শ্রীনগররাজ চক্রবর্মণ তাঁর প্রাসাদের ছাদ থেকে তাকিয়ে ছিলেন দূরের গিরিবর্ত্মের দিকে। পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত এই প্রাসাদ থেকে নীচ থেকে ওপরে উঠে আসা গিরিপথটা স্পষ্ট দেখা যায় মেঘ আর কুয়াশামুক্ত গ্রীষ্মের সকালে। এই শীতপ্রধান দেশে গ্রীষ্ম অতি মনোরম। প্রাসাদসংলগ্ন বাগিচায় থরে থরে গোলাপ ফুটে আছে, আর তার সুবাস এসে পৌঁছচ্ছে এই সুউচ্চ প্রাসাদের ছাদ পর্যন্ত। মধ্যবয়সি চক্রবর্মণের ঠিক পশ্চাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মহামন্ত্রী ভিক্ষচর। বার্ধক্যের সীমানায় উপনীত তিনি। চক্রবর্মণের পিতার আমল থেকেই শ্রীনগর-কাশ্মীর রাজের মহামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। শ্রীনগররাজ চক্রবর্মণ দমর গোত্রের দুই নর্তকীকে যেদিন হারেমে এনে রাজমহিষীর আসনে বসালেন সেদিন থেকেই পতন শুরু হয়েছে এ রাজ্যের। কামুক রাজা চক্রবর্মণের প্রশ্রয়ে হারেম থেকেই হংসী ও সোমলতা নামের দুই ডোম বারবনিতা রাজ্যের যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে। ভিক্ষচর এখন নামেই মহামন্ত্রী। বিশেষত হংসীর কাছে, বলা ভালো তার যৌনতার কাছে যেন আত্মসমর্পণ করেছেন রাজা চক্রবর্মণ। আর সে জন্যই ঔদ্ধত্য, শালীনতার সব সীমাকে যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে নীচস্বভাবা হংসী। হ্যাঁ, সে নীচস্বভাবা। নইলে কেউ ঋতুস্রাবের রক্তমাখা কাপড় পাগড়ি বানাবার জন্য উপহার দিতে পারে মহামন্ত্রী ভিক্ষচরের সহকর্মী আর এক মন্ত্রী শল্ককে?
রাজাদের হারেম থাকবে এ ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। রাজসভার মহিমাবর্ধনকারী দ্বাদশ রত্নের মধ্যে তিন রত্ন তিন নারী। মহিষী বা প্রধান রানি, ববতা বা প্রিয় পত্নী, পরিবৃক্তি বা পরিত্যক্ত স্ত্রী। যাকে রাজা পত্নী হিসাবে পরিত্যাগ করলেও বিশেষ কোনো গুণাবলীর জন্য রাজদরবারে স্থান দেন। এছাড়া সম্ভোগের জন্য থাকে হারেম। রাজার ক্ষমতা ও ইচ্ছা অনুসারে নারীদের সংখ্যা নির্ণীত হয়। যেমন বারাণসীরাজ তম্ব-র অতীব রূপসী মহিষী সুষোন্দী থাকা সত্ত্বেও তাঁর হারেমে ষোল হাজার নারী ছিল। এ প্রথা তো প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দু রাজাদের মধ্যে চলে আসছে। এই শ্রীনগর রাজ্যও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এ রাজ্যে এমন কখনও হয়নি যে হারেমের জন্য রাজ্যের শাসন ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়তে চলেছে। যা ঘটছে এই চক্রবর্মণের রাজত্বে।
গিরিবর্ত্মের দিকে তাকিয়ে ছিলেন রাজা চক্রবর্মণ। পাহাড়ের ফাঁক গলে সকালের সূর্যকিরণ এসে পড়েছে তাঁর মুখে। কোটরগত কামাতুর চোখ, উন্মুক্ত ঝুলে পড়া রক্তিম ওষ্ঠ, প্রকট হয়ে ওঠা হনু, লাম্পট্যের স্পষ্ট চিহ্ন যেন দিনের আলোতেও ধরা দিচ্ছে শ্রীনগর নৃপতির মুখমণ্ডলে। তিনি অপেক্ষা করছেন এক নারীর দর্শন পাবার জন্য। অনন্ত সম্ভোগের প্রতীক সেই নারী। যার জন্য ইতিমধ্যেই বিশাল এক অট্টালিকা নির্মাণ করেছেন রাজা চক্রবর্মণ। যার ঠিক কেন্দ্রস্থলে রয়েছে প্রাকারবেষ্টিত স্বর্ণখচিত সম্ভোগ মঞ্চ। যেখানে তার সঙ্গে যৌনক্রীড়া করবেন শ্রীনগররাজ। সব আয়োজনই সম্পন্ন। এখন শুধু তার আসার প্রতীক্ষা। চক্রবর্মণ সংবাদ পেয়েছেন যে গতকালই সেই নারী এসে উপস্থিত হয়েছেন শ্রীনগরের উপকণ্ঠে। ওই গিরিবর্ত্ম দিয়েই তাঁর নগরীতে প্রবেশ করার কথা। বিরাট এক শিবিকাতে বহন করে আনা হচ্ছে তাকে। শিবিকা না বলে অবশ্য তাকে কক্ষ বলাই ভালো। চল্লিশজন বেহারা তাকে বহন করে আনছে। কক্ষের মধ্যেই সে নারীর স্বাচ্ছন্দ্যের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে তাকে শিবিকা ত্যাগ না করতে হয়, যাতে কোনো পুরুষের দৃষ্টি সেই যুবতীর ওপর না পড়ে। চক্রবর্মণের আর তর সইছে না কখন সে আসবে বলে।
গিরিবর্ত্মের দিকে তাকিয়ে রাজা চক্রবর্মণ বললেন, ‘মহামন্ত্রী, ওই যুবতী কেমন দেখতে তুমি জানো?’
ভিক্ষচর জবাব দিলেন, ‘যা শুনেছি তাতে সে দীর্ঘাঙ্গী, গাত্রবর্ণ শুভ্র, দীর্ঘ অক্ষিপল্লব, স্ফীত বক্ষ, ক্ষীণ কটিদেশ, গুরু নিতম্ব।’
জবাব শুনে রাজা বললেন, ‘চান্দেলরাজাদের মন্দিরগাত্রে এ জাতের নারীর যে ছবি খোদিত দেখেছিলাম ঠিক তেমনই তো?’ কিছুকাল আগে রাজা চক্রবর্মণ সপার্ষদ ভ্রমণ করতে গেছিলেন চান্দেলরাজদের রাজ্যে। সেখানে যাবার পিছনে অবশ্য এক বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। সেখানে বেশ কয়েকটা প্রাচীন মন্দিরগাত্রে সম্ভোগের বিভিন্ন চিত্রাবলী, মিথুন ভাস্কর্য খোদিত আছে। যৌনতাই চক্রবর্মণের জীবনের সব কিছু। যদি সেই মন্দিরগাত্রের যৌন শিল্পকলা দেখে নতুন কোনো রতি-ক্রীড়া-সম্ভোগ পদ্ধতি জানা যায় সে জন্যই তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন। হ্যাঁ, জেনেছেন কাশ্মীররাজ। মন্দিরগাত্রে খোদিত এক অদ্ভুত যৌন দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেছিলেন রাজা চক্রবর্মণ। এমন মিথুন দৃশ্য আগে কোনওদিন দেখেননি তিনি। বিশেষ জাতের নারীর সঙ্গে বিশেষ পদ্ধতিতে যৌনক্রীড়া। আর তা দেখে ও এই মিথুনক্রীড়ার উপযোগিতা শুনে রাজা চক্রবর্মণের মনে হয়েছিল ঠিক এমন নারী তাঁর চাই। তাই ফেরার আগে তিনি চান্দেলরাজ মহীতপকে অনুরোধ করেছিলেন যে কোনও মূল্যে এমন এক নারী সংগ্রহ করে যেন শ্রীনগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কথা রেখেছেন মহীতপ। সেই নারীকে তিনি পাঠাচ্ছেন। চান্দেলরাজার মন্দিরে দেখা সেই নারীমূর্তির কথাই মহামন্ত্রীকে বোঝাতে চাইলেন রাজা। ঠিক তেমনই হবে তো এই নারী?
ভিক্ষচর জবাব দিলে, ‘নিশ্চয়ই তেমনই হবে। আপনি তো নিজের চোখেই মন্দিরগাত্রে দেখেছেন সে জাতীয় নারীর ছবি। চান্দেলরাজ আপনাকে ফাঁকি দেবেন কীভাবে?’
শ্রীনগররাজ বললেন, ‘তা বটে। তাছাড়া আমি শ্রীনগর-কাশ্মীরের রাজা। সত্যিকারের নৃপতি। মহীতপকে স্থানীয় লোকেরা রাজা বললেও সে তো আসলে ওই জঙ্গলপ্রদেশের ভূ-স্বামী মাত্র। আমার মতো সত্যিকারের রাজার সঙ্গে তার মতো ভূ-স্বামীর সম্পর্ক স্থাপন নিশ্চয়ই তার কাছে গৌরবের ব্যাপার।’
মহামন্ত্রী মৃদু চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, ‘তা তো নিশ্চয়ই। আপনি এই বিশাল উপত্যকার সত্যিই অধীশ্বর। আর মহীতপ সেই রুক্ষ-জঙ্গুলে রাজ্যের ভূ-স্বামী মাত্র। কৃষ্ণবর্ণের বুনো লোকদের দলপতি ছাড়া সে কিছুই নয়। আপনার অনুরোধ রক্ষা করতে পেরে নিশ্চয়ই কৃতার্থ হয়েছে।’
রাজা চক্রবর্মণ বললেন, ‘তা তো বটেই। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, সে সেই নারীকে পাঠাবে। তবে যারা তাকে নিয়ে আসছে সেই বেহারার দল আর মহীতপের দূত হয়ে যদি কেউ এসে থাকে তবে তাদের পর্যাপ্ত স্বর্ণমুদ্রা দেবেন। আর মহীতপের জন্য উপহারস্বরূপ তুলে দেবেন সোনার সুতোর কারুকাজ করা পশুলোমের শাল। যাতে খুশি হয় তারা।’
মহামন্ত্রী বললেন, ‘আপনার নির্দেশ পালিত হবে, মহারাজ।’
রাজা চক্রবর্মণ মুখে মহামন্ত্রীকে যদিও বললেন, যে তিনি নিশ্চিত ছিলেন মহীতপ সে নারীকে পাঠাবে। কিন্তু গতকাল মহীতপের উপহার শ্রীনগরের উপকণ্ঠে পৌঁছেছে এ খবর কানে না আসা পর্যন্ত চক্রবর্মণ ব্যাপারটা নিয়ে একটু সন্দিহান ছিলেন। কারণ, চক্রবর্মণ সবার অলক্ষে একটা ব্যাপার ঘটিয়ে এসেছিলেন সেখানে। অন্য কেউ হয়তো জানে না তবে চক্রবর্মণ নিজে সেটা জানেন।
একথা সত্যি রাজা চক্রবর্মণের মতো নগরীর নানা প্রান্তে উদ্যানশোভিত হর্ম্যপ্রাসাদ-অতিথিশালা বা প্রমোদ-প্রাসাদ মহীতপের নেই। নদীতীরে অনুচ্চ এক পাহাড়ের গায়ে ছিরিছাঁদহীন এক পাথুরে দুর্গের মধ্যেই তার সবকিছু। চক্রবর্মণেরও স্থান হয়েছিল সেখানেই। চন্দ্রালোকিত এক রাত্রে চক্রবর্মণ গবাক্ষ দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন যে এক রূপসী নারী একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছে দুর্গের পশ্চাতভাগে যে ক্ষুদ্র কানন আছে তার বৃক্ষরাজির নীচে। সঙ্গে সঙ্গে কামজ্বালা জেগে উঠেছিল চক্রবর্মণের মনে। যে রাজা নিজের রাজ্যে প্রতিদিন অন্তত তিনজন নারীকে সম্ভোগ করেন, তিনি এই জঙ্গলপ্রদেশে সুদূর শ্রীনগর থেকে দীর্ঘ পথ পরিক্রমার কারণে নারীদেহ থেকে বঞ্চিত, তাঁর দেহে কামনার আগুন জ্বলে ওঠা স্বাভাবিক। চক্রবর্মণ তাকে দেখামাত্রই কক্ষ ত্যাগ করে মার্জারের মতো উপস্থিত হয়েছিলেন সেই নির্জন বাগিচায়। তারপর পিছন থেকে জাপ্টে ধরে সে রমণীকে টেনে নিয়ে গেছিলেন এক প্রাচীন বৃক্ষের আড়ালে। প্রাথমিক অবস্থায় চক্রবর্মণকে বাধা দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল সেই নারী। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেছিল সেই অসহায়া। হয়তো সে শেষ পর্যন্ত চিনতে পেরেছিল রাজ-অতিথি শ্রীনগররাজ চক্রবর্মণকে। নিজের কামেচ্ছা-সম্ভোগ চরিতার্থ করে সে রাতে আবার নিজ কক্ষে ফিরে এসেছিলেন চক্রবর্মণ। আর এর পরদিনই শ্রীনগরে ফেরার জন্য যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি।
জঙ্গলপ্রদেশের রাজা মহীতপ দুর্গের প্রধান তোরণ পর্যন্ত এসে বিদায় জানিয়েছিল তাঁকে। মহীতপের আচরণে কোনও উষ্মা প্রকাশ পায়নি। তবু রাজা চক্রবর্মণের মনে একটা আশঙ্কা থেকেই গেছিল যে হয়তো পরবর্তীকালে সে রাতের ঘটনাটা গোচরে এল মহীতপের, ক্ষুব্ধ হয়ে হয়তো মহীতপ রাজা চক্রবর্মণের অভীষ্ট সেই নারীকে শ্রীনগরে পাঠালেন না। গতকাল শিবিকা আসার খবর পেয়ে চক্রবর্মণ এ ব্যাপারেও নিশ্চিত হয়েছেন যে সেই ধর্ষণের খবরটা তবে মহীতপের কানে পৌঁছয়নি। অথবা যদি পৌঁছিয়েও থাকে তবে ব্যাপারটাতে তেমন আমল দেয়নি মহীতপ। ছাদে দাঁড়িয়ে মহামন্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথনের সময় সে ঘটনার কথা আরও একবার স্মরণে এল রাজা চক্রবর্মণের। এরপর তিনি মহামন্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, সত্যিই কি ওই নারী পুরুষের যৌন ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়? যে ওই নারীকে তৃপ্ত করতে পারে সে সত্যি কি এক রাতে সাতজন নারীকে সম্ভোগ করতে পারে? তৃপ্ত করতে পারে? সে কারণেই কিন্তু এ নারীকে পাবার জন্য আমার এত বাসনা।’
গা-ঘিনঘিনে সেই রতিক্রীড়ার কথা কল্পনা করে মনে মনে শিউরে উঠলেন মহামন্ত্রী ভিক্ষচর। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ না করে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘তাই তো বলেছিল চান্দেলরাজ। আপনার মনে নেই তার বলা সেই কাহিনি? বারাণসীরাজ এভাবেই তো তাঁর যৌনক্ষমতা বাড়াতেন। তম্বর ষোল হাজার সম্ভোগা ছিল। তিনি কোনও নারীর সঙ্গে দ্বিতীয়বার মিলিত হতেন না ঠিকই কিন্তু প্রতিদিন অন্তত দশজন নারীকে তৃপ্ত করতে পারতেন। এ ধরনের বিশেষ নারীর সঙ্গে মিলনের কারণে যৌনক্ষমতা বৃদ্ধি পেত। তাছাড়া ব্যাপারটা যদি সত্যি না হয় তবে মন্দিরগাত্রে ও ধরনের নারীর সঙ্গে সম্ভোগ দৃশ্য কেন আঁকতে যাবে প্রাচীন ভাস্করের দল; যদি তার কোনও ভিত্তি না থাকে? বাৎসায়ন নির্দেশিত কামশাস্ত্র অনুযায়ী ওই মন্দিরের বহিঃগাত্রের ভাস্কর্য রচনা করা হয়েছিল। নিশ্চয়ই এই মিথুনক্রীড়া যৌনাচারের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ব্যাপারটা পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে। আমার ধারণা আপনি হতাশ হবেন না।’
মহামন্ত্রী ভিক্ষচরের কথা শুনে বেশ খুশি হলেন শ্রীনগররাজ চক্রবর্মণ। তিনি এরপর হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে গিরিবর্ত্মে চক্রবর্মণের দৃষ্টিগোচর হল সেই শিবিকা। তাকে নিয়ে ওপরে উঠে আসছে বাহকের দল। দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বিশাল সেই শিবিকা। যেন আস্ত একটা গৃহকেই বহন করে আনছে বাহকরা। সে দৃশ্যের দিকে বেশ কিছুক্ষণ উল্লসিত ভাবে চেয়ে রইলেন রাজা। ওই শিবিকার মধ্যেই আছে সেই অভীষ্ট নারী। যার সঙ্গে মিলনের ফলে তিনি লাভ করবেন প্রতিদিন বহু নারীকে তৃপ্ত করার ক্ষমতা। অনন্ত পৌরুষের অধিকারী হবেন কাশ্মীর অধিপতি চক্রবর্মণ।
ক্রমশ নগরীর দিকে উঠে আসছে সেই শিবিকা। কামাতুর রাজা বেশ কিছুক্ষণ সে দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকার পর অবশেষে সম্বিত ফিরে পেয়ে ভিক্ষচরকে বললেন, ‘আপনি আর কালক্ষেপ করবেন না। শীঘ্র ওদের কাছে পৌঁছে শিবিকা নবনির্মিত হারেমের পথে নিয়ে যান। খেয়াল রাখবেন, আমি-আপনি আর হারেমের খোজা রক্ষী যারা নবাগত নারীর পরিচর্যা ও প্রহরার দায়িত্বে থাকবে তারা ছাড়া সে নারীর দর্শন যেন কেউ না পায়। অন্য কেউ যদি তার দর্শনলাভ করে তবে তৎক্ষণাৎ তার মৃত্যুদণ্ড হবে। এমনকী তাকে কেমন দেখতে সে ব্যাপারেও যেন হারেমের বাইরে কোনও খবর না পৌঁছয় সে ব্যাপারে আমি নির্দেশ দিয়ে রেখেছি খোজা প্রহরীদের। শুধু তাকে দর্শনই নয় তাকে নিয়ে কোনও আলোচনা হলেও মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। এই নবনির্মিত হারেমে কাকে স্থান দেওয়া হতে চলেছে তা জানতে আমার বৃহৎ হারেমের নারীরা অত্যন্ত আগ্রহী। তারা যেন এই নবাগতার ব্যাপারে কিছু জানতে না পারে। হারেমে আপনি সেই নবাগতা নারীকে পৌঁছে দিয়ে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য প্রাসাদে আসবেন। প্রতীক্ষায় রইলাম।’
ভিক্ষচর এবার একটু শঙ্কিত ভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘যদি নটী হংসী অথবা নটী সোমলতা কিছু জানতে চান? আপনি তো তাঁদের নির্দেশ পালন করার নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন আমাকে?’
নাম দুটো শুনেই হাসি ফুটে উঠল কাশ্মীররাজের ওষ্ঠে। তিনি বলে উঠলেন, ‘তারা দুজন আমার কাছে মহিষীর থেকেও প্রিয়। বিশেষত হংসীকে অদেয় কিছু আমার নেই। তবু তাদের কাছেও ব্যাপারটা নিয়ে মুখ খুলবেন না আপনি। তারা তো বুঝবে না যে তাদের তৃপ্ত করার জন্যই এ নারীর আগমন ঘটছে। ব্যাপারটা তারা সহজ ভাবে গ্রহণ করতে নাও পারে।’
ভিক্ষচর বললেন, ‘যথা আজ্ঞা মহারাজ।’ তারপর তিনি স্থানত্যাগ করলেন, সম্রাটের আদেশ পালনের জন্য।
২
বিশাল পালকি নিয়ে বেহারার দল নগরীতে প্রবেশ করতেই অশ্বারূঢ় ভিক্ষচর উপস্থিত হলেন তাদের সামনে। বেহারারা ছাড়া আরও একজন লোক আছে পালকির সমুখে। সুঠাম কৃষ্ণবর্ণের রুক্ষ চেহারা তার। শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমণ্ডল, মাথায় বিড়ে বাঁধা নোংরা পাগড়ি, পরনে ধূলিমলিন বিবর্ণ পোশাক, উন্মুক্ত পদযুগল। অলঙ্কার বলতে হাতে ও পায়ে মোটা মোটা মিশ্র ধাতুর বালা, আর ধাতুর কর্ণকুণ্ডল। স্পষ্টই লোকটাকে দেখে বোঝা যায় সে জঙ্গল অধ্যুষিত মধ্য ভারতের বন্য উপজাতির লোক। পালকি বেহারাদের চেহারাও অনেকটা একইরকম। এ লোকগুলোর অধিপতিই হলেন মহীতপ। ঘোড়া থেকে নেমে অগ্রবর্তী লোকটার উদ্দেশে মহামন্ত্রী ভিক্ষচর বললেন, ‘আমি তোমাদের নিয়ে যেতে এসেছি।’
অগ্রবর্তী লোকটা প্রশ্ন করল, ‘রাজপ্রাসাদে?’
মহামন্ত্রী জবাব দিলেন, ‘না, হারেমে।’
বিদেশি কথাটা শুনে ভ্রূ-কুঞ্চিত করে বললে, ‘অন্য রমণীদের সঙ্গে একই হারেমে রাখা হবে নাকি? এ নারী কিন্তু বরাবরই একলা থাকতেই অভ্যস্ত।’
ভিক্ষচর জবাব দিলেন, ‘না, অন্য নারীদের সঙ্গে তিনি থাকবেন না। তাঁর জন্য নতুন হারেম নির্মাণ করেছেন শ্রীনগরপতি। সেখানে একা থাকবেন এই নারী।’
জঙ্গলবাসী বলল, ‘চলুন, তবে সেখানে যাওয়া যাক।’
ঘোড়া থেকে নেমে লোকটাকে নিয়ে এগোলেন হারেমের দিকে। সে দিকে যেতে যেতে ভিক্ষচর লোকটাকে কৌতূহলবশত জিগ্যেস করলেন, ‘নবাগতা এই সুন্দরীর নাম কী?’
লোকটা জবাব দিল, ‘রম্ভা। স্বর্গের অপ্সরা রম্ভার মতোই অনন্ত যৌবনের প্রতীক এই নারী।’
বিদেশি লোকটা জানতে চাইল, ‘আপনাদের হারেম সুরক্ষিত তো?’
ভিক্ষচর বললেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই। বাগিচা সুরভিত শ্বেতমর্মর হারেমের চারপাশে আছে সুউচ্চ প্রাকারের বেষ্টনী। খোজা রক্ষীরা পাহারা দেয় সেই হারেম। নারী ছাড়া কোনো পুরুষের প্রবেশ নিষেধ সেখানে। রাজ-আজ্ঞা পেলে আমি বা প্রধান সেনাপতির মতো দু-একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী সেখানে প্রবেশের অনুমতি পাই। তাছাড়া হারেমে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি রাখেন না রাজারা। জানোই তো এদেশে বহু রাজাকে হত্যা করা হয়েছে, অথবা হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে হারেমের ভিতর। সে জন্য হারেমের সুরক্ষায় সর্বদা সজাগ থাকেন রাজারা।’
কথাটা শুনে বনচারী রাজা মহীতপের প্রতিনিধি বলল, ‘হারেমেও রাজহত্যা হয় নাকি?’
ভিক্ষচর বললেন, ‘হ্যাঁ, হয় তো, এ ঘটনার নজির এ দেশে বহু আছে। বিশেষত বিষ প্রয়োগে হত্যার ঘটনা। কাশীরাজকে খৈ-মুড়ির সঙ্গে বিষপ্রয়োগ করে হারেমের এক নারী হত্যা করেছিল। যাকে কাশীরাজ পত্নীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। রাজা রৈবন্তককে একজোড়া বিষ নূপুরের সাহায্যে হত্যা করেছিল হারেম নর্তকী। কামার্ত রৈবন্তক নর্তকীর পদচুম্বন করতে গিয়ে মারা যান। হারেম সুন্দরী তার গোপনাঙ্গে বিষ-পাথর লুকিয়ে রেখে হত্যা করে রাজা সৌবীরকে। রাজা করুষকে তাঁর পুত্র হত্যা করেছিল হারেমের ভিতর তার পিতা-মাতা সম্ভোগ চলাকালীন দর্পণের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে। বিদূরথকে এক কামিনী হত্যা করেছিল হারেমের ভিতর তার কেশগুচ্ছে ক্ষুদ্রাকৃতি তীক্ষ্ন কিরিচ লুকিয়ে রেখে। যে কারণে হারেমে নারীসঙ্গের সময় সবসময় সতর্ক থাকেন রাজা চক্রবর্মণ। ফুলের যে মালা পরে তিনি রতিক্রিয়া করেন সে মালা তিনি গলায় পরার আগে তাঁর চোখের সামনে স্পর্শ করানো হয় নগ্ন যুবতীদের দেহে। যাতে রাজা নিশ্চিত হতে পারেন যে ওই ফুলমালা কণ্ঠে ধারণ করলে বিষক্রিয়ার সম্ভাবনা নেই সে ব্যাপারে। একই কারণে অনেক সময় রাজ সম্ভোগের আগে নারীর যৌনাঙ্গ লেহন করানো হয় খোজা প্রহরীদের দ্বারা। বিশেষত তাদের ক্ষেত্রে এ কাজটা করা হয়, যাদের প্রথমবার হারেমে আনা হয় অথবা যাকে প্রথমবার সম্ভোগ করতে চলেছেন রাজা।’
লোকটা বলল, ‘শিবিকায় যাকে নিয়ে এলাম, তার ক্ষেত্রেও এ সব পরীক্ষা করা হবে নাকি?’
ভিক্ষচর বললেন, ‘হতেও পারে। যতটুকু জানি মহারাজ আজ রাতেই মিলিত হবেন এই নবাগতার সঙ্গে।’
লোকটা বলল, ‘তাতে অবশ্য আপত্তির কিছু নেই। এ যুবতী এ সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে।’
তার জবাব শুনে মহামন্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললেন, ‘এমন যদি হত তবে ভালোই হত। কেউ যদি চক্রবর্মণকে হত্যা করতে পারত তাহলে দেশটা অন্তত বেঁচে যেত ওই দুই কামার্ত ব্যভিচারিণী হংসী আর সোমলতার হাত থেকে। রাজমহিষী যশোবতীর দ্বাদশবর্ষীয় বালক পুত্র আছে। তাকে সিংহাসনে বসিয়ে রাজমাতা আর মন্ত্রীপরিষদ রাজ্য চালনা করতে পারতেন।’
শিবিকা নিয়ে ভিক্ষচর একসময় হারেমের প্রবেশ তোরণে পৌঁছে গেলেন। খড়গধারী আর ধনুর্ধর খোজারা ঘিরে রেখেছে প্রবেশ তোরণ। শিবিকা যে আসছে সে খবর তাদের কাছে আগেই পৌঁছে গেছিল। কাজেই তোরণ খুলে দেওয়া হল। খোজা প্রহরীরা সতর্কভাবে নিয়ে চলল, প্রাকারবেষ্টিত স্থাপত্যের কেন্দ্রস্থলের দিকে। বিরাট একটা মর্মর প্রাসাদ অবস্থান করছে বাগিচার কেন্দ্রস্থলে। আর তাকে ঘিরে আরও ছোট ছোট নানান গৃহ। ফোয়ারা আর ছোট ছোট জলাধার শোভিত সুরম্য বাগিচায় ঘুরে বেড়াচ্ছে মৃগ-ময়ূরের দল। নানান সুগন্ধী ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ। হারেম প্রাকারের ভিতর প্রবেশ করে সেই মধ্য ভারতীয় ব্যক্তি চারপাশে তাকিয়ে বিস্মিত ভাবে বলল, ‘এই এত বড় অট্টালিকা, আর সংলগ্ন এই সুরম্য বাগিচা—এ সবই কি রম্ভার জন্যই?’
ভিক্ষচর জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, এ সবই তাঁর জন্য নির্মিত। মূল অট্টালিকাতে থাকবেন পালকির ভিতরে থাকা যুবতী। আর বাগিচার নানান জায়গাতে মূল হারেম প্রাসাদকে ঘিরে যে সব গৃহ আছে সেখানে থাকবে মালিনী, চন্দনলেপিনী, ভূষণবাহিকা, পরিচ্ছদবাহিকা থেকে শুরু করে পাচিকা সহ দাসী-বাঁদির দল। যারা শ্রীনগরপতি ও নবাগতা যুবতী রম্ভার পরিচর্যায় নিয়োজিত থাকবে। পার্বত্য উপজাতির ধনুর্ধর কিছু নারীকেও শুনেছি নিয়োগ করা হতে চলেছে হারেমের অভ্যন্তরে। সম্ভবত আগামীকাল থেকেই তাদের নিয়োজিত করা হবে।’
বনচারী বলল, ‘এখানে উপস্থিত নারীর দল তো বাইরের পৃথিবীর কাছে ব্যক্ত করে দিতে পারে রম্ভার সৌন্দর্যের কথা? তাকে পাবার জন্য কোনও রাজা তো আক্রমণ করতে পারে এই রাজ্য?’
ভিক্ষচর জবাব দিলেন, ‘না, তার সম্ভাবনা নেই। ভোগ্যা নারী হোক বা দাসী, একবার হারেমে প্রবেশ করলে কেউ আর জীবন্ত বাইরে বেরোতে পারে না। দু-একজন নারীকে হয়তো মহানুভব শ্রীনগরাধীপ কোনও কোনও সময় মুক্তি দেন ঠিকই, কিন্তু মুক্তিদানের পূর্বে তাদের জিহ্বা কর্তন করা হয় যাতে তারা হারেমের খবর বাইরে প্রকাশ না করতে পারে।’
প্রাসাদের ভিতর প্রবেশ করল শিবিকা। ভিক্ষচর তাদের নিয়ে উপস্থিত হলেন সম্ভোগ মণ্ডপ সংলগ্ন ছাদঅলা এক প্রাঙ্গণে। পালকি নামাল বেহারারা। পালকির দরজা উন্মুক্ত করা হল। তার ভিতর উঁকি দিল খোজা রক্ষীরা। শিবিকার ভিতর এক কোণে হাঁটু মুড়ে সলজ্জ ভঙ্গিতে বসে আছে সেই নারী, রম্ভা। সামান্য বস্ত্রখণ্ডও নেই সেই যুবতীর দেহে। যৌবন যেন চুঁইয়ে পড়ছে তার অঙ্গ বেয়ে। পুরুষ্টু বুক, ক্ষীণ কটি আর মৃদঙ্গের মতো ভারী নিতম্বে অনন্ত সম্ভোগের হাতছানি। খোজা রক্ষীরাও অবাক হয়ে গেল তার সৌন্দর্য দেখে। ভিক্ষচর একবার শিবিকার দিকে দৃষ্টিপাত করে চোখ ফিরিয়ে নিলেন।
আবছা হাসি ফুটে উঠল সেই মধ্য ভারতীয়র ঠোঁটে। সে প্রশ্ন করল, ‘কেমন দেখলেন?’
ভিক্ষচর বললেন, ‘অতীব সুন্দরী ঠিকই। কিন্তু কোনও ধরনের নারীদেহের প্রতিই আকর্ষণ নেই আমার। আমি কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ। উপবীত ধারণ করার পর আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম যে আমি শুধু এই শ্রীনগর রাজ্যের হিতার্থেই মন দেব, অন্য কোনও কাজে মন দেব না। যে কারণে আমি নিজে দারপরিগ্রহ করিনি। পরনারী সম্ভোগ তো অনেক দূরের ব্যাপার।’
এ কথা বলার পর মহামন্ত্রী বললেন, ‘এবার আপনাকে ও আপনার লোকজনকে হারেম ত্যাগ করতে হবে। এখানে দ্বিতীয়বার প্রবেশানুমতি আর আপনারা পাবেন না। অতিথিশালায় আপনাদের থাকার ব্যবস্থা হবে। শ্রীনগর ত্যাগের আগে অবশ্য ভালো পারিতোষিক পাবেন আপনারা কর্তব্য সম্পাদনের জন্য। তাছাড়া চান্দেলরাজের জন্য শ্রীনগর নরেশের পক্ষ থেকে একটি মহার্ঘ শালও উপহারস্বরূপ নিয়ে যেতে হবে আপনাদের। এমনই রাজনির্দেশ।’
কথাটা শুনে মহীতপের প্রতিনিধি বলল, ‘কিন্তু আমাকে অন্তত আজকের রাতটা এই হারেমে থাকতে হবে। বেহারার দল না হয় অতিথিশালাতেই রইল। আমি না থাকলে রতিক্রিয়ার সেই বিশেষ পদ্ধতি সুচারুভাবে নাও বুঝতে পারেন রাজা। সমস্যা হতে পারে।’
কথাটা শুনে ভিক্ষচর বললেন, ‘কিন্তু এখানে থাকার জন্য রাজ-অনুমতি লাগবে। দেখি কাশ্মীর নরেশ কী বলেন?’ বেহারার দল আর তাদের সর্দারকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই হারেম প্রাকারের বাইরে এসে দাঁড়ালেন মহামন্ত্রী ভিক্ষচর। তারপর লোকগুলোকে নিয়ে তিনি রওনা হলেন অতিথিশালার দিকে। বেহারাদের সেখানে বিশ্রাম ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে সর্দার লোকটাকে নিয়ে তিনি রওনা হলেন রাজপ্রাসাদের দিকে।
৩
পাথর, ইষ্টক আর দারু নির্মিত শ্রীনগররাজের প্রাসাদ। বিশাল তার চৌহদ্দি। ফলফুলের বাগিচা, দ্রাক্ষাকুঞ্জ, প্রমোদ মণ্ডপ, অতিথিশালা, দেবদেউল, সৈনিক আবাস, পশুশালা কী নেই সেখানে। প্রচুর লোকজন চারদিকে। প্রাসাদ চত্বরটাকে শ্রীনগর নগরীর অভ্যন্তরে একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ নগরী বললেও অত্যুক্তি হয় না। মূল প্রাসাদে অবশ্য সাধারণের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হলেও মহামন্ত্রী বলে এ প্রাসাদে প্রবেশের কোনও বাধা নেই ভিক্ষচরের। শতাধিক কক্ষযুক্ত এই রাজপুরীর যে-কোনও জায়গাতেই প্রবেশাধিকার আছে মহামন্ত্রীর ও প্রধান সৈন্যাধ্যক্ষের। এমনকী রাজার শয়নকক্ষেও উপস্থিত হতে পারেন তাঁরা দুজন। সম্প্রতি অবশ্য আরও দুজন রাজনির্দেশে এ অধিকার পেয়েছে। সেই হংসী আর সোমলতা। ভিক্ষচর মৃদু সন্দিহান ছিলেন যে চক্রবর্মণ সত্যিই তাঁর জন্য এ প্রাসাদে অপেক্ষা করে আছেন, নাকি হংসীর আহ্বানে প্রাসাদ ত্যাগ করেছেন? আজকাল প্রায় সময়ই তো দিনের বেলা তিনি চলে যান হারেমে। আদিম রিপুর কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছেন শ্রীনগররাজ। দিন-রাতের পার্থক্য এখন তাঁর কাছে গৌণ। কামই তাঁর জীবনের সবকিছু। অন্য কোনও কীর্তি বা খ্যাতির অভিলাষী তিনি নন। মহারাজের প্রধান ভৃত্যের সঙ্গে প্রাসাদে প্রবেশ করার পর দেখা হয়ে গেল ভিক্ষচরের। খাস ভৃত্য জানাল যে মহারাজ অন্তঃপুরেই আছেন। স্নানাগারে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। অর্থাৎ প্রথম তলেই আছেন তিনি।
লোকটাকে নিয়ে বারমহল অতিক্রম করে ভিক্ষচর প্রথমে উপস্থিত হলেন শ্বেতপাথর বসানো একটা চকে। চকটাই বারমহল আর অন্দরমহলকে আলাদা করে রেখেছে। অন্দরমহলে সবাই প্রবেশ করতে পারে না। বিদেশিকে সেখানে দাঁড় করিয়ে অন্দরমহলে প্রবেশ করলেন ভিক্ষচর। স্নানাগার সংলগ্ন এক বিশাল কক্ষ আছে। যেখানে স্নানের পূর্বে রাজার দেহে সুগন্ধি তৈল মর্দন করা হয়। পরিচ্ছদ, আভূষণ সে কক্ষে পরিত্যাগ করে রাজা কক্ষ সংলগ্ন স্নানগৃহে যান।
ভিক্ষচর প্রবেশ করলেন সেই কক্ষে। দীপদানে বড় বড় ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। ঘরের ভিতর সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরী পরিচারিকারা। তাদের কারো হাতে রুপোর থালায় মখমলের আচ্ছাদনের ওপর রাখা সুগন্ধির পাত্র, কারো হাতে থালায় রাখা অলঙ্কার বা রেশমবস্ত্র অথবা নানা ধরনের উপাচার। কক্ষের ঠিক মাঝখানে একটা চন্দন কাঠের বেদির ওপর আধশোয়া অবস্থায় বসে আছেন রাজা। সম্পূর্ণ নিরাবরণ তাঁর দেহ। উন্মুক্ত বক্ষ তিনজন সুন্দরী দামি তৈল-সুগন্ধি মর্দন করছে তাঁর অঙ্গে। লজ্জাহীন রাজা। ভিক্ষচর কক্ষে উপস্থিত হয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে সোজা হয়ে বসলেন রাজা। তারপর ব্যগ্রভাবে জানতে চাইলেন, ‘কেমন দেখলেন তাকে?’
মহামন্ত্রী মাথা নীচু করে প্রথমে জবাব দিলেন, ‘অতীব সুন্দরী।’ তারপর বললেন, ‘এ ব্যাপারে একান্তে কিছু বলার ছিল।’
রাজ-নির্দেশে সুন্দরী নারীর দল কক্ষ থেকে প্রস্থান করল। ভিক্ষচর এবার ব্যক্ত করলেন শিবিকার সঙ্গে আসা লোকটার বক্তব্য।
কথাটা শুনে রাজা বললেন, ‘ব্যাপারটা যখন আবশ্যক তখন তো লোকটাকে সেখানে থাকতে দিতেই হয়। ঠিক আছে, আমি হারেমের দ্বাররক্ষী প্রধান খোজাকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিচ্ছি।’
শ্রীনগররাজ এরপর আবার ডেকে নিলেন দাসীদের। তারা আবার তৈল মর্দন শুরু করল। রাতের প্রস্তুতির জন্য এবার তাঁর বিশেষ এক অঙ্গ মর্দন শুরু করালেন উলঙ্গ রাজা।
কক্ষ ত্যাগ করলেন মহামন্ত্রী। অলিন্দ পেরিয়ে যখন তিনি প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হলেন ঠিক তখনই সেখানে এসে থামল এক শিবিকা। তার ভিতর থেকে যে নামল তাকে দেখেই অন্যদিকে বাঁক নিলেন ভিক্ষচর। কিন্তু সে দেখে ফেলেছে ভিক্ষচরকে। সে হাঁক দিল, ‘মহামন্ত্রী, কোথায় যাচ্ছেন? এদিকে আসুন।’
যদিও তার সঙ্গে কথা বলার প্রবৃত্তি নেই মহামন্ত্রীর, তবু এই মুহূর্তে তার ডাক অস্বীকার করার ক্ষমতা এ রাজ্যে বর্তমানে কারো নেই। কারণ, তার নাম হংসী।
ভিক্ষচর এগিয়ে গিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে একবার তার দিকে তাকিয়েই আবার চোখ নামিয়ে নিলেন। বলা ভালো যে চোখ নামিয়ে নিয়ে বাধ্য হলেন। সালঙ্কারা সেই নারীর বসন এতটাই স্বচ্ছ যে তার স্তনযুগল তো বটেই, স্তনবৃন্ত, নাভিকূপ, এমনকী নিম্ন উদরও দৃশ্যমান। বিধাতা তার শরীরে রূপ দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় যে তা অত্যন্ত কুটিল ছলাকলাপূর্ণ। পুরুষ, বিশেষত সে পুরুষ যদি কামুক হয় তবে তাকে প্রলুব্ধ করাই তার একমাত্র কাজ। তার স্বচ্ছ পোশাকের কারণও ওই একই।
হংসী তাঁর উদ্দেশে বলল, ‘আমার দিকে তাকাচ্ছেন না যে? আমাকে কি আপনার ভালো লাগে না?’
ভিক্ষচর এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, ‘কার্যোপলক্ষে আমাকে শীঘ্র অন্যত্র গমন করতে হবে।’
হংসী চটুল হেসে বলল, ‘নারীসঙ্গ করতে নাকি?’
জবাব দিলেন না মন্ত্রীবর।
হংসী এরপর প্রশ্ন করল, ‘শুনলাম মহারাজ নাকি ভিনদেশ থেকে এক নারীকে এনে নতুন হারেমে স্থান দিলেন? আপনার তত্ত্বাবধানে নাকি তাকে হারেমের অন্তঃপুরে রাখা হয়েছে?’
হংসীর অনেক চর আছে। তারাই নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে হংসীর কাছে খবরটা পৌঁছে দিয়েছে। অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই। কাজেই ভিক্ষচর জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ।’
হংসী বলল, ‘যার জন্য এত আয়োজন, এমনকী নতুন হারেম পর্যন্ত নির্মাণ করা হল, তাকে দেখতে কেমন? হংসিনী, পদ্মিনী নাকি হস্তিনী নারী সে? তার স্তনযুগল কি বিম্বের মতো বর্তুলাকার, নাকি শঙ্খের মতো উন্নত? কটিদেশ কি খর্জুরপত্রর মতো ভাঁজযুক্ত নাকি ক্ষীণ? যোনিদেশ কি…।’
আরও কিছু কদর্য বাক্য হয়তো তাঁকে শোনাতে উদ্যত হয়েছিলেন সেই কদর্য নারী কিন্তু তার আগেই ভিক্ষচর বললেন, ‘তাঁর সম্পর্কে কোনও তথ্যই আমি বলব না।’
হংসী বললেন, ‘বলবেন না কেন?’
ভিক্ষচর সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, ‘রাজ-নির্দেশ।’
ইতিপূর্বে হংসী নানাভাবে রাজার কাছে জানতে চেয়েছে যে নতুন হারেম কার জন্য নির্মিত হচ্ছে? সে নারী কে? কোথা থেকে তাকে আনা হচ্ছে? কিন্তু এই একটা মাত্র ব্যাপার যেখানে রাজা নিশ্চুপ থেকেছেন। আর এর ফলে একটা শঙ্কা জেগেছে হংসীর মনে। সে নারী কি, তবে হংসী বা সোমলতার থেকেও বেশি সুন্দরী? সে কি তাদের থেকেও বেশি ছলাকলা জানে? তার যৌনতায় রাজা আকৃষ্ট হয়ে যদি হংসীকে আর আগের মতো গুরুত্ব না দেন, যদি খর্ব করেন হংসীর ক্ষমতা, তখন? এমন তো ঘটতেই পারে।
ভিক্ষচরের কথা শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল হংসীর। সে বলল, ‘আপনি তবে বলবেন না? মনে আছে তো আমার আদেশ পালন না করায় কীভাবে অপমান করেছিলাম মন্ত্রী শল্ককে? রজস্রাবের বস্ত্র উপহার দিয়েছিলাম তাকে।’
কথাটা কানে যেতেই মহামন্ত্রী ভিক্ষচরের মনে হল সে তরবারি কোষমুক্ত করে এখনই এই পাপিষ্ঠার মুণ্ডচ্ছেদ করবেন। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল নয়। কোনও দিন সুযোগ এলে নিশ্চয়ই তিনি কাজটা করবেন এই ভেবে নিয়ে ক্রোধ দমন করে ভিক্ষচর জবাব দিলেন, ‘বললাম তো, রাজ-আদেশ অমান্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
হংসী সাপের মতো হিসহিস করে বলে উঠল, ‘শোনো মহামন্ত্রী। যে নারী যত অপরূপাই হোক না কেন, আমার জায়গা আমি কাউকে নিতে দেব না। তার জন্য আমি যা ব্যবস্থা করার তাই করব। আর এদিকটা সামলে ওঠার পর তোমারও যথাযথ ব্যবস্থা আমি করব।’
হিংস্রভাবে কথাগুলোর পর খিলখিল করে হেসে সেই পাপিষ্ঠা বলল, ‘শুনেছি তুমি সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। ফলাহার করো, যৌনাচার করো না, এমনকী যৌন দৃশ্যও দেখা পাপ মনে করো। তবে আজ রাতে যাতে তুমি সে দৃশ্য দেখতে বাধ্য হও সে ব্যবস্থা আমি করছি। আমি রাজাকে বলব যে আমি স্বপ্নাদেশ পেয়েছি আজ পূর্ণিমা তিথিতে মহামন্ত্রী যদি রাজার যৌনাচার প্রত্যক্ষ না করেন তবে কামশক্তি রহিত হবে মহারাজের। তুমি তো জানো এসব স্বপ্নাদেশ ইত্যাদিতে প্রচণ্ড বিশ্বাস রাখেন শ্রীনগর নরেশ। নিশ্চয়ই তিনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন। বিশেষত যখন এই স্বপ্নাদেশ যৌনাচারের সঙ্গে জড়িত। কামদেবের নির্দেশ তিনি অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। তখন চোখের সামনে যা ঘটবে তা আগামীকাল প্রত্যুষে আমাকে অবগত করবে তুমি। এটা আমার নির্দেশ।’—এই বলে সেই খল রমণী হাসতে হাসতে এগোল অন্দরমহলের দিকে।
লজ্জায়, অপমানে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে মহামন্ত্রী ভিক্ষচর ভাবতে লাগলেন, ‘আর কত অপমান সহ্য করতে হবে আমাকে? এই পাপিষ্ঠাদের হাত থেকে মুক্তি নেই এ রাজ্যের?’
আর এর পরই মহামন্ত্রীর সামনে এসে দাঁড়াল তাঁর সঙ্গে আসা লোকটা। সে প্রশ্ন করল, ‘এই লজ্জাহীনা নারী কে? রাজমহিষী নাকি?’
মহামন্ত্রী জবাব দিলেন, ‘না, না, এ নারী রানিমা নন। রানিমা অত্যন্ত বিদুষী ও লজ্জাশীলা। তিনি অন্তঃপুরের বাইরে আসে না। স্বামী আর সন্তান ব্যতীত অন্য কোনও পুরুষকে দর্শন দেন না। আমরা চিকের আড়াল থেকে তাঁর কণ্ঠস্বর শুনি মাত্র। যে নারীকে দেখলে তার নাম হংসী। হারেমের এক নীচ প্রকৃতির নারী।’
ভিক্ষচরের কথা শুনে লোকটা বিস্মিত ভাবে বলল, ‘হারেমের নারী! আপনি তো এ রাজ্যের মহামন্ত্রী তাই না? তবে সামান্য এক হারেমবনিতা আপনাকে এমন অপমান করার সাহস পায় কীভাবে? আমাদের দেশে তো একমাত্র রাজা ছাড়া অন্য কেউ মহামন্ত্রী বা প্রধান সৈন্যাধক্ষের মুখের ওপর কথাই বলতে পারে না। এমনকী রাজমহিষীও নন।’
ভিক্ষচর এবার বুঝতে পারলেন যে, হংসীকে শুধু দর্শনই নয়, তার কথাবার্তাও প্রত্যক্ষ করেছে এই আগন্তুক। অপমানের জ্বালাটা এবার তীব্র হয়ে উঠল মহামন্ত্রীর মনে। এই বিদেশি নিশ্চয়ই তার দেশে ফিরে গিয়ে জানাবে যে শ্রীনগর রাজ্যের মহামন্ত্রীর কোনও সম্মান নেই। হারেমের গণিকারাও তাঁকে প্রকাশ্য অপমানের স্পর্ধা রাখে। তাই বিদেশির প্রশ্ন শুনে নিজের মনের ক্ষোভ এবার আর চেপে রাখতে পারলেন না ভিক্ষচর। তিনি বলে উঠলেন, ‘কামুক রাজা চক্রবর্মণ আত্মসমর্পণ করেছেন এই নীচ নারীর দেহ আর ছলাকলার কাছে। আরও একজন আছে, তার নাম সোমলতা। এই দুই ডোমরি নারীই এখন এ রাজ্যের সব কিছু পরিচালনা করে। বিশেষত এই হংসী। তার নির্দেশেই এখন রাজ-নির্দেশের সমতুল্য। সারা দেশে অন্ধকার নেমে এসেছে। ভয়ংকর জীবনযাপন করছে নাগরিকরা।’
লোকটা শুনে বলল, ‘যে দেশে মহামন্ত্রীর এমন অবস্থা সেখানে দেশের বা সাধারণ নাগরিকদের জীবন যে দুর্বিষহ তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এর প্রতিবাদে বিদ্রোহ হয় না? নতুন কেউ সিংহাসন দখল করে না কেন?’
কথাটা শুনে মহামন্ত্রী বললেন, ‘রাজাহত্যা না করে সিংহাসন দখল সম্ভব নয়। কিন্তু রাজা যত অন্যায়ই করুন না কেন রাজার হত্যাকারীকে কেউ মেনে নেবে না এ রাজ্যে। রাজহত্যা আমাদের রাজ্যের রীতিবিরোধী। এক যদি রাজা কোনও অসুখে বা দুর্ঘটনায় মারা যান তবে হয়তো বেঁচে যেতে পারে এ রাজ্য।’
বিদেশির কাছে কথাগুলো ক্ষোভে তিনি বলে ফেললেন ঠিকই, কিন্তু এরপরই তিনি নিজেকে সংযত করে নিলেন। এ প্রসঙ্গে আর কোনও কথা না বলে লোকটাকে নিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করলেন ভিক্ষচর। তারপর তাকে নতুন হারেমের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে নিজের গৃহে ফিরে এলেন।
স্বপাক আহার গ্রহণ করেন ভিক্ষচর। তিনি রন্ধনের উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। এমন সময় অশ্বখুরের শব্দ এসে থামল তাঁর দরজাতে। মহামন্ত্রী কক্ষের বাইরে বেরিয়ে দেখতে পেলেন এক পরিচিত বার্তাবহককে। লোকটা ঘোড়া থেকে নেমে মাথা ঝুঁকিয়ে মহামন্ত্রীকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘মহারাজ আপনাকে আজ সূর্যাস্তের পর নতুন হারেমে উপস্থিত থাকতে বলেছেন।’
সংক্ষিপ্ত বার্তা দিয়ে প্রস্থান করল লোকটা। মহামন্ত্রী বুঝতে পারলেন সেই নীচ নারী হংসীর মিথ্যা ভাষণে প্রভাবিত হয়েছেন মহারাজ।
৪
বার্তাবাহক চলে যাবার পর বেশ কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইলেন ভিক্ষচর। তারপর পুনরায় কক্ষে প্রবেশ করলেন। তবে রন্ধন বা আহার করার প্রবৃত্তি আর তাঁর রইল না। লজ্জায়, অপমানে, ক্রোধে তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। বংশপরম্পরায় তাঁরা এই শ্রীনগর রাজ্যের মন্ত্রী বা মহামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ভিক্ষচরের কয়েকজন পূর্বপুরুষ কখনও রাজার জীবনরক্ষায় অথবা দেশরক্ষার্থে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আর ভিক্ষচরও তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে শ্রীনগর রাজ্যের হিতার্থে দীর্ঘদিন ধরে কর্তব্য পালন করে আসছেন। তিনি দারপরিগ্রহণও করেননি এই জন্য যে, সংসার প্রতিপালনে যে সময় ব্যয় হয় তা তিনি রাজ্যের মঙ্গল সাধনায় ব্যয় করতে চেয়েছিলেন। তাছাড়া স্ত্রী-সন্তানের জন্য পিছুটান থাকলে অনেক সময় দেশের জন্য আত্মবলিদান সম্ভব হয় না। কোনওদিন নারীসঙ্গ করেননি পাছে নারীদেহের প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে নিজ ভাবনা ও কর্তব্যচ্যুত হন। আর তাঁকেই কিনা হারেম গণিকার জঘন্য নির্দেশ মেনে চলতে হবে? রাজার রমণ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে হবে এক নীচ নারীকে? ভিক্ষচর ভাবতে লাগলেন, ‘আমি কী পাপ করেছি যার জন্য বিধাতাপুরুষ এই নিষ্ঠুর পরিহাস করছেন আমার সঙ্গে?’
সময় এগিয়ে চলল। ভিক্ষচর যখন সেই বিদেশি বনচারীকে হারেমে পৌঁছে দিয়ে গৃহে ফিরেছিলেন তখন দ্বিপ্রহর। তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকাল হল, সূর্যও একসময় ঢলতে শুরু করল পাহাড়ের আড়ালে। আলো কমে আসতে লাগল ভিক্ষচরের কক্ষে। সময় এগিয়ে আসছে। একসময় ভিক্ষচর প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন যে, না, তিনি সেই অনাচারের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করবেন না। তাতে যা হয় হবে। দরকার হলে আজ গভীর রাত্রেই তিনি শ্রীনগর রাজ্য ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবেন। কক্ষে প্রদীপ জ্বাললেন না মহামন্ত্রী। অন্ধকার কক্ষে বসে তিনি নিজের আর এ রাজ্যের দুর্দশার কথা ভাবতে লাগলেন।
উপত্যকা কিছুক্ষণের জন্য ঢেকে গেল নিকষ কালো অন্ধকারে। তারপর ভিক্ষচর একসময় খেয়াল করলেন ঘরের অন্ধকার যেন মৃদু ফিকে হয়ে আসছে। উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তিনি দেখতে পেলেন, পাহাড়ের মাথার ওপর চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। পূর্ণিমার চাঁদ। ঠিক এই সময় একদল অশ্বারোহী ভিক্ষচরের দরজায় উপস্থিত হল। ভিক্ষচর কক্ষ থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখতে পেলেন প্রধান সেনাপতি ভালুক একদল সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি ভিক্ষচরকে দেখে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, ‘মহারাজ হারেমে পৌঁছে গেছেন। আপনাকে সেখানে না দেখতে পেয়ে আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আপনাকে সেখানে নিয়ে যাবার জন্য। মহারাজ যে হারেমে আপনাকে উপস্থিত থাকতে বলেছিলেন সে সংবাদ কি আপনি পাননি?’
মহামন্ত্রী বললেন, ‘সংবাদ যথাসময় পেয়েছি। কিন্তু আমি যদি সেখানে না যাই তবে কী করবেন?’
প্রশ্ন শুনে একটু ইতস্তত করে প্রধান সেনাধ্যক্ষ ভালুক বললেন, ‘রাজ-নির্দেশ অমান্য কীভাবে করি বলুন? আমি, আপনি সবাই তো তাঁর নির্দেশ মানতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে আমাদের আপনাকে রজ্জুবদ্ধ অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে সেখানে।’
ভালুকের কথা শুনেও একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন মহামন্ত্রী ভিক্ষচর।
ভালুক তাঁর সেনাদের তফাতে রেখে ঘোড়া থেকে নেমে ভিক্ষচরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ভিক্ষচর বিষণ্ণ হেসে বললেন, ‘এবার আমাকে রজ্জুবদ্ধ করবেন তো? করুন। তবে আমি আপনাকে বলি যে কেন আমাকে রাজা হারেমে উপস্থিত হতে বলেছেন। আমাকে তাঁর যৌন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে হবে এবং তার বিবরণ দিতে হবে হংসীকে। সেই পাপিষ্ঠার প্ররোচনাতেই মহারাজ সেই জঘন্য দৃশ্য প্রত্যক্ষ করাতে চাইছেন।’
তাঁর কথা শুনে প্রধান সেনাধ্যক্ষ একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘ব্যাপারটা যে এ ধরনের কিছু তা আমিও অনুমান করেছিলাম।’ তারপর গলা নামিয়ে বললেন, ‘ওই পাপিষ্ঠার দ্বারা আমরা কেউই কম অপমানিত হইনি। আমাকে ঘোড়ার পিঠে তার পাদুকা বহন করতে হয়েছে। অপমানবোধ আমারও কম নেই। কিন্তু আমি সুযোগের প্রত্যাশাতে আছি। আপনি প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ। একবার শুধু ভেবে দেখুন। কোনওদিন সে সুযোগ উপস্থিত হতে পারে। তখন আপনার মতো বিচক্ষণ, এ রাজ্যের জন্য নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তিকেই আমাদের অভিভাবক হিসাবে প্রয়োজন হবে এ রাজ্যে শান্তির পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য। দোহাই আপনার, ক্রোধের বশে এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না যার জন্য সে সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হই। আপনার মৃত্যুদণ্ড হলে বা আপনি কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলে শয়তানী হংসীর ক্ষমতা আরও বাড়বে। ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে শ্রীনগর রাজ্যে। নরককুণ্ডে পরিণত হবে এ রাজ্য।’
মহামন্ত্রী বললেন, ‘এ রাজ্যে অন্ধকার কি কোনওদিন সত্যি কাটবে? আমাকে কি আর প্রয়োজন হবে?’
ভালুক বললেন, ‘কে বলতে পারে প্রয়োজন হবে না? রাজপুত্র এখনও সিংহাসন সামলানোর পক্ষে অনুপযুক্ত। সে সিংহাসনে বসলেও এই রাজ্যের দায়িত্ব আপনাকেই সামলাতে হবে। আমি আর আমার সেনাদল আপনার পাশে থেকে এ রাজ্য থেকে অন্যায় ব্যভিচার উৎখাত করব। কে বলতে পারে তেমন দিন আসবে না। একটু আগেই তো চারপাশে অন্ধকার ছিল, আর এখন কেমন সুন্দর চাঁদের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ছোট্ট একটা ঘটনার প্রতীক্ষা তো মাত্র। রাজা যেমন ব্যভিচারী, উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করছেন তাতে যে-কোনওদিন তিনি প্রাণঘাতী ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন। ইতিমধ্যেই তাঁর মুখমণ্ডল, চেহারা যে বিপর্যস্ত হতে শুরু করেছে তা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন? প্রাসাদে অগ্নিকাণ্ড হতে পারে, বজ্রপাত হতে পারে, ঘোড়া পাগল হয়ে তাঁকে নিয়ে খাদে ঝাঁপ দিতে পারে, আরও কতরকম দুর্ঘটনার সম্ভাবনা তো থেকেই যায়। এমনকী আর কিছুদিন পর হয়তো রাজপুত্র সাবালক হয়ে পিতার অন্যায়ের প্রতিকার করলেন। সে দিনের জন্য আমরা কি অপেক্ষা করব না? সেদিন আমরাই যদি না থাকি তবে এ রাজ্যের কী হবে? আমরা কি শুধু বর্তমান নিয়েই ভাবব? ভবিষ্যতের প্রতি কি আমাদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই?’
সেনাধ্যক্ষ ভালুকের বলা কথাগুলো, বিশেষত শেষ কথাটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেন ভিক্ষচর। হ্যাঁ, ভবিষ্যতের প্রতিও তো তাঁর দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। এই শেষ ব্যাপারটাই তাঁর মত পরিবর্তন ঘটাল। ভিক্ষচর বললেন, ‘ঠিক আছে, চলুন তবে।’
ভালুক হেসে বললেন, ‘আমি আপনাকে কথা দিলাম, যদি তেমন কোনও মুহূর্ত উপস্থিত হয় তবে সর্বতভাবে আমি আপনার পাশে থাকব।’
ভিক্ষচর এরপর ভালুক আর তাঁর সেনাদলের সঙ্গে চাঁদের আলোতে রওনা হয়ে গেলেন হারেমের দিকে।
একসময় সেখানে পৌঁছে গেলেন তাঁরা। পূর্ণিমার চাঁদ এখন মাথার ওপর উঠে গেছে। হারেমের প্রবেশ তোরণ মশালের আলোতে আলোকিত। খোজা দ্বাররক্ষীরা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। মহারাজের একদল দেহরক্ষীও স্বর্ণ শিবিকা নিয়ে তোরণের একপাশে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ হারমে প্রাকারের অন্তরালে রয়েছেন রাজা চক্রবর্মণ। সেনাপতি ভালুক মহামন্ত্রী ভিক্ষচরকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেও হারেম প্রাকারের অভ্যন্তরে প্রবেশাধিকার তাঁরও নেই। হারেমের তোরণে তাঁরা দুজন ঘোড়া থেকে নামার পর ভালুক বললেন, ‘আমি এখানেই রইলাম। মধ্যরাত বা প্রত্যুষ যাই হোক না কেন, আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। একত্রে ফেরা যাবে।’
ভিক্ষচর জবাব দিলেন, ‘ধন্যবাদ। তাই হবে।’
ভিক্ষচর তোরণের সামনে পৌঁছতেই তাঁকে দেখে তোরণ উন্মুক্ত হয়ে গেল। ভিতরে প্রবেশ করলেন তিনি। তারপর কয়েকজন খোজা তাঁকে নিয়ে চলল নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। সে লোকগুলো ভিক্ষচরকে কিছু না বললেও তাদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে ভিক্ষচরের মনে হল তারা যেন বেশ আমোদ পাচ্ছে এ স্থানে ভিক্ষচরের উপস্থিতির কারণে। এ রাজ্যের অন্য আরও অনেকের মতো এ লোকগুলোও সম্ভবত জানে যে মহামন্ত্রী সারা জীবন নারীসঙ্গ করেননি। সন্ন্যাসীই বলা যায় মহামন্ত্রীকে। আর তিনিই কিনা আজ হারেমে এসে উপস্থিত হয়েছেন যৌন দৃশ্য দেখার জন্য।
থরে থরে গোলাপ ফুটে আছে বাগিচাতে। তার সুবাসে মাতোয়ারা বাতাস। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। তার আলো যেন চুঁইয়ে পড়ছে উপত্যকায়, পর্বতশৃঙ্গ বেয়ে। এত সুন্দর পূর্ণিমার চাঁদ এর আগে কোনওদিন দেখেননি মহামন্ত্রী। মনে মনে তিনি বললেন, ‘কী সুন্দর এই প্রকৃতি! কী সুন্দর এই দেশ! কিন্তু এর আড়ালে সামনের ওই বিশাল মহলের অন্তঃপুরে কী কদর্য ঘটনা ঘটে চলেছে কে জানে?’
খোজাদের সঙ্গে হারেমে প্রবেশ করলেন ভিক্ষচর। বেশ কয়েকটা মহল, প্রাঙ্গণ অতিক্রম করে অবশেষে তিনি উপস্থিত হলেন স্বর্ণখচিত সেই সম্ভোগ মণ্ডপের সামনে। তার চারপাশ বর্তমানে রেশমের পর্দা দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। তার ভিতরে অন্য কিছু বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও উজ্জ্বল প্রদীপের অবস্থান স্পষ্ট। মৃদু একটা শব্দও যেন ভেসে আসছে আচ্ছাদনের ওপাশ থেকে। পর্দার সমানে এসে দাঁড়ালেন ভিক্ষচর। ভিতরে ঢোকার আগে তিনি মুহূর্তের জন্য হয়তো ইতস্তত বোধ করছিলেন। কিন্তু তাঁকে আর কোনও চিন্তার অবকাশ না দিয়ে একজন খোজা পিছন থেকে ধাক্কা দিল। পর্দার গায়ে একটা ফাঁক গলে মণ্ডপের ভিতর প্রবেশ করলেন ভিক্ষচর।
মণ্ডপের ভিতর প্রদীপদানে বেশ কয়েকটা বড় বড় ঘৃতের প্রদীপ জ্বলছে। তার আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে মণ্ডপের স্বর্ণখচিত স্তম্ভে, ছাদে। ঝলমল করছে চারপাশ। মণ্ডপের ঠিক কেন্দ্রস্থলেই অনুচ্চ রমণবেদি। মহামন্ত্রী ভিক্ষচর সেখানেই দেখতে পেলেন সেই নারী ও রাজা চক্রবর্ণমকে। দুজনের দেহই সম্পূর্ণ নিরাবরণ, একটা সুতোও কারও গায়ে নেই। মিথুনবেদিতে দণ্ডায়মান দুজনেই। সামনে নারী, পিছনে উলঙ্গ রাজা। যুবতীর নিতম্ব আঁকড়ে ধরে পশ্চাৎভাগে মিথুনরত রাজা চক্রবর্মণ। যৌন উত্তেজনাতে নারী-পুরুষ দুজনেই কাঁপছে। সুন্দর দৃশ্যের মতো কুৎসিত দৃশ্যেরও নাকি মানুষকে মোহাবিষ্ট করার ক্ষমতা থাকে। তাই হয়তো বা ভিক্ষচর সে দৃশ্য থেকে চোখ সরাতে গিয়েও পারলেন না। তিনি চেয়ে রইলেন সেই সঙ্গম দৃশ্যের দিকে।
উলঙ্গ রাজার অবশ্য কোনও হুঁশ নেই, তিনি রমণক্রিয়ায় ব্যস্ত। বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়েছে তাঁর। কাম তাঁর সব সত্তাকে গ্রাস করেছে। ভিক্ষচরও যেন অনেকটা বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়েই দেখতে লাগলেন সেই দৃশ্য। ক্রমশ যৌন উত্তেজনায় যেন শরীরের কম্পন বেড়েই চলেছে তাদের। এমন রমণদৃশ্য এর আগে কেউ প্রত্যক্ষ করেছেন কিনা তা জানা নেই মহামন্ত্রী ভিক্ষচরের। তাঁর মনে হতে লাগল অনন্তকাল ধরে যেন এই মিথুন দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে চলেছেন তিনি। এ দৃশ্যের কোনও শুরু নেই, শেষ নেই।
কিন্তু এ দৃশ্যেরও পরিসমাপ্তি ঘটল এক সময়। এবং তা অদ্ভুত ভাবেই। হঠাৎই যেন উত্তেজনার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে প্রচণ্ড কেঁপে উঠল সঙ্গমরত সেই নারী-পুরুষ দুজনের শরীরই। আর তারপরই রাজা চক্রবর্মণের দেহটা প্রচণ্ড গতিতে শূন্যে নিক্ষিপ্ত হয়ে আছড়ে পড়ল একটা স্তম্ভের গায়ে!
মহামন্ত্রী ভিক্ষচরের সম্বিত ফিরতে কিছুটা সময় লাগল। তারপরই তিনি ছুটে গেলেন মাটিতে পড়ে থাকা রাজার কাছে। তখন আর প্রাণ নেই শ্রীনগর নরেশ চক্রবর্মণের শরীরে। স্তম্ভের গায়ে আছড়ে পড়ার সময় সংঘর্ষে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে তাঁর মাথা। মস্তিষ্ক ছড়িয়ে আছে চারপাশে রক্তের স্রোত বইছে। দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে কাশ্মীর নরেশ চক্রবর্মণের। ভিক্ষচর তাকিয়ে রইলেন সেই ভয়ংকর দৃশ্যের দিকে।
মহামন্ত্রীর হুঁশ ফিরল একটা কণ্ঠস্বর শুনে—’স্তম্ভে আঘাত না লাগলেও মৃত্যু ঘটত রাজার। কারণ তাঁর বক্ষপিঞ্জর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে না হলেও রাত্রি শেষে সূর্যোদয়ের পূর্বেই মৃত্যু হত তাঁর। অথবা খুব বেশি হলে আর একটা দিন মাত্র তিনি জীবিত থাকতেন।’
কথাটা শুনে মহামন্ত্রী ভিক্ষচর তাকিয়ে দেখলেন, তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেই বিদেশি। তার ঠোঁটের কোণে জেগে আছে আবছা হাসির রেশ!
মহামন্ত্রী ভিক্ষচর তাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি জানতেন যে এই দুর্ঘটনা ঘটবে?’
শিবিকার সঙ্গে আসা সেই লোকটা জবাব দিল, ‘সম্ভবত।’
ভিক্ষচর জিগ্যেস করলেন, ‘তবে, আপনার দেশের প্রাচীন মন্দিরগাত্রে খোদিত যে চিত্র আমরা দেখেছিলাম তা কি মিথ্যা ছিল? তার মধ্যে কি লুকিয়ে ছিল মৃত্যুর ইঙ্গিত? সে চিত্র কি তবে মিথ্যা ছিল?’
লোকটা জবাব দিল, ‘না, ঠিক তা নয়। তবে শিল্পী শুধু সেই মিথুন দৃশ্যই খোদিত করেছিলেন মন্দিরে। সতর্কবার্তা সেই চিত্রে খোদিত ছিল না। তবে আমি তা জানতাম। এ নারী যখন যৌন আনন্দের চূড়ান্ত মুহূর্তে পৌঁছয় তখন উত্তেজনায় পদাঘাত করে। আপনাদের রাজাকে তার সঙ্গে সঙ্গম প্রক্রিয়া দেখিয়ে দিলেও এই শেষ কথাটা তাঁকে জানাইনি আমি। জানাইনি যে চূড়ান্ত উত্তেজনার পূর্বমুহূর্তে এই নারীর কাছ থেকে দূরে সরে আসতে হয়। কারণ এ নারী চূড়ান্ত উত্তেজিত হলে পাদঘাত করে।’
মহামন্ত্রী ভিক্ষচর জানতে চাইলেন, ‘তবে সে কথা আপনি রাজাকে জানাননি কেন?’
ভিক্ষচরের কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত তাঁর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সেই বিদেশি জবাব দিল, ‘জানাইনি, কারণ, আমি এটা চেয়েছিলাম। শ্রীনগর নরেশকে অতিথি হিসাবে বিশ্বাস করে অতিথিরূপে বরণ করেছিলাম আমি। কিন্তু তিনি তার মর্যাদা রক্ষা করেননি। গভীর রাতে পুষ্পচয়নরত রাজ-মহিষীকে একলা পেয়ে কামুক নৃপতি তাঁকে ধর্ষণ করেন। মহিষীর সেই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই আমি এখানে ছুটে এসেছিলাম। মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে আমার। আজ রাতেই আমি সঙ্গীদের নিয়ে নিজের দেশে ফেরার জন্য যাত্রারম্ভ করব।’
বিস্মিত ভিক্ষচর এবার জানতে চাইলেন, ‘আপনার পরিচয় কী?’
সেই বিদেশি জবাব দিল, ‘আমি চান্দেলরাজ মহীতপ।’
হতভম্ভ ভিক্ষচর বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন তাঁর দিকে।
চান্দেলরাজ মহীতপ এরপর মৃদু হেসে বললেন, ‘যে কেউ মানবেন এটা হত্যা নয় দুর্ঘটনা। এমনই কোনও দুর্ঘটনার প্রতীক্ষাতে তো আপনারাও ছিলেন। শ্রীনগরনরেশ মৃত। আপনি এখন তাঁর অবর্তমানে এই রাজ্যের অভিভাবক। আজ রাত থেকেই নিজের কার্য সম্পাদন করুন।’
কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে বুঝতে পেরে খোজা প্রহরীরা এরপর প্রবেশ করল মণ্ডপে। রাজার মৃতদেহ দেখে ব্যাপারটা যে হত্যা নয়, দুর্ঘটনা সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হল তারা। মহামন্ত্রী ভিক্ষচরই রাজার অবর্তমানে তাদের মালিক। চান্দেলরাজকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই হারেম প্রাকারের বাইরে বেরিয়ে এলেন ভিক্ষচর। চান্দেলরাজ বিদায় নিলেন ভিক্ষচরের কাছ থেকে। বহু দূর দেশে তাঁকে ফিরতে হবে। তিনি চাঁদের আলোতে মিলিয়ে যাবার পর ভিক্ষচর সেনাপতি ভালুককে নিয়ে ছুটলেন তাঁর প্রথম কর্তব্য সম্পাদনের জন্য, হংসী আর সোমলতাকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে হবে।
মহা সমারোহে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন হল শ্রীনগররাজ চক্রবর্মণের। তাঁর নাবালক পুত্রকে বসানো হল সিংহাসনে। তাকে সামনে রেখে মহামন্ত্রী ভিক্ষচরের নেতৃত্বে আবার শান্তি প্রতিষ্ঠিত হল শ্রীনগর রাজ্যে। সেদিন রাতে নতুন হারেমের অভ্যন্তরে পূর্ব পরিকল্পিত যে ঘটনা সংঘঠিত হয়েছিল তার সম্বন্ধে জানল না বাইরের পৃথিবীর কেউ।
রাজদরবারে নানা লোক নানা কাজে আসে। তেমনই একবার একটা লোক এসেছিল। পেশায় শিকারি সে লোকটা পার্বত্য উপত্যকায় শিকারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। কী একটা কথা প্রসঙ্গে সে একবার ভিক্ষচরকে গল্প করেছিল যে নির্জন পাহাড়ি উপত্যকায় চাঁদের আলোতে সে নাকি একটা বিরাট ঘোড়াকে একলা ঘুরে বেড়াতে দেখেছিল। জ্যোৎস্না নাকি চুঁইয়ে পড়েছিল তার সাদা অঙ্গ বেয়ে। থুড়ি সে ঘোড়া নয়, ঘোটকী।