মৎস্যকন্যার খোঁজে
জাহাজটা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেল সুদীপ্ত৷ এ ধরনের জাহাজ সে আগে কখনও দেখেনি৷ কেপটাউন বন্দরের মূল জেটিতে যেখানে বিরাট বিরাট পণ্যবাহী জাহাজ বা যাত্রীবাহী জাহাজগুলো দাঁড়িয়ে আছে, তার থেকে বেশ কিছুটা তফাতে একলা দাঁড়িয়ে ছিল জাহাজটা৷ ছোট একটা জাহাজ৷ লম্বাটে ধরনের৷ তার সামনের আর পিছনের অংশটা অত্যন্ত সরু আর ছুঁচোলো মাকুর মতো দেখতে৷ ডেকের ওপরটা প্রায় ন্যাড়া বললেই চলে৷ ক্যাপ্টেনের একটা কেবিন আছে সেখানে৷ আর ডেকের ঠিক সামনে বসানো আছে কামানের নলের মতো একটা নল৷ সেটা সম্ভবত চারপাশে, ওপর-নীচে ঘোরানো যায়৷ নলের পিছন থেকে লম্বা কাছি বেরিয়ে একটা লোহার স্তম্ভকে ময়াল সাপের মতো আলিঙ্গন করে আছে৷ সাত-আটজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল ডেকে৷ যেন সুদীপ্ত আর হেরম্যানের জন্যই প্রতীক্ষা করছিল তারা৷ হেরম্যান অবশ্য তাঁর মালপত্র আগেই জাহাজে উঠিয়ে ফেলেছিলেন, সুদীপ্তকে জাহাজে নিয়ে আসার জন্য একজন লোককে নিয়ে একটা ছোট নৌকোয় জেটিতে গেছিলেন৷ সুদীপ্তকে নিয়ে হেরম্যান ডেকের উপর উঠে আসতেই একজন লোক এসে দাঁড়াল তাদের সামনে৷ লোকটার বয়স আনুমানিক বছর ষাট৷ গায়ে তিমি মাছের ছবি আঁকা হাফহাতা গেঞ্জি৷ পেশিবহুল ডান বাহুতে একটা ‘অ্যাঙ্কর’ অর্থাৎ নোঙরের উল্কি আঁকা আছে৷ লোকটা শ্বেতাঙ্গ, তবে তার মুখ রোদে পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে৷ গায়ের রংও তামাটে বর্ণের৷ লোকটাকে দেখে পাকা জাহাজি বলেই মনে হয়৷ লোকটা সামনে এসে দাঁড়াতেই হেরম্যান সুদীপ্তকে বললেন, ‘ইনি হলেন এই সিগাল জাহাজের ক্যাপ্টেন ও মালিক মিস্টার হ্যামার’, আর সুদীপ্তকে দেখিয়ে লোকটাকে বললেন, ‘আর এ-ই হল আমার বন্ধু সুদীপ্ত৷ ফ্লাইট পাঁচ ঘণ্টা লেট করেছে৷ তাই ওর আসতে দেরি হল৷ সারা পৃথিবীর নানা প্রান্তে আমরা একসঙ্গেই ঘুরে বেড়াই৷’ ক্যাপ্টেন হ্যামার সুদীপ্তর দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘হ্যালো৷ সিগালে আপনাকে স্বাগত জানাই৷’ সুদীপ্ত ক্যাপ্টেনের সঙ্গে করমর্দন করে বুঝতে পারল ক্যাপ্টেনের খসখসে হাতের বেঁটে বেঁটে আঙুলগুলো বেশ শক্তি ধরে৷ হেরম্যান এরপর চারপাশে তাকিয়ে বললেন, ‘মিস ক্যাথলিন কোথায় গেলেন?’
হ্যামার জবাব দিলেন, ‘তিনি খোলের ভিতর তাঁর কেবিনে বিশ্রাম নিচ্ছেন৷’ তারপর হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সাড়ে চারটে বাজে৷ পাঁচটা বেজে গেলে হারবার মাস্টার আর আজকের মতো জাহাজ ছাড়ার অনুমতি দেবেন না৷ আমি যাই৷ হারবার মাস্টারকে ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়ে জাহাজ ছাড়ার ব্যবস্থা করি৷ তারপর কথা হবে৷’—এই বলে তিনি এগোলেন তাঁর কেবিনের দিকে৷ সুদীপ্তর এখনও জানা নেই কোথায় পাড়ি জমাচ্ছে তারা, আর কেনই বা সেখানে যাচ্ছে৷ হেরম্যানের ডাক পেয়ে মাত্র কয়েকদিনের প্রস্তুতিতে কলকাতা থেকে কেপটাউনে সে উড়ে এসেছে৷ স্বাভাবিক- ভাবেই তারা কোথায় পাড়ি দিচ্ছে তা জানার জন্য সুদীপ্তর মনে উত্তেজনা কাজ করছে৷ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেরম্যান হেসে বললেন, ‘তোমাকে বেশিক্ষণ আর রহস্যের মধ্যে রাখব না৷ তবে তার আগে তোমাকে একবার কেবিন থেকে ঘুরিয়ে আনি৷ পোশাক পালটে ফ্রেশ হয়ে নাও৷ ততক্ষণে সূর্যের তাপও আর- একটু কমে যাবে৷ ডেকে বসে গল্প হবে৷’ এই বলে হেরম্যান সুদীপ্তকে তার মালপত্র সমেত নিয়ে চললেন খোলের ভিতরে নামার সিঁড়ির দিকে৷
বেশ কয়েকটা তল আছে কেবিনে৷ একেবারে নীচের তলের কেবিনে সুদীপ্তদের থাকার ব্যবস্থা৷ বেশ কয়েকটা কেবিন রয়েছে সেখানে৷ নিজেদের কেবিনে ঢোকার আগে পাশের একটা কেবিন দেখিয়ে হেরম্যান বললেন, ‘ওটা মিস ক্যাথলিনের কেবিন৷ পেশায় প্রকৃতিবিদ৷ স্কটিশ নাগরিক৷ আমাদের সফরসঙ্গী৷ ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার মৃদু সৌজন্য বিনিময় হয়েছে৷’
সুদীপ্তদের কেবিনটা বেশ সাজানো- গোছানো৷ ধবধবে সাদা বিছানা, চেয়ার- টেবিল, ওয়ার্ড্রোব সবই আছে৷ এমনকি একটা লম্বাটে ধরনের কাঠের সিন্দুকও ডালা খোলা অবস্থায় রাখা আছে৷ ঘরের একপাশের দেওয়ালের গায়ে একটা বৃত্তাকারের কাচের জানলা বা পোর্ট হোল আছে৷ বাইরের সূর্যের আলো সেখান দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছে৷ দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের জলরাশি৷ কেবিনটা বেশ পছন্দ হল সুদীপ্তর৷ হেরম্যান বললেন, ‘কেবিনে পাখার ব্যবস্থা নেই ঠিকই, তবে শীতকাল বলে এখানে থাকতে কষ্ট হবে না৷ তা ছাড়া আমরা যেদিকে যাব সেদিকটা এখন বরফের রাজ্য৷’
সুদীপ্ত তার জিনিসপত্র ওয়ার্ড্রোবে সাজিয়ে পোশাক পালটে ফ্রেশ হতে হতেই জাহাজটা দুলে উঠল, ইঞ্জিনের শব্দও কানে আসতে শুরু করল৷ সুদীপ্তরা যখন তাদের কেবিন ছেড়ে আবার ওপরে ডেকে উঠে এল, ততক্ষণে জাহাজটা জেটি ছেড়ে সমুদ্রের গভীরে এগোতে শুরু করেছে৷ সাত-আটজন লোক ডেকের নানা জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছে৷ শক্তপোক্ত চেহারার মাল্লা শ্রেণির লোক৷ কালো গাত্রবর্ণের আফ্রিকান৷ গায়ে ডোরাকাটা পোশাক, কারও মাথায় আবার বারান্দাওলা জাহাজি টুপি৷ জাহাজটা যন্ত্রচালিত হলেও একটা মাস্তুল আছে৷ তার গায়ে দড়াদড়ি দিয়ে গোটানো আছে বিরাট একটা পাল৷ সুদীপ্তদের দেখে একজন মাল্লা ভাঁজ করা দুটো কাঠের চেয়ার পাতল মাস্তুলের নীচে৷ হেরম্যান সুদীপ্তকে নিয়ে সেখানে বসলেন৷ বেলা পড়ে এসেছে৷ দিনের শেষ আলো খেলছে সমুদ্রের বুকে৷ একদল গাঙচিল খাবারের লোভে জেটি থেকে জাহাজটার পিছু ধাওয়া করেছে৷ ডেকের মাথার ওপর সাদা ডানা মেলে ওড়াউড়ি করছে তারা৷ বাতাসে মৃদু ঠান্ডা ভাব৷ যাত্রার শুরুটা বেশ মনোরম৷ জল কেটে এগোচ্ছে জাহাজ৷ সামনের দিকে তাকিয়ে ডেকে বসানো কামানের নলের মতো সেই নলটা দেখিয়ে সুদীপ্ত জানতে চাইল, ‘ওটা কী?’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘ওটা হল যন্ত্রচালিত হারপুন৷ তিমি শিকার ছাড়াও বড় আকৃতির সিল, সিন্ধুঘোটকও শিকার করা হয় এই হারপুন দিয়ে৷ এ জাহাজটা তিমি শিকারের জাহাজ৷ শিকার করতে চলেছে সাব আন্টার্কটিকায়, ভারত মহাসাগরে৷ ওখানে মারিয়ান নামের একটা দ্বীপ আছে৷ এই শীতকালে দ্বীপসংলগ্ন সমুদ্রতট বরফে ঢাকা থাকে৷ সমুদ্রের জলের উপরিভাগও কোথাও কোথাও পাতলা বরফে পরিণত হয়৷ তিমি, সিল, সিন্ধুঘোটক আর প্রচুর পেঙ্গুইন আছে সেখানে৷ আন্টার্কটিকা না হলেও আমরা যাচ্ছি সাব আন্টার্কটিকায়৷’
কথাটা শুনে বিস্মিত হল সুদীপ্ত৷ সে বলল, ‘এটা তিমি শিকারের জাহাজ! আমরা কি তবে কোনো দানবীয় তিমি বা জলচর প্রাণীর খোঁজে যাচ্ছি?’
হেরম্যান হেসে বললেন, ‘দানবীয় নয়, তবে জলচর তো বটেই৷’—এই বলে তিনি তাঁর পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে তার ভাঁজ খুলে সেটা সুদীপ্তর হাতে দিলেন৷ ‘হারবার নিউজ’ নামে একটা ইংরেজি কাগজের একটি অংশের প্রতিলিপি সেটা৷ সংবাদপত্রের তারিখ ঠিক এক বছর আগের৷ সুদীপ্ত পড়তে শুরু করল কাগজটা—
মারমেড দর্শন! মৃত্যু নাবিকের৷
নিজস্ব সংবাদদাতা, কেপটাউন বন্দর তিমি শিকারের কাজ শেষ না করেই নাবিকের মৃতদেহ নিয়ে বন্দরে ফিরে এল সিগাল নামের জাহাজ৷ তিমি শিকারের এই জাহাজ ভারত মহাসাগরের মারিয়ান দ্বীপে নোঙর করেছিল তিমি ও সিল শিকারের জন্য৷ জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক, সিগাল জাহাজের নাবিক গার্থের মৃতদেহ ফিরিয়ে এনেছে জাহাজ৷ নাবিকের মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে এক বিস্ময়কর ব্যাপার জানিয়েছেন জাহাজের ক্যাপ্টেন হ্যামার৷ ১২ ডিসেম্বর তারিখে ডেকে রাতপাহারার দায়িত্বে ছিল বৃদ্ধ নাবিক গার্থ৷ সারাদিনের পরিশ্রমের শেষে নিজেদের কেবিনে ঘুমোতে গেছিলেন ক্যাপ্টেন সহ অন্যরা৷ মাঝরাতে গার্থের আতঙ্কিত চিৎকারে ঘুম ভেঙে ডেকে উঠে আসেন সবাই৷ তাঁরা দেখেন চন্দ্রালোকে ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে গার্থ৷ ক্যাপ্টেন তাকে আতঙ্কের কারণ জিজ্ঞেস করতেই সে কোনোমতে জানায়, তীরের কাছে জলের ভিতর থেকে মাথা তোলা একটা বরফ মোড়া পাথরের ওপরে সে একজন মৎস্যকন্যাকে বসে থাকতে দেখেছে৷ চাঁদের আলোতে সেই মৎস্যকন্যা নাকি হাত নেড়ে জলে নামার জন্য ডাকছিল তাকে৷ ক্যাপ্টেন তাকে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই তার দৃষ্টিবিভ্রম৷ অনেক সময় সিলেরা জল থেকে পাথরের ওপর উঠে বসলে তাকে মানুষের মতো দেখতে লাগে৷ তেমনই কোনো কিছু দেখেছে নাবিক৷ কিন্তু নাবিক দৃঢ়ভাবে জানায় সে একজন মারমেডকেই দেখেছে৷ তার দেহের ওপরের অংশ মানবীর মতো, আর কোমরের নীচের অংশ মাছের মতো আঁশে ঢাকা পাখনাযুক্ত৷ যুগ যুগ ধরে মারমেড বা মৎস্যকন্যা নিয়ে নানা কুসংস্কার প্রচলিত আছে নাবিকদের মধ্যে৷ এই মৎস্যকন্যারা নাকি সুরের টানে নাবিককে ডুবিয়ে মারে সমুদ্রের জলে৷ মারমেডের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যে জাহাজ তাকে অনুসরণ করে, তাকেও কৌশলে ডুবোপাহাড়ে বা সমুদ্রস্রোতে ফেলে ডুবিয়ে দেয়৷ অনেক নাবিক মনে করে মারমেড দর্শন মানে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী৷ গার্থ নামের এই নাবিকের মনেও সম্ভবত এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল৷ কারণ, ক্যাপ্টেন তাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা সত্ত্বেও সে একসময় আতঙ্কে জ্ঞান হারায়৷ এবং ভোরের আলো ফোটার আগেই সে অবস্থাতেই তার মৃত্যু ঘটে৷ জাহাজের ক্যাপ্টেন হ্যামার ও সিগালের অন্য নাবিকদের জেরা করে গার্থের মৃত্যু সম্বন্ধে অন্য কোনো তথ্য পায়নি বন্দর কর্তৃপক্ষ৷ ময়নাতদন্তের পর নাবিক গার্থের মৃতদেহ কেপটাউনের ব্রিটিশ দূতাবাসের হাতে সমর্পণ করা হয়েছে৷ মারমেড দর্শনে বৃদ্ধ নাবিকের মৃত্যু হোক বা না হোক, এ ঘটনা নিয়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে বন্দর অঞ্চলে, বিশেষত স্বল্পশিক্ষিত নাবিকদের মধ্যে৷ যে কারণে ‘সি হক’ নামে অন্য একটি জাহাজের ওই অঞ্চলে যাত্রা বাতিল হয়েছে৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ওই মারিয়ান দ্বীপের কাছেই বছর দশেক আগে আলেকজান্ডার নামের সিল-শিকারি জাহাজের এক নাবিক মৎস্যকন্যা দেখার দাবি করেছিলেন৷ ওই মারিয়ান দ্বীপেই কি তবে মৎস্যকন্যাদের বাস?
কাগজটা পড়ে সুদীপ্ত বলল, ‘এবার বোধগম্য হল ব্যাপারটা৷ আমরা চলেছি মৎস্যকন্যার খোঁজে!’
হেরম্যান হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক তাই৷ মৎস্যকন্যার খোঁজেই এ জাহাজে উঠে বসেছি আমরা৷’
৷৷২৷৷
‘তাহলে আপনারাও মৎস্যকন্যার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন!’—নারীকণ্ঠের শব্দ শুনে সুদীপ্ত কাগজটা থেকে মুখ তুলে দেখল, তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন এক মহিলা৷ বয়স মনে হয় ছাব্বিশ-সাতাশ হবে৷ পরনে শার্ট-ট্রাউজার, গায়ের রং ইওরোপীয়দের মতো ফর্সা৷ কোমর পর্যন্ত নেমে আসা সোনালি চুল আর নীল চোখের মহিলার চোখে-মুখে বেশ একটা সপ্রতিভ ভাব আছে৷ হেরম্যান সুদীপ্তর সঙ্গে ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ইনিই মিস ক্যাথলিন৷ সেই স্কটিশ ভদ্রমহিলা৷’
আরও একটা চেয়ার আনা হল৷ ক্যাথলিন বসল সেখানে৷ তারপর মুক্তোর মতো ঝকঝকে হেসে দ্বিতীয়বারের জন্য প্রশ্নটা করল, ‘আপনারা বিশ্বাস করেন যে মৎস্যকন্যা বলে কিছু আছে?’
হেরম্যান হেসে জবাব দিলেন, ‘মৎস্যকন্যা বা মারমেডের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে এখনও প্রমাণিত না হলেও তা থাকতেও তো পারে৷ আমাদের চেনা পৃথিবীর বাইরে আমরা কতটুকুই বা জানি? এই মহাবিশ্ব তো এক অসম্ভবের দুনিয়া৷ কত রহস্যই যে এর আনাচেকানাচে লুকিয়ে আছে! আর আমরা দুজন তার সন্ধানেই ঘুরে বেড়াই!’
‘তার সন্ধানে ঘুরে বেড়াই মানে?’ জানতে চাইল ক্যাথলিন৷
সুদীপ্ত জবাব দিল, ‘ক্রিপটিভ খুঁজে বেড়াই আমরা৷ হেরম্যান হলেন ‘ক্রিপ্টোজুলজিস্ট’৷—এ শব্দের অর্থ জানেন?’
ক্যাথলিন তাদের এ পরিচয় পেয়ে বিস্মিত ভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, জানব না কেন? ‘ক্রিপ্টোজুলজিস্টরা রূপকথা, লোককথা বা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া প্রাণী খোঁজেন, যেমন হিমালয়ের ইয়েতি, ড্রাগন বা ডায়ানোসর৷ ঠিক বললাম?’
সুদীপ্ত হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছেন৷’
হেরম্যান বললেন, ‘আমরা মৎস্যকন্যার অস্তিত্বে বিশ্বাস করি কি না, করলে কেন করি আপনি জানতে চাইছেন তো? তাহলে এ ব্যাপারে কিছু কথা বলি আপনাকে৷’
সূর্য ডুবতে চলেছে সমুদ্রের বুকে৷ জল কেটে গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চলেছে জাহাজ৷ মৃদু চুপ করে থেকে হেরম্যান বলতে শুরু করলেন, ‘দেখুন, মারমেড বা মৎস্যকন্যার কাহিনি বহু প্রাচীন৷ পুরাণ, কিংবদন্তিতেও এর উল্লেখ আছে৷ শুধু একটা দেশে নয়, গ্রিক, ভারতীয়, স্কটিশ, আইরিশ, আফ্রিকান, নানা দেশের প্রাচীন রচনাতে৷ যেমন তার একটা উদাহরণ হল গ্রিক মহাকবি হোমারের লেখা ‘ওডিসি’৷ হাজার হাজার বছরের নৌ অভিযানের ইতিহাসেও নানাসময় মারমেড বা মৎস্যকন্যার কথা উঠে এসেছে৷ এর মধ্যে কিছু প্রামাণ্য বক্তব্যও আছে৷ ক্রিস্টোফার কলম্বাসের লগবুক থেকে জানা যায়, তিনি যখন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ অতিক্রম করছিলেন, তখন এক নির্জন দ্বীপের সমুদ্রতটে এক অর্ধমানবী-অর্ধমৎস্যকে একটা পাথরের ওপর বসে থাকতে দেখেছিলেন৷ তাঁর মতো বহু নাবিকই মৎস্যকন্যা দেখার কথা দাবি করেন৷ এমন কি আধুনিক পৃথিবীতেও নানাসময় এ দাবি উঠে এসেছে৷ আঠেরোশো নববই সালে আপনার স্কটল্যান্ডের সমুদ্রতটেই বহু মানুষ একসঙ্গে মৎস্যকন্যা দেখার দাবি করেছিলেন৷ তার কিছুকাল আগে স্কটল্যান্ডেরই এন্টাকুলা আইল্যান্ডে শ্যাওলা সংগ্রহ করতে গিয়ে ধীবররা মৎস্যকন্যা দেখেছিলেন বলে দাবি জানান৷ হাল আমলে মাত্র বছরখানেক আগে অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রতটে এক ফটোগ্রাফার দূর থেকে একজনের ছবি তুলেছিলেন৷ যাকে অর্ধমানবী-অর্ধমৎস্য বলেই মনে হয়৷ যারা সারা পৃথিবীর সামনে পশুপাখি-জীব জগতের জীবননাট্য তুলে ধরে টেলিভিশনের মাধ্যমে, সেই বিখ্যাত ‘অ্যানিম্যাল প্লানেট’ সম্প্রতি একটা টিভি শো সম্প্রচারিত করেছে মৎস্যকন্যা নিয়ে৷ তাতে তারা বলেছে, মৎস্যকন্যার ব্যাপারে তাদের কাছে অকাট্য প্রমাণ না থাকলেও এখনই তারা ব্যাপারটা উড়িয়ে দিতে রাজি নয়৷ আর এর পিছনে প্রধান কারণ হল মৎস্যকন্যা সম্পর্কে এতদিন ধরে চলে আসা বহু মানুষের দাবি৷ তাঁদের সবারই কি দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছিল? সবাই কি মিথ্যা বলেছেন? যার কথা হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে, শুধু কুসংস্কারগ্রস্ত জাহাজি মাল্লারাই নয়, হোমার, শেক্সপিয়র থেকে কলম্বাস যার কথা লিখেছেন, তার সবটাই কি কল্পনা?
এবার নিশ্চয়ই আপনি আপনার প্রশ্নের উত্তর পেলেন?’ একটানা কথাগুলো বলে থামলেন হেরম্যান৷
ক্যাথলিনের মুখমণ্ডলে স্পষ্ট একটা বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠেছে৷ সে বলল, ‘এ ব্যাপারে এত কথা আমার জানা ছিল না৷ আমি এতদিন জানতাম মৎস্যকন্যার ব্যাপারটা নিছকই অশিক্ষিত মাল্লাদের গালগল্প৷ এর সঙ্গে যে কলম্বাসের মতো মানুষেরও নাম জড়িয়ে আছে, তা জানতাম না৷ ক্যাপ্টেন হ্যামার আমার কাছে আপনার পরিচয় দিয়েছিলেন আপনি পশুপাখি নিয়ে গবেষণা করেন বলে৷ আমি ভেবেছিলাম আপনারা ও অঞ্চলে যাচ্ছেন সিল, পেঙ্গুইন এসব দেখবেন বলে৷ ঠিক যেমন আমি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে যাচ্ছি ওখানে৷’
ক্যাপ্টেন হ্যামারের নাম নিতে না নিতেই একটা চেয়ার নিয়ে তিনি সেখানে উপস্থিত হলেন৷ ক্যাথলিন এরপর হেরম্যানকে প্রশ্ন করল, ‘আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে কি মৎস্যকন্যার দেখা মেলার সম্ভাবনা আছে? এর আগে কেউ দেখেছিলেন?’
হেরম্যান, ক্যাপ্টেন হ্যামারের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘গত বছর ওই মারিয়ান দ্বীপে ও জাহাজেরই এক বৃদ্ধ নাবিক মৎস্যকন্যা দেখেছেন বলে দাবি করেছিলেন৷ ওই একই জায়গাতে বছর দশেক আগে অন্য এক জাহাজের নাবিকও নাকি মৎস্যকন্যা দেখতে পান৷ একই জায়গাতে দুবার মৎস্যকন্যা দেখার দাবি করা হয়েছে৷’
হেরম্যানের কথা শুনে ক্যাথলিন ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনিও কি মৎস্যকন্যার ব্যাপারটা বিশ্বাস করেন?’
ক্যাপ্টেন হ্যামার একটা কড়া জাহাজি চুরুট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘আমার যখন দাড়ি-গোঁফ গজায়নি তখন থেকে আমি সমুদ্রে ভাসতে শুরু করেছি৷ জাহাজিদের দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রে একঘেয়ে জীবন কাটাতে হয়৷ গল্পগুজবই হয়ে ওঠে তাদের মনোরঞ্জনের একমাত্র বিষয়৷ অনেক সময় মাল্লারা গল্প বানিয়ে সঙ্গীদের কাছে তা সত্যি বলে চালাবার চেষ্টা করে৷ নিরক্ষর, অশিক্ষিত, কুসংস্কারগ্রস্ত মাল্লারা অনেকসময় বিশ্বাসও করে সেসব কথা৷ তবে আমি কিন্তু সে দলের নই৷ কিশোর বয়স থেকে যেমন হাতে-কলমে সমুদ্র অভিযানে বেরিয়েছি, তেমনই পড়াশোনাও করেছি৷ কেপটাউন মেরিন ইউনিভার্সিটি থেকে নৌবিদ্যা সম্বন্ধে ডিগ্রিও আছে আমার৷ আর তার নিরিখে আমি বলতে পারি, মৎস্যকন্যার ব্যাপারটা আমার মতে নিছকই গল্পগাথা৷ আমার জাহাজের যে বুড়ো নাবিক গত শীতে মারিয়ান দ্বীপে মৎস্যকন্যা দেখে আতঙ্কে মারা পড়েছিল, সেটা নিছকই পাথরের ওপর বসা একটা সিল ছিল বলেই আমার ধারণা৷ বুড়োটা নেশা করেছিল৷ সে কোনোভাবে কোনোদিন মৎস্যকন্যার গল্প শুনে থাকবে৷ একটা সিল বা সিন্ধুঘোটক, মৎস্যকন্যা হিসাবে ধরা দিয়েছিল তার চোখে৷ হেরম্যান, আপনি আমাকে টাকা দিয়েছেন, তাই আমি আপনাকে সঙ্গী করেছি৷ আপনি মৎস্যকন্যার সন্ধান পাবেন, এ ব্যাপারে আমার বিশ্বাস নেই৷ হ্যাঁ, একজন পাকা নাবিক হয়েও আমি এ কথা আপনাদের বলছি৷’
এরপর একটু থেমে চুরুটে একটা লম্বা টান দিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘তবে একটা কথা—আমি এসব গালগল্পে বিশ্বাস না করলেও আমার জাহাজের নিগ্রো নাবিকরা কিন্তু এসব ব্যাপারে অল্পবিস্তর বিশ্বাসী৷ জানেনই তো, অনেকে মনে করে যে মৎস্যকন্যা দর্শন ঘোর অমঙ্গলের প্রতীক৷ কাজেই ওদের সামনে এ ব্যাপার নিয়ে কোনো আলোচনা করবেন না৷ মোটা অর্থের বিনিময়ে এদের রাজি করে জাহাজে তুলেছি৷ গতবার মাঝপথে ফিরে যাবার ফলে আমার প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল৷ সেটা এবার পুষিয়ে নিতে হবে৷’
হেরম্যান বললেন, ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, এ ব্যাপারে ওদের সামনে কোনো আলোচনা হবে না৷’
ক্যাথলিনও বলল, ‘আমার দিক থেকেও এ ব্যাপারে ক্যাপ্টেন আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই৷’
ক্যাপ্টেন হ্যামার বললেন, ‘ধন্যবাদ৷ তবে আপনাদের নিয়ে আমার একটা ভয়ের কারণ আছে৷ বিশেষত মিস ক্যাথলিনকে নিয়ে৷’
তাঁর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই মৃদু বিস্মিত ভাবে সুদীপ্ত আর ক্যাথলিন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘ভয়ের কি কারণ?’
ক্যাপ্টেন হ্যামার মৃদু চুপ করে থেকে বললেন, ‘দেখুন, তিমি শিকার, সিল শিকার আমার পেশা৷ আমার ও বহু মানুষের পেট চলে এই শিকারে৷ বিরাট বিরাট তিমি বা সিলকে লক্ষ্য করে হারপুন ছুটে যায়৷ রক্তে লাল হয়ে ওঠে সমুদ্রের জল৷ বড় প্রাণী তো, প্রচুর রক্ত থাকে ওদের দেহে৷ হারপুন গাঁথার সঙ্গে সঙ্গে ওরা মরে না৷ খাবি খায়, বেশ অনেকক্ষণ ধরে ছটফট করে, নিষ্ফল চেষ্টা করে বাঁচার জন্য৷ আপনারা পশুপ্রেমী, প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ৷ সেসব দৃশ্য আপনারা সহ্য করতে পারবেন তো? আমি যখন কিশোর বয়সে প্রথম তিমি শিকারের জাহাজে উঠি, তখন তিমি হত্যার দৃশ্য দেখে বেশ কয়েক রাত ঘুমাতে পারিনি৷ কলের হারপুন নয়, বেশ কয়েকজন শিকারি মিলে হাতে ছোড়া হারপুন দিয়ে শিকার করেছিল বিশাল একটা তিমি৷ তার রক্তে লাল হয়ে গেছিল আমাদের জাহাজের চারপাশ৷ দৃশ্যটা এখনও আমার চোখে ভাসে৷ তবে সেদিন ভয় পেলেও পেটের তাগিদে ভবিষ্যতে তিমি শিকারকেই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম আমি৷’— এই বলে মৃদু হাসলেন ক্যাপ্টেন হ্যামার৷
কথাটা শুনে মিস ক্যাথলিন বলল, ‘হ্যাঁ, খারাপ আমার লাগবে নিশ্চয়ই৷ কিন্তু কিছু করার তো নেই৷ আমি তো এটা শিকারি জাহাজ জেনেই আপনাদের সঙ্গী হয়েছি৷ বলা যেতে পারে বাধ্য হয়েই হয়েছি৷ কারণ, অন্য কোনো জাহাজ ওই মারিয়ান দ্বীপের ওখানে যায় না৷ যদি যেত তবে সে জাহাজেই যেতাম৷’
ক্যাপ্টেন হ্যামার হাসলেন ক্যাথলিনের কথা শুনে৷
হেরম্যান এবার ক্যাথলিনকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি তো স্কটল্যান্ডে থাকেন, এ জাহাজ যে মারিয়ান দ্বীপের ওদিকে যাচ্ছে তা জানলেন কীভাবে?’
ক্যাথলিন হেসে বলল, ‘সম্ভবত আপনি যেভাবে জেনেছেন সেভাবেই৷ ইন্টারনেটের মাধ্যমে৷ জাহাজ ছাড়ার পঁয়তাল্লিশ দিন আগে নিয়মমাফিক বন্দর কর্তৃপক্ষকে তা জানিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন৷ বন্দর কর্তৃপক্ষ তাঁদের গেজেট প্রকাশ করেছিলেন ইন্টারনেটেও৷ তাই দেখে আমি যোগাযোগ করি ক্যাপ্টেন হ্যামারের সঙ্গে৷’
হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, আমিও অনেকটা এভাবেই খবরটা পাই৷ মিস ক্যাথলিন, আপনার কর্মপদ্ধতিটা কী ধরনের?’
ক্যাথলিন জবাব দিল, ‘বিশেষ জটিল কিছু নয়, দ্বীপটা ঘুরে দেখব৷ ওখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্বন্ধে নোট নেব, ছবি তুলব৷ আপনারা?’
হেরম্যান বললেন, ‘আমরাও দ্বীপের চারপাশটা, বিশেষত সমুদ্রতটটা ঘুরে দেখার চেষ্টা করব৷ দেখি যদি মৎস্যকন্যার কোনো সন্ধান করতে পারি৷’
হ্যামার বললেন, ‘একটা কথা জানিয়ে রাখি৷ জাহাজ কিন্তু দ্বীপ থেকে কিছুটা তফাতেই থাকবে৷ নাব্যতা কম ও বরফ থাকায় তটে ভেড়া যাবে না৷ আপনাদের নৌকা নিয়ে দ্বীপে যেতে হবে৷ আমার কোনো লোকও কিন্তু আপনাদের সঙ্গী হবে না৷ আর জাহাজ ছেড়ে দ্বীপে নামার পর কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় একান্তভাবেই আপনাদের ওপর বর্তাবে৷’
হেরম্যান কথাটা শুনে ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন৷ অচেনা পরিবেশে কীভাবে চলতে হয় সে শিক্ষা আমাদের আছে৷ আফ্রিকার আদিম অরণ্য থেকে নিষ্প্রাণ মরুভূমি, বরফ ঢাকা হিমালয় পর্বতাঞ্চল থেকে মুক্তো- সন্ধানী ডুবুরিদের সঙ্গে সমুদ্রের তলদেশ, সর্বত্রই আমরা দুজন ঘুরে বেড়িয়েছি নানা প্রাণীর খোঁজে৷ আর এসব অভিযানে বহুবার সাক্ষাৎ মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত শেষ হাসি হেসেছি আমরাই৷ যদি এবারের যাত্রাতে নিতান্তই কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তার দায় আমাদের ওপরই বর্তাবে৷’
মিস ক্যাথলিন বলল, ‘আমার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷ তবে আশা করি তেমন কিছু ঘটবে না৷ ওই দ্বীপ সম্বন্ধে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয় দ্বীপের পরিবেশ শান্তই৷ যে কারণে সিল, সিন্ধুঘোটক, পেঙ্গুইনের দল বাসা বাঁধে ওখানে৷ মাংসাশী প্রাণী বলতে ছোটো শিয়াল আছে৷ ন্যাশনাল জিওগ্রাফি সোসাইটির একটা দল ওখানে গেছিল৷ তাদের রিপোর্ট পড়ে ব্যাপারটা জেনেছি৷’
এ কথা বলে ক্যাথলিন হ্যামারকে প্রশ্ন করল, ‘আপনি ও দ্বীপ ঘুরে দেখেছেন?’
ক্যাপ্টেন জবাব দিলেন, ‘দ্বীপের বেলাভূমিতে নামলেও দ্বীপের ভিতর ঘুরে দেখার প্রয়োজন হয়নি৷ দ্বীপটা বিশাল৷ আসলে অসংখ্য দ্বীপের সমষ্টি৷ নানা খাঁড়ি চলে গেছে তার ভিতর দিয়ে৷ ছোটো ছোটো পাহাড়ও আছে ও দ্বীপে৷’
কথা চলতে লাগল৷ একসময় সূর্য ডুবে গেল সমুদ্রের বুকে৷ অন্ধকার নামার পর ঠান্ডাও পড়তে শুরু করল৷ ডেক থেকে নেমে নিজেদের কেবিনে ফিরে গেল সুদীপ্তরা৷
৷৷ ৩৷৷
সুদীপ্তরা এর আগে সমুদ্রযাত্রা করলেও জাহাজে চেপে এমন দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রা করেনি৷ বিভিন্ন বইতে সুদীপ্ত পড়েছিল যে সমুদ্রযাত্রা বড় একঘেয়ে৷ এবার সে ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারল৷ সকালে সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পর থেকেই তেতে উঠতে শুরু করে ডেক৷ সূর্যালোক সমুদ্রের জলে এমন ভাবে প্রতিফলিত হয় যে সেদিকে তাকানো যায় না৷ চোখে পীড়া দেয়৷ দিকচিহ্নহীন সমুদ্র, চারপাশে শুধু জল আর জল৷ সারাদিন খোলের কেবিনের মধ্যেই কাটাতে হয় বিকেলের প্রতীক্ষাতে৷ দিনের মধ্যে ওই সময়টুকুই শুধু একটু আরামদায়ক৷ সুদীপ্তরা ডেক ছেড়ে ওপরে উঠে আসে৷ ক্যাথলিনও আসে৷ ক্যাপ্টেন হ্যামারও কখনও কখনও কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এসে যোগ দেন তাদের সঙ্গে৷ নানা ধরনের গল্প, আলোচনা হয়৷ সেই সূত্র ধরে ক্যাথলিনের সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছে সুদীপ্তরা৷ ক্যাথলিনের জন্ম লন্ডনের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে৷ বাবা-মার একমাত্র সন্তান সে৷ যদিও সে একলাই থাকে৷ ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি-পরিবেশের ওপর তার খুব টান৷ ক্যাথলিনের পড়াশোনাও লন্ডনে৷ পরিবেশবিদ্যাতে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছে ক্যাথলিন৷ বর্তমানে ভারত মহাসাগরে জনহীন দ্বীপগুলোর প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করছে সে৷ ঠাকুর্দার ব্যাংকে রেখে যাওয়া কিছু অর্থ আর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত স্কলারশিপের টাকাতেই তার দিন চলে৷ সুদীপ্ত আর হেরম্যান তাদের অভিযানের বেশ কিছু গল্প শুনিয়েছে ক্যাথলিনকে৷ সেসব শুনে ক্যাথলিন তো একদিন বলেই ফেলল, ‘এই ক্রিপ্টোজুলজি ব্যাপারটা এত ইন্টারেস্টিং আর রোমাঞ্চকর বিষয় তা আগে জানা ছিল না৷ থাকলে এ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতাম৷’
তার কথা শুনে হেরম্যান হেসে বললেন, ‘তা করতে পারতেন ঠিকই, তবে এ কাজের জন্য কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ পাওয়া যায় না৷ বরং ব্যঙ্গবিদ্রুপই জোটে৷ অথচ ইন্দোনেশিয়ার কোমোডো ড্রাগন থেকে শুরু করে সমুদ্রতলে বাস করা জায়েন্ট স্কুইডদের খুঁজে বের করেছেন কিন্তু ক্রিপ্টোজুলজিস্টরাই৷ যেসব প্রাণীকে একদিন তথাকথিত পণ্ডিতরা নিছক রূপকথার প্রাণী বলেই ভাবতেন৷ ঠিক যেভাবে তাঁরা মারমেড বা মৎস্যকন্যাকেও রূপকথার প্রাণী ভাবেন৷’
ডেকে বসে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য এই বৈকালিক আড্ডা ছাড়া বাকি সময়টা বলতে গেলে বই পড়ে আর ঘুমিয়েই কাটাতে হল সুদীপ্তদের৷ একটা জিনিস খেয়াল করল সুদীপ্তরা৷ একটা একটা করে দিন যত এগোচ্ছে, ঠান্ডা যেন তত বাড়ছে৷ ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ৷ খোলের ভিতরেও ঠান্ডা নামছে৷ মোটা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুতে হচ্ছে সুদীপ্তদের৷
সপ্তম দিন বিকালে ডেকে উঠে নাবিকদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য লক্ষ করল সুদীপ্তরা৷ বিরাট বিরাট বেশ কয়েকটা ধাতব চৌবাচ্চা বা বাথটবের মতো পাত্র খোলের ভিতর থেকে তুলে এনে ডেকে রাখা হয়েছে৷ আর রাখা হয়েছে বেশ কিছু কাঠের পিপে আর মুখ বন্ধ করা টিনের ড্রাম৷ ড্রামগুলোর গায়ের লেবেল দেখে বোঝা গেল তার ভিতরের রাসায়নিক দিয়ে শিকার করা মাছ সংরক্ষণ করা হবে৷ হারপুন ছোড়ার কামানটার কাছে বেশ কিছু নাবিক দাঁড়িয়ে ছিল৷ আর তার কাছিটা যে লোহার স্তম্ভের গায়ে জড়ানো, সেটা হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরীক্ষা করছিলেন ক্যাপ্টেন হ্যামার৷ সুদীপ্তরা বুঝতে পারল ওই দণ্ডায়মান স্তম্ভটা একটা লাটাইয়ের মতো৷ ক্যাথলিনও সুদীপ্তদের সঙ্গেই ডেকে উঠে এসেছিল৷ তারা তিনজন হ্যামারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হ্যামার হেসে বললেন, ‘কাল সকাল নাগাদ আমরা মারিয়ান দ্বীপে পৌঁছে যাব৷ দেখছেন বাতাস কেমন ঠান্ডা হয়ে এসেছে! যন্ত্রপাতিগুলো সব আর-একবার পরীক্ষা করে নেওয়া হচ্ছে৷ যন্ত্রের কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য হারপুন ছোড়া হবে এখন৷ এর ওপরই আমাদের সব কিছু নির্ভর করছে৷’—এ কথা বলে সুদীপ্তদের নিয়ে হারপুন ছোড়ার কামানটার সামনে দাঁড়ালেন তিনি৷ কামানটার সামনেই মাটিতে নামানো আছে বেশ অনেক ক-টা হারপুন৷ দশ ফিট মতো লম্বা সরু অথচ মজবুত স্টিলের তৈরি দণ্ড৷ তার সামনের অংশটা অনেকটা দেখতে তিরের ফলার মতো৷ দুপাশে খাঁজ আছে৷ ঝকঝকে ধারালো ফলাটা শিকারের গায়ে বিদ্ধ হবার পর পিছনে যাতে বেরিয়ে না আসে, তার জন্য অমন খাঁজ৷ লৌহদণ্ডের শেষ মাথায় কাছি বা দড়ি পরাবার জন্য ছিদ্রও আছে৷ সুদীপ্তরা হারপুন ছোড়ার প্রস্তুতি দেখতে লাগল৷ হারপুন কামানের ঠিক পিছনে একটা লোহার ছোট খাঁচা আছে, যে হারপুন ছুড়বে তার বসার জন্য৷ সেই খাঁচায় বসে একজন শিকারি কামানটাকে গিয়ারের মতো লিভারের সাহায্যে নববই ডিগ্রি কোণে এপাশ-ওপাশে ঘোরাতে লাগল সমুদ্রের দিকে নল তাক করে৷ এরপর একটা হারপুন তুলে তার পিছনে কাছি পরানো হল৷ তারপর সেটাকে ঠেসে দেওয়া হল কামানের মুখে৷ হেরম্যান, সুদীপ্তকে বললেন, ‘কামানের ভিতরে সম্ভবত শক্তিশালী ধাতব স্প্রিং ধরনের কিছু আছে৷ যা হারপুনকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে৷ নলের গায়ে পিছনের দিকে যে লিভারের মতো অংশ দেখছ, সম্ভবত ওটাই হল ট্রিগার৷’ কামানে হারপুন ভরা হয়ে গেলে ক্যাপ্টেন একজনকে জাহাজের ইঞ্জিন বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়ে সুদীপ্তদের বললেন, ‘আপনারা ডেকের ওপর আঁকা ওই লাল দাগটার ওপাশে গিয়ে দাঁড়ান৷ হারপুন যখন ছোড়া হবে, এখন হোক বা মাছ শিকারের সময়, কখনও ওই লাল দাগ অতিক্রম করে এগিয়ে আসবেন না৷ দড়ি যখন হারপুনের সঙ্গে বিদ্যুৎগতিতে সমুদ্রের দিকে ছুটে যায়, তখন দড়িতে পা পড়লে হয় সমুদ্রেতে ছিটকে পড়বেন অথবা দড়ির চাপে মাংসের দলা হয়ে যাবেন নিমেষের মধ্যে৷ তিমি বা সিল শিকারের জাহাজে অসতর্কতার কারণে হারপুনের দড়িতে বহু নাবিকের মৃত্যু হয়েছে৷ ব্যাপারটা খেয়াল রাখবেন৷ শিকারের সময় আপনারা যদি ডেকে থাকেন তখন আমরা এমন ব্যস্ত থাকব যে আপনাদের ওপর নজর রাখতে পারব না৷ তাই আগাম সতর্ক করে দিলাম৷’
ক্যাপ্টেনের সতর্কবাণী মেনে সেই লাল দাগ অতিক্রম করে ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়াল ওরা তিনজন৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজ থেমে গেল৷ সমুদ্রের ঢেউয়ে শুধু মৃদু দুলতে থাকল জাহাজটা৷ এবার হারপুন পরীক্ষা করা হবে৷ হারপুন চালকের পাশ থেকে ক্যাপ্টেন আর অন্য নাবিকরাও বেশ খানিকটা তফাতে দড়ির উল্টোদিকে সরে গেল৷ একজন নাবিক এরপর একটা কাঠের ফাঁকা পিপে ছুড়ে ফেলল জলে৷ মন্থর গতিতে ভাসতে ভাসতে সেই পিপেটা জাহাজ থেকে দূরে সরে যেতে লাগল৷ কামানের পিছনে যে হারপুন থ্রোয়ার বসে আছে, সে নলটাকে এবার ঘোরাতে শুরু করল ভাসমান পিপেটাকে লক্ষ্য করে৷ পিপেটা তখন বেশ অনেকটা দূরে চলে গেছে৷ ক্যাপ্টেন হ্যামার চিৎকার করে উঠলেন, ‘চার্জ৷’
একটা ধাতব শব্দ হল৷ সুদীপ্তরা দেখল হারপুনটা বিদ্যুৎগতিতে দড়িসমেত ছুটে চলেছে সমুদ্রের দিকে৷ অব্যর্থ নিশানায় হারপুনটা গিয়ে আঘাত হানল পিপেটার গায়ে৷ তার গায়ের কাঠগুলো চুরমার হয়ে জলের সঙ্গে ছিটকে উঠল আকাশের দিকে৷ অকল্পনীয় ওই নিশানা! চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না৷ ব্যাপারটা দেখে আনন্দে বিস্ময়ে তালি দিয়ে উঠল ক্যাথলিন৷ সম্ভবত সেই শব্দ কানে যেতেই হারপুনচালক তার আসন ছেড়ে উঠে সুদীপ্তদের দিকে তাকিয়ে হাসল৷ মাঝবয়সি লোকটা জাতিতে সম্ভবত একজন আফ্রিকান৷ গায়ের রং কালো হলেও দাড়ি- গোঁফ, মাথার চুল লালচে ধরনের৷ অর্থাৎ লোকটার শরীরে সাদা চামড়ার লোকের রক্তও আছে৷
একজন মাল্লা এরপর যে লৌহদণ্ডের গায়ে দড়িটা জড়ানো ছিল তার গায়ে নীচের দিকে একটা হাতল টানল৷ লাটাইয়ের মতো ঘুরতে শুরু করল দণ্ডটা৷ গুটাতে শুরু করল কাছি৷ হারপুনটা আবার ফিরে আসতে লাগল জাহাজের দিকে৷
পরীক্ষা শেষ৷ ক্যাপ্টেন হ্যামার এসে দাঁড়ালেন৷ সুদীপ্তদের উদ্দেশে তিনি হেসে বললেন, ‘কি, কেমন দেখলেন?’
সুদীপ্ত জবাব দিল, ‘দারুণ লক্ষ্যভেদ৷’
হ্যামার বললেন, ‘ওর নাম মরগ্যান স্মিথ৷ লোকে ডাকে ‘হারপুন স্মিথ’ নামে৷ অসাধারণ শিকারি৷ বলতে গেলে এ জাহাজের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ লোক৷ যেখানে বরফের জন্য জাহাজ এগোতে পারে না, সেখানে ছোট নৌকা নিয়ে হাত দিয়ে হারপুন ছুড়েও শিকার করতে পারে ও৷ আগেকার দিনে যেভাবে শিকার করা হত সেভাবে৷’
হেরম্যান বললেন, ‘কাল থেকেই কি শিকারের কাজ শুরু করবেন?’
ক্যাপ্টেন বললেন, ‘তেমনই পরিকল্পনা আছে৷ আমরা শিকারের কাজ করব৷ আর আপনারা বোটে করে দ্বীপে যাবেন৷ বিকালে আবার জাহাজে ফিরে আসবেন৷ মাইল তিনেক জায়গা জুড়ে সারাদিন চক্কর কাটবে জাহাজটা৷ তবে প্রতিদিন রাত্রিবাসের জন্য একই জায়গাতে নোঙর করা থাকবে৷’
হেরম্যান জানতে চাইলেন, ‘গতবার যে জায়গাতে আপনার নাবিক সেই মৎস্যকন্যাকে দেখেছিল, ঠিক সেই জায়গাতেই জাহাজ নোঙর করবে কি?’
একটু ভেবে নিয়ে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আচ্ছা তাই হবে৷’—এ কথা বলে ক্যাপ্টেন তাঁর কেবিনের দিকে এগোলেন৷ জাহাজের ইঞ্জিন আবার চালু হয়ে গেল৷ জল কেটে এগোচ্ছে জাহাজ৷ সূর্য ডুবতে চলেছে সমুদ্রের বুকে৷ বাতাস যেন আরও ভারী আর ঠান্ডা হয়ে আসছে৷ রেলিং-এর গায়েই হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা৷ ক্যাথলিন হঠাৎ জলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আরে ওই দেখুন!’
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সুদীপ্তরা জলের দিকে তাকিয়ে দেখল ছোট ছোট বরফের টুকরো জলে ভাসছে! তুষারসমুদ্রের প্রবেশদ্বারে পৌঁছে গেছে তারা!
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার নেমে এল সমুদ্রেতে৷ সুদীপ্তরা পা বাড়াল খোলে নামার জন্য৷
৷৷ ৪৷৷
পরদিন ভোরে এক অদ্ভুত ঘসঘস শব্দে ঘুম ভাঙল সুদীপ্তদের৷ পোর্ট হোল দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে সব কিছু যেন সাদা মনে হল৷ বাইরেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না৷ পোর্ট হোলের কাচে যেন তুষার জমে আছে৷ শীতের পোশাক পরে তৈরি হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই খোল ছেড়ে ডেকে উঠে এল তারা৷ কনকনে ঠান্ডা ডেকে৷ চারদিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেল সুদীপ্ত আর হেরম্যান৷ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে দুজন, কিন্তু এমন জায়গাতে তারা কোনোদিন আসেনি৷ এ এক বরফের দেশ৷ চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ! বরফের চাদরে মোড়া সমুদ্র৷ পাতলা চাদরের মতো বরফ তো আছেই, আবার কোথাও ভেসে চলেছে জাহাজের চেয়েও উঁচু হিমশৈল বা আইসবার্গ! সূর্যের আলো সেই আইসবার্গে বিচ্ছুরিত হয়ে বর্ণালির সৃষ্টি করেছে! অপূর্ব দৃশ্য! কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যাথলিনও ডেকে উঠে সুদীপ্তদের পাশে এসে দাঁড়াল৷ বিমোহিত হয়ে সেও তাকিয়ে রইল এই অচেনা পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্যের দিকে৷
খুব ধীর গতিতে জাহাজটা এগোচ্ছে সামনের বরফের চাদর কাটতে কাটতে৷ ড্রেজার বসানো আছে জাহাজের সামনের অংশের তলদেশে৷ খসখস ঘসঘস শব্দটা ওই ড্রেজারের বরফ সরানোর শব্দ৷ জাহাজের মাল্লারা ডেকের এককোণে রেলিংয়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ তার মধ্যে সেই হারপুন স্মিথও আছে৷
দুপাশে বিরাট দুটো আইসবার্গের মধ্যে দিয়ে পথ ধরল তিমি-শিকারি জাহাজটা৷ পাহাড়ের মতো হিমশৈল দুটো জাহাজের প্রায় গা ঘেঁষে ভাসছে৷ যেন ডেকের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেই তাদের ছোঁয়া যায়! হুড়মুড় করে যেন ডেকের ওপর তারা যে-কোনো সময় ভেঙেও পড়তে পারে৷ খুব ধীরে আর সন্তর্পণে জাহাজটা অতিক্রম করল সেই হিমশৈল দুটোর মধ্যবর্তী পথ৷ এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্যাপ্টেন হ্যামার এসে দাঁড়ালেন সুদীপ্তদের কাছে৷ সুদীপ্তদের প্রভাতী সম্ভাষণ জানাবার পর যেদিকে জাহাজ এগোচ্ছে সেদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমরা প্রায় এসে গেছি৷ ওই দেখুন মারিয়ান দ্বীপ দেখা যাচ্ছে৷ আর মাত্র ঘণ্টা দুই সময় লাগবে৷’
তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে সুদীপ্তরা দেখল দূরে একটা কালো বিন্দু দেখা যাচ্ছে৷
এগোতে থাকল জাহাজ৷ ক্রমশ বাড়তে লাগল সেই কালো বিন্দুর আকার৷ বিন্দু থেকে সেটা ক্রমশ চওড়া হয়ে উঠতে লাগল দুপাশে বিস্তৃত কালো দাগের মতো৷ এক ঘণ্টা পর দ্বীপটা মোটামুটি ভেসে উঠল সুদীপ্তদের চোখে৷ বিশাল এক দ্বীপ৷
জাহাজ যত দ্বীপের দিকে এগোতে লাগল ততই যেন উত্তেজনার ভাব ফুটে উঠল নাবিকদের মুখে৷ সুদীপ্তরাও বেশ উত্তেজিত৷ চারপাশে বরফের চাদর মোড়া৷ আর তা গিয়ে মিশেছে দ্বীপে৷ হঠাৎ একজন মাল্লা সমুদ্রের দিকে একটা জায়গা দেখিয়ে ক্যাপ্টেন হ্যামারকে কী যেন বলল৷ হ্যামারের মুখে হাসি ফুটে উঠল৷ তিনি সুদীপ্তদের সে জায়গাটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওই দেখুন৷’
বরফের চাদরের মাঝখানে একটা ফাটলের ভিতর থেকে ফোয়ারার মতো জল ছিটকোচ্ছে আকাশের দিকে! হেরম্যান তা দেখে জানতে চাইলেন, ‘কী ওটা?’
ক্যাপ্টেন হেসে জবাব দিলেন, ‘ওখানে জলের নীচে তিমি আছে৷ সে-ই জল ছেটাচ্ছে৷ যত এগোব তত এ দৃশ্য দেখতে পাবেন৷ যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল৷ আশা করি শিকারের অভাব হবে না৷’
হ্যামারের কথা সত্যি প্রমাণিত হল৷ বরফের চাদরের আড়াল থেকে মাঝে মাঝেই ফোয়ারার মতো জল ছিটকানোর দৃশ্য চোখে পড়তে লাগল তাদের৷
বেলা দশটা নাগাদ নির্দিষ্ট স্থানে দ্বীপের কাছে পৌঁছে জাহাজ থেমে গেল৷ দ্বীপটা তখন সুদীপ্তদের সামনে স্পষ্ট৷ ছোটখাটো পাহাড় সম্মিলিত দ্বীপটা ঢালু হয়ে এসে মিশেছে বরফমোড়া সমুদ্রের সঙ্গে৷ কিছু পাথুরে খাঁড়িও নেমে এসেছে সমুদ্রের অনেক ভিতর পর্যন্ত৷ জাহাজটা যেখানে থামল তার আশেপাশেও বরফমোড়া ছোট-বড় প্রস্তরখণ্ড উঁকি দিচ্ছে সমুদ্রের ভেতর থেকে৷ এরই কোনো একটার ওপর হয়তো চাঁদের আলোতে মৎস্যকন্যাকে বসে থাকতে দেখেছিল সেই বৃদ্ধ নাবিক৷ ক্যাপ্টেন হ্যামার সুদীপ্তদের উদ্দেশে বললেন, ‘জাহাজ আর এগোবে না৷ এই সেই জায়গা৷ দেখছেন কাছেপিঠে কত শিকার তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে!’
সত্যিই জাহাজটা যেখানে থেমেছে তার কাছে-দূরে নানা জায়গাতে সমুদ্রের মধ্য থেকে জলের ফোয়ারা উঠছে৷
ক্যাপ্টেন এরপর হেরম্যানকে বললেন, ‘শুনুন, আমাদের একটা সংস্কার আছে৷ প্রথম প্রাণীটা শিকার না করা পর্যন্ত কাউকে নীচে জলে নামতে দেওয়া হয় না৷ সে কাজটা মিটলে আপনারা নৌকা নিয়ে দ্বীপে যাবেন৷’
দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে হেরম্যান বললেন, ‘বেশ, তাই হবে৷’
শিকারের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল৷ মাল্লারা ব্যস্ত হয়ে পড়ল হারপুন ঠিক করতে এবং আরও নানা কাজে৷ সেই লাল দাগের অন্যপাশে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে সুদীপ্তরা তিনজন দেখতে লাগল সব কিছু৷ একসময় শিকারিদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হল৷ জায়গাটার আনুমানিক একশো মিটার দূরে মাঝে মাঝে বেশ বড় ফোয়ারা উঠছে৷ সেদিকে তাক করা হল হারপুন কামান৷ এরপর হঠাৎই কয়েক মুহূর্তের জন্য ডেকটা যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেল৷ মাল্লারা সব চেয়ে রইল ফোয়ারাটার দিকে৷ আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ্তরাও৷ অত বড় জাহাজটাতে তখন একটা পিন পড়লেও যেন শব্দ শোনা যাবে৷
লোহার খাঁচায় হারপুন তাক করে বসা সেই হারপুন স্মিথের উদ্দেশে ক্যাপ্টেন হ্যামার চিৎকার করে উঠলেন, ‘চার্জ’ বলে৷ ট্রিগার টানল শিকারি৷ একটা ধাতব শব্দ৷ উল্কার গতিতে হারপুন ছুটল তার লক্ষ্যে৷ দড়িসমেত হারপুনটা গিয়ে অদৃশ্য হল বরফের চাদরের ফাটলের মাঝে যেখান থেকে জলের ফোয়ারাটা উঠছিল ঠিক সে জায়গাতে৷ নাবিকরা অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেদিকে৷ খুব বেশি হলে আধ মিনিট৷ সমুদ্রের সে অংশের জল লাল হতে শুরু করল৷ আর তারপরই বরফের চাদরের আড়াল থেকে ছটফট করতে করতে ভেসে উঠতে লাগল উল্টানো নৌকার মতো তিমির কালো পিঠ৷ আর সেটাকে দেখামাত্রই একসঙ্গে উল্লাসধ্বনি করে উঠল ডেকে দাঁড়ানো তিমি-শিকারিরা৷ সফল হয়েছে তাদের প্রথম শিকার কার্য৷ জলের ফোয়ারা নয়, রক্তের ফোয়ারা উঠছে হারপুনবিদ্ধ তিমির পিঠ থেকে৷ আর তা রাঙিয়ে দিচ্ছে তার আশেপাশের বরফের চাদরকে৷ আস্তে আস্তে পুরো তিমিটাই ভেসে উঠল৷ দূর থেকে সুদীপ্ত অনুমান করল আকারে অন্তত সেটা কুড়ি-পঁচিশ ফুট হবে৷ হেরম্যানের পাশে দাঁড়ানো ক্যাথলিন বলে উঠল, ‘ও মাই গড! এত বড় প্রাণীটাকে ওরা মেরে ফেলল!’ হেরম্যান মন্তব্য করলেন, ‘কী আর করা যাবে! আমাদের চোখে খারাপ লাগলেও ওদের এটাই জীবিকা৷’ ক্যাপ্টেন হ্যামার এসে দাঁড়ালেন সুদীপ্তদের সামনে৷ তাঁর মুখে হাসি৷ তিনি বললেন, ‘প্রথম তিমিটাকে যখন ঠিকভাবে শিকার করা গেল তখন বরাতটা ভালোই হবে মনে হচ্ছে৷ আশা করি গতবারের ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে পারব৷’
হেরম্যান বললেন, ‘কীভাবে অতবড় প্রাণীটাকে জাহাজে ওঠাবেন? এমন কতগুলো তিমি শিকার করবেন আপনারা?’
হ্যামার বললেন, ‘নৌকা নিয়ে গিয়ে প্রথমে তিমিটাকে জাহাজের কাছে টেনে আনা হবে৷ তারপর ক্রেনে বেঁধে ডেকে তুলে করাত দিয়ে মাথা বাদ দিয়ে খণ্ড খণ্ড করে কেটে মাংসগুলো বরফ আর রাসায়নিক দিয়ে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে৷ যতক্ষণ না খোল ভরবে ততক্ষণ শিকার চলবে৷ ছোট-বড় মিলিয়ে আনুমানিক চল্লিশটা তিমি শিকার করতে হবে৷ তিমি শিকারের কাজ যদি ভালোভাবে মেটে, তবে কয়েকটা সিন্ধুঘোটকও মারব ভাবছি৷ ওর চর্বি ওষুধ তৈরিতে লাগে৷ চড়া দামে বিক্রি হয়৷ ওদের মারার জন্য অবশ্য দ্বীপে যেতে হবে৷ দেখি কী করি! আর হ্যাঁ, আপনারা তো দ্বীপে যাচ্ছেন, সিন্ধুঘোটক থেকে একটু সাবধানে থাকবেন৷ পুরুষ সিন্ধুঘোটক অনেকসময় আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে৷ লেজের ঝাপটায় মাটিতে ফেলে বুকে চেপে বসে তলোয়ারের ফলার মতো দাঁত বিঁধিয়ে দেয়৷ ওদের কারো কারো ওজন দু-টনও হয়৷’
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ কয়েকটা নৌকা নামানো হল জলে৷ তার একটাতে সুদীপ্তরা তিনজন রওনা হল দ্বীপের দিকে৷ আর দড়িদড়া নিয়ে অন্য নৌকাগুলো রওনা হল তিমিটাকে টেনে আনার জন্য৷ ততক্ষণে স্থির হয়ে গেছে বিশাল সেই প্রাণীটা৷ লাল জলের মধ্যে ভেসে আছে তার দেহ৷
জলে কোনো স্রোত নেই৷ দাঁড় টানছেন হেরম্যান৷ সুদীপ্ত প্রয়োজনে একটা লগি দিয়ে ভাসমান বরফের টুকরোগুলো সরাতে লাগল৷ ক্যাথলিন চারপাশের ছবি তুলতে থাকল৷ এগিয়ে আসতে লাগল দ্বীপ৷ ক্যামেরায় চোখ রেখে একসময় ক্যাথলিন মৃদু বিস্মিত ভাবে বলল, ‘দ্বীপে ওরা কারা? মানুষ নাকি?’
হ্যাঁ, একদল মানুষ যেন হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে দ্বীপের তটে৷ কিছুক্ষণের মধ্যে অবশ্য স্পষ্ট হল আসল ব্যাপারটা৷ মানুষ নয়, পেঙ্গুইনের দল৷ দূর থেকে প্রায় মানুষের মতোই লাগছে তাদের৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই দ্বীপের কাছে এসে ভিড়ল সুদীপ্তদের ছোট নৌকাটা৷ একটা পাথরের সঙ্গে নৌকাটা বেঁধে হাঁটুজল ভেঙে তারা তিনজন দ্বীপে উঠে এল৷
চারপাশে পেঙ্গুইনের দল হেলতে- দুলতে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ তাদের চিৎকারে চারপাশ মুখরিত৷ বেশ কয়েকটা সিলও এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে৷ পেঙ্গুইনের দঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল সুদীপ্তরা৷ কিছুটা এগিয়ে বিশালাকৃতির একটা সিন্ধুঘোটকও দেখতে পেল তারা৷ সুদীপ্তদের এই প্রথম জীবন্ত সিন্ধুঘোটক দর্শন৷ একটা পাথরের ওপর অলসভাবে শুয়ে আছে সিন্ধুঘোটকটা৷ গুম্ফাধারী প্রাণীটার তলোয়ারের ফলার মতো দাঁত দুটো অন্তত চার ফুট লম্বা হবে৷ ক্যাথলিন তার দিকে এগোল ছবি তোলার জন্য৷ হেরম্যান তাকে সাবধান করে বললেন, ‘বেশি কাছে যাবেন না৷ ক্যাপ্টেন হ্যামারের কথাটা খেয়াল রাখবেন৷’ ক্যাথলিন নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফিরে আসার পর সুদীপ্ত হেরম্যানকে বললেন, ‘দ্বীপটা কীভাবে দেখবেন? কীভাবে অনুসন্ধান চালাব আমরা?’
হেরম্যান বললেন, ‘দ্বীপটা বেশ বড়৷ আমার ধারণা এর পরিধি অন্তত দশ মাইল হবে৷ আপাতত প্রথমে দ্বীপের তটরেখা বরাবর অনুসন্ধান চালাব আমরা৷ আজ পর্যন্ত যাঁরা বিভিন্ন সময় মৎস্যকন্যা দেখার দাবি করেছেন, তার মধ্যে প্রায় নববই শতাংশ মানুষ বলেছেন বিভিন্ন দ্বীপের সমুদ্রতটেই তাঁরা বসে থাকতে দেখেছেন মৎস্যকন্যাদের৷ হয়তো বা এই সিল বা সিন্ধুঘোটকদের মতোই জল থেকে উঠে সমুদ্রতটে বসে রোদ পোহাতে ভালোবাসে মৎস্যকন্যারা৷’
এ কথা বলার পর হেরম্যান ক্যাথলিনকে বললেন, ‘আপনি কীভাবে কাজ শুরু করবেন?’
ক্যাথলিন জবাব দিল, ‘আপনাদের আপত্তি না থাকলে আজ আমি আপনাদের সঙ্গেই ঘুরব৷ তটরেখাটা দেখা হয়ে যাবে৷ কাল থেকে অবশ্য কিছু যন্ত্রপাতি নেব প্রকৃতি বীক্ষণের জন্য৷’
হেরম্যান বললেন, ‘আমাদের আপত্তি নেই৷ চলুন তবে৷’
তটরেখার পশ্চিম দিক বরাবর এগোল সুদীপ্তরা৷ দ্বীপটা পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত৷ টিলার মতো ছোট ছোট পাহাড় সম্মিলিত দ্বীপ৷ বাইরের দিকে গাছপালা বেশি নেই৷ পাহাড়ের ঢালে জায়গাতে জায়গাতে ছিট ছিট তুষার জমেছে৷ ঢালগুলো এসে মিশেছে সমুদ্রতটে৷ কোথাও আবার অনুচ্চ কোনো পাহাড়ের শিরা নেমে গেছে সমুদ্রেও৷ ছোট ছোট গুহাও আছে সেই শিরাগুলোর ভিতর৷ সমুদ্রর জল প্রবেশ করছে গুহায়৷ দ্বীপের তটরেখাটা ছোট-বড় কালচে পাথরে পরিপূর্ণ৷ পাহাড়গুলোও ওই পাথরেরই তৈরি৷ ক্যাথলিন বলল, ‘এ দ্বীপটার নীচে সম্ভবত সুপ্ত আগ্নেয়গিরি আছে৷ অগ্ন্যুৎপাতের ফলেই একসময় এ দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছিল৷ এ পাথরগুলো হল আগ্নেয় পাথর৷’ হেরম্যানও সহমত পোষণ করলেন তার সঙ্গে৷ কখনও তটরেখা ধরে হেঁটে আবার যেখানে পাথুরে শিরাগুলো সমুদ্রে নেমেছে সেখানে জলে নেমে এগোতে থাকল তিনজন৷ ক্যাথলিন তার ডায়েরিতে মাঝে মাঝে কী সব যেন নোট নিতে লাগল৷ মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও দেখা মিলছে পেঙ্গুইনদের ছোট ছোট ঝাঁকের৷ কখনও তারা সুদীপ্তদের দেখে কাছে এগিয়ে আসছে, আবার কখনও বা ভয় পেয়ে বরফমোড়া সমুদ্রেতে ঝাঁপ দিচ্ছে৷ সিল বা সিন্ধুঘোটকও মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে দু-একটা৷ মানুষ দেখে অবশ্য তাদের খুব একটা ভ্রূক্ষেপ নেই৷ নিজেদের মতো তারা শুয়ে আছে৷ মাঝে মাঝে তটের ঠিক গায়ে সমুদ্রর ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে ঠিক টেবিলের মতো পাথর৷ হেরম্যান তেমনই একটা পাথর দেখিয়ে সুদীপ্তকে বললেন, ‘কে বলতে পারে, হয়তো বা ওর ওপরই বসে থাকে কোনো মৎস্যকন্যা!’
তবে ঘণ্টা তিনেক তটরেখা বরাবর হেঁটেও তেমন কারও দর্শন মিলল না সুদীপ্তদের৷ হেরম্যান বললেন, ‘চলো এবার ফেরা যাক৷ নইলে সূর্যাস্তের আগে জাহাজে পৌঁছোতে পারব না৷ কাল এগোব দ্বীপের পূর্ব দিকে৷’
৷৷ ৫৷৷
বিকাল চারটে নাগাদ তারা ফিরে এল যে জায়গা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল সেখানে৷ আগের মতোই সে জায়গা পেঙ্গুইনের প্যাঁকপ্যাঁকানিত মুখরিত৷ জলে নেমে নৌকা নিয়ে তারা ভেসে পড়ল জাহাজের দিকে৷ দাঁড় টেনে জাহাজটার কাছে পৌঁছোতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল তারা৷ জাহাজের গায়ে বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে জলের রং ঘন লাল! না, তা বিদায়ী সূর্যের অস্তরাগ নয়৷ তিমির রক্ত৷ তীব্র আঁশটে গন্ধ ছড়াচ্ছে জাহাজের চারপাশে৷ ক্যাথলিন নাকে রুমাল চাপা দিল৷ নৌকা জাহাজের গায়ে ভিড়তেই ওপর থেকে দড়ির মই নেমে এল৷ ডেকে উঠে পড়ল তিনজন৷ সারা ডেক তিমির রক্তে মাখামাখি৷ আর তার সঙ্গে তেমনই আঁশটে গন্ধ৷ বিরাট একটা ট্রেতে বরফ চাপা দেওয়া তিমির মাংস ধরাধরি করে খোলের ভিতর নামাচ্ছে কয়েকজন মাল্লা৷ সুদীপ্তদের দেখে ক্যাপ্টেন হ্যামার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, ‘ওই ট্রেটা খোলে নামালেই আজকের মতো কাজ শেষ৷ প্রথম দিনই এগারোটা প্রাণী শিকার করা হল৷’
হেসে কথা শেষ করে তিনি হেরম্যানকে প্রশ্ন করলেন, ‘যার খোঁজে গেছিলেন তার দর্শন মিলল?’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘না, আপাতত মেলেনি৷ দ্বীপের পশ্চিম তটরেখা বরাবর আমরা গেছিলাম৷ কাল যাব পূর্বদিকে৷’
হ্যামার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই জাহাজের উল্টোদিকের রেলিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন নাবিকদের মধ্যে একজন আফ্রিকান ভাষায় চিৎকার করে কী যেন বলল, তারপর হাত দিয়ে রেলিংয়ের নীচে জলের দিকে দেখাল৷
ক্যাপ্টেনের পিছনে তারা তিনজনও এগোল সেদিকে৷ জাহাজের যে পাশ দিয়ে সুদীপ্তরা ডেকে উঠেছে তার অন্য পাশে রেলিংয়ের কাছে পৌঁছোতেই নীচ থেকে অদ্ভুত একটা শব্দ৷ সেখানে পৌঁছে রেলিং ধরে নীচে তাকাতেই সুদীপ্তদের চোখে পড়ল বিরাট আকারের একটা মৃত তিমি লোহার শিকল দিয়ে জাহাজের গায়ে বাঁধা৷ আকারে সেটা অন্তত তিরিশ ফুট হবে৷ ক্যাপ্টেন হ্যামার সুদীপ্তদের বললেন, ‘আপনারা জাহাজে ফেরার কিছুক্ষণ আগেই ওকে শিকার করেছি৷ এতবড় তিমিটাকে ডেকে তুলে কেটে ট্রেতে ভরতে অন্ধকার নেমে যাবে৷ কাল সকালে ওকে ডেকে তোলা হবে৷’ আর এরপরই আসল দৃশ্যটা চোখে পড়ল সুদীপ্তদের৷ শিকলবাঁধা মৃত তিমিটার গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আরও একটা ছোট তিমি৷ অদ্ভুত একটা শব্দ তুলছে সেই ছোট্ট প্রাণীটা৷ আর মাঝে মাঝে এসে ঘা দিচ্ছে মৃত তিমিটার পেটে৷ হ্যামার বললেন, ‘যাকে শিকার করা হয়েছে তার শাবক ওই ছোট তিমিটা৷ মাকে সমুদ্রতে ফিরিয়ে নেবার জন্য ও চেষ্টা করছে৷ অথবা স্তন্যপান করার জন্য৷’
যে নাবিকরা সুদীপ্তদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তারা হাসছে দৃশ্যটা দেখে৷ স্পষ্টতই ব্যাপারটাতে বেশ আমোদ পাচ্ছে তারা৷
হেরম্যান জানতে চাইলেন, ‘তিমির বাচ্চাটার কী হবে?’
হ্যামার জবাব দিলেন, ‘ওকে মেরে আমাদের লাভ নেই৷ গায়ের মাংস এখনও খুব নরম আছে৷ তবে ও বাঁচবে না৷ জানেনই তো তিমি স্তন্যপায়ী প্রাণী৷ বাচ্চাটার আকার দেখে অনুমান ও এখনও দুধ ছাড়েনি৷ কাজেই ক’দিনের মধ্যেই মারা পড়বে ও৷’
জলের মধ্যে অদ্ভুত শব্দ করছে বাচ্চা তিমিটা৷ ঠিক যেন ক্রন্দনধ্বনি৷ এই করুণ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে ক্যাথলিন বলে উঠল, ‘আমার আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না৷ আমি কেবিনে চললাম৷’ সুদীপ্তদের কাছেও দৃশ্যটা বেশ পীড়াদায়ক৷ তা ছাড়া শরীরও পরিশ্রান্ত৷ কাজেই তারাও ক্যাথলিনের সঙ্গে নিজেদের কেবিনে ফেরার রাস্তা ধরল৷ ডেক ছেড়ে নীচে নেমে নিজের কেবিনে প্রবেশ করার আগে ক্যাথলিন বেশ ক্ষুব্ধস্বরে বলল, ‘কীভাবে ওরা অত বড় বড় নিরীহ প্রাণীগুলোকে শিকার করছে! এরা কি মানুষ! নাকি নরপিশাচ? মাল্লাগুলো যখন মৃত তিমি আর বাচ্চাটাকে দেখে হাসছিল তখন মনে হচ্ছিল ওদের গালে চড় কষিয়ে দিই৷ ব্যাপারটা এত নৃশংস আগে জানলে কিছুতেই এ জাহাজে উঠতাম না৷’
সুদীপ্ত বলল, ‘আমাদেরও খুব খারাপ লাগছে৷ কিন্তু আমাদের তো কিছু করণীয় নেই এ ব্যাপারে৷ যথাসম্ভব এসব দৃশ্য না দেখে আমাদের নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে৷’
হেরম্যান বললেন, ‘কাল সকালে আলো ফোটার পরই আমরা জাহাজ ছেড়ে দ্বীপে রওনা হব৷’
ক্যাথলিন বলল, ‘হ্যাঁ, যতক্ষণ এ জাহাজে না থাকা যায় ততই ভালো৷ ভোরের আলো ফুটলেই আমি তৈরি হয়ে থাকব৷’—এই বলে কেবিনে ঢুকে দরজা দিল ক্যাথলিন৷
রাত আটটা নাগাদ খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ার আগে একটু টাটকা অক্সিজেন ঘরে ঢোকাবার জন্য কেবিনের পোর্ট হোল অর্থাৎ গোলাকার কাচের জানলা খুললেন হেরম্যান৷ বাইরে জ্যোৎস্না আলোকিত বরফ-মোড়া সমুদ্র৷ এখানে সমুদ্রের নাব্যতা খুব কম বলে, জাহাজের নীচের অংশের অনেকটাই জলের ভিতরে ডুবে আছে৷ আর জলতল পোর্ট হোলের অনেকটাই কাছে চলে এসেছে৷ মাত্র হাত তিন-চার ব্যবধান৷ ছোট ছোট বরফের পাত ভাসছে জলে৷ কিন্তু জানলাটা খুলতেই প্রবল ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে তিমির রক্তের আঁশটে গন্ধ প্রবেশ করতে লাগল কেবিনে৷ তিনি তাই পোর্ট হোলের পাল্লাটা আবার বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ঠিক সেই সময় বাইরে হঠাৎ একটা জিনিস চোখে পড়তেই তিনি বললেন, ‘সুদীপ্ত, দেখবে এসো!’
সুদীপ্ত পোর্ট হোল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেল ব্যাপারটা৷ সেই তিমির বাচ্চাটা জাহাজের অন্যপাশে তার মাকে ছেড়ে এবার এদিকে এসে উপস্থিত হয়েছে! সুদীপ্তরা দেখতে লাগল তাকে৷ একবার তো সেই ছোট্ট তিমিটা পোর্ট হোলের একদম কাছে চলে এল৷ কয়েক বিন্দু জল ছিটকে উঠে সুদীপ্তদের মুখেও লাগল৷ তারপর সম্ভবত জাহাজের অন্যদিকে যাবার জন্য রওনা হল সে৷ যেমন ঠান্ডা, তেমনই আঁশটে গন্ধ৷ এরপর আর পোর্ট হোল খোলা রাখা সম্ভব হল না৷ পোর্ট হোলটা বন্ধ করার সময় হেরম্যান আক্ষেপের স্বরে বললেন, ‘মানুষের লালসার জন্য এমন কত নিরীহ প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়৷ আমার ক্ষমতা থাকলে মা-হারা এই প্রাণীটাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম৷’
সুদীপ্তরা ঘুমিয়ে পড়েছিল৷ তখন মধ্যরাত৷ হঠাৎ কেবিনের দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তাদের৷ হেরম্যান বাতি জ্বালিয়ে দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে কেবিনে প্রবেশ করল সেই হারপুন স্মিথ৷ তার হাতে একটা লম্বা টর্চ৷ ‘এত রাতে ঘুম ভাঙালাম বলে ক্ষমা করবেন৷’—এ কথা বলেই সে সোজা এগিয়ে গিয়ে পোর্ট হোল খুলে জলের ওপর টর্চের আলো ফেলতে লাগল৷ বেশ কিছুক্ষণ বাইরেটা দেখার পর পোর্ট হোল বন্ধ করে বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই সুদীপ্ত তাকে প্রশ্ন করল, ‘কী দেখলে?’
লোকটা যা জবাব দিল তা শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন সুদীপ্ত আর হেরম্যান৷ স্মিথ বলল, ‘যে নাবিক ডেকে রাত-পাহারা দিচ্ছিল, সে নাকি মারমেড দেখেছে৷ এদিকে এসে অদৃশ্য হয়ে যায় প্রাণীটা৷ তাই দেখলাম কিছু আছে নাকি!’
স্মিথ ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই হেরম্যান আক্ষেপের স্বরে বললেন, ‘আমরা বোকামি করেছি৷ যত কষ্টই হোক না কেন, আমাদের উচিত ছিল ডেকে রাত কাটানো৷ আগের সেই বুড়ো নাবিক তো রাতে ডেক থেকেই মৎস্যকন্যার দর্শন পেয়েছিল৷ আজ ডেকে থাকলে আমরাও পেতাম৷ চলো ডেকে চলো৷’
হারপুন স্মিথের প্রায় পিছন পিছন ঘরের বাইরে এল তারা৷ ওপরে ওঠার জন্য সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়ে পাশের কেবিনের দিকে তাকিয়ে সুদীপ্ত বলল, ‘ক্যাথলিনকে ডাকব নাকি?’
হেরম্যান বললেন, ‘থাক৷ মাঝরাতে মেয়েটাকে ডেকে লাভ নেই৷ ওপরে গিয়ে ব্যাপারটা কী ঘটেছে জানি৷’
ডেকে উঠে এল সুদীপ্তরা৷ প্রায় সব নাবিকই ডেকে জড়ো হয়েছে৷ একজন নাবিককে ঘিরে তারা চাঁদের আলোতে উত্তেজিতভাবে জটলা করছে৷ সুদীপ্তরা ডেকে উঠতেই ক্যাপ্টেন এগিয়ে এলেন৷ সিঁড়ির মুখটাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি৷ সুদীপ্তদের কাছে চাপাস্বরে তিনি জানতে চাইলেন, ‘আপনারা কি নাবিকদের সামনে মৎস্যকন্যা সম্পর্কে কিছু বলেছিলেন? আমি তো আপনাদের বারণ করেছিলাম৷’
হেরম্যান বেশ দৃঢ়ভাবে জবাব দিলেন, ‘না, কারও সামনে আমরা ও ব্যাপারে আলোচনা করিনি৷’
তাঁর কথা শুনে যেন আশ্বস্ত হয়ে ক্যাপ্টেন এগোলেন জটলার দিকে৷ তাঁর পিছনে হেরম্যান আর সুদীপ্ত৷ ছোটখাটো যে মাল্লাকে ঘিরে জটলা হচ্ছে, তার চোখে- মুখে বেশ ভয়ার্ত ভাব৷ আর তাকে যারা ঘিরে আছে তাদের মুখেও উত্তেজনা৷ ক্যাপ্টেন হ্যামার নাবিকদের বলয়ের মধ্যে থাকা লোকটাকে বললেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই ভুল দেখেছ হেনরি৷ এমন ঘটনা হতেই পারে না৷ মারমেড বলে কোনো প্রাণী থাকতে পারে না৷’
হেনরি নামের লোকটা বলল, ‘না, আমি ভুল দেখিনি৷ মরা তিমিটার গায়ে ও ভেসে উঠল৷ মাছের মতো লেজটা ওপরে তুলে তাকাল জাহাজের দিকে৷ আমি সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে কোমর থেকে ছুরিটা খুলে ছুড়ে মারলাম তাকে লক্ষ্য করে৷ আর সেই মুহূর্তেই ডুব দিল প্রাণীটা৷ জলের তরঙ্গ দেখে মনে হল সে যেন জাহাজটাকে বেড় দিয়ে অন্যদিকে চলে গেল৷’
ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আমার ধারণা যদি তুমি কিছু দেখে থাকো তবে সেটা ওই তিমির বাচ্চাটাই৷’
নাবিক আবারও বলল, ‘না, ওটা মৎস্যকন্যাই৷ চাঁদের আলোতে ঝলমল করছিল ওর বিরাট লেজটা৷ আমার খুব ভয় করছে৷’
তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অপর একজন নাবিক বলল, ‘মারমেড দর্শন খুব অশুভ ব্যাপার৷ আমাদের ফিরে যাওয়াই ভালো৷’ আর তাকে সমর্থন করে অন্য একজন নাবিক বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়৷’
নাবিকদের মধ্যে আতঙ্ক সঞ্চারিত হতে শুরু করেছে দেখে ক্যাপ্টেন হ্যামার চিৎকার করে উঠলেন, ‘চোপ! আর একটা কথা বলবে না কেউ৷’
এ কথা বলার পর তিনি সুদীপ্তদের চমকে দিয়ে কোমর থেকে একটা রিভলবার বার করে সমবেত নাবিকদের দিকে সেটা উঁচিয়ে ধরে বললেন, ‘ফের যদি কেউ ফিরে যাবার কথা বলো বা এ ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করো তবে তাকে গুলি করে মেরে জলে ফেলে দেব৷ যাও, যে যার কেবিনে ফিরে যাও৷ কাল সূর্যের আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করতে হবে৷’
যে লোকটা মারমেড দেখেছে বলে দাবি করছে, হেরম্যানের তার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও এ পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা সম্ভব হল না৷ ক্যাপ্টেনের হুমকি শুনে নাবিকের দল জটলা ভেঙে নিজেদের কেবিনের পথ ধরল৷ আর তাদের সঙ্গে সুদীপ্ত আর হেরম্যানও নিজেদের কেবিনে ফিরে এল৷
৷৷ ৬৷৷
পরদিন সকালে সুদীপ্তরা যখন দ্বীপে যাবার জন্য তৈরি হয়ে ডেকে উঠে এল, তার অনেকক্ষণ আগেই সূর্যোদয় হয়েছে৷ নাবিকরা ইতিমধ্যে যে যার কাজে নেমে পড়েছে৷ মৃত তিমিটাকে শিকল বেঁধে ডেকে তোলার চেষ্টা হচ্ছে৷ সুদীপ্তরা ডেকে উঠে দেখল ক্যাথলিন তাদের আগেই তৈরি হয়ে ডেকে উপস্থিত হয়েছে৷ একটা সিন্দুকের ওপর বসেছিল সে৷ সুদীপ্তদের ঘরে যেমন সিন্দুক আছে, ঠিক একইরকমের সিন্দুক৷ সুদীপ্তদের দেখে ক্যাথলিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সিন্দুকটা কেবিন থেকে আনলাম৷ দ্বীপে নিয়ে যাব৷ টেলিস্কোপ আর অন্যান্য যন্ত্রপাতি আছে৷ কিছু খাবার, ব্যক্তিগত কিছু জিনিসও আছে৷ দ্বীপেই এটা রেখে আসব৷ ওখানে তো আর চুরি যাবার ভয় নেই৷ শেষ দিন আবার ফিরিয়ে আনব৷’
কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন মাল্লা দড়ি বেঁধে সিন্দুকটা সুদীপ্তদের নৌকাতে নামিয়ে দিল৷ সুদীপ্তরা দাঁড় বাইতে শুরু করল দ্বীপের দিকে৷ জাহাজ থেকে কিছুটা দূরে যাবার পর হেরম্যান ক্যাথলিনকে বললেন, ‘কাল রাতের ঘটনা জানো কিছু?’
ক্যাথলিন বলল, ‘কী ঘটনা? কাল কেবিনে ঢোকার পর আমি আর বাইরে বেরোইনি৷’
হেরম্যান গতরাতের ঘটনাটা সংক্ষেপে তাকে ব্যক্ত করতেই ক্যাথলিন বিস্মিতভাবে বলল, ‘এত ব্যাপার ঘটে গেছে আমি বুঝতেই পারিনি৷ তবে মৎস্যকন্যা দর্শনের ভয়ে ওরা যদি তিমি শিকার বন্ধ করে তবে বেশ ভালো হয়৷’
সুদীপ্ত বলল, ‘তা হলে কিন্তু আমরাও সমস্যাতে পড়ব৷ শিকার বন্ধ হলে নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন আমাদের জন্য এখানে অপেক্ষা করবেন না৷ আমাদেরও ফিরে যেতে হবে৷’
কথা বলতে বলতে দ্বীপে পৌঁছে গেল তারা৷ সিন্দুকটা বেশ ভারী৷ হেরম্যান আর সুদীপ্ত সেটাকে ধরাধরি করে জল থেকে ডাঙায় টেনে তুলল৷ আগের দিনের মতোই পেঙ্গুইনের দল ডাক ছেড়ে মারিয়ান দ্বীপে স্বাগত জানাল তাদের৷
হেরম্যান ক্যাথলিনকে বললেন, ‘আমরা তো আজ দ্বীপের পুবদিকের তটরেখা বরাবর যাব৷ তুমি কী করবে?’
গতকাল যে পাথরের ওপর সিন্ধুঘোটকটা শুয়ে ছিল সেখানে আজ আর প্রাণীটা নেই৷ ক্যাথলিন পাথরটা দেখিয়ে বলল, ‘ওর ওপর টেলিস্কোপ বসিয়ে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করব৷ আমি এ জায়গাতেই থাকব৷ চিন্তা নেই৷ আপনারা ফিরে এলে জাহাজের দিকে রওনা হব৷’
ক্যাথলিনকে সে জায়গাতে রেখে তটরেখা বরাবর হাঁটতে লাগলেন হেরম্যান আর সুদীপ্ত৷ গতরাতের ঘটনার পর হেরম্যান বেশ উজ্জীবিত৷ তিনি বললেন, ‘আমার ধারণা মৎস্যকন্যারা দ্বীপের গভীরে যায় না৷ কারণ মাটিতে নিশ্চয়ই তাদের অনেকটা সিল বা সিন্ধুঘোটকদের মতো বুকে ভর দিয়ে লাফিয়ে যেতে হয়৷ পাহাড়ের গায়ে যে গুহাগুলো সমুদ্রে এসে নেমেছে, তার ভিতরেও ওদের বাস হতে পারে৷’
গতদিনের মতোই তারা এগিয়ে চলল৷ পথটা মোটামুটি আগের দিনের মতোই৷ নির্জন তটরেখা, গিরিশিরা কোথাও বা তটরেখা অতিক্রম করে সমুদ্রে নেমেছে৷ কোথাও কোথাও জটলা করছে পেঙ্গুইনের দল, পাথরের ওপর আড়মোড়া ভাঙছে সিল৷ ঘণ্টাখানেক চলার পর তটরেখাটা এক জায়গাতে নববই ডিগ্রি বাঁক নিয়েছে৷ সেটা অতিক্রম করেই হেরম্যান বলে উঠলেন, ‘আরে! একটা জাহাজ মনে হচ্ছে!’
হ্যাঁ, একটা জাহাজের অবয়ব যেন দূর থেকে চোখে পড়ছে! সুদীপ্তরা তটরেখা ধরে দ্রুত এগোল সেদিকে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজের অবয়বটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করল তাদের চোখের সামনে৷ একসময় জাহাজটার কাছাকাছি পৌঁছে গেল ওরা দুজন৷ জলে নয়, জল থেকে বেশ অনেকটা তফাতে ডাঙার মধ্যে রয়েছে কিছুটা হেলে পড়া বিশাল জাহাজটা৷ অবশ্য এখন তাকে কোনো দানব জাহাজের কঙ্কাল বলাই ভালো৷ কাঠের অংশ অধিকাংশই খসে পড়েছে, লোহার কাঠামোটাই দাঁড়িয়ে আছে৷ জাহাজটা যে প্রাচীনকালের পালবাহিত জাহাজ তা তার ভেঙে পড়া সার সার মাস্তুলদণ্ডের অবশিষ্ট অংশ দেখে বোঝা যাচ্ছে৷ বর্তমানে রেলিংবিহীন ডেকটাতে বেশ কয়েকটা কামান রয়েছে৷ কয়েকটা আবার ডেক থেকে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ কিছুটা তফাতে থেকে জাহাজটাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর হেরম্যান বললেন, ‘এ জাহাজ হয় যুদ্ধজাহাজ অথবা জলদস্যুদের জাহাজ ছিল বলে মনে হয়৷ নইলে কামানের এত আধিক্য থাকত না৷ ছবির বইতে এ ধরনের জাহাজের ছবি হয়তো বা তুমিও দেখেছ৷ বাষ্পীয় জাহাজ আসার আগে সপ্তদশ- অষ্টাদশ শতকে এ ধরনের জাহাজ ব্যবহার করা হত৷’
সুদীপ্ত বলল, ‘সম্ভবত সামুদ্রিক ঝড় জাহাজটাকে ডাঙায় টেনে তুলেছিল৷ অথবা সমুদ্র দ্বীপের আরও গভীরে বিস্তৃত ছিল, এখন কিছুটা দূরে সরে এসেছে৷ নইলে এত বড় জাহাজকে কিছুতেই ডাঙায় টেনে তোলা সম্ভব নয়৷’
হেরম্যান বললেন, ‘আমারও তাই মনে হয়৷ খোলটার আয়তন দেখেছ! আমাদের জাহাজের মতো তিনটে জাহাজ ঢুকে যাবে ওর পেটে!’
এ কথা বলার পর হেরম্যান বললেন, ‘হয়তো এই অজানা দ্বীপে এসে খাদ্যাভাব বা রোগে ভুগে মারা পড়েছিল এ জাহাজের নাবিকরা, অথবা অন্য কোনো জাহাজ এসে তাদের উদ্ধার করেছিল৷ আজ শুধু সেদিনের কোনো অজানা নৌ-অভিযানের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে জাহাজটা৷ অনেকসময় কিন্তু এসব জাহাজে গুপ্তধন পাওয়া যায়৷ কাছে গিয়ে একবার জাহাজটা ঘুরে দেখবে নাকি?’
শেষ কথাগুলো যে হেরম্যান মজা করে বললেন, তা বুঝতে অসুবিধা হল না সুদীপ্তর৷ সহজে বড়লোক হবার ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনোটাই যে হেরম্যানের নেই, তা এতদিন তাঁর সঙ্গে থেকে জানে সুদীপ্ত৷ হেরম্যান এরপর নিজেই বললেন, ‘আমরা যেভাবে এগোচ্ছিলাম, চলো সেভাবেই এগোনো যাক৷ এর মধ্যে কোনোদিন সুযোগ-সুবিধা পেলে জাহাজটা ঘুরে দেখা যাবে৷’
সুদীপ্তরা এগোতে লাগল৷ এ জায়গাতে কিছুটা তফাতে তফাতেই গিরিশিরাগুলো সমুদ্রতে এসে মিশেছে৷ অন্ধকার সব গুহা৷ সমুদ্রের জল এসে মিশেছে সেখানে৷ একটা সময় যাত্রাপথ রুদ্ধ হল তাদের৷ একটা উঁচু গিরিশিরা এমনভাবে সমুদ্রের বেশ ভিতরে প্রবেশ করেছে যে সমুদ্রে নৌকা নিয়ে গিরিশিরাটাকে বেড় দিয়ে ওপাশে যেতে হবে৷
একটু ভেবে নিয়ে হেরম্যান বললেন, ‘আজকের মতো তবে ফিরে চলো৷ দেখা যাক কাল কী করতে পারি?’
তারা ফেরার পথ ধরল৷ যে জায়গা থেকে তারা রওনা হয়েছিল, গতদিনের থেকে অনেক আগেই, বেলা দুটো নাগাদ তারা সে জায়গাতে ফিরে এল৷
কিন্তু ক্যাথলিন কই? সমুদ্রতটে শুধু রয়েছে তার সিন্দুকটা৷ একই জায়গায় সেটা রয়েছে, যেখানে হেরম্যান আর সুদীপ্ত সেটা নামিয়ে রেখেছিলেন৷ হেরম্যান বেশ কয়েকবার হাঁক দিলেন, ‘ক্যাথলিন, ক্যাথলিন’ বলে৷ সুদীপ্তও বেশ কয়েকবার হাঁক দিল ক্যাথলিনের নাম ধরে, কিন্তু তার কোনো সাড়া মিলল না৷ সুদীপ্তদের হাঁকডাকে ভয় পেয়ে একদল পেঙ্গুইন শুধু লাফিয়ে পড়ল বরফগলা সমুদ্রে৷
হেরম্যান বললেন, ‘মেয়েটা কোথায় গেল? ও কি দ্বীপের ভিতরে ঢুকল? অবশ্য আমাদের তো এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল না৷ হয়তো বা ও নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে আসবে বিকাল নাগাদ৷ চলো আপাতত ওই সিন্দুকটার ওপরে কিছুক্ষণ বসি৷ তবে আজকে থেকে পালা করে ডেকে রাত জাগতে হবে৷ বলা যায় না, হয়তো আবার মৎস্যকন্যা এসে যদি হাজির হয় জাহাজের কাছে?’
কথা বলতে বলতে তারা হাজির হল সিন্দুকটার কাছে৷ তার ডালাটা খোলা৷ ভিতরে কিছু নেই৷ সুদীপ্তরা বেশ অবাক হল৷ এত মালপত্র নিয়ে ক্যাথলিন কোথায় গেল? সিন্দুকটার ভিতরটাও যেন কেমন ভেজা ভেজা৷ সিন্দুকটার ডালা বন্ধ করার জন্য একটু ঝুঁকতেই সিন্দুকের ভিতর একটা জিনিস চোখে পড়ায় হেরম্যান সেটা তুলে নিলেন৷ ঝিনুকের একটা মালা৷ হয়তো বা সেটা ক্যাথলিনেরই হবে৷ মালাটা নেড়েচেড়ে একটু পরীক্ষা করে ক্যাথলিন ফিরলে সেটা তাকে ফেরত দেবার জন্য জ্যাকেটের পকেটে রেখে দিলেন হেরম্যান৷ ডালা বন্ধ করে সিন্দুকের ওপর বসে ক্যাথলিনের ফেরার প্রতীক্ষা করতে লাগলেন তাঁরা৷ সময় এগিয়ে চলল৷
বিকেল হয়ে এল একসময়৷ সমুদ্রে ভাসমান পেঙ্গুইনের ঝাঁকগুলো একে একে ডাঙায় উঠে আসতে লাগল৷ হেরম্যান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চলো তো, আশেপাশে একটু দেখে আসি৷ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না!
খোঁজ শুরু করল সুদীপ্তরা৷ তটরেখা থেকে কিছুটা তফাতে একটা পাথুরে টিলা আছে৷ তার ওপর সুদীপ্তরা চড়ে বসল৷ দ্বীপের ভিতরটা বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে৷ সুদীপ্তদের যতদূর চোখ যাচ্ছে তাতে দ্বীপের ভিতর গাছপালা বিশেষ নেই৷ পাথুরে টিলা, পাহাড় আর গিরিশিরা সমন্বিত দ্বীপ৷ কোথাও কোথাও খাত বেয়ে নালা বা ছোট ছোট খালের মতো সমুদ্রের জল দ্বীপের ভিতরেও প্রবেশ করেছে৷ উঁচু টিলা বা পাহাড়গুলোর মাথায় বরফ জমে আছে৷ টিলার ওপর দাঁড়িয়ে সুদীপ্ত আর হেরম্যান বেশ কয়েকবার ডাক দিলেন ক্যাথলিনের নাম ধরে৷ তাঁদের ডাক টিলাগুলোর গায়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল৷ কিন্তু ক্যাথলিনের কোনো সাড়া মিলল না৷ অগত্যা টিলা থেকে নেমে এল সুদীপ্তরা৷ তারা যখন টিলা থেকে নেমে সমুদ্রতটে তাদের আগের জায়গাতে ফিরে এল তখন সূর্য ঢলে পড়তে শুরু করেছে সমুদ্রের বুকে৷ দূরে একটা দেশলাই বাক্সর মতো দেখা যাচ্ছে জাহাজটা৷ মৃদু বাতাসে কিছুটা তফাতে জলের মধ্যে দোল খাচ্ছে নৌকোটা৷
হেরম্যান বললেন, ‘কী হতে পারে বলো তো?’
সুদীপ্ত বলল, ‘যতদূর মনে হয়, এ দ্বীপে হিংস্র জন্তু বিশেষ নেই৷ নইলে এই নিরীহ পেঙ্গুইনের দল এখানে বাসা বাঁধত না৷ এমন হতে পারে যে ক্যাথলিন টিলার গোলকধাঁধায় পথ হারিয়েছে, অথবা কোনোভাবে চোট পেয়েছে বা আহত হয়েছে৷ কিছু একটা তো হয়েইছে৷’
হেরম্যান বললেন, ‘হ্যাঁ, দ্বীপের ভিতর ঢুকে ভালো করে খোঁজ চালাতে হবে৷ কিন্তু সেটা কাল সকালের আগে হবে না৷ একটু পরেই অন্ধকার নামবে৷ কিন্তু জাহাজেও ফেরা যাবে না৷ বলা যায় না, সূর্যাস্তের পর হয়তো ক্যাথলিন ফিরে এল৷’
সুদীপ্ত বলল, ‘হ্যাঁ৷ আমরা জাহাজে এখন ফিরব না৷ এখানেই ক্যাথলিনের জন্য অপেক্ষা করা উচিত৷ আমরা ফিরছি না দেখে হয়তো বা জাহাজ থেকে ক্যাপ্টেন কাউকে পাঠাতে পারেন আমাদের খোঁজ করার জন্য৷’
হেরম্যান বললেন, ‘তেমন হলে আরও ভালো৷ ক্যাথলিন না ফিরলে ওকে খোঁজার জন্য তাদেরও সাহায্য পাওয়া যাবে৷’
কিছু সময়ের মধ্যেই বরফসমুদ্রে সূর্য ডুবে গেল৷ আর তার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসতে লাগল কনকনে ঠান্ডা বাতাস৷ অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গেই পেঙ্গুইনের দলও তাদের চিৎকার থামিয়ে আশ্রয় নিতে থাকল সমুদ্রতটে পড়ে থাকা পাথরগুলোর খাঁজে৷ হেরম্যান বললেন, ‘ওভাবে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকলে আমরা নির্ঘাত মারা পড়ব৷ চলো, কোনো পাথরের আড়ালে আশ্রয় নেওয়া যাক৷’
যে বিরাট পাথরটার ওপর আগের দিন একটা সিন্ধুঘোটক বসে ছিল, সেখানে গিয়ে উপস্থিত হল সুদীপ্তরা৷ তার আড়ালে একটা গর্ত মতো জায়গাতে বসেছিল এক পেঙ্গুইন দম্পতি৷ সেটা মনে হয় তাদের স্থায়ী আস্তানা৷ ব্যাপারটা অভদ্রজনোচিত হলেও শীত থেকে বাঁচতে তাদের হঠিয়ে সে জায়গার দখল নিল সুদীপ্তরা৷ বেশ কিছু সময়ের জন্য অন্ধকারে ঢেকে গেল চারপাশ৷
৷৷ ৭৷৷
চাঁদ উঠতে শুরু করল একসময়৷ ধীরে ধীরে চারদিক স্পষ্ট হতে লাগল৷ একসময় ভরা চাঁদের আলোতে ভরে গেল চারদিক৷ গুটি গুটি পায়ে নিজেদের আস্তানা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে লাগল পেঙ্গুইনের দল৷ তারা একে একে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল, খেলে বেড়াতে লাগল চাঁদের আলোতে উচ্ছ´সিত ধবধবে দুধের মতো বরফসমুদ্রে৷ সেই অপূর্ব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুক্ষণের জন্য ক্যাথলিনের কথাও ভুলে গেল সুদীপ্তরা৷ ঘণ্টাখানেক ধরে জলক্রীড়া সাঙ্গ করে অবশেষে আবার পাড়ে উঠে এল পেঙ্গুইনের দল রাত্রিযাপনের জন্য৷ আগের মতোই নিস্তব্ধ হয়ে গেল চারদিক৷ পাথরের আড়ালে বসে সুদীপ্তরা চেয়ে রইল সমুদ্রের দিকে৷ অপেক্ষা করতে লাগল ক্যাথলিনের ফিরে আসার জন্য৷
এখন মাঝরাত৷ হেরম্যানকে ঘুমোতে বলে জেগে ছিল সুদীপ্ত৷ তার চোখেও ঘুমের ভাব নেমে আসছিল৷ মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল চোখের পাতা৷ হঠাৎ তার চোখে ধরা দিল একটা দৃশ্য৷ সমুদ্রর জল থেকে বুকে হেঁটে কী যেন একটা ডাঙায় উঠছে! চোখ কচলে ভালো করে সেদিকে তাকাল সুদীপ্ত৷ প্রথমে তাকে সিল মনে হলেও ডাঙার ওপর বেশ কিছুটা এগিয়ে এসে সে থামতেই সুদীপ্তর ভুল ভেঙে গেল৷ সিল কোথায়! এ যে একটা মেয়ে! দু-হাতের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে সে যেন কিছু খুঁজছে! আর তারপরই মেয়েটা একদিকে পাশ ফিরতেই চমকে উঠল সুদীপ্ত৷ নিজের চোখকেই যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না৷ চাঁদের আলোতে ঝলমল করছে মেয়েটার কোমরের নীচ থেকে মাছের মতো রুপোলি আঁশে ঢাকা অংশটা৷ আর তার শেষপ্রান্তে মাছের মতো পাখনাটাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সুদীপ্ত! মারমেড! মৎস্যকন্যা!! প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে হেরম্যানকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তুলে সুদীপ্ত চাপাস্বরে উত্তেজিত ভাবে বলল, ‘সামনে দেখুন, সামনে দেখুন!’
চোখ মেলে সুদীপ্তর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে হেরম্যানও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন৷ একপাশ ফিরে এদিকে-ওদিকে মাথা ফিরিয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে মৎস্যকন্যা! একরাশ চুল তার কাঁধ বেয়ে নেমে এসেছে কোমর পর্যন্ত৷ কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর ভালো করে তাকে দেখার জন্য হেরম্যান উঠে দাঁড়াতেই একটা ঘটনা ঘটল৷ হেরম্যানকে ওভাবে উঠে দাঁড়াতে দেখেই কাছেই শুয়ে থাকা একজোড়া পেঙ্গুইন দম্পতি হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল৷ আর সে শব্দ কানে যেতেই আশেপাশে ঘুমিয়ে থাকা পেঙ্গুইনরাও একযোগে ডাকতে শুরু করল৷ মৎস্যকন্যা ফিরে তাকাল সুদীপ্তরা যে পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে৷ সুদীপ্তদের উপস্থিতি সে বুঝতে পারল কি না কে জানে, কিন্তু কিছু একটা হয়তো অনুমান করল সেই মৎস্যকন্যা৷ কারণ, এরপরই সে অসম্ভব ক্ষিপ্রগতিতে পিছু ফিরে বুকে, হাতে ভর দিয়ে ছুটতে শুরু করল সমুদ্রের দিকে৷ তার দেহের পিছনের অংশটা স্পষ্ট দৃশ্যমান৷ হ্যাঁ, পাখনাঅলা মাছেরই দেহ! কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ছুটে গিয়ে সে ঝাঁপ দিল সমুদ্রের জলে৷ সাঁতার কাটতে লাগল মৎস্যকন্যা৷ মাঝে মাঝে তার লেজটা চাঁদের আলোতে জলের নীচ থেকে জেগে উঠছে৷ উত্তেজনার বশে সুদীপ্তরা কখন যেন পাথরের আড়াল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে তা তাদের খেয়াল নেই৷ সামান্য সময়ের মধ্যেই তটরেখার সমান্তরালে সাঁতার কেটে একটা গিরিশিরার কাছে অদৃশ্য হয়ে গেল মৎস্যকন্যা৷ হেরম্যান আর সুদীপ্তও এবার ছুটে এসে জলে নেমে পড়ে সেদিকে তাকালেন৷ না, সমুদ্রর জলে আর দেখা যাচ্ছে না তাকে৷ হেরম্যান বললেন, ‘সমুদ্রর মধ্যে নেমে আসা এই গিরিশিরার মধ্যে একটা গুহা আছে দেখেছি৷ সম্ভবত ওর মধ্যেই প্রবেশ করল মৎস্যকন্যা৷ আমরা নিজের চোখে দেখলাম তাকে! এবার তো আর মৎস্যকন্যার উপস্থিতি অস্বীকার করা যাবে না! ভোরের আলো ফুটলেই গুহাটাতে একবার ঢুকব৷ হয়তো ওখানেই সে থাকে৷ কাছ থেকে একবার তাকে দেখব৷ আর যদি ক-টা ছবি তুলতে পারা যায় তো কথাই নেই৷ ছবিগুলো আমাদের জীবনের অন্যতম সেরা সম্পদ হয়ে থাকবে৷’
বাকি রাতটা পাড়ে উঠে ভোরের প্রতীক্ষাতে কাটিয়ে দিল সুদীপ্তরা৷ তারপর একসময় সূর্যদেব রং ছড়াতে শুরু করলেন সমুদ্রের বুকে৷ নতুন ভোরকে স্বাগত জানিয়ে হাঁকডাক শুরু করল পেঙ্গুইনের দল৷ জলে নামার আগে সুদীপ্ত একবার জানতে চাইল, ‘ক্যাথলিনকে খোঁজার ব্যাপারটা কী হবে?’
হেরম্যান বললেন, ‘নিশ্চয়ই তার খোঁজে বেরোতে হবে আমাদের৷ আগে গুহাটা দেখে আসি৷ হয়তো বা ততক্ষণে জাহাজ থেকে আমাদের খোঁজে লোকও চলে আসবে৷’
সুদীপ্তরা জলে নেমে পড়ল৷ তারপর তটরেখার সমান্তরালে এগিয়ে উপস্থিত হল ঠিক সে জায়গাতে, যেখানে গিরিশিরার গুহামুখ সমুদ্রতে এসে মিশেছে৷ হাতকুড়ি চওড়া হবে গুহার মুখটা৷ উচ্চতাতে সুদীপ্তদের মাথা থেকে কিছুটা বেশি৷ সমুদ্রের জল তার ভিতরে প্রবেশ করছে৷ ভিতরটা এখনও প্রায় অন্ধকারই বলা চলে৷ সুদীপ্ত টর্চের আলো ফেলল গুহার ভিতর৷ গুহাটা বেশ গভীরই মনে হল তাদের৷ টানেলের মতো এগিয়েছে সেটা৷ সুদীপ্তরা প্রবেশ করল গুহার ভিতর৷ কোমরসমান জল ভেঙে তারা এগোতে লাগল সামনে৷ সুদীপ্ত মাঝে মাঝে দু-পাশের দেওয়ালের গায়েও আলো ফেলতে লাগল৷ কিছুক্ষণ চলার পর অবশ্য অন্ধকার অনেকটাই কেটে গেল৷ বাইরে সূর্য উঠতে শুরু করেছে৷ গুহার মাথার ছাদের ফাটল দিয়ে আলো প্রবেশ করতে শুরু করেছে গুহার ভিতর৷ গুহাটা একমুখী, কোথাও বাঁক নেই৷ সোজা এগিয়েছে সামনের দিকে৷ দু-পাশের দেওয়ালের গায়ে তাকের মতো খাঁজ আছে৷ তাতে ভর দিয়ে মাঝে মাঝে তারা হাঁটছিল দেহের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য৷ কারণ জলের ভিতর তাদের পায়ের নীচটা নুড়িপাথরে ভর্তি৷ হঠাৎই চলতে চলতে এক জায়গাতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন হেরম্যান৷ সেখানে দেওয়ালের তাকে রাখা আছে বেশ কিছু শামুক-ঝিনুক৷ সেগুলো হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে হেরম্যান বেশ উৎফুল্লভাবে বললেন, ‘আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি মনে হয়৷ এগুলো সমুদ্রের জলে ভেসে আসা শামুক-ঝিনুক নয়, অন্য কোথাও থেকে সংগ্রহ করে এনে এখানে রাখা হয়েছে৷ এটা মানুষের কাজ৷ কিন্তু মানুষ এখানে আসবে কোথা থেকে? নিশ্চয়ই ওই মৎস্যকন্যা ওগুলো সংগ্রহ করে এখানে এনে রেখেছে৷’
সুদীপ্ত বলল, ‘হ্যাঁ, আমারও মনে হচ্ছে এগুলো মানুষের হাতে রাখা, থুড়ি মৎস্যকন্যার৷’
দ্বিগুণ উৎসাহে এরপর তারা এগোতে শুরু করল৷ সুদীপ্তরা বুঝতে পারল গিরিশিরার অভ্যন্তরে গুহার ভিতর দিয়ে ক্রমশ দ্বীপের গভীরে তারা প্রবেশ করছে৷ সুদীপ্তরা যত এগোতে লাগল জলস্রোত যেন এরপর বাড়তে শুরু করল৷ সমুদ্রের জল আরও বেশি প্রবেশ করতে শুরু করেছে গুহাতে৷ স্রোত এগোচ্ছে সামনের দিকে৷ একটা সময় তারা দেখতে পেল গুহাটা শেষ হয়ে এসেছে৷ বাইরের সূর্যালোক দেখা যাচ্ছে৷ তারা এগোল সেদিকে৷ কিন্তু অপরপ্রান্তের গুহামুখের কাছাকাছি পৌঁছে নিজেদের আর দাঁড় করিয়ে রাখতে পারল না সুদীপ্তরা৷ এখানে জলের নীচের মাটিটা এত মসৃণ আর পিচ্ছিল যে তারা দুজনেই পা হড়কে পড়ে গেল৷ তারপর জলস্রোতের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে ছিটকে পড়ল একটা পুকুরের মতো জায়গাতে৷
কিছুক্ষণ হাবুডুবু খেয়ে ভেসে উঠল তারা৷ জায়গাটা বড় অদ্ভুত৷ তিনদিকে তিনটে গুহামুখ আছে৷ তার মধ্যে দুটো গুহামুখ থেকে জল এসে পুষ্ট করছে ছোট এই জলাশয়টাকে৷ তৃতীয় গুহামুখ থেকে অবশ্য জল সিঞ্চন হচ্ছে না৷ আর চৌকোনা জলাশয়ের উন্মুক্ত জায়গাতে রয়েছে কিছু ঘর-বাড়ি৷ জলাশয়ের সে-পাড়ে অদ্ভুত চেহারার কিছু মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে৷ লোকগুলো অস্ত্রধারী৷ হাতে তলোয়ার, বল্লম এ ধরনের অস্ত্র আছে৷ সুদীপ্তরা নিরুপায়৷ তারা এগোল পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে৷ পাড়ের কাছে পৌঁছোতেই লোকগুলো প্রায় হ্যাঁচকা মেরেই জল থেকে ডাঙায় তুলল সুদীপ্তদের৷ লোকগুলোর পরনে সম্ভবত সিলের চামড়ার তৈরি পোশাক, চামড়ার কান ঢাকা টুপি৷ তাদের গায়ের রং দেখে মনে হয় তারা ইওরোপীয় বংশোদ্ভূত৷ চুল-দাড়ির রং লালচে ধরনের৷ অস্ত্রগুলোও যেন সাবেক কালের৷ সুদীপ্ত আর হেরম্যানকে তারা ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে চলল বাড়িঘরগুলোর দিকে৷ বাড়িগুলোও ছিরিছাঁদহীন৷ দেখে মনে হচ্ছে সেগুলো কোনো কোনোটা জাহাজের লোহা-কাঠ দিয়ে বানানো৷ সুদীপ্তদের নিয়ে তারা হাজির হল একটা বাড়ির সামনে৷ বাড়ির দরজাটার ঠিক সামনে একটা মাস্তুল পোঁতা আছে৷ তার সামনে একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে একটা দীর্ঘদেহী লাল দাড়িঅলা লোক৷ তার মাথায় প্রাচীনকালের নাবিকদের মতো বাঁকানো টুপি৷ পোশাকও আদ্যিকালের ভিক্টোরিয়া যুগের নাবিকদের মতো৷ কোমরবন্ধ থেকে ঝুলছে একটা বাঁকানো তলোয়ার৷ তবে অন্য লোকদের থেকে এ লোকটার পোশাক কিছুটা জমকালো ধরনের৷ গলায় একছড়া মুক্তোর মালা আর কানে সোনার মাকড়িও আছে৷ তাকে ঘিরে আরও বেশ কয়েকজন লোকও দাঁড়িয়ে আছে৷ সুদীপ্তদের বুঝতে অসুবিধা হল না যে লাল দাড়িঅলা লোকটাই দলপতি৷ মাঝবয়সি লোকটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুদীপ্তদের পর্যবেক্ষণ করে ইংরেজিতে প্রশ্ন করল, ‘তোমরা নিশ্চয়ই ওই তিমি-শিকারি জাহাজের নাবিক?’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা ও জাহাজেই এসেছি৷ কিন্তু তোমরা কে?’
লোকটা প্রথমে জবাব দিল, ‘আমি ক্যাপ্টেন শার্ক৷ এ দ্বীপের মালিক৷ পাঁচশো বছর ধরে আমরা আছি এখানে৷’
হেরম্যান জানতে চাইলেন, ‘পাঁচশো বছর মানে?’
শার্ক বলে লোকটা জবাব দিল, ‘মানে সেই আমাদের বুকানির ফ্রান্সিস ড্রেকের সঙ্গে স্প্যানিশ আর্মাডার লড়াই বাঁধল যেসময়, আমাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন এ দ্বীপে৷’
এ কথা বলার পর শার্ক নামের সেই স্বঘোষিত দ্বীপমালিক প্রশ্ন করল, ‘তোমরা আমাদের মৎস্যকন্যাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ? জাহাজে? মৎস্যকন্যা দেখলে জাহাজিরা ভয় পায়৷ তার মানে ব্যাপারটা জেনে ফেলেছ তোমরা!’
হেরম্যান বললেন, ‘তাকে তো আমরা লুকোইনি৷ আর কী ব্যাপার জানার কথা বলছেন আপনি?’
এরপর তিনি বলতে যাচ্ছিলেন, ‘মৎস্যকন্যাকে তো আমরা গতরাতে সমুদ্রতটেই দেখেছি৷’ কিন্তু তার আগেই শার্ক নামের লোকটা বলে উঠল, ‘ওকে আমরা পালাতে দেব না৷ জাহাজ থেকে দরকার হলে ছিনিয়ে আনব৷ তারপর এই মাস্তুল থেকে তাকে ফাঁসিতে ঝোলাব৷ বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি পাবে সে৷ আর তোমাদের উদ্দেশ্যও পূরণ হবে না৷’
কাজেই মৎস্যকন্যা যে এই দ্বীপেই কোথাও আছে, তা লোকটাকে জানানো সমীচীন মনে করলেন না হেরম্যান৷ তবে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যেও হেরম্যান আর সুদীপ্ত মনে মনে খুশি হল এই ভেবে যে তাহলে মৎস্যকন্যা সত্যিই আছে৷ তাকে দেখার ব্যাপারটা তাদের দৃষ্টিবিভ্রম ছিল না৷ তবে লোকটা কী উদ্দেশ্যর কথা বলছে, তা বুঝতে পারল না তারা৷ শার্ক, সুদীপ্তদের চুপ থাকতে দেখে বলল, ‘তবে তোমরা ব্যাপারটা স্বীকার করবে না?’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘বলছি তো তার খবর আমাদের জানা নেই৷’
লোকটা এবার অন্যপাশে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কাছেও আমি শেষবারের মতো জানতে চাইছি, মৎস্যকন্যা কোথায়?’
শার্ক নামের অদ্ভুত লোকটা যেদিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল, সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সুদীপ্তরা৷ কিছুটা তফাতে একটা কাঠের পিপের গায়ে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে ক্যাথলিন! তার মানে সে আগেই ধরা পড়েছে এ লোকগুলোর হাতে৷ ক্যাথলিন জবাব দিল, ‘আমি জানি না সে কোথায়৷ আমি তাকে দেখিনি৷’
শার্কের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল৷ এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল তার মুখে৷ ক্যাথলিনের উদ্দেশে সে বলল, ‘সামনের এই পুকুরটার নাম জানো? মারমেড পন্ড৷ এই পুকুরে তোমাকে মৎস্যকন্যা বানিয়ে তোমাকে ছাড়া হবে৷ বেশ আনন্দে তুমি ঘুরে বেড়াবে এই পুকুরে৷ মাঝে মাঝে তোমাকে সমুদ্রেও নিয়ে যাওয়া হবে৷’
এ কথা বলার পর ক্যাপ্টেন শার্ক তার সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, ‘আপাতত এ মেয়েটাকে ঘরে ঢোকা, আর এ লোক দুটোকে মাস্তুলের সঙ্গে বাঁধ৷ কাল এ দুটো লোককে সমুদ্রের তীরে নিয়ে গিয়ে খুঁটির মাথায় ঝোলাব৷ পণবন্দি বানাব৷ যদি মৎস্যকন্যা জাহাজে থাকে তবে তার বিনিময়ে দুজনের মুক্তির কথা বলব৷ জাহাজে নিশ্চয়ই দূরবিন আছে৷ খুঁটিতে ঝোলালে জাহাজ থেকে নিশ্চয়ই দেখা যাবে ওদের৷’
কথাটা শুনে পাশ থেকে একজন লোক বলল, ‘কিন্তু ক্যাপ্টেন শার্ক৷ মৎস্যকন্যার বিনিময়ে এদের ছেড়ে দেওয়ার পর এরা যদি ফিরে এসে আমাদের আক্রমণ করে?’
শার্ক কথা শুনে হিংস্রভাবে হেসে উঠে বলল, ‘কেউ ছাড়া পাবে না৷ মৎস্যকন্যাকে পেলেও পাবে না, না পেলেও পাবে না৷ যেদিন এই মেয়েটাকে মৎস্যকন্যা বানিয়ে পুকুরে ছাড়া হবে সেদিন এ লোক দুটোকে সমুদ্রদানবের কাছে উৎসর্গ করব৷’
সুদীপ্ত এবার বলে উঠল, ‘আপনারা কিন্তু অযথা আমাদের সন্দেহ করছেন৷ আমরা দ্বীপে বেড়াতে নেমেছিলাম৷’
লোকটা বলল, ‘তুমি কি আমাকে বোকা পেয়েছ? আমি প্রাইভেটিয়ার শার্কের বংশধর৷ আমাকে ধোঁকা দেওয়া অত সহজ নয়৷ বাঁধ, বেঁধে ফেল৷’ শেষ কথাটা তার সঙ্গীদের উদ্দেশে বলে উঠে দাঁড়াল লোকটা৷
সুদীপ্তদের আর-কোনো কথা বলতে দেওয়া হল না৷ তাদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হল মাটিতে পোঁতা জাহাজের মাস্তুলের কাছে৷ মাটিতে বসিয়ে তাদের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে দেওয়া হল মাস্তুলদণ্ডের সঙ্গে৷ একদল লোক ক্যাথলিনকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ঘরবাড়িগুলোর আড়ালে৷ হিংস্র দৃষ্টিতে একবার সুদীপ্তদের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন শার্ক নামের লোকটা তার অস্ত্রধারী সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, ‘চলো, এবার সমুদ্রের পাড়ে যাব৷ দেখতে হবে ওখানে কোথাও মৎস্যকন্যা লুকিয়ে আছে কি না৷ অথবা তিমি শিকারের জাহাজ থেকে ওদের কাছে কেউ এসেছে কি না৷’
অবশিষ্ট লোকজনকে নিয়ে সে জায়গা ছেড়ে এরপর অদৃশ্য হয়ে গেল ক্যাপ্টেন শার্ক৷ নিস্তব্ধতা নেমে এল চারপাশে৷ এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে সুদীপ্তরা আগেও পড়েছে৷ মাথা ঠান্ডা রাখাই এখন একমাত্র কাজ৷ তারা চলে যাবার পর সুদীপ্ত বলল, ‘ক্যাপ্টেন শার্ক লোকটার সম্বন্ধে কী বুঝলেন বলুন তো?’
হেরম্যান বললেন, ‘লোকটা জলদস্যুদের বংশধর৷ একসময় যেসব জলদস্যু যুদ্ধের সময় ইংরেজ নৌবাহিনীর হয়ে ভাড়া খাটত, তাদের ‘প্রাইভেটিয়ার’ বলা হত৷ আমি বইতে পড়েছি৷’
সুদীপ্ত বলল, ‘কিন্তু ওরা এই দ্বীপে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রয়ে গেছে কেন?’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘নিশ্চয়ই তার পিছনে নির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে৷ তবে দেখা যাক ওরা শেষ পর্যন্ত আমাদের নিয়ে কী করে৷ এমনও হতে পারে ক্যাপ্টেন হ্যামার এসে আমাদের উদ্ধার করল৷ জাহাজে বন্দুক আছে৷ এ লোকগুলোর কাছে বন্দুক নেই বলেই মনে হয়৷ আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে৷ আমার শুধু ভাবনা হচ্ছে ক্যাথলিনকে নিয়ে, সে বেচারি একা পড়ে গেল৷ তার তো আর আমাদের মতো এ ধরনের অভিজ্ঞতা নেই৷ তবে যাই হোক না কেন আমাদের এই অভিযান এক অর্থে সফল৷ আমরা দেখা পেয়েছি মৎস্যকন্যার৷’
সুদীপ্ত বলল, ‘ঠিক তাই৷ এ অভিযানে যদি আমাদের মৃত্যুও ঘটে, তবে মরার আগে সান্ত্বনা থাকবে যে আমাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে৷’
হেরম্যান বললেন, ‘এবার ধীরে ধীরে দণ্ডটার গায়ে হাত ঘষতে থাকো৷ যদি দড়ি ছেঁড়া যায় কোনোভাবে৷’
সময় এগিয়ে চলল৷ তবে সুদীপ্তরা বুঝতে পারল যেভাবে তাদের বাঁধা হয়েছে তাতে ঘষে দড়ি ছেঁড়া সম্ভব নয়৷
দুপুর হল একসময়৷ তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল৷ একইভাবে দড়ি বাঁধা অবস্থায় বসে রইল তারা৷ অবশেষে সন্ধ্যা নামল৷ গাঢ় অন্ধকার নেমে এল চারপাশে৷ তার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা৷
৷৷ ৮৷৷
বেশ কিছুক্ষণ অন্ধকারে বসে কাটাল তারা দুজন৷ তারপর একসময় চাঁদ উঠতে শুরু করল আকাশে৷ আবছাভাবে সুদীপ্তদের চোখের সামনে ফুটে উঠতে লাগল পুকুরটা৷ অন্ধকার গুহামুখগুলো৷ হেরম্যান বললেন, ‘এভাবে ওরা যদি আমাদের এখানে সারারাত ফেলে রাখে, তবে আমাদের আর কষ্ট করে মারতে হবে না৷ ঠান্ডাতেই মারা পড়ব৷’
তাঁর কথার জবাবে সুদীপ্ত কিছু বলতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু একটা শব্দ শোনা গেল পুকুর থেকে৷ ভারী কিছু একটা যেন পুকুরে এসে পড়ল! কথা থামিয়ে তারা তাকিয়ে রইল পুকুরের দিকে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই পুকুর সাঁতরে পাড়ে উঠে এল একটা ছায়ামূর্তি৷ তার হাতে লম্বা লাঠির মতো কিছু একটা যেন আছে৷ লোকটার মুখ বোঝা না গেলেও সুদীপ্তদের মনে হল লোকটা যেন চারপাশে তাকাচ্ছে৷ সুদীপ্তরা যেখানে বসে আছে সেখানে সামনের বাড়িটা চাঁদের আলোকে আড়াল করে রাখায় লোকটা তাদের দেখতে পাচ্ছে না৷ চারপাশে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিয়ে ঘরবাড়িগুলোর আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল৷
সুদীপ্ত বলল, ‘এ আবার কে?’
হেরম্যান বললেন, ‘অন্ধকারের জন্য ঠিক বুঝতে পারলাম না৷ তবে আমরা যে পথে এসেছি, এও সম্ভবত সে পথেই পুকুরে এসে পড়েছে৷’
ঠান্ডা আরও বাড়তে শুরু করেছে৷ হাড়ে যেন কাঁপন ধরে যাচ্ছে৷ তবুও তারই মধ্যে আরও কিছু চোখে পড়ে কি না তার জন্য সুদীপ্তরা অপেক্ষা করতে লাগল৷ কিন্তু সে লোকটাকে আর দেখা গেল না৷ বেশ কিছুক্ষণ পরে আবার লোকজনের কথাবার্তার শব্দ যেন কানে এল তাদের৷ ক্রমশ সে শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল বাড়িঘরগুলোর পিছন থেকে৷ আর তার সঙ্গে মশালের আলো৷ ঘরবাড়িগুলোর আড়াল থেকে বেরিয়ে সুদীপ্তদের সামনে দলবলসমেত আত্মপ্রকাশ করল ক্যাপ্টেন শার্ক৷ সুদীপ্তদের কাছে এসে ব্যঙ্গভরে সে জানতে চাইল, ‘সারাদিন কেমন কাটল? ঠান্ডাটা আজ একটু বেশিই পড়েছে, তাই না?’
শার্ক সহ তার সঙ্গীদের প্রত্যেকের পরনে এখন অনেকটা লম্বা ঝুলের কোটের মতো চামড়ার তৈরি শীতের পোশাক৷
হেরম্যান শান্তভাবে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, ঠান্ডা একটু পড়েছে বটে৷’
শার্ক বলল, ‘ভাবছি তোমাদের এখন একবার পুকুরের জলে চোবাব৷ ঠান্ডা কাকে বলে বুঝতে পারবে৷ আসল কথাটা বললেই সব সমস্যা মিটে যেত৷ মৎস্যকন্যা কোথায়? তোমরা কেনই বা দ্বীপে এসেছ?’
হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘তোমাকে তো আগেই বলেছিলাম তার খবর আমরা জানি না৷ এ দ্বীপে আমরা বেড়াতে এসেছিলাম৷’
হেরম্যানের কথা শুনে শার্ক বলে উঠল, ‘চুপ করো মিথ্যাবাদী৷’ তারপর ভিড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ডাক্তার স্ক্যাভেঞ্জার? স্ক্যাভেঞ্জার, এদিকে এসো৷’
শার্কের আহ্বান শুনে একটা লোক শার্কের কাছে এসে দাঁড়াল৷ তার পরনে অত্যন্ত নোংরা একটা পোশাক৷ হাতে একটা কাঠের বাক্স ঝুলছে৷ লোকটা বুড়ো৷ একটু ঝুঁকেই দাঁড়িয়েছে সে৷
শার্ক তাকে বলল, ‘তোমার জিনিসপত্র সব ঠিক আছে তো? মরচে পড়েনি তো?’
প্রশ্ন শুনে লোকটা তার ক্ষয়াটে দাঁত বার করে হেসে বাক্সটা একটু ঝাঁকাল৷ বাক্সর ভিতর ধাতব কী সব যেন ঝনঝন করে উঠল৷
‘জড়ি-বুটি—ঘা শুকোবার ওষুধ?’ আবারও প্রশ্ন করল শার্ক৷
স্ক্যাভেঞ্জার নামের বুড়োটা বলল, ‘সব আছে ক্যাপ্টেন৷’
শার্ক বলল, ‘তবে তুমি কাল থেকেই কাজ শুরু করে দাও৷ কাল পূর্ণিমা৷ চেষ্টা করবে যাতে তার পরের পূর্ণিমাতেই এই পুকুরে ছাড়া যায়৷ সাঁতার না জানলে অবশ্য আবার তাকে তা শেখাতে হবে৷’
বুড়োটা বলল, ‘আচ্ছা তাই হবে৷’
শার্ক এরপর তার সঙ্গীদের বলল, ‘তোমাদের মধ্যে দুজন গিয়ে মেয়েটাকে আনো৷ তারপর স্ক্যাভেঞ্জারের সঙ্গে মেয়েটাকে তার ঘরে নিয়ে যাবে৷ যতদিন না আসল কাজ শেষ হয় ততদিন মেয়েটাকে তোমরা পাহারা দেবে৷’
দুজন লোক চলে গেল ক্যাপ্টেনের নির্দেশ পালন করতে৷ শার্ক এরপর সুদীপ্তদের প্রশ্ন করল, ‘তোমাদের এই মেয়েটার নাম কী?’
সুদীপ্ত জবাব দিল, ‘ক্যাথলিন৷’
শার্ক হেসে বলল, ‘ক্যাথলিন মারমেড৷ বেশ সুন্দর নাম হবে৷’
ব্যাপারটা যেন বুঝেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সুদীপ্তরা৷ ক্যাথলিনকে কীভাবে মারমেড বানাবে লোকগুলো? ক্যাপ্টেন শার্ক এরপর তার সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, ‘আমার পূর্বপুরুষরা যখন এখানে এসেছিলেন, তখন তাঁদের সঙ্গে বন্দিনী নারীর সংখ্যা ছিল প্রায় একশো৷ এই পাঁচশো বছরে পুরুষের সংখ্যা যত কমেছে, নারীর সংখ্যা কমেছে তার পাঁচগুণ বেশি৷ আর তো মাত্র কয়েকজন নারী আছে গ্রামে৷ খুব চিন্তায় ছিলাম এরপর কী হবে? মারমেড পন্ড কি ফাঁকা থাকবে? তবে শয়তান আমাদের সহায়৷ এর আগেও সে একজনকে জুটিয়ে দিল, আর এবারও একজনকে৷’
স্ক্যাভেঞ্জার হেসে বলল, ‘আপনার পূর্বপুরুষকেও তো শুনেছি অনেকে শয়তান নামে ডাকত৷ তার আশীর্বাদ বর্ষিত হচ্ছে আমাদের ওপর৷ ক্যাপ্টেন উলফের আশীর্বাদ৷’
শার্ক হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, আমার পূর্বপুরুষ ক্যাপ্টেন উলফের যোগ্য স্যাঙাত ছিল তোমার পূর্বপুরুষ ভালচার৷ সত্যিই শকুনের মতো ধূর্ত ছিল সে৷ মৎস্যকন্যার ব্যাপারটা তো প্রথম তার মাথা থেকেই আসে৷’
শার্কের কথার জবাবে বুড়ো স্ক্যাভেঞ্জার কী যেন একটা বলতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু ঠিক সেই সময় যে দুজন লোক ক্যাথলিনকে খুঁজতে গেছিল তারা ছুটতে ছুটতে এসে হাজির হল৷ তাদের একজন বলল, ‘মেয়েটা পালিয়েছে ক্যাপ্টেন৷ দড়িটা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে৷’
কথাটা শুনেই শার্ক বলে উঠল, ‘ওকে কিছুতেই পালাতে দেওয়া যাবে না৷ কয়েকজন সমুদ্রের পাড়ে যাও৷ যেখানে ওই ফাঁকা সিন্দুকের পাশ থেকে ওকে আমরা ধরে এনেছিলাম৷ আর অন্যরা আশেপাশে খোঁজ চালাও৷’
সুদীপ্তদের কাছে এবার স্পষ্ট হয়ে গেল ক্যাথলিন কীভাবে এদের হাতে ধরা পড়েছিল৷
শার্ক এরপর তার সঙ্গীদের আরও কিছু নির্দেশ দিতে যাচ্ছিল৷ কিন্তু ঠিক সেই সময় দূর থেকে একটা শব্দ ভেসে এল৷ প্রথমে একবার, তারপর আরও একবার৷ সুদীপ্তরা শব্দটা চিনতে পারল৷ বন্দুকের গুলির শব্দ!
সে শব্দ চিনতে পারল দ্বীপবাসীরাও৷ চাঞ্চল্য দেখা গেল তাদের চোখেমুখেও৷ একজন বলল, ‘জাহাজের লোকরা এদের খুঁজতে দ্বীপে নেমেছে৷ শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে পাড় ধরে আমাদের পুরোনো জাহাজটার দিকেই এগোচ্ছে!’
শার্ক বলল, ‘আমারও তাই মনে হয়৷ চলো লড়াই দিতে হবে৷ কেউ ভয় পাবে না৷ মনে রাখবে জলদস্যুর রক্ত আমাদের প্রত্যেকের শরীরে৷ আমাদের পূর্বপুরুষরা ধ্বংস করেছিল স্প্যানিশ আর্মাডাকে, নৌবহরকে৷ এদেরও কচুকাটা করব আমরা৷ টুকরো টুকরো করে এদের দেহগুলো সিল মাছকে খাওয়াব৷’
তার কথা শুনে একজন লোক বলল, ‘এ লোক দুটোর কী হবে?’
শার্ক হিংস্রভাবে বলল, ‘এ দুটোকে আপাতত সমুদ্রদানবের গুহায় ঢুকিয়ে দে৷ আমরা ফিরে আসার পর যদি এরা বেঁচে থাকে তবে দেখা যাবে৷’—এই বলে শার্ক কোমর থেকে তলোয়ার খুলে সঙ্গীদের নিয়ে ছুটল লড়াইয়ের জন্য৷ চারজন লোক শুধু রয়ে গেল৷ তারা মাস্তুলের গা থেকে সুদীপ্তদের দড়ি খুলে তাদের ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে চলল পুকুরের পাড় থেকে সামান্য ওপরে জলহীন যে অন্ধকার গুহামুখ আছে সেদিকে৷ তাদের সঙ্গে গুহাতে প্রবেশ করল তারা৷ গুহাটার দশ-পনেরো পা ভিতরে একটা লোহার দরজা বা গরাদ বসানো আছে৷ দ্বীপবাসীদের একজনের হাতে ধরা মশালের আলোতে সেই গরাদটাকে দেখে সেটা জাহাজ থেকে খুলে আনা লোহার গরাদ বলেই মনে হল৷ আবারও বন্দুকের শব্দ ভেসে এল সমুদ্রের পাড় থেকে৷ যারা সুদীপ্তদের ধরে এনেছে এরপর তারা আর দেরি করল না৷ সুদীপ্তদের ধাক্কা দিয়ে গরাদের ওপাশে ফেলে দিয়ে বাইরে থেকে ইস্পাতের পাত বসানো লোহার গরাদ বন্ধ করে ছুটল শার্ক ও তার সঙ্গীদের সাহায্য করার জন্য৷
৷৷ ৯৷৷
অন্ধকার গুহার মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল সুদীপ্ত আর হেরম্যান৷ বাইরে থেকে আরও বেশ কয়েকবার বন্দুকধ্বনি কানে এল৷ হেরম্যান বললেন, ‘ক্যাপ্টেন হ্যামাররা সম্ভবত বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করছেন আমাদের সংকেত দেবার জন্য৷ তবে একটু পর সত্যিই যুদ্ধ শুরু হবে৷’
সুদীপ্ত বলল, ‘হয়তো বন্দুক আছে বলে শেষ পর্যন্ত হ্যামাররা জিতলেন, কিন্তু আমাদের সন্ধান তাঁরা নাও পেতে পারেন৷’
হেরম্যান বললেন, ‘ঠিক তাই৷’—এ কথা বলে তিনি দরজার দিকে এগিয়ে দরজাটা খোলা যায় কি না তার চেষ্টা করলেন৷ কিন্তু ইস্পাতের পাত বসানো দরজাটা ভিতর থেকে খোলার কোনো উপায় নেই৷ সুদীপ্ত বলল, ‘আমরা এখন তবে কী করব?’
হেরম্যান বললেন, ‘চুপচাপ এখানে বসে থেকে কোনো লাভ নেই৷ অন্ধকার হাতড়ে চলো সামনের দিকে এগোই৷ দেখা যাক বাইরে বেরোবার কোনো সন্ধান মেলে কি না৷ তবে সাবধানে এগোতে হবে৷’
সুদীপ্ত বলল, ‘ওরা এই গুহাটাকে বলছিল ‘জলদানবের গুহা’৷—এমনও হতে পারে কোনো হিংস্র প্রাণী এ গুহাতে বাস করে৷’
হেরম্যান বললেন, ‘তা হতেই পারে৷ কিন্তু এখানে বসে থেকেই বা লাভ কী? মৃত্যু যদি আমাদের কপালে লেখা থাকে তবে সেই জলদানব এখানে এসেই আমাদের ওপর হামলা চালাতে পারে৷ ঝুঁকিটা আমাদের নিতেই হবে৷ যদি বাইরে যাবার কোনো উপায় মেলে৷’
হেরম্যানের কথা শুনে উঠে দাঁড়াল সুদীপ্ত৷ তারপর তারা দুজনে অন্ধকার হাতড়ে ধীরে ধীরে এগোল সামনের দিকে৷ কিছুটা এগোতেই গুহার নিশ্ছিদ্র অন্ধকারটা একটু যেন কেটে যেতে লাগল৷ আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে লাগল সামনেটা৷ যে গিরিশিরার ভিতর এই গুহাটা, তার মাথার ওপর লম্বাটে একটা ফাটল আছে তা দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকছে গুহাতে৷ এবার আর পথ চলতে অসুবিধা হল না তাদের৷ হেরম্যান চাপাস্বরে বললেন, ‘অন্য গুহার মতো এ গুহাটাও সম্ভবত এগিয়ে গিয়ে সমুদ্রতটে বা সমুদ্রতে গিয়ে নেমেছে৷’ তবে গুহার মেঝে সমুদ্রতল থেকে উঁচু হওয়াতে এখানে জল প্রবেশ করছে না৷ সন্তর্পণে এগোতে থাকল তারা৷ বেড়ে চলল রাত৷ বাইরে কী হচ্ছে তা তাদের জানা নেই৷ হয়তো বা এতক্ষণে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে৷ গুহাটা সোজা এগোলেও মাঝে মাঝে দু-পাশের দেওয়ালের গা থেকে ছোটো সুড়ঙ্গর মতো পথ বেরিয়ে গেছে৷ কিন্তু সুদীপ্তরা এগোতে লাগল মূল সুড়ঙ্গ ধরেই৷ কখনও কখনও সামান্য কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম তারপর আবার চলা৷ বেশ কয়েক ঘণ্টা চলার পর একটা সময় গুহাটা ক্রমশ চওড়া হতে লাগল৷ মাথার ওপরের ফাটলটাও এদিকটাতে বেশ বড়৷ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব কিছু৷ মৃদু আঁশটে গন্ধও যেন নাকে আসতে লাগল৷ হেরম্যান বললেন, ‘আমরা সম্ভবত সমুদ্রের কাছাকাছি এসে পড়েছি৷’ পাথুরে মাটিতে এখানে ছোট ছোট গর্ত আছে৷ তার থেকে সাবধানে পা বাঁচিয়ে সামনে চলল তারা৷ কিন্তু আর কিছুটা এগিয়েই হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তে হল তাদের৷ প্রায় ছাদ পর্যন্ত উঁচু একটা বড় পাথর তাদের পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাই দেখে সুদীপ্ত বলল, ‘এবার এগোব কীভাবে?’
হেরম্যান বললেন, ‘পাথরটা আর দেওয়ালের মাঝখানে একচিলতে ফাঁক দেখছি৷ চলো, কাছে গিয়ে দেখি৷ ওখান দিয়ে গলে ওপাশে যাওয়া যায় কি না?’ আঁশটে গন্ধটা বড্ড বেশি লাগছে৷ সম্ভবত পাথরটার ওপাশেই সমুদ্র৷ সুদীপ্তরা পা বাড়াল সেদিকে৷ কিন্তু কয়েক পা এগোতেই তাদের অবাক করে দিয়ে পাথরটা হঠাৎ নড়ে উঠল৷ তারপর ধীরে ধীরে পাক খেয়ে থেমে গেল৷ সুদীপ্তদের সামনে সেই পাথরের গা থেকে ছাদের দিকে মাথা তুলল একজন! একটা মাথা! আরে পাথর কোথায়? সুদীপ্ত আর হেরম্যান যাকে পাথরখণ্ড ভেবেছিল সেটা আসলে প্রায় ছোটখাটো হাতির মতো বিশাল সিন্ধুঘোটক! এতক্ষণ ঘাড় গুঁজে নিশ্চল হয়ে পড়েছিল৷ এখন সুদীপ্তদের উপস্থিতি টের পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে৷ তীব্র আঁশটে গন্ধটা প্রাণীটার দেহ থেকে বেরুচ্ছে৷ এই সেই দ্বীপবাসীদের—সমুদ্রদানব! চাঁদের আলো এসে পড়েছে তার থ্যাবড়ানো মুখে৷ কুতকুতে চোখে সে তাকিয়ে আছে সুদীপ্তদের দিকে৷ মুখের ভিতর থেকে দুদিকে নেমে আসা দাঁত দুটো অন্তত পাঁচ- ফুট করে লম্বা হবে৷ তলোয়ারের মতো ধবধবে সাদা দাঁত৷ সামনের দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বিশাল প্রাণীটা৷ থলথলে শরীরটা কাঁপছে৷ তার দিকে তাকিয়ে যেন সম্মোহিত ভাবে দাঁড়িয়ে রইল সুদীপ্তরা৷ দানবটার কাঁটার মতো গোঁফগুলো দুপাশে খাড়া হচ্ছে৷ মাথাটা একবার সে নামাল৷ তার দাঁত দুটো পাথুরে মাটিতে ধাক্কা খেয়ে ঠকঠক শব্দ তুলল৷ এটাই মনে হয় তার শত্রু বা শিকারকে আক্রমণ করার আগে তাল ঠোকা৷ ঠিক যেমন অনেক প্রাণী আক্রমণের আগে মাটিতে খুর বা শিং ঠোকে৷ কারণ এরপরই প্রাণীটা তার অতবড় শরীরটা নিয়ে অবিশ্বাস্য ভাবে একটা লাফ দিয়ে সুদীপ্তদের কাছে চলে এল৷ এবার হুঁশ ফিরল সুদীপ্তদের৷ পালাতে হবে তাদের৷ প্রাণীটা ওই ভয়ংকর দাঁত দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে তাদেরকে৷ অথবা পিষে মারবে তার শরীরের নীচে৷ তাদের প্রতি বিজাতীয় ঘৃণা ফুটে উঠেছে সমুদ্রদানবের চোখে৷ ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাবার চেষ্টা করল সুদীপ্তরা৷ কিন্তু কিছুটা এগোবার পরই হেরম্যান হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেলেন৷ তাঁর পা ঢুকে গেছে একটা গর্তের মধ্যে৷ সুদীপ্ত তাড়াতাড়ি টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগল হেরম্যানকে৷ কিন্তু গর্তের খাঁজে পা এমন আটকেছে যে কিছুতেই বেরোচ্ছে না৷ ওদিকে সমুদ্র দানবও লাফ দিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে৷ একসময় একদম কাছে চলে এল সে৷ আর একটা মাত্র লাফের ব্যবধান তার সুদীপ্তদের ঘাড়ে এসে পড়ার জন্য৷ পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করে হেরম্যান চিৎকার করে উঠলেন, ‘সুদীপ্ত তুমি পালাও৷ নইলে তুমিও বাঁচবে না৷’
সুদীপ্তও বলে উঠল, ‘না, কিছুতেই না৷ মরলে দুজনে একসঙ্গেই মরব৷’
হেরম্যান আবারও বলে উঠলেন, ‘না, কথা শোনো৷ পালাও, পালাও….’
কিন্তু পালাবার পরিবর্তে সুদীপ্ত ঝুঁকে পড়ে জাপটে ধরল হেরম্যানকে৷ মরলে একইসঙ্গে তারা মরবে৷
শেষ লাফটা দেবার আগে প্রাণীটা একটু ঝুঁকে পড়ে তারপর সোজা হয়ে দাঁড়াল৷ আর সামান্য কয়েকটা মুহূর্তমাত্র৷ সমুদ্র- দানব ঝাঁপিয়ে পড়বে! দানবীয় সিন্ধুঘোটক সুদীপ্তদের লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল৷ ঠিক সেই মুহূর্তেই সুদীপ্তর মাথার ওপর দিয়ে কী যেন একটা উড়ে গেল৷ সুদীপ্তরা দেখল ঝাঁপ দেবার পরিবর্তে দানবটার থলথলে দেহটা কাঁপতে শুরু করেছে৷ কয়েক মুহূর্ত মাত্র৷ তারপর টাল খেয়ে সিন্ধুঘোটকটা হেলে পড়ল দেওয়ালের গায়ে৷ চাঁদের আলোতে তার গলা থেকে রক্তর স্রোত নামতে থাকল৷ আর এরপরই কে যেন বলে উঠল, ‘ভয় পাবেন না৷ ও শেষ৷ ছ’ফুট লম্বা ‘হাত হারপুন’-টা পুরোটা বিঁধিয়ে দিতে পেরেছি ওর শরীরে৷’
সেই কণ্ঠস্বরের দিকে তাকিয়ে সুদীপ্তরা দেখল তাদের পিছনে কিছুটা তফাতে দাঁড়িয়ে আছে তিমি-শিকারি হারপুনবাজ সেই মরগ্যান স্মিথ বা হারপুন স্মিথ৷ আর ক্যাথলিন৷
সুদীপ্ত তাদের দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘তোমরা এখানে কীভাবে এলে?’
হারপুন স্মিথ বলল, ‘আপনাদের খুঁজতে সকালবেলা আমাকে দ্বীপে পাঠিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হ্যামার৷ সুড়ঙ্গপথে ঘুরতে ঘুরতে একটা সুড়ঙ্গপথ ধরে আমি পুকুরে পড়লাম৷ এখানকার সুড়ঙ্গগুলো একটা অন্য একটার সঙ্গে নানাভাবে সংযুক্ত৷ তারপর পুকুর থেকে পাড়ে উঠে একটা বাড়ির সামনে বাঁধা অবস্থায় মিস ক্যাথলিনকে মুক্ত করলাম৷ তারপর অন্য একটা সুড়ঙ্গে ঢুকে আপনাদের খুঁজতে খুঁজতে এখানে এলাম৷ ভাগ্যিস ঠিক সময় পৌঁছেছি৷ নইলে ভয়ংকর ঘটনা ঘটত!’
সুদীপ্তরা বুঝতে পারল তারা তবে এই হারপুন স্মিথকেই জল থেকে উঠে আসতে দেখেছিল৷ হারপুন স্মিথ এগিয়ে গেল দানবটার কাছে৷ সত্যি লোকটা সাহসী বটে! দানবীয় সিন্ধুঘোটকটা তখন স্থির হয়ে গেছে৷ একটু চেষ্টা করে স্মিথ একটা হ্যাঁচকা টানে সমুদ্রদানবের বুক থেকে হারপুনটা বের করে আনল৷ রক্ত এবার ফোয়ারার মতো বেরোতে থাকল সদ্য মৃত প্রাণীটার শরীর থেকে৷ কাজটা করে সুদীপ্ত- হেরম্যানের কাছে ফিরে এল সে৷ হেরম্যান এবার ধীরে ধীরে চেষ্টা করলেন তাঁর পা-টা বের করার৷ তাঁকে সাহায্য করল সুদীপ্ত আর হারপুন স্মিথ৷ অবশেষে একসময় গর্তের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল হেরম্যানের পা৷ উঠে দাঁড়ালেন হেরম্যান৷
একটু ধাতস্থ হবার পর তিনি স্মিথ আর ক্যাথলিনের কাছে জানতে চাইলেন, ‘এখান থেকে বাইরে বেরোবার রাস্তা তোমরা জানো? বাইরের খবর কি?’
ক্যাথলিন বলল, ‘হ্যাঁ, কিছুটা এগোলেই সমুদ্রতট৷ আমরা উঁকি দিয়ে দেখেছি৷ বাইরে কিছুক্ষণ আগে অব্দি গোলাগুলি চলছিল৷’
সুদীপ্ত বলল, ‘তবে আমরা সে দিকে এগোই?’
স্মিথ বলল, ‘ভোরের আলো ফুটলে আমরা পরিস্থিতি বুঝে বাইরে বেরোব৷ কিন্তু তার আগে মিস ক্যাথলিনের সঙ্গে আমাদের একটা সুড়ঙ্গে যেতে হবে৷’
সুদীপ্ত বলল, ‘কেন?’
সুদীপ্ত আর হেরম্যানকে অবাক করে দিয়ে ক্যাথলিন বলল, ‘একটা সিন্দুক বয়ে নিয়ে যেতে হবে সেখান থেকে৷ রাশি রাশি সোনার মোহর আছে তাতে৷ জলদস্যুদের গুপ্তধন৷ আপনারাও তার ভাগ পাবেন৷ ওই সম্পদের জন্যই দ্বীপবাসীরা বংশানুক্রমিক ভাবে এ দ্বীপে রয়ে গেছে৷’
কথাটা শুনে সুদীপ্তরা বিস্মিত হলেও হেরম্যান একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘গুপ্তধনের লোভ আমাদের নেই৷ বরং মৎস্যকন্যার ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের অনেক বেশি আগ্রহ৷ আমরা তাকে দূর থেকে দেখেছি৷ তার কোনো খবর জানো?’
ক্যাথলিন বলল, ‘সম্ভবত তার সাক্ষাৎ আমরা পাব৷ সেই তো আমাকে গুপ্তধনের খোঁজ দিল৷ সোনা বোঝাই বাক্সটা একা ঠেলে বার করতে পারছিলাম না৷ গুহা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আপনাদের খোঁজ করতে যাচ্ছি, এমন সময় দ্বীপবাসীদের হাতে বন্দি হলাম৷ তারা অবশ্য জানে না যে আমি তাদের সিন্দুকের সন্ধান পেয়েছি৷ পরে সব কথা হবে৷ এখন চলুন৷’
বিস্মিত সুদীপ্তরা আর কথা না বাড়িয়ে অনুসরণ করল ক্যাথলিনকে৷ দেওয়ালের গায়ের একটা ফাটলের সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে অন্য একটা সুড়ঙ্গে প্রবেশ করল তারা৷ এখানেও ছাদের দিকে অনেক ছিদ্র আছে৷ আবছা আলো ঢুকছে এখানেও৷ বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলার পর তারা পৌঁছে গেল প্রাকৃতিক ঘরের মতো জায়গাতে৷ সেখানে রয়েছে বেশ লম্বাটে ধরনের অতি প্রাচীন একটা সিন্দুক৷ হেরম্যান, ক্যাথলিনকে বললেন, ‘তুমি সিন্দুকটা খুলে দেখেছ?’
ক্যাথলিন হেসে প্রথমে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, দেখেছি৷’ তারপর ঘরের উল্টোদিকের একটা সুড়ঙ্গ দেখিয়ে বলল, ‘ওটা দিয়ে একটু এগোলেই বাইরে বেরোবার রাস্তা৷’
স্মিথ উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘চলুন তবে সিন্দুকটা ধরাধরি করে বেরোবার মুখে নিয়ে যাই৷ দিনের আলো ফুটলে পরিস্থিতি বুঝে বাইরে যাব৷’
সেই মতোই কাজ হল৷ সিন্দুকটা গুহামুখে টেনে নিয়ে গিয়ে আলো ফোটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সবাই৷
একসময় ভোরের আলো ফুটে উঠল৷ বাইরে কোলাহলের শব্দ শোনা গেল৷ জাহাজের লোকজনের গলার শব্দ৷ তা শুনে সুদীপ্তরা বাইরে বেরিয়ে আসতেই ক্যাপ্টেন হ্যামার দলবল সমেত ছুটে এলেন তাদের কাছে৷
৷৷ ১০৷৷
হেরম্যান সংক্ষেপে তাঁদের কথা ব্যক্ত করে জানতে চাইলেন, ‘দ্বীপবাসীদের কি হল? কাল রাতে লড়াই হয়েছিল?’
ক্যাপ্টেন বললেন, ‘হ্যাঁ, ওদিকে পুরোনো জাহাজটার কাছে ওরা আক্রমণ করতে এসেছিল আমাদের৷ দু-চারটে গুলির ঘায়ে আহত হতেই সবাই পালাল৷ সর্দারটাকে আমি প্রায় ধরে ফেলেছিলাম৷ কিন্তু অন্ধকারে হাত ফসকে পালাল৷’
একথা বলার পর ক্যাপ্টেন একটু উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, ‘কেন যে আপনারা মৎস্যকন্যার খোঁজে এলেন! আপনাদের জন্য আমি ঝামেলায় জড়ালাম৷ তিমি শিকার বন্ধ আছে৷ এবার তাড়াতাড়ি জাহাজে চলুন৷ শিকারের কাজ শুরু করব৷’
ক্যাথলিন বলল, ‘হ্যাঁ, চলুন৷ তবে গুহাতে একটা পুরোনো সিন্দুক আছে৷ সেটা জাহাজে নিয়ে যেতে হবে৷’
‘সিন্দুক! কি আছে তাতে?’ জানতে চাইলেন ক্যাপ্টেন৷
ক্যাথলিন হেসে জবাব দিল, ‘জাহাজে চলুন৷ তারপর অনেক কিছু জানতে পারবেন৷’
ক্যাপ্টেন হ্যামার আর কিছু জানতে চাইলেন না৷ সিন্দুকটা বার করে সমুদ্রতট দিয়ে এগিয়ে জলে নেমে সেটা নৌকায় তোলা হল৷ সেটাতে চড়ে বসল ক্যাথলিন, সুদীপ্ত আর হেরম্যান৷ অন্য নৌকাগুলোতে ক্যাপ্টেন আর তাঁর সঙ্গীরা৷ পেঙ্গুইনের দল একসঙ্গে ডেকে উঠল৷ সার বেঁধে ভাসমান বরফের ফাঁক বেয়ে নৌকাগুলো এগোল জাহাজের দিকে৷ চারপাশে জলের দিকে তাকাচ্ছে ক্যাথলিন৷ সে যেন কিছু দেখার চেষ্টা করছে৷ হেরম্যান দাঁড় টানতে টানতে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার মৎস্যকন্যার দেখা মিলবে কখন?’
ক্যাথলিন জবাব দিল, ‘সে যখন নৌকায় উঠে এল না, এখন হয়তো নির্দিষ্ট জায়গাতে আত্মগোপন করে আছে৷’
‘সেটা কোথায়?’ প্রশ্ন করল সুদীপ্ত৷ কিন্তু ক্যাথলিন জবাব দিল না৷
নৌকাগুলো জাহাজের গায়ে এসে ভিড়ল৷ সবাই উঠে পড়ল জাহাজে৷ সিন্দুকটাও ডেকে তোলা হল৷ ক্যাথলিন, ক্যাপ্টেন হ্যামারকে বলল, ‘সিন্দুকটা যেন কেউ না খোলে৷ আপনি আমাদের সঙ্গে নীচে চলুন৷’
ক্যাপ্টেন তার কথা শুনে বললেন, ‘আমি কিন্তু অনুমান করতে পারছি সিন্দুকে কি আছে৷’ হয়তো বা তাঁকে ব্যাপারটা বলে দিয়ে থাকতে পারে হারপুন স্মিথ৷ যাই হোক এরপর তিনি তাঁর সঙ্গীদের নির্দেশ দিলেন শিকারের কাজ শুরু করার জন্য৷ তারপর একজন নাবিককে সিন্দুক পাহারার দায়িত্ব দিয়ে সুদীপ্তদের সঙ্গে খোলে নামার জন্য এগিয়ে এলেন৷
সবাইকে নিয়ে নিজের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল ক্যাথলিন৷ দরজাটা ধাক্কা দিয়ে ভিতর থেকে সেটা বন্ধ দেখে হাসি ফুটে উঠল ক্যাথলিনের মুখে৷ সে এবার বলল, ‘মিস মার্গারেট৷ দরজা খুলুন৷ কোনো ভয় নেই৷ আমি এসেছি৷ দরজা খুলুন৷’
কয়েক মুহূর্তর মধ্যে দরজা খুলে গেল৷ দরজা খুললেন অপরূপ সুন্দরী এক প্রৌঢ়া৷ একরাশ দীর্ঘ সোনালি চুল তাঁর৷ নীল চোখ, গায়ের রং দুধের মতো৷ বুক থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত পোশাক তাঁর পরনে৷ দরজা খুলে পা ঘষে ঘষে বিছানাতে গিয়ে বসলেন তিনি৷ সুদীপ্তরা কেবিনে প্রবেশ করল৷ অবাক দৃষ্টিতে তারা চেয়ে রইল ভদ্রমহিলার দিকে৷ ক্যাথলিন হেসে তাঁর উদ্দেশে বলল, ‘আপনি এবার আপনার কথা বলুন এদেরকে৷’
ভদ্রমহিলা মৃদু হাসলেন৷ তারপর বললেন, ‘আমি মার্গারেট হক৷ ইতালীয় সমুদ্রবিজ্ঞানী৷ কুড়ি বছর আগে আমি এমনই এক তিমি-শিকারি জাহাজে এসেছিলাম এ জায়গার বরফ সমুদ্র দেখার জন্য৷ আমাকে ওই জাহাজ দ্বীপে ফেলে রেখে পালায়৷ দ্বীপবাসীরা আমাকে ধরে মৎস্যকন্যা বানিয়ে দিল৷ হাতের আঙুলগুলো আর হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত অপারেশন করে জুড়ে দিল৷ আমাকে পরিয়ে দিল মাটিতে পড়ে থাকা কোমর থেকে পা পর্যন্ত নকল লেজসহ খোলসটা৷ এটা ওদের প্রাচীন নিষ্ঠুর প্রথা৷ আমি রয়ে গেলাম এখানে৷ যে জাহাজের কাছেই আমি আমার কথা বলতে এসেছি, সে জাহাজের নাবিকরাই আমার কথা না শুনে, আমাকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়েছে বা মারতে উদ্যত হয়েছে৷ কাজেই এখানে রয়ে যেতে হয়েছে আমাকে৷’ কথা থামালেন মার্গারেট৷
ক্যাথলিন এরপর বলল, ‘দু-দিন আগে রাতের বেলাতে উনি একই কারণে জাহাজের কাছে এসেছিলেন৷ কিন্তু ডেকের পাহারাদার ওনাকে দেখে ছুরি ছুড়ে মারল৷ ঘটনাচক্রে উনি প্রাণ বাঁচাতে ওই খোলা পোর্ট হোল দিয়ে আমার এই কেবিনে ঢুকে পড়লেন৷ আমিও প্রথমে ওনাকে দেখে বেশ ভয় পেয়ে গেছিলাম৷ তারপর সারারাত ধরে ওর কাহিনি শুনলাম৷ গুপ্তধনের কথাও শুনলাম৷ আমি ভাবলাম আগে সিন্দুকটা উদ্ধার করে আনি তারপর ব্যাপারটা আপনাদের জানাব, ওনাকে জনসমক্ষে আনব৷ তাই ওকে এ ঘরের সিন্দুকটাতে ভরে আপনাদের সাহায্যে দ্বীপে নিয়ে গেলাম৷ আর তারপরের ঘটনা তো আপনাদের জানা৷ দূর থেকে দ্বীপবাসীদের আসতে দেখে জলে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে ছিলেন উনি৷ আমি ধরা পড়ে গেলাম৷’
মার্গারেট বললেন, ‘গত রাতে যখন লড়াই চলছিল তখন সাঁতরে এসে ওই পোর্টহোল দিয়েই এ কেবিনে ঢুকে আসি৷ ক্যাথলিন পোর্টহোলটা খুলে রেখে গেছিল আমার জন্য৷
হেরম্যান এগিয়ে গিয়ে ঘরের কোনা থেকে কুড়িয়ে নিলেন মৎস্যকন্যার খোলসটা৷ সিল মাছের চামড়ার ওপর মাছের চকচকে আঁশ বসিয়ে জিনিসটা বানানো৷ সুদীপ্ত আর হেরম্যান জিনিসটা নেড়েচেড়ে আবার রেখে দিল৷
ক্যাথলিন এরপর বলল, ‘এবার সবাই ওপরে চলুন৷ তবে মিস মার্গারেটকে সাহায্য করতে হবে৷ পায়ের পাতা জোড়া হওয়ায় উনি হাঁটতে পারেন না৷’
হেরম্যান, মার্গারেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আশা করি অপারেশনের মাধ্যমে আপনি হাত-পায়ের আগের অবস্থা ফিরে পাবেন৷’ তার কথা শুনে মার্গারেট হাসলেন৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই মার্গারেটকে নিয়ে ওপরে উঠে এল সবাই৷
তিমি শিকারের প্রস্তুতি তখন শুরু হয়ে গেছে৷ নাবিকরা যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ সিন্দুকটাকে ঘিরে দাঁড়াল সবাই৷ সিন্দুক পাহারাদার লোকটা নিজের কাজে চলে যাবার পর ক্যাথলিন, মার্গারেটকে বলল, ‘নিন, ডালাটা খুলুন৷ এ সিন্দুক তো আসলে এখন আপনারই৷’
মার্গারেট বললেন শুধু আমার নয় তোমারও৷ তুমিই বরং ডালাটা খোলো৷
ক্যাথলিন হেসে ডালাটা খুলে দিল৷ উপচে পড়া প্রাচীন স্বর্ণমুদ্রাগুলো ঝলসে উঠল সূর্যের আলোতে৷ বেশ কয়েক মুহূর্ত সেই স্বর্ণমুদ্রার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল সুদীপ্ত-হেরম্যান আর ক্যাপ্টেন৷ এ যে সাত রাজার ধন! প্রাচীন জলদস্যুদের গুপ্তধন!
ক্যাথলিন এরপর বলল, ‘বাক্সটা এবার বন্ধ করি৷ চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে৷ খোলে নামাতে হবে সিন্দুকটা৷’
এ কথা বলে ঝুঁকে পড়ে সে সিন্দুকের ডালাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল কিন্তু ঠিক সেই সময় একটা অকল্পনীয় ঘটনা ঘটল৷ হঠাৎ সিন্দুকের মোহরগুলো চারপাশে ছিটকে উঠল, আর মোহরের নিচে সিন্দুকের ভিতর থেকে উঠে দাঁড়াল দ্বীপবাসীদের দলপতি সেই ক্যাপ্টেন শার্ক! সিন্দুক থেকে লাফিয়ে নেমে মার্গারেটকে দেখতে পেয়ে প্রচণ্ড ঘৃণা, আক্রোশে সে চেপে ধরল মার্গারেটের গলা! শার্কের হাত থেকে মার্গারেটকে মুক্ত করার জন্য শার্কের মুখে ঘুসি চালিয়ে দিল সুদীপ্ত৷ মাটিতে ছিটকে পড়ল লোকটা৷ ক্যাপ্টেন হ্যামার এগোলেন শার্কের দিকে তাকে কব্জা করার জন্য৷ এতগুলো লোকের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয় বুঝে শার্ক স্প্রিং-এর মতো লাফিয়ে উঠে ডেকের কোনাকুনিভাবে ছুটল রেলিং টপকে জলে ঝাঁপ দেবার জন্য৷ ঠিক সেদিকেই যেখানে মাটিতে হারপুনের দড়ি পড়ে আছে৷ তবে সে রেলিং পর্যন্ত পৌঁছবার আগেই হারপুন চালক একটা তিমিকে লক্ষ্য করে হারপুন চালিয়ে দিল৷ নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল সে৷ পিছনে কি ঘটছে তা সে খেয়াল করেনি৷ বিদ্যুৎগতিতে ছুটে চলা দড়িতে শার্কের পা জড়িয়ে গেল৷ মুহূর্তর মধ্যে উল্কার গতিতে সে ডেক ছেড়ে উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল জাহাজের থেকে কিছুটা তফাতে পাথুরে বরফের ওপর৷ তারপর শার্কের দেহটা ডুবে গেল বরফ জলের গভীরে৷ সুদীপ্তরা বুঝতে পারল সে আর উঠবে না৷ সুদীপ্তরা কেউই শার্কের মৃত্যু চায়নি৷ কিন্তু ভাগ্যর পরিহাসে নিজের কৃতকর্মের সাজা পেল দ্বীপবাসীদের দলপতি৷
এ ঘটনার ফলে কিছুক্ষণের জন্য মৃদু গোলোযোগ সৃষ্টি হল ডেকে৷ মোহরগুলো আর মার্গারেটকে দেখে বেশ বিস্মিত নাবিকরা৷ ক্যাপ্টেন কড়া ধমকে তাদের কাজে পাঠালেন৷ তারা আবার প্রস্তুত হল তিমি শিকারের জন্য৷ মোহরগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সিন্দুকে রেখে ডালা বন্ধ করা হয়৷ সুদীপ্তরা এরপর সিন্দুকটা ওঠাতে যাচ্ছিল নীচে ক্যাথলিনের ঘরে পৌঁছে দেবার জন্য৷ ক্যাপ্টেনও আপাতত তার নিজের কাজে ফিরতে যাচ্ছিলেন৷ ঠিক সেই সময় মার্গারেট হঠাৎ ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘এই সিন্দুকের মোহরের তিনভাগের একভাগ আমি আপনাকে দিতে পারি যদি আপনি আমার একটা শর্ত মানেন৷ এই পরিমাণ সম্পদ কিন্তু আপনি সারা জীবন রোজগার করতে পারতেন না৷’
কথাটা শুনে ক্যাপ্টেন হ্যামার ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দেবেন? কী শর্ত?’
মার্গারেট বললেন, ‘আপনাকে কথা দিতে হবে তিমি শিকার আপনি ছেড়ে দেবেন৷ অনেকদিন একসঙ্গে আমি কয়েক মুহূর্ত মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থেকে হ্যামার বললেন, ‘কাজটা আমি করতাম পেটের দায়ে৷ এ কাজ আর করব না৷’
মার্গারেটকে এ কথা বলে তিনি নাবিকদের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠলেন, ‘হারপুন থামাও৷ আমরা ফিরে যাব৷’ কথাটা শোনামাত্রই ক্যাথলিন আনন্দে জড়িয়ে ধরল মার্গারেটকে৷ মার্গারেট এরপর সুদীপ্ত আর হেরম্যানের দিকে তাকিয়ে তাদের গুপ্তধনের অংশ দেবার ব্যাপারে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু ব্যাপারটা অনুমান করে তার আগেই হেরম্যান বললেন, ‘আমরা গুপ্তধন নেব না৷ তবে আপনার মৎস্যকন্যার পোশাকটা স্মৃতি হিসাবে সঙ্গে নিতে চাই৷’
মার্গারেট হেসে বললেন, ‘আচ্ছা ওটা আপনারাই নেবেন৷’
মুখ ফিরিয়ে বরফ জল কেটে শেষবারের মতো ফেরার পথ ধরল তিমি শিকারি জাহাজ৷
__