রাজার খেলা

রাজার খেলা

ধর্মতলায় নিধু জ্যাঠার সঙ্গে ট্রাম থেকে নেমে কার্জন পার্কের ভেতর দিয়ে ইডেন গার্ডেনের দিকে যেতে যেতে একেবারে হাঁ হয়ে গেল রাজা। চারপাশ থেকে যত বাস মিনিবাস ট্রাম ট্যাক্সি আর প্রাইভেট কার আসছে, সব মানুষে ঠাসা। গাড়িগুলো এসে থামছে কার্জন পার্কে, রাজভবনের গায়ে এবং ওধারের ময়দানে। সেগুলো থেকে গল গল করে মানুষ বেরিয়ে এসে সোজা চলেছে ইডেন গার্ডেনের দিকে। আজ গোটা কলকাতা যাচ্ছে রঞ্জি স্টেডিয়ামে ইণ্ডিয়া ভার্সাস ইংল্যান্ডের টেস্ট ম্যাচ দেখতে।

কার্জন পার্ক থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। অগুনতি গাড়ি সামনে দিয়ে দারুণ স্পীডে রেড রোডের দিকে ছুটে যাচ্ছে। ট্রাফিক কনট্রোলে লাল আলো জ্বলতেই ছুটন্ত গাড়িগুলো থেমে গেল। আর নিধু জ্যাঠার হাত ধরে, রাস্তা পেরিয়ে রাজভবনের ফুটপাথে চলে এল রাজা। তারপর মানুষের

স্রোতে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল।

নিধু জ্যাঠার বয়স সত্তরের কাছাকাছি। সাধারণ বাঙালিদের তুলনায় সে অনেক লম্বা, প্রায় ছ ফুটের মতো। টান টান চেহারা, শরীরে এক গ্রাম বাজে চর্বি নেই। মাথার প্রায় সব চুল সাদা হয়ে  গেছে, তবু নিধু জ্যাঠা খুব স্মার্ট। তার হাঁটার ভঙ্গি যুবকদের মতো।

এই মুহূর্তে নিধু জ্যাঠার পরনে মালকোচা দিয়ে পরা ধুতি আর ফুল শার্ট, তার ওপর রোঁয়াওলা উলের সোয়েটার। পায়ে কেডস। কাঁধ থেকে একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে।

তার পাশে রাজাকে বেশ ছোট দেখাচ্ছে। রাজার পরনে এখন ফুল প্যান্ট আর বুশ শার্ট, তার ওপর লাল পুল-ওভার। পায়ে নীল মোজা আর বুট।

রাজভবনের ফুটপাথটা সেমি সার্কেলে ঘুরে গেছে। সেটা ধরে খানিকটা যেতেই চোখে পড়ল, ওধারের ময়দানে কয়েক হাজার প্রাইভেট কার পার্ক করা রয়েছে। তার মানে গাড়িওলারা ওখানে গাড়ি রেখে স্টেডিয়ামে ঢুকেছে। খেলা ভাঙলে ফিরে এসে যে যার গাড়িতে উঠে চলে যাবে।

নিধু জ্যাঠার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দারুণ ভাল লাগছিল রাজার, ভীষণ উত্তেজনাও হচ্ছিল। তার কারণ, এই প্রথম সে ইডেন গার্ডেনে টেস্ট ম্যাচ দেখতে যাচ্ছে।

রাজারা থাকে উত্তর কলকাতায়−বাগবাজারের কাছে একটা সরু গলিতে। সে পড়ে মডেল স্কুলে, ক্লাস সিক্সে। আজ একত্রিশে ডিসেম্বর। এ বছরেরই অক্টোবরে সে এগার পেরিয়ে বারোয় পা দিয়েছে।

পড়শোনায় রাজা বেশ ভাল। প্রতি বছর ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে আসছে। লেখাপড়ার মতো খেলাধুলোতেও তার খুব ঝোঁক। কিন্তু নর্থ ক্যালকাটায় খেলার মাঠ নেই। কখনও সখনও কোনো পার্কে একটু জায়গা পেলে পাড়ার ছেলেদের জুটিয়ে টেনিস বল দিয়ে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল কি ইণ্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচের আসর বসিয়ে দ্যায়। নইলে খবরের কাগজের খেলার পাতা আর ঝকমকানো রঙিন সব স্পোর্টস ম্যাগাজিন পড়ে কখনও সে স্বপ্ন দ্যাখে পেলের মতো ফুটবল খেলোয়াড় হবে, কখনও বা ভাবে ভিভ রিচার্ডসের মতো ব্যাটসম্যান না হলে চলবে না।

এই খেলাধুলোর ব্যাপারটায় সারাক্ষণ রাজাকে তাতিয়ে রাখে নিধু জ্যাঠা। এই যে আজ জীবনে প্রথম ইডেনে টেস্ট ম্যাচ দেখতে যাচ্ছে সেটাও নিধু জ্যাঠার জন্যই।

রাজার বাবারও খেলাটেলায় যথেষ্ট আগ্রহ। তিনি মোটামুটি একটা চাকরি করেন। এদিকে ফ্যামিলিতে লোকজন অনেক। রাজারা চার ভাইবোন, বাবা, মা, ঠাকুমা আর এক বিধবা পিসিমা। মোট আটজন। এত বড় সংসার চালাতে অফিস ছুটির পরও বাবা আরো কী সব করেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রোজই তাঁর রাত হয়। অনেক কষ্টে টায়টোয় কোনোরকমে রাজাদের চলে যায়।

বাবার পক্ষে পঁচাত্তর টাকা দিয়ে টেস্ট ম্যাচের টিকিট কেটে দেওয়া সম্ভব না। দামী দামী খেলার ম্যাগাজিনও তিনি কিনে দিতে পারেন না। বাড়িতে একটাই মোটে বাংলা খবরের কাগজ আসে। নিধু জ্যাঠাই এর ওর কাছ থেকে অন্য সব খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন চেয়ে এনে রাজাকে দেয়। পড়া হয়ে গেলে সেগুলো ফেরত দিয়ে আসে।

টেস্ট খেলা তো আজ বললে কাল হয় না। ছ’মাস কি তারও আগে ঠিক করা থাকে। এবার ইডেনে ইন্ডিয়া ইংল্যান্ডের টেস্ট দেখার জন্য রাজা আর নিধু জ্যাঠা সবাইকে লুকিয়ে পয়সা জমাতে শুরু করেছিল। দু’জনের টিকিটের দাম দেড়’শ টাকা। টেস্টের তারিখটা জানার পর থেকেই টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে একটা ফাঁকা পাউডারের কৌটোয় রাখছিল রাজা। এইভাবে পঁচিশ টাকা জমানো গেছে। বাকি একশ পঁচিশ টাকা দিয়ে দু’খানা টিকিট কিনে আনে নিধু জ্যাঠা।

নিধু জ্যাঠা রাজার আপন জ্যাঠা নয়। এমন কি তার সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্কই নেই। না থাক, তবু আপনজনের চেয়ে সে অনেক বেশি।

রাজা শুনেছে, দেশভাগের আগে ঢাকা শহরে বাবারা যে পাড়ায় থাকতেন নিধু জ্যাঠাও সেখানেই থাকত। বাবার থেকে কয়েক বছরের বড়; সেই হিসেবে সে বাবার দাদা, রাজাদের জ্যাঠা।

নিধু জ্যাঠার পোশাকী নাম প্রিয়নাথ নাগ, ডাকনাম নিধু। ভাল নামটা লোকে ভুলেই গেছে। নিধুটাই সবার মুখে মুখে চালু রয়েছে।

নিধু জ্যাঠার তিন কুলে কেউ নেই, বিয়েও করেনি। রাজা শুনেছে, দেশভাগের কয়েক বছর বাদে ঢাকা থেকে বাবাদের সঙ্গে সে-ও কলকাতায় চলে আসে। তার জন্মের ঢের আগে থেকেই নিধু জ্যাঠা তাদের বাড়িতে আছে। তবে তার খরচ সে নিজেই চালায়। কলেজ স্ট্রীটে একটা বড় বইয়ের দোকানে কী একটা কাজ করে। তাতে যা মাইনে পায় তার প্রায় সবটাই মাসের শেষে বাবার হাতে তুলে দেয়। তাতে রাজাদের যথেষ্ট উপকার হয়। দিনে সাত-আট কাপ চা ছাড়া আর কোনো নেশা নেই। সবাই তাকে ভালবাসে। ছোটদের যত আবদার তার কাছে।

রাজা আরো শুনেছে ঢাকায় থাকতে দুর্দান্ত স্পোর্টসম্যান ছিল নিধু জ্যাঠা। বিখ্যাত উয়াড়ি ক্লাবের সে ছিল বাঘা রাইট আউট। তখন ঢাকায় ক্রিকেট খেলাটা তেমন একটা হত না। তবু উৎসাহ কম ছিল না। ওরই মধ্যে ব্যাট-ট্যাট কিনে প্র্যাকটিশ করত।

পৃথিবীতে যত বড় বড় ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা হয়েছে তার সমস্ত রেকর্ড নিধু জ্যাঠার মুখস্থ। তার কাছেই রাজা শুনেছে টেস্ট ম্যাচে কে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মেরেছে, কে বেশি ক্যাচ ধরেছে, কোন দেশে সবচেয়ে বেশি অল রাউন্ডার পাওয়া গেছে, ইত্যাদি। ফুটবলের গল্প শুরু হলে তো রাতের পর রাত কাবার করে দিতে পারে নিধু জ্যাঠা। পেলে, লেভ ইয়াসিন, গ্যারিঞ্চা বা জার্ড মুলার থেকে পাওলো রোসি পর্যন্ত কে কীভাবে গোল করে, কার খেলার স্টাইল কী রকম-বলতে বলতে তার চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে।

এতক্ষণে বাঁ দিকে রেড রোড, নেতাজীর স্ট্যাচু, দেশবন্ধুর মূর্তি রেখে আকাশবাণী ভবনের সামনে এসে পড়ল রাজারা। এখানে বাঁশের খুঁটি পুঁতে নানা গেটের দিকে যাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। চারদিকে প্রচুর পুলিশ। একজন পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করে সাত নম্বর গেটের হদিসটা জেনে নিল নিধু জ্যাঠা।

মিনিট পনেরর ভেতর দেখা গেল, ক্লাব হাউসের ডান দিকে সিমেন্টের গ্যালারিতে তারা সীট খুঁজে বসে পড়েছে। বাড়ি থেকে আসার সময় দুপুরে খাবার জন্য মা লুচি আলুভাজা ডিমসেদ্ধ আর কমলালেবু দিয়েছিল। খাবারগুলো একটা কাপড়ের সাইড-ব্যাগে পুরে নিয়ে এসেছে নিধু জ্যাঠা। ব্যাগটা এখন তার কোলে।

এখনও খেলা শুরু হয়নি। সবে সাড়ে ন’টা। আরো আধ ঘণ্টাবাদে ঠিক দশটায় টস হবে, তারপর তো খেলা।

রাজা মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে লাগল। তাদের বাঁ পাশে ক্লাব হাউস। তারপর থেকে গোল মাঠটাকে ঘিরে স্টেডিয়ামের অনেকগুলো ব্লক। ব্লকগুলোতে এখন শুধু মানুষ আর মানুষ। অসংখ্য গেট দিয়ে আরো অনেকে আসছে। কোথাও এক ইঞ্চি জায়গা ফাঁকা থাকবে না, খেলা শুরু হবার আগে স্টেডিয়াম বোঝাই হয়ে যাবে।

পশ্চিম দিকের ব্লকগুলোর পেছনে ইডেন গ্যার্ডেনের উঁচু উঁচু গাছ, আরো দূরে হাইকোর্টের চুড়ো দেখা যাচ্ছে।

এতদিন রাজা তার বন্ধু বুবুনদের টিভিতেই রঞ্জি স্টেডিয়াম দেখেছে। এখন নিজের চোখে সব দেখতে পাচ্ছে। এত মানুষ, তাদের নানা রঙের পোশাক, মাথার টুপি, ক্লাব হাউস, ইডেনের গাছপালা−সমস্ত মিলিয়ে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।

এ বছর শীতটা বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে। কনকনে হাওয়া ইডেন গার্ডেনের ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই ছুটে যাচ্ছে। হাওয়াটা এত ঠাণ্ডা, মনে হয় হিমালয়ের বরফ গায়ে মেখে নেমে এসেছে। অবশ্য রোদও উঠেছে চমৎকার। উষ্ণ সোনালি রোদ আর ঠাণ্ডা বাতাসে শীতের সকালটি দারুণ লাগছে।

চারপাশের মানুষেরা আজকের খেলাটার ব্যাপারে নানা রকম মন্তব্য করে যাচ্ছে।

একজন বলল, ‘গাভাসকার টপ ফর্মে আছে। ইডেনে ডাবল সেঞ্চুরি করবে।’

আরেক জন বলল, ‘কচু করবে। কাওয়ানস আর এডমণ্ডসকে ঠেকিয়ে কুড়িটা রান আগে করুক। তারপর বলবেন−’

তৃতীয় লোকটি বলল, ‘এই নতুন ছেলেটা, মানে আজাহারউদ্দিন সম্পর্কে কী মনে হয়?’

চতুর্থ লোকটি বলল, ‘আমার ধারণা, খুব ভাল খেলবে। ওকে পাওয়াতে ইন্ডিয়ার মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের সমস্যা অনেকটাই মিটে যাবে।’

পঞ্চম লোকটি বলল, ‘ইংল্যাণ্ডের ল্যাম্ব আর গ্যাটিং দুর্দান্ত খেলছে এই সীজনটা। এখানকার টেস্টের রেজাল্ট কী হবে কে জানে।’

রাজারা যেখানে বসে আছে সেখান থেকে পাঁচ রো নিচের সীট থেকে একটা লোক অনবরত চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘এই আইসক্রিম, এই পটেটো চীপস, এই চিউয়িং গাম, এই পপ কর্ন, ইধর আও−’ অর্থাৎ সামনে দিয়ে যে ফেরিওলা যা-ই নিয়ে যাক তাকেই ডাকছে লোকটা।

রাজার বাঁ পাশের সীটে এক মহিলা স্টেডিয়ামে ঢুকেই ব্যাগ থেকে উলের গোলা বার করে সোয়েটার বুনে চলেছেন। তাঁর ডান ধারে এক বেজায় মোটা মারোয়াড়ি আরেক জনের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোতে শুরু করেছে। খুব সম্ভব উল বোনা আর ঘুমোবার মতো জরুরি কাজের জন্যই তাদের এখানে আসা।

রাজা কিন্তু এসব কিছুই শুনছিল না, বা লক্ষ্যও করছিল না। সে শুধু স্বপ্নের ঘোরে পুরো স্টেডিয়ামটা বার বার দেখছে।

হঠাৎ পাশ থেকে নিধু জ্যাঠা ডাকল, ‘রাজা−’

অন্যমনস্কর মতো সাড়া দিল রাজা, ‘উ−’

‘নোট বইটা এনেছিস?’

একটা তিন ইঞ্চি বাই দু ইঞ্চি মাপের ছোট-সবুজ মলাটের নোট বই রাজাকে দিয়েছে নিধু জ্যাঠা। ওটাতে পেলে গ্যারিঞ্চা বেকেনবাউয়ার থেকে শুরু করে মারাদোনা ফ্রান্সিস কোলি ইউসোবিও পর্যন্ত ফুটবলের বাঘা বাঘা খেলোয়াড়দের গোল করার কায়দা যেমন লেখা আছে তেমনি ভিভ রিচার্ডস, ব্রাডম্যান, উইকস, গাভাসকার ইত্যাদি ক্রিকেটের বড় বড় স্টাররা কে কীভাবে স্ট্রোক করেন তার নিখুঁত বর্ণনাও নোট বইটিতে পাওয়া যাবে। ক্রিকেট এবং ফুটবলের দারুণ কিছু ঘটলেই রাজার সবুজ নোট বুকে তা উঠে যায়।

রাজা ঘাড় হেলিয়ে বলল, ‘এনেছি।’

‘ভেরি গুড। যখনই কারো ভালো স্ট্রোক কি বোলিং দেখবি তক্ষুণি টুকে রাখবি।’

মুখে কিছু না বলে আবার ঘাড় কাত করে রাজা।

কাঁটায় কাঁটায় দশটায় পেঙ্গুইন পাখির মতো ঢলঢলে কালো কোট-পরা দুই আম্পায়ার এবং দু’দলের ক্যাপ্টেন সুনীল গাভাসকার আর ডেভিড গাওয়ার মাঠের মাঝখানে টস করতে এলেন। টসে জিতে ইণ্ডিয়া ব্যাটিং নিল। গাওয়ার এবং গাভাসকার ক্লাব হাউসে ফিরে গেলেন। আম্পায়াররা মাঠেই থেকে গেলেন।

একটু পরেই গাওয়ার তাঁর টীম নিয়ে ফিল্ডিং করতে এলেন।

গাভাসকার তাঁর পার্টনার গাইকোয়াড়কে নিয়ে এলেন ব্যাটিং করতে।

সবুজ কার্পেটের মতো গোল মাঠে ধপধপে সাদা ট্রাউজার্স শার্ট পরা এগার জন ফিল্ডার, দু’জন ব্যাটসম্যান আর কালো কোট পরা দু’জন আম্পায়ার ছাড়া আর কেউ নেই।

এতদিন টিভিতে আর স্বপ্নে রাজা যাদের দেখেছে, এখন তারা একেবারে চোখের সামনে। উত্তেজনায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এসেছে তার, চোখের পলক পড়ছে না।

গাভাসকার আর গাইকোয়াড় কিন্তু বেশিক্ষণ ব্যাট করতে পারলেন না, অল্প রান করেই এডমণ্ডস এবং কাওয়ানসের বলে কট আউট হয়ে গেলেন।

কাওয়ানস দুর্দান্ত ‘বল’ করছিলেন। নিধু জ্যাঠা পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল, ‘কাওয়ানসের বল করার কায়দাটা টুকে নে।’

রাজা নোট বই আর ডট পেন বার করেই রেখেছিল। তক্ষুণি লিখে ফেলল।

গাভাসকার এবং গাইকোয়াড়ের পর এলেন বেঙ্গসরকার আর অমরনাথ। বেঙ্গসরকার এবং অমরনাথের দুটো স্ট্রেট ড্রাইভ, একটা স্কোয়ার কাট আর একটা সুইপের বর্ণনা লিখে নিল রাজা।

বেঙ্গসরকার এবং অমরনাথ জুটি আউট হলে এলেন রবি শাস্ত্রী আর আজাহারউদ্দিন। তাঁদের কত লেট কাট, অন ড্রাইভ, পুল আর কভার ড্রাইভের বিবরণ যে রাজার নোট বুকে টোকা হতে লাগল তার ঠিক নেই।

একসময় প্রথম দিনের খেলা শেষ হলো।

এরপর আরো চার দিন নিধু জ্যাঠার সঙ্গে ইডেনে এল রাজা। ইন্ডিয়ার প্রথম ইনিংস সাত উইকেটে চারশ সাঁইত্রিশ রানে ডিক্লেয়ার করে দেওয়া হলো। ইংল্যাণ্ড আউট হলো দুশো ছিয়াত্তর রানে। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ ড্র হয়ে গেল।

এর মধ্যে মাইক গ্যাটিং আর অ্যালান ল্যাম্বের হাঁটু মুড়ে পুল, সুইপ, ড্রাইভ, চেতন শর্মা, শিবরামকৃষ্ণণ ও শিবলাল যাদবের বোলিং-এর স্টাইল, ডেলিভারি, সব টুকে নিয়েছে রাজা।

১৯৮৫-এর পাঁচই জানুয়ারি খেলা শেষ হবার ঘণ্টাখানেক আগে পাশ থেকে নিধু জ্যাঠা হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা রাজা−’

পাঁচ দিন ধরে রাজার চোখ মাঠের মাঝখানেই আটকে আছে। মুখ না ফিরিয়ে সে বলল, ‘কী বলছ?’

‘স্টেডিয়ামে সবসুদ্ধ কত লোক আছে বল্ তো−’

‘খবরের কাগজে লিখেছে আশী হাজার।’

‘এর মধ্যে কত বাঙালী আছে, মনে হয়?’

‘বলতে পারব না।’

একটু ভেবে নিধু জ্যাঠা বলল, ‘ধর মিনিমাম সত্তর হাজার।’

রাজা উত্তর দিল না।

নিধু জ্যাঠা এবার বলল, ‘সত্তর হাজার লোকের হাত কতগুলো?”

রাজা হতভম্বের মতো বলল, ‘তুমি কি খেলা দেখতে এসে গুণ অঙ্কের ক্লাস বসাতে চাইছ?’

‘বল্ না−’

‘একজন মানুষের দুটো করে হাত হলে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার।’

‘রাইট। ভেবে দ্যাখ, কেউ ভাল ব্যাট, বল বা ফিল্ডিং করলে সত্তর হাজার বাঙালী একলাখ চল্লিশ হাজার হাতে হাততালি দিচ্ছে। দিচ্ছে কিনা?’

মাঠের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে বিমূঢ়ের মতো তাকালো রাজা। বলল, ‘হ্যাঁ দিচ্ছে।’

‘এবার বল মাঠে কত জন প্লেয়ার খেলছে?’

‘দু দলের বাইশ জন।’

‘তাদের ভেতর ক’জন বাঙালী?’

‘একজনও না।’

অনেকক্ষণ চুপচাপ।

তারপর খুব আস্তে আস্তে, অথচ বেশ জোর দিয়ে নিধু জ্যাঠা বলল, ‘আর কেউ পারুক, আর না-ই পারুক, তোকে অন্তত মাঠের মাঝখানে ওই বাইশ জনের একজন হতে হবে।’

রাজা চমকে উঠল, ‘কীভাবে?’

‘লেখাপড়ার সঙ্গে ক্রিকেট প্র্যাকটিশ করে করে, ভাল খেলা শিখে।’

‘শিখব কী করে? আমার কি প্যাড আছে? ব্যাট, উইকেট, গ্লাভস, ডিউস বল আছে?’

‘ঠিক বলেছিস।’ খানিকক্ষণ চিন্তা করে নিধু জ্যাঠা বলল, ‘দেখি কী করা যায়।’

টেস্ট ম্যাচ শেষ হবার মাসখানেক বাদে একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ভীষণ অবাক হয়ে গেল রাজা। যতটা অবাক, ততটাই খুশি। নিধু জ্যাঠা নতুন ব্যাট, লাল টুকটুকে ডিউস বল, প্যাড, উইকেট আর গ্লাভস কিনে এনে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

রাজার বাবাও হঠাৎ শরীর খারাপ হওয়ায় আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসেছেন। তিনি বললেন, ‘নিধুদা, এত টাকা খরচ করে এসব কিনতে গেলে কেন?’

নিধু জ্যাঠা বাবাকে বলল, ‘এ নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না ‘ভজন।’ রাজার বাবার ডাকনাম ভজন।

‘কিন্তু টাকাগুলো পেলে কোথায়? নিশ্চয়ই ধার-টার করেছ?’

‘যা ভাল বুঝেছি, করেছি। তোর শরীর ভাল না, শুয়ে থাক গিয়ে।’

বাবা তাঁর এই একরোখা জেদী দাদাটিকে ভাল করেই চেনেন। আর একটি কথাও না বলে তিনি অন্য ঘরে চলে গেলেন।

নিধু জ্যাঠা বলল, ‘তা হলে কাল থেকেই প্র্যাকটিশ শুরু করা যাক। ভাবছি তোর সঙ্গে আমিও নতুন করে আরম্ভ করব। ভোরবেলা উঠে আড়াই ঘণ্টা পড়ে নিবি, তারপর এক ঘণ্টা প্র্যাকটিশ। মাঠ থেকে ফিরে আধ ঘণ্টা রেস্ট। রেস্টের পর স্নান করে খেয়ে স্কুল। আর আমি চলে যাব কলেজ স্ট্রীটে। কাল থেকে এই হবে আমাদের রুটিন। রোজকার রুটিন। ঠিক আছে?’

রাজা মাথা হেলিয়ে জানালো, ‘ঠিক আছে।’

‘মনে রাখবি, ইডেন গার্ডেনে মাঠের ভেতর যে বাইশ জনকে দেখেছিস তার একজন তোকে হতেই হবে।’

রাজা বলল, মনে রাখবে।

পরদিন সকালে ব্যাট প্যাড-ট্যাড নিয়ে ঠিক আটটায় রাজা আর নিধু জ্যাঠা চলে গেল কাছাকাছি একটা পার্কে। সেখানে ঘাস-টাস বলতে কিছু নেই। চারদিক গর্তে বোঝাই। প্র্যাকটিশ অসম্ভব।

নিধু জ্যাঠা বলল, ‘চল, অন্য জায়গায় যাই।’

এখানে ক্রিকেট

খানিকটা দূরে আরেকটা পার্কে এসেও কাজের কাজ কিছুই হলো না। সি. এম. ডি এ’র কী সব কাজকর্ম হচ্ছে এদিকে, যার জন্য পার্কটায় অগুনতি গুদাম বানিয়ে মালপত্র রাখা হয়েছে। দশ ইঞ্চি জায়গাও এখানে ফাঁকা পড়ে নেই।

এবার রাজারা গেল আরো দূরের একটা পার্কে। সেটা পাতাল রেল দখল করে রেখেছে। এখানেও বিরাট বিরাট গোডাউন। সেগুলো সিমেন্ট বালি লোহার রড এবং নানারকম ভারী ভারী যন্ত্রপাতিতে বোঝাই।

রাজার স্কুল আর নিধু জ্যাঠার কাজে যাবার সময় হয়ে আসছিল। ওরা বাড়ি ফিরে এল। ঠিক হলো, পরের দিন আবার মাঠের খোঁজে বেরুবে।

কিন্তু পরের দিনও খেলার মাঠ পাওয়া গেল না। সব পার্কই হয় সি. এম. ডি. এ নয় পাতাল রেল কিংবা হকার আর ভিখিরিরা দখল করে রেখেছে।

চারদিন ঘোরাঘুরির পর একটা পার্ক পাওয়া গেল কিন্তু সেখানে বদমাশ বাজে ছোকরাদের আড্ডা। রাজাদের উইকেট পুঁততে দেখে তারা তেড়ে এল, ‘এখানে খেলা-ফেলা চলবে না। ভাগ−’

রাজা হতাশ হয়ে পড়ল। কিন্তু নিধু জ্যাঠা ভেঙে পড়ার মানুষ না। খবর নিয়ে সে জানতে পারল, ওই ছোকরাগুলো সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত পার্কে বসে থাকে। সারাক্ষণ নেশাটেশা করে। ওরা পারে না, এমন নোংরা কাজ নেই। ওদের জন্য সন্ধে পর্যন্ত কেউ পার্কে ঢুকতে পারে না। তবে সন্ধের পর ঠাণ্ডাটা যখন আরো কয়েক গুণ বেড়ে যায় তখন ওরা পার্ক থেকে চলে যায়।

এই পার্কটার ভেতরে এবং চারদিকের রাস্তায় কর্পোরেশন প্রচুর তেজী আলো লাগিয়ে দিয়েছে। এত আলো যে একটা আলপিন পড়লে খুঁজে নেওয়া যায়।

নিধু জ্যাঠা আর রাজা ঠিক করে ফেলল, রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর আলোয় ঝলমলে ফাঁকা পার্কে তারা প্র্যাকটিশ করতে আসবে। ঠাণ্ডাটা তখন একটু বেশিই থাকবে কিন্তু কী আর করা যাবে। ক্রিকেট তো শীতেরই খেলা। তা ছাড়া ইংল্যাণ্ডে গেলে তো এর থেকে অনেক বেশি ঠাণ্ডায় খেলতে হবে।

পরদিন রাত থেকেই আলোকিত ফাঁকা মাঠে সত্তর বছরের একজন বোলার বারো বছরের এক ব্যাটসম্যানকে বল করতে থাকে। চারদিক নিঝুম, মাথার ওপর জানুয়ারির হিম পড়ে যাচ্ছে অবিরাম। কিন্তু দুই ক্রিকেটারের সে ব্যাপারে হুঁশ নেই। সারা পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে তারা প্র্যাকটিশ করে চলেছে।

নিধু জ্যাঠা বল করতে করতে বলে, ‘এই একটা লেগ স্পিন দিলাম। সুইপ কর−’

রাজা ব্যাট চালায়।

নিধু জ্যাঠা হাঁ হাঁ করে ওঠে, ‘হলো না, হলো না। ল্যাম্ব “শিবরামকৃষ্ণণের বলে হাঁটু মুড়ে কীভাবে সুইপ করেছিল, ভেবে নে−’ বল কুড়িয়ে এনে আবার ডেলিভারি দিতে গিয়ে বলল, ‘আবার লেগ স্পিন দিচ্ছি। ট্রাই এগেন−’

এইভাবে রাতের পর রাত দু’জনে প্র্যাকটিশ করে যায়। ইডেন গার্ডেনে বাইশ জন টেস্ট খেলোয়াড়ের মধ্যে একজন হতে পারবে কিনা, রাজা জানে না। কিন্তু চেষ্টা তো করে যেতে হবে।

***

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *