রানি হাটশেপসুটের মমি – ১১

১১

যখন প্রথম জ্ঞান ফিরল তখন বুঝতে পারলাম বালির উপর শুয়ে আছি৷ মাথার উপর রুপোর থালার মতো গোল চাঁদ আর দু-একটা তারা চোখে পড়ছে৷ সেদিকে তাকিয়ে আমি ভাবতে লাগলাম, আমি কে? আমি এখন কোথায়? কিন্তু কিছুই মনে করতে পারলাম না৷ কিছুক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকার পর উঠে বসবার চেষ্টা করলাম৷ তখনই বুঝতে পারলাম, আমার পা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা৷ আমি শুয়ে ছিলাম চিত হয়ে ডান দিকে মাথাটা একটু কাত করে৷ ঘাড়টা বাঁ-দিকে কাত করতেই মাথাটা জগদ্দল পাথরের মতো ভারী মনে হল৷ অনেক কষ্টে বাঁ-দিকে মুখটা ফেরালাম৷ বাঁ-দিকে আমার পাশেই বালির উপর কী যেন একটা জিনিস পড়ে রয়েছে৷ বেশ কিছুক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর বুঝলাম সেটা আমার ক্যামেরার ব্যাগ! তৎক্ষণাৎ আমার মনে পড়ে গেল সব কিছু৷ কিন্তু যেটা বুঝতে পারছিলাম না তা হল, আমি এখন কোথায়? সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে এই খোলা আকাশের নীচে আমি এলাম কীভাবে! অংশু, ডা. ঘটক, ডা. নাসের তাঁরাই বা কোথায়?

অনেক কষ্টে আস্তে আস্তে উঠে বসলাম৷ দেখলাম, একটা গুহার সামনে বালির উপর পড়ে রয়েছি৷ কিছু দূরে তাঁবু খাটানো৷ তার সামনে বিরাট একটা অগ্নিকুণ্ড ঘিরে কয়েকটা কালো কালো ছায়ামূর্তি বসে রয়েছে৷ টুকরো টুকরো কথাবার্তার শব্দ ভেসে আসছে সেদিক থেকে৷ তারা কী বলছে কিছুই বুঝতে পারলাম না৷

একটু পরে ডা. নাসেরকেও দেখতে পেলাম আমি৷ যেদিকে আমি প্রথমে মুখ করে শুয়ে ছিলাম তার একটু দূরে একটা বালির ঢিপির আড়াল থেকে বেরিয়ে আছে তাঁর মাথা ও ঘাড়ের কিছুটা অংশ৷ তাঁর বিরাট টাকটা দেখে বুঝতে পারলাম, তিনি ডা. নাসেরই৷ তবে তিনি কিন্তু একদম নড়ছেন না৷ মনে হয় ঢিপির আড়ালে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন৷ আমি অনেক কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে তাঁর দিকে এগোতে লাগলাম৷ এগোতে এগোতে আমি যখন তাঁর প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি, ঠিক তখনই তাঁবুর দিক থেকে চিৎকার ভেসে এল আমার কানে৷ চমকে সেদিকে তাকিয়ে দেখি, আগুনের পাশে বসা ছায়ামূর্তিগুলো দৌড়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে৷ তাদের ওভাবে আসতে দেখে আমি হঠাৎ কেন জানি না উঠে দাঁড়াতে গেলাম৷ কিন্তু পা-দুটো যে দড়ি দিয়ে বাঁধা তা খেয়াল ছিল না আমার৷ তাই আবার বালির উপর পড়ে গেলাম৷ মাথার পিছনে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আবার জ্ঞান হারালাম৷

একটা শব্দে যখন আবার আমার জ্ঞান ফিরল তখন সূর্যের আলোয় প্রথমে চোখ ধাঁধিয়ে গেল৷ চোখ খুলেই চোখের পাতা আবার বন্ধ করে ফেললাম৷ সেই অবস্থায় কে যেন আমার মুখের উপর বারকয়েক জলের ঝাপটা মারল৷ চোখ মেলতেই সে এক ঝটকায় হাত ধরে টেনে আমাকে বসিয়ে দিল৷ দেখলাম, আমার সামনে ঢিলে পোশাকপরা জনা দশেক লোক দাঁড়িয়ে আছে৷ তাদের কাঁধে রাইফেল আর কোমরে বাঁকানো ছুরি ঝুলছে৷ দু-জনের হাতে আবার চামড়ার ফিতেয় বাঁধা হিংস্র চেহারার গোটা পাঁচেক কুকুর৷ তাদের গায়ে লোম নেই, পিছনের পায়ে ভর দিয়ে তারা জিভ বের করে বসে আছে, ফোঁটা ফোঁটা লালা চুইয়ে পড়ছে বালির উপর৷ বুঝতে পারলাম, ওদেরই চিৎকারে জ্ঞান ফিরেছে আমার৷

দেখলাম কয়েক হাত দূরে বসে আছেন ডা. নাসের৷ তাঁর পা দুটো আমারই মতো দড়ি দিয়ে বাঁধা৷ তাঁর চোখে চোখ পড়তেই তিনি আমার দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে যেন একটু হাসলেন৷ আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে-থাকা লোকগুলো নিজেদের মধ্যে মিনিটখানেক কীসব কথাবার্তা বলল৷ সে ভাষার বিন্দুবিসর্গ আমি বুঝতে পারলাম না৷ জানি না ডা. নাসের কিছু বুঝতে পারলেন কি না৷ লোকগুলোর মধ্যে দু-জন এবার তাদের কাঁধ থেকে রাইফেল খুলে নিল৷ তারপর নীচু হয়ে বালির উপর বসে আমাদের পায়ের বাঁধন খুলে দিতে লাগল৷ যে দু-জনের হাতে তারা রাইফেল দিয়েছিল সে দু-জন রাইফেল দুটো তাক করে রইল ডা. নাসের আর আমার দিকে৷ বুঝতে পারলাম যে, এ লোকগুলোর হাতেই আমাদের বাঁচা-মরা নির্ভর করছে৷ কিন্তু এদের হাতে এলাম কীভাবে? আর কেন এলাম? এ দুটো প্রশ্নের উত্তর অবশ্য কিছুক্ষণ পরই পেয়ে গেলাম৷

লোকগুলো পা থেকে দড়ি খুলে দিয়ে আমাকে আর ডা. নাসেরকে পাশাপাশি দাঁড় করাল৷ তারপর আমাদের কোমরে দড়ি বাঁধল৷ চারপাশে যত দূর চোখ যায় শুধু ধু-ধু মরুভূমি৷ তার মধ্যে শুধু জেগে রয়েছে ছোট্ট একটা পাহাড় আর তার গুহামুখ, যার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমরা৷ একজন ক্যামেরার ব্যাগটা কুড়িয়ে এনে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিল৷ কোমরের দড়ির প্রান্ত ধরে তারপর আমাদের হাঁটিয়ে নিলে চলল তাঁবুর দিকে৷ তাঁবুটা বেশ বড়ো৷ তার পিছনে একটা জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে৷ সেটা নজরে পড়ল আমার৷ যে লোকগুলোর হাতে আমরা বন্দি, তার মধ্যে একটা বেশ ঢ্যাঙা লোক ছিল৷ আপাদমস্তক তার কালো পোশাকে মোড়া৷ দু-গালে তার বিচিত্র উলকি আঁকা৷ লোকটা অনেকক্ষণ থেকেই অন্যদের নানারকম নির্দেশ দিচ্ছিল৷ সম্ভবত সে-ই দলপতি৷

তাঁবুর সামনে আসবার পর সকলকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে লোকটা তাঁবুর পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকল৷ তার কয়েক মুহূর্ত পর বাইরে বেরিয়ে এসে তার সঙ্গীদের উদ্দেশে কী যেন বলল৷ যে দু-জন লোক দড়ি ধরে ছিল তারা এবার দড়ি ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা মেরে আমাকে আর ডা. নাসেরকে তাঁবুর ভিতর ঢুকিয়ে দিল৷ বাইরের আলো থেকে ভিতরে ঢোকার পর প্রথমে কিছুই আমার নজরে পড়ল না৷ কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল চোখের সামনে সব কিছু স্পষ্ট হতে৷ দেখলাম, তাঁবুর এক কোনে একটা গদি পাতা, আর তার উপরে বসে আমাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আলতুনিয়া৷

হঠাৎ আমার কানে এল অংশুর গলা, ‘তোমরা এতক্ষণ কোথায় ছিলে? দেখো না এই লোকগুলো কাল রাত থেকে আমাকে এখানে আটকে রেখেছে৷’

চমকে তাকিয়ে দেখি, তাঁবুর আর এক কোনায় অন্ধকারমতো জায়গায় একটা ক্যাম্প খাটের উপর বসে আছে অংশু৷ অবশ্য তার হাত-পা বাঁধা নেই, কিন্তু তার পাশে বসে আছে দু-জন সশস্ত্র লোক৷ পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা যাযাবর নয়, আলতুনিয়ার নিজস্ব সঙ্গী৷ অংশু মনে হয় উঠে দাঁড়াল আমাদের কাছে চলে আসার জন্য৷ কিন্তু সঙ্গেসঙ্গে আলতুনিয়ার একজন সঙ্গী তার হাতটা টেনে এমনভাবে খাটের উপর বসিয়ে দিল যে, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল অংশু৷ আলতুনিয়া তাই দেখে একবার দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসল৷ তাঁবুর ভিতরের মৃদু আলোয় চকচক করে উঠল তার সোনার দাঁত৷ এর পর সে ডা. নাসেরের উদ্দেশে বলল, ‘আমি সত্যিই দুঃখিত নাসের, এমনভাবে আপনাকে এখানে ধরে আনতে হল বলে৷ কিন্তু কী করব? নিমন্ত্রণ করলে তো আর আপনি এখানে আসতেন না!’

পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে উত্তেজিত না হয়ে ডা. নাসের ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘আমাদের এখানে আনার কারণটা জানতে পারি কি? ছেলেটাকেই বা তোমরা এমনভাবে ধরে রেখেছ কেন? আর বাইরে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারাই বা কে?’

তাঁর প্রশ্ন শুনে আর একবার নিঃশব্দে হাসল আলতুনিয়া৷ তারপর বলল, ‘আপনার সব প্রশ্নের উত্তরই আমি একে একে দিচ্ছি৷ প্রথমত, আপনাকে আমি ধরে এনেছি আপনার কাছে প্যাপাইরাসের যে বাকি অংশটা আছে সেটা পাওয়ার জন্য৷ দ্বিতীয়ত, আমি ছেলেটিকে ধরেছি, কারণ, আপনার বাড়ি থেকে হাতিয়ে আনা ক্যাসেটটার কন্ঠস্বরটা যে ওর, তা আমার বুঝতে কোনো অসুবিধে হয়নি৷ হয়তো ও আমাকে মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা নতুন কিছুর সন্ধান দেবে৷ প্যাপাইরাসের যে অংশটা আমার হাতে আছে আর ছেলেটির ক্যাসেটবন্দি কন্ঠস্বর আমাকে এই ইঙ্গিতই দিচ্ছে৷ আর তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরটা হল, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো এক যাযাবর গোষ্ঠীর৷ আফ্রিকার বিস্তৃত মরুভূমি অঞ্চলই হল ওদের ঘরবাড়ি৷ মরুভূমির কঠিন পরিবেশের মধ্যে বাস করতে হয় বলে প্রকৃতিগতভাবেই ওরা খুব নিষ্ঠুর৷ মানুষ মারতে ওদের হাত কাঁপে না৷ মাঝে মাঝে আমি ওদের বন্দুক-বারুদ ইত্যাদি সরবরাহ করি৷ যে কারণে ওরা আমার খুব বাধ্য৷

মজার ব্যাপার হল, এই অশিক্ষিত লোকগুলো নিজেদের সেনমুটের বংশধর বলে মনে করে৷ হাটশেপসুটের ভয়ে মরচুয়ারি মন্দির থেকে পালাবার সময় নাকি সেনমুট তাঁর যাবতীয় ধনরত্ন মাটির গভীরে কোথাও লুকিয়ে রেখে যান৷ এদের বিশ্বাস সেই ধনরত্ন আজও লুকোনো আছে৷ তাই বংশপরম্পরায় এই লোকগুলো মরুভূমির বুকে আজও খুঁজে চলেছে সেই গুপ্তভাণ্ডার৷ আমি ওদের বলেছি, সেই গুপ্তভাণ্ডারের খোঁজ পেয়ে আপনারা তা লুঠ করতে এসেছেন৷ তাই ওরাই আপনাদের মরচুয়ারি মন্দিরের সুড়ঙ্গ থেকে এখানে ধরে এনেছে৷ আপনি যদি প্যাপাইরাসটা আমার হাতে তুলে না দেন, তাহলে আমি আপনাদের ওদের হাতে তুলে দেব৷ তারপর আপনাদের ভাগ্যে যা লেখা আছে তাই হবে৷’

এই বলে আলতুনিয়া স্থির দৃষ্টিতে ডা. নাসেরের দিকে তাকিয়ে রইল উত্তরের অপেক্ষায়৷ আমি বুঝতে পারলাম, আলতুনিয়া আর ডা. নাসেরের মধ্যে একটা তীব্র স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে৷ ভিতরে ভিতরে দু-জনই খুব উত্তেজিত কিন্তু তা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন দু-জনেই৷ ডা. নাসের ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘তুমি কি মনে করো আমরা সেনমুটের গুপ্তভাণ্ডারের সন্ধান জানি? প্যাপাইরাস বা ছোটো ছেলেটার কথার মধ্যে কোথাও তো তা বলা নেই৷’

আলতুনিয়া বলল, ‘হ্যাঁ, আমি তা জানি৷ কারণ, হাইয়ারোগ্লিফিক আমি অন্যদের চেয়ে ভালোই পড়তে পারি৷ তবে তার মধ্যে একটা সমাধির স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে৷ ছোটো ছেলেটির রেকর্ড করা টুকরো টুকরো শব্দও সে কথাই সমর্থন করছে৷ প্যাপাইরাসের বাকি অংশে হয়তো সমাধিতে যাওয়ার পথের হদিশ দেওয়া আছে৷ আমি সেই সমাধি পর্যন্ত পৌঁছোতে চাই৷ কে বলতে পারে সেখানে তুতানখামেনের সমাধির মতো কোনো অতুল ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে কি না?’

ডা. নাসের এবার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন৷ তারপর বললেন, ‘প্যাপাইরাসের বাকি অংশটা আমার কাছে নেই, আবার আছেও৷’

আলতুনিয়া বলল, ‘মানে?’

ডা. নাসের বললেন, ‘প্যাপাইরাসটা আছে ব্যাঙ্কের ভল্টে৷ তবে তার একটা কপি করা আছে এখানে৷’ এই বলে তিনি নিজের কপালে বার দুই টোকা মারলেন৷

‘তাহলে কি ধরে নেব, সেই সমাধিতে পৌঁছোবার রাস্তা আপনার জানা আছে?’ প্রশ্ন করল আলতুনিয়া৷

‘সমাধিটা ঠিক কোথায় আছে তা বলতে পারব না৷ তবে যা ইঙ্গিত আছে তাতে মরচুয়ারি মন্দিরের নীচেই কোনো সুড়ঙ্গে হবে৷ একটা নির্দিষ্ট কক্ষের কথা বলা আছে প্যাপাইরাসে৷ সেই কক্ষ পর্যন্ত না পৌঁছোলে পথের দিশা পাওয়া যাবে না৷’ উত্তর দিলেন ডা. নাসের৷

‘তাহলে সেই কক্ষ পর্যন্ত আপনাকে নিয়ে যেতে হবে আমাকে৷ তারপর আমি ছেড়ে দেব আপনাদের৷’

‘ওই পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দরকার কী? আমি তোমাকে এখনই বলে দিতে পারি সেই পথ৷’

এবার বেশ জোরে হেসে উঠল আলতুনিয়া৷ তারপর বলল, ‘আমাকে কি আপনি দুধের শিশু পেয়েছেন৷ আপনি যে সত্যি কথা বলছেন তার গ্যারান্টি কোথায়? তা ছাড়া আপনারা সুড়ঙ্গ থেকে উধাও হয়ে যাওয়ায়, আপনাদের লোকগুলোও নিশ্চয়ই বসে নেই৷ সুড়ঙ্গের মধ্যে নিশ্চয়ই তাঁরা আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন৷ হয়তো তাঁদের সঙ্গে পুলিশের লোকও আছে৷ আপনাদের ছেড়ে দিলে তাঁদের খপ্পরে পড়ার আশঙ্কা আমার কম নেই৷ আপনি যাবেন আমাকে নিয়ে৷ আর যতক্ষণ আমার উদ্দেশ্য সফল না হয়, ছোটো ছেলেটি আর আপনার সঙ্গী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর হেফাজতে থাকবে৷’

আলতুনিয়ার কথা শুনে এবার হেসে উঠলেন ডা. নাসেরও৷ তারপর বললেন, ‘সমাধিতে ধনসম্পদ পেলে তুমি যে আর বাইরের লোকগুলোর ছায়া মাড়াবে না, তা আমি জানি৷ ফলে ছোটো ছেলেটি আর আমার সঙ্গী কোনোদিনই সভ্য জগতে ফিরে যাবে না৷ মরুভূমির বালির নীচেই ওদের সমাধি দিয়ে দেওয়া হবে৷ আমি তোমার সঙ্গে যেতে রাজি, কিন্তু ওদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে৷ তা ছাড়া ছোটো ছেলেটি না থাকলে পথের হদিশ না-ও মিলতে পারে৷ কারণ, আমার মনে হয়েছে ছেলেটির মধ্যে বিশেষ কিছু একটা ব্যাপার লুকিয়ে আছে, যা ওই সমাধি খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করবে৷’

‘আর আপনার পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীকে কী কাজে লাগবে? তাহলে উনিই নয় জামিন থাকুন,’ এই বলে আলতুনিয়া তাকাল আমার দিকে৷

হঠাৎ যেন আমার বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটা শুরু হল৷ আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলাম নিজেকে সংযত রাখতে৷ ডা. নাসের বললেন, ‘না, সেটা হয় না৷ কারণ, প্রথমত, ও না থাকলে ছেলেটির সঙ্গে কমিউনিকেট করার ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা হতে পারে৷ দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে বড়ো কথা হল, ওকে রেখে আমি তোমার সঙ্গে এক পা-ও কোথাও নড়ব না৷’ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ডা. নাসের৷ তারপর বললেন, ‘আমার যা মত তা আমি বললাম৷ এবার তুমি যা খুশি করতে পার৷ তবে একটা জিনিস মনে রেখো, আমাদের তিন জনের কারও কোনো ক্ষতি হলে কিন্তু এ জীবনে আর তুমি ওই সমাধির সন্ধান পাবে না৷’

আলতুনিয়া বেশ কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল তাঁর কথা শুনে৷ তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি রাজি৷ তিন জনেই যাবে৷ কিন্তু কোনো চালাকির চেষ্টা করলেই খুলি উড়ে যাবে৷ এখন আমি তল্লাশি করে দেখব প্যাপাইরাসের বাকি অংশটা আপনাদের কাছে আছে কি না! যদি থাকে, তাহলে আর কষ্ট করে আমার সঙ্গে যেতে হবে না৷ বাইরের কুকুরগুলো অনেক দিন ভালো করে খায়নি৷ মানুষের মাংস ওদের মন্দ লাগবে না!’

আলতুনিয়ার ইশারায় অংশুর পাশে বসে থাকা এক সঙ্গী উঠে এসে আমাদের তল্লাশি শুরু করল৷ প্রথমে ডা. নাসেরকে তারপর আমাকে৷ ক্যামেরার ব্যাগটা দেখার সময় লোকটি যখন লেন্সটা একবার হাতে নিল, তখন যেন মনে হচ্ছিল আমার হৃৎপিণ্ড থেমে গিয়েছে৷ শুধু কানে আসছিল তাঁবুর বাইরে কুকুরগুলোর গর্জন৷ আমি একবার তাকালাম ডা. নাসেরের দিকে৷ চোখের ইশারায় তিনি আমাকে শান্ত থাকতে বললেন৷ লোকটি লেন্সটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল৷ তারপর ক্যামেরা ইত্যাদির সঙ্গে আবার ব্যাগের মধ্যে রেখে দিল৷ তল্লাশি শেষ হওয়ার পর আলতুনিয়া অংশুর পাশে বসা একটি লোককে বলল অংশুকে ছেড়ে দিতে৷ লোকটি তার হাতটা ছাড়ার সঙ্গেসঙ্গেই অংশু ছুটে এসে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল৷ তারপর আমাকে প্রশ্ন করল, ‘ডা. ঘটক কোথায়?’

আমারও মনে হল, ডা. ঘটক আমাদের খুঁজে না পেয়ে কী অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছেন এখন! হয়তো আমার আর অংশুর সঙ্গে তাঁর আর কোনোদিন দেখা হবে না৷ আমাদের দু-জনকে মিশরে আনার জন্য বাকি জীবন নিজেকে দোষারোপ করবেন৷ আমি অংশুর মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই আলতুনিয়া ও তার সঙ্গীরা আমাদের নিয়ে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়াল৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *