১২
তাঁবুর বাইরে আসার পর যাযাবরদের সর্দার সেই ঢ্যাঙা লোকটা এগিয়ে এল আলতুনিয়ার দিকে৷ দু-জনের মধ্যে অচেনা ভাষায় কী যেন কথাবার্তা শুরু হল৷ একটু পরেই দেখলাম দু-জনেই উত্তেজিত হয়ে পরস্পরকে বোঝাবার চেষ্টা করছে৷ ঢ্যাঙা লোকটি বেশি উত্তেজিত৷ বারবার সে গুহাটার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে কী যেন বলছে৷ তারা যেখানে দাঁড়িয়ে, তার হাত পাঁচেক পিছনে দাঁড়িয়ে আমরা৷ তাদের উত্তেজিত হতে দেখে আলতুনিয়ার নিজস্ব তিন সঙ্গীর মধ্যে দু-জন আলতুনিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল৷ অন্য একজন আমাদের থেকে হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আলতুনিয়া আর ঢ্যাঙা লোকটির কথা শুনতে লাগল৷ তাঁবুর একটু দূরে বসা অন্য যাযাবরদের দৃষ্টিও দেখলাম তাদের সর্দার ও আলতুনিয়ার উপর নিবদ্ধ৷ সেই সুযোগে ডা. নাসের ফিসফিস করে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘যাযাবর সর্দারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আলতুনিয়া মাঝে মাঝে ভুল করে আরবি শব্দ বলে ফেলেছে৷ তাতে যতটুকু বুঝছি তা হল, আলতুনিয়া ওদের নিয়ে গুহায় ঢুকতে চাইছে না৷ কিন্তু ওরা আমাদের সঙ্গে যেতে চাইছে৷ আপনি ভয় পাবেন না, ওই সমাধি খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আলতুনিয়া আমাদের কাউকে মারবে না৷ আগে আমাদের সুড়ঙ্গপথে হাটশেপসুটের মরচুয়ারির কাছ পর্যন্ত পৌঁছোতে হবে৷ তারপর ওর হাত থেকে বাঁচবার চেষ্টা করতে হবে৷ আর সুড়ঙ্গে ঢোকার পর চেষ্টা করবেন আমরা তিন জন যেন সবসময় কাছাকাছি থাকতে পারি৷’
আলতুনিয়ার যে সঙ্গী আমাদের একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, সে মনে হয় বুঝতে পারল ডা. নাসের আমাকে কিছু বলছেন৷ তাই সে একেবারে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল৷ অংশুকে দেখলাম সে শুধু একদৃষ্টিতে লক্ষ করছে যাযাবরদের হিংস্র কুকুরগুলোকে৷ আমি তার হাতটা শক্ত করে ধরে আছি৷ তাকে সাহস দেওয়ার জন্য আমি বললাম, ‘ভয় নেই, ওরা তোমার কিছু করতে পারবে না৷’
অংশুর গলা দিয়ে শুধু একটা অস্পষ্ট শব্দ বের হল, ‘আনুবিস!’
কিছুক্ষণ পর যাযাবর সর্দার আর আলতুনিয়ার মধ্যে উত্তেজিত কথাবার্তা থেমে গেল৷ মনে হল, তারা দু-জনে শেষ পর্যন্ত একটা সমঝোতা সূত্রে পৌঁছোল৷ তার একটু পরেই আলতুনিয়া ও যাযাবরদের দলের সঙ্গে আমরা এসে দাঁড়ালাম সুড়ঙ্গে ঢোকার গুহামুখের সামনে৷ গুহায় ঢোকার আগে সর্দার নিজের দলের লোকদের উদ্দেশে কী যেন বলতে শুরু করল৷ আর তার কথা শুনে লোকগুলো গোল হয়ে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে মাথা ঝাঁকাতে লাগল৷ ডা. নাসের তাই দেখে আলতুনিয়াকে প্রশ্ন করলেন, ‘ও কী বলছে?’
আলতুনিয়া বলল, ‘ও বলছে যে, সে ওদের পূর্বপুরুষ সেনমুটের রত্নভাণ্ডার উদ্ধার করতে যাচ্ছে৷ শিগগিরই সে ফিরে আসবে তার সঙ্গীদের কাছে৷ যে সম্পদ সে পাবে তা দিয়ে মরুভূমির বুকে নতুন এক রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করবে৷ তার আর সেনমুটের দুটো বিরাট মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করা হবে সেখানে, এই সব আর কি৷’ এই বলে আলতুনিয়া হাসল৷
সূর্যের আলো ঝিলিক মারল তার দাঁতে৷ ডা. নাসের হেসে বললেন, ‘আমি যদি ওদের বলি যে, আমরা সেনমুটের রত্নভাণ্ডারের সন্ধান জানি না, তুমি ওদের ভাঁওতা দিচ্ছ, তাহলে?’
আলতুনিয়া বলল, ‘সে চেষ্টা তুমি করে দেখতে পার৷ কিন্তু ওরা ইংরেজি বা আরবির বিন্দুবিসর্গ বোঝে না৷ কাজেই কোনো লাভ হবে না৷’
যাযাবর সর্দারের ভাষণ শেষ হওয়ার পর আলতুনিয়া তার সঙ্গে কী সব কথাবার্তা বলল৷ তারপর ডা. নাসেরকে বলল, ‘এই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে হাটশেপসুটের মন্দিরের নীচে পৌঁছোতে ঘণ্টা আটেক সময় লাগবে৷ আমরা এই সুড়ঙ্গে ঢুকব ঠিকই, কিন্তু তারপর অন্য সুড়ঙ্গ ধরে ঘুরপথে মন্দিরের তলায় পৌঁছোব৷ তাতে একটা দিন লেগে যাবে ঠিকই, কিন্তু তা অনেক বেশি নিরাপদ৷ কারণ, আমি চাই না হাটশেপসুটের মন্দিরের নীচে সুড়ঙ্গপথে তোমার সঙ্গীরা, যারা হয়তো তোমাদের খুঁজছে অথবা অন্য কোনো অনুসন্ধানকারী দলের সঙ্গে আমার দেখা হোক৷ আর একটা কথা মগজে ঢুকিয়ে নাও৷ আমাকে কোনো বিপদে ফেলার চেষ্টা করলে সঙ্গেসঙ্গে মারা পড়বে তোমরা৷’
ডা. নাসের তার কথা শুনে হেসে বললেন, ‘আচ্ছা মনে থাকবে৷’
গুহায় ঢোকার আগে একটা লোক তাঁবুর ভিতর থেকে বেশ কিছু জিনিসপত্র নিয়ে এল৷ খাবারও এল তার সঙ্গে৷ আমাদের খেতে দেওয়া হল রুটিজাতীয় একধরনের খাবার আর জল৷ খাবার পর শরীরটা যেন একটু চাঙা মনে হল৷ আসলে তার আগে পর্যন্ত যেন খিদে-তেষ্টার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা৷
সব মিলিয়ে আট জন ঢুকলাম গুহার ভিতর সুড়ঙ্গপথে৷ আমরা তিন জন, আলতুনিয়া ও তার দুই সঙ্গী এবং যাযাবর সর্দার ও তার এক সঙ্গী৷ আলতুনিয়া ডা. নাসেরকে বলল, ‘যে গুহামুখ দিয়ে আমরা সুড়ঙ্গে ঢুকলাম, তার নাম জানেন আপনি?’
ডা. নাসের জবাব দিলেন, ‘না৷’
আলতুনিয়া বলল, ‘এই গুহামুখের নাম ‘সেনমুটের গুহা’৷ প্রাচীন প্রবাদ হল, হাটশেপসুটের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে সেনমুট নাকি এ পথেই মরুভূমির বুকে পালিয়ে গিয়েছিলেন৷ আমার নিজেরও ধারণা, সেনমুটই এই সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিলেন৷’
ডা. নাসের প্রশ্ন করলেন, ‘এ ধারণার ভিত্তি কী?’
আলতুনিয়া বলল, ‘আমি দেখেছি এই সুড়ঙ্গের অনেক জায়গায় সারস পাখির ছবি খোদাই করা আছে৷ সেসময় ফ্যারাওদের ঘনিষ্ঠ অভিজাত ব্যক্তিরা নানাধরনের প্রতীক ব্যবহার করতেন৷ অনেক দিন আগে হাটশেপসুটের আমলের এক চিত্রলিপি দেখেছিলাম৷ তাতে হাটশেপসুটের এক বিশ্বস্ত মন্ত্রী, তাঁর ব্যক্তিগত প্রতীকচিহ্ন হিসেবে সারস পাখির ছবি ব্যবহার করতেন, সেই উল্লেখ আছে৷ নাম উল্লেখ না থাকলেও আমার বিশ্বাস, সারস পাখির প্রতিকৃতি ব্যবহারকারী ওই ব্যক্তি হলেন সেনমুট৷ আর এই সুড়ঙ্গ তিনিই তৈরি করেন৷’
আলতুনিয়ার কথা শুনে ডা. নাসের কিছুটা আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘তোমার বেশ কিছু ভালো গুণ ছিল আলতুনিয়া! কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তা তুমি ভালো কাজে লাগালে না!’
সুড়ঙ্গের মধ্যে চলতে চলতে আলতুনিয়া এর পর ঝাঁঝিয়ে উঠে ডা. নাসেরকে বলল, ‘ভালো কাজে লাগিয়ে কী হবে শুনি? আপনি তো নিশ্চয়ই আবু হোসেনকে চিনতেন৷ তাঁর মতো আর কোনো মিশর-বিশেষজ্ঞ চিত্রলিপি পড়তে পারতেন না৷ তাঁর সাহায্যে কত সমাধির যে সন্ধান মিলেছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই৷ কত লোক তাঁকে ব্যবহার করে অর্থ-নাম-যশ কামিয়েছে৷ কিন্তু আবু হোসেনের কিছুই হয়নি, না অর্থ, না যশ! শেষ জীবনে তাঁকে ভিক্ষে করে কাটাতে হয়েছে কায়রো মিউজিয়ামের সামনে আল তহরি স্কোয়ারে৷ মারা যাওয়ার পর অন্য ভিখিরিরা চাঁদা তুলে তাঁর সমাধির ব্যবস্থা করেছিল৷ এই তো হল ভালো কাজ করার ফল!’
আলতুনিয়ার কথা শুনে ডা. নাসের বললেন, ‘আসলে তোমার মতো মানুষরা নিজেদের অপরাধের সমর্থনে একটা করে যুক্তি খাড়া করে রাখে৷ তাই তুমি এ উদাহরণটা দিলে৷’ ডা. নাসেরের এ কথার কোনো উত্তর দিল না আলতুনিয়া৷
সুড়ঙ্গটা ঢালু হয়ে নীচের দিকে নেমে গিয়ে ডান দিকে একটা বাঁক নিয়েছে৷ এতক্ষণ কোথা দিয়ে যেন একটা আবছা আলো ভেসে আসছিল৷ মনে হয় মাথার উপরের কোনো ফাটল দিয়ে৷ কিন্তু বাঁকের পরই শুরু হল ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ আলতুনিয়ার সঙ্গীরা বেশ কয়েকটা মশাল সঙ্গে এনেছিল৷ বাঁকের মুখে এসে তারই একটা জ্বালানো হল৷ তারপর সেই অন্ধকার রাজ্যের মধ্যে আমরা ঢুকলাম৷
এ সুড়ঙ্গপথ খুব সংকীর্ণ৷ কোনো রকমে দু-জন লোক পাশাপাশি চলতে পারে৷ সুড়ঙ্গের ছাদও খুব নীচু, প্রায় মাথায় ঠেকে যাচ্ছে৷ প্রথমে মশাল হাতে চলেছে আলতুনিয়ার একজন সঙ্গী৷ তারপর আলতুনিয়া এবং যাযাবরদের সর্দার৷ এদের পিছনে ডা. নাসের, অংশু ও আমি৷ আমার পিছনে অন্য দুই জন৷ এভাবে সার বেঁধে চলতে লাগলাম আমরা৷ পায়ের নীচে এবড়োখেবড়ো পাথরে ভরতি৷ তার উপর দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল প্রত্যেকেরই৷ তাই খুব ধীর গতিতে এগোচ্ছিলাম আমরা৷ টানা ঘণ্টা দুয়েক চলার পর একজায়গায় থামলাম৷ জায়গাটা একটু চওড়া, মানে একটা ছোটো ঘরের মতো৷ সেখান থেকে সুড়ঙ্গ দু-দিকে ভাগ হয়ে গিয়েছে৷ তার মধ্যে একটা সুড়ঙ্গ বাঁ-দিকে বেঁকে গিয়েছে৷ সেটা দেখিয়ে আলতুনিয়া বলল, ‘এ পথে গেলে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই আমরা মরচুয়ারি মন্দিরে পৌঁছে যেতে পারি৷ এ পথ দিয়েই ধরে আনা হয়েছিল আপনাদের৷ কিন্তু আমরা ধরব ডান দিকের সুড়ঙ্গ৷ এই সুড়ঙ্গ ভ্যালি অফ কিংসের নীচ দিয়ে পৌঁছেছে মরচুয়ারি মন্দিরের নীচে৷’
আমরা ঢুকলাম ডান দিকের সুড়ঙ্গে৷ এ সুড়ঙ্গ আরও বেশি সংকীর্ণ৷ ছাদও বেশ নীচু৷ একটু অসাবধান হলেই পাথরের ছাদে মাথা ঠুকে যাওয়ার আশঙ্কা৷ ঢ্যাঙা যাযাবর সর্দারটি বেশ কয়েকবার ঠোক্কর খেল সুড়ঙ্গে ঢোকার পরই৷ তা দেখে মনে মনে অবশ্য বেশ আনন্দই হল৷ অংশু চলেছে ঠিক আমার সামনে সামনে৷ আমি তাকে বার দুয়েক জিজ্ঞেস করলাম, তার কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি না?’
সে বলল, ‘না৷’
ঘণ্টা তিনেক সেই সুড়ঙ্গ ধরে চলার পর আমরা এসে পৌঁছোলাম একটা হলঘরের মতো জায়গায়৷ আলতুনিয়া বলল, ‘আমরা এখানে একটু বিশ্রাম নেব৷’
তার সঙ্গী মশালটা গুঁজে দিল দেওয়ালের খাঁজে একটা উঁচুমতো জায়গায়৷ মাটিতে জমে আছে শতাব্দী প্রাচীন পুরু ধুলোর আস্তরণ৷ তার উপরেই বসে পড়লাম সকলে৷ অংশু আমাকে বলল, ‘আমার জলতেষ্টা পেয়েছে৷’
আলতুনিয়ার এক সঙ্গীর কাছ থেকে ইশারায় জলের বোতল চাইলাম৷ যাতে কোনো ভাবেই পালাতে না পারি, সম্ভবত সেজন্যই আমাদের কোনো জলের বোতল দেওয়া হয়নি৷ অথচ আমরা ছাড়া প্রত্যেকেরই, এমনকী আলতুনিয়ার কোমরেও ঝুলছে একটা জলের বোতল৷ জল চাইতেই সে আলতুনিয়াকে আরবি ভাষায় কী একটা বলল৷ মনে হল, জল দেওয়ার ব্যাপারে সে আলতুনিয়ার কাছে অনুমতি চাইল৷ তারপর সে কোমর থেকে জলের বোতল খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল৷ আমি বোতলটা নিয়ে অংশুকে দিলাম৷ সে কয়েক ঢোক জল খাওয়ার পর আমি আবার সেটা ফিরিয়ে দিলাম আলতুনিয়ার সেই সঙ্গীর দিকে৷
তার পরমুহূর্তেই অংশু হঠাৎ ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল! সে কেন এরকম ভয় পেল আমি প্রথমে তা বুঝতে পারলাম না৷ পরে অংশুর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনের দেওয়ালের দিকে তাকাতেই আমার বুকটাও প্রথমে ধক করে উঠল৷ মশালের আলোটা হালকা হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে সারা ঘরে৷ সেই আলোয় দেখতে পেলাম, আমরা যেখানে বসে আছি তার ফুট তিরিশেক দূরে উলটো দিকের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে একটা নরকঙ্কাল! তার দুটো পায়ে বুট জুতো আর গায়ে কাপড়ের টুকরো এখনও লেগে রয়েছে৷ আশপাশেও ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু জিনিসপত্র৷ তবে আবছা আলোয় সেসব ঠিক ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না৷ অংশু আমাকে জড়িয়ে ধরল দেখে আলতুনিয়া বুঝতে পারল অংশু ভয় পেয়েছে৷ এবং ভয়ের কারণটাও তার বুঝতে দেরি হল না৷
আলতুনিয়া শব্দ করে হেসে উঠে কঙ্কালটার দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ও নড়বে না৷ কুড়ি বছর আগেও ওকে আমি ওখানেই একইভাবে বসে থাকতে দেখেছি৷ হয়তো একশো বছর ধরে সে ওখানে এমন ভাবেই বসে আছে৷ লোকটি হয়তো কোনো সমাধির সন্ধানে সুড়ঙ্গে ঢুকেছিল, তারপর আর বাইরে বের হতে পারেনি৷ খিদে-তেষ্টায় শুকিয়ে মরেছে৷ সুড়ঙ্গে এসব দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়৷’
ইতিমধ্যে অন্যদের নজরে পড়েছে কঙ্কালটা৷ আমি অংশুকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার পর সে শান্ত হল৷ আমার ডান পাশে বসে ছিল ঢ্যাঙা সর্দারটা৷হঠাৎ তার কী মনে হওয়ায় আমাদের পাশ থেকে উঠে গিয়ে কঙ্কালটার সামনে দাঁড়াল৷ তারপর কাঁধ থেকে বন্দুক খুলে নিয়ে তা দিয়ে কঙ্কালটার পাশে পড়ে থাকা জিনিসপত্রগুলো ঘাটতে থাকল৷
ডা. নাসের তা দেখে আলতুনিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কী খুঁজছে ওখানে?’
‘হয়তো ভাবছে ওর কাছে সোনা-টোনা পাওয়া যেতে পারে৷’ হেসে উত্তর দিল আলতুনিয়া৷
কিন্তু তার কথা শেষ হতে-না-হতেই হঠাৎ চিৎকার করে দু-পা পিছিয়ে এল ঢ্যাঙা লোকটি৷ সবাই চমকে তাকালাম সেদিকে৷ প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না৷ তারপর লোকটির হাত দুয়েক দূরে ফুট পাঁচেক উচ্চতায় শূন্যে দুটো ছোট্ট আলোর বিন্দু চোখে পড়ল৷ অন্ধকারের মধ্যে সে দুটো জ্বলছে৷ আস্তে আস্তে দৃশ্যটা সম্পূর্ণ বুঝতে পারলাম৷ লোকটির সামনে ল্যাজের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুচকুচে কালো একটা সাপ৷ তার চোখ দুটোই অন্ধকারে চুনির মতো জ্বলছে৷ লোকটি বা সাপটা কেউই নড়ছে না৷
দু-জনেই চেয়ে আছে দু-জনের দিকে৷ আমরাও সকলে সেদিকে তাকিয়ে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেলাম৷ শুধু আলতুনিয়া আস্তে আস্তে কোমর থেকে তার রিভলভারটা টেনে বার করল৷ আরও কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল৷ তারপরই হঠাৎ সাপটা লাফিয়ে পড়ল লোকটির গায়ে৷ একটা মৃদু ঝটাপটির পর বীভৎস চিৎকার করে কাটা কলা গাছের মতো দুম করে মাটিতে পড়ে গেল লোকটি৷ তার দেহ ছেড়ে সরসর করে ঘরের উলটো দিকে ছুটে গেল সাপটা৷
এবার প্রচণ্ড শব্দে গর্জন করে উঠল আলতুনিয়ার হাতের রিভলভার৷ ধোঁয়ায় ভরে গেল আমাদের সামনেটা৷ মাথার উপর থেকে খসে পড়ল ধুলোবালি৷ ধোঁয়া কাটতেই দেখি, মাটির উপর ছড়িয়ে আছে সাপটার শরীরের ছিন্নভিন্ন অংশ৷ আলতুনিয়ার একজন সঙ্গী দেওয়াল থেকে মশালটা খুলে নিয়ে এগিয়ে গেল মাটিতে পড়ে থাকা ঢ্যাঙা লোকটির কাছে৷ আমরাও এগিয়ে গেলাম সেখানে৷ কিন্তু যাযাবর সর্দারের শরীর মুহূর্তের মধ্যেই যেন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছে৷ সারা মুখ তার নীল, বিস্ফারিত চোখ দুটো তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে৷ তার প্রাণপাখি যে বেরিয়ে গিয়েছে তা বুঝতে অসুবিধে হল না৷ সামনে বসে তার সঙ্গী যাযাবরটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷ মশালের আলোয় আর-একটা জিনিস আমাদের চোখে পড়ল৷ কঙ্কালটার পাশেই নানা আবর্জনার মধ্যে পড়ে রয়েছে গোটা দশেক ডিম৷ আসলে সাপটা তার নিজের বাসায় যাযাবর সর্দারের অনধিকারচর্চা পছন্দ করেনি৷ তাই তাকে আক্রমণ করেছিল৷ আলতুনিয়া শুধু বলল, ‘ভয়ংকর বিষধর সাপ, স্যান্ড ভাইপার আর আফ্রিকার বিখ্যাত ব্ল্যাক মাম্বার সংকর৷ কামড়ালেই মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যু অনিবার্য৷’
কিছুক্ষণ পর আলতুনিয়ার এক সঙ্গী কঙ্কালটার পাশে একইভাবে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল যাযাবর সর্দারের শরীরটাকেও৷ তার বন্দুকটা অবশ্য লোকটা নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে নিল৷ এবার আমরা ঢুকলাম নতুন সুড়ঙ্গপথে৷ কিন্তু আমার যেন কেন মনে হল, ইচ্ছে করলে সাপটা কামড়াবার আগেই আলতুনিয়া গুলিটা করতে পারত৷ যাযাবর সর্দারকে সঙ্গে আনার ইচ্ছে তার ছিল না সম্পদের বখরা দেওয়ার ভয়ে৷ তাই আলতুনিয়া কৌশলে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল৷