১
রয়াল জর্ডেনিয়ান এয়ারলাইনের বিমান যখন কায়রোর মাটি ছুঁল তখন স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে দশটা৷ আমাদের কায়রো পৌঁছোবার কথা ছিল সকাল সাতটা নাগাদ৷ কিন্তু রানওয়েতে কী একটা সমস্যার জন্যে আম্মানের কুইন অলিয়া এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের বিমান নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টা চারেক পরে আকাশে উড়ল৷ কলকাতার নেতাজি সুভাষ বিমানবন্দর থেকে জর্ডনের রাজধানী আম্মানে পৌঁছোতে সময় লাগল সাত ঘণ্টা৷ আর আকাশে ওড়ার পর জর্ডন থেকে কায়রো পৌঁছোতে সময় লাগল আরও এক ঘণ্টা৷ কুইন অলিয়া এয়ারপোর্টে বসে থাকতে থাকতে বিরক্তি ঝরে পড়ছিল ডা. ঘটকের চোখে-মুখে৷ বারবার ঘড়ি দেখছিলেন তিনি৷ আমি আর অংশু লক্ষ করছিলাম সবকিছু৷ সত্যি কথা বলতে আমার কিন্তু খুব একটা খারাপ লাগছিল না বসে থাকতে৷ কত রকমের যাত্রী আসা-যাওয়া করছে৷ বিচিত্র তাদের সাজপোশাক, বিচিত্র তাদের ভাষা৷
এসব দেখতে দেখতে দিব্যি আমার সময় কেটে গেল৷ তা ছাড়া মনের মধ্যে একটা আলাদা রোমাঞ্চ তো আছেই৷ এই প্রথম আমি বিদেশ সফরে বেরিয়েছি৷ তাও আবার আমার সফর মিশরের মতো প্রাচীন সভ্যতার দেশে৷ পিরামিডের দেশে! নীলনদের দেশে! ডা. ঘটকের অবশ্য এ ব্যাপারে খুব একটা বহিঃপ্রকাশ নেই৷ হয়তো ব্যাপারটা তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক৷ কারণ, তাঁর এই মিশর ভ্রমণ প্রথমবার হলেও এর আগে তিনি অনেকবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন৷ মিশর দেশটা সম্বন্ধে খুব একটা বেশি ধ্যানধারণা আমার নেই৷ কলকাতা থেকে আসবার আগে আমার এক বন্ধু আমাকে একটা বই দিয়েছিল৷ বইটার নাম ‘দ্য আইজ অব দ্য স্ফিংক্স’৷ মিশরের পটভূমিতে বইটা দানিকেনসাহেবের লেখা৷ প্লেনে আসবার সময় বইটার কিছু অংশ আমি পড়ে ফেলেছি৷ দেশটা সম্বন্ধে সামান্য কিছু ধারণা হয়েছে৷
কায়রো বিমান বন্দরে ভিসা পরীক্ষা, কাস্টমস পরীক্ষা, ট্যাগ মিলিয়ে লাগেজ বুঝে নেওয়া ইত্যাদি সারতে আরও তিরিশ মিনিট সময় লাগল৷ শেষে একসময় আমরা ‘এগজিট’ লেখা কাচের দরজার বাইরে পা রাখলাম৷ বাইরে বেশ ভিড়৷ আমরা আমাদের লাগেজ একপাশে রেখে সরে দাঁড়ালাম৷ ডা. ঘটকের চোখ চারপাশে খুঁজতে লাগল তাঁকে, যাঁর আমন্ত্রণে ডা. ঘটক এবং তার সঙ্গী হিসেবে অংশু ও আমার এই বিদেশ ভ্রমণ৷ মিনিট পাঁচেক সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ দেখলাম, একজন বেশ বয়স্ক দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন৷ মাথায় তাঁর বিশাল টাক, আর সবচেয়ে আকর্ষক, বুকের নীচ পর্যন্ত নেমে আসা ধবধবে সাদা দাড়ি৷ ভদ্রলোককে দেখতে পেয়েই হাসি ফুটে উঠল ডা. ঘটকের মুখে৷ কাছে আসার পর ভদ্রলোক এমনভাবে ডা. ঘটককে জড়িয়ে ধরলেন যে, তাঁর শীর্ণ দেহ প্রায় ঢাকা পড়ে গেল ভদ্রলোকের বিশাল চেহারার আড়ালে৷ বুঝতে অসুবিধে হল না, ইনিই ডা. ঘটকের দীর্ঘ দিনের বন্ধু, মিশর-গবেষক ও শল্যচিকিৎসক ডা. নাসের৷ যাঁর কথা আমি ডা. ঘটকের মুখে অনেকবার শুনেছি৷ আলিঙ্গন মুক্ত হওয়ার পর ডা. ঘটক আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমাকে দেখিয়ে বললেন, ‘ইনি সৌরভ সেন, একজন তরুণ লেখক৷’
এভাবে আমার পরিচয় দেওয়ায়, সত্যি কথা বলতে আমি একটু লজ্জাই পেলাম৷ আমি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাধারণ চাকরি করি, আর একলা মানুষ বলে সময় কাটাবার জন্য মাঝেমাঝে একটু-আধটু লেখালিখির চেষ্টা করি মাত্র, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়৷ ডা. নাসের আমার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, ‘আমাদের এই প্রাচীন সভ্যতার দেশে আমি আপনাকে স্বাগত জানাই৷ আশা করি এ দেশ থেকে আপনি লেখার জন্য প্রচুর রসদ সংগ্রহ করতে পারবেন৷’
উত্তরে আমি বললাম, ‘আপনার মতো পণ্ডিত মানুষ পাশে থাকলে অবশ্যই পারব৷’
ডা. নাসের বললেন, ‘আমি পণ্ডিত নই, পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন এই দেশ সম্পর্কে কিছুটা পড়াশোনা করি মাত্র৷ বলতে পারেন, এটা আমার একটা নেশার মতো৷’
বুঝতে পারলাম ভদ্রলোক যথেষ্ট বিনয়ীও বটে৷ স্বাভাবিক নিয়মেই আমাদের দু-জনের কথা হল৷ কিন্তু ইংরেজিতেই৷ আমার সঙ্গে কথা বলার পর ডা. নাসের অংশুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি তো অংশু!’ তারপর তিনি অংশুর দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি আমাকে চেনো?’
অংশু ঘাড় নেড়ে জানাল, না৷
ডা. নাসের অংশুর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘আমি নাসের, আমি তোমার বৃদ্ধ বন্ধু৷’
অংশু হেসে ফেলল তাঁর কথা শুনে৷
এর পর ভিড় ঠেলে ডা. নাসেরের পিছন পিছন গিয়ে আমরা হাজির হলাম এয়ারপোর্টের পার্কিং জোনে৷ সেখানে অনেক গাড়ির মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল একটা কালো রঙের লিমুজিন৷ ডা. নাসের পকেট থেকে চাবি বের করে ডিকি খুলে ফেললেন৷ আমরা আমাদের লাগেজ তার মধ্যে রাখার পর তিনি ডিকি বন্ধ করে উঠে বসলেন চালকের আসনে৷ ডা. ঘটক আমাকে ডা. নাসেরের পাশে বসতে বলে অংশুকে নিয়ে বসলেন পিছনের আসনে৷ পার্কিং জোনের বাইরে বেরিয়ে মসৃণ রাস্তা ধরে ছুটতে শুরু করল গাড়ি৷ ঝকঝকে রাস্তা, দু-পাশে বিরাট বিরাট বাড়ি, আধুনিক শপিং মল, চোখে পড়ছে দু-একটা মসজিদও৷ রাস্তায় প্রচুর গাড়ি, তবে সকলেই চলছে নিয়ম মেনে৷ রাস্তার মোড়ে স্বয়ংক্রিয় সিগনালিং সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের গতি৷ রেলিং-ঘেরা ফুটপাত দিয়ে হেঁটে চলেছে বহু মানুষ৷ তার মধ্যে যেমন আছে স্থানীয় মানুষ, তেমনই মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে বিশাল বপু কুচকুচে কালো আফ্রিকান ও আমরা যাদের চলতি কথায় ‘সাহেব’ বলি, সেই সাদা চামড়ার মানুষও৷
গাড়ি চালাতে চালাতে ডা. নাসের বললেন, ‘আমি আপনাদের থাকার জন্য এখানে একটা ভালো হোটেলের ব্যবস্থা করেছি৷ আমরা এখন যাচ্ছি সেই হোটেল রোসেটাতে৷ রোসেটা কায়রোর অন্যতম সেরা হোটেল৷ আসলে আমি একা মানুষ, ছোট্ট একটা দু-কামরার ফ্ল্যাটে থাকি৷ তার অর্ধেক আবার বইপত্র আর নানা জিনিসে ভরতি৷ সেখানে থাকতে আপনাদের কষ্ট হত, তাই এই ব্যবস্থা৷’ এর পর ডা. নাসের আমার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি রোসেটা শব্দের মানে জানেন?’
কথাটা আগে যেন আমি পড়েছিলাম বা শুনেছিলাম, কিন্তু তার সম্বন্ধে কিছুই আর মনে করতে পারলাম না৷ তাই ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলাম, না৷
গাড়ি চালাতে চালাতে ডা. নাসের বলতে লাগলেন, ‘রোসেটা হল সেই পাথর, যা দিয়ে হাইয়ারোগ্লিফ বা প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছে৷ নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী যখন মিশরে প্রবেশ করে, তখন তাঁর সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন বুখার্ড রোসেটা শহরের সেন্ট জলিয়ান দুর্গের কাছে মাটির তলা থেকে এই পাথর উদ্ধার করেন৷ সেদিন দৈবক্রমে যদি তাঁরা পাথরটা উদ্ধার না করতেন, তাহলে এই সুমহান সভ্যতার ইতিহাসের বেশির ভাগটাই আজও আমাদের অজানাই থেকে যেত, যেমন ঘটেছে পেরুর ইনকা সভ্যতার ক্ষেত্রে৷’
ডা. ঘটক এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই লিপির পাঠোদ্ধার প্রথম কে করেন?’
ডা. নাসের বললেন, ‘ফরাসি পণ্ডিত ফাঁসোয়া শাঁপেলিয়ঁ ও ইংরেজ পণ্ডিত টমাস ইয়ং এই লিপির পাঠোদ্ধার করেন৷ তবে এ দু-জনের মধ্যে শাঁপেলিয়ঁই প্রথম এর মর্ম উদ্ধার করতে সক্ষম হন৷ গ্রিক ভাষায় হাইয়ারোগ্লিফিকা শব্দের অর্থ পবিত্র চিহ্ন৷ এই শব্দ থেকেই হাইয়ারোগ্লিফ
বা হাইয়ারোগ্লিফিক শব্দের উৎপত্তি৷ রোসেটা স্টোনের উপর
হাইয়ারোগ্লিফিক, গ্রিক ও ডিমোটিক লিপিতে ফ্যারাও টলেমির
তিনটি অনুশাসন খোদিত ছিল৷ রানি ক্লিওপেট্রার কথা সর্বপ্রথম
রোসেটা স্টোনেই পাওয়া যায়৷’
ডা. নাসেরের কথা শুনে বুঝতে পারলাম এসব বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট পাণ্ডিত্য আছে৷ আমরা এর পর ডা. নাসেরকে বর্তমান মিশর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, আর তিনিও সুন্দরভাবে একের পর এক উত্তর দিয়ে যেতে লাগলেন৷ তাঁর কথা শুনতে শুনতে আমরা একসময় পৌঁছে গেলাম হোটেল রোসেটাতে৷
রোসেটা বিরাট বড়ো হোটেল, নির্মাণশৈলীতে গ্রিক স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট৷ গাড়ি থেকে নেমে জিনিসপত্র নামানোর পর ডা. নাসেরর পিছু পিছু কাচের দরজা ঠেলে হোটেলের ভিতর ঢুকলাম৷ নীল রঙের নরম কার্পেটে পা ডুবে গেল সঙ্গে সঙ্গে৷ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিশাল হলঘরের মধ্যে রাখা আছে বেশ কয়েকটি মহার্ঘ সোফা৷ মাথার উপর জ্বলছে ঝাড়বাতি৷ ঘরের একপাশে রিসেপশন কাউন্টারের ওপাশে বসে ছিলেন গোলগাল চেহারার মধ্যবয়সি একজন লোক৷ তাঁর নাম মনে হয় আল মামুন৷ কারণ, তাঁর সামনে রাখা একটা পিতলের ফলকে ওই নামটাই শোভা পাচ্ছিল৷ আল মামুন ডা. নাসেরকে দেখে এমনভাবে ঘাড় নেড়ে হাসলেন, তাতে আমার মনে হল, তিনি ডা. নাসেরের পূর্বপরিচিত৷
তাঁদের দু-জনের মধ্যে স্থানীয় ভাষায় দু-চারটে কথা হল৷ ভাষাটা সম্ভবত আরবি৷ কারণ, গাড়িতে আসার সময় ডা. নাসেরের কাছে শুনেছি, এখানকার স্থানীয় মানুষরা নিজেদের মধ্যে সাধারণত আরবিতে কথা বলেন, অবশ্য ইংরেজিতে কথা বলারও চল আছে৷ আল মামুন একটা রেজিস্টার খাতায় আমাদের নাম-ঠিকানা লেখার পর তাতে ডা. নাসের আর ডা. ঘটক দু-জনই সই করলেন৷ আল মামুন বেল টিপে ডাকলেন দু-জন বয়কে৷ তারা আমাদের জিনিসপত্র তুলে নিল৷ মিনিট তিনেকের মধ্যেই লিফটে আমরা পৌঁছে গেলাম পাঁচ তলায় আমাদের সুইটের সামনে৷ থাকার জায়গাটা দেখে সকলেরই খুব পছন্দ হল৷ পায়ের তলায় পুরু কার্পেট, ঝকঝকে পালিশ করা কাঠের আসবাবপত্র, দুধ-সাদা বিছানা, নীল রঙের দেওয়ালে টাঙানো উজ্জ্বল সোনালি ফ্রেমে বন্দি বহু বর্ণের মিশরের চিত্রকলা৷ বিরাট ড্রয়িং কাম ডাইনিং স্পেসকে ঘিরে বিপরীতমুখী দুটো বড়ো বড়ো ঘর, দামি টাইলস-বসানো অ্যাটাচড বাথ আর পশ্চিমে রাস্তার দিকে খোলা বারান্দা৷ ভিতরে ঢুকেই এক পা দু-পা করে অংশু গিয়ে দাঁড়াল বারান্দার দিকে, তারপর রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নীচে তাকিয়ে দেখতে লাগল৷ কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে ডা. নাসের বললেন, ‘ও কি জানে, এটা ওর পিতৃভূমি?’
ডা. ঘটক বললেন, ‘না৷’
ডা. নাসের কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে চাইলেন না৷ কিছু কথাবার্তার পর তিনি ডা. ঘটকের কাছে জানতে চাইলেন, বিকেল বেলা আমরা রেস্ট নেব কি না, না হলে তিনি সাড়ে চারটের সময় আমাদের কায়রো মিউজিয়াম দেখাতে নিয়ে যাবেন৷ ঘড়িতে বারোটা বাজতে পাঁচ, আমি আর ডা. ঘটক দু-জনেই হাতঘড়ির দিকে তাকালাম৷ ডা. ঘটক আমাকে বললেন, ‘কী, যাবে নাকি সৌরভ? এখনও চার ঘণ্টার বেশি সময় আছে, এর মধ্যে স্নান-খাওয়া সেরে ঘণ্টা দুই বিশ্রামও নিয়ে নেওয়া যাবে৷ তা ছাড়া সন্ধ্যের পর হোটেলে ফিরে তো কোনো কাজ নেই! কাজেই মিউজিয়াম থেকে ফিরে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়া যাবেখন৷’
আমি বললাম, ‘আমার কোনো অসুবিধে নেই, দেখার জন্যই তো এসেছি৷’
ডা. ঘটক বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ৷’ এর পর তিনি ডা. নাসেরকে জানিয়ে দিলেন যে, বিকেল সাড়ে চারটেয় আমরা তৈরি হয়ে থাকব৷
ডা. নাসের আমাদের অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নিজের কাজে৷ তাঁকে বিদায় জানিয়ে দরজা বন্ধ করে ফিরে এসে ডা. ঘটক আমার উদ্দেশে বললেন, ‘জানো সৌরভ, আমার বাবা একটা কথা বলতেন, কোনো জায়গায় বেড়াতে গেলে যেটা প্রথমে দেখার সুযোগ ঘটবে সেটা দেখে নেওয়াই ভালো৷ না হলে অনেক সময় তা আর দেখাই হয় না৷ পরবর্তীকালে দেখেছি কথাটা সত্যি৷ সেবার যখন প্যারিস গেলাম, ঘরের কাছেই ল্যুভর মিউজিয়ম৷ ভাবলাম চারদিন তো থাকব, তার মধ্যে একদিন ঘুরে আসব সেখানে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যাওয়াই হল না৷’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমারও এরকম হয়েছে দু-একবার৷’
এক ঘণ্টার মধ্যেই স্নান-খাওয়া হয়ে গেল আমাদের৷ ডাইনিং-এ খাবার পৌঁছে দিয়েছিল হোটেলের লোকেরা৷ তার মধ্যে ছিল চাপাটি, মুরগির মাংস, কীসের একটা নিরামিষ তরকারি, বিনের সুপ আর দু-রকমের শুকনো মিষ্টি৷ খাবার পর এক ঘণ্টা গড়িয়ে নেওয়ার জন্য শুয়ে পড়লাম আমরা৷ ডা. ঘটক শুলেন একটা ঘরে, আর অংশুকে নিয়ে আমি শুলাম তার উলটো দিকের ঘরটায়৷ বিছানায় শোওয়ার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই অংশুর চোখ বুজে এল, ঘুমিয়ে পড়ল ও৷ আমার কিন্তু ঘুম এল না৷ নতুন কোথাও গেলে এই একটা সমস্যা আমার হয়৷
নতুন পরিবেশে ঘুম আসতে আমার একটু সময় লাগে৷ শুয়ে শুয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম অংশুর মুখের দিকে৷ অংশুকে দেখতে খুব সুন্দর৷ একমাথা কোকড়ানো চুল, ফরসা গোলগাল মুখে টিকোলো নাক, টানা টানা চোখ, তার উপর ভুরু দুটো মনে হয় যেন তুলি দিয়ে আঁকা৷ ঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, আসলে এই অরফ্যান অংশু এক বিশেষ অসুখে ভুগছে, তাকে দেখবেন বলেই ডা. ঘটককে, অংশুকে সঙ্গে নিয়ে দিন সাতেকের জন্য কায়রো ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন ডা. নাসের৷ আর ডা. ঘটক তাঁর ভ্রমণের জন্য সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করেন তাঁর অসমবয়সি বন্ধু এবং দাবা খেলার সঙ্গী অর্থাৎ আমাকে৷ ডা. ঘটকের মতো আমারও সংসার বলে কোনো কিছু নেই, কাজেই এই লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হতে আমার দেরি হয়নি৷
আমি অংশুর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম তার দুর্ভাগ্যের কথা, তার অদ্ভুত অসুখের কথা৷ সত্যিই কি সেটা কোনো জটিল অসুখ? নাকি এর মধ্যে অন্য কিছু ব্যাপার আছে! যে কারণে ডা. নাসের অংশুর প্রতি এতটা আগ্রহী৷ আর একটা প্রশ্নও হঠাৎ আমার মাথায় এল৷ অংশুর সঙ্গে ডা. ঘটকের যোগাযোগ, অংশুর মাতৃভূমির মাটিতে পা রাখা, এ সবই কি কাকতালীয়, নাকি এর মধ্যেও অন্য কোনো ব্যাপার কাজ করছে৷ এসব হিজিবিজি নানা কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ঘড়িতে দেখি, চারটে বাজতে চলেছে৷ অংশুর ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম তৈরি হয়ে নেওয়ার জন্য৷ ঠিক ওই সময় তাঁর ঘর থেকে ডা. ঘটকের গলা শোনা গেল, ‘সৌরভ, এবার উঠে পড়ো! তৈরি হতে হবে, চারটে কিন্তু বাজে৷’
এ ঘর থেকে আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ, আমরা উঠে পড়েছি৷’
আবার তাঁর গলা শোনা গেল, ‘তোমার ক্যামেরাটা সঙ্গে নিয়ো কিন্তু!’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা৷’