যদি ফিরে আসা যায়
পর্দাগুলোর রং গাঢ় সবুজ হতে পারে। নাকি কালো? ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। পেলমেট থেকে এমন ঘনিষ্ঠভাবে ঝুলছে, ঘরের চারদিকের দেওয়ালকে যেন লুকিয়ে ফেলেছে। বাইরের একফোঁটা আলো পর্যন্ত ঢুকতে পারছে না যে কারণে। নাকি, জানলাই নেই ঘরটায়! ঘরে আসবাব নেই। শুধু শ্যাম্পু স্টেশনের মতো দেখতে একটা সলোঁ চেয়ার ছাড়া। আলোর উৎস বলতে মেঝের মাঝখানে একটা ছোট্ট গর্ত। লালচে তরল আলো উঠে আসছে সেখান থেকে। থইথই করছে সারা ঘর।
এমন আশ্চর্য আলো আর কখনও দেখেনি তীর্থঙ্কর। চেয়ারে বসে ওই আলোর দিকে তাকিয়েই সে বুঝতে পেরেছে, এই আলোটার মধ্যে একটা দুনির্বার আকর্ষণ আছে। লালচে রংটা তাকে টানছে। সে ক্রমশ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। সেন্স তার আছে ঠিকই, কিন্তু একটা ঘোর তাকে ঘিরে রেখেছে। হিমশীতল বাতাসের মতো। দু’চোখের পাতা ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে তীর্থঙ্করের। ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। তীর্থঙ্করের মনে হল, তার চোখেমুখেগায়ে এসে লাগছে রোঁয়া বৃষ্টি।
২
পাহাড়ি বৃষ্টি নাকি নাছোড় হয়। চাইলেও মুক্তি পাওয়া যায় না। শরীর পেলে সে আরও লেপ্টে যায়। আদুরে প্রেমিকার মতো। বাষ্পের মতো মিহি গুঁড়োগুঁড়ো ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে থাকে। ভরা শীতের সঙ্গে শত্রুতা আছে সোয়েটারের। তীব্র গ্রীষ্মের সঙ্গে যেন আইসক্রিমের কিউবের। পাহাড়ের বৃষ্টিও তেমন। একে ভালোবাসা না দিলে, আপন করে না নিলে ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকবে। এমন নয় যে, এই প্রথম পাহাড়ে বেড়াতে এল সুজন। এর আগেও বহুবার এসেছে। কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
তার ব্যাজার মুখ দেখে শতরূপা ভ্রু উঁচিয়ে হেসে বলল, ‘কী গো সুজন। সেই সকাল থেকে তোমার মেঘলা মুখ দেখছি। এখনও মেঘ কাটল না।’
শতরূপার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল সুজন। আকাশের সমস্ত কালোমেঘ কি মেয়েটার চোখে এসে জমেছে? এত গভীর, এত গাঢ় চোখ আর কখনও তো দেখেনি সে। বড়বড় আইল্যাশে যেন খুব যত্ন করে ধরে রেখেছে দু’চোখের কাজলকালো মেঘকে। আশ্চর্য হয়ে সুজন দেখল, চোখের দু’কোণ বেয়ে আলো গড়াচ্ছে। সেই আলোতে ক্রমশ লালচে হয়ে উঠছে তার গাল। চিবুকের কাছে এসে সেই আলো আবার ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে। যেন নীলচে গোধূলি নেমে এসেছে। সীমাহীন স্বপ্ন হয়ে ভেসে যাচ্ছে পাহাড়ের ভ্যালিতে। কানের পাশ থেকে কাঁধ বরাবর চুলের রেখার মধ্যে রাত্রির আগমনী সুর ভেসে আসছে। শতরূপার চোখে চোখ রেখে গভীর হাসি হাসল সুজন। চেষ্টা করল তার হাসিকে মোহময় করে তুলতে। শতরূপা যাতে কক্ষচ্যুত হয়ে পড়ে।
‘কী হল, উত্তর দিলে না যে?’ ছটফটে গলায় আবার জিজ্ঞেস করল শতরূপা।
সুজন গাঢ় গলায় বলল, ‘মেঘ কেড়েছে আমার মন/ মেঘও জানে আমি কেমন!’
খিলখিল করে হেসে উঠল শতরূপা। তার সরলরৈখিক হাসি বেয়ে ছিটকে এল একদলা উত্তপ্ত বাতাস। বৃষ্টির টানাপোড়েনে শীতকাতর এই পাহাড় দ্রুত শুষে নিল সেই উষ্ণতাটুকু।
এইরকম একটা ট্রিপের জন্য সুজন অপেক্ষা করে রয়েছে অনেকদিন। যবে থেকে সে শুনেছে খবরটা, একটা অস্থিরতা কাজ করেছে তার মধ্যে। তার ভেতরে জমে রয়েছে দমবন্ধ করা দীর্ঘশ্বাস। বিষাক্ত বাতাসের মতো। সে ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি, এ দিকে গড়াতে পারে ব্যাপারটা। যাকে সে এতটা চেয়েছে, যার জন্য সে পাগল, যার জন্য সে একটা একটা করে মুহূর্ত গুনেছে, সে অন্য কারও হয়ে যাবে! না-না, সে বেঁচে থাকতে এটা হতে দেবে না। এখনও চেষ্টা করলে হয়তো সব কিছু ঠিক করা যেতে পারে। শতরূপার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া যেতে পারে তার আকাঙ্খিত স্বপ্নের দিকে। তার কথা কি শুনতে চাইবে না মেয়েটা? নাকি অলোকের মধ্যে পুরোপুরি ডুবে গিয়েছে সে? শতরূপার মুখের লালচে আলোয় ডুব দেওয়ার চেষ্টা করল সুজন।
৩
‘লালচে আলোটার দিকে তাকান। মন থেকে গ্রহণ করুন ওই অলোকবিন্দু, সমস্ত কণা, অণু-পরমাণু। মিশিয়ে দিন নিজেকে। আরও, আরও!’
শব্দের অদ্ভুত স্রোত ভাসছে তীর্থঙ্করের চারপাশে। মাটি থেকে জলস্রোতের মতো লালচে আলো ক্রমশ উঠে আসছে। ঘিরে ধরছে তাকে। তার পায়ের পাতা, হাঁটু, কোমর ভিজিয়ে দিতে দিতে ক্রমশ উঠে আসছে রক্তিম আলো। এতক্ষণ একটা ভীতি কাজ করছিল তার মধ্যে। সে বুঝতে পারল, অসীম জলরাশিতে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু এই ডুবে যাওয়ার মধ্যে কোনও যন্ত্রণা নেই। মোহের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে গেলে যাবতীয় আশঙ্কা দূরে সরিয়ে রাখতে হয়। তীর্থঙ্কর হাট করে খুলে দিল তার মনের সমস্ত জানলা।
৪
গাড়ির জানলার বাইরে হাত রাখল অলোক। রাশিরাশি জলবিন্দু নিমেষে ধুয়ে দিল তার হাত। কী ঠান্ডা! শিরশির করে উঠল তার সারা শরীর। যেন আদিম পৃথিবীর প্রথম বৃষ্টি ছুঁয়ে ফেলেছে সে।
গাড়ির সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসে রয়েছে অলোক। সুজন, সমর আর শতরূপা তার ঠিক পেছনের সিটে। সুমোর একেবারে পেছনের সিটে সঞ্জীবন আর শেখর। একই অফিসে চাকরি করে তারা। প্রতিবছর তারা দলবেঁধে কোথাও না কোথাও বেড়াতে যায়। এবারই প্রথম এসেছে শতরূপা। মেয়েটার কথা মনে পড়তে অলোকের ভেতরের জমি নড়ে উঠল। মাসখানেক আগে শতরূপা সম্পর্কে কানাঘুষো একটা খবর বেশ কিছু দিন ধরেই শুনেছে। কিন্তু সত্যি না মিথ্যে, সেটাই বুঝতে পারেনি। প্রায় সব মেয়েকে ঘিরেই এমন গল্প টুকটাক থাকেই। সেই মেয়ে যদি আবার শতরূপার মতো সুন্দরী হয়, তা হলে তো কথাই নেই। অলোক বেশ কয়েকবার ভেবেছে, সরাসরিই একবার জিজ্ঞেস করবে শতরূপাকে। কিন্তু যদি সত্যি না হয়? যদি রেগে যায় শতরূপা? একটা সঙ্কোচ কাজ করেছে। তবু সে কাল্পনিক প্রেমের জগতে আটকে থাকতে চায়নি। বরং চেয়েছে, স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝের সেতুটাকে পোক্ত করতে। চারদিন আগে শিলিগুড়িতে অফিসের জোনাল মিটিংয়ে আসার সময় সিকিমের এই ছোট্ট ট্যুরটা অ্যারেঞ্জ করেছে সমর। দু’দিনের জন্য সবাই মিলে হইহই করা। এটা শোনার পর সমরের দিকে তাকিয়ে শতরূপা বলেছিল, একটা সারপ্রাইজ আছে। তখন থেকেই অলোকের মনে প্রশ্নমালা উঁকি দিয়েই চলেছে। তার মানে ব্যাপারটা ওই দিকেই গড়াচ্ছে। তার রাগ হয়েছিল। যন্ত্রণা হয়েছিল। আক্ষেপ হয়েছিল। হতাশা কুরে কুরে খেয়েছে তাকে। এমন নয় যে, সে কখনও হাবেভাবে তার মনের কথা প্রকাশ করেনি। কিন্তু মেয়েটা সেভাবে পাত্তাই দেয়নি। সমরের মধ্যে কী এমন দেখল শতরূপা?
‘ড্রাইভার সাহেব, আর কতক্ষণ লাগবে?’ বিরক্তির সুরে জিজ্ঞেস করল অলোক।
ভোরবেলায় শিলিগুড়ি থেকে গাড়ি ধরে গ্যাংটকে এসেছে পৌঁছেছে তারা। তারপর থেকেই অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির কবলে। আগে থেকেই ট্যুরের পুরো নির্ঘণ্ট ঠিক করা ছিল। হোটেল, গাড়ি, লাচেন যাওয়ার পারমিট সব করানোই ছিল। ঘণ্টাখানেকের রেস্ট নিয়ে গাড়ি বদলে তারা বেরিয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। ওয়েদারের খোঁজখবর যতটুকু নিয়েছিল অলোক, তাতে এই অক্টোবরে সিকিমে বৃষ্টি পড়ার কথা নয়। মুঠোমুঠো গাঢ় নীলে ভেজা আকাশের গায়ে মণিমুক্তোর মতো পেঁজাপেঁজা সাদা নির্ভার মেঘই প্রাপ্তি ছিল তাদের। তার বদলে কালচে দলাপাকানো মেঘ আর তুমুল বৃষ্টি! সন্ধে গড়াতে চলল অথচ, নুসরৎ ফতেহ্ আলি খানের গজলের মতো একসুরে গেয়ে যাচ্ছে! বৃষ্টির জন্যই জোরে গাড়ি চালানো যাচ্ছে না। জায়গায় জায়গায় ধ্বসও নেমেছে। রাস্তা নরম হয়ে বসে গিয়েছে কোথাও কোথাও। ফলে যে রাস্তা ঘণ্টা ছয়েকের বেশি লাগার কথা নয়, সেটাই অনন্ত মনে হচ্ছে।
‘সাবজি, রাস্তা তো দেখ্ রহে হো। বহত রিস্ক হ্যায়।’
ড্রাইভারটির নাম থাংকা ভুটিয়া। সিকিমের ছেলে। চোস্ত হাত। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সে-ও এই বৃষ্টি থকথকে রাস্তায় গাড়ি চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। এক্সেলেটর থেকে পায়ের চাপ আরও কমিয়ে নিল থাংকা। গাড়ির গতি আরও কমে যাচ্ছে। যেন ক্লান্তিতে গাড়িটা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ছে!
৫
‘আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ুন তীর্থঙ্করবাবু। যে লালচে আলো ঘিরে ধরেছে আপনাকে, সেটা এখন অসীম জলের মতো মনে হবে। ডুবে যান, তলিয়ে যান ওই জলরাশিতে।’
রঙিন প্রজাপতির মতো একগুচ্ছ শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে তীর্থঙ্করের চারপাশে। তার মুখে, গলায়, বুকে, হাতে, শরীরময় সে সব প্রজাপতি ডানা নামিয়ে বসছে। যেন তীব্র আবেশ নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। ওই প্রজাপতিগুলো কি কথা বলছে তার সঙ্গে?
প্রজাপতির রঙে একাকার হতে হতে আরও কিছু ফিসফিসে শব্দ শুনতে পেল সে। ‘আলো দেখতে পাচ্ছেন তীর্থঙ্করবাবু? আলো? লালচে আলো?’
৬
হেড লাইটের তীক্ষ্ণ আলো পাথুরে রাস্তার পড়ে ভেঙেচুরে যাচ্ছে। ছিটকে যাচ্ছে চারদিকে। সেই আলোতে আদিম ঘূর্ণনের মতো দেখাচ্ছে পাহাড়ি বাঁকগুলো। রাশিরাশি কুয়াশা ছেঁকে ধরেছে পাহাড়ি রাস্তা। খাদের কান ঘেঁষে ক্লান্ত পায়ে চলেছে গাড়িটা। গাড়ির মাঝখানে বসেও সমরের মনে হল বাইরের অসীম অন্ধকার হাতছানি দিচ্ছে। দুর্বৃত্তের মতো আচমকা উঠে আসা ফ্যাকাশে কুয়াশায় মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।
গাড়ির সামনের কাচে জল অক্লান্ত মুছে চলেছে ওয়াইপার দুটো। তুমুল শত্রুতা নিয়ে নতুন একঝাঁক জলরাশি ঝাঁপিয়ে পড়ছে আবার। আচ্ছা, বৃষ্টির কি গন্ধ হয়? একটা চাপা সুবাস কোন সকাল থেকে ঘিরে রেখেছে সমরকে। মাঝেমাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। আবার বুদবুদের মতো ফিরে আসছে। পুরোনো গানের কলির মতো। এ যেন এক লুকোচুরি খেলা। কে কাকে ধরবে, কে কাকে ছোঁবে, অনন্ত খেলা খেলে চলেছে সমরের সঙ্গে।
এই রাতে সিকিমের পাহাড়ি অলিন্দে ঘুরতে ঘুরতে সমরের মনে হল, যে গন্ধটা তাকে সকাল থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সেটার উৎসস্থল এতক্ষণে তার চেনা লাগছে। পাশে বসে থাকা শতরূপার শরীর থেকে ভেসে আসছে। না, পারফিউম নয়। ওইরকম গন্ধের সঙ্গে শরীর মিশলে ককটেল হয়ে যায়। এই গন্ধে তেমন মিশেল নেই। শতরূপার শরীরের অচেনা গহ্বর থেকে উঠে আসছে খনিজ সুবাস।
শতরূপার দিকে আড়চোখে তাকাল সমর। ডানদিকে, ড্রাইভারের ঠিক পেছনে জানলার ধারে বসেছে সে। বৃষ্টির নিত্যনতুন ছাঁটে জানলার কাচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। পুরোনো জলকণার ওপর নতুন জলবিন্দু স্থাপনের ভারে গড়িয়ে নামছে ক্ষীণ জলধারা। তারা শেষবার মরিয়া কামনায় ছুঁয়ে যেতে চাইছে শতরূপাকে।
শুধু কি ওই ভেসে যাওয়া জলরাশি, অলোক নিজেও তো তা-ই চাইছে! তার পাশে বসে থাকলে কী হবে, শতরূপার যত কথা তো অলোকের সঙ্গেই!
সমরের কষ্টটা আবার উঠে আসছে বুক ঠেলে। এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। নির্নিমেষ দুঃখ। অফিসে গত পাঁচবছর ধরে তার পাশের কিউবিকলে বসে কাজ করে শতরূপা। তাকে ছুঁয়ে আসা সমস্ত অবাধ্য বাতাসের খোঁজ রাখে সমর। মেয়েটা কি বোঝে না? সে দেখতে পেত না সমরকে, যদি একবার চোখ রাখত তার মনের আয়নায়?
৭
‘আপনার মন এখন একটা আয়নার মতো। ভালো করে তাকিয়ে দেখুন। কোনও ছবি কি ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠছে?’
ঘন তরল অন্ধকার ছেয়ে রয়েছে তীর্থঙ্করের চোখের সামনে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। পৃথিবী তার রহস্যময় আদিম কালো পোশাকে ফিরে গিয়েছে। সে চোখ কচলে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। অন্ধকার কেটে গিয়ে দুটো সরলরৈখিক আলো ফুটে উঠল। আলোটা নাচতে নাচতে এগোচ্ছে। একটা গাড়ির হেডলাইটের মতো। হ্যাঁ, ঠিক তা-ই! একটা টাটা সুমো মনে হচ্ছে। পিছল, কর্দমাক্ত পাথরের বুকের ওপর দিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছে চারটে বলিষ্ঠ চাকা। অস্ফুটে কিছু বলার চেষ্টা করল তীর্থঙ্কর। পারল না। তার ঠোঁট নড়ে উঠল শুধু।
৮
ঠোঁট নড়ে উঠল সঞ্জীবনের। অনেকক্ষণ ধরে গালিবের কবিতার ক’টা লাইনের অনুরণন চলছে তার ভেতরে।
‘রোনে সে অওর ইস্ক মে বেবাক হো গ্যয়ে/ ধোয়ে গয়ে হম ইতনে কি বস্ পাক হো গয়ে’। প্রেম আর চোখের জল নির্বাক করে দিয়েছে আমাকে। যুগপৎ জলধারায় সব মলিনতা ধুয়ে গিয়ে পবিত্র হয়ে উঠেছি আমি!
গালিবের পংক্তিতে নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে সঞ্জীবন। প্রেম আর চোখের জন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে তার বুকে। কিন্তু পবিত্রতা যার ছোঁয়ায় আসবে, সে? সে কি জানে তার কয়েক মিটার পিছনে প্রেম আর আকাঙ্খার অভিঘাতে চুরমার হয়ে যাওয়া মানুষটার কথা? সুমোর পিছনের টানা সিটে সে আর শেখর মুখোমুখি বসে রয়েছে। সকালে যখন এই গাড়িতে সিকিম থেকে রওনা দিয়েছিল তারা, মনটা ফুরফুরে ছিল। পথে কত গল্প করেছে তারা ছ’জন। কিন্তু এখন যেন যে যার মনের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে সবাই। নিজের কাছে মেলে ধরছে নিজেকে। বৃষ্টির জন্য সুমোর জানলার সব ক’টা কাচ তোলা। শুধু ড্রাইভারের দিকের জানলাটা সামান্য নামানো। ওই পথে কিছু নিয়মবিরুদ্ধ হাওয়া ঢুকে পড়ছে গাড়িতে। শতরূপার ঠিক পিছনটাতে বসে থাকার জন্য তার রেশমি চুল উড়ে এসে পড়ছে সঞ্জীবনের চোখেমুখে। ভালোলাগার ঘোর বাড়িয়ে দিচ্ছে। এইরকম মুহূর্তগুলোর জন্যই তো এখানে আসা। বাঁচতে চাওয়া। সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, আর কোনও বাধা মানবে না। তার মনের কথা জানিয়ে দেবে শতরূপাকে। মেয়েটা নাকি সারপ্রাইজ দেবে! কী হতে পারে সেটা? সমরের কথা বলবে নাকি? গাড়িতে উঠে সে সমরকেই ডেকেছিল না, তার পাশে বসার জন্য? না-না, কোনও ভিত্তিহীন অকারণ আশঙ্কা বয়ে বেড়িয়ে লাভ নেই। সে শুধু তার সবটুকু জানাতে, বুঝে নিতে চায়। সঞ্জীবন আরও আপন করে নিল রাতের অন্ধকারকে।
৯
রাতের অন্ধকার চিরে তীর্থঙ্কর দেখতে পেল একটা টাটা সুমো। চুলের সিঁথির মতো অন্ধকার সর্পিল পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা। গাড়িটা দুলছে মৃদু। পাথুরে পথে ধাক্কা খেয়ে।
‘কী দেখতে পাচ্ছেন?’
ঘোরের মধ্যে কিছু শব্দে ঠোক্কর খেল তীর্থঙ্করের ভাবনা। তার সন্মোহিত ঠোঁট নড়ে উঠল— ‘একটা গাড়ি। টাটা সুমো।’
‘বেশ। এবার গাড়ির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করুন। কী দেখা যাচ্ছে?’
১০
অন্ধকারে বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শেখর জলের বোতলটা ঠোঁটে ঠেঁকাল। সামান্য জ্বালাজ্বালা করে উঠল তার জিভ। জলের বোতলটা আবার ছিপি এঁটে রেখে দিল। এই বোতলে জলের সঙ্গে রঙিন তরলও মেশানো আছে। টানা বৃষ্টির জন্য যা ঠান্ডা পড়েছে, নিজেদের গরম রাখার জন্য এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। কিন্তু শেখর মদ পান করে না। দরকারই বা কী আছে? নেশা যে তার অনেক কাল ধরেই হয়ে রয়েছে। যে দিন সে প্রথম দেখেছিল শতরূপাকে। একটা টলটলে মুখ, দুটো গভীর চোখের মোহে সে অনেক আগেই ভেসে গিয়েছে খড়কুটোর মতো। ভাসতে ভাসতে এতদিনে সে পাড়ের কাছে এসে পৌঁছেছে। জল থেকে উঠে সে এবার তার স্বপ্ননীড়ে পৌঁছতে চায়। শতরূপার সঙ্গে সেখানে সংসার পাতবে।
সুজনই হোক আর অলোক, সমর কিংবা সঞ্জীবন— এদের মনে কী চলছে, শেখর খুব ভালো করে জানে। তারাও শতরূপাকে আকন্ঠ ভালোবাসে। হয়তো আরও শতশত প্রেমিক আছে তার। এইরকম একটা মেয়েকে ভালো না বেসে যে পারা যায় না। তার মানে তো এই নয়, সে হেরে যাবে। শেখরকে স্পষ্ট করে বলতেই হবে সে কী চায়। যে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় সে থেকেছে, তা এসে উপস্থিত হয়েছে।
অফিসে তার ফিউচার অত্যন্ত ব্রাইট। এখন কলকাতা অফিসের সেলস সুপারভাইজার সে। আগামী তিন-চার বছরে আরও পদোন্নতি হবে। ম্যানেজমেন্টের নেকনজরে আছে। তার মতো ব্রাইট ছেলেকে ভালোবাসবে না তো কাকে বাসবে শতরূপা? যদি অন্য কাউকে বাসে, তাতেও কিছু যায় আসে না তার। শতরূপাকেও বুঝতে হবে, জীবনটা শুধু ভালোবাসার ভেলায় ভেসে কাটিয়ে দেওয়া যায় না। জীবনের আরও অনেক দাবী আছে। সেসব মানতে হয়। পূরণ করতে হয়। এটুকু বুঝতে না পারার মতো আহাম্মক শতরূপা নয়। পেশাদারি প্রতিযোগিতায় সে সহজে জিতেছে এতদিন। প্রেমের প্রতিযোগিতাতেও হেরে যাবে না। গাড়ির ভেতরে চোখ বুলিয়ে নিঃশব্দে হেসে উঠল শেখর।
১১
‘গাড়ির ভেতরে কী দেখতে পাচ্ছেন তীর্থঙ্করবাবু?’
প্রজাপতির মতো শব্দগুলো উড়ছে তীর্থঙ্করকে ঘিরে। সে তাকিয়ে দেখল, গাড়ির সামনে-পেছনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে ছ’জন। তাদের সব্বাইকে সে চেনে। খুব ভালো করে চেনে।
তীর্থঙ্করের ঠোঁট ফাঁক হল। একটু আগেও যে জড়তাটুকু তার জিভে ছিল, সেটা কেটে গিয়েছে। স্পষ্ট ভাষায় সে বলল, ‘ছ’জন। অলোক, সুজন, সমর, শতরূপা, সঞ্জীবন, শেখর।’
‘আর?’ আবার উড়ে এল কিছু শব্দ, ‘আর কী দেখতে পাচ্ছেন?’
তীর্থঙ্কর বলল, ‘গাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। সব কাচ তোলা। তবু শীতল পলকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে ভেতরে।’
‘আর? গাড়ির ভেতরে আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না?’
‘ছ’জন ছাড়াও একজন রয়েছে গাড়িতে। ড্রাইভার। ওর নাম থাংকু।’
১২
‘থাংকু ভাইয়া, শিসা অর থোড়া উঠা দোগে?’
বড্ড ঠান্ডা লাগছে শতরূপার। কবজি উল্টে ঘড়িটা দেখল। সাড়ে আটটা। লাচেনে পৌঁছতে আরও ঘণ্টাখানেক বোধহয় লাগবে। নাকি আরও বেশি? কতদূর এসেছে তারা, কে জানে! গায়ের পাতলা চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিল সে। গাড়িতে টানা বসে থাকার একটা যন্ত্রণা আছে। কোমর ধরে যায়। হাঁটুতে একটা ব্যথা শুরু হয়। সে নিয়মিত জিম করে। বেশ ফিট। তবু শতরূপার সমস্যা হচ্ছে। তা ছাড়া পাহাড়ি রাস্তার টার্নিংগুলো এত শার্প যে, গা গুলিয়ে ওঠে। কোলড্রিংসের একটা বোতল যে কারণে হাতে রেখেছে শতরূপা। কোকের বোতলে একটা সিপ দিল সে।
গাড়ির ছাদে অবিরাম বৃষ্টির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না শতরূপা। সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো গাড়ির যান্ত্রিক আওয়াজ। যে পাঁচ পুরুষের মাঝে সে বসে রয়েছে, তারা আশ্চর্যজনক ভাবে চুপচাপ। শতরূপা বিরক্ত হল। জোনাল মিটিংয়ের জন্য শিলিগুড়িতে না এলে এখানে মোটেও আসত না সে। এমন নয় যে, সে এই পুরুষদের দলে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সুজন, অলোক, শেখররা মোটেও খারাপ মানুষ নয়। বরং অত্যন্ত কেয়ারিং। তার ব্যাপারে স্পর্শকাতর। তার নারীসত্ত্বা বোঝে, এরা প্রত্যেকেই তাকে মনে মনে চায়। এরা তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কাঙাল।
পাঁচবছর হল এই কোম্পানিতে কাজ করছে সে। এরা তার বন্ধু হলেও বরাবর একটা সূক্ষ দূরত্ব বজায় রেখে চলে। শতরূপা জানে, এটুকু ব্যক্তিত্ব মানুষের না থাকলে অস্তিত্ব রাখা দায় হয়ে পড়ে। তা ছাড়া সেও তো একজনকে ভালোবাসে। সেও যে তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে, তার চোখের উপচে পড়া ভাষায় বহুবার পড়েছে শতরূপা। সে অনেকদিন ধরে তার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। কিন্তু সে এগিয়ে এসে শতরূপাকে তার মনে কথা বলার সাহস করেনি। তার কথা মনে পড়তেই একটু হাসি পেল শতরূপার। নাহ্, এবার তাকেই এগোতে হবে। নিজেই তার মনের কথা বলবে ছেলেটিকে। একটা মেয়ের পক্ষে ব্যাপারটা বেশ বেমানান। কিন্তু কী করবে? আর অপেক্ষা করা যায় না। শতরূপা যখন বলবে, সে ভালোবাসে তাকে, কী হবে তার চোখমুখের অবস্থা? ভেবে হেসে ফেলল শতরূপা।
গাড়িটা একটা নির্দিষ্টি গতিতে এগোচ্ছে। এই পরিবেশে শতরূপার দমবন্ধ হয়ে আসছে। ছেলেগুলো চুপচাপ কেন? অসহ্য লাগল তার। হইহই ব্যাপারটা না থাকলে বেড়াতে আসার মজা নেই।
‘আরে তোমরা সবাই এত সিরিয়াস মুখে বসে আছো কেন? থাংকুর বদলে তোমরা গাড়ি চালাচ্ছো নাকি?’
১৩
‘গাড়ি থাংকু চালাচ্ছে না! আপনি ভুল দেখছেন, তীর্থঙ্করবাবু!’
সেই ঈষৎ গম্ভীর গলা আবার শুনতে পেল তীর্থঙ্কর। তার শরীর অজান্তেই কেঁপে উঠল। কী বলছে লোকটা? থাংকুই তো গাড়ি চালাচ্ছে। সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে তাকে। ওই তো, ফর্সা মতো সিকিমিজ ছেলেটা! কালো টুপি হুডটা একটু বেশি নামিয়ে রেখেছে কপালের ওপর।
‘থাংকু কোথায়? গাড়ি তো আপনিই চালাচ্ছেন! হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনিই!’ সুর বদলে লোকটার গলা খাদে নেমে গেল যেন। অনেক দূর থেকে আবছা ভেসে আসছে শব্দগুলো।
‘আমি! আমি চালাচ্ছি?’
তীর্থঙ্কর অবাক হয়ে বলল কথাগুলো। সে কী করে গাড়ি চালাবে? সে তো নেই-ই সেখানে। তীর্থঙ্কর বিড়বিড় করে কিছু বলার চেষ্টা করল। শব্দগুলো জন্ম নেওয়ার আগেই তার বুকের খাঁজে হারিয়ে গেল। সে অবাক হয়ে দেখল, যে কন্ঠস্বর নিয়ন্ত্রণ করছে তাকে, সে ভুল বলেননি। আবেশের মধ্যেই তীর্থঙ্কর আবিষ্কার করল, ড্রাইভারের সিটে থাংকু বসে আছে আগের মতো। হ্যাঁ থাংকুই। শুধু তার অভ্যন্তরে বাসা বেঁধেছে তীর্থঙ্কর। এই মুহূর্তে তারই হাতে স্টিয়ারিং!
১৪
স্টিয়ারিং হাতে মন দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে থাংকু। সে দিকে তাকিয়ে তেতো গলায় সুজন বলল, ‘মাইরি, এত বিরক্তি অফিসের সেমিনারের সময়ও লাগে না। আর কতক্ষণ বসে থাকব, বলো তো?’
পেছন থেকে শেখর বলল, ‘যা বলেছিস ভাই। গাড়িটা কোথাও একটা দাঁড় করালে ভালো হতো। এ কখন যে লাচেন পৌঁছবে কে জানে। খিদেয় পেট চোঁচোঁ করছে!’
‘গানবাজনা, গালগল্প করলে তো পারো। খিদে পাবে না!’ কপট রাগ দেখিয়ে বলল শতরূপা।
অলোক বোধহয় ঝিমোচ্ছিল। গলা ঝেড়ে বলল, ‘কোথাও এক কাপ চা পেতে পারি ড্রাইভার সাহেব? ঠান্ডায় হাত পা জমে যাবে মনে হচ্ছে।’
সঞ্জীবন জলের বোতলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখান থেকে দু-এক সিপ দিয়ে দেখ, মনে হবে নব্বই মিনিটের ফুটবল ম্যাচ খেলে উঠেছিস।’
‘ধুর!’ খেঁকিয়ে উঠল সমর। ‘আমি বলি কি, শতরূপা একটা সারপ্রাইজের কথা বলছিল না আসার সময়। আর সাসপেন্স না রেখে ওটাই বলুক বরং।’
‘তা-ই-ই-ই হোক তবে!’ বাকিরা হইহই করে উঠল।
১৫
হইচইয়ের মধ্যে ক্ষীণ কিন্তু দৃঢ় কন্ঠস্বরটা আবার শুনতে পেল তীর্থঙ্কর, ‘রাস্তায় কী দেখতে পাচ্ছেন?’
‘বৃষ্টিতে কাদায় ডুবে থাকা পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ। গাড়িটা দুলছে। রাস্তার বেহাল অবস্থার জন্য।’
‘আর কী দেখতে পাচ্ছেন?’
‘বাঁদিকে রাস্তার ধারে ঘোর অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে। যেন কেউ যত্ন করে কালি ঢেলে দিয়েছে সেখানে। কুয়াশা পেঁজা তুলোর মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে, খাদের ধার বেয়ে এগোচ্ছে গাড়িটা।’ থেমে থেমে বলল তীর্থঙ্কর।
‘আপনার স্টিয়ারিংটা বাঁদিকে ঘোরান। তাড়াহুড়ো করবেন না। ধীরে, খুব ধীরে।’
১৬
ধীরে, খুব ধীরে মুখটা তুলল শতরূপা। তার লজ্জা করছে। উত্তেজনা হচ্ছে তার। রোমাঞ্চিতও। আপেলের মতো লাল হয়ে গিয়েছে তার গাল। তপ্ত বাস্পমাখা শব্দে শতরূপা বলল, ‘অ্যাই তোমরা থামবে! আমি তখন মজা করেছিলাম। কোনও সারপ্রাইজ নেই।’
‘বললেই হল। আছে তো বটেই। না হলে তুমি ওভাবে বলতে না!’ সামনের সিট থেকে হাতে ভর দিয়ে পুরো শরীরটা শতরূপার দিকে ঘুরিয়ে বলল অলোক।
শতরূপার পাশ থেকে সমর বলে উঠল, ‘একদম ঠিক কথা। এখন তো আর কথা ঘোরালে চলবে না ম্যাডাম!’ সুজন, সঞ্জীবন, শেখর তালে তাল মেলাল।
শতরূপা নিঃশব্দে হাসল। আশা-আশঙ্কা কাজ করছে তার মনে। একটা অদ্ভুত দোলাচল। একটা ভালোলাগা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে শরীর জুড়ে। যে বাঁধনহারা ঠান্ডা জমে ছিল তার হাতের আঙুল, শরীরের খাঁজে খাঁজে, চিবুকের তলায়, সে সব আচমকাই ছেড়ে যেতে লাগল তাকে। প্রেম নিজেই উষ্ণ আধার। শতরূপার ধমনী, শিরায় বইতে শুরু করল তরল উত্তপ্ত ভালোবাসা।
সে বলল, ‘বলতে পারি, তবে ব্যাপারটা কাউকে বলা যাবে না। প্রমিস করলে, তবেই বলব।’
গাড়ির যান্ত্রিক ঘড়ঘড়ে আওয়াজ আর ছাদে বৃষ্টির ছটফটানি ছাড়া আর কোনও শব্দ সহসা শোনা গেল না।
‘বেশ, তাই হবে!’ শুধু সুজন বলল নীচুগলায়।
১৭
নীচুগলায় থেমে থেমে ভেসে শব্দগুলো আবার শুনল তীর্থঙ্কর। ‘এবার স্টিয়ারিংটা ঘোরান ধীরে ধীরে। আরও কাটান গাড়িটা। বাঁদিকে নিয়ে যান। আরও আরও।’
দূর থেকে ভেসে আসা মন্ত্রের মতো শব্দগুলো শুনল তীর্থঙ্কর। যেন কেউ বশ করে ফেলেছে তাকে। তার কাজই হল, শুধু নির্দেশ পালন করা। তীর্থঙ্কর নির্দেশ পালন করার চেষ্টা করল। সে আর কোনও শব্দ শুনতে পেল না। অখণ্ড নীরবতা গ্রাস করেছে তাকে। তার মনে এতক্ষণ যে সেতুটা প্রবলভাবে, সেটাও যেন শ্বাস রোধ করে দেখছে তীর্থঙ্করকে।
১৮
ভালোবাসা বোধহয় দুটো পাহাড়ের মাঝে দোদুল্যমান একটা সেতু। প্রচণ্ড উৎকন্ঠা নিয়ে সবাই ওই সেতুটুকু পার করতে চায়। যত দ্রুত সম্ভব পেরিয়ে যেতে চায়। শতরূপার এখন সে-ই রকম অবস্থা। যে প্রেমের গভীরে বাস করে সে জানে, ভালোবাসা আসলে একটা মন্ত্রের মতো। একটা ধর্মের মতো। যে বিশ্বাস করে, একমাত্র সে-ই দীক্ষা নেয়।
ঘোরলাগা গলায় শতরূপা বলল, ‘চেষ্টা করেছি এর আগেও কয়েকবার, তাকে আমার মনের কথা বলার। কিন্তু পারিনি। আমি জানি, সে আমাকে ভালোবাসে। সেও চায় বলতে তার মনের কথা।’
গাড়ির পাঁচটা পুরুষ রূদ্ধশ্বাসে শুনছে শতরূপার কথা। আবছা অন্ধকারেও বোঝা গেল সুজন মিষ্টি করে হাসছে। ছটফটে অলোক আচমকা চুপ করে গিয়েছে। সঞ্জীবনের দুটো ঠান্ডা হাত উত্তেজনায় আঁকড়ে ধরেছে একে অপরকে। শেখর ভুল করে চুমুক দিয়ে বসল মদ মেশানো জলের বোতলে। সমর বাকিদের উপস্থিতি ভুলে উষ্ণতা খোঁজার জন্য শতরূপার দিকে আরও একটু সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। যেন ছ’জন একটা বন্ধনীতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। একই স্বপ্নের আধারে আটকে পড়া কিছু মানুষ।
শতরূপা বলল, ‘ছেলেটা মুখচোরা। কিন্তু আমার বিশ্বাস, ওর হৃদয়ে একটা সবুজ পাহাড়ি ভ্যালি আছে। তোমরা সবাই চেনো তাকে।’
শতরূপার কথাগুলো কি শুনতে পেল ওরা? রাস্তার বাঁদিকটা অসীম কালচে রংয়ে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। ওই নিবিড়, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার গ্রাস করতে শুরু করল অলোক, সুজন, সমর, সঞ্জীবন, শেখরদের। অন্ধকারের পথেই যেন তারা এগিয়ে যাচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
১৯
শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে যেন একই পথ হাঁটছে তীর্থঙ্কর। এই অঢেল পথের শেষ কোথায় সে জানে না।
‘আরও বাঁদিকে ঘোরান স্টিয়ারিংটা। আরও, আরও।’
সন্মোহিতের মতো স্টিয়ারিং পুরোপুরি বাঁদিকে ঘুরিয়ে দিল তীর্থঙ্কর। গাড়িটা ধীরে ধীরে বেঁকে যাচ্ছে বাঁদিকে। খাদ টানছে তাকে। থোকাথোকা কুয়াশা ঘিরে ধরছে। তবু তীর্থঙ্কর থমকে গেল। দূর থেকে ভেসে আসা মোহময় পুরুষ কন্ঠ ছাপিয়ে একটা চেনা নারী কন্ঠ ভেসে উঠছে। সে কী বলতে চায়?’
২০
‘সে কী বলতে চায়, তার মনে কী আছে, আমি জানি। আমি নিজে না এগোলে সে কোনও দিন তার মনের কথা বলতে পারবে না, খুব ভালো করে জানি। এখান থেকে ফিরে গিয়ে ওকে বলব মনের কথা। সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাত, সংকোচ ভুলে আমাকেই বলতে হবে, তীর্থঙ্কর তোমাকে আমি ভালোবাসি। প্রচণ্ড ভালোবাসি।’
২১
‘তীর্থঙ্কর তোমাকে আমি ভালোবাসি। প্রচণ্ড ভালোবাসি।’
বলতেই হত শতরূপাকে এই কথাগুলো? পাঁচটা পুরুষ হতভম্বের মতো বসে রয়েছে নিজের নিজের সিটে। যেন তারা স্থবির হয়ে গিয়েছে। যেন পাথরের মূর্তি। স্বপ্নবন্ধনীর মাঝে হঠাৎই জমে উঠেছে হতাশা আর দীর্ঘশ্বাসের ঢেউ তোলা সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে তারা। যত সময় যাচ্ছে এই সমুদ্র আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। প্রবল জোলোচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সব কিছু।
গাড়িটা খাদের দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। হতভম্বের মতো বসে রয়েছে পাঁচটা পুরুষ। স্বপ্নের জগতে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে শতরূপা। গাড়ির ড্রাইভার এক্সেলটরে চাপ দিয়েও যেন বাক্রুদ্ধ হয়ে গেল। এ কী শুনল সে? তীর্থঙ্করকে ভালোবাসে মেয়েটা? শতরূপা…
তার শরীর ছটফট করে উঠল। সে প্রাণপণে ডানদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করল গাড়ির স্টিয়ারিং। আঁকড়ে ধরল হ্যান্ডব্রেক। তবু পারল না। সে দেখল, তার সমস্ত অন্তিম চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে এক নারীকে ঘিরে বসে থাকা ছ’টা পুরুষকে নিয়ে খাদের দিকে হামাগুড়ি দিচ্ছে একটা টাটা সুমো। এখনই ওটা লাফিয়ে পড়বে পাহাড় থেকে। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল ড্রাইভার তীর্থঙ্কর।
২২
তীর্থঙ্করের যন্ত্রণামাখা মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শুভ্র আচার্য। যেন তার মনের মধ্যে যন্ত্রণার গোপন উৎসস্থলটা খোঁজার চেষ্টা করছেন তিনি।
গম্ভীর গলায় প্রফেসর বললেন, ‘মুখটা মুছে নিন।’
লালচে আলোমাখা ঘরটা চোখের সামনে ফুটে উঠেছে তীর্থঙ্করের। প্রফেসর শুভ্র আচার্য তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘোর কাটতেই সে পুরো ঘরটা তন্নতন্ন করে খোঁজার চেষ্টা করল। এতক্ষণ যে গাড়িটাতে সে ছিল, সেটা কোথায়? ওটা কি তলিয়ে গেল খাদে? সে পুরোটাই স্বপ্ন দেখছিল? নাকি, সে যা দেখল, সেটাই সত্যি?
ধড়ফড় করে উঠে বসার চেষ্টা করল তীর্থঙ্কর। চেপে ধরল শুভ্র আচার্যের হাত।
ভয়ার্ত গলায় তীর্থঙ্কর বলল, ‘গাড়িটা তলিয়ে গেল খাদে, জানেন? সবাই মরে গেল? কেউ কি বাঁচেনি? আপনি প্লিজ শতরূপাকে বাঁচান। প্লিজ।’
ঠান্ডা গলায় প্রফেসর বললেন, ‘আপনি স্বপ্ন দেখতে চাওয়ার আগেই বলেছিলাম, নিশ্চিত হয়ে নিন, কী চাইছেন। এখন আর কোনও কিছুই আমার হাতে নেই।’
দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল তীর্থঙ্কর, ‘কিন্তু ও যে আমাকেই ভালোবাসে, প্রফেসর! আমি জানতাম না। বিশ্বাস করুন, জানতাম না। আমি ভেবেছিলাম…’
তীর্থঙ্করের দিকে জলের গ্লাস এগিয়ে দিলেন শুভ্র আচার্য। মৃদু একটা হাসি লেগে রয়েছে তাঁর মুখে।
কেটে কেটে প্রফেসর বললেন, ‘নিজেকে সামলান। আপনি যা করতে চেয়েছিলেন, সেটা করেছেন। এটাই তো প্রাপ্তি।’
গলা শুকিয়ে গিয়েছে তীর্থঙ্করের। সে গ্লাসের জলটুকু এক চুমুকে খেয়ে নিল। তারপর যন্ত্রণাভরা চোখে আবার তাকাল শুভ্র আচার্যের দিকে। লোকটর মুখে হাসির রেখা ছড়িয়ে আছে। এটা আরও বেশি ভাঙচুর চালাচ্ছে তীর্থঙ্করের মধ্যে। সে কেন করল এমন কাজ? এত হঠকারী না হলেই হচ্ছিল না? ভদ্রলোককে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সে-ই চেয়েছিল এটা। পরশু যখন শুনেছিল, শিলিগুড়িতে অফিসের সেমিনারের পর সুজন, অলোকদের সঙ্গে দু’দিনের জন্য শতরূপা লাচেন বেড়াতে যাচ্ছে, তখনই সে ঠিক করে নিয়েছিল, কী করবে। শতরূপাকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে। আর যাকে ভালোবাসে, তাকে অন্যের হতে দেবে না। অজান্তেই তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল একটা পাশবিক লিপ্সা। প্রতিশোধ স্পৃহা। আগুন জ্বলছিল তার মনে। তার নরম তুলতুলে ভালোবাসাটা সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। তীর্থঙ্কর ভেবেছিল, প্রতিশোধটা নেওয়ার পর সে শান্ত হবে। কিন্তু নিজের আগুনে সে যে এখন নিজেই পুড়ে মরছে! এই দহনজ্বালা মারাত্মক। অসহনীয়!
শুভ্র আচার্যের কথা তীর্থঙ্কর শুনেছিল টিভির এক অনুষ্ঠানে। কথা তো বটেই, লোকটাকেও খুব রহস্যময় লেগেছিল তার। স্বপ্ন নিয়ে গবেষণা করছেন ভদ্রলোক। তাঁর গবেষণা নিয়ে প্রফেসর অনেক কথা বলেছিলেন। পুরোটা বুঝতে না পারলেও শুভ্র আচার্যের একটা কথা মনে ছিল তার, স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে একটা মানুষকে আর একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই সেটা সম্ভব। স্বপ্নের একটা নিজস্ব আধার হয়। তার মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে অনেক কিছু করা যায়। পরশুই সে চন্দননগরে ছুটে এসেছিল শুভ্রবাবুর বাড়িতে।
তীর্থঙ্করের কাছে সবটা শোনার পর শুভ্র আচার্য বলেছিলেন, ‘আমার কাজ মস্তিষ্কের শুধুমাত্র সেই অঞ্চলটুকু নিয়ে, যেখানে স্বপ্ন জন্ম নেয়। আমার গবেষণা বলছে, যে কোনও মানুষকে তার স্বপ্নের মাধ্যমে যে কোনও জায়গায় নিয়ে চলে যাওয়া যায়। ওই পর্যায়টুকুতে সে ছায়াশরীর ধারণ করে। একজন বা বেশ কয়েকজনের স্বপ্নবন্ধনীর মধ্যে সে খুব সহজেই ঢুকে পড়তে পারে তখন। আর সেটা পারলে, সে যা চায়, নির্দ্বিধায় করে ফেলতে পারে। স্বপ্নের মধ্যে সে যাকে ইচ্ছে খুনও করতে পারে। যদি করেও, সে ধরা পড়বে না। কিন্তু যাকে বা যাদের খুন করল, সে বা তারা পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য সরে যাবে।’
শুভ্র আচার্য মাঝবয়সী লোক। কিন্তু তার দড়ি পাকানো চেহারা দেখে মনে হয়েছিল বয়স আশি হলেও হতে পারে। কঙ্কালের ওপর চামড়ার খোলস পরানো হলে যেমন হয়। কোটরে ঢুকে যাওয়া দুটো অসম্ভব জ্বলজ্বলে চোখ।
সেই দুটো চোখ ফেলে এখন তীর্থঙ্করকে দেখছেন শুভ্রবাবু। যেন তার ভেতরে কী চলছে, তা পড়ে নিতে চাইছেন তিনি। তীর্থঙ্কর অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে নিল। তার ভেতরে ক্ষরণ চলছে। ভালোবাসার অগ্নুৎপাত হচ্ছে। আক্ষেপের রক্তক্ষরণ হচ্ছে মুহুর্মুহু। যেন তার বুকের মধ্যে কেউ বুলডোজার চালাচ্ছে। শতরূপা তাকেই ভালোবাসত! আর একটু ধৈর্য ধরতে পারল না তীর্থঙ্কর? একবার কথা বলতে পারত শতরূপার সঙ্গে!
‘স্বপ্নবন্ধনীর মজা কী জানেন তীর্থঙ্করবাবু? এও অনেকটা ওষুধের মতো। সাইড এফেক্ট থাকে। স্বপ্ন তো কখনও শেষ হয় না। ভেঙে যেতে যেতে, মুছে যেতে যেতে নতুন চেহারায় ফিরে আসে।’
তীর্থঙ্কর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর থেমে থেমে কাঁপা গলায় বলল, ‘মানে? ককক্কী বলছেন আপনি, বুঝতে পারছি না!’
‘মানে? মানে বুঝতে পারছেন না আপনি?’ সশব্দে হাসলেন শুভ্র আচার্য। তার এই হাসি যেন শেষ হবে না। ঘরটাতে এখন আর লালচে আলোটা নেই। তার বদলে একটা মোমবাতি জ্বলছে। তার হলদেটে আলোয় ঘরটা যেন পোড়া চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঝলসানো, দগ্ধ একটা ঘর।
‘মানে হল’, হাসি থামিয়ে তার ওপর ঝুঁকে পড়েছেন প্রফেসার। ‘অনেকগুলো একই বাসনা বা স্বপ্ন থেকে তৈরি হয় স্বপ্নবন্ধনী। মানুষগুলো না থাকলেও সে স্বপ্নগুলো হারিয়ে যায় না। বরং তারা ঠিক থেকে যায়। সেগুলো ফিরে আসতে চায় অন্য চেহারা নিয়ে। চাইলেও আটকানো যায় না!’
তীর্থঙ্কর ভয় পেল। তার গলা শুকিয়ে গিয়েছে। জড়িয়ে যাচ্ছে তার জিভ। ঢোঁক গিলে কোনও রকমে সে বলল, ‘আপনি তো আগে বলেননি?’
শুভ্র আচার্য হাসলেন। আগের মতোই। হাসির দমকে তাঁর শুকনো চেহারাটা এলোমেলো দুলছে। যেন ঝড়ের তাণ্ডবে পড়ে অসহায় হয়ে পড়েছে সদ্য নবীণ কোনও গাছ।
‘অন্য চেহারা মানে, আপনি কী বলতে চাইছেন?’ তীর্থঙ্কর মৃদু গলায় আবার বলল।
শুভ্র আচার্যের হাসি ক্রমশ গভীর হচ্ছে। তাঁর হাসি ঘরের চার দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। প্রতিধ্বণির মতো ফিরে ফিরে আসছে। আচমকা হাসি থামিয়ে গম্ভীর ঘষাটে গলায় বললেন, ‘স্বপ্নেরও তো অতৃপ্তি থাকে, নাকি? থাকে না? অপূর্ণতা তো ওই স্বপ্নেরই হয়! কী, হয় না?’
২৩
টলতে টলতে প্রফেসর ঘর থেকে বেরিয়ে এল তীর্থঙ্কর। চন্দননগরে গঙ্গার গায়ে শুভ্র আচার্যের বাড়ি। জায়গাটা বেশ নির্জন। গাছগাছালিতে ভরা। রাত নেমেছে এখানে। দু’পারে জমে থাকা সমস্ত আলো যেন গঙ্গার জলে মিশে পাক খেতে খেতে ভেসে যাচ্ছে। তীর্থঙ্কর দেখল, ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁয়েছে। তাড়াতাড়ি পা চালালে কলকাতা ফেরার লাস্ট ট্রেনটা সে পেয়ে যাবে। নির্জন রাস্তা ধরে তীর্থঙ্কর হাঁটতে শুরু করল। স্টেশন থেকে আসার সময় মোড়ের মাথায় রিক্সা থেকে নেমেছিল। ওখানে একটা রিক্সা স্ট্যান্ড দেখেছিল তখন। সে দিকে এগোনোর সময় মোবাইলটা বেজে উঠল তীর্থঙ্করের। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে স্ক্রিনে ফুটে ওঠা নামটা দেখে সে অবাক হয়ে গেল— শতরূপা!
মুহূর্তে হাত কেঁপে উঠল তীর্থঙ্করের। শতরূপা বেঁচে আছে? গাড়িটা খাদে পড়ে যাওয়ার সময় কি…
ফোনটা কানে দিতে ওপার থেকে শতরূপার ভয়ার্ত গলা শুনতে পেল সে।
‘তীর্থ! তীর্থ, আমি! আমি শতরূপা!’
শতরূপার গলার আওয়াজ পেয়ে তীর্থঙ্করের দুটো চোখ জলে ভরে গেল। শতরূপা বেঁচে আছে! যে মারাত্মক ঘটনাটা ঝোঁকের বশে সে ঘটিয়েছে, সেটার জন্য সারাটা জীবন অপরাধী থাকতে হবে তাকে। অন্তত শতরূপার মুখে দিকে তাকিয়ে সে তার যন্ত্রণাটা কিছুটা ভুলতে পারবে। তীর্থঙ্কর প্রচণ্ড খুশিতে ভেসে গেল। এতক্ষণের খারাপলাগাটা যেন মুহূর্তে মুছে গেল খানিকটা। কিছুটা ভারহীন লাগল নিজেকে। তা হলে সে স্বপ্নই দেখেছে? প্রফেসর কি হিপনোটাইজ করেছিলেন তাকে? একটা মিথ্যে স্বপ্ন দেখানোর জন্য? প্রফেসরের স্বপ্নবন্ধনী মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে। তৃপ্তিতে দুটো চোখ যেন বুজে এল তার।
শতরূপাকে সে এতদিন মনে মনে রূপা বলে ডেকে এসেছে। আজ সব ভুলে সেই নামেই ডেকে উঠল তীর্থঙ্কর। ‘রূপা, তুমি কোথায়? কোথায় তুমি?’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সে।
শতরূপা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘জানো তীর্থ, আমরা সবাই মিলে লাচেনের দিকে যাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে অনেক দেরি হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে গাড়ি চালাতে অসুবিধা হচ্ছিল ড্রাইভারের। হঠাৎ দেখলাম, গাড়িটা হঠাৎ খাদে তলিয়ে যাচ্ছে। আমি গাড়ির ডানদিকে, ড্রাইভারের পিছনে বসে ছিলাম। কিছু না ভেবে লাফিয়ে নেমে পড়েছি। না হলে সুজন, অলোক, সঞ্জীবনদের মতো আমিও তলিয়ে যেতাম খাদে!’
তীর্থঙ্কর থমকে গেল। গলা শুকিয়ে গেল তার। মানে? স্বপ্নবন্ধনীর মাঝে তা হলে সে সত্যিই আটকে পড়েছিল? প্রফেসর মিথ্যে বলেননি? যা ঘটেছে, সব সত্যি?
তীর্থঙ্কর কাঁপা গলায় বলল, ‘রূপা, তুমি কোথায় আছো? কী অবস্থায় আছো? চোট লাগেনি তো?’
শতরূপা বলল, ‘না গো, আমি একদম ঠিক আছি। কিন্তু ওরা পাঁচজন? ড্রাইভারটাও ছিল। ওরা যে তলিয়ে গেল খাদে? ওরা আমার চোখের সামনে মরে গেল, তীর্থঙ্কর!
শতরূপাকে থামিয়ে তীর্থঙ্কর কোনওরকমে গলায় বলল, ‘আমি বুঝতে পেরেছি রূপা। চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখার পর মনের ওপর কতটা চাপ পড়ে, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তো চলবে না। অনেক রাত হল। তুমি কাউকে একটা ফোন করার চেষ্টা করো। রেসকিউ টিম ডাকতে হবে। আমিও দেখছি এখান থেকে, কী করা যায়।’
একটু ভেবে তীর্থঙ্কর বলল, ‘তুমি এক কাজ করো, একটু পেছনের দিকে হাঁটো। দেখতে পাবে একটা চায়ের দোকান আছে। একটু আগেও দেখেছি, ওটা খোলা ছিল।’
ফোনের ওপার থেকে কিছু শোনা যাচ্ছে না। শতরূপার কথা থেমে গিয়েছে আচমকা। ফোনটা কি কেটে গেল? তীর্থঙ্কর মোবাইলটা দেখল। নাহ্, লাইন তো কাটেনি! তবে?
তীর্থঙ্করের ‘হ্যালো-হ্যালো’র মাঝে ভেসে এল থমথমে গলা, ‘তুমি কী করে জানলে তীর্থঙ্কর, এখানে একটা চায়ের দোকান আছে?’
থেমে গিয়েছে তীর্থঙ্করও। আবছা অন্ধকারে একটা চায়ের দোকান সে স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে দেখেছিল। সেটা ফেলে একটু এগিয়ে গাড়িটা খাদের দিকে ঠেলে দেয় সে।
‘তুই কী করে জানলি তীর্থ?’
কতগুলো পুরুষালি শব্দ ছুটে এল পেছন থেকে। তীর্থঙ্কর প্রচণ্ড ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ঘুরতেই দেখল সুজন। তীর্থঙ্কর আশ্চর্য হয়ে তাকাল তার দিকে।
‘সুউউজন, তুতত্তুই?’ কোনওরকমে বলল তীর্থঙ্কর। বলতে বলতে চমকে উঠে তীর্থঙ্কর দেখল, শুধু সুজন নয়, তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, অলোক, সঞ্জীবন, সমর, শেখর।
তীর্থঙ্কর আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল। ‘আআআআমি কিছু করিইইনি! বিশ্বাস কর তোরা!’
‘তীর্থ তুমি কী করে করলে এটা!’
শতরূপার গলার আওয়াজ পেয়ে তীর্থঙ্কর পেছন ঘুরল। হ্যাঁ, শতরূপাই! তার মাথার একটা দিক থেঁতলে গিয়েছে। রক্ত ঝরছে বাঁ চোখ থেকে। মাথাটা কাঁধের বাঁদিকে ঝুলে রয়েছে। রক্তে ভেজা সারাটা শরীর। এমন সুন্দর একটা চেহারাটা নিয়ে যেন ছিনিমিনি খেলেছে কেউ। তার সমস্ত রূপ ঢাকা পড়ে গিয়েছে নারকীয় দুর্যোগে।
তীর্থঙ্কর দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল। সে পরিণাম না বুঝেই করে ফেলেছে কাজটা। ভেজা গলায় বলল, ‘আমি জানতাম না। বিশ্বাস করো, আমি জানতাম না তুমি আমায় ভালোবাসো, রূপা।’
শতরূপা তার দিকে দু’হাত তুলে ধরল। ‘আর তুমি? আমাকে ভালোবাসো না, তীর্থ? বলো, ভালোবাসো না?’
তীর্থঙ্কর কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই বুঝতে পারল, তার পাঁচ বন্ধু তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তার পিছনে। সুজন, শেখররা হাসছে। হাসছে শতরূপাও। এ হাসি যেন থামবে না কোনও দিন। তীর্থঙ্কর বুঝতে পারল, শুভ্র আচার্য ভুল বলেননি। স্বপ্নবন্ধনীর মধ্যে ঢুকে পড়লে আর বেরোনো যায় না। এর হাত থেকে আর মুক্তি নেই। যতক্ষণ না সে নিজেই মিশে যাচ্ছে তাতে।
তীর্থঙ্কর তাকিয়ে দেখল শতরূপাকে। অলোক, সঞ্জীবনদের। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তার নিজের তৈরি করা স্বপ্নবলয়ের দিকে।