যারা ভোর এনেছিল – ২০

২০

যুব সম্মেলন হবে আবুল হাসনাতের বাড়িতে।

সম্মেলনের এই স্থান ঠিক করা হয়েছিল যে সভায়, সেটার কথা তাজউদ্দীনের খুব মনে পড়ে। ঘটনার শুরু একটা চিঠি থেকে।

কলকাতা থেকে চিঠি এসেছে কামরুদ্দীন আহমদের কাছে।

কামরুদ্দীন আহমদের বয়স মধ্য তিরিশ, গোলগাল প্রসন্ন মুখশ্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ করে আইন পড়েছেন। মুন্সিগঞ্জের এই মানুষটা থাকেন পুরান ঢাকায়, দারুণ সক্রিয় রাজনীতিতে। ’৪৭-এর আগে করতেন মুসলিম লীগের আবুল হাশিম গ্রুপ, যাদের বলা হতো বামপন্থী। আগে ছিলেন স্কুলশিক্ষক। এখন পুরোদস্তুর আইনজীবী কাম রাজনীতিবিদ। ২২ বছরের দিব্যকান্তি গোলগাল নাতিদীর্ঘ তরুণ তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী। কামরুদ্দীন আহমদ কয়েক বছর আগে ১৫০ মোগলটুলীতে মুসলিম লীগের অফিস খুলেছেন, যাকে তাঁরা বলেন পার্টি হাউস। তিনতলা বাড়ির দোতলায় পার্টি হাউস। নিচতলায় কাগজের দোকান। এর আগে মুসলিম লীগের ঢাকার সব কাজকর্ম পরিচালিত হতো আহসান মঞ্জিল থেকে। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম ঢাকার প্রগতিশীলদের উদ্বুদ্ধ করেন মুসলিম লীগ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে। তাঁরই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কামরুদ্দীন আহমদরা এই পার্টি হাউস খোলেন।

তাজউদ্দীন আহমদ ফুলটাইম কর্মী। আর পার্টটাইম কর্মীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন কুমিল্লার ছোটখাটো শুকনো এক যুবক, তাঁর নাম খন্দকার মোশতাক আহমদ।

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি আমগাছের ডালে বসে খুনসুটি করে। হঠাৎ ব্যাঙ্গমা কণ্ঠস্বরে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলে,

আলোকের পাশে পাশে থাকে অন্ধকার,
তাজউদ্দীনের পাশে আছে খন্দকার ॥
খন্দকার তাজউদ্দীন দুজনের দিকে,
লক্ষ্য রাখতে হবে ঐতিহাসিকে ॥
আজ তারা পাশাপাশি করছেন কাজ,
খন্দকারের সহিত আমাদের তাজ ॥
একদা তাজউদ্দীনে হত্যার অর্ডার
৩১ বছর পর দেবে খন্দকার ॥

‘কলকাতা থেকে আসা চিঠিতে বলা হয়েছে’—কামরুদ্দীন সাহেব পায়চারি করেন আর বলেন, ‘বামপন্থী যুবকদের নিয়ে একটা সংগঠন করতে। সে জন্য ঢাকায় একটা কনফারেন্স করতে বলছে।’

তাজউদ্দীন আহমদের কপালে ভাঁজ পড়ে।

তাঁরা আলোচনায় বসেছেন পার্টি হাউসেই। আরও দু-চারজন নিয়মিত বিশ্বস্ত কর্মী সেখানে উপস্থিত।

খুব সতর্ক থাকতে হচ্ছে। কারণ, এখন বামপন্থীদের সমাবেশ করার চেষ্টা মানেই খাজা নাজিম উদ্দিনের গুন্ডাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া।

কামরুদ্দীন বলেন, ‘শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক পর্যন্ত এই গুন্ডাদের ভয়ে আলাদা বাসাও নিতে পারছেন না, ঘর থেকে বের হয়ে আইন ব্যবসাও করতে পারছেন না। অথচ উনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী আর লাহোর কনফারেন্সে পাকিস্তানের প্রস্তাবক।’

তাজউদ্দীন বলেন, ‘হ্যাঁ, ফজলুল হক সাহেব যেদিন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে আসেন, সেদিন তাঁকে গুন্ডারা কালো পতাকা দেখিয়েছে।’

কামরুদ্দীন বলেন, ‘উনি যাতে বাসা ভাড়া করতে না পারেন, সেই জন্য নাজিম উদ্দিন নিয়ম করেছে, এখন প্রাদেশিক রাজধানীর জন্য বাড়ি দরকার, কোনো বাড়ি ভাড়া দিতে হলে সরকারের পারমিশন লাগবে। শেরেবাংলাকে বাড়িভাড়া দেওয়ার পারমিশন কেউ পাচ্ছে না।’

তাজউদ্দীন বলেন, ‘স্যার সলিমুল্লাহর ভাগনে সাহেবে আলম ট্রাকে করে আদালত প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়েছিল। কারণ কী? কারণ, ফজলুল হক সাহেব নাকি জিন্নাহ সাহেবকে খর-দজ্জাল বলেছিলেন।’

কামরুদ্দীন বলেন, ‘শেরেবাংলার পক্ষে এটা বলা সম্ভব। কারণ, আমি একদিন শেরেবাংলার সাথে দেখা করতে বার লাইব্রেরিতে গেছি। উনি বললেন, ‘খর-দজ্জালের চেহারা কেমন হবে, তা তোমরা জানো! তার এক চোখ কানা, স্বর্গে এক পা আর মর্ত্যে এক পা থাকবে।’ নাম বলেননি। কিন্তু আমরা বুঝলাম। জিন্নাহ তো একচোখো চশমা ব্যবহার করেন। তাঁর এক পা পশ্চিম পাকিস্তানে, এক পা পূর্ববঙ্গে।’

তাজউদ্দীন বললেন, ‘ফজলুল হক তাঁর লাহোর প্রস্তাবে বলেছিলেন মুসলমানপ্রধান দেশ নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা, ‘স্টেটস’ বলেছিলেন, জিন্নাহ সেটাকে বানালেন প্রিন্টিং মিস্টেক, বানালেন একটা পাকিস্তান, আর ফজলুল হকও প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হতে পারলেন না, সব মিলিয়ে জিন্নাহর ওপরে ফজলুল হকের রাগ তো থাকতেই পারে।’

‘আরে শুধু রাগ,’ কামরুদ্দীন বলেন, ‘উনি কী করেন, জানো, একবার পকেট থেকে আট শ টাকা হারিয়ে গেল। উনি লিখে রাখলেন, জিন্নাহ ফান্ড আট শ টাকা, রিকশাওয়ালা হাইকোর্টে যাবার ভাড়া চাইল বারো আনা, হাইকোর্টে পৌঁছে বলল, দিতে হবে এক টাকা, উনি দিলেন এক টাকা, আর বাড়ি ফিরে নোট রাখলেন, রিকশাভাড়া বারো আনা, জিন্নাহ ফান্ড চার আনা। আমি একদিন তাঁর নোটবই দেখে অবাক। আপনি জিন্নাহকে সারা দিন গালি দেন, আবার জিন্নাহ ফান্ডে টাকা দান করেন। উনি বললেন, ‘যে টাকা চুরি হয়, যে টাকা লোকে আমাকে ঠকিয়ে নেয়, সে সবই তো জিন্নাহ ফান্ডে যায়, নইলে যায় কোথায়। হা হা হা।’ তাহলে আমরা কোথায় করতে পারি যুব সম্মেলন?’

একজন কর্মী বলেন, ‘বার লাইব্রেরিতে।’

‘আরে বললাম না, বার লাইব্রেরিতেও সাহেবে আলম গুন্ডা নিয়ে হামলা চালায়’—কামরুদ্দীন সাহেবের চোখেমুখে উদ্বেগ।

‘তাহলে?’

কামরুদ্দীন বললেন, ‘একমাত্র উপায়, মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান হাসনাতের বাসায় করা। হাসনাত রেগে আছেন মুখ্যমন্ত্ৰী খাজার ওপরে। কারণ, খাজা সাহেবে আলমকে এখন মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান করতে চান।’

‘সেটাই ভালো।’ উপস্থিত সবাই এই প্রস্তাবে সমর্থন জানালেন।

এইভাবে এই সম্মেলনের স্থান নির্ধারিত হয়।

সম্মেলন আগামীকাল। আজ তাই পার্টি অফিসেই ব্যস্ত সময় কাটছে তাজউদ্দীনসহ ঢাকার অনেক যুবকর্মীর।

প্রতিনিধিরা আসছেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে, তাঁদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন তাঁরা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে বিরামহীভাবে।

এরই মধ্যে একমাথা বৃষ্টি নিয়ে হাজির হলেন শেখ মুজিব।

কলকাতা থেকে এসে এই প্রথম তাঁর পার্টি হাউসে আসা।

মুজিবকে দেখে সবাই হইহই করে ওঠে।

মুজিব সবার সঙ্গে হাত মেলান। প্রত্যেকের নাম ধরে ডাকেন। কথা বলেন। অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি লোকটার। তাজউদ্দীন খেয়াল করছেন। যাকে তিনি একবার দেখেছেন, তার নামই কি তাঁর মনে থাকে!

তাজউদ্দীনের দিকেও এগিয়ে আসেন মুজিব। ‘কী খবর, তাজউদ্দীন, খাজা নাজিম উদ্দিনের আজাদ পাকিস্তান কেমন লাগছে?’

তাজউদ্দীন হাত বাড়িয়ে মুজিবের সঙ্গে করমর্দন করলেন। প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। উত্তর তাঁদের দুজনেরই জানা। উর্দুভাষী নাজিম উদ্দিন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, এটা তাঁদের পছন্দ নয়। নবাব পরিবারই দেশ শাসন করবে, এটাও না। আর পাকিস্তানিরা ব্রিটিশদের মতো বাংলাকে উপনিবেশ বানিয়ে তুলুক, সেটাই বা কে চায়। কিছু না বলে বরং তাজউদ্দীন মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুললেন। শেখ মুজিব বললেন, ‘উজিরে আলার মর্জি। ভালোই আছ। হা হা হা।’

মুজিব কথা বলছেন। অফিসের সবাই তাঁকে ঘিরে ধরল। মুজিব বললেন, ‘আসার সময় লিডারের সাথে দেখা করে এসেছি। সোহরাওয়ার্দী সাহেব বলেছেন, “তুমি যাও। গ্রাউন্ড ঠিক করো। সময়মতোই এই পূর্ব বাংলায় আমি আসব”।’

.

বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানি, একটু পর প্রচণ্ড গর্জন। আজ আর বাসায় ফেরা হবে না। পার্টি হাউসের মেঝেতেই শুয়ে পড়েন তাজউদ্দীন

কিন্তু তাঁর ঘুম আসতে চাইছে না। নানা কথা মনে পড়ছে। কিছুদিন আগে, পাকিস্তানের স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিন দশেকের মাথায় তিনি গিয়েছিলেন ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে। নতুন স্বাধীনতা পেয়ে লোকজন চেষ্টা করছে সবকিছু সুন্দর করে তুলতে। স্টেশনে গিয়ে দেখা গেল, সুন্দর নিয়ম করা হয়েছে। টিকেট বা প্ল্যাটফরম টিকেট ছাড়া কেউ প্ল্যাটফরমে যেতে পারবে না। কিন্তু সমস্যা হলো, গাড়িভাড়া নিয়ে গাড়িঅলা আর যাত্রীদের মধ্যে বচসা চলছে। কলকাতা থেকে লোকজন আসছে, তাদের স্টেশন থেকে ঢাকার বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দিতে গাড়িচালকেরা অনেক বেশি ভাড়া চাইছে। এর একটা প্রতিকার করতে হবে। একটা ট্রাক ভাড়া করতে হবে। কিন্তু এ কী!

আপার ক্লাসের প্রবেশপথের মেঝেতে একজন উলঙ্গ বৃদ্ধা পড়ে আছেন। মৃত্যুপথযাত্রী। কেউ তাঁর দিকে খেয়াল করছে না। তাজউদ্দীন মিটফোর্ড হাসপাতালে টেলিফোন করলেন। সাড়া পেলেন না। তিনি ছুটলেন হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা বললেন, ‘আমাদের তো কিছু করার নাই।’ লীগ অফিসে গিয়ে আবারও ফোন করলেন একজন সহকারী স্টেশনমাস্টারকে। তিনি আশ্বাস দিলেন ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তারপর তাজউদ্দীন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কলকাতা থেকে আসা কর্মকর্তাদের রেলওয়ে স্টেশনে অভ্যর্থনা জানানোর ব্যবস্থা করতে। একটা ট্রাক জোগাড় করলেন ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকা থেকে। ট্রাকের গায়ে সাঁটালেন মুসলিম লীগের ব্যানার। ট্রাক নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন মেইল ট্রেনের জন্য। ট্রেন এলে নীলক্ষেত, পলাশী ব্যারাক আর চকবাজারে দুটো ট্রিপ দেওয়া হলো।

পরের দিন তাজউদ্দীন আবার গিয়ে দেখলেন, ওই বৃদ্ধা পড়েই আছেন মেঝেতে। তিনি গেলেন স্টেশনমাস্টারের খোঁজে। পাওয়া গেল সহকারী মাস্টারকে। সহকারী মাস্টার নোট দিলেন রেলওয়ে পুলিশ আর ডেপুটি মেডিকেল অফিসারকে। কেউ কর্ণপাত করলেন না। তিনি এবার ফোন করলেন ডিএমওকে। সহকারী স্টেশন ম্যানেজারের নোট নিয়ে তাঁর সতীর্থ শামসুদ্দিন দেখা করলেন ডিএমওর সঙ্গে। তিনি আবার যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আরেকটা নোট দিলেন।

সকাল ১০টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত তাজউদ্দীন আর শামসুদ্দিন দৌড়াদৌড়ি করলেন বিভিন্ন অফিসারের কাছে, বিভিন্ন শাখায়। এর নামই আমলাতন্ত্র!

সন্ধ্যার সময় গিয়ে দেখা গেল মহিলা ওখানে নাই। প্রশাসন ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই হয়তো প্রকৃতিই ব্যবস্থা নিয়ে ফেলেছে। জায়গাটা পরিষ্কার। আর পরিষ্কার ছিল সন্ধ্যার পরের আকাশ।

কিন্তু তাজউদ্দীনের মনের ভেতর থেকে ময়লা যায় না। ২২ বছরের যুবক, রাজনীতি করেন। ‘কিন্তু মানুষের দুঃখ যদি দূর করতে না পারি, কিসের রাজনীতি?’ তাজউদ্দীন ভাবেন।

আস্তে আস্তে পার্টি হাউসের মেঝেতে তাজউদ্দীন ঘুমিয়ে পড়লেন।

পরের দিন আবুল হাসনাতের বাড়িতে প্রতিনিধি সভা শুরু হয় দুপুরে।

পার্টি হাউস থেকেই সবাই সরাসরি যান সম্মেলনে যোগ দিতে।

.

বাইরে তখন খাজা নাজিম উদ্দিনের সমর্থকেরা ট্রাকে করে শহরময় মিছিল করছে। স্লোগান দিচ্ছে এই যুব সম্মেলনের বিরুদ্ধে, ‘ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার, সাবধান, পাকিস্তান ধ্বংসের চক্রান্ত বন্ধ করো, বন্ধ করো।’ স্লোগানে স্লোগানে গুন্ডারা ঢাকার আকাশ আচ্ছন্ন করে ফেলছে।

প্রচণ্ড বৃষ্টি এসে তাদের সেই বিষোদ্‌গারকে ধুয়েমুছে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

২১

টুঙ্গিপাড়ায় ফিরছেন শেখ মুজিব। নৌকায় চড়ে। ঢাকা থেকে প্ৰথমে লঞ্চ। লঞ্চঘাট থেকে নৌকা। এই হলো বাহন। বেশ সময় লেগে যায়। দিনে দিনে টুঙ্গিপাড়া পৌঁছানো যায় না। ফরিদপুর থেকে গোপালগঞ্জ যাতায়াত করতেই লাগে ৬০ ঘণ্টা।

এখন তাঁর নৌকা ভাসছে বাইগার নদীতে। মধুমতীর শাখা এই বাইগার তাঁকে মধুমতী থেকে নিয়ে যাচ্ছে টুঙ্গিপাড়ায়। হেমন্তকালের বিকেল। নদীর দুধারে সবুজ ধানখেত। ধানগাছে শিষ এসেছে। তবে পুষ্ট হয়নি শিষের ধান। বাতাসে ঢেউ খেলে যাচ্ছে ধানখেতে। দূরে দূরে ঘরবাড়ি। গাছগাছড়ায় ছাওয়া সবুজে ঢাকা ঘরদোরগুলো। কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তালগাছ। সুপারিগাছ আর বাঁশঝাড়ও চোখে পড়ে খুব। মাছরাঙা ঝাঁপিয়ে পড়ছে পানিতে, তারপর ঠোঁটে মাছ ধরে উড়াল দিচ্ছে আকাশে। পানকৌড়ি আর ডাহুকও দেখা যাচ্ছে কখনো কখনো। পানকৌড়ি ডুব দিচ্ছে, আবার জেগে উঠছে পানির ভেতর থেকে। দূরে আধো ডোবা ধানখেতে একটা সাদা বক।

চরাচরজুড়ে কাশবন। কাশফুলে সাদা হয়ে গেছে সব। এত নরম, এত শুভ্র, এত বিস্তারিত।

কতগুলো গরু সাঁতরে নদী পার হচ্ছে। তাদের পেছনে ভাসছে একটা রাখাল। রোজ সকালে গরু নিয়ে সাঁতরে নদী পার হয়ে চরে আসে এরা। সারা দিন গরু চরিয়ে আবার সাঁতরে নদী পার হয়ে ঘরে ফেরে গরু আর গরুর রাখাল।

নৌকার পাটাতনে বসে আছেন মুজিব। তাঁর চশমা পরা চোখ বাংলার অপূর্ব নিসর্গশোভা তৃষিতের মতো পান করে চলেছে। তাঁর পরনে পাঞ্জাবি আর পায়জামা। ২৭ বছরের পরিপূর্ণ যুবক বহুদিন পর বাড়ি ফিরছেন। মধ্যিখানে কিছুদিন রেনুই গিয়ে থেকে এসেছেন কলকাতায়।

কলকাতায় আর যাওয়া পড়বে না। এর মধ্যে রেজাল্ট হয়ে গেছে। বিএ পাস করেছেন তিনি। ঢাকা থেকে তাই মিষ্টি কিনে নিয়েছেন কয়েক সের। শুকনো লাড্ডু নিয়েছেন, যাতে দেরি করে বাড়ি পৌঁছালেও নষ্ট না হয়।

বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে তাঁর মেসের ঠিকানায়। তাঁর একটা মেয়ে হয়েছে। মেয়ে হওয়ার খবর পেয়েই তিনি বাড়ির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন।

ঢাকায় থাকলে কাজ থাকবেই। পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়েছে। তার কমিটিতে তিনিও আছেন। মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল অংশ কেন্দ্রে আর প্রদেশে ক্ষমতায়। তারা এরই মধ্যে নানা ধরনের অথর্বতা আর বাঙালিবিরোধিতার স্বাক্ষর রেখেছে যথেষ্ট পরিমাণে। তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করতে হবে। সে জন্য চাই সংগঠন। চাই কর্মসূচি। নেতৃত্বও দরকার। লিডার সোহরাওয়ার্দী খুব তাড়াতাড়ি আসছেন না। এ কে ফজলুল হক তো ঘর থেকেই বের হতে পারছেন না গুন্ডাদের অত্যাচারে। আরেকজন আছেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সিলেটের রেফারেন্ডামের সময় তাঁর সঙ্গে সিলেটেই পরিচয়। মানুষকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা আছে তাঁর। এই সময়ের কর্তব্য কী, সেটা আগে স্থির করা দরকার। তো সেসব করতে গেলে ঢাকায় থাকতে হয়। কিন্তু এই কাজের কোনো শেষ নাই, বিরামও নাই। মেয়ের জন্মের খবর পেয়েই তাই শেখ মুজিব বেরিয়ে পড়েছেন টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে।

লঞ্চে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এদের অনেককেই তিনি চেনেন। অনেকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হলো। মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়া, তাদের খোঁজখবর করা—এই সব তাঁর মজ্জাগত অভ্যাস। আর এই যে পরিচিত হলেন, এদের আর আজীবন ভুলবেন না তিনি।

নৌকায় আরও জনা ছয়েক যাত্রী। টুঙ্গিপাড়ার যাত্রীদের সবাইকেই তিনি চেনেন। তরুণদের চেনেন না, কিন্তু তাদের বাবা-মাকে চেনেন। গল্প করতে করতেই যাচ্ছেন তিনি। ‘কী রে হাশেম আলী, তোর কী খবর? তোর বড় চাচার যে পা ভেঙেছিল জামগাছ থেকে পড়ে, পা ঠিক হয়েছে? খোঁড়ায়া হাঁটে। আবদুল মজিদের কী খবর। তুই না মাদারীপুরে দোকান দিয়েছিলি। কিয়ের দোকান? মনোহারি? আছে দোকান?

‘গোপালের কী খবর। ছেলেটার নাম যেন কী? নেপাল। খুব ভালো গানের গলা না?’

‘মজিদ চাচা দেখি অনেক শুকিয়ে গেছেন। গালটা বসে গেছে। থুতনির ডগায় দাড়ি আগাছার মতো।’ মুজিব নৌকার মাথার গলুইয়ে বসা বছর পঁয়তাল্লিশের একজনকে দেখে মনে মনে ভাবেন।

‘চাচা, ও মজিদ চাচা, নীল রঙের পাঞ্জাবিটা তো ভালো পরেছেন।’ মজিদ হাসেন। বলেন, ‘বাবা, তুমি এত দিন পরে আইলা। ভালো আছো তো, বাবা।’

‘জি চাচা, আপনাদের দোয়া।’ মুজিব একটু বাঁ দিকে সরে বসেন। সবাই ডান দিকে সরে আসায় নৌকার ডান পাশটা হেলে আছে।

মজিদ বলেন, ‘বাবা মজিবর, তোমার লাইগা আমি প্রত্যেক নামাজের ওয়াক্তে দোয়া করি। বাবা, তুমি জানো, তুমি আমার ছোট পোলাটার জান বাঁচাইছিলা। সেই যে গেরামে খুব আকাল পড়ল, বাবা, কারও ঘরে খাওয়া নাই। তুমি আমগো বাড়ি গেলা। গিয়া কইলা, ‘লাল মিয়া আছে নাকি।’

‘লাল মিয়া তো তখন খিদায় আধমরা। আর অর ছোটটা ফুল মিয়া, সে মারা যায় যায়। কিছু খায় নাই। খালি ‘খিদে লেগেছে, খিদে লেগেছে’ বইলে কান্দে। অর মা ওরে কলার থোর সেদ্ধ কইরে দিয়ে কয়, ‘খা।’ তুমি বাবা, ফেরেশতার মতো এইসে পড়লে। বললে, ‘কী হয়েছে। ফুল মিয়া কান্দে কেন।’ আমি কই, বাবা, ঘরে কিছু নাই। খাতি দিতি পারি না। তাই কান্দে।

‘তুমি বললে কি, ‘চলো আমার সাথে। আমাদের গোলায় তো ধান চাউল আছে।’ তুমি আমারে ডেইকে নিলে। ‘আসো আসো, চাউল দিমু।’ শুনে আমগো বাড়ির আরও তিনজন তোমার পিছে পিছে দৌড় ধরল। বাবা, কী করব, কারও ঘরে তো খাবার নাই। তুমি গিয়ে গোলাঘর খুইলে আমগো চাউল দেওয়া শুরু করলে। আমি লুঙ্গির কোছা ভইরে চাউল নিলাম। অরা তিনজনও নিল। সেই সময় এলেন তোমার বাপে। কয়, খোকা, কী করো।’ তুমি বললে, ‘লাল মিয়া, ফুল মিয়া না খায়া আছে, বাবা। অগো চাউল দেই।’ তোমার বাপে হাসব না কানব বুঝতে পারে না। আমি কই, ‘ভাইজান, পোলায় ডাইকে এনে দিয়েছে। কইলে ফেরত দেই।’ লুৎফর ভাই কয়, ‘ক্যান, ফিরত দিবা ক্যান। আমার পোলায় কি তোমাগো ফেরত দেওনের লাইগা দিছে। শেখ বাড়িতে এয়েছ আশা নিয়া। নিরাশ হইয়ে ফিরত যাবা?’ সেই দিন ওই চাউলটা না পাইলে ফুল মিয়া মইরেই যাইত, বাবা। তোমারে অনেক দোয়া করি। তোমার শত বছর পরমায়ু হোক।’

মুজিবের চোখ ছলছল করে ওঠে। আহা রে আমার বাংলার গরিব মানুষ! কত অল্পে খুশি! কত কম তাদের চাওয়া! খালি একটু মুখের অন্ন পেলেই ওরা সুখী। এই সুখটাই তাদের কেউ দিতে পারল না!

রেনু ভালো আছে তো? মেয়েটা কেমন আছে? আহা রে! প্রথম বাচ্চাটা বাঁচল না। বেঁচে থাকলে আজকে বছর দেড়েক বয়স হতো। তিনি স্বামী হিসেবে, বাবা হিসেবে তো ভালো না। স্ত্রী-সন্তানের খোঁজখবর তো ঠিকভাবে নেন না।

যে কন্যাকে তিনি এখনো দেখেননি, তার জন্য তার বুকের ভেতরটা মাঝির বৈঠার আঘাত পাওয়া নদীর পানির মতো ছলাৎ ছলাৎ করে উঠছে। পড়ন্ত বিকেলবেলার রোদ শুয়ে আছে কেবল শিষ আসা ধানগাছগুলোর বুকের পরে, আকাশ ঘন নীল, মাঝেমধ্যে সাদা মেঘ, দিগন্তব্যাপী যেন মায়া আর মায়া।

তিনি অকারণে বিড়বিড় করতে থাকেন—

গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে!
দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়, কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায় ভাঙে দু ধারে-
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।

তিনি তাঁর সদ্যোজাত কন্যাটিকে দেখেননি। অথচ ‘মনে হচ্ছে সে আমার কত দিনের চেনা।’ কেন এমন হয়! নিজের মেয়ে বলে? নিজের অস্তিত্বেরই একটা উৎসারণ বলে।

নৌকা ঘাটে ভেড়ে। তার বাক্স দুইটা বহন করার জন্য নৌকাযাত্রীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যায়। তিনি মাঠ পেরিয়ে বাড়ির খোলায় ওঠেন। সূর্য অনেকটা হেলে পড়েছে। আলোর রং হলুদ। কাচারিঘরের টিনের চালটাকে হলুদ নদীর ঢেউ বলে মনে হচ্ছে।

সাদা গাভির পাশে একটা সাদা রঙের বাছুর। মা তার সন্তানের গা চাটছে পরম যত্নে। বাছুরটা গা এলিয়ে দিয়ে সেই আদর উপভোগ করছে।

মায়া, মায়া! এই জগৎটা মায়ার বন্ধনে জড়ানো।

তাকে ঘাট থেকে উঠে আসতে দেখে এরই মধ্যে বাড়িতে বাড়িতে খবর রটে গেছে। বাচ্চাকাচ্চারা সব ছুটে ছুটে আসছে। বউঝিরাও মাথায় কাপড় তুলে দিয়ে উঁকি দিচ্ছে, কেউ বলছে, ‘মিয়া ভাই, মাইয়া খুব সুন্দর হইছে, যান, ঘরে যান।’ কেউ বলছে, ‘মজিবর, আইলা, একেবারে পাকিস্তান বানায়া তারপর আইলা!’

একজন বলে, ‘মজিবর, বাবা, এত শুকায়েছ কেন!’

শেখ মুজিব নিজেদের বাড়ির উঠানে পা রাখেন। মা ছুটে আসছেন রান্নাঘর থেকে। ‘কেমন আছো, বাবা?’

‘ভালো আছি, মা, তোমাদের দোয়ায়। তোমরা কেমন আছো?’

মা আসেন। ছেলেকে জড়িয়ে ধরেন। মায়ের গায়ে একটা অদ্ভুত গন্ধ। মনে হয়, আলোয়ার গন্ধ।

‘বাবা কই, মা? গোপালগঞ্জে?’

‘হ্যাঁ, বাবা। গোপালগঞ্জ। যাও, বাবা, ঘরে যাও। বউমা তোমার মাইয়ারে খাওয়ায়।’

মুজিব নিজের ঘরে যান। পাকা ঘর। সুন্দর নকশা করা দেয়াল, স্তম্ভ। ছোট্ট কিন্তু সুন্দর।

বারান্দায় উঠে তিনি আওয়াজ দেন, ‘রেনু, আমি এসে গেছি।’

রেনু বলেন, ‘আসো।’

বাইরের আলোকিত প্রাঙ্গণ থেকে ঘরে ঢুকে প্রথমে তাঁর মনে হয় ভেতরটা বেশ অন্ধকার। তারপর তাঁর চোখ ধাতস্থ হলে তিনি দেখতে পান, বিছানায় রেনু অর্ধশায়িত। তাঁর কোলে ফুটফুটে একটা বাচ্চা।

মা বারান্দা থেকে বললেন, ‘নাতনি আমার মাশাল্লাহ সুন্দর হইছে। সেই জন্য তোর বাবা তার নাম রাখছে হাসিনা। হাসিনা মানে সুন্দর।

মুজিব বাচ্চাটাকে অনভ্যস্ত হাতে কোলে তুলে নেন। তাঁর বুকের কাছে ধরে বাচ্চার চোখের দিকে তাকান। তাঁর বুকটা ভরে ওঠে

২২

রেনু বাচ্চা নিয়ে রোদে আসেন। রোজ সকালবেলা উঠানে মাদুর পেতে হাসুর ছোট্ট শরীরে রোদ লাগান, হাতে-পায়ে সরষের তেল মাখিয়ে দেন দাদি। রেনু পাশে বসে তাঁকে সাহায্য করেন।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য উপভোগ করেন মুজিব।

ছেলে এসেছে। নতুন ধান কাটার নির্দেশ দিয়েছেন লুৎফর রহমান। উত্তরের ভিটায় একটা খেতে আগাম ধান ওঠে। তার বিছনই ওই রকম।

ধান কেটে মাড়াই করে আটা কোটা হবে। তারপর বানানো হবে পিঠা। নারকেলগাছে চড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শামসু গাছিকে। লুৎফর রহমান সেসবের তদারক করছেন।

সায়রা বেগম বলেন, ‘বউমা, আজকে পোলাও রান্ধি, কী কও?’

রেনু বলেন, ‘আপনি যেটা ভালো মনে করেন, মা।’

সায়রা বেগম বাচ্চাটার হাত-পা একখানে করে একটু শরীরচর্চা মতো করেন। মুখে বলেন, ‘তাইলে তো মোরগ ধরা লাগে। জয়নাল কই, জয়নাল।’

জয়নাল তাঁদের গৃহপরিচারকের নাম।

লুৎফর রহমান সাহেব আসেন। জয়নাল তাঁর পেছনে পেছনে। জয়নালের দুহাতে অনেক নারকেল।

লুৎফর রহমান বলেন, ‘আরে, গাছের কেউ যত্ন-আত্তি করে নাকি? ঠিকমতো গাছ পরিষ্কার না করলে নারিকেল হয়! জয়নাল মিয়া কোনো কামের না।’

মুজিব হাসেন।

বাবা বলেন, ‘খোকা, বিএ তো পাস করলা? এইবার কী করবা?’ মুজিব বলেন, ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হব, বাবা।’

‘ভালো। বিএ-তে সাবজেক্ট কী নিছিলা?’

‘হিস্ট্রি আর পলিটিক্যাল সায়েন্স।’

‘ভালো। এইবার ল ন্যাও। আমার বড় শখ, বাবা, তোমারে অ্যাডভোকেট বানাব। বোঝো তো, আদালতে সেরেস্তাদারি করি। দেখি তো। উকিলদেরই সম্মান। আর তুমি তো পলিটিক্সও করবাই। উকিল হইলে পলিটিক্স করা যায় ভালো। তোমার নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেব, শেরেবাংলা, কায়েদে আজম—সবাই তো উকিল-ব্যারিস্টার। তাই না?’

‘জি, বাবা।’

‘তুমি ওকালতি পড়তে পারো না?’

‘আপনি যখন, বাবা, শখ করছেন, নিশ্চয়ই আমি চেষ্টা করব। ঢাকায় গিয়া এবার আমি ল-তেই ভর্তি হব।’

এরই মধ্যে বাড়িতে ভিড় জমতে থাকে। মুজিবের শৈশবের বন্ধুরা খবর পেয়ে গেছেন। তাঁরা আসছেন। মুসলিম লীগের মাঠপর্যায়ের কর্মীরাও আসছেন দল বেঁধে। আর আছে সাহায্যপ্রার্থীদের দল। তারা জানে, মজিবরের কাছে চাইলে না শুনতে হবে না।

জয়নাল লেগে পড়ে মোরগ ধরতে। পাড়ার আর ছেলেমেয়েরা তাকে সহায়তা করে। মোরগটার অবস্থান আঙিনাতেই। চারপাশ থেকে সবাই মোরগটাকে ঘিরে বৃত্ত রচনা করে। তারপর বৃত্তটা ছোট করে আনতে থাকে।

কাচারিঘরে দর্শনার্থীদের ভিড়ে বসে নতুন দিনের কর্তব্য সম্পর্কে কথা বলতে বলতে মুজিব শুনতে পান মোরগের কক কক আওয়াজ। সবাই হুল্লোড়ও করে উঠছে। মোরগটা ধরা পড়েছে।

.

রাতের বেলা মুজিবের সঙ্গে দুটো কথা বলার সুযোগ পান রেনু। ঘরের এক কোণে একটা আলমারি। আর একটা ছোট্ট টেবিল। টেবিলের ওপরে রাখা লন্ঠন। কেরোসিনের গন্ধ আর আলো ছড়াচ্ছে বাতিটা।

বিছানায় বসে মেয়ের কাঁথা বদলাতে বদলাতে রেনু বলেন, ‘তুমি এবার একটু বেশি দিনের জন্য থাকতে পারো না, হাসুর আব্বা!’

মুজিব হাসেন। ‘ও গো, হ্যাঁ গো, তার আগে দুলা। এখন থেকে হাসুর আব্বা! আচ্ছা, তাহলে এবার আমিও তোমাকে আর রেনু না বলে বলব হাসুর মা।

‘আমার প্রশ্নের জবাব তো পেলাম না!’

‘কোন প্রশ্ন। এবার বেশি দিন থাকা! না গো। ঢাকায় অনেক কাজ!’

‘এত দিন দেশ পরাধীন ছিল। এত দিন না হয় কাজ ছিল। তুমি কলকাতায় ছিলা। সেইখানে তোমার লিডার ছিলেন। কিন্তু ঢাকায় কী?’

‘এই স্বাধীনতা তো স্বাধীনতা না, হাসুর মা। আমার আসল লক্ষ্য স্বাধীন পূর্ব বাংলা। লিডাররে কলিকাতা থেকে ঢাকায় নিয়া আসব। উনি আসবেনও কিছুদিনের মধ্যে। শান্তিমিশন নিয়া। এর মধ্যে আন্দোলন- সংগ্রাম করে পার্টি গড়তে হবে।’

‘আবার জেলে যাবা না তো?’

‘যেতে হলে যাব। আমি তোমাকে বলছি না, যে মৃত্যুরে, জেল- জুলুমরে ভয় পায় না, তাকে কেউ দাবায়া রাখতে পারে না।

‘তোমার কিন্তু এখন একটা মেয়ে আছে।’

‘আমার মেয়ের একটা মা-ও আছে।’

‘খালি মিষ্টি মিষ্টি কথা।’

‘দাঁড়াও। পড়াশুনাটা শেষ করে নেই। তারপর ঢাকায় বাসা নিয়া তোমাকে নিয়া যাব। এরপর আর তোমাকে গ্রামে থাকতে হবে না।’

‘গ্রামে থাকতে আমার কোনোই আপত্তি নাই। বাবা আছেন। মা আছেন। তাঁরা আমাকে খুব যত্ন কইরেই থুয়েছেন। তোমারে লাগবে না। আর তা ছাড়া আমি বাবা-মা মরা মেয়ে। মা আমারে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছেন। উনিই আমার মা। উনিই আমার বাবা।

‘বিয়া হয়ে গেলে নিজের মেয়েও তো ঘরে থাকে না। থাকে?’

‘আচ্ছা। যুক্তি মানলাম। তুমি বললে যাব। তুমি তো রাজনীতি করবা। গ্রেপ্তার হবা। তখন আমার কী হবে?’

‘তুমি চাও না আমি রাজনীতি করি? তাইলে কি আমি লক্ষ্মী ছেলের মতো ল পড়া শেষ করে কালো কোট পরে ওকালতি করব। তাইলে তুমি সুখী হবা?’

‘না। একটু আগে না তুমি বললা দেশ এখনো স্বাধীন হয় নাই। তোমার আসল লক্ষ্য পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা। তুমি দেশের কাজ করতে নামছ। দেশের কাজই করবা। আমার কথা ভেবে তোমারে ওকালতি করা লাগবে না।’

‘আমি জানতাম, তুমি এই রকমই বলবা। কিন্তু তুমি কী বুঝতেছ। বলো তো।’

‘বাবা রেডিওর ব্যাটারি কিনা এইনেছেন। উনি যখন বাড়িতে আসেন, খবর শুনেন। আমরাও শুনি। খবর তো আগেও শুনেছি, তাই না? কিন্তু আজকাল রেডিও পাকিস্তানের খবর শুনে তো কিছুই বুঝি না। উজিরে আলা ফরমাইয়াছেন। মানে কী। বাবা বলেন, এর মানে হলো প্রধানমন্ত্রী হুকুম করেছেন। সদরে রিয়াসাত মানে কী? বলেন, দেশের প্রধান। সংবাদরে বলেন এলান। ছবিরে বলে তসবির। আমি আর কইতে পারছি না গো। তুমি বাবারে জিগোও। শুনলে হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে যাবানে।’

‘তুমি ঠিকই ধরেছ। খাজারা কোনো ঘোষণা না দিয়াই চুপে চুপে উর্দু ব্যবহার করা শুরু করে দিয়েছে। খামে, পোস্টকার্ডে সব জায়গায় উর্দু আর ইংরাজি। পুরা পাকিস্তানের জনসংখ্যার মধ্যে বাঙালিরা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। বাংলা হবে সরকারি ভাষা। কিন্তু অরা উর্দু চাপায়া দিতে চায়। ঢাকায় এই নিয়া ছাত্ররা অসন্তুষ্ট। এই নিয়া আন্দোলন শুরু করা দরকার। মওলানা ভাসানী আছেন সন্তোষে। আবুল কাশেম ফজলুল হক বাইর গুন্ডাদের ভয়ে। হইতে পারতেছেন না খাজা নাজিম উদ্দিনের গুন্ডাদের সোহরাওয়ার্দী সাহেব খোঁজ পাঠাইছেন ঢাকায় আসা যাবে কি না। ফলে ছাত্রদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।’

‘তুমি এমএটা শেষ কইরো।’

‘সে আমি জেলখানায় গিয়াও শেষ করতে পারব। তুমি চিন্তা কইরো না। রাজনীতিকদের জন্য জেলখানাই পড়াশোনা করার আসল জায়গা। আসল পাঠশালা।

‘তোমার একটা মেয়ে হয়েছে। এইটা যেন খেয়াল থাকে।’

‘আমার একটা বউ আছে। সে কি বুঝবে না যে স্বামী দেশের কাজ করে?’

‘বুঝবে।’

রাত বাড়ে। দূরে কাশবনে শিয়াল হুক্কাহুয়া বলে ডাকে। পাল্লা দিয়ে ডেকে ওঠে গৃহস্থবাড়ির কুকুরের দল। তারা হঠাৎ থেমে গেলে চারদিক নিস্তব্ধ বলে মনে হয়। শুধু কানে আসে ঝিঁঝির একটানা ডাক।

ঘুমের জাদুকরি স্পর্শ এসে মুদে দেয় সব কটা চোখ।

টুঙ্গিপাড়ার শেখবাড়ির আঙিনায়, খুলিতে, খালে, বাইগার নদীতে, কাশবনে, চরে, ঘুমন্ত ধানখেতে জোছনা পড়ে থাকে বালিতে শুকোতে দেওয়া চাদরের মতো।

২৩

অগ্রহায়ণ মাস শেষ হয়ে আসছে। শীত পড়ছে। তাজউদ্দীনের শরীরটা ভালো নয়। প্রচণ্ড কাশি। সারা দিন নিমতলীর মুসলমান ছাত্রদের মেসে নিজের বিছানায় শুয়ে রইলেন তাজউদ্দীন। দেয়ালে শেওলা পড়েছে। সেই শেওলার দিকে তাকিয়ে থাকলে নানা কিছুর আকার কল্পনা করে নেওয়া যায়। একটা ভেড়ার মুখ যেন দেখা গেল ওই ওখানটায়। সে দিকে তাকিয়ে থেকে সাত-পাঁচ ভাবছেন তাজউদ্দীন।

১৫০ মোগলটুলীর পার্টি অফিসে যাঁরা আসেন, তাঁদের মধ্যে একটা শুকনো পটকা তরুণকে প্রথম দেখাতেই কেন যেন অপছন্দ হয় তাজউদ্দীনের। কোনো বিশেষ কারণ নাই। কুমিল্লা থেকে এসেছেন তিনি। ’৪৬-এর নির্বাচনের সময় কুমিল্লা অঞ্চলের পার্লামেন্টারি কমিটির সদস্যও ছিলেন। মানে মুসলিম লীগ থেকে কারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, সেটা ঠিক করবার দায়িত্ব কমিটির অন্যদের সঙ্গে তার ওপরও পড়েছিল। তরুণটির নাম খন্দকার মোশতাক আহমদ। তাঁকে অপছন্দ হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে?

তাজউদ্দীন ভাবেন। প্রথম দেখাতে তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ‘আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?’ মোশতাক জবাব দিয়েছিলেন, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম, আল্লাহ মুসলমানদের সব সময় ভালো রাখেন। আলহামদুলিল্লাহ।’ তাজউদ্দীনের জবাবটা কেন যেন পছন্দ হলো না। তাজউদ্দীন নিজে কোরআনের হাফেজ, এখনো দরদরিয়া গ্রামে গেলে মসজিদে ইমামতি করেন, কিন্তু আল্লাহ শুধু মুসলমানদের ভালো রাখবেন, অন্যদের ভালো রাখবেন না, আর আল্লাহ মুসলমানদের সব সময় ভালোই রাখবেন, খারাপ রাখবেন না, এটা একটু বেশি সরলীকরণ হয়ে যায় না? আল্লাহ তো সবারই প্রভু। সর্বজনীন ও শাশ্বত। তবু তাজউদ্দীন ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবিত হতেন না, যদি না দেখতেন, পরক্ষণেই যখন কামরুদ্দীন আহমদ জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই যে খন্দকার, কেমন আছেন?’ তখন তিনি জবাব দিলেন, ‘আপনার দোয়া, কামরুদ্দীন সাহেব। আপনি আমার ওপরে সব সময় দোয়া রাখবেন। তাহলেই আমি ভালো থাকব।

কামরুদ্দীন সাহেবও খেয়াল করেছিলেন কথা বলার ধরনটা। পরে তিনি বললেন, ‘তাজউদ্দীন, আপনাকে একটা কথা বলে রাখি। এই ছেলে বহুদূর যাবে। মোসাহেবির একটা খুব বড় প্রতিভা নিয়া সে কুমিল্লা থেকে ঢাকা শহরে পা রেখেছে।’

সত্যি সে তরতরিয়েই এগোচ্ছে। কলকাতা থেকে মুসলিম লীগের আবুল হাশিমপন্থী তথা প্রগতিশীল যেসব ছাত্র আসছে, তাদের জন্য একটা ওয়ার্কার্স ক্যাম্প খোলা হয়েছে। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাহেব আছেন তাতে, উনি আপাতত নেতৃত্বে বেশ এগিয়ে। আছেন শেখ মুজিব, কিন্তু তাঁর সঙ্গে আছেন এই খন্দকার মোশতাকও। এই লোক এই গ্রুপে না থেকে যদি থাকত প্রতিক্রিয়াশীল, খাজার তল্পিবাহক শাহ আজিজের সঙ্গে, তাহলেই যেন তাকে মানাত। বয়সে তিনি মুজিব ভাইয়ের চেয়েও বড়।

শাহ আজিজ সম্পর্কে আবুল হাশিম সাহেব সেবার ভালো বলেছিলেন। আবুল হাশিমকে তাজউদ্দীনের সব সময় মনে হয় একজন অন্ধ হোমারের মতো, যাঁর নিজের চোখের জ্যোতি কমে আসছে, অথচ যে কিনা আলো দেখাচ্ছেন বেপথু মুসলিম বাঙালিকে।

বিভাগ-পূর্বকালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম কাছে থেকে দেখেছেন শাহ আজিজকে। কারণ, শাহ আজিজ কলকাতায় আশ্রয় গেড়েছিল। হাশিম বলেছিলেন, ‘শাহ আজিজ আড়ালে আমাকে গালি দেয় কমিউনিস্ট বলে, আর সামনাসামনি দেখা হলে বলে, “হাশিম ভাই, আমি আপনার আদর্শের অনুসারী।” একই অবস্থা খুলনার আবদুস সবুর খানের। তিনি আসলে খাজা নাজিম উদ্দিনের তল্পিবাহক, আর আমাকে মনে করে সন্ত্রাসবাদীদের পৃষ্ঠপোষক ও ঘোরতর কমিউনিস্ট। খাজা নাজিম উদ্দিনেরও তা-ই ধারণা। শাহ আজিজকে প্রথম দেখি ঢাকায় ডা. ময়েজউদ্দীনের বাড়িতে। তখন তাঁর বাবরি চুল। তাঁর সঙ্গে কথা বললাম। মনে হলো, এর ওপরে আস্থা রাখা যায় না।’

মুজিব ভাই দুই চোখে দেখতে পারেন না শাহ আজিজকে। কুষ্টিয়ার সম্মেলনে শাহ আজিজের মুখে ঘুষি মেরেছিলেন। সেদিন বললেন, কলকাতার দাঙ্গায় শাহ আজিজেরা খুবই খারাপ ভূমিকা পালন করেছে। খাজা ঘোষণা দিয়েছিল, এই অ্যাকশন হিন্দু আর কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, সেই কথাটা শাহ আজিজেরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। আর আবুল হাশিম সাহেব বলেছিলেন, এই আন্দোলন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, জিন্নাহ সাহেব পর্যন্ত বলেছেন, শান্তি রক্ষা করা হবে, সোহরাওয়ার্দী নিজের প্রাণ বিপন্ন করে দুর্গত হিন্দু এলাকায় গিয়েছিলেন।

তাজউদ্দীন শেখ মুজিবকে এই কথার পিঠে বলেছিলেন, ‘এমনিতে খাজা কিন্তু খুবই ভিতু। গফরগাঁওয়ে দেখেছিলাম না, এমারত পার্টির পক্ষে যখন হাজার হাজার মানুষ রামদা আর বল্লম নিয়ে রেলস্টেশন ঘেরাও করল, খাজা থরথর করে কাঁপছিলেন। একমাত্র সোহরাওয়ার্দী সাহেব ওদের দিকে চোখ রেখে নির্ভীক চিত্তে সোজা হেঁটে গেছেন।’

.

একটা টিকটিকি দেয়ালে নড়াচড়া করছে। মাকড়সার জালে একটা পোকা আটকে আছে। তাজউদ্দীন সেই দিকে তাকান। টিকটিকি কি ওই পোকাটাকে খেয়ে নেবে? মাকড়সা কষ্ট করে জাল পাতল, আর শিকারটাকে ভোগ করবে টিকটিকি? ডিম পাড়ে হাঁসে, খায় বাগডাশে।

তাজউদ্দীন পাশ ফিরে শোন।

আবার তাঁর মনের মধ্যে নানা ভাবনা ঘুরপাক খায়।

মুসলিম লীগ প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনে পরিণত হয়ে আছে। সরকার হয়ে পড়েছে আমলানির্ভর। দুই অংশে দুই সাবেক আইসিএস অফিসার দেশ চালাচ্ছে। জিন্নাহ তাঁর পাকিস্তান হওয়ার পর প্রথম বক্তৃতায় বলেছিলেন, পাকিস্তান কোনো ইসলামিক দেশ হবে না, হবে ইসলামি সাম্যের আদর্শভিত্তিক দেশ, এখানে মুসলিম হিন্দু খ্রিষ্টান ইত্যাদি পরিচয় বড় নয়, বড় পরিচয় হবে পাকিস্তানি।

জিন্নাহর পক্ষেই এই রকম বক্তৃতা দেওয়া সম্ভব। পোশাকে-আশাকে পুরোপুরি সাহেব। কংগ্রেসই করতেন। লোকে তাঁকে কোনো দিন নামাজ পড়তে দেখেনি। মদ্যপান করেন নিয়মিত। তাঁর মতো কেতাদুরস্ত মানুষ কমই আছে। তিনি হিন্দি বলতে পারেন না, উর্দু বলতে পারেন না। পাকিস্তান তাঁর বাড়ি নয়। জন্ম বোম্বেতে, কেউ বা বলে করাচিতে। তাঁর বাবা ছিলেন গুজরাটি ব্যবসায়ী আর দাদা ছিলেন হিন্দু রাজপুত। করাচি খ্রিষ্টান মিশনারি স্কুলে পড়ে বোম্বের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক করেন। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়েন, এশিয়ার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে ১৯ বছরের মধ্যেই ইংল্যান্ডের বারে যোগ দেন। বোম্বেতে তাঁর প্র্যাকটিস ছিল খুবই ভালো, ব্যারিস্টারি করে তিনি খুবই নাম করেছিলেন। এই রকম একটা আধুনিক লোক যখন দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচার করেন এবং একটামাত্র টাইপরাইটার নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন বলে দাবি করেন, তখন বুঝতে হবে তাঁর মধ্যে গন্ডগোল আছে। সেটা আর কিছু না, তাঁর শ্রেণীগত সীমাবদ্ধতা, উপনিবেশি শিক্ষার কুফল।

এই স্বাধীনতা স্বাধীনতা নয়। তাজউদ্দীন আবার বলেন। বিছানা থেকে তিনি উঠে বসেন। উঠে গিয়ে রান্নাঘরে পিপে থেকে গেলাসে পানি ঢালেন। পানি খান।

কী করা উচিত তাঁদের এখন?

‘৪৭-এর ১৫ আগস্টের আগেই তাঁরা গণ-আজাদি লীগের পক্ষে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলেছেন। এই দাবি আজকের নয়। ১৭৭৮ সালে ব্রিটিশ লেখক নাথানিয়েল ব্র্যাসি হলহেড অ্যা গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাংগুয়েজ লিখেছিলেন। তখন উপমহাদেশের রাষ্ট্রভাষা ছিল ফারসি। হলহেড সাহেব তাঁর ব্যাকরণ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, ফারসির বদলে বাংলাকে রাজভাষা করা হলে কোম্পানি সরকারের সুবিধা হবে। আজ থেকে ৩০ বছর আগে শান্তিনিকেতনে এক আলোচনা সভায় হিন্দুস্তানের লিংগুয়া ফ্রাংকা হিন্দিই হওয়া উচিত বলে মত উঠলে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর বিপরীতে বাংলাকে লিংগুয়া ফ্রাংকা করার পক্ষে তাঁর মত তুলে ধরেছিলেন। তাঁর পরপরই সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ব্রিটিশ সরকারকে চিঠি লিখে জানান, ভারতের অন্য অংশে যা-ই করা হোক না কেন, বাংলার রাষ্ট্রভাষা বাংলাই হওয়া উচিত। আর গত ১০ বছরে দৈনিক আজাদসহ বিভিন্ন পত্রিকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে অনেক লেখালেখি হয়েছে। এটা বাঙালিদের আলোচনা ও বিবেচনার মধ্যে আছে যে বাংলার রাষ্ট্রভাষা বাংলাকেই করতে হবে। এখন মুসলিম লীগের ক্ষমতাসীন লোকেরা কেন সেটা ভুলে যাওয়ার ভান করছেন, তাজউদ্দীনের বোধগম্য হচ্ছে না।

ঢাকায় বুদ্ধিজীবীরা তমদ্দুন মজলিস গড়ে তুলেছেন। অধ্যাপক আবুল কাসেম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ আছেন এই দলে। তাঁরা বাংলার পক্ষে লিফলেট বের করেছেন। তাঁদের ঘোষণাপত্র সমাবেশের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে। অধ্যাপক আবুল কাসেম, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদের মতো অধ্যাপক-সাংবাদিকেরা এতে প্রবন্ধ পাঠ করেছেন। কাজী মোতাহার হোসেন বলেই দিয়েছেন, ‘বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা করা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হওয়ার আশংকা রয়েছে।’

এই সব কাণ্ড যখন ঘটছে, তাজউদ্দীন তখন দরদরিয়ায়। তবে তিনি সব খবরই পান। সাইকেল নিয়ে একবার পার্টি অফিস, একবার কামরুদ্দীন সাহেবের বাসা, সর্বত্র ঘুরে বেড়ানো আর সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা তাঁর স্বভাব।

এর মধ্যে এঁরা শতাধিক বুদ্ধিজীবীর স্বাক্ষর সংগ্রহ করে প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে এসেছেন। এঁরা এখন গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন। এই স্বাক্ষর মুখ্যমন্ত্রীকে দেওয়া হবে। তারপর আজ থেকে দিন চারেক পর এঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসভা আহ্বান করেছেন। এতে যোগ দিতে হবে।

মুজিব ভাই গ্রামের বাড়ি গেছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়াটা এক বিরাট প্রেরণাদায়ী ব্যাপার। তিনি বলেন, ‘তাজউদ্দীন, আমি হলাম আমার নেতা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ফলোয়ার। উনি হলেন অ্যাকশনের মানুষ। আমিও অ্যাকশনে বিশ্বাস করি। থিয়োরি দিয়ে জগৎ চলে না। ধরো, মার্ক্সবাদীরা, তারা কিন্তু জানে বলশেভিক পার্টির সদস্যসংখ্যা কত, কিন্তু জানে না, পদ্মা নদী এপার-ওপার করতে কী লাগে! আবুল হাশিম সাহেব একটা পাঠচক্র খুলেছিলেন। তাতে তিনি নানা কিছু পড়াতেন। কলকাতায় থাকতে আমিও যেতাম। রাতের বেলা ক্লাস হতো। সবাই লেকচার শুনত। আমি ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম থেকে উঠে ফেরার সময় জিজ্ঞাসা করতাম, আগামীকাল সকালে কী করতে হবে, সেইটা বলেন। যা বলেছেন, তা-ই করেছি। কত বড় বড় গুন্ডাপান্ডা একা সামলেছি। আবুল হাশিম সাহেবকে তো একদিন মেরেই ফেলেছিল খাজাদের গুন্ডারা, আমি একলা গিয়া তাদের সামনে দাঁড়ায়েছি। সোহরাওয়ার্দী সাহেব আমাকে বললেন, “ফরিদপুর গোপালগঞ্জে খাজাপন্থীদের তিনজন বড় চামুণ্ডা আছে, ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া, সালাম খান আর ওয়াহিদুজ্জামান। তুমি ওইখানে আমাদের বামপন্থী লিডারশিপ প্রতিষ্ঠা করো। তোমার কাজটাই সবচেয়ে শক্ত। আমি একা। ওরা সব রামদা-সড়কি-বল্লম নিয়া প্রস্তুত। আমার এক হুংকারে সব সোজা। তোমার নীতি যদি ঠিক থাকে, আদর্শ যদি সৎ হয়, সাহস নিয়া দাঁড়াবা। কেউ তোমার সাথে পারবে না”।’

এইখানে এসেও তিনি শুধু অ্যাকশন খুঁজছেন। ভাষার প্রশ্নে অ্যাকশনের সূত্র তিনি বোধ হয় পেয়েই গেলেন। এবার তিনি নামবেন।

কিন্তু আমি কী করব? তাজউদ্দীন ভাবেন। তিনি ছাত্রলীগ করেন না। সরাসরি মুসলিম লীগ করেন। যদিও বয়স এখন কেবল ২২। সামনের বছর ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবেন। তবে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে নয়, প্রাইভেটে। এখনো তাঁর প্রিয় হবি সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো। মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়েন সাইকেল নিয়ে। নতুন ঢাকার দিকে যান। রমনার বিস্তৃত সবুজের মধ্যে সাইকেল চালাতে তাঁর কী যে আরাম লাগে। একেক দিন চলে যান মগবাজারের দিকে। পুরোটাই জঙ্গল। তারপর আবার তাঁদের পরিচিত ঢাকা শহর। এক লাখ লোকের এই শহর। ছয় বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে। আরেকটু বিস্তৃত করে যদি শহরটার আয়তন বাড়িয়ে নেওয়া যায়, বড়জোর তিন লাখ মানুষ হবে শহর আর শহরতলি মিলে। ইসলামপুর, মৌলভীবাজার, নাজির লাইব্রেরি থেকে ইডেন কলেজ কাম সচিবালয়, রেসকোর্স, নীলক্ষেত, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, হেয়ার রোড, মিন্টো রোড, ময়মনসিংহ রোড, তেজগাঁও—এই সব নতুন ঢাকায়।

একদিন রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় দেখলেন। সাত বছর হলো ঢাকায় এসেছেন। এই প্রথম তার ঘোড়দৌড় দেখা। তারুণ্যের উষ্ণতা তাঁর ভেতরে। আবার প্রৌঢ়ের চিন্তাশীলতা। তাঁদের গ্রুপে আছেন কামরুদ্দীন সাহেব, অলি আহাদ সাহেব, তোয়াহা সাহেব। তাঁরা মুসলিম লীগের চেয়েও একটা অগ্রসর দল গড়ে তুলতে চান। সেটার কতদূর কী হবে? একদিন তাঁরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে পূর্ববঙ্গে আনতে হবে। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই। সোহরাওয়ার্দী সাহেব কিছুদিন আগে এসেছিলেন ঢাকায়, শান্তিমিশনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। খাজা নাজিম উদ্দিনও তাতে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু খাজাদের মুখ ছিল বড় শুকনো। তাঁরা ভয় পাচ্ছেন, সোহরাওয়ার্দী এই দেশে এলে তাঁদের নেতৃত্ব চলে যাবে। গান্ধীজির সঙ্গে শান্তিমিশনে সারা ভারত ঘুরেছেন সোহরাওয়ার্দী। করাচিও গিয়েছিলেন। তাঁর হারানো মর্যাদা তিনি বহুলাংশেই পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন।

রাত নেমে এসেছে নিমতলীতে। মেসের ছেলে রঞ্জ হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। বাইরে থেকে রিকশার টুংটাং আওয়াজ, ঘোড়ার হ্রেষার শব্দ আসছে।

নাহ্। খিদে পাচ্ছে। রান্নাঘরে রঞ্জু ভাত তুলে দিয়েছে চুলায়। ভাত সেদ্ধ হচ্ছে, গরম ভাতের গন্ধ আসছে এই ঘরে। তারপর আসে তরকারির ঝাল গন্ধ।

এই সর্দিকাশি জ্বর জ্বর ভাব নিয়ে ভাত খাওয়া কি উচিত হবে? তবু ভাতই খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তিনি।

‘রঞ্জু রঞ্জু।’ তাজউদ্দীন হাঁক পাড়েন। সর্দিধরা গলাটা নিজের কাছেই অচেনা লাগছে। কাশি শুরু হয়। রঞ্জু কাছেই ছিল বোধ হয়। চলে আসে। তাজউদ্দীন বলেন, ‘ভাত দাও।’

নিজের চকির ওপর খবরের কাগজ বিছিয়ে তিনি ভাত খেতে বসেন।

২৪

রেনুর কাছ থেকে বিদায় নেন মুজিব। দুই মাস বয়সী কন্যা হাসিনার কপালে চুমু দেন। বলেন, ‘আসি মা। ভালো থাকিয়ো। অনেক বড় হও।’ বাচ্চা হাই তোলে।

রান্নাঘরের দরজায় মুজিব মাকে জড়িয়ে ধরেন।

হাসুকে কোলে নিয়ে রেনু বারান্দায় দাঁড়ান। বারান্দার ছাদে কবুতরগুলো বাকবাকুম রবে ডাকছে। সকালবেলাটায় আজ বড় কুয়াশা। রেনুর মনটা খারাপ বলেই কি? তবু তিনি মুখে হাসি আনার চেষ্টা করছেন। শেখ লুৎফর রহমান আঙিনায়। তিনি তাঁর পাঞ্জাবির পকেট থেকে হাত বের করে মুজিবের হাতে গুঁজে দেন কিছু টাকা। প্রত্যেকবার বাড়ি থেকে যাওয়ার সময় বাবা তাঁর হাতে টাকা দেন।

মুজিব টাকাটা নিতে সংকোচ বোধ করেন। ‘আবার টাকা দেন কেন?’

বাবা বলেন, ‘কী, নিতেছ না ক্যান, ন্যাও।’

‘বড় হয়েছি না, বাবা?’

শেখ লুৎফর রহমান বলেন, ‘বাবা রে। বাবার কাছে ছেলে কি বড় হয়? তুমি একদিন অনেক বড় হবা। আমি দোয়া করি। কিন্তু সেই দিনও তুমি আমার ছেলেই থেকে যাবা, বাবা!’

বাবার সঙ্গে শেখ মুজিবের একটা গোপন আন্তরিক যোগাযোগ আছে। সেটা অদৃশ্য। কিন্তু আছে সেটা। বাবার সঙ্গে তিনি ছোটবেলায় গোপালগঞ্জ আর মাদারীপুরে এক বাসায় থেকেছেন। সেখানে আর কেউ থাকত না। শুধু বাবা আর তিনি। তাঁরা রোজ সকালে হাঁটতে বেরোতেন। বাবা সঙ্গে নিতেন একটা ছাতা বা একটা ছড়ি। বাবা বলতেন, ‘এই যে ছাতা বা ছড়ি, এইটে তোমাকে সাহস দিবে। ধরো, পথে বৃষ্টি হলো, রোদ হলো, ছাতা কাজে লাগবে। কিংবা ধরো, একটা কুকুরে তাড়া করল, একটা গরু ছুটে আসল, এই ছাতা বা ছড়ি তখন তোমার অস্ত্র।

বাপ-ছেলে মিলে চলে যেতেন নদীর ধারে। শীতকালে ভোরবেলাতে পুরো জগৎ ঘুমিয়ে থাকত কুয়াশার চাদরটা মুড়ি দিয়ে।

‘বাবা।’ মুজিব ডাকতেন।

‘কী, খোকা?’

‘এখনো সবকিছু ঘুমাচ্ছে। গাছ, রাস্তা, গ্রাম। তাই না, বাবা।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু একটা জিনিস ঘুমাচ্ছে না। দেখবা চলো।’

‘কী, বাবা?’

‘এই যে দেখো নদী। সবাই এখনো ঘুমে। কেবল নদী জেইগে আছে।’ বালক মুজিব অবাক হয়ে দেখেন। তাই তো। নদী ছলছল করে বেয়ে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য! নদী ঘুমায় না?

‘বাবা, আমাদের বাড়ির সামনের খালটা কিন্তু শীতকালে ঘুমায়। সকালবেলা। তাই না?’

‘হ্যাঁ। খাল ঘুমাতে পারে। যদি খালে স্রোত না থাকে।

কুয়াশার ভেতর দিয়ে নদীর পাড় ধরে হেঁটে হেঁটে তাঁরা ফিরে আসেন। পথের মোড়ে সেরাজ গাছি খেজুরের রসের হাঁড়ি নিয়ে বসে আছে। একটু একটু করে রোদ উঠতে শুরু করেছে। গোপালগঞ্জ মহকুমা শহরের পথে দোকানপাট, গাছপালার ছায়া তখন দীর্ঘ হয়ে মাটিতে পড়তে শুরু করেছে। মিউনিসিপ্যালিটির দেহাতি মানুষেরা রাস্তা ঝাড়ু দিতে গেলে রোদের সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করেছে সোনালি ধূলিকণা। বাবা বলতেন, ‘নাও, বাবা, খেজুরের রস খাও।’

বাবা এক গেলাস খেতেন। মুজিব খেতেন দুই গেলাস। ঘোলা কাচের গেলাসে রস খেয়ে বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুজিব ঠোঁট মুছতেন। বাবা বলতেন, ‘র‍্যাপারটা তো, বাবা, ধুলায় গড়াচ্ছে।’ বাবা র‍্যাপারটা জড়িয়ে দিতেন ছেলের গায়ে।

তাদের মধ্যে কথা না হলেও চোখে চোখে ভাববিনিময় হয়ে যেত অনেক সময়। রস খাওয়া হয়ে গেলে মুজিব বলেন, ‘বাবা!’ তিনি ইঙ্গিতে একটু দূরে নির্দেশ করেন। বাবা তাঁর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন ছেলে কী বলতে চায়। একটা গরিব বাচ্চা রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে তাদের খাওয়া দেখছে। ছেলে চায় বাবা তাকেও রস কিনে দিক। লুৎফর রহমান সাহেব ডাকেন, ‘এই, এদিকে আয়।’

বালক মুজিব বলতেন, ‘বাবা, ওর নাম মিজান।’

‘সেরাজ, অরেও রস দ্যাও।’ বাবা তাঁর পাঞ্জাবির পকেট থেকে খুচরো পয়সা বার করতে করতে বলতেন।

হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ বৃষ্টি এসে গেলে বাবা ছাতা মেলে ধরতেন। মুজিব ছাতার নিচে বাবার গা ঘেঁষে হাঁটতেন। এমন একটা নির্ভরতা পাওয়া যেত বাবার সংস্পর্শে। কিন্তু মুজিবের আরেকটা আশ্চর্য কথা মনে হয়। ছাতা হাতে না থাকলে রোদের মধ্যে মুজিব বাবার ছায়ায় হাঁটতেন। কিন্তু তাঁর ধারণা ছিল, তিনি ছায়া পাবেন বাবার ছায়ার ওপরে ওপরে হাঁটলে। বাবা সেটা খেয়াল করে বললেন, ‘ছায়ার ওপরে দাঁড়ালে তো তুমি ছায়া পাবা না নে, তোমাকে আমার আড়ালে দাঁড়াতে হবে, কাছে আসো।’ মুজিব বাবার ছায়ার ভেতরে নিজের ছায়াটাকে হারিয়ে ফেলেন।

এই রকম একটা অদৃশ্য কিন্তু অচ্ছেদ্য যোগাযোগ আছে পিতাপুত্রের। মুজিব তাই বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে শেষ পর্যন্ত আপত্তি করেন না। মেসে উঠেছেন, টাকাপয়সা তো লাগবেই। বাবার এই সহযোগিতাটুকু তাঁর দরকার হবে। তাতে তাঁর মনের জোর থাকবে। টিউশনি ইত্যাদি করতে হবে না।

মুজিব ঘাটে এসে নৌকায় সওয়ার হন। বাবাও এসেছেন ঘাট পর্যন্ত। পাড়ার নানা বয়সী ছেলে-বুড়োরাও ভিড় করে দাঁড়ায় ঘাটের পাড়ে।

‘নদী কখনো ঘুমায় না।’ বাবা বলেছিলেন।

কুয়াশামোড়া সকালে গাছপালা এখনো নিদ্রিত। এমনকি এই খালটাও। খাল ঘুমাতে পারে, বাবার কথা।

নদীতে গিয়ে পড়তে পড়তে রোদটা একটু চাড়া দেবে। তখন চারপাশের সবকিছুকেই মনে হবে জাগ্ৰত।

মাঝি নৌকা ছেড়ে দেয়।

কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যায় চিরপরিচিত ঘাট, সুপুরিগাছ, বাঁশঝাড়, আর মানুষগুলো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *