যাবার বেলায়
মেট্রোতে অফিস টাইমের ভিড়টা আজকে অদ্ভুতভাবে কম। উজ্জ্বল রোদ, সোমবার। কোন রকম মিটিং, মিছিল, বনধ কিছুই নেই। তবু মেট্রোতে অফিস টাইমের সেই মারকাটারি ভিড়টা নেই।
উপমন্যু বসার জায়গাও পেল। এক ভদ্রলোক সরে গিয়ে জায়গা করে দিলেন। এই সময়ে টালিগঞ্জ থেকে বসার জায়গা পাওয়া মিরাকেল। উপমন্যু চারদিকে তাকাল।
সবাই মোবাইলে ব্যস্ত। একটা গোটা জাতি মাথা নিচু করে রয়েছে।
তাকেও ফোন দেখতে হত না এমন নয়।
যতক্ষণ অটোতে ছিল ফোন বেজে গেছে। উপমন্যু ফোন তোলে নি। নিজের নিয়মে ফোন বেজে গিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
তারপরে আবার অবুঝ শিশুর মত বাজতে শুরু করেছে। উপমন্যুর পাশে বসা ভদ্রলোক তাকে সতর্কও করেছেন, “ফোন বাজছে তো”।
উপমন্যু প্রত্যুত্তরে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে হেসেছে।
ভদ্রলোক সম্ভবত তাকে পাগল ভেবেছেন। মেট্রোর টিকিটের লাইনেও ফোনটা বেজেছিল।
উপমন্যু পাত্তা দেয় নি।
পাত্তা দেওয়ার মত কিছু হয় নি।
ট্রেন পাতালে প্রবেশের পর ফোন বিরক্ত করা বন্ধ করল তাকে। উপমন্যু খুশি হল।
আশে পাশের লোকজন কেউ গেম খেলছে, কেউ একা একাই মোবাইলের দিকে তাকিয়ে হেসে যাচ্ছে।
উপমন্যুর মাথায় এল, এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ জন্মালে গেম খেলতেন? এই যে একটা লোক বন্দুক নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে, সবাইকে গুলিতে ঝাঁঝরা করছে, না করতে পারলে নিজে মরছে… এই তীব্র অস্তিত্বরক্ষার যুগে রবীন্দ্রনাথ জন্মালে এত লিখতেন? নাকি গেম খেলে আর হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম করেই সময় কাটিয়ে দিতেন?
উত্তর ভেবে ওঠার আগে ফোনটা আবার বেজে উঠল।
উপমন্যু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। প্রযুক্তি পাতালেও প্রবেশ করে ফেলেছে।
পালানোর পথ নেই।
আশে পাশের লোক তার দিকে তাকাচ্ছে। একজনের ফোন বাজছে, অথচ সে ধরবে না, এ কী ব্যাপার?
উপমন্যু গম্ভীর হয়ে বসে রইল।
সামনের মহিলার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।
তার দিকে তাকিয়ে বললেন “ফোনটা ধরুন”।
উপমন্যু প্রত্যুত্তরে আবার হাসল।
মহিলাটি বললেন “টেলি মার্কেটিং কল বুঝি? তাহলে না ধরাই ভাল। বড় জ্বালায়”।
ভদ্রমহিলার এই ব্যাখ্যার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আশে পাশের মানুষেরা নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। তার দিকে আর কেউ তাকাল না। সবাই ধরে নিল ফোন করে কোন ক্রেডিট কার্ডের এজেন্ট বা লোনদানকারী জ্বালাতন করছে বলেই উপমন্যু ফোনটা ধরছে না।
শান্তি বর্ষিত হল। ফোনটা যদিও সে চুক্তি মানল না। বেজে চলল।
কালীঘাট থেকে এক ঝাঁক যুবতী উঠল। তার সামনে দাঁড়াল। উপমন্যু সুপুরুষ।
তার দিকে দুজনের চোখ পড়ল। আগ্রহ সহকারে তাকাল।
এ ওকে ঠেলছে।
উপমন্যুও তাকাল। দুজনের দিকেই।
এই মুহূর্তগুলো কলেজ লাইফে হৃদযন্ত্রের ক্লাস নিত। নন কো এড ছেলেদের জন্য এই সময়গুলো অ্যাসিড টেস্ট। আগে হলে উপমন্যু মাথা নামিয়ে ফেলত।
আজ নামাল না। হাসি হাসি মুখে মেয়েদুটির দিকে একবার তাকিয়ে মাথা উঁচু করে বসে রইল।
যতীন দাস পার্ক থেকে আরও এত লোক উঠল মেয়েদুটিকে আর দেখা গেল না। উপমন্যুর ফোন অবশ্য রণে ভঙ্গ দিল না।
বাজতে লাগল।
অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে খেয়াল হল, এই সময় “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে” গানটা মাথায় বাজতে শুরু করেছে।
এই গানটা কেন? এখন বসন্ত নয়, পূর্ণিমাও নয়। এক্কেবারে কেজো দিন, তবে? “যাব না এ মাতাল সমীরণে” মাথায় ঘুরবে কেন?
উপমন্যু বেশি ভাবল না আর। গুনগুন করতে শুরু করল। নেতাজী ভবনে কয়েকজন নামলেও ফাঁকা হল না।
মেট্রো নড়ে উঠতে উপমন্যু উঠে দাঁড়াল। সামনে দাঁড়ানো এক ভদ্রলোক জন্টি রোডসের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ফেলে যাওয়া জায়গাটা দখল করল।
উপমন্যুর হাসি পেল। একটা স্টেশনের জন্যও বসতে পারলে মানুষ বর্তে যায়। জায়গা ছাড়া যাবে না।
বড় কষ্ট পরাজয়ের।
ভিড়টা এগোতে বাধা দিচ্ছিল।
উপমন্যু কোন মতে ঠেলে গেটের দিকে এগোল। মেট্রো স্টেশনে ঢুকছে।
“আমার এ ঘর বহু যতন করে, ধুতে হবে, মুছতে হবে মোরে”… দরজা খুলতে একদল প্ল্যাটফর্মে ঝাঁপাল, আরেকদল মেট্রোতে।
যোগ বিয়োগের জটিল সমীকরণের মধ্যেই উপমন্যু নামতে পারল। ফোনটা আবার বাজছে।
অবশ্য এখন কারও উপমন্যুর ফোনে মন দেওয়ার সময় নেই। সবাই দৌড়তে শুরু করেছে। পাতাল থেকে বেরোনোর লড়াই। ভীষণ তাড়া সবার।
উপমন্যু ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙল। প্রবল তাড়ায় একজন তার পা মাড়িয়ে গেল, উপমন্যু কিছু বলল না। টোকেন জমা দিয়ে রেলিং ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আবার সিঁড়িতে ওঠা।
এবারও উপমন্যু তাড়াহুড়ো করল না।
শহরটা তার গায়ে আছড়ে পড়ল দিনের আলো গায়ে পড়তেই। উপমন্যু হাঁটতে শুরু করল।
স্কুল, কলেজ, অফিস, ব্যবসা… সর্বত্র প্রবল গতিতে ছুটে চলেছে মানুষ।
খানিকটা হাঁটার পর উপমন্যু একটা রিক্সা নিল। উঠে বসে গন্তব্য বলতেই বিহারী রিক্সাওয়ালা তাকে তুলে দৌড়তে শুরু করলেন।
ফোন বাজছে। আবার। উপমন্যু ফোনটা বের করে নম্বরটার দিকে তাকাল। ফোনটা কেটে দিল। কলেজ জীবনের কথা ভাবতে চেষ্টা করল। রবীন্দ্রসদনে নেমে তারা নন্দনে সিনেমা দেখতে যেত। সিনেমাটা বড় কথা না, হুল্লোড়টাই ছিল আসল।
শ্রুতবর্মা সব থেকে বেশি লাফাত। ও এখন বোস্টনে থাকে। আসে না বললেই চলে। ঋতায়ণ বেঙ্গালুরুতে। পিনাকী সিঙ্গাপুরে থাকে।
পিনাকী নন্দনে এসে মেয়ে দেখলে বিভিন্নভাবে লড়াই চালিয়ে যেত। কিছু করতে পারত না। অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ হয়েছে শেষ পর্যন্ত। উপমন্যু যেতে পারে নি অফিসের কাজের জন্য।
খুব রাগারাগি করেছিল পিনাকি।
নন্দনের কাছের বাস রাস্তাতেই তো একবার শ্রুতবর্মাকে অত্যধিক গালাগালি দেওয়ার জন্য বাস থেকে তাদের গোটা দলটাকে নামিয়ে দিয়েছিল বাস কন্ডাকটার। একটুও দুঃখ পায় নি তারা। যেন বিরাট কোন কাজ করেছিল, এই আনন্দে হই হই করেছিল খুব।
ভিক্টোরিয়ায় একবার এক যুগলকে চুমু খেতে দেখতে ঝোপে ঢুকতে গিয়ে তাড়া খেয়েছিল ঋতায়ণ। ভাবতেই হেসে ফেলল উপমন্যু।
এসব স্মৃতি কোন দিন পুরনো হবে না।
নার্সিং হোম এসে গেছে। উপমন্যু রিক্সাভাড়া দিয়ে নামল। গিজগিজ করছে লোক। উপমন্যু রিসেপশনে গিয়ে বলল “অরুন্ধতী মিত্র, এখন দেখতে যেতে পারি?”
রিসেপশনিস্ট তার দিকে বিরক্ত চোখে তাকালেন “সকাল থেকে আপনাকে ফোন করে যাচ্ছি ধরছেন না কেন?” পরক্ষণেই চোখ মুখ নরম হয়ে এল তার, “শি ইজ নো মোর”।
উপমন্যু যেন এর স্পয়লার আগেই পেয়ে গেছিল এমনভাবে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল “আচ্ছা। দেখতে পারি এখন?”
রিসেপশনিস্ট একজনকে ডেকে দিলেন। তাকে নিয়ে চললেন সে মেয়েটি। অসংখ্য লোক নার্সিং হোমে। কেউ টাকা গুণতে ব্যস্ত, কেউ বা কেঁদে চলেছেন। কেউ বা রিপোর্ট নিয়ে বসে রয়েছেন শক্ত মুখে। ডাক আসবে যে কোন সময়। এত কিছুর মধ্যেও বেশিরভাগ মানুষ ফোনেই ঢুকে আছেন। উপমন্যু সব পিছনে ফেলে হাঁটতে লাগল।
মাথায় গানটা ফিরে এসেছে আবার “আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে”…
সাদা চাদরে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে অরু।
উপমন্যু চাদর সরাল।
অরুর মুখে একটুও হাসি নেই। নাকি আছে? উপমন্যু তীক্ষ্ণ চোখে অরুর দিকে তাকাল। যাওয়ার সময়ে একটুও হাসে নি?
তাকে সঙ্গে করে যে মেয়েটি নিয়ে এসেছেন, উপমন্যুর এভাবে তাকিয়ে দেখা দেখে খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েই হয়ত বলল “আপনি ওনার কে হন? স্বামী?”
উপমন্যু ঘাড় নাড়ল।
মেয়েটি বলল “আচ্ছা, বডি হ্যান্ডওভার নেবার আগে ডিউজগুলো ক্লিয়ার করে দেবেন। আপনি কীসে পেমেন্ট করবেন? কার্ডে, না ক্যাশে?”
উপমন্যু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল “পেমেন্ট না করলে কী হতে পারে?”
মেয়েটি অবাক হল। এ কী অদ্ভুত প্রশ্ন? সে চলে গেল। মিনিট দুয়েক উপমন্যু অরুর দিকে তাকিয়ে থাকল, মেয়েটি দু জন পুরুষকে নিয়ে এসেছে। একজন তাকে বলল “আপনি ডিউজ ক্লিয়ার করবেন না বলেছেন?”
উপমন্যু বলল “না। তা বলিনি। আমি শুধু ওর কাছে জানতে চেয়েছি পেমেন্ট না করলে কী হতে পারে”।
ওরা পরস্পরের দিকে বিভ্রান্তভাবে মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।
একজন বলল “ডিউজ ক্লিয়ার না করলে বডি আটকে থাকবে”।
উপমন্যু বলল “ঠিক আছে। কত টাকা হয়েছে?”
“আপনি রিসেপশনে আসুন। আপনাকে বিল দেওয়া হবে”।
উপমন্যু অরুন্ধতীর মুখে চাদরটা যেমন ছিল, তেমন করে ঢেকে দিল।
লোকগুলোর পিছন পিছন আবার রিসেপশনে গিয়ে বসল।
তিন লক্ষ পচাত্তর হাজার টাকার একটা বিল দিয়েছে।
উপমন্যু বিলটা নিয়ে খানিকক্ষণ নেড়ে চেড়ে দেখে বলল “আমি টাকা নিয়ে আসছি”।
ওরা নিশ্চিন্ত হল।
নার্সিং হোমের বাইরে থেকে উপমন্যু আবার রিক্সা নিল।
ফোন আবার বাজতে শুরু করেছে। অরুন্ধতীর বাড়ির লোক? হবে হয়ত। উপমন্যু ফোন বের করার প্রয়োজনীয়তা পেল না।
গানটা মারাত্মকভাবে জেকে বসেছে মাথায়। গলাটা অরুন্ধতীর। ও এই গানটাই সব থেকে ভাল গাইত।
মেট্রো স্টেশনে কী ভিড়! টিকিটের লাইনে শুনতে হল “ও দাদা, ফোনটা ধরুন”।
উপমন্যু এবারেও হাসল।
সিঁড়ি ভেঙে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছল। কবি নজরুল দু মিনিটের মধ্যে আসবে।
উপমন্যু একটা বেঞ্চে বসল।
বিলটা না দিলে কী হবে? অরুন্ধতীকে পোড়ানো হবে না? অতৃপ্ত আত্মা হয়ে ঘুরবে অরু?
যেদিন জানা গেছিল টিউমরটা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর গতিতে অরু তাকে বলেছিল “বিয়ে করবে বুঝলে? সারাজীবন একা থাকবে না। কোন দরকার নেই”।
উপমন্যু হেসেছিল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল “কিচ্ছু হয় নি। সেরে যাবে। কয়েকটা তো কেমো। বেশিদিন লাগবে না”।
অরু বলেছিল “নাহ। আমি জানি, এ সারবে না”।
উপমন্যু আর বেশি স্তোক দেয় নি। জেগে বসেছিল।
অরু সেদিনই মরে গেছিল আসলে। কেমোগুলো তো মৃত্যুর ইনস্টলমেন্ট ছিল।
মেট্রো আসার শব্দ বাড়ছে। উপমন্যু উঠে দাঁড়াল। শরীর ঝুঁকছে।
ঝাঁপ দিতে হবে। কেউ কিছু বোঝার আগেই শেষ করে দিতে হবে নিজেকে।
ট্রেন এগিয়ে আসছে। উপমন্যুর শ্বাস বন্ধ হয়ে এল। মাথায় গানটা যায় নি এখনও। “যাব না, এ মাতাল সমীরণে”…
লাফটা দেওয়ার সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশ সময়ের আগে উপমন্যু মিত্র থমকে দাঁড়াল। মেট্রো প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করল নির্বিঘ্নে।
ট্রেনের দরজা খুলে গেল। বাকি সবার মত উপমন্যু মেট্রোয় প্রবেশ করল।
ফোনটা আবার বাজতে শুরু করেছে।
নার্সিং হোম থেকে।
উপমন্যু ধরে বলল “শুনুন না, বডিটা মেডিকাল কলেজে দান করে দেবেন না হয়? টাকা দিয়ে একটা মৃত দেহ ছাড়িয়ে আনার কোন যুক্তি আছে কী, তার চেয়ে যদি চিকিৎসা শাস্ত্রের কোন উন্নতি হয় বডিটা নিয়ে…”
আশে পাশের সবাই তার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাচ্ছে।
ফোনটা কেটে উপমন্যু গেমটা খেলতে শুরু করল।
একটা মানুষ বন্দুক নিয়ে সবাইকে মারতে নামছে একটা উপত্যকায়। হয় সে আত্মরক্ষা করে সবাইকে মেরে ফেলবে। নয়ত তাকে অন্য কেউ মারবে।
বাঁচতেই হবে।
মরলে গেম ওভার…
সমাপ্ত