রানি হাটশেপসুটের মমি – ১০

১০

সুড়ঙ্গ থেকে বাইরে এসেই সূর্যের আলোয় চোখ ঝলসে গেল৷ বেশ কয়েকটা মুহূর্ত লাগল ভালো করে তাকাতে৷ সূর্য এখন ঠিক মাথার উপর৷ তাঁবুর সামনে এসে দেখি, নীচ থেকে খাবার চলে এসেছে৷ নীচে যেখানে ড. হান্সদের তাঁবুগুলো রয়েছে, অংশু সেদিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল৷ দেখলাম আমাদের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির হয়েছে সেখানে৷ তাকে দেখেই হাত নাড়ল অংশু৷ আমরা এর পর খেতে বসলাম৷ খাবার বলতে হাতে-বানানো মোটা রুটি আর ভেড়ার মাংসের ঝোল৷ খেতে কিন্তু মন্দ লাগল না৷ অংশু বেশ তৃপ্তির সঙ্গে খেল৷ ড. হান্স আমাদের সঙ্গে খেতে বসলেন৷ শুনলাম, অন্যরা নাকি একটু পরে নীচে তাঁবুতে গিয়ে খাবেন৷

খাবার পর একটা চামড়ার ব্যাগ থেকে তামাক বের করে তাঁবুতে বসে বেশ কিছুক্ষণ ধূমপান করলেন ড. হান্স৷ তাঁর ধূমপান করার সময় অংশু হঠাৎ বলল, ‘সিগারেট স্মোকিং ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ৷’

ডা. হান্স হেসে উঠলেন তার কথা শুনে৷ তারপর অংশুর পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, এটা খুবই বাজে নেশা৷ আমি এর পর থেকে এটা ছাড়ার চেষ্টা করব৷’ ধূমপান শেষ করার পর ডা. হান্স বললেন, ‘চলুন, এবার আপনাদের মরচুয়ারি মন্দির দেখিয়ে আনি৷ দেখবেন, পর্যটকদের ভিড়ে এখন মন্দিরচত্বর কেমন গমগম করছে৷’

যে পথ বেয়ে আমরা নীচে নেমেছিলাম সে পথ দিয়েই আমরা উঠে এলাম মন্দিরচত্বরে৷ সত্যিই আগের দেখা মন্দিরচত্বর এখন পর্যটকদের ভিড়ে ভরতি৷ নানা দেশের পোশাকপরা নানা ধরনের মানুষজন৷ পাথরের ঢালু পথ বেয়ে আমরা ঢুকলাম মন্দিরের ভিতরে৷ পাথরের তৈরি বিরাট বিরাট স্তম্ভ ধরে রেখেছে মন্দিরের ছাদ৷ কয়েক হাজার বছর অতিক্রান্ত হলেও তার কোথাও এখনও একটুও চিড় ধরেনি৷ সত্যি সত্যি সেসময়ের স্থাপত্যবিদদের শ্রদ্ধা জানাতে হয়৷ মন্দিরের স্তম্ভ বা দেওয়ালের ছবি বা মূর্তিগুলো সব পাথর কুঁদে তৈরি করা৷ তার বেশির ভাগই দেবদেবীর মূর্তি৷ কখনো ডা. নাসের আবার কখনো ড. হান্স আমাকে আর ডা. ঘটককে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন তাঁদের কোনটা আমনরা, কোনটা সূর্যকন্যারা, কোনটা দেবী হ্যাথোর আর কোনটা বা রানি হাটশেপসুটের মূর্তি৷ আর একটা দেবতার মূর্তি অবশ্য আমাদের চিনিয়ে দিতে হল না৷ প্রতিটি স্তম্ভ আর দেওয়ালের গায়ে তিনি বিরাজমান৷ তিনি মৃত্যুর দেবতা, আনুবিস৷ তিনিই পরলোকের সঙ্গে মৃত ব্যক্তির যোগসূত্র স্থাপন করতেন৷ মরচুয়ারি মন্দিরেই মমি তৈরির শেষ কাজ সম্পন্ন করে মৃত ব্যক্তিকে তুলে দেওয়া হত আনুবিসের হাতে৷ মন্দিরের মধ্যে চারদিকে এত আনুবিসের মূর্তি৷ তাই একে আনুবিসের মন্দির বললেও খুব একটা ভুল হবে না৷ ডা. নাসের আমাদের একটা দেওয়ালে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন৷ সেখানে ধাপে ধাপে দেখানো হয়েছে কীভাবে মমি তৈরি করা হত৷ মন্দিরের এক অংশে কালো গ্রানাইটের তৈরি বাথটবের মতো জিনিস রাখা ছিল৷ তা দেখিয়ে ড. হান্স বললেন, ‘ওই পাত্রগুলোর মধ্যে লবণ জলের দ্রবণে মৃতদেহ চুবিয়ে রাখা হত৷’

অংশুকে দেখলাম, আগ্রহ নিয়ে সব কিছু দেখছে৷ কিন্তু লক্ষ করলাম, একবারের জন্যও সে ডা. ঘটকের হাত ছাড়েনি৷ হয়তো আনুবিসের মতো মূর্তি দেখে তার মনের মধ্যে ভয় কাজ করছে৷ আমি তার অন্য হাতটা ধরার পর সে ডা. ঘটকের হাত ছাড়ল৷ আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার কি ভয় করছে অংশু?’

আমার কথার জবাবে একটা অদ্ভুত কথা বলল সে৷ সে শুধু বলল, ‘আমি এসব আগে দেখেছি৷’

আমি বললাম, ‘কবে?’

এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না অংশু৷ মন্দিরের নীচের অংশ দেখে আমরা ঢালু পথ বেয়ে মন্দিরের দোতলায় বা উপরে উঠে এলাম৷ দোতলার ছাদও ধরে রেখেছে সার সার স্তম্ভ৷ দোতলায় দাঁড়িয়ে রুক্ষ মরুপ্রান্তরের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়৷ দোতলায় ছড়িয়ে আছে মিশরীয় শিল্পকলার আশ্চর্য সব নিদর্শন৷ ডা. নাসের আমাদের এনে দাঁড় করালেন এক অদ্ভুত ছবির সামনে৷ সেখানে দেখা যাচ্ছে, একজনের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মৃত্যুর দেবতা আনুবিস৷ তাঁর সামনে একটা বিরাট দাঁড়িপাল্লা রাখা৷ আর তার দু-ধারে দুটো পাত্র ওজন করার জন্য বসানো রয়েছে৷ দাঁড়িপাল্লার ঠিক নীচে দাঁড়িয়ে আছে একজন, তার শরীরের উপরের দিকে কুমিরের মাথা বসানো৷ কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন বাজপাখির মতো মাথাওলা আকাশের দেবতা হোরাস৷

ডা. নাসের বললেন, ‘এই ছবিতে আত্মার শেষ বিচারের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ ছবিতে দেখানো হচ্ছে মৃত ব্যক্তিকে আনুবিস তার শেষ বিচারের জন্য এনেছেন৷ দাঁড়িপাল্লার একদিকে পাত্রের মধ্যে রাখা হয়েছে তার হৃৎপিণ্ড৷ অন্য দিকের পাত্রে রাখা হয়েছে তার জীবিত অবস্থায় সঞ্চিত পাপ৷ পাপের পরিমাণ বেশি হলে তার হৃৎপিণ্ড খাইয়ে দেওয়া হবে কুমিরমুখী দেবতাকে৷ তার আত্মা অনন্ত নরকবাস করবে৷ আর পাপের পরিমাণ কম হলে তার আত্মাকে তুলে দেওয়া হবে দেবতা হোরাসের হাতে৷ আকাশের দেবতা হোরাস আকাশপথে মৃত ব্যক্তির আত্মাকে নিয়ে পাড়ি দেবেন অনন্তলোকের উদ্দেশে৷’

স্তম্ভ আর দেওয়ালের গায়ে ছবিগুলো দেখতে দেখতে ডা. ঘটক হঠাৎ ডা. নাসেরের উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, প্রাচীন মিশরীয়রা কি শুধু মানুষের মমি তৈরি করতেন?’

ডা. নাসের বললেন, ‘এ ধারণা কিন্তু একদম ভুল৷ তাঁরা কুকুর, বেবুন, পাখি থেকে শুরু করে সাপ-ব্যাঙেরও মমি তৈরি করতেন৷ নীলনদের পশ্চিমে অবস্থিত টেরটাইনিস নামের এক সমাধিক্ষেত্রে দু-লক্ষেরও বেশি কুমিরের মমির সন্ধান মিলেছে৷ এমনকী তাদের ডিমগুলোকে পর্যন্ত পাতলা রেশমের কাপড়ে মুড়ে মমি করে রাখা হয়েছে৷ লাক্সরের পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এসনা শহরের কাছে সন্ধান মিলেছে মাছের সমাধিক্ষেত্রের৷ লক্ষ লক্ষ মাছের মমি আবিষ্কৃত হয়েছে সেখানে৷ প্রাচীন এসনার পুরোহিতরা মাছের মমি তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিলেন৷’

আমি খুব আশ্চর্য হলাম ডা. নাসেরের কথা শুনে৷ তক্ষুনি আমার পকেট ডায়েরিতে নোট করে নিলাম৷ ঘুরে ঘুরে আমরা মন্দিরের মধ্যে ছড়িয়ে-থাকা আশ্চর্য সুন্দর ভাস্কর্য, চিত্রলিপি ইত্যাদি দেখতে লাগলাম৷ কখনো ডা. নাসের কখনো বা ড. হান্স আমাকে আর ডা. ঘটককে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন সব কিছু৷ ঘণ্টা তিনেক পর আমরা মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে এলাম৷ ডা. নাসের আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন লাগল আপনাদের?’

আমি আর ডা. ঘটক একসঙ্গে বলে উঠলাম, ‘চমৎকার!’

তবে অংশুকে দেখে মনে হল, সে যেন কী একটা ভাবছে৷ ডা. নাসের আমাদের বললেন, ‘আপনাদের মন্দির দেখা কিন্তু এখনও বাকি থেকে গিয়েছে৷’ তারপর তিনি ড. হান্সের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাইছি?’

ড. হান্স মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি৷ যদিও সাধারণ পর্যটকদের সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধে হবে না৷ মন্দিরের সব জায়গায় ঢোকার জন্য বিশেষ অনুমতিপত্র আমার কাছে আছে৷ চলুন, তাহলে সেখানেই যাওয়া যাক৷’

ডা. নাসের বললেন, ‘অনুমতিপত্র আমিও সংগ্রহ করে এনেছি কায়রো থেকে৷ আগে যদি আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হত, তাহলে বেশ কিছুটা পরিশ্রম লাঘব হত আমার৷ কায়রোয় আমার এত পরিচিত থাকা সত্ত্বেও সরকারি দপ্তর থেকে অনুমতিপত্র বের করতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে৷’

ড. হান্স হেসে বললেন, ‘সে অভিজ্ঞতা যে আমারও একদম নেই তা নয়৷’

মন্দিরের দেওয়াল ঘেঁষে ডান ও বা-দিক দিয়ে দুটো রাস্তা মন্দিরের পিছন দিকে চলে গিয়েছে৷ ডান দিকের রাস্তাটা নীচে নেমে চলে গিয়েছে ড. হান্সের সুড়ঙ্গ ছুঁয়ে আরও নীচের দিকে, যেখানে তাঁবু খাটানো আছে, সে পর্যন্ত৷ সে পথে ইতিমধ্যে আমরা একবার গিয়েছি৷

এবার আমরা ডা. নাসের আর ড. হান্সের পিছুপিছু বাঁ দিকের রাস্তাটা ধরলাম৷ রাস্তার বাঁ দিকে খাদ আর ডান দিকে মরচুয়ারি মন্দিরের পাথুরে দেওয়াল৷ কিছুটা পথ এগোবার পর ডান দিকে একটা বাঁক নিয়ে মন্দিরের দেওয়ালে আটকানো একটা ভারী লোহার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম৷ দরজা তালাবন্ধ, তার সামনে একটা কাঠের টুল রাখা আছে৷ কিন্তু কোনো লোক নেই সেখানে৷ ড. হান্স আমাদের বললেন, ‘আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন, আমি পাহারদারকে খুঁজে আনি৷’

এই বলে আমাদের দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে তিনি সামনের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলেন৷ ডা. ঘটক ডা. নাসেরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘দরজার ওপাশে কী আছে?’

ডা. নাসের উত্তর দেওয়ার আগেই অংশু বলল, ‘মন্দিরের নীচে যাওয়ার রাস্তা৷’

অংশুর কথা শুনে ডা. নাসের চমকে তার মুখের দিকে তাকালেন৷ তারপর বললেন, ‘তুমি জানলে কীভাবে?’

অংশু খুব অস্পষ্টভাবে উত্তর দিল, ‘আমি জানি, ওখানে কোনো মূর্তি নেই, সব ছবি, সব ছবি…৷’

ডা. নাসের আমার আর ডা. ঘটকের সঙ্গে চোখাচোখি করলেন তার কথা শুনে৷ ডা. নাসেরের মুখ দেখে ধারণা হল যে, অংশু যা বলল তা সম্ভবত সত্যি৷ মিনিট তিনেক পর মাথায় পাগড়িআঁটা একজন লম্বা-চওড়া চেহারার মিশরীয়কে নিয়ে ফিরে এলেন ড. হান্স৷ লোকটার গলায় ঝোলানো দুটো টর্চ৷ সে এসে কোমর থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে দিল৷ দেখলাম, ভিতরটা অন্ধকার৷ থাক থাক সিঁড়ি নেমে গিয়েছে নীচের দিকে৷ দরজাটা খুলে দেওয়ার পর সে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বলল, ‘নো ক্যামেরা, নো ক্যামেরা৷’ তারপর স্থানীয় ভাষায় আরও কী যেন বলল৷

ড. হান্স তার কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ক্যামেরা নিয়ে নীচে যাওয়ার নিয়ম নেই৷ আপনি বরং ক্যামেরার ব্যাগটা ওর কাছে রেখে দিন৷ ওকে আমি চিনি, আপনার তাতে কোনো ক্ষতি হবে না৷’

ড. হান্সের কথা শুনে আমি তাকালাম ডা. নাসেরের দিকে৷ কারণ, ব্যাগে শুধু ক্যামেরা নেই৷ লেন্সের ভিতর সেই জিনিসটাও লুকোনো আছে৷ ডা. নাসের এবার আরবি ভাষায় কথা বলতে শুরু করলেন লোকটির সঙ্গে৷ মিনিট দুই কথা বলার পর তিনি কীভাবে যেন ক্যামেরা নিয়ে ভিতরে ঢোকার ব্যাপারে রাজি করিয়ে ফেললেন লোকটিকে৷ সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গো গো৷’

তারপর সে গলা থেকে টর্চলাইট দুটো খুলে একটা ড. হান্সের হাতে ও আর একটা ডা. নাসেরের হাতে ধরিয়ে দিল৷ টর্চ জ্বালিয়ে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে শুরু করলাম আমরা৷ প্রায় একশো ফুট নীচে নামার পর আমরা এসে দাঁড়ালাম একটা জায়গায়৷ ড. হান্স তাঁর হাতের টর্চটা একবার চারপাশে ঘোরালেন৷ দেখলাম বিরাট বিরাট স্তম্ভওলা বিশাল একটা ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি৷ ঘরের দেওয়াল আর স্তম্ভ জুড়ে আঁকা রয়েছে নানা রঙের চিত্রকলা৷ ডা. নাসের সিলিংয়ের উপর আলো ফেললেন৷ সেখানেও আঁকা রয়েছে নানা ধরনের ছবি৷ টর্চের আলোয় আমরা সব ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম৷ সেই হলঘরে দেওয়ালের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে অন্ধকার সুড়ঙ্গ বেরিয়েছে৷ সুড়ঙ্গের মুখগুলো সব কাঠের তক্তা দিয়ে আটকানো৷

ডা. নাসের বললেন, ‘ওইসব সুড়ঙ্গ থেকে নাকি আরও সুড়ঙ্গ বেরিয়েছে৷ তাদের সবকটা যে ঠিক কোথায় কোথায় চলে গিয়েছে, তা আজও ঠিকভাবে বলা যায় না৷ অনেক মানুষ ধনরত্নের লোভে ওইসব সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায় ঢুকে মারা পড়েছে৷’

ছবিগুলো দেখতে দেখতে লক্ষ করলাম, বেশ কিছু ছবিতে এক পুরুষমূর্তির মুখ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, ছবির অন্য অংশগুলো কিন্তু অক্ষত৷ আমি ডা. নাসেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এগুলো এরকম কেন? এগুলো কি তাহলে হাটশেপসুটের ছবি যা তৃতীয় টুথমোসিস নষ্ট করে দেন?’

ডা. নাসের বললেন, ‘না, এগুলো হাটশেপসুটের ছবি নয়৷ এ ছবিগুলো নষ্ট করেন হাটশেপসুট নিজেই৷’

আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘তাহলে এগুলো কার ছবি?’

ডা. নাসের বললেন, ‘আমি আপনাকে একটা ছোট্ট গল্প বলি৷ মিশরের জাঁদরেল রানি হাটশেপসুট চেয়েছিলেন এমন কিছু করে যেতে, যা দেখে হাজার হাজার বছর পরেও মানুষ স্মরণ করবে তাঁকে৷ কিন্তু তাঁর মনে এ ধারণাও ছিল যে, তাঁর পরবর্তী ফ্যারাওরা মিশরের ইতিহাস থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলার জন্য ধ্বংস করে ফেলতে পারে তাঁর কীর্তি৷ তাই তিনি অন্য ফ্যারাওদের মতো নিজের বড়ো মূর্তি বা পিরামিড না তৈরি করে মরচুয়ারি মন্দির তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন৷ এর পিছনে কারণ হল, মরচুয়ারি মন্দিরের প্রধান আরাধ্য দেবতা হলেন মৃত্যুর দেবতা আনুবিস৷ স্বাভাবিক কারণেই সে সময় মিশরের মানুষজন অন্যান্য দেবদেবী অপেক্ষা আনুবিসকে বেশি ভয় পেতেন৷ হাটশেপসুট বুঝতে পেরেছিলেন, আনুবিসের মন্দির ধ্বংস করার সাহস পরবর্তীকালের ফ্যারাওদের হবে না৷ ঠিক এই কারণে কার্নাক মন্দিরে তৃতীয় টুথমোসিসের আমলে হাটশেপসুটের কীর্তি ধ্বংস করা হলেও রক্ষা পেয়ে যায় এই মরচুয়ারি মন্দির৷ কিন্তু হাটশেপসুট মরচুয়ারি মন্দির তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পড়লেন আর এক সমস্যায়৷ কার হাতে তিনি তুলে দেবেন এই বিশাল কর্মযজ্ঞের দায়িত্ব? কোনো স্থপতিই দায়িত্ব নিতে চাইছিলেন না৷ কারণ, এ কাজে সামান্য ভুল হলে রানি তাদের জ্যান্ত মমি বানিয়ে সারকোফ্যাগাসে পুরে ফেলবেন৷

‘শেষ পর্যন্ত এ কাজের দায়িত্ব সামলাবার জন্য এগিয়ে গেলেন হাটশেপসুটের বিশ্বস্ত মন্ত্রী সেনমুট৷ তিনি ছিলেন অনেক জ্ঞানের অধিকারী৷ তৈরি করে ফেললেন মরচুয়ারি মন্দিরের নকশা৷ এই ঊষর মরুপ্রান্তর ভরে উঠল লক্ষ শ্রমিকের কোলাহল আর হাতুড়ি-ছেনির ধাতব শব্দে৷ তারপর একদিন মরুভূমির বুকে মাথা তুলে দাঁড়াল রানির মরচুয়ারি মন্দির৷ মন্দিরের অঙ্গসজ্জার কাজ তখন চলছে, শ্রমিকরা পাথরের স্তম্ভ-দেওয়াল কুঁদে ফুটিয়ে তুলছে আশ্চর্য সুন্দর সব শিল্প৷ একদিন সপার্ষদ মন্দির দেখতে এলেন রানি৷ মন্দিরের আশ্চর্য সুন্দর স্থাপত্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন সকলে৷ রানির পার্শ্বচররা বললেন, এই মন্দির নিশ্চিতভাবে অমর করে রাখবে তাঁকে৷ এ কথা শোনার পর অমরত্বের লোভ পেয়ে বসল সেনমুটকেও৷ তিনিও চাইলেন অমর হয়ে থাকতে৷ তাই তিনি মন্দিরের নানা লুকোনো জায়গায় গোপনে নিজের মূর্তি-ছবি ইত্যাদি তৈরি করাতে লাগলেন৷ মন্দির তৈরি ও তার অঙ্গসজ্জার কাজ যখন প্রায় সম্পূর্ণ, তখন কীভাবে যেন এ খবর পৌঁছোল রানির কানে৷ এই অমার্জনীয় অপরাধের জন্য সঙ্গেসঙ্গেই সেনমুটের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেন রানি৷ তাঁর সৈন্যদল মরচুয়ারি মন্দিরের দিকে ছুটল সেনমুটকে ধরবার জন্য৷ কিন্তু বিপদ আঁচ করে সেনমুট ঢুকে গেলেন মন্দিরের নীচে সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায়৷ তাঁর সন্ধান আর কোনোদিন পেলেন না হাটশেপসুট৷ তবে রানির নির্দেশে সেনমুটের যত মূর্তি বা ছবি খুঁজে পাওয়া গেল, সব নষ্ট করে ফেলা হল৷ এখানে যেসব ছবির মুখ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে সে সবই হল সেনমুটের৷’

ডা. নাসেরের গল্প শুনতে শুনতে আর ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার খেয়াল হল, অংশু আমার পাশে নেই৷ নীচে নামার পর অংশু আমার ডান হাতটা ধরে ছিল৷ তারপর আমি একবার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মোছার জন্য৷ সম্ভবত তারপর সে আমার হাতটা আর ধরেনি৷ অংশুকে না দেখতে পেয়ে আমি বললাম, ‘অংশু! অংশু কই?’

সঙ্গেসঙ্গে ডা. নাসের তাঁর হাতের টর্চটা অন্ধকার হলঘরের চারপাশে ঘোরাতে লাগলেন৷ ড. হান্সও যোগ দিলেন তাঁর সঙ্গে৷ থামগুলো ঘরের মধ্যে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে, ঘরের ভিতর সম্পূর্ণটা দেখা যাচ্ছে না৷ টর্চের আলো যেসব জায়গায় পড়ল সেখানে দেখা মিলল না অংশুর৷ ডা. ঘটক চিৎকার করে ডেকে উঠলেন, ‘অংশু, অংশু৷’

তাঁর গলার শব্দে গমগম করে উঠল ঘরটা৷ কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া গেল না৷ এবার আমরা সকলে মিলে থামের পিছনগুলো খুঁজতে লাগলাম৷ কিন্তু না, অংশু কোথাও নেই৷ ডা. নাসের এবার সুড়ঙ্গের মুখগুলোয় আলো ফেলতে লাগলেন৷ সুড়ঙ্গগুলোর মাথার উপর এক, দুই, তিন, এভাবে নম্বর লেখা আছে৷ হঠাৎ একটা জায়গায় এসে আটকে গেল ডা. নাসেরের টর্চের আলোটা৷ সাত নম্বর সুড়ঙ্গের সামনে মাটির উপর পড়ে আছে অংশুর টুপিটা৷ ডা. নাসেরের পিছুপিছু আমিও পৌঁছে গেলাম সুড়ঙ্গের মুখটায়৷ ডা. নাসের মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন টুপিটা৷ আমরা এবার খেয়াল করলাম, সুড়ঙ্গের মুখটা যে দুটো কাঠের তক্তা দিয়ে আড়াআড়িভাবে আটকানো ছিল, তার একটা উই লেগে খসে পড়েছে৷ ফলে যে ফোকর সৃষ্টি হয়েছে তাতে একটা মানুষ অনায়াসে গলে যেতে পারে ভিতরে৷ ডা. নাসের তাঁর টর্চের মুখটা মাটির দিকে ঘোরালেন৷ দেখলাম, সুড়ঙ্গের মুখে জমে-থাকা ধুলোর উপর স্পষ্ট হয়ে আছে অংশুর পায়ের ছাপ৷ আর দেরি না করে কাঠের তক্তার ফাঁক গলে ডা. নাসের ঢুকে পড়লেন ভিতরে৷ আমিও তাঁকে অনুসরণ করলাম৷

ভিতরে ঢুকে ডা. নাসের তাঁর টর্চের আলো ফেললেন সামনের দিকে৷ টর্চের আলো সুড়ঙ্গের অন্ধকার ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ল শেষ মাথা পর্যন্ত৷ এবার আমরা দেখতে পেলাম অংশুকে৷ সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে সে সামনের দিকে হেঁটে চলেছে৷ আমি চিৎকার করে ডেকে উঠলাম তার নাম ধরে, কিন্তু সে থামল না৷ আগের মতোই হাঁটতে থাকল৷ যেন সে শুনতেই পায়নি আমার চিৎকার৷ আমি আর ডা. নাসের এবার ছুটতে শুরু করলাম তাকে লক্ষ করে৷ সুড়ঙ্গের দু-পাশ দিয়ে কিছু দূর অন্তর বেরিয়ে গিয়েছে আরও নানা সুড়ঙ্গ৷ আমরা যখন তার কাছাকাছি চলে এসেছি, তখন সে এরকমই একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়ল৷ কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমরাও ঢুকে পড়লাম তার মধ্যে৷ দেখতে পেলাম, হাত দশেক দূরে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে অংশু৷ আমি দৌড়ে তাকে ধরতে গেলাম৷ কিন্তু তার আগেই মাথায় কীসের একটা প্রচণ্ড আঘাতে ছিটকে পড়লাম৷ জ্ঞান হারাবার আগে শুধু বুঝতে পারলাম, ডা. নাসেরের হাতের টর্চটা মাটির উপর আছড়ে পড়ে নিভে গেল৷ তার সঙ্গেসঙ্গেই অন্ধকার হয়ে গেল সব কিছু৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *