যারা ভোর এনেছিল – ৩০

৩০.

আইএ পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। একটা ছেলে সলিমুল্লাহ কলেজ থেকে স্ট্যান্ড করেছে। ফোর্থ স্ট্যান্ড। তবে ছেলেটা পরীক্ষা দিয়েছে প্রাইভেটে। হোক প্রাইভেটে। তবু তো আমার কলেজ। কলেজের অধ্যক্ষ খুশিতে আটখানা। তিনি হাঁক পাড়লেন, ‘এই, কে আছো, এই ছেলেকে খুঁজে বের করো। তাজউদ্দীন আহমদ।’

কলেজের ক্লার্ক তাকে চিনতেন। যেদিন সে ফরম ফিলআপ করতে আসে, সেদিনও তার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল। তারা দুজনে হেঁটে হেঁটে জেলগেট পর্যন্ত গিয়েছিলেন।

ক্লার্ক সাহেব পিয়নকে বোঝালেন। ‘যাও, একে খুঁজে বের করা কোনো কঠিন কাজ না। ১৫০ মোগলটুলীতে মুসলিম লীগ অফিসে গেলেই তাকে পাওয়া যাবে। বিখ্যাত ছেলে। কায়েদে আজমের সঙ্গে মিটিং করে। খাজার সঙ্গে তো করেই। তবে আসলে ছেলে সরকারবিরোধী। ওই লীগ অফিসে গেলেই তার ঠিকানা পাওয়া যাবে।’

লীগ অফিসে গেল পিয়ন ওয়াহিদ। সাইকেল চালিয়ে। তাজউদ্দীন তখন সেখানে ছিলেন না। মেসের ঠিকানাও পাওয়া গেল।

পিয়ন তাঁর মেসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

তাজউদ্দীন এলেন বেশ রাতে। তখন ভয়ানক বৃষ্টি হচ্ছে। সাইকেলে এলেন তিনি, বৃষ্টিতে ভিজে সমস্ত শরীর থেকে পানি ঝরছে। বাড়ির বারান্দায় একজন লোক দাঁড়িয়ে। বিদ্যুৎ চমকালে তাঁকে দেখা গেল।

তাজউদ্দীন বললেন, ‘আপনি কী করছেন এখানে?’

লোকটা বলল, ‘আমি, আমি একজনকে খুঁজতে এসেছি।’

‘কাকে?’

‘তাজউদ্দীন।’

‘কেন খুঁজতে এসেছেন?’ তাজউদ্দীন আগে জানতে চান পরিস্থিতি। ইদানীং তাঁদের নামে ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। পুলিশের লোক, নাকি গুপ্তচর?

লোকটি বলল, ‘আমি কলেজ থাইকা আসছি। আপনাগো আইএ পরীক্ষার রেজাল্ট হইছে।’

তাজউদ্দীনের মাথা থেকে পানি ঝরছে চুল বেয়ে। সাইকেলটা তিনি বারান্দায় তুলেছেন। সাইকেল থেকেও পানি গড়াচ্ছে।

‘তাই নাকি? খুব খারাপ করেছি নাকি?’

‘আপনে খুব ভালো করছেন। প্রিন্সিপাল স্যার আপনাকে কাইলকা যাইতে কইছে।’

‘খুব ভালো মানে কী?’

‘ক্লার্ক স্যারে আপনারে চিঠি দিছে।’

‘আচ্ছা, আপনি আমার ঘরে আসেন।’

তাজউদ্দীন ঘরে ঢোকেন। লন্ঠন দরজার কাছেই ছিল। সেটা ভেজা হাতে তুলে নিয়ে আলোটা উসকে দেন।

‘বসেন।

‘না, বসুম না।’

‘আরে, যাবেন কীভাবে। বৃষ্টি কমুক। আসেন এক সাথে ভাত খাই। তারপর যান।’

তাজউদ্দীন গামছা টেনে নিয়ে মাথা মোছেন। হাত মোছেন। তারপর চিঠিটা লন্ঠনের কাছে নিয়ে গিয়ে মেলে ধরেন।

‘কংগ্রাচুলেশন্স। ইউ হ্যাভ স্টুড ফোর্থ ইন দ্য কম্বাইন্ড মেরিট লিস্ট।’

তাজউদ্দীন আহমদ নির্লিপ্ত। তাঁর হাত কপালের চুল থেকে পানি ঝরে হাতের কাগজ ভিজে যায়।

৩১.

রিকশা চলছে। রাস্তা অসমান। টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। একটু একটু ঝাঁকি লাগছে। শেখ মুজিবের সেই দিকে খেয়াল নাই। তিনি দেখছেন, পুরো ঢাকা শহর—মোগলটুলী থেকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল—চাঁদের আলোয় ডুবে আছে। রেসকোর্স ময়দান, রমনার গাছগাছালি, গভর্নর হাউস, ঢাকা ক্লাব, আর অ্যাসেম্বলি ভবন—সবকিছুকেই নিমগ্ন করল এই চাঁদের আলো।

শেখ মুজিবের উদাস উদাস লাগে। রিকশা হলের সামনে আসে। তিনি রিকশাঅলার হাতে একটা আধুলি দিয়ে ফিরে না তাকিয়ে হাঁটতে থাকেন। রিকশাঅলা ভাংতি পয়সা বের করে দেখে সাহেব অনেক দূরে চলে গেছেন।

এটা কি একটা হল, নাকি কোনো স্বপ্নমহল!

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলটি খুবই সুন্দর। স্যার আর এন মুখার্জি ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন, মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি এই হলটির স্থাপত্য নকশা ও নির্মাণকাজ সমাধা করেছে। মাথার ওপর মায়াবী রঙের বড় বড় মিনার, লম্বা বারান্দায় সুদৃশ্য খিলান, সামনে টেনিস খেলার তিনটা লন। এর চেয়ে সুন্দর ভবন ঢাকায় আর আছে কি না সন্দেহ। কার্জন হল কিংবা হাইকোর্ট ভবনও এত দৃষ্টিনন্দন নয়।

চাঁদের আলোয় বিভ্রান্ত শেখ মুজিবের প্রত্যয় হয়!

১৬ নম্বর রুমটির দিকে হাঁটেন শেখ মুজিব।

বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজের স্যান্ডেলের আওয়াজ লম্বা করিডর বেয়ে দূরে দেয়ালে লেগে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে শেখ মুজিবের কানে।

আস্তে করে রুমের দরজা ঠেললেন মুজিব

গাজীউল হক শুয়ে আছেন তাঁর বিছানায়।

পাশের বিছানাটা আলী আশরাফের। তিনি ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছেন। এই সুযোগে সেই বিছানায় রাত্রি যাপন করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

মুজিবের হাতে একটা ওষুধের শিশি। ড. করিম এই ওষুধ তাঁকে দিয়েছেন। মুজিবের শোয়া-খাওয়া কোনো কিছুর স্থিরতা নাই। এর ফলটা দাঁড়িয়েছে, ইদানীং কনুইয়ের উল্টো দিকে, হাঁটুর নিচে ভীষণ চুলকায়। এই ওষুধটা লাগাতে বলেছেন ডাক্তার সাহেব।

রুমে ঢুকে ওষুধের শিশিটা নিয়ে তিনি বিছানার দিকে তাকিয়ে আবার বিভ্রান্ত বোধ করেন।

খোলা জানালা দিয়ে একটা চারকোনা আলো এসে পড়েছে আলী আশরাফের বিছানায়। তিনি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন, মোগলটুলী থেকে যে চাঁদটা তাঁকে অনুসরণ করে আসছে, সেটি ঠিকই বিড়ালের মতো চুপি চুপি এসে তাঁর বিছানায় আশ্রয় নিয়েছে।

‘মুজিব ভাই, আসলেন?’ গাজীউল বললেন।

‘কী গাজী, তুমি ঘুমাও নাই?’

‘না, মুজিব ভাই। আপনি বাতি জ্বালান।’

মুজিব এতক্ষণ বাতি জ্বালাচ্ছিলেন না, গাজী সেটা লক্ষ করেছেন।

মুজিব বললেন, ‘সারা দিন পরিশ্রম করো, ক্লাস করো, আবার মিটিং- মিছিলও করো, তোমার তো ঘুমানো দরকার।’

গাজী বললেন, ‘আপনার তুলনায় আমার পরিশ্রম কোনো পরিশ্রমই না, মুজিব ভাই। সকালে শুরু করেন মিছিল-মিটিং। কোথায় শোন, কোথায় ঘুমান, কী খান না খান, কোনো কিছুর ঠিক নাই। এখন একটু ভালো বিছানা পাইছেন। আপনি একটু শান্তিমতো ঘুমান। আপনার শরীরের অবস্থা তো ভালো না।’

‘আরে মিয়া, ঘুম হয় নাকি। দেখো না কী রকম চুলকানি হয়েছে!’

‘চুলকানির ওষুধ দিছেন নাকি?’

‘হ্যাঁ। ডাক্তারের কাছে গেছলাম। সেখান থেকে আনলাম। এখন একটু ওষুধ লাগাই।’

মুজিব ওষুধের শিশির মুখটা মোচড় দিয়ে খুললেন। আধা তরল সাদা ওষুধটা হাতে নিয়ে যথাস্থানে লাগালেন।

শিশির মুখ খুললেন, যেন ভেতর থেকে বেরিয়ে এল আলাউদ্দিনের ভয়ংকর এক দৈত্য, যে দৈত্যের নাম দুৰ্গন্ধ।

‘বাপ রে, কী গন্ধ! কুইনিন জ্বর সারাবে, তবে কুইনিন সারাবে কে?’ মুজিব বললেন।

গাজী নাকের কাছে একটা কাঁথা ধরলেন। সত্যি ভীষণ বদ গন্ধ।

মুজিব বাইরের কাপড় ছাড়ার জন্য লুঙ্গি হাতে নেন।

তারপর আবার বাতির সুইচটা টিপে ঘরটা অন্ধকার করেন।

আবারও একটা চারকোনা জ্যোৎস্নাখণ্ড অধিকার করে নেয় জানালার ধারের শূন্য বিছানাটি।

মুজিব ডাকেন, ‘গাজী, এই দিকে আসো।’

গাজীউল বুঝতে পারেন না ঠিক কোথায় যেতে বলা হচ্ছে।

‘আসো না। আমার কাছে আসো। একটা জিনিস দেখাই তোমাকে।’

‘কী জিনিস?’

‘আমার বিছানায় এসে বসো। তাইলেই কেবল দেখা যাবে। আসো।’ গাজীউল কাছে গেলেন মুজিবের। রাসায়নিকের গন্ধটা আবার একটা ধাক্কা মারল গাজীর ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে।

এক হাত বিছানায়, আরেক হাত উঁচিয়ে শেখ মুজিব দেখাতে লাগলেন জানালার বাইরে, ‘ওই দেখো।’

‘কী?’

‘চাঁদ। আজ মনে হয় পূর্ণিমা। পৃথিবীতে চাঁদের আলোর চেয়ে সুন্দর আর কী আছে, বলো তো?’

চাঁদের আলোয় মুজিব ভাইয়ের মুখখানা অপার্থিব বলে মনে হচ্ছে। গাজীউলের মনে হচ্ছে, এই দৃশ্য কি সত্যি হতে পারে? এই কথামালা?

এই লোকটা সারাটা দিন খাজা নাজিম উদ্দিন সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। একটার পর একটা ইস্যু খুঁজে বের করছেন। প্রতিদিনই মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়া চাই তাঁর। এর মধ্যে জেলখানার অভিজ্ঞতাও তাঁর কম হয়নি। সর্বক্ষণ তাঁর পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছে মুসলিম লীগ সরকার। তিনি কিনা এইখানে, সলিমুল্লাহ হলের ১৬ নম্বর কক্ষে শুয়ে আকাশের চাঁদ দেখছেন!

ঘরে তো কোনো ফুলের ঘ্রাণও নাই, যা আছে তা চর্মরোগের ওষুধের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ।

‘মুজিব ভাই, আমি ঠিক ধরতে পারছি না কোনটা সত্য—চাঁদের আলো, নাকি এই চুলকানির ওষুধের ঝাঁঝ!’ গাজী হেসে বললেন।

‘খাজার শাসনে দুইটাই সত্য, গাজী। তোমাকে চুলকানির ওষুধও দিতে হবে, আবার চাঁদের আলোও উপভোগ করতে হবে।’

হেথায় ওঠে চাঁদ ছাদের পারে,

প্রবেশ মাগে আলো ঘরের দ্বারে।

আমারে খুঁজিতে সে ফিরিছে দেশে দেশে,

যেন সে ভালোবেসে চাহে আমারে।’

শেখ মুজিব, ২২ বছরের শুকনো পটকা গাজীউলের চেয়ে বছর সাতেকের বড়। অত্যন্ত সুদর্শন। তাঁর গলাটাও ভারি চমৎকার। বক্তৃতা দিয়ে দিয়ে সেটাকে খোলসা করে রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা অবলীলায় মুখস্থ বলে যেতে লাগলেন।

গাজী বিস্মিত হলেন না। মুজিব ভাইয়ের স্মরণশক্তি অসাধারণ। যেখানেই যান তিনি, রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই হাতে করে নিয়ে যান। একবার পড়লেই তিনি সেটা মনে রাখতে পারেন।

মুজিব বললেন, এর আগের লাইনগুলো শোনো—

সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা।
কেমন করে কাটে সারাটা বেলা!
ইটের পরে ইট, মাঝে মানুষ-কীট—
নাইকো ভালোবাসা, নাইকো খেলা ॥

কোথায় আছ তুমি কোথায় মা গো,
কেমনে ভুলে তুই আছিস হাঁগো!
উঠিলে নবশশী ছাদের ’পরে বসি
আর কি রূপকথা বলিবি না গো?

হৃদয়বেদনায় শূন্য বিছানায়
বুঝি, মা, আঁখিজলে রজনী জাগ’–
কুসুম তুলি লয়ে প্রভাতে শিবালয়ে
প্রবাসী তনয়ার কুশল মাগ’ ॥

মুজিব বলে চলেন, ‘আমার মেয়েটা, হাসু, ওর বয়স এক পেরিয়ে গেল। ওর মা ওকে চাঁদ দেখায়। আয় আয় চাঁদমামা টিপ দিয়ে যা। এবার যে গেলাম টুঙ্গিপাড়ায়, মেয়েটাকে ফেলে আসতে আমার কষ্ট হয়েছিল, জানো, গাজীউল। ওর মায়ের প্রতিও আমি সুবিচার করতে পারলাম না। ওদের যে ঢাকায় নিয়ে আসব, সেই অবস্থাও তো এখানে নাই। আন্দোলন আর আন্দোলন। যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করে ফেলতে পারে ওরা। কোনো কিছুর ঠিকঠিকানা নাই।’

গাজীউল বুঝতে পারেন, মুজিব ভাইয়ের কণ্ঠস্বর ভেজা।

আসলেই সামনে অনেক কাজ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী

আসবেন। তাঁকে একটা স্মারকলিপি দেওয়া হবে। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের মিটিংয়ে গিয়েছিলেন মুজিব। ১৭ নভেম্বর ১৯৪৮-এর সেই সভায় কামরুদ্দীন আহমদকে ভার দেওয়া হয়েছে মেমোরেন্ডামটা রচনা করার। লিয়াকত আলী ঢাকায় এলে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

সরকারের লোকজনের মাথাও খারাপ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। ফজলুর রহমান, কেন্দ্রের শিক্ষামন্ত্রী, এখন ঘোষণা করছেন, বাংলা লিখতে হবে আরবি হরফে। এর আগে একবার প্রস্তাব করা হয়েছে রোমান হরফে বাংলা লেখার। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই উর্দু ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার কথাও বলা হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে মিছিল হচ্ছে। সভা হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে হু হু করে। শেখ মুজিব দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদেও মিছিল সংগঠিত করছেন। কর্ডন- প্রথার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করছেন। কর্ডন-প্রথা হলো, খাদ্য-উদ্বৃত্ত জেলা থেকে কোনো খাদ্য বাইরের জেলায় বেসরকারিভাবে যেতে পারবে না, সরকার সেটা কিনে নিয়ে তারপর নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নেবে। এটা করতে গিয়ে খাদ্যসংকট আরও বাড়ানো হচ্ছে।

গাজী শেখ মুজিবের চোখের দিকে তাকালেন। তাঁর চোখের নিচে দুটো চাঁদ টলমল করছে।

কথা ঘোরানোর জন্য গাজী বললেন, ‘মুজিব ভাই, আপনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভক্ত হলেন কেমন করে? আপনার লিডার সোহরাওয়ার্দী তো বাংলাই ভালো করে বলতে পারেন না। আর আপনি তাঁর অনুসারী হয়ে সারাক্ষণ রবীন্দ্রনাথ আওড়ান।’

মুজিব হেসে উঠলেন শব্দ করে।

‘কী ব্যাপার, হাসলেন যে!’

‘আছে ব্যাপার।’ বলে তিনি লুঙ্গি পরে গামছা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন হাতমুখ ধোয়ার জন্য।

এসে দেখেন গাজী ঘুমিয়ে পড়েছেন।

মুজিব বিছানায় শুয়ে পড়লেন।

এই বিছানা থেকে সরাসরি চোখ যাচ্ছে চাঁদের দিকে।

তিনি চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চাঁদের ওপর দিয়ে মেঘ দৌড়াচ্ছে হালকা শরীর নিয়ে। মনে হচ্ছে চাঁদটাই দৌড়াচ্ছে। আসলে তো চাঁদ দৌড়ায় না। মেঘেরা দৌড়ায়।

কত কথা মনে পড়ে মুজিবের!

সাতচল্লিশের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বারবার এসেছেন পাকিস্তানে। ঢাকায় এসে খাজা নাজিম উদ্দিনের অতিথি হয়েছেন। করাচিতে গণপরিষদের সভায় ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসেই ভাষণ দিয়েছেন। প্রতিবারই তিনি কথা বলেছেন অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে, হিন্দু- মুসলিম সম্প্রীতির পক্ষে, ভারত-পাকিস্তান শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে। লিডারের এই অসাম্প্রদায়িকতার গুণটিকে মুজিব বড় ভালোবাসেন। কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে সরাসরি এসেছেন যশোরে। শান্তির সপক্ষে সভা করে ফিরে গেছেন দিনে দিনে। খুলনায় এসেছিলেন। সেখান থেকে ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ। ফরিদপুর-গোপালগঞ্জে সভা সফল করার জন্য মুজিব খেটেছেন প্রচুর। সভা সুন্দরভাবে সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

এপ্রিল মাসেও তিনি এসেছিলেন ঢাকায়। সদরঘাট করোনেশন পার্কে সভা করেছেন। তিনি যখন বক্তৃতা করছিলেন, তখন শাহ আজিজের মুসলিম ছাত্রলীগের পাঠানো একটা ছেলে দড়ি বেয়ে মঞ্চের পেছনে উঠে পড়ে। তার হাতে ছিল ছুরি। সে এসেছিল সোহরাওয়ার্দীকে খুন করতে। জনতা অবশ্য ছেলেটিকে ধরে ফেলে।

সোহরাওয়ার্দী বারবার এই দেশে আসুক, খাজা নাজিম উদ্দিনরা তা চান না। না চাইবারই কথা। তিনি এলে এই দেশে আর সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের রাজনীতি চলবে না। খাজা আর লিয়াকত আলীরা তাঁর সঙ্গে পেরে উঠবেন না। গত জুন মাসে সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে আমন্ত্রণ জানানো হয় মানিকগঞ্জের একটা শান্তিসভায় ভাষণ দেওয়ার জন্য।

কলকাতা থেকে সোহরাওয়ার্দী আসবেন বিমানে।

সকাল সকাল মুজিব হাজির হয়েছিলেন তেজগাঁও বিমানবন্দরে। কামরুদ্দীন আহমদসহ ১৫০ মোগলটুলীর ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

কিন্তু দুই মাস আগে লিডার এসে যে বাড়িতে উঠেছিলেন, ‘দিলকুশা’ নামের সেই বাড়ির মালিক খাজা নসরুল্লাহই উপস্থিত নেই। কামরুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘মানিকগঞ্জের লঞ্চ তো ছাড়বে সেই সন্ধ্যায়। এতক্ষণ লিডার কোথায় থাকবেন, আর যাবেনই বা কী করে? খাজা নসরুল্লাহ সাহেব যে এখনো এলেন না!’

বিমান অবতরণ করল রানওয়েতে। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন ৫৬ বছর বয়সী সোহরাওয়ার্দী সাহেব। পাঞ্জাবি-পায়জামা পরা লিডারকে বেশ ফুরফুরেই দেখাচ্ছিল। পূর্ব আকাশে সূর্য ছিল, আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে, তিনি ভ্রু কুঁচকে আছেন। তবু তাঁর মুখ হাসি হাসি।

মুজিব হাত বাড়িয়ে দিলেন। লিডার তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন।

কুশল বিনিময়ের পর লিডার বললেন, ‘চলো, যাওয়া যাক। খাজা কই?’

‘তিনি আসেননি।’ কামরুদ্দীন সাহেব জানালেন।

‘তাকে আমি তার করে এসেছি। সে তো জানে, আমি তার বাসায় উঠব। দেখো তো কী ব্যাপার?’

কামরুদ্দীন সাহেব ছুটলেন বিমানবন্দর অফিসে, একটা ফোন করার জন্য। ফিরে এসে বললেন, ‘খাজা সাহেব বললেন, তাঁর বাড়িতে অনেক মেহমান। সুতরাং ওখানে তিনি লিডারকে নিতে পারছেন না।’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘তা কী করে হয়! আমি ফোনে কথা বলি। কোথাও কিছু একটা ভুল-বোঝাবুঝি হচ্ছে।’

ভুল-বোঝাবুঝিটা কী, মুজিব সেটা আঁচ করতে পারছেন। তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয়, সরকার চায় না আপনি বারবার পূর্ব বাংলায় আসেন। কাজেই তারা সবাইকে বলে দিয়েছে, কেউ যেন আপনাকে বাড়িতে না ওঠায়।

কামরুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘আপনার ফোন করাটা উচিত হবে না।’

বিমানবন্দর থেকে ঘোড়াগাড়ি ভাড়া করে তাঁরা চললেন আমজাদ খান সাহেবের জয়নাগ রোডের বাসায়। ততক্ষণে আকাশে মেঘ জমে গেছে। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। ভাপসা গরম।

আমজাদ সাহেবও অবিভক্ত বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকে একটা প্রহরের জন্য ঠাঁই দিতে রাজি হলেন না। এ তো ভারি মুশকিল হলো!

মুজিবের বড় রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, লিডারকে নিয়ে সোজা চলে যান পার্টি অফিসে। ওয়ার্কার্স ক্যাম্পে। কিন্তু লিডারের মুখ হাসি হাসি। তিনি রাজনৈতিক নেতা। জানেন, রাজনীতি

জানেন, রাজনীতি মানেই চড়াই-উতরাই। নাগরদোলার মতো একজন রাজনীতিকের জীবন। কাল যিনি পরম বন্ধু, আজ তিনি দুচোখের বিষ।

এদিকে কামরুদ্দীন সাহেব ছুটলেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান সাহেবের বাসায়। কামরুদ্দীন সাহেব পরে জানিয়েছেন মুজিবকে, শাহজাহান সাহেবের স্ত্রী নূরজাহান বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁকে বলতেই তিনি রাজি হয়ে গেছেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মতো বড় মানুষ আসছেন শুনে তিনি রান্নাঘরে চলে গেছেন সোজা।

কামরুদ্দীন সাহেব এসে বললেন, ‘লিডার, চলুন। খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘কোথায়?’

‘প্রশ্ন নয়,’ কামরুদ্দীন সাহেব বললেন, ‘চিরকাল আপনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, আমরা আপনার কথামতো চলেছি। আজ না হয় আপনি আমার নেতৃত্ব মেনে নিন। আমার সাথে চলুন।’

কথা না বাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেব ঘোড়ার গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলেন। মুজিব আর কামরুদ্দীন সাহেবও তাঁর সঙ্গে চললেন। কর্মীরা পেছনে পেছনে তাঁদের গাড়ি অনুসরণ করলেন।

নূরজাহান খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেছেন বিশাল। অনেক পদের রান্না। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তো খেলেনই, কর্মীবহরের খাওয়াও সম্পন্ন হলো আয়েশের সঙ্গে।

শাহজাহান সাহেব ও নূরজাহান তাঁদের শয়নকক্ষটাই ছেড়ে দিলেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের জন্য।

সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় স্টিমার ছাড়বে বাদামতলী ঘাট থেকে। কর্মীবহর নিয়ে নেতা চললেন ঘাটে। সন্ধ্যা নামার আগেই।

তখন বাদামতলীতে ভিড় জমে উঠেছে। কুপিবাতি জ্বলছে ফেরিঅলাদের পসরার সামনে। কুলিরা হাঁকাহাঁকি করছে। ভিখিরিরা ভিক্ষা করছে গান গেয়ে। স্টিমার ঘাটে ভেড়ানোই ছিল। নেতা সেটায় উঠলেন। দোতলায় কেবিনের সামনে অনেকটা জায়গা ফাঁকা। সেখানে চেয়ার পাতা। সবাই গিয়ে সেখানে বসে পড়া গেল। আড্ডাও উঠল জমে। আটটা বাজল, সাড়ে আটটা। কিন্তু স্টিমার ছাড়ার কোনো নামই নাই। সারেংকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানাল, পুলিশ সাহেব এসে বলে গেছেন, তাঁর আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত জাহাজ ছাড়া যাবে না।

মুজিব উঠলেন। কামরুদ্দীন সাহেব ছুটলেন। তাঁরা ফোন করতে লাগলেন নানা কর্তাব্যক্তির কাছে। জানা গেল, মুখ্যমন্ত্রী কল বুক করেছেন করাচিতে। কেবিনেট মিটিং চলছে। করাচি থেকে ফোন এলে তারপর তিনি সিদ্ধান্ত দেবেন জাহাজ ছাড়বে কি ছাড়বে না।

সাড়ে নটায় পুলিশের গাড়ি এল দুটো। ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের আইজি, ডিআইজি। তাঁরা হাতে করে এনেছেন একটা সরকারি আদেশপত্র। সোহরাওয়ার্দী মানিকগঞ্জে বক্তৃতা করতে যেতে পারবেন না। তাঁকে অনতিবিলম্বে দেশ ছাড়তে হবে।

পুলিশের আইজি জাকির হুসেন। এই জাকির হুসেনকে ঢাকার পুলিশ সুপার পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী। তারপর একজন ইংরেজ সাহেব যখন এই প্রদেশের আইজি পদে নিয়োগ পেল, তখন বাঙালি পুলিশ কর্তাদের সবাইকে এক ধাপ করে পদাবনমনের সামনে পড়তে হলো। তখন এঁরা সবাই মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে বলে- কয়ে ওই ইংরেজের নিয়োগ বাতিল করিয়েছিলেন। আজ তাঁরাই বয়ে এনেছেন সোহরাওয়ার্দীর বহিষ্কারাদেশ।

জাকির হুসেন বললেন, ‘আপনি আজ রাতে আমার বাসায় থাকতে পারেন।’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘থ্যাংকস। ইফ আই অ্যাম নট আন্ডার অ্যারেস্ট আই উড প্রেফার টু রিমেইন উইথ মাই হোস্ট।’

জাকির হুসেন বললেন, ‘আপনি যেখানে খুশি আজকের রাতটা কাটাতে পারেন।’

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘টেল ইয়োর নাজিম উদ্দিন দ্যাট সোহরাওয়ার্দী ইজ নট ইয়েট ডেড।’

বুড়িগঙ্গায় তখন ঘন অন্ধকার। ঘাটের আলোয় নদীর পানিতে কালো ঢেউয়ের নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। দূরে নৌকার গায়ে গায়ে আলো। সোহরাওয়ার্দী, কামরুদ্দীন, শেখ মুজিব—সবাই নেমে এলেন জাহাজের ডেক থেকে।

সোহরাওয়ার্দী সাহেব পুলিশদের বললেন, ‘একটা ছোট্ট সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরি করলে চলবে? অযথা এতজন সাধারণ যাত্রীকে আপনারা এতক্ষণ ধরে কষ্ট দিলেন।’

শাহজাহান সাহেবের বাসাতেই ফিরে এলেন তাঁরা। এসে দেখেন, বাসার চারদিকে পুলিশ। ভেতরেও পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বসা।

সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘শাহজাহান সাহেবের না কোনো ক্ষতি করে বসে এরা?’

শাহজাহান সাহেব অবশ্য ভয় পেলেন না। সবাই মিলে ধরে শোবার ঘরের খাটটা ফ্যানের নিচে আনলেন। কর্মীরা একে একে চলে গেল। শুধু রয়ে গেলেন কামরুদ্দীন।

মুজিবও বিদায় নিলেন। পরের দিন ভোর থাকতে থাকতেই মুজিব এসে হাজির শাহজাহান সাহেবের বাসায়।

নূরজাহান, কামরুদ্দীন, মুজিব প্রবেশ করলেন শোবার ঘরে। দেখতে পেলেন, লিডার একমনে চোখ বুজে কবিতা বলে চলেছেন, ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,/ শান্তির ললিতবাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস,/ যাবার আগে তাই ডাক দিয়ে যাই,/ দানবের সাথে সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হতেছ যারা ঘরে ঘরে।’

নূরজাহান ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার এমএ ক্লাসের ছাত্রী, বললেন, ‘শহীদ সাহেব, আপনি বাংলা পড়েন? বাংলা কবিতা পড়েন? রবীন্দ্রনাথ পড়েন?’

সোহরাওয়ার্দীর সামনে নূরজাহানের নোটখাতা, সেটা বন্ধ করে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি তো বাংলার ছাত্রী। আমাকে বোঝাও তো, মধুমাখা আঁখিজল মানে কী? লবণাক্ত আঁখিজল কি মধুমাখা হতে পারে?’

তারপর তিনি উঠলেন। বাথরুমের দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘আমি দুঃখিত। আমার জন্য তোমাদের কষ্ট করতে হলো।’

চাঁদের আলোর দিকে তাকিয়ে আছেন মুজিব। তাঁর চোখে আবারও অশ্রু। আজ তাঁর কী হয়েছে? এখনই যদি গাজী চোখ মেলে, সে দেখে ফেলবে তাদের মুজিব ভাইয়ের চোখ ভেজা। এ-ও কি হয়?

তিনি চোখ মুছলেন। এই অশ্ৰু কি মধুমাখা?

গাজীউল হক ঘুমুচ্ছে। ঘুমাক। ও জেগে উঠলে ওকে বলতে হবে, ‘শোনো গাজী, আমার লিডার শুধু রবীন্দ্রনাথ পড়েনই না, তিনি বোঝারও চেষ্টা করেন। মধুমাখা অশ্রুজল মানে কী! তুমি কী ভাবো, বলো তো?’

.

মুজিবের মনে রবীন্দ্রনাথের পক্তি দোলা দিয়ে যাচ্ছে :

সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর-
তারপর ছুটি নিব।
সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,
সুন্দর হবে নয়নের জল,
স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল
আরো আপনার হবে।
প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে
আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,
আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ-’পরে
শিশিরের মতো রবে।

মুজিবের মনে পড়ে, সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে কীভাবে পুলিশ পরের দিন বিকেলে গাড়িতে তুলে নেয়। মুজিবও সেই গাড়িতে উঠে পড়েন। লিডারকে পুলিশ গোয়ালন্দগামী জাহাজে তুলে দেয়।

মুজিব তাঁকে কেবিনে বসিয়ে দিয়ে তারপর নেমে আসেন।

জাহাজ ছেড়ে দেয় ভেঁপু বাজিয়ে। পানিতে ঢেউ তোলে। ঢেউ আছড়ে পড়ে ঘাটে। বাঁধা নৌকাগুলো দুলে ওঠে। জাহাজটা আস্তে আস্তে চোখের আড়ালে চলে যায়।

জেটি শূন্য হয়ে গেলে মুজিবের চারপাশটা যেন শূন্য বলে মনে হয়। তবু তিনি নিজেকে শক্ত করেন। নেতা বলে গেছেন অসাম্প্রদায়িকতার পথে সংগঠন আর আন্দোলন চালিয়ে যেতে। তিনি আবার আসবেন।

সলিমুল্লাহ হলের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। এই চাঁদ উঠেছে কলকাতায়। একই চাঁদ উঠেছে টুঙ্গিপাড়ায়।

লিডারের সঙ্গে তাঁর কত দিনের পথচলা। কত মধুর স্মৃতিই না আছে তাঁর সোহরাওয়ার্দীকে ঘিরে। কর্মীদের সুখদুঃখকে নিজের সুখদুঃখ মনে করেন, প্রত্যেকের খোঁজখবর নেন, মানুষের উপকার করার জন্য সদা প্রস্তুত।

মুজিব নেতার এই গুণের কথা জানেন। ধনীর ঘরের ছেলে, অভিজাত পরিবার। কলকাতা ক্লাবের সদস্য। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ। তিনি যখন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, সে সময় এক ইংরেজ আইসিএস কর্মকর্তা ফাইলের নোটে যা লিখেছিলেন, সোহরাওয়ার্দীর তা মনঃপূত হয়নি। তিনি ওই অফিসারকে তিরস্কার করলেন। গভর্নরকেও জানালেন, ‘এই অফিসার তো নোটই লিখতে জানে না।’ গভর্নর বললেন, ‘সে কি, ও তো অক্সফোর্ডের এমএ!’ সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘অক্সফোর্ডের এমএ তো আমিও। আমি খুব জানি, সব ইংরেজ ভালোমতো ইংরেজি জানে না।’ এ রকম প্রবল যাঁর ব্যক্তিত্ব, তিনি কিনা তাঁদের সঙ্গে একটা দেশি নৌকায় বসে সারা রাত জেগে গ্রামবাংলা সফর করছেন!

.

মুজিবের আজ ঘুম আসছে না। এই রকম সাধারণত হয় না। যেকোনো স্থানে চোখ বোজামাত্রই ঘুমিয়ে পড়ার আশ্চর্য ক্ষমতা তাঁর আছে। তা না হলে কারাগারে, কিংবা স্টিমারে, কিংবা পার্টি অফিসে কিংবা পাতলা খান লেনের মেসে—যেখানে রাত, সেখানেই কাত, আর সেখানেই নিদ্ৰাপাত করতে পারতেন না তিনি।

সোহরাওয়ার্দী তখন অবিভক্ত বাংলার সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী। থিয়েটার রোডের বাসভবনে নিজের ডেস্কে বসে সেদিনের ডাক দেখছেন তিনি। মুজিব বসে আছেন তাঁর ডেস্কের অপর দিকে। একটা পোস্টকার্ড হাতে তুলে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী সাহেব বিমর্ষ হয়ে পড়লেন যেন। উঠে পড়লেন।

‘কী খবর, লিডার? কোনো জরুরি খবর?’

‘আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হবে খিদিরপুরের দিকে।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি বসে পড়লেন গাড়িতে। মুজিবও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসলেন শকটে। নেতা নিজেই গাড়ি চালাচ্ছেন। মুজিব বসে আছেন সারথির পাশের আসনে। গাড়ি গিয়ে থামল খিদিরপুর ওয়ার্ডগঞ্জ শ্রমিক বস্তিতে। তাঁরা গাড়ি থেকে নামলেন। মন্ত্রীকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে পুরো বস্তি যেন ভেঙে পড়ল। জনারণ্যের ভেতর দিয়ে লিডার হাঁটছেন, সঙ্গে মুজিব। একে-ওকে জিজ্ঞেস করলেন লিডার, অমুকের ঘর কোনটা? বস্তির জনস্রোত তাঁদের ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। একটা জীর্ণ ঘরের সামনে এসে তাঁরা থামলেন। জনতাকে বাইরে থাকতে বলে সোহরাওয়ার্দী মাথা নিচু করে ঢুকে পড়লেন ওই পর্ণকুটিরে, পেছনে মুজিব। মাটিতে পাতা মাদুরের ওপর শুয়ে আছে একটা কঙ্কালসার দেহ। অতিবৃদ্ধ লোকটি কাশছে ঘন ঘন। তিনি বললেন, ‘এই মুরুব্বিকে আমার গাড়িতে তুলে দাও।’

জনতার সঙ্গে হাত লাগালেন মুজিবও। গাড়িতে উঠে তিনি বস্তিবাসীকে বললেন, ‘আমাকে আগে খবর দাওনি কেন তোমরা?’

তারপর গাড়ি সোজা চলে এল যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতালে।

হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো বৃদ্ধকে। মন্ত্রী নির্দেশ দিলেন, ‘এর চিকিৎসার যেন কোনো ত্রুটি না হয়। যা খরচ লাগে, সব আমি দেব।’

তিনি নিয়মিত টাকা পাঠাতেন এই বৃদ্ধকে।

১৯৪৩ সালের দিককার কথা। মুজিব একবার বসে আছেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবের থিয়েটার রোডের বাসায়, শোবার ঘরে। বিছানার ওপর একটা কালো খাতা। লিডার ঘরে ছিলেন না। মুজিব আনমনেই কালো খাতাটা খুলে পাতা মেলে ধরলেন। কতগুলো লোকের নাম আর ঠিকানা লেখা। তার পাশে একটা করে টাকার অঙ্ক। সব মিলিয়ে সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো।

নেতা এই বিপন্ন মানুষগুলোকে প্রতি মাসে পেনশন দেন। এর পেছনে তাঁর মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা খরচ হয়। জিজ্ঞেস করেছিলেন মুজিব, ‘মাসে মাসে এত টাকা পেনশন কেন দিচ্ছেন?’

নেতা করুণ একটা হাসি দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেশের অবস্থা তো জানো না! ও তালিকা আমার দিন দিন বড় হচ্ছে। কবে যে আমরা এদের একটা হিল্লা করতে পারব!’

মুজিবের তন্দ্রামতো আসে। তিনি দেখতে পান, তাঁরা ঘাসি নৌকায় চড়ে চলেছেন পার্টির কাজে। একজন মাত্র মাঝি সেই নৌকার। মুজিব তাঁকে বললেন, ‘লিডার, আপনি এইভাবে হালটা সোজা ধরে থাকেন। আমি আর মাঝি দাঁড় টানি। সময়টা বাঁচবে।’ সোহরাওয়ার্দী সাহেব হাল ধরলেন। তারপর লিডার বললেন, ‘তুমি এবার হাল ধরো, মুজিব। আমি দেখি দাঁড় টানতে পারি কি না।’

‘ও আপনি পারবেন না, লিডার। আপনি বড় ঘরের ছেলে। কলকাতা শহরে ননি-মাখন খেয়ে বড় হয়েছেন। গাড়ি চালাতে পারবেন, কিন্তু নৌকার দাঁড় বাওয়া আপনার নরম হাতের কাজ নয়। আমরা নদীপারের ছেলে। বলা যায় নদীতেই বড় হয়েছি।’

‘আরে দাও তো। কথা শোনো।’

লিডার দাঁড় ধরলেন প্রায় জোর করেই, হাল ধরলেন মুজিব।

.

মাঝি গান ধরল, ‘মাঝি বায়া যাও রে,/ অকূল দরিয়ায় আমার ভাঙা নাও রে/ মাঝি বায়া যাও রে।’

তন্দ্রা ভেঙে যায় মুজিবের। গাজীউল ঘুমিয়ে পড়েছেন। চাঁদটা আকাশের গায়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পড়েছে অনেকটা ওপরে।

নাহ্। এভাবে কবিতা আর আবেগের কাছে আত্মসমর্পণ করলে চলবে না। কাল ভোরে উঠতে হবে। আবার নামতে হবে মিছিলে। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের আগমনের বিরুদ্ধে মিছিলে নেতৃত্ব দিতে হবে।

৩২.

হেমন্তকাল। আমগাছের পাতা শুকিয়ে আসছে। শীতে ঝরবে পাতা, বসন্তে পাতা গজাবে, আসবে মুকুল। কিন্তু হেমন্তের সকালের রোদটা বড় ভালো লাগে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমির।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের আমগাছের একেবারে মগডালে গিয়ে বসে তারা; রোদটা যত বেশি গায়ে মেখে নেওয়া যায়।

ব্যাঙ্গমা বলে, ‘বলো তো, শেখ মুজিবের প্রিয় কাজ কোনটা?’

ব্যাঙ্গমি বলে, ‘মিছিল করা। মিছিল করতে না পারলে তার হাত-পায়ে বিষ-বেদনা ওঠে। এইবার তুমি কও তো, শেখ মুজিব কোন প্রতিভাটা নিয়া জন্মাইছে?’

ব্যাঙ্গমা বলে, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের হেমন্তের বাতাসে দোল খেতে খেতে, ‘আহ্, ভাষণটা বড় ভালো দেয় এই নওজোয়ান!’

ব্যাঙ্গমি আমগাছের ডালে মুখ ঘষে নিয়ে বলে, ‘আইজ থাইকা ঠিক চার বছর আগে কলকাতায় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বার্ষিক সভা হইতেছিল। আগের দিন সোহরাওয়ার্দীর বাড়িতে অনেকে মিলা ঠিক করল, আবুল হাশিম সাহেব কমিউনিস্টঘেঁষা, তারে আর সাধারণ সম্পাদক রাখা চলব না। হাশিম সাহেবও সেইটা মাইনা নিছিলেন। কিন্তু সন্ধ্যায় যখন শেখ মুজিব ভাষণ দেওয়া শুরু করল, সেই প্রথম তার লিডার সোহরাওয়ার্দীর সাথে পরামর্শ না কইরাই মুজিব হাশিম সাহেবের পক্ষে ভাষণ দিতে লাগল, আর পুরা কাউন্সিল মুজিবের কথায় একেবারে মন্তরের মুখে সাপের মতো মোহিত হইয়া আবুল হাশিমকেই আবার সাধারণ সম্পাদক করল, মনে আছে?’

‘থাকব না কেন? মুজিব যখনই ভাষণ দেয়, তখনই শ্রোতারা তার কথার জাদুতে ভাইসা যায়। এইটা তো কতই দেখলাম। তবে আরও দেখবা। মুজিব আরও অনেক ভাষণ দিব। একটা ভাষণ দিব একেবারে দুনিয়া ওল্টাইনা, সেইটা আর ২২/২৩ বছর পর। আর মুজিব তার লিডার শহীদ সোরওয়ার্দীর কথার অবাধ্য হইব আরও একবার। সেইটাও আরও দেড় যুগ পরে। যখন আইয়ুব খানের মার্শাল লর পর প্রথম পলিটিকস ওপেন করব, উনি তখন নেতার নির্দেশ অমান্য কইরা আওয়ামী লীগ খুইলা বসব। সেই অবাধ্য হওয়াটাই বড় কাজের কাজ হইব।’

‘কিন্তু এই সব বড় কাজের প্রস্তুতি তার চলতাছে রোজকার মিছিল মিটিং জনসভা প্রতিবাদ আর গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়া। খাজা নাজিম উদ্দিন গোপালগঞ্জ যাইতাছে। তার গোপালগঞ্জ। সেইখানকার এমএলএ শামসুদ্দিন আহম্মেদ এলাকা গরম কইরা ফেলছে। মহকুমায় পোনে ছয় লক্ষ মানুষ। প্রত্যেকের চান্দা এক টাকা। পোনে ছয় লাখ টাকা চান্দা উঠানো হইছে। কোর্ট মসজিদ আর পাকিস্তান মিনারের লাইগা ৪০ হাজার টাকা, পাশের রাস্তার লাইগা ৩০ হাজার। বাকি টাকা তারা দিতে চায় জিন্নাহ ফান্ডে। মুজিব কী করব?’

৩৩.

তখন ১১টা বাজে, গোপালগঞ্জের আদালতপাড়া এলাকায় তখন গভীর রাত। শীত আর কুয়াশা, কামিনী ফুলের ঘ্রাণ সেই কুয়াশার ওপরে ভর করে ভাসছে। কুকুর ডাকছে, শিয়ালের ডাকও শোনা যাচ্ছে নদীর ধারে শটিবন হেলেঞ্চাবন থেকে, ঝিঁঝি রব তো প্রকৃতিরই অংশ, শেখ মুজিব তাঁদের গোপালগঞ্জের বাসায় এসে হাজির হন। দরজায় শব্দ করেন।

‘কে?’ লুৎফর রহমান সাহেবের কাশি হয়েছে, কে বলতে গিয়েই কাশির গমক ওঠে। ‘আব্বা, আমি খোকা।

লুৎফর রহমান লুঙ্গিতে গিঁট বাঁধতে বাঁধতে বিছানা ছাড়েন। টেবিলের ওপরে রাখা লন্ঠনটার নব ঘুরিয়ে আলো বাড়ান। চিমনিতে কালো দাগ পড়েছে। কয়েকটা পোকা চিমনির পাশে উড়ছে। একটা মরা পোকা টেনে নিয়ে যাচ্ছে পিঁপড়ার দল।

তিনি কবাটের খিল খোলেন। হাতে হারিকেন। হারিকেনের আলোয় ছেলের মুখটা দেখে তাঁর বুকে একধরনের প্রশান্তি অনুভূত হয়। পরক্ষণে একটা দুশ্চিন্তাও তাঁর মনে ঝিলিক দিয়ে যায়। করাচি থেকে খাজা নাজিম উদ্দিন আসছেন, ছেলে না আবার কোনো ঝামেলা করে বসে। তিনি আদালতের কর্মচারী; সরকার বাহাদুরের সর্বোচ্চ কর্তার সঙ্গে ঝামেলায় জড়ানোর সাহস তো তাঁর বুকে আসে না।

‘এত রাতে? কোত্থেকে?’

‘শামসুদ্দিন এমএলএর বাড়ি থেকে।’

‘হঠাৎ আসলা? খবর দিয়া আসলা না?’ লুৎফর রহমান খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন।

‘খবর তো পাইতেছেনই। ছয় লক্ষ টাকা চাঁদা তুলছে। গোপালগঞ্জের গরিব মানুষের টাকা। এই টাকা নাকি অরা জিন্নাহ রিলিফ ফান্ডে দিবে। তারই প্রতিবাদ করতে আসছি।’

‘হাতমুখ ধোও। ভাত খাও। জয়নালরে বলি ভাত রাতে।’

‘না, এত রাতে আর জয়নালরে কষ্ট দেওয়ার দরকার নাই। আমি খাইয়া আসছি। আপনি ঘুমায়া পড়েন। বড় কাশি হইছে দেখছি। ডাক্তার দেখাইছেন?’

‘না, কাশির আবার ডাক্তার কী! তুলসীপাতার রস খাচ্ছি। সেরে যাবে নে।’

মুজিব আলনা থেকে নিজের লুঙ্গি-গেঞ্জি নিয়ে কাপড় পাল্টালেন। পুকুরপাড়ে গিয়ে পানি তুলে হাতমুখ ধুলেন। তারপর শুয়ে পড়লেন।

কিন্তু তাঁর ঘুম আসছে না। ছটফট লাগছে। আজকে শামসুদ্দিন আহম্মেদের বাসায় অভ্যর্থনা কমিটির মিটিং ছিল। সেখানে তিনি হাজির হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘এই যে পোনে ছয় লাখ টাকা চাঁদা উঠল, এটা বাংলার গরিব মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকা। এই টাকা কেন আমরা করাচিতে পাঠাব! ওরা আমাদেরকে নতুন কলোনি বানিয়েছে। কথায় কথায় শোষণ করছে। আজ বাংলাজুড়ে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। মানুষ না খেয়ে আছে। আর আমরা টাকা খরচ করছি খাজা নাজিম উদ্দিনের সংবর্ধনায়! টাকা পাঠাচ্ছি জিন্নাহ ফান্ডে! আজ গোপালগঞ্জে কোনো কলেজ নাই। এই টাকায় আমরা কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।’

তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই অনেকেই, ‘আরে থামো মজিবর। তুমি খালি লেকচার দেও’, ‘স্যার খাজা সাহেব আসতেছেন আমাদের গোপালগঞ্জে, এ তো আমাদের সৌভাগ্য’ ইত্যাদি বলে তাঁকে বসিয়ে দেন।

বসিয়ে দিলেই বসে যাওয়ার পাত্র তো মুজিব নন। তিনি জানেন এর বিহিত কী করে করতে হবে। তাঁর পক্ষে আছে মানুষ। গোপালগঞ্জের মানুষ। কাল সকালেই কাজ শুরু করতে হবে। মানুষকে সংগঠিত করতে হবে।

আটাশের যুবক মুজিব এরই মধ্যে গোপালগঞ্জে তুমুল জনপ্ৰিয়। এখানে তিনি বহুদিন পড়েছেন মিশনারি স্কুলে, যুক্ত থেকেছেন এলাকাবাসীর ভালো-মন্দের নানা চড়াই-উতরাইয়ের সঙ্গে। স্কুল ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। শুধু যে গোপালগঞ্জে খেলেছেন তা নয়, হায়ারে খেলতে এদিক-ওদিকও গেছেন।

একবার তাঁরা ফুটবল খেলতে গেলেন পাইককান্দি ইউনিয়নের ঘোরদাইড়ে। গোপালগঞ্জ থেকে খেয়া নৌকায় করে যেতে হয়। খেলায় জিতল মুজিবদের দল। খেলা শেষে যখন খেয়া নৌকায় উঠলেন, ততক্ষণে চরাচরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে মসজিদে। আকাশে আলোর আভা আছে একটুখানি। হঠাৎ শুরু হলো ধূলিঝড়। মুজিব তখন নৌকার হাল ধরে আছেন। তাঁর সঙ্গে আমিন মামাসহ আরও কয়েকজন। প্রচণ্ড বাতাসে নৌকা বাঁক নিতে চাইছে। তিনি দুই হাতে শক্ত করে ধরে আছেন হাল। এই অবসরে তাঁর চোখ থেকে উড়ে গেল চশমা। তিনি চশমা ছাড়া প্রায় কিছুই দেখেন না। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘ও মামা, হাল ধরো, আমার চশমা পড়ে গেছে। আমি কিছুই দেখি না। আমিন মামা হাল ধরলেন। সবাই মিলে চশমা খুঁজতে লাগল নৌকার পাটাতনে। নাহ, পাওয়া গেল না। ওটা নদীর জলেই তলিয়ে গেছে কোথাও। নৌকা অপর পাড়ের ঘাটে ভিড়ল। কিন্তু তিনি হাঁটবেন কী করে। অন্ধকারে চোখে তো কিছুই দেখছেন না। শেষে হরিদাসপুর ডাকবাংলোয় রাত কাটাল কিশোর ফুটবলারের দল।

এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগলে ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই’ বলে স্লোগান দিয়ে এগিয়ে গেছেন স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়ে। গরিব ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য স্টুডেন্ট ইউনিয়ন গড়ে তুলে মুষ্টিভিক্ষা করে তহবিল জোগাড় করেছেন। আবার মুসলিম লীগের সম্মেলনে যখন নিজের শক্তি প্রয়োগের দরকার হয়েছে, তখন বিপুল কর্মীর সমাবেশ ঘটিয়ে সেটা করেও দেখিয়েছেন।

গত রাতেই মিছিল বের করেছেন, ‘নাজিম উদ্দিন ফিরে যাও’। এলাকার কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন পাড়ায় পাড়ায় খবর দেওয়ার জন্য। আগামীকাল কয়েক হাজার মানুষের বিক্ষোভ মিছিল বের করতে হবে। মুজিবুর ডাক দিয়েছেন, এলাকার টাকা এলাকার উন্নয়নে খরচ করতে হবে। সবাই যেন মিছিলে আসে।

খাজা নাজিম উদ্দিন আসছেন নদীপথে। আর পি সাহার গ্রিনবোটে আসবেন তিনি। এদিকে শহরের পরিস্থিতি খারাপ। হাজার হাজার লোকের মিছিল প্রদক্ষিণ করছে শহর। সবার মুখে এক স্লোগান : ‘নাজিম উদ্দিন ফিরে যাও’। চারদিক থেকে আরও মিছিল আসছে।

গ্রিনবোট যে ঘাটে ভিড়বে, সেই এলাকাটা ঘিরে রেখেছে পুলিশ। মিছিল সেই কর্ডন ভাঙার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে। পুলিশও বাঁশি বাজিয়ে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসছে। হাজার হাজার মানুষ। পুলিশের সাধ্য কী এই জনস্রোত রুখে দেয়! গ্রিনবোটে খাজা নাজিম উদ্দিন। নদীর ঘাটে মানুষের মিছিল আর স্লোগান। আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া।

খাজা নাজিম উদ্দিন বোটে বসেই টের পেলেন একটা কিছু অঘটন ঘটছে। তিনি জানতে চাইলেন পুলিশের কাছে, ‘হোয়াটস হ্যাপেনিং দেয়ার।’

‘দে আর হেয়ার টু ওয়েলকাম ইউ, স্যার।’

‘দেন হোয়াই আর দে থ্রোয়িং স্টোনস অ্যাট দ্য পুলিশ ফোর্স?’

‘দেয়ার আর সাম মিসক্রিয়ান্টস, স্যার।’

খন্দকার শামসুদ্দিন বললেন, ‘শেখ মুজিবর ইজ ক্রিয়েটিং ডিস্টারবেন্স, স্যার। দ্য ফলোয়ার অব সোহরাওয়ার্দী, দি এজেন্ট অব ইন্ডিয়া।

৫৬ বছর বয়সী শেরওয়ানি পরা খাজা নাজিম উদ্দিন বোটের ডেকে বসেছিলেন হাওয়া খেতে। তিনি তাঁর বাটারফ্লাই গোঁফটা নাড়তে লাগলেন। শেখ মুজিবকে তিনি চেনেন। হ্যাঁ, খুবই একরোখা ভয়ংকর ধরনের ছাত্রনেতা। তবে মুসলিম লীগেরই কর্মী। সেদিনও তো ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বলে স্লোগান দিয়েছেন। কিছুদিন আগেই তাঁকে কারাগার থেকে ছাড়া হয়েছে, যখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।

খাজার জন্ম আহসান মঞ্জিলে। তিনি বিলেতে লেখাপড়া করেছেন, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়েছেন। ‘নাইটহুড’ পেয়েছেন ইংরেজরাজের কাছ থেকে। অবিভক্ত বাংলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী মায় মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছিলেন। কিন্তু লোকে তাঁকে সরল-সোজা মানুষ বলেই জানত। আবুল হাশিম তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন, তিনি এতই সরল যে সেটাকে বলা যায় একেবারেই বোকা। মুসলিম লীগ সরকার যখন জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের কথা বলছিল, তখন তিনি দিনাজপুরের ভূস্বামীদের এক সভায় বলেছিলেন, ‘আপনাদের ভয় পাওয়ার কিছু নাই। ক্ষুধার্ত কুকুরকে হাড়গোড় কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে হয়, নাহলে তারা পুরো মাংসটাই নিয়ে যাবে; ফ্লাউড কমিশনের কাজও তেমনি।’ খাজা জীবনে কোনো নির্বাচনে জয়ী হননি। চলতেন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের বুদ্ধিতে।

খাজা বললেন, ‘শেখ মুজিবকে ডাকো, ওকে আমার কাছে আসতে বলো। ও কেন বিক্ষোভ করছে, আমাকে বলুক। আলোচনার মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান সম্ভব।’

শেখ মুজিব কয়েকজন কর্মী নিয়ে উঠলেন বোটে। বৈঠকে মুখোমুখি হলেন খাজার।

খাজা বললেন, ‘কেন তোমরা বিক্ষোভ করছ? কারণ কী?’

মুজিব বললেন, ‘আপনি জানেন না এই এলাকার মানুষ কত গরিব। এই গরিব মানুষদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা তোলা হয়েছে। সেই টাকা দেওয়া হবে জিন্নাহ ফান্ডে। অথচ এলাকায় একটা কলেজ নাই। এই গরিবের রক্তচোষা টাকা জিন্নাহ ফান্ডে জমা পড়লে কি কায়েদে আজমের সম্মান বাড়বে? নাকি একটা এলাকায় একটা কলেজ হলে তাঁর সম্মান বৃদ্ধি পাবে?’

খাজা বললেন, ‘আচ্ছা, আমি এই এলাকায় একটা কলেজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেব কালকের সভায়। কায়েদে আজম মেমোরিয়াল কলেজ। আর সেই কলেজের ফান্ডে বাকি টাকা রেখে দেওয়া হবে।’

‘থ্যাংক ইউ’ বলে মুজিব বেরিয়ে এলেন তাঁর কর্মীদের নিয়ে।

লুৎফর রহমান বললেন, ‘গোপালগঞ্জ এসেছ। টুঙ্গিপাড়া যাবা না?’

‘এইবার আর যাই না। গোপালগঞ্জ থেকে যেতে বেশি সময় লাগে। এর চেয়ে ঢাকা থেকে যেতেই সময় লাগে কম। আর ঢাকায় অনেক কাজ, আব্বা।

‘কী কাজ করতেছ? ওকালতিটা পড়তে বইলেছিলাম। পড়তেছ?’

‘ভর্তি তো হয়েছি ঢাকা ইউনিভার্সিটি। এলএলবি পড়তেছি। সেকেন্ড ইয়ার। দেখি।’

‘সাবধানে থাইকো, খোকা। তোমারে নিয়া সব সময় দুশ্চিন্তা করি। পুলিশ তো তোমার পিছনে লেইগে আছে। আবার কবে জানি অ্যারেস্ট হও।’

‘দেশের মানুষের ভালো থাকার জন্য কাউরে কাউরে কষ্ট করতে হয়, আব্বা। অন্যায় হইলে প্রতিবাদ না করলে সেইটাও অন্যায়। অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে/ তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’ রাতের বেলা ভাত খেতে খেতে পিতা-পুত্র কথা বলেন। তাঁদের সঙ্গে আরও কয়েকজন কর্মী খেতে বসেছেন। তাঁরা মুজিবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন খাওয়া ভুলে। হারিকেনের আলোয় তাঁরা দেখতে পান, গোপালগঞ্জের চরের লেঠেলদের কাঠিন্য আর পলিমাটির নরম পেলবতা একই সঙ্গে এই যুবকের মুখে খেলা করছে।

লুৎফর রহমান বলেন, ‘খোকা। চিরটাকাল আদালতে সেরেস্তাদারের চাকরি করতেছি। স্বপ্ন দেখি, তুমি জজ-ব্যারিস্টার হবা। ম্যাজিস্ট্রেট- এসডিও হবা। অন্তত ভালো উকিল হলিও তো খোকা তোমার আব্বার মুখটা উঁচু হয়।’

রহমত সরদার, গোপালগঞ্জের সরদারপাড়ার ২৩ বছরের যুবক, বহুদিন থেকেই মুজিবের সংগঠনের কর্মী, এক লোকমা ভাত মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে বলেন, ‘চাচা, আপনে চিন্তা কইরেন না। খোকা ভাইরে দেখে আসতিছি সেই ছোটবেলা থন। খোকা ভাইয়ের নিজের সাধ-স্বপ্ন সব আল্লাহ পুরা করে, আপনেরটেও করবা নে। কী কও, খোকা ভাই? আপনের মনে আছে না, রফিক সিনেমা হলের সামনের দোতলায় বইসে আপনেরে আমি কী বলছিলাম? বুঝলেন নাকি চাচা, খোকা ভাই তখন কলকাতা থেইকে মাঝেমইধ্যে আসেন, এই প্রত্যেক মাসের কুড়ি বাইশ তারিখে গোপালগঞ্জ আসতেন। আমাদের অ্যান্টি গ্রুপ মুকসুদপুরের সালাম খানের গ্রুপের মিটিং বড় হতো। একবার গিমাডাঙ্গা স্কুল মাঠে খোকা ভাই মিটিং দিয়েছেন। সব মিলে লোক হলো ১৭ জন। পথে আসার সময় আমি কলাম, মিয়া ভাই, এত কম লোকের মিটিং কইরে কী লাভ? দিনটাই মাটি! খোকা ভাই, সেদিন কী কছিলেন মনে আছে?’

মুজিব রহমত সরদারের দিকে তাকালেন। তাঁর মনে আছে।

রহমত সরদার বলেন, ‘খোকা ভাই সেই দিন বলেছিলেন, বুঝলেন চাচা, হতাশ হয়ো না। দেখবা আমার মিটিংয়ে একদিন লক্ষ লক্ষ লোক হবি নে! তো আইজকে দেখেন। হাজার হাজার মানুষ খোকা ভাইয়ের পিছনে মিছিল করতিছে। ‘৪৫ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব যেদিন এলেন, সেই মিটিংয়েও তো লক্ষ লোক হয়েছিল। নাকি হয়নি? তো, আপনার খোকা জজ-ব্যারিস্টার কেন, তার চেয়ে বড় বৈ ছোট কিছু হবে না নে। ব্যারিস্টার তো জিন্নাহ, ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী সাহেব সবাই। তাঁরা তো আবার মন্ত্রী-মিনিস্টারও হয়েছেন। আমাদের খোকা ভাইও হবিনে।

মুজিব একটু যেন লজ্জিত হন। মন্ত্রী হওয়ার জন্য তিনি আন্দোলন করছেন না। তিনি আন্দোলন করেন জুলুমের হাত থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাবেন বলে। জন্মের পর থেকেই দেখে আসছেন, দেশ পরাধীন। পরাধীন দেশকে মুক্ত করতে হবে, তাঁর গৃহশিক্ষক স্বদেশি আন্দোলন করতে গিয়ে জেল খেটে আসা হামিদ মাস্টার তাঁকে শুনিয়েছেন তিতুমীর, সূর্যসেন, ক্ষুদিরামের কাহিনি; মানুষের মুক্তির জন্য, দেশকে মুক্ত করার জন্য এসব বীর কীভাবে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় কলকাতায় নেতাজি সুভাষ বসু হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের দাবি জানান। তিনি সময়সীমা বেঁধে দেন—১৯৪০ সালের ৩ জুলাইয়ের মধ্যেই ওই মনুমেন্ট সরাতে হবে।

শেখ মুজিব জানার চেষ্টা করেন, হলওয়েল মনুমেন্টটা কী! কলকাতা থেকে খবরের কাগজ আসে এক দিন পর, কখনো কখনো দুই দিনও লাগে। তা-ই পড়ে পড়ে তিনি কিছুটা বুঝতে পারেন ব্যাপারটা। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৬ সালে নাকি কিছুসংখ্যক ইংরেজ বন্দীকে একটা ক্ষুদ্র কক্ষে আটকে রেখেছিলেন, যাতে তারা মারা যায় শ্বাসরোধের ফলে। ওই সৈনিকদের সম্মানে হলওয়েল মনুমেন্ট স্থাপন করা হয়েছিল কলকাতার ডালহৌসি স্কয়ারে। ওই মনুমেন্ট হলো পরাধীনতার চিহ্ন, ওটা সরাতে হবে—সুভাষ বসু ১৯৪০-এ ঢাকায় এলে ঢাকাবাসী নেতাজিকে বলল সেই কথা। নেতাজি বললেন, ‘ঠিক আছে, ওই মনুমেন্ট সরানোর ডাক দেব আমি।’

ডাক দিয়েছিলেন নেতাজি। বলেছিলেন, ‘সিরাজউদ্দৌলা স্মৃতি দিবস ৩ জুলাইয়ের মধ্যে হলওয়েল মনুমেন্ট নামের কলঙ্কচিহ্ন সরাতে হবে। না হলে ৩ জুলাই আমার বাহিনীর অভিযানে নেতৃত্ব দেব আমি।’

২ জুলাই নেতাজিকে গ্রেপ্তার করা হয়। সারা বাংলায় সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। গোপালগঞ্জেও এসে লাগে তার ঢেউ। স্কুলছাত্র মুজিব ও যোগ দেন মিছিলে। ‘হলওয়েল মনুমেন্ট, সরাতে হবে, সরাতে হবে’, ‘ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, হলওয়েল মনুমেন্ট’, ‘সুভাষ বসুর মুক্তি চাই’। মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বললেন, ‘আমি সুভাষকে ভালোবাসি। শ্ৰদ্ধা করি। আমরা সবাই তাঁর অনুরক্ত। এ দেশের রাজনীতিতে তিনিই সবচেয়ে জনপ্রিয়।’ শুধু কংগ্রেস কিছু বলল না। অথচ সুভাষ বসু পরপর দুই বছর সভাপতি ছিলেন কংগ্রেসের। কিন্তু হিন্দু, মুসলিম, বাঙালি এক হয়ে গেল সুভাষের মুক্তির প্রশ্নে। ওই গোপালগঞ্জেও রব উঠল : হিন্দু- মুসলিম ঐক্য, জিন্দাবাদ। সুভাষ বসু, জিন্দাবাদ।

সুভাষ বসু তখনই টানতে থাকেন মুজিবকে। এই নেতার সঙ্গে তাঁর দেখা করতে হবে। তাঁকে জানাতে হবে, তিনি চান ইংরেজদের তাড়াতে। সুভাষ বসু কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়। এই সুযোগ। মুজিব চলে যাবেন কলকাতায়, সোজা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দেখা করবেন নেতাজির সঙ্গে। নেতাজির খবর রোজ বেরোচ্ছে পত্রিকায়। ক্লাস নাইনের ছাত্র মুজিব সেসব পড়েন আর চূড়ান্ত করে ফেলেন তাঁর পরিকল্পনা। উঠে পড়েন গোয়ালন্দের স্টিমারে। গোয়ালন্দ দিয়ে ট্রেনে উঠে সোজা কলকাতা। সারা রাত ট্রেন চলল, সকালবেলা গিয়ে পৌঁছাল শিয়ালদা স্টেশনে। মুজিব ট্রেন থেকে নেমে খুঁজে পেতে হাজির হলেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ততক্ষণে ১০টা বেজে গেছে।

পুলিশ কর্মকর্তা অজয়কুমার বসু তখন সুভাষ বসুকে প্রহরাধীন ও নিরাপদ রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর কাছে একটা আবেদনপত্র পাঠাতে হবে। মুজিব কাগজপত্র জোগাড় করে দরখাস্ত লিখলেন : ‘আই হ্যাভ কাম ফ্রম গোপালগঞ্জ টু মিট নেতাজি। প্লিজ, অ্যালাউ মি টু মিট হিম।’

হাসপাতালের বড় সিঁড়ির দক্ষিণ পাশে অজয়কুমার দে ছাত্রটির সঙ্গে দেখা করেন। ছেলেটির চোখে চশমা। পরিধানে সাধারণ প্যান্ট-শার্ট। অজয়কুমার দের মনে হলো ছেলেটির বয়স ১৬-১৭ হবে। আসলে মুজিবের বয়স তখন ২০ বছর।

‘তোমার নাম কী?’ পুলিশ কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন। ‘শেখ মুজিবুর রহমান।’

‘তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?’

‘ক্লাস ওও-এ।’ (তখন নাইনকে ক্লাস ওও বলা হতো)

‘তুমি কেন শ্রীবসুর সঙ্গে দেখা করতে চাও?’

‘আমি নেতাজির ভক্ত। তিনি মহান ভারতীয় নেতা। তিনি মানুষের

সঙ্গে মানুষের কোনো ভেদাভেদ করেন না।’

‘আচ্ছা। খুব ভালো কথা। তিনি তো ভারতবর্ষে স্বরাজ চান। তুমিও কি চাও?’

‘হ্যাঁ। আমিও চাই ভারতবর্ষ শাসন করবে ভারতীয়রাই।’

‘তা করতে হলে তো সংগঠন করতে হবে। তুমিও নিশ্চয়ই সংগঠন করো।

‘আমি মুসলিম স্টুডেন্ট লীগ করি।’

‘কিন্তু তুমি তো নেতাজির ভক্ত। নেতাজির সংগঠন করো না?’

‘না, আমি নেতাজির সংগঠন করি না।’

‘করো নিশ্চয়ই। আমি জানি, নেতাজির সংগঠন করলে সেটা কাউকে বলতে হয় না। আমাকে বলতে পারো। কারণ, আমিও নেতাজিরই লোক। আমাকে বলতে কোনো অসুবিধা নাই।’

‘না, আমি মুসলিম স্টুডেন্ট লীগই করি। নেতাজির সংগঠন করি না। কিন্তু তাঁকে শ্রদ্ধা করি।’

‘তুমি কেন সত্য গোপন করছ। নেতাজির গোপন সংগঠনগুলোর খবর আমিই রাখি। তুমি আমাকে বলো। তুমি ফরোয়ার্ড ব্লক করো।’

মুজিব বুঝতে পারলেন, এই ভদ্রলোক আসলে পুলিশের লোক। এই অল্প বয়সেই কারাগার থেকে ঘুরে আসা মুজিব এদের সম্পর্কে যথেষ্টই ওয়াকিবহাল। তা ছাড়া সত্যি তো মুজিব নেতাজির সংগঠন করতেন না। কিন্তু মুসলিম-হিন্দুনির্বিশেষে সবাই তখন ভক্ত ছিল নেতাজির। ঢাকা থেকেই তো প্রথম হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের ডাক আসে। ইসলামিয়া কলেজের ছেলেরাই নেতাজিকে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ও সক্রিয় ছিল। তারা ধর্মঘট আর বিক্ষোভ করতে থাকলে পুলিশ তাদের ওপরে চড়াও হয়। লাঠিচার্জ করে। তখন তারা মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে শুরু করে। বেকার, কারমাইকেল আর ইলিয়ট হোস্টেলের ছেলেরা অশান্ত হয়ে উঠলে সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন হোস্টেলে চলে যান। খাজা ছিলেন ভিতু ধরনের মানুষ। গাড়ি থেকে নামেননি। ফজলুল হক গাড়ি থেকে নেমে হোস্টেলের দিকে যাত্রা শুরু করলে ছেলেরা তাঁর গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দেয় ওপর থেকে। বাতি নিভিয়ে দেয়। তা সত্ত্বেও ফজলুল হক ভেজা কাপড়ে ছেলেদের কাছে যান। এবং ছেলেদের কথা দেন, হলওয়েল মনুমেন্ট তিনি অপসারণ করবেন। ‘ছাত্রদের ওপর লাঠি চালানো মানে আমার নিজের বুকেই লাঠির ঘা বসানো। তোমরা আমার নিজের ছেলেরই মতো।’ তিনি বলেছিলেন।

ফজলুল হক কথা রেখেছিলেন। সেই রাতের অন্ধকারেই মনুমেন্টটা অপসারণের ব্যবস্থা করেছিলেন।

‘না, আমি ফরোয়ার্ড ব্লক করি না। আমি মুসলিম স্টুডেন্ট লীগই করি।’

পুলিশকর্তা বুঝলেন, ছেলেটা আসলেই কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়। তবে সব খবর রাখে। তরুণ হৃদয়ের মধ্যে খুব বড় আদর্শ ধারণ করে আছে এই ছেলেটা।

‘তোমার আদর্শবাদিতা আমার পছন্দ হয়েছে। তোমার মতো ছেলে আজকের দিনে সত্যি বিরল। তুমি দেশে ফিরে যাও। লেখাপড়া শেষ করো। নেতাজির সঙ্গে কারও দেখা করার নিয়ম নেই। থাকলে আমি অবশ্যই তোমার সঙ্গে তাঁকে দেখা করিয়ে দিতাম।’

মুজিব সেদিন চলে এসেছিলেন। কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার পাত্র তো তিনি নন। জীবনে যা করবেন বলে মনস্থ করেছেন, তা তিনি করেই ছেড়েছেন। তিনি প্রায়ই কলকাতা যাতায়াত করতে লাগলেন। একদিন গেলেন মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের কাছে। তাঁর বন্ধু প্রাণতোষের বাবা অকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। বিধবা মা আর প্রাণতোষ ছাড়া তাঁদের সংসারে কেউ নেই। প্রাণতোষের মা তাঁকে ধরলেন, ‘বাবা, তুমি তো মুসলিম লীগ করো, ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে। তুমি না ওনার সাথে ডাকবাংলোয় দেখা করেছ। তুমি না ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্রলীগের সহসভাপতি। প্রাণের একটা চাকরির ব্যবস্থা তুমিই কইরে দিতে পারো, বাবা।’

প্রাণতোষ আর তাঁর বিধবা মাকে নিয়ে মুজিবকে যেতে হয়েছিল কলকাতায়। দেখা করতে হয়েছিল ফজলুল হকের সঙ্গে, তাঁর ঝাউতলার বাসায়। পুলিশ কর্মকর্তা অজয়কুমার দের সঙ্গে আবার দেখা তাঁর। তিনি বললেন, ‘তোমাকে পরিচিত মনে হচ্ছে? কী যেন নাম তোমার?’

‘শেখ মুজিবুর রহমান।’

‘কোথায় যেন বাড়ি তোমার, পদ্মার ওই পারে?’

‘গোপালগঞ্জ।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। কেন এসেছিলে?’

‘এই যে আমার বন্ধু প্রাণতোষের বাবা মারা গেছেন। বিধবা মাকে নিয়ে ও বড় কষ্টে আছে। ওর একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে…’

‘কী বললেন চিফ মিনিস্টার।’

‘সাথে সাথে ফোন করলেন ইলেকট্রিক সাপ্লাই অফিসে। হয়ে যাবে একটা হিল্লে। এখন যাচ্ছি ওখানে।’

তো, সেবার প্রাণতোষকে নিয়েই ব্যস্ততা গেল। পরের বার, হ্যাঁ পরের বার, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ৩৮/২ এলগিন রোডের বাড়ির সামনে মুজিব ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। নেতাজি তখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ওই বাড়িতে গৃহবন্দী। ফাঁক খুঁজতে লাগলেন, নজরদারিতে একটু শিথিলতা নিশ্চয়ই হবে। ধোপা, ফেরিওয়ালারা তো বাড়িতে যাচ্ছে আসছে। এক ফাঁকে মুজিব ঢুকে গেলেন বাড়ির ভেতরে। আরও দর্শনার্থী ছিল তখন ওই ঘরে। কথা তেমন হয়নি।

‘আমি আপনার আদর্শের একজন ভক্ত, আপনার সঙ্গে দেখা করতে গোপালগঞ্জ থেকে এসেছি। গোপালগঞ্জ স্কুলে পড়ি। আপনার আদর্শের সঙ্গে একাত্মতা জানাতে এসেছি।’ মুজিব বললেন।

নেতাজি বলেছিলেন, ‘তোমার মতো তরুণেরাই তো দেশের আশা। তুমি চলে যাও। পুলিশ দেখে ফেললে তোমাকে অযথা অ্যারেস্ট করবে। হয়রানি করবে।’

‘আশীর্বাদ করবেন। নমস্কার।’ মুজিব বেরিয়ে এলেন।

তখনই আবার নজরে পড়ে গেলেন অজয়কুমার দের। পুলিশের কাজই সন্দেহ করা। শেখ মুজিবকে অনুসরণ করে অজয় দে পোস্ট অফিস পর্যন্ত গেলেন। তাঁকে বললেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান না?’

‘জি।’

‘নেতাজির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে?’

‘হ্যাঁ। এটা আমার একটা স্বপ্ন ছিল, আমি একবার নেতাজিকে কাছ থেকে দেখব। সাক্ষাৎ হয়েছে।’

‘কেন সাক্ষাৎ করলে, বলো তো?’

‘আমি তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্গে সলিডারিটি প্রকাশ করলাম। ‘ সহজভাবে বললেন মুজিব। পুলিশকর্তা অজয়কুমার দেও সহজভাবেই নিলেন বলে মনে হলো। তিনি আর কিছু বললেন না। মুজিবও বিদায় নিলেন।

সত্যি, বড় আদর্শই মুজিবকে টেনে এনেছে রাজনীতিতে। জজ- ব্যারিস্টার, মন্ত্রী-মিনিস্টার হওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি রাজনীতি করছেন না।

রাতের খাওয়া সারা হয়ে গেলে কর্মীদের বিদায় দিলেন মুজিব। সবাই যার যার বাড়িতে, হোস্টেলে চলে গেল। মুজিব আর লুৎফর রহমান বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন।

.

পরের দিন গোপালগঞ্জ টাউন মাঠে খাজা নাজিম উদ্দিনের জনসভা। পাকিস্তান মিনার উদ্বোধন শেষে এই জনসভায় তিনি বক্তৃতা করতে ওঠেন। তিনি ঘোষণা দেন, ‘এই মহকুমা শহরে একটা কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। কলেজের নাম হবে ‘কায়েদে আজম মেমোরিয়াল কলেজ’। এই কলেজের ফান্ডে আমি আপনাদের চাঁদার দুই লাখ টাকা তহবিল এখন থেকেই জমা করে গেলাম। বাকি খরচ এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে দেওয়া হবে।’

‘কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’, ‘খাজা নাজিম জিন্দাবাদ’ স্লোগান আসতে থাকে মঞ্চ থেকে।

জনতাও সেই জিন্দাবাদ ধ্বনির সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়।

অচিরেই সেই স্লোগান ‘শেখ মজিবর জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

৩৪.

ব্যাঙ্গমা বলে, ‘দুইজন আলাদা আলাদাভাবে কাজ কইরা চলছে।’

ব্যাঙ্গমি বলে, ‘আমি জানি দুইজন কে?’

ব্যাঙ্গমা বলে, ‘কও তো কে?’

ব্যাঙ্গমি বলে, ‘তুমি কও।’

ব্যাঙ্গমা বলে, ‘শেখ মুজিব আর তাজউদ্দীন। শেখ মুজিব পাকিস্তান হওয়ার প্রথম দিন থাইকাই জানেন, এই স্বাধীনতা স্বাধীনতা না। আরেকটা স্বাধীনতার জন্য তাঁর লড়াই শুরু হইল মাত্র। সিরাজউদ্দৌলা হোস্টেলে ছাত্রকর্মীদের ডাইকা তিনি এই কথা বলছিলেন। আর অনেক পরে, একই কথা কইবেন অন্নদাশঙ্কর রায় নামের এক বিখ্যাত লেখককে। তত দিনে বাংলা স্বাধীন হইয়া গেছে। শেখ সাহেব তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্ৰী। অন্নদাশঙ্কর রায় জিগাইলেন তাঁরে, “বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এল?”

“শুনবেন?” মুচকি হাসি দিয়া শেখ মুজিব কইলেন, “সেই ১৯৪৭ সালে। তখন আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি আর শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন তাঁরা। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় এই প্রস্তাবে। আমিও দেখি যে উপায় নেই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে শুরু করি। তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই। কিন্তু আমার স্বপ্ন কেমন করে পূর্ণ হবে, এই আমার চিন্তা। তখন স্বপ্ন পূরণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। লোকগুলো যা কমিউনাল। বাংলাদেশ চাই বললে সন্দেহ করত। হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলা ভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে পাক-বাংলা, কেউ বলে পূর্ব বাংলা। আমি বলি, না, বাংলাদেশ।”’

ব্যাঙ্গমি বলে, ‘হ্যাঁ, এই তো সেই দিন, নারায়ণগঞ্জ ছাত্রলীগের সম্মেলনে তিনি পূর্ব বাংলাকে বাংলাদেশ বইলা ডাকেন

ব্যাঙ্গমা বলে, ‘আর তাজউদ্দীন, গত বছরেই, ২৯ মার্চ ৪৮, বিকেলবেলা কার্জন হলে ছাত্রনেতা অলি আহাদ, নাঈমউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আলোচনা-তর্কবিতর্কে মাইতা উঠলেন। তাজউদ্দীনের কথা হইল, আদৌ স্বাধীনতা পাওয়া যায়নি। অলি আহাদ সেইটা মানতে চাইলেন না।’

ব্যাঙ্গমি বলল, ‘শেখ মুজিব কইরা চলল মিছিল-মিটিং আন্দোলন- সংগ্রাম। জেল-জুলুম, পুলিশের লাঠির বাড়ি কিছুই তাঁরে দমাইতে পারে না। তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে সরকারের একের পর এক চক্রান্তের কারণে তাঁর রাগ আরও বাড়ছে।’

ব্যাঙ্গমা বলল, ‘আর তাজউদ্দীন কইরা চলল পেপার ওয়ার্কস। নানা রকমের মেনিফেস্টো তৈরি করা, পুস্তিকা ছাপানো, মুসলিম লীগ না নতুন দল—এই সব তর্কবিতর্কে রইল মাইতা। শেখ মুজিব যেইখানেই যায়, লোকে তাকে ঘিরা ধরে। তাজউদ্দীন কাজ করে টেবিলে টেবিলে, ঘরের মধ্যের আলোচনায়। তবে তার এলাকায়ও যায়। সভা করে। ঢাকাতেও সভাসমিতি আলোচনা দেনদরবারে অংশ নেয়।’

ব্যাঙ্গমি বলল, ‘ইতিহাস দুইজনরে এক করব। আরও পরে।’

বাতাস ওঠে। আমগাছের পাতা নড়ে, শাখা দোলে। আমের গাছে মুকুল এসেছে। মুকুলের গন্ধে একটা মাদকতা আছে। ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি সেই গন্ধভরা বাতাস বুক ভরে টেনে নেয়। তাদের ভালো লাগে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *