রাতের নৌকা
দরজা ভেঙে তান্ত্রিক দুর্লভ চক্রবর্তীর ঘরে ঢোকার পর ভজন বাউড়ি প্রথমেই ওঁর চোখ দুটো জম্পেশ করে একটা গামছা দিয়ে বেঁধে দিয়েছিল।
তখন রাত দু’প্রহর। রাস্তার কুকুর, গাছের পাখি, এমনকী আহিরন—বিলের জলের ঢেউগুলো অবধি যেন কুয়াশার চাদর জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। দুর্লভ তান্ত্রিকও তার বিলের ধারে বানিয়ে তোলা কালীমন্দিরের দোর এঁটে ঘুমোচ্ছিলেন।
মন্দিরের নকশা ততদিনে ভজনের মুখস্থ। গত একমাসের মধ্যে ভজন তিন—তিনবার ভক্ত সেজে এসে সবকিছু মেপেঝুপে গিয়েছে। পাকা মন্দির নয়, কাঁচা ঘর। টালির চাল, দরমার দেয়াল, মাটির মেঝে। দরজার ঠিক মুখোমুখি কষ্টিপাথরের চামুণ্ডা মূর্তি। হাত দুয়েক উঁচু। দেখলে ভয় লাগে। ঘরে কোনো জানলা নেই।
মেঝের একপাশে যে একপ্রস্থ চাটাই, বালিশ আর কাঁথা গুঁটিয়ে রাখা আছে সেটা ভজনের চোখ এড়ায়নি। সে নিশ্চিন্ত হয়েছিল— ঠাকুরমশাই তাহলে এই ঘরেই রাতে ঘুমোন। এবং যেহেতু আর কোনো বিছানাপত্তর ছিল না, কাজেই ভজন বুঝে নিয়েছিল, তিনি একাই ঘুমোন।
তখনই ভজন দেবীর গয়না—লুঠের মতলবটা পাকা করেছিল।
না, একটু ভুল বলা হল। অত চট করে কোনো ডাকাতির মতলব পাকা করা যায় না। যার ঘরে ডাকাতি করতে ঢুকছ, তার কমজোরিগুলো যেমন জানতে হয়, তেমনি তার জোরের জায়গাগুলো চোখ এড়িয়ে গেলেও ভুগতে হয়। এই যে, একসময়ের গোটা বহরমপুর পরগনার আতঙ্ক ভজন বাউড়ি, যার দলে ত্রিশজন যমদূতের মতন চ্যালা ছিল— যে মশাল জ্বালিয়ে, রণপায়ে চড়ে, হা—রে—রে করে ডাকাতি করতে বেরোলে কোম্পানির সেপাইরা মানে—মানে রাস্তা ছেড়ে সরে পড়ত— সেই ভজন বাউড়িই যে আজ একেবারে একলা হয়ে পড়েছে, তার পেছনেও তো ওই একদিনের একটু অসাবধানতা।
দিনটা ছিল চারবছর আগের মাঘী—পূর্ণিমার রাত। তার পরের দিন রাধাসায়রের জমিদার হরেকৃষ্ণ বাগচির মেয়ের বিয়ে। খোঁজখবর পাক্কা। কলকাতা থেকে একলাখ টাকার গয়না জমিদারবাড়ির তবিলখানার সিন্দুকে সেইদিনই এসে জমা হয়েছে। মাত্র তিনজন লাঠিধারী সিপাই সারারাত সেই তবিলখানা পাহারা দেবে। সব খবর নিয়েই ভজন বাউড়ি আর তার দলবল রাধাসায়রের জমিদারবাড়িতে হানা দিয়েছিল।
লাঠিধারী সিপাইয়ের খবরটা ভজন ঠিকই শুনেছিল। যে খবরটা জানতে পারেনি সেটা হল, মেয়ের বিয়েতে যে আমোদ—অনুষ্ঠান হবে, তাতে কসরত দেখানোর জন্যে জমিদারবাবু ভুবনডাঙা থেকে রায়বেঁশে নাচের দল ভাড়া করে এনেছেন। আর সেই চল্লিশজন নাচিয়ের দল বাড়ির পেছনে একটা চালাঘরে ডেরা বেঁধেছে।
ভুবনডাঙার রায়বেঁশে নাচের দলের লোকেরা লাঠি, সড়কি কিংবা ছুরিখেলা—টা ভজনের দলের লোকেদের থেকে কিছু কম জানত না। যে জমিদারবাবুর নুন তারা খেয়েছে তার বাড়িতে ডাকাতি হবে আর তারা বসে বসে দেখবে এও তাদের ধর্মে লেখে না। ফলে যা হবার তাই হল। ভজনের দলের বারোজন লোক সেই রাতেই রায়বেঁশের দলের হাতে খুন হয়ে গেল। ভজন নিজেও একটুর জন্যে খুন হতে হতে বেঁচে গেল, তবে তার ডান—পায়ের গোছে এমন একখানা সড়কি এসে বিঁধল যে, ইংরেজদের জেলখানার ডাক্তারবাবুকেও সেই ঘা সারিয়ে তুলতে নাকের জলে চোখের জলে হতে হয়েছিল। এখনও, জেলখানা থেকে বেরোনোর পরেও, ভজন ভালো করে দৌড়তে পারে না। একটু লেংচে হাঁটে। দল বেঁধে ডাকাতির কাজে তার ওইখানেই ইতি।
সেইজন্যে এবার প্রথমদিনেই মন্দির—ফেরত একটা বোকাসোকা মতন লোকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ভজন কথাটা আলতো করে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছিল— এই যে দুর্লভঠাকুর মায়ের এত গয়নাগাটি নিয়ে বিলের ধারে একলা থাকেন, তা ভয়ের কিছু নেই এতে?
গেঁয়ো লোকটা এই কথা শুনে চলা থামিয়ে হাঁ করে কিছুক্ষণ ভজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, দুর্লভঠাকুরের ঘরে ডাকাতি! ডাকাতের নাকের ওপর দুটো চোখ থাকবে তো?
ভজন ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে না পেরে নিজের চোখদুটোয় একবার হাত বুলিয়ে নিল। তারপর আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ, ধরো তা তো থাকবেই। চোখ না থাকলে ডাকাতিটা করবে কেমন করে?
তাহলেই হল। লোকটা আবার মাঠ পেরিয়ে চলা শুরু করল। চলতে চলতেই বলল, একবার দুর্লভ ঠাকুরের চোখে চোখ পড়ে গেলে তাকে আর নড়ে বসতে হবে না। দলবল সমেত তাকে ওইখানেই থম হয়ে বসে থাকতে হবে। আর আহিরন থানার বড়বাবু চার্লিসাহেব পরে সময়মতন এসে তাদেরকে টুকটুক করে কাঁকড়ার মতন ঝাঁকায় পুরে লে যাবে।
ভজনের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল— সেদিন মন্দিরে যাতায়াতের পথে ভক্তদের মুখে এমনধারা কথাই সে সারাক্ষণ শুনেছে বটে। সম্মোহনের কথা। দুর্লভঠাকুর নাকি মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে সম্মোহন করে দিতে পারেন। যতক্ষণ তিনি নিজে থেকে কাটান না দিচ্ছেন, ততক্ষণ সম্মোহিত লোকটার আর নড়াচড়ার ক্ষমতা থাকে না।
তবে হ্যাঁ, যে কোনো গুণী মানুষের মতন দুর্লভ চক্রবর্তী তাঁর ওই গুণটা যেখানে—সেখানে যখন—তখন দেখান না। একমাত্র পাগল রোগীকে ভালো করতে হলে তিনি তাদের সম্মোহন করেন, আর কখনো সখনো কারুর স্মৃতিলোপ পেলে সেই হারানো স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে।
কপালজোরে দুর্লভ তান্ত্রিকের সম্মোহন শক্তির একেবারে চাক্ষুষ প্রমাণ ভজন ঠিক পরদিনই পেয়ে গেল। বাপরে বাপ, একেবারে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! হল কী, ঠাকুরের একটা ছোট ডিঙি—নৌকা আহিরন বিলের ঘাটে বাঁধা থাকে। যারা বিলের ধারে ঘরবসত করে, তাদের একটা নৌকা ছাড়া চলে না। কারণ, নামে বিল হলেও আহিরন আসলে সমুদ্রের মতন বিশাল একখানা ব্যাপার। বিশেষ করে বর্ষাকালে তার এপার ওপার দেখা যায় না। এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে যাতায়াত করতে গেলে এদিকের লোকেরা তাই ট্যাঙস ট্যাঙস করে না হেঁটে, সড়াৎ সড়াৎ করে ডিঙি বেয়ে জলের ওপর দিয়ে চলে যায়। তাছাড়া পদ্ম কিংবা পানিফল তুলতে, ঘর ছাইবার হোগলা আনতে, আরও চৌষট্টিরকমের কাজে বিলের বুকে ভেসে পড়তেই হয়। ডিঙি ছাড়া চলবে কেমন করে?
হ্যাঁ, দুর্লভ ঠাকুরের সেই ডিঙি—নৌকাটা ভজনও যেতে—আসতে দেখেছে। দিব্যি গাবের আঠার পালিশ লাগানো কালো কুচকুচে একখানা নৌকা। গলুইয়ের দুপাশে আবার তেল—সিঁদুর দিয়ে টানা—টানা দুখানি চোখ এঁকে দিয়েছে দুর্লভ তান্ত্রিক। সেই নৌকাটাকেই নাকি খুঁটির বাঁধন থেকে খুলে নিয়ে চারটে বদমাশ ছেলে বিলের জলে ভেসে গিয়েছিল। দুর্লভ তান্ত্রিক খবর পেয়ে বিলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে ছেলে চারটে ফিরে এসেছে। খুব কাছ থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছিল ভজন বাউড়ি— ঠাকুরমশাইয়ের চোখদুটো কেমন যেন জ্বলে উঠল। তিনি একবার হাওয়ায় হাতটা ঘুরিয়ে বলল, তোরা ওইখানেই বসে থাক।
ব্যস, চারটে জোয়ান ছেলে একেবারে চারটে শামুকের মতন গুটিয়ে গেল; থম মেরে বসে রইল গাছতলায়। ভজন ইচ্ছে করেই দুয়েকবার গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল। তোমাদের নাম কী? গ্রাম কোথায়?— এমনধারা কথা সব। ছেলেগুলো যেন সেসব শুনতেই পেল না। ফ্যালফ্যাল করে সামনের দিকে চেয়ে বসে রইল। শেষকালে পুজোপাট সেরে দুর্লভঠাকুর ঘণ্টাদুয়েক বাদে বাইরে বেরিয়ে এসে আবার ওদের চোখের সামনে হাতটাকে ঢেউয়ের মতন দু—চারবার নাড়াচাড়া করলেন। তখন ওদের সাড় ফিরল। তারপর ছেলেগুলোর মাঠঘাট ভেঙে পাঁইপাঁই করে দৌড় দেখে কে?
তখনই ভজন কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মনে মনে বলেছিল, বাপস। ঠাকুরের চোখের দিকে চাওয়া নেই। এ যা বিপজ্জনক বিদ্যে, মুহূর্তের মধ্যে পাথর করে দেবে।
.
ভজন বুঝেছিল ওই সম্মোহনের ব্যাপারটুকু সামলে দিতে পারলে আর বিশেষ কোনো চিন্তার কারণ নেই। লড়াইটা একজনের বিরুদ্ধে একজনের। তার ওপর দুর্লভ ঠাকুরের সরু বাঁশের মতন টিঙটিঙে চেহারা, আর তার নিজের ডান পা—টা খোঁড়া হলেও চেহারাটা এখনও মা দুর্গার অসুরের মতন তাগড়াই। অসুবিধে ছিল শুধু দুটো জায়গায়। এক, ওই সম্মোহন। আর দুই, দেবীর গায়ের গয়নাগুলো দুর্লভঠাকুর কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন সেটা ওঁকে দিয়ে কবুল করানো। সেই দুটো কাজ কীভাবে একসাথে সারা যায় সে ব্যাপারে মনে মনে ছক কষেই এগিয়েছিল ভজন।
ঘরের ভেতর থেকে শক্ত শালকাঠের খিল লাগানো ছিল। ভজন বাউড়ির লোহার নেহাইয়ের মতন শক্ত কাঁধের তিন ধাক্কায় সেই খিল মড়মড় শব্দ করে ভেঙে পড়ে গেল। তান্ত্রিক দুর্লভ চক্রবর্তী সেই সময়টুকুর মধ্যে তক্তাপোশের ওপর উঠে বসবার সুযোগটুকুই পেয়েছিলেন, তার বেশি কিছু নয়। দরজা ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই গুলবাঘার মতন লাফ মেরে ঘরে ঢুকে ভজন বাঁ—হাতে ঠাকুরমশাইয়ের ঘাড় ধরে তাঁকে বিছানার ওপর উপুড় করে ফেলেছিল।
সে সময়টুকুতেও সে হুঁশিয়ার ছিল, ওঁর চোখে যেন চোখ না পড়ে যায়।
বিছানায় মুখ ঠেসে ধরে কাউকে তো বলা যায় না, এবার বলো দিকিনি, কোথায় লুকিয়ে রেখেছ দেবী চামুণ্ডার জড়োয়ার গয়না, যে গয়না সবেমাত্র গতমাসেই রাধাসায়রের জমিদারমশাই দেবীর কাছে মানত হিসেবে দিয়েছেন। কাজেই ভজন আগে ভালো করে দুর্লভ ঠাকুরের চোখের ওপর দিয়ে গামছার ফেট্টি জড়াল। তারপর তাঁর হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধল। তারপর ঠাকুরমশাইকে তক্তাপোশের ওপর বসিয়ে, গলার ওপর রামদা খানা ঠেকিয়ে, ভজন হিসহিস করে সেই প্রশ্নটা করে ফেলল—
গয়নাগুলো কোথায় লুকিয়েছেন?
অমন ডাকসাইটে তান্ত্রিককেও চোখ বাঁধা অবস্থায় নিতান্তই এলেবেলে লাগছিল। তিনি মিনমিন করে বলে ফেললেন, শিবঠাকুরের মাথার নিচে পাথরের ফোকরে।
সত্যিই ফোকরের মধ্যে হাত গলিয়ে গয়না পেয়ে গেল ভজন। বেশি কিছু নয়, একটা হার, একটা তাবিজ আর দুটো বালা। তবে সবকটাই ওজনে ভারী। এগুলো বিক্রি করলে তার বছরখানেকের ভাত—কাপড়ের ভাবনা থাকবে না। ভজন কাজ সেরে বেরিয়েই আসছিল। হঠাৎ দুর্লভ তান্ত্রিক সেই মারাত্মক ভুলটা করে ফেললেন। বলে বসলেন, তোমার মুখটা দেখবার সুযোগ পাইনি। তবে তোমার একটা পায়ের জোর নেই। তুমি পা টেনে টেনে হাঁটছ। চোখ বেঁধে রাখলেও সেটা আমি কানে শুনে টের পাচ্ছি। এই কথাটুকু আমি দারোগা চার্লিসাহেবকে বলব।
ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও কথাটা শুনে পাথর হয়ে গেল ভজন। তারপর মনে মনে মা চামুণ্ডাকে একটা প্রণাম করল। মা, ভাগ্যিস অহঙ্কারী লোকটার মুখ দিয়ে কথাটা বলালি! না হলে আমি তো বুঝতেই পারতাম না, ও আমার খোঁড়া পায়ের কথা জেনে ফেলেছে। খোঁড়া গুন্ডা একটা পরগনায় আর কটা থাকে? কাজেই কাল ভোরেই চার্লিসাহেব আমাকে ঘর থেকে তুলে এনে পিটিয়ে আধমরা করে ডাকাতির কথা বার করে নিত।
এরপর আর দেরি করেনি ভজন। চোখ বাঁধা দুর্লভের গলায় রামদার এক কোপ ঝেড়ে বলেছিল, যা, এবার বলগে যা কাকে বলবি খোঁড়া পায়ের কথা।
না, তা বলবার সুযোগ পাননি দুর্লভ চক্রবর্তী। তবে মরবার আগে ঘরঘরে গলায় অন্য একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, আমার চোখের নজর থেকে তুমি বাঁচবে না। আমার চোখের নজর…থেকে…বাঁচবে না।
যতসব বাজে কথা। মরার আগের প্রলাপ।
.
মন্দির থেকে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এপাশ ওপাশ তাকাল ভজন। সবকিছু যেমন ছিল তেমনই রয়েছে। সেই কুয়াশায় ঢাকা আঁধার দুনিয়া। গাছের পাতা থেকে টুপিয়ে পড়া শিশিরের টপটপ শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই কোনোখানে। ভজনের চোখে অন্ধকার সয়ে এলে সে হাঁটা লাগাল আহিরন বিলের দিকে।
আসবার পথে হেঁটে এসেছে। তাতে সময় লেগেছে অনেক। কষ্টও হয়েছে কম নয়। তবে ফেরার পথে সে আর হাঁটবে না।
কয়েক পলকের মধ্যেই ভজন মন্দিরের পেছনের শুঁড়িপথ ধরে আহিরন বিলের কাছাকাছি এসে পৌঁছল। একটু দূরে ওই রাঙচিতের ঝোপটার আড়ালেই দুর্লভ হালদারের ডিঙি নৌকা বাঁধা রয়েছে। একবার সেটাকে শুধু খুঁটি থেকে খুলে নেওয়ার অপেক্ষা। ভোর হওয়ার আগেই সোজা উত্তরপূর্ব কোণের দিকে লগি ঠেলে সে পৌঁছে যাবে লালবাগের ঘাটে। তারপর লালবাগের চোরাই সোনার কারবারি হুজুরিমলের হাতে গয়নাগুলো ধরিয়ে দিলেই সে নিশ্চিন্ত।
একবার পেটকোঁচড়ে বাঁধা গয়নাগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে নিল ভজন। তার মুখে একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। সে পায়ে পায়ে ঝোপটার দিকে এগলো।
জলের ধারে দাঁড়িয়ে ভজন দেখল, বিলের বুকে চাপ চাপ কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে। ঘন অন্ধকারের মধ্যেও কেমন করে কে জানে কুয়াশার গায়ে সাদাটে এক আলো লেগে রয়েছে। দণ্ডে দণ্ডে সেই কুয়াশার স্তূপ তাদের আকার বদলাচ্ছে। সাপের মতন মোচড় খাচ্ছে, বাঘের মতন গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছে। এই মনে হচ্ছে একটা মানুষ হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছে, আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে চারটে লোক মড়ার খাটিয়া কাঁধে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল।
বিলের বুকে দপদপ করে আলেয়া জ্বলছে নিভছে। হোগলার বনের মধ্যে দিয়ে বাতাস বওয়ার শব্দ হচ্ছে খট—খট, সড়—সড়।
মোদ্দা কথা, বিলের ধারে এসে পৌঁছতেই ভজনের মনে হল মন্দির চত্বরের সেই নির্জনতা এখানে আর নেই। এখানে আর সে একা নয়। চারিদিকে কারা যেন ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে, কথা বলছে, দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।
ভজন একবার রামদার ওপরে হাতটা বুলিয়ে নিল। লোহা ছুঁয়ে থাকলে তেনাদের আসার কথা নয়। কী যেন এক রাতচরা পাখি হঠাৎ ভজনের একেবারে কানের কাছে তীক্ষ্ন গলায় চিৎকার করে উঠল, কিয়ো কিয়ো কিকোরেএএ। ভজনের বুকটা কেঁপে উঠল। কেন এমন হচ্ছে আজ? ওই পাখিটার মতন, শিয়ালের মতন, সেও তো চিরকালের এক নিশাচর জীব। অন্ধকারকে তো সে এর আগে কখনও ভয় পায়নি। আজ তাহলে বুকের ভেতর এত ধুকপুকুনি কীসের?
রাঙচিতের ঝোপটাকে বেড় দিয়ে নৌকার কাছে পৌঁছতেই ভজনের বুকের ভেতর দিয়ে হিম ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল।
দুটো চোখ!
দুটো চোখ অন্ধকারের মধ্যে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে তার দিকে!
টানা টান বিশাল দুটো চোখ। কাজলকালো জোড়াভুরু ধনুকের মতন বাঁক খেয়ে গেছে। ওপরের আর নিচের ঘন আঁখিপল্লবের প্রান্ত বরাবর রক্তরেখা। একটু খয়েরি মণিদুটো কী ভীষণ জীবন্ত!
সেই চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ভজন বাউড়ির সবকিছু বিস্মরণ হয়ে গেল। সে ভুলে গেল তার নাম ভজন বাউড়ি, সে আজ একটু আগে একটা মানুষ খুন করেছে। সে ভুলে গেল তাকে পালাতে হবে, আর তার জন্যে তাকে নৌকা ধরতে হবে এখান থেকেই। সে ভুলে গেল কাকে বলে পৃথিবী, কাকে বলে আকাশ, কাকে বলে দিন, কাকে বলে রাত্রি।
ভজনের সমস্ত চেতনা জুড়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে লাগল টকটকে লাল তেলসিঁদুরের কাজল—টানা দুটো চোখ। একটু খয়েরি দুটো মণি দুটো গভীর কুঁয়োর মতন তাকে ডাক দিল— আয় ভজন, কাছে আয়! আয়!
সেই শব্দহীন ডাকে সাড়া দিয়ে ভজন বিলের জলে এক পা ফেল। তারপর আরেক পা। তারপর আরেক পা।
বিলের পাড়ে একটা মরাগাছের ডালে বসে রাতচরা পাখিটা আতঙ্কিত চোখে সেই দৃশ্য দেখল। তারপর হঠাৎ হাহাকার করে উঠল—গেল, গেল, গেলরেএএএ। তারপর পাখিটা তিরবেগে বিলের অন্যদিকে উড়ে পালাল।
ভজনের কানে অবশ্য এসব কিছুই ঢুকছিল না। তখন সে গভীর সম্মোহনে সম্মোহিত। তার সামনে তখন দূর থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে দুটো দীর্ঘ চোখ আর ভজন আকুল হয়ে দুহাত বাড়িয়ে সেই চোখদুটোর কাছে পৌঁছনোর জন্যে জল ভেঙে হেঁটে চলেছে।
আহিরন বিলের ঘন কালো জল প্রথমে ভজনের কোমর ছুঁল। তারপর বুক। রাশি রাশি ঝাঁঝি আর শাপলার দল ভজনের দুই পায়ের গোছ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল।
ভজনকে ঘিরে শেষবারের মতন এক আলেয়ার মালা দপ করে জ্বলে উঠেই মিলিয়ে গেল।
জল ভজনের গলা ছুঁল। ভজন মাথা তুলে দেখল, তার প্রায় হাতের কাছে স্থির হয়ে ভেসে আছে সেই দুটো চোখ। তারা ভজনকে ডাকছে, আয় ভজন! আর একটু এগিয়ে আয়!
ভজন এগল। তারপর তাকে আর দেখা গেল না। আহিরনের কালো জল ভজনের মাথার ওপরে একবার বুড়বুড়ি কেটেই স্থির হয়ে গেল।
.
পরদিন সকালে বিলের ধারের বাসিন্দারা ভজনের ভেসে ওঠা মৃতদেহটাকে টেনে পাড়ে এনে তুলেছিল। তার পেটকোঁচড়ে মা—কালীর গয়না আর মন্দিরের মধ্যে দুর্লভঠাকুরের লাশ দেখে কারুর বুঝতে অসুবিধে হয়নি আগের রাতে কী হয়েছিল।
তারা দুর্লভ ঠাকুরের ভেসে যাওয়া নৌকাটাকেও আবার টেনে এনে পাড়ের খুঁটিতে বেঁধে রেখেছিল। কেমন করে নৌকাটার বাঁধন—দড়ি খুলে গিয়েছিল কে জানে!
তখনও নৌকাটার গলুইয়ের দুপাশে তেলসিঁদুর দিয়ে আঁকা সেই চোখদুটো নিষ্পলক তাকিয়েছিল।
তবে সেই চোখদুটোতে তখন আর আগের রাতের সম্মোহন ছিল না।