঠল৷ প্রথমে আমি দেখতে পেলাম ডা. নাসেরের মুখ৷ তাঁর কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে৷ পোশাকও ছিঁড়ে গিয়েছে বেশ কয়েক জায়গায়৷ তারপর তাকালাম অংশুর দিকে৷ দেখলাম, তার চোখ বন্ধ৷ আমার মনে হল, একটানা চলার পর সে এখানে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷
ডা. নাসের বললেন, ‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদের চলবে না৷ ঘণ্টা তিনেক এই মশালের আলো জ্বলবে৷ তার মধ্যেই যেভাবে হোক একটা পথ আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে৷ ছেলেটা যদি আর হাঁটতে না পারে তাহলে আমি ওকে কোলে তুলে নিচ্ছি৷’
আমি বললাম, ‘না, না৷ আপনাকে নিতে হবে না, আমিই নিচ্ছি৷’
এই বলে অংশুকে কোলে তুলে নেওয়ার আগে আমি একবার তার নাম ধরে ডাকলাম৷ আর সঙ্গেসঙ্গেই চোখ মেলল সে৷ আমি তাকে বললাম, ‘তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?’
অংশু উত্তর দিল, ‘না৷ আমি চোখ বুজে মনে করবার চেষ্টা করছিলাম মরচুয়ারি মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা কোনটা৷’
আমার মনে হল, অংশুর কথাগুলো কেমন জড়ানো জড়ানো৷ একটা ঘোরের মধ্যে থেকে যেন সে কথাগুলো বলল৷ তাঁর কথা শুনে ডা. নাসের একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন৷ আমি অংশুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাদের আরও এগোতে হবে৷ তুমি কি হাঁটতে পারবে?’
অংশু বলল, ‘পারব,’ এই বলে সে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করল৷
এই সুড়ঙ্গটা তুলনামূলকভাবে চওড়া৷ পাশাপাশি স্বচ্ছন্দে দু-জনে হাঁটা যায়৷ দেওয়ালও মসৃণ বললেই চলে৷ কিছুক্ষণ চলার পর ডা. নাসের বললেন, ‘না৷ মশালটা এভাবে জ্বালিয়ে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না৷ আমরা বরং মশালটা নিভিয়ে দেওয়ালের গায়ে হাত ছুঁইয়ে চলি৷ তাতে অন্ধকারে চলার গতি কম হলেও মশালটা আমরা দরকারের সময় ব্যবহার করতে পারব৷’
মশাল নিভিয়ে দেওয়া হল৷ অংশুকে আমাদের দু-জনের মাঝে রেখে দেওয়াল ছুঁয়ে চলতে শুরু করলাম৷ ডা. নাসের মশালটা তাঁর মাথার উচ্চতায় ধরে আছেন৷ ছাদ যেখানে অনেক নীচুতে নেমে এসেছে, সেখানে মশালটা যখনই ছাদের সঙ্গে ঠোক্কর খাচ্ছে তখনই ডা. নাসের সাবধান করে দিচ্ছেন আমাকে৷ মনে হল অনন্তকাল ধরে হেঁটে চলেছি এই অন্ধকার পথ ধরে৷ এ চলার বিরাম নেই৷ শেষে একসময় থামলাম৷ ডা. নাসের আবার মশালটা জ্বালালেন৷ দেখলাম, বিরাট বড়ো একটা হলঘরের ভিতর দাঁড়িয়েছি আমরা৷
ডা. নাসের বললেন, ‘এবার আমরা ঘণ্টা পাঁচেকের জন্য বিশ্রাম নেব৷ কারণ, সুস্থ থাকার জন্য এটা এখন অত্যন্ত জরুরি৷ আমাদের হয়তো আরও অনেক পথ চলতে হবে৷ যদিও জানি না এই সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধা থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীর আলো শেষ পর্যন্ত দেখতে পাব কি না!’
আমি অংশুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার চোখের পাতা বন্ধ৷ আমি তার নাম ধরে ডাকলাম, কিন্তু কোনো উত্তর দিল না৷ তাকে মাটির উপর আস্তে আস্তে শুইয়ে দিলাম৷ ডা. নাসের আমাকেও শুয়ে পড়তে বললেন৷ কিন্তু আমার চোখে কিছুতেই ঘুম আসছিল না৷ শুধু মনে হচ্ছিল এই অন্ধকার জগৎ থেকে আর মুক্ত হতে পারব না৷ মৃত্যুভয় চেপে বসতে লাগল আমার উপর৷ আমি বসে বসে চিন্তা করতে লাগলাম ডা. ঘটকের কথা, আমার ছেলেবেলার কথা, প্রিয়জনের কথা৷
ডা. নাসের মশালটা হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে চারপাশটা দেখছিলেন৷ বেশ কয়েকটা সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ বেরিয়েছে ঘরের নানা দিক থেকে৷ সেগুলোর মধ্যে উঁকি মারছিলেন তিনি৷ হঠাৎ শুনতে পেলাম ডা. নাসের বললেন, ‘মি. সেন, একবার এদিকে আসুন৷’
ডা. নাসের দাঁড়িয়ে ছিলেন একটা সুড়ঙ্গের সামনে৷ আমি গিয়ে সেখানে দাঁড়াতেই ডা. নাসের মশালটা মাথার উপর উঁচু করে ধরে সুড়ঙ্গে ঢোকার মুখের উপরের দেওয়ালে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছেন?’
ভালো করে দেখার পর মনে হল, সেখানে দেওয়ালের গায়ে যেন কিছু খোদাই করা৷ কিন্তু তার প্রায় সবটুকুই ধুলোবালিতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে৷ জায়গাটা মাটি থেকে ফুট দশেক উঁচুতে৷ মাটিতে দাঁড়িয়ে ছোঁওয়া যাবে না৷
ডা. নাসের আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি মাটিতে বসে পড়ছি, আপনি আমার পিঠের উপর দাঁড়িয়ে ধুলোবালি পরিষ্কার করুন৷’ এই বলে তিনি মশালটা আমার হাতে দিয়ে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে মাটির উপর বসে পড়লেন৷ আমি তাঁর পিঠে দাঁড়াবার আগে একটু ইতস্তত করতে লাগলাম৷ তা দেখে তিনি নির্দেশের সুরে বললেন, ‘এখন ভদ্রতা রক্ষার সময় নয়, যা বলছি তাই করুন৷’
আমি এবার তাকালাম ডা. নাসেরের চোখের দিকে৷ দেখলাম, তাঁর চোখ দুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে৷ তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘হয়তো এই সুড়ঙ্গ শেষ পর্যন্ত আমাদের পৃথিবীর আলো দেখাবে৷’
এরপর মশাল নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা৷
ডা. নাসের যখন ঘুম ভাঙালেন তখন আমার ঘড়িতে ঠিক পাঁচটা বাজে৷ বাইরের পৃথিবীতে নিশ্চয়ই এতক্ষণে আলো ফুটে গিয়েছে৷ কিন্তু তার চিহ্নমাত্র নেই এই পাতালপুরীতে৷ চারপাশে শুধু জমাট অন্ধকার৷ ডা. নাসের মশালটা আবার কিছুক্ষণের জন্য জ্বালালেন৷ অংশুর ঘুম ভাঙিয়ে কয়েক ঢোক জল খাওয়ালাম৷ আমরাও মুখে দিলাম কয়েক ফোঁটা৷ অংশুকে মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সাহস দেওয়ার জন্য বললাম, ‘তোমার কোনো ভয় নেই৷ আজই আমরা এখান থেকে বাইরে বের হব৷’
সে আমার দিকে একবার তাকাল মাত্র৷ কিন্তু কোনো উত্তর দিল না৷ ডা. নাসের মশালটা নিভিয়ে দিলেন৷ অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে আবার শুরু হল আমাদের যাত্রা৷
একটার পর একটা সুড়ঙ্গপথ বেয়ে আমরা এগিয়ে চললাম৷ ঘড়ির কাঁটাও ঘুরতে লাগল সেই সঙ্গে৷ মাঝে মাঝে কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামছি৷ মুখে দিচ্ছি কয়েক ফোঁটা করে জল৷ জলও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে৷ আমি আর ডা. নাসের গায়ের জামাগুলো ছিঁড়ে লম্বা লম্বা ফালি করে নিয়েছি মশালের উপর জড়ানোর জন্য, যাতে মশালটা বেশি সময় ধরে জ্বলে৷ ডা. নাসের মাঝে মাঝে মশালটা জ্বালাচ্ছেন পথের দিশা ঠিক করে নেওয়ার জন্য৷ আমি আর অংশু তাঁকে অনুসরণ করছি৷ অংশু কোনো কথা বলছে না৷ মনে হচ্ছে, সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে৷
বেলা দশটা নাগাদ আমরা একটা বিরাট হলঘরে ঢুকলাম৷ ডা. নাসের মশালটা জ্বালালেন সেখানে৷ সারা ঘরের দেওয়াল জুড়ে নানা ধরনের সব ছবি আঁকা৷ সে ঘর থেকে আরও দুটো সুড়ঙ্গ দু-দিকে বেরিয়েছে৷ ডা. নাসের মশাল জ্বালিয়ে দেওয়ালগুলো দেখতে দেখতে একজায়গায় এসে থামলেন৷ সেখানে একটা হাইয়ারোগ্লিফিক বেশ কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখার পর তিনি আমাকে ক্যামেরার লেন্সের মধ্যে রাখা প্যাপাইরাসটা বের করতে বললেন৷ দেওয়ালের গায়ের হাইয়ারোগ্লিফিকের সঙ্গে ডা. নাসের সেটা মেলাতে লাগলেন এক মনে৷ কিছুক্ষণ পর তিনি নিজের মনেই বললেন, ‘না, এসবের পিছনে সময় নষ্ট করা এখন আর উচিত হবে না৷ সময় এখন অত্যন্ত মূল্যবান৷’ এই বলে তিনি প্যাপাইরাসটা আবার গোটাতে শুরু করলেন৷
‘কী লেখা আছে দেওয়ালে?’ আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম৷
ডা. নাসের মৃদু হেসে বললেন, ‘যে সমাধির সন্ধানের জন্য আলতুনিয়া আমাদের ধরেছিল, ড. হান্স সম্ভবত যে সমাধির সন্ধান করছেন, সব চেয়ে বড়ো কথা, যে সমাধির সঙ্গে অংশুর অসুখের একটা অদৃশ্য যোগসূত্র আছে বলে মনে হয়, সেই সমাধির কাছে যাওয়ার রাস্তা এই ঘরেই কোথাও লুকোনো আছে৷ কিন্তু তা খুঁজে বের করার সময় ও রসদ এই মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই৷ এখন আমাদের প্রথম কাজ হল, এই অন্ধকার পৃথিবী থেকে মুক্তি পাওয়া৷ প্রাণ নিয়ে বাইরে যেতে পারলে ভবিষ্যতে একদিন হয়তো এখানে ফিরে আসতে পারব৷ তবে এ ঘরে পৌঁছোবার পর একটা জিনিস আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, আমরা এই মুহূর্তে রয়েছি মরচুয়ারি মন্দিরের নীচে অথবা খুব কাছাকাছি কোনো জায়গায়৷ মুক্তির পথ এবার আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে৷’
আমরা যে সুড়ঙ্গ দিয়ে ঘরে ঢুকেছি সেটা ছাড়া ঘরের উলটো দিকের দেওয়াল থেকে আরও দুটো সুড়ঙ্গপথ বেরিয়েছে৷ সুড়ঙ্গ দুটোর মুখে মশালের আলো ফেলে যতটুকু বোঝা গেল, তার একটা ঢালু হয়ে আরও মাটির গভীরে নেমে গিয়েছে, আর-একটা উপর দিকে উঠে গিয়েছে৷ যে সুড়ঙ্গটা উপর দিকে উঠেছে সে পথেই যাবেন বলে মনস্থির করলেন ডা. নাসের, হয়তো সে পথে উঠে পৃথিবীর আলো দেখা যেতে পারে এই আশায়৷ আমরা যখন সেই সুড়ঙ্গে ঢুকতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই সুড়ঙ্গে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে ঘাড় নাড়তে শুরু করল অংশু৷ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি কিছু বলবে?’
সে উত্তর দিল না, শুধু প্রবলভাবে ঘাড় নাড়তে লাগল৷ দেখলাম, তার দৃষ্টি কেমন ঘোলাটে৷ আমি আবার তাকে একই প্রশ্ন করলাম৷ কিন্তু মনে হল আমার কথা যেন তার কানে যাচ্ছে না৷
ডা. নাসের আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাহলে এ সুড়ঙ্গপথ দিয়ে কি বাইরে যাওয়া যাবে না! ও কি সে কথাই বলছে ঘাড় নেড়ে? আচ্ছা, তাহলে আর একটা সুড়ঙ্গ দেখা যাক৷ হয়তো ও-ই আমাদের শেষ পর্যন্ত মুক্তির রাস্তা দেখাবে৷’
আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম, যে সুড়ঙ্গটা নীচের দিকে নেমে গিয়েছে তার ঢোকার মুখে৷ কিন্তু তার ঢোকার মুখে দাঁড়িয়েও অংশু একই রকমভাবে ঘাড় নাড়তে লাগল৷ আমি তাকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলাম, সে কি কিছু বলতে চাইছে? কিন্তু আগের মতোই কোনো উত্তর পেলাম না৷ কয়েক মিনিট আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে৷
ডা. নাসের তারপর বললেন, ‘আমার মনে হয় আসলে প্রচণ্ড পরিশ্রমে আর খিদে-তেষ্টায় ও বিকারগ্রস্ত হয়েছে৷ আমরা বরং যে সুড়ঙ্গ উপর দিকে উঠেছে সেটায় ঢুকব৷’ এরপর অংশুকে কিছুটা জোর করেই আমরা ঢুকলাম আগের সুড়ঙ্গটায়৷
আবার শুধু চলা আর চলা৷ সুড়ঙ্গ বেশ কিছুটা উপর দিকে উঠে আবার নীচের দিকে নেমেছে৷ সে পথ নীচে নামার পর আবার উপরে উঠেছে৷ এভাবে উপর-নীচ করতে করতে এগোতে লাগলাম আমরা৷ ডা. নাসের কখনো ক্ষণিকের জন্য মশাল জ্বালচ্ছেন, আবার নিভিয়ে ফেলছেন৷ এক জায়গায় মশাল জ্বালতেই দেখলাম, সুড়ঙ্গের ছাদে আর দেওয়ালে নানা ধরনের ছবি আঁকা৷ ছবিগুলো ঘন নীল আর সোনালি রঙে আঁকা৷ তার মধ্যে রয়েছে ফ্যারাও, নানা দেবদেবী, পশুপাখি ইত্যাদির ছবি৷ এত বছর পরেও ছবিগুলো একটুও নষ্ট হয়নি৷ বিশেষত, সোনালি রংগুলো মশালের আলোয় ঝলমল করে উঠছে৷ ডা. নাসের আমার একটা ভুল ভেঙে দিলেন৷ তিনি বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন সোনালি রংগুলো আজও এত ঝলমলে কেন! আসলে ওগুলো হচ্ছে সোনার পাত, রং নয়৷ ছবির মধ্যে সোনার পাতগুলো বসানো আছে৷ সমাধিচোরের দল নিশ্চয়ই এখনও এ সুড়ঙ্গের সন্ধান পায়নি৷ তাহলে ওরা কবেই খুলে নিয়ে যেত এসব৷’
আমি বললাম, ‘তাহলে মরচুয়ারি মন্দির থেকে ওরা আমাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল কোন পথে?’
ডা. নাসের বললেন, ‘এ পথে নয়, নিশ্চয়ই অন্য কোনো পথে৷’
সময় এগিয়ে চলতে লাগল, কিন্তু পথ শেষ হল না৷ প্রতি মুহূর্তেই মনে হতে লাগল, হয়তো আর একটু এগোলেই শেষ হবে সুড়ঙ্গ, আমরা আবার পৃথিবীর আলো দেখতে পাব৷ বিশেষত, যেসব জায়গায় সুড়ঙ্গ উপর দিকে উঠেছে সেসব জায়গায় বারবার এই আশা জেগে উঠতে লাগল৷ কিন্তু উপরে ওঠার পর ভুল ভেঙে যাচ্ছিল৷ সুড়ঙ্গ আবার নেমে যাচ্ছিল নীচের দিকে৷ ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়তে লাগলাম৷ শরীর অবসন্ন হচ্ছে, পা যেন আর চলছে না৷ আমি আর ডা. নাসের দরকার ছাড়া কোনো কথা বলছি না৷ অংশুকে প্রশ্ন করলেও কোনো কথা বলছে না৷ সম্পূর্ণ ঘোরের মধ্যে দিয়ে সে হেঁটে চলেছে, ঠিক যেন দম দেওয়া একটা কলের পুতুল৷
এভাবে চলতে চলতে দুপুর গড়িয়ে গেল৷ আমরা আর হাঁটতে পারছি না৷ কিছু দূর চলার পরই বিশ্রাম নিতে হচ্ছে৷ অবশেষে বিকেল পাঁচটা নাগাদ অর্থাৎ অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে আরও প্রায় সাত ঘণ্টা হাঁটার পর আমরা এসে ঢুকলাম একটা বিরাট ঘরের মধ্যে৷ ডা. নাসের তাঁর মশালটা জ্বাললেন৷ ঘরটার দেওয়ালে নানা ধরনের ছবি আঁকা৷ হঠাৎ মশালের আলোয় আমার নজরে পড়ল ঘরের মেঝেয় ধুলোর উপর বেশ কয়েকটা পায়ের ছাপ৷ তা দেখে আমি ডা. নাসেরকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে উঠলাম, ‘এই ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার রাস্তা আছে৷ ওই দেখুন ধুলোর উপর মানুষের পায়ের ছাপ!’
ডা. নাসেরের চোখ দুটো খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল আমার কথা শুনে৷ তিনি নীচু হয়ে ছাপগুলো দেখবার জন্য মশালের আলো ফেললেন সেখানে৷ আর সঙ্গেসঙ্গেই তাঁর চোখের দ্যুতি নিভে গিয়ে সারা মুখে ফুটে উঠল গভীর হতাশা৷ ধীরে ধীরে সেখানেই মাটির উপর বসে পড়লেন তিনি৷
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হল ডা. নাসের?’
তিনি আঙুল তুলে ছাপগুলো দেখিয়ে দিলেন৷ ভালো করে দেখার পর আমার কাছে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল৷ পায়ের ছাপগুলো আসলে আমাদেরই৷ ডা. নাসের মৃদুস্বরে বললেন, ‘সারাদিন আমরা একই সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়িয়েছি৷ এ ঘরের এক দিক দিয়ে বেরিয়ে আর এক দরজা দিয়ে একই জায়গায় ফিরে এসেছি৷ এখন বুঝতে পারছি অংশু কেন দুটো সুড়ঙ্গের কোনোটাতেই ঢুকতে চাইছিল না! আসলে আমরা আটকে গিয়েছি এখানে৷ সমাধিচোরদের ফাঁকি দেওয়ার জন্য ফ্যারাওরা এ ব্যবস্থা করে রাখতেন৷’
আমি আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘আমরা কি কোনোদিন পৃথিবীর আলো দেখব না?’
ডা. নাসের বললেন, ‘হয়তো তাই৷’
তাঁর কথা শুনে আমার বুকের ভিতর যেন হাতুড়ি পেটা শুরু হল৷ মনে হল, আমি এবার পাগল হয়ে যাব! আমি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম৷ অংশু আমার পাশে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে আর মৃদু মৃদু দুলছে৷ প্রতিটি মুহূর্ত যেন অসহ্য মনে হতে লাগল৷
কয়েক মিনিট পর ডা. নাসের যেন নিজেকে একটু শক্ত করে আমাকে বললেন, ‘চলুন, আমরা এখন শুয়ে পড়ি৷ ঘণ্টা পাঁচেক পর একটা শেষ চেষ্টা করা যাবেখন৷ তারপর কপালে যা আছে হবে৷’
তাঁর কথা শুনে আমার মনেও একটু সাহস এল৷ ঘরের এক কোনায় একটা পাথরের বেদি ছিল৷ অংশুকে নিয়ে গিয়ে প্রথমে শুইয়ে দিলাম সেখানে৷ ডা. নাসেরের কথামতো জলের বোতলের তলায় যেটুকু জল ছিল তা ঢেলে দিলাম অংশুর গলায়৷ তারপর মশাল নিভিয়ে দু-জনে শুয়ে পড়লাম অংশুর পাশে৷ জলও নেই, আলোও প্রায় শেষ! কীভাবে বাইরে যাব আমরা! অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে এসব চিন্তা করতে করতে আবার আতঙ্ক ঘিরে ধরল আমাকে৷ আতঙ্ক এবং পথশ্রমের ক্লান্তিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম৷