ম্যাজিশিয়ানের পেন

ম্যাজিশিয়ানের পেন

বস্তুটার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলেন সুশান্তবাবু। রিডিং টেবলে ওপর খোলা ডায়েরির মাঝে নিশ্চিন্তে শুয়ে রয়েছে ইঞ্চি চারেকের জিনিসটা। মিশমিশে কালো শরীর জুড়ে সূক্ষ্ম সোনালি কারুকাজ। মাথার ওপর একটা ঝকঝকে সবুজ পাথর বসানো। ওটার মসৃণ গায়ে রিডিং লাইট পড়ে পিছলে যাচ্ছে। ডায়েরির পাতায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছে সোনালি রং। যেন একটা নিজস্ব আবর্ত তৈরি করছে। আর তাতে জিনিসটা পরম সুরক্ষিত!

এমন একটা ফাউন্টেন পেনের বড় স্বাদ ছিল সুশান্তবাবুর। ছেলেবেলায় পাইলট ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতে দেখেছেন বাবাকে। গাঢ় নীল রংয়ের। তাঁর বাবা খুব যত্নে রাখতেন পেনটা। মোটেও হাতছাড়া করতেন না। অফিস থেকে ফিরে ড্রয়ারে তুলে রাখতেন। সকালে অফিস যাওয়ার আগে তাঁর বাবা যখন স্নানে যেতেন, সুশান্তবাবু চুপিসাড়ে বের করতেন ফাউন্টেন পেনটা। একদিন ধরা পড়ে গিয়েছিলেন। শুধু বকুনি নয়, মারও জুটেছিল। ভয়ে আর কোনওদিন হাত দেননি। ভেবেছিলেন, জন্মদিনে অথবা কোনও পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে বাবার কাছে চাইবেন ওইরকম একটা ফাউন্টেন পেন। ততদিনে পেনের জগতটা পাল্টে গিয়েছিল। ফাউন্টেনের বদলে বল পেন ঢুকে পড়েছিল বাজারে। কালি বদল বা টিউব লিক করার ঝামেলা নেই। নিত্যনতুন বল পেনের বাহারে একসময় ফাউন্টেন পেনের প্রতি মোহটাই হারিয়ে ফেলেছিলেন সুশান্তবাবু।

ডানহাতের তিন আঙুলে পেনটা তুলে নিলেন সুশান্তবাবু। খুলে ফেললেন ক্যাপটা। পেনটা আবরণ মুক্ত হতেই যেন আলো জ্বলে উঠল পড়ার টেবলটাকে ঘিরে। সোনালি রংয়ের নিবটা ঝলমল করছে। গোল্ড প্লেটের নিব! এইরকম পেন আজকাল বড় একটা দেখা যায় না। তিনি শুনেছেন, খুব দামী ফাউন্টেন পেনের নিব গোল্ড প্লেট দিয়ে তৈরি হত। চোখের সামনে তুলে নিবটা মনযোগ দিয়ে পরীক্ষা করলেন। কত দাম হবে, কে জানে! পেনটার নিবের গায়ে লেখা, ‘মঁ ব্লাঁ। মেড ইন জার্মানি’! তলায় ছোট্ট অক্ষরে, ১৯০৫! তার মানে পেনটার বয়স ১১০ বছরেরও বেশি!

মনে মনে শিউরে উঠলেন সুশান্তবাবু। অজান্তে কেঁপে উঠল ডান হাতটা। কত লোকের হাত ঘুরেছ এই পেনটা, কে জানে! অ্যান্টিক পিস! তবু ফাউন্টেন পেনটা এখনও নিটোল, দাগহীন। নিবের বাঁদিকটা সামান্য ক্ষয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও ক্ষতি হয়নি।

পাঁচশো বছর আগে পেনের ব্যবহার শুরু। মূলত ছবি আঁকার জন্য ব্যবহার হত। আধুনিক পেনের জন্ম প্রায় দুশো বছর আগে। রোমানিয়ার পেত্রাক পোয়েনারুর হাত ধরে। এসব ইতিহাস সুশান্তবাবু জানা। জার্মান কোম্পানি মঁ ব্লাঁ এর নামও শুনেছেন। তাদের লিমিটেড এডিশন পেনের দাম বেশ চড়া। চাহিদাও দারুণ। পার্কার, ল্যামি, পাইলট পেনের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রবলভাবে রয়েছে মঁ ব্লাঁ।

শেষ কবে এই পেন দিয়ে লেখা হয়েছে, কে জানে! নিয়মিত ব্যবহার করা হলে কালির শুকনো দাগ থাকত নিবে। তা নেই। পেনে কালি নাও থাকতে পারে। থাকলেও এতদিনে শুকিয়ে গেছে। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলের মাঝে পেনটাকে আলতো ধরে ডায়েরিতে লিখলেন, সুশান্ত চক্রবর্তী। জার্মান কলম দিয়ে ঝরঝর করে শব্দ ঝরে পড়ল ডায়েরিতে। আশ্চর্য হয়ে গেলেন সুশান্তবাবু। এত মসৃন লেখা পড়ে এখনও! তাঁর মনে হল, গতকালও এই পেনে লেখা হয়েছে!

সুশান্তবাবু একা মানুষ। বিয়েশাদি করেননি। সাতকূলে কেউ নেই। সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে প্রথম জীবনে। পরে একটা বেসরকারি ব্যাঙ্কের সিকিউরিটি ইনচার্জ ছিলেন। অবসর নিয়েছেন বছর দুয়েক। প্রতি মানুষের জীবনের কিছু না কিছু শখ থাকে। সুশান্তবাবুর শখ ডায়েরি লেখা। অবসর নেওয়ার পর রোজ রাতে কয়েক পাতা লেখেন। যদিও তাঁর নিস্তরঙ্গ জীবনে বিশেষ কিছু লেখার নেই। নিজের অভিজ্ঞতা, আশপাশের মানুষ, তাদের ব্যবহার, কোনও ঘটনা, হিজিবিজি যা মনে হয়, তাই লেখেন।

মঁ ব্লাঁ ফাউন্টেন পেনটা হাতে নিয়ে পরম যত্নে লিখলেন, ৩ মার্চ। কিছুক্ষণ লেখালিখি করে শুয়ে পড়লেন সুশান্তবাবু।

সূর্য ওঠার আগে বিছানা ছাড়েন সুশান্তবাবু। আধঘণ্টা ফ্রিহ্যান্ড করে দিন শুরু করেন। এককাপ চা আর সকালের কাগজ নিয়ে বসেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন প্রতিটা খবর। বেলা বাড়লে পাড়ার ক্লাবে গিয়ে খানিক আড্ডা দেন।

সুশান্তবাবুর এক্সারসাইজ শেষ হতেই ডোরবেল বেজে উঠল। এত সকালে কে এল জ্বালাতে! বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে দেখলেন, শিবু। ছেলেটা তাঁর বাড়িতে দীর্ঘদিন কাগজ দেয়। তিনি চারতলা অ্যাপার্টমেন্টের দোতলায় থাকেন। ভোরবেলায় দোতলার তাঁর ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে ছুঁড়ে দিয়ে যায় কাগজ। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা শিবুর নিয়মের কোনও হেরফের হয় না। মাসে একটা দিনই তার সঙ্গে দেখা হয় সুশান্তবাবুর। সে মাসকাবারির টাকাটা নিতে এসেছে।

সুশান্তবাবু দরজা খুলতেই যেন থতমত খেয়ে গেছে শিবু। তার চোখেমুখে বিস্ময় লক্ষ্য করলেন সুশান্তবাবু। অবাক গলায় সে বলল, ‘বাবু আছেন? একটু ডেকে দেবেন?’

সুশান্তবাবু বিরক্ত হলেন। ছেলেছোকড়াদের ফক্করবাজি একেবারে বরদাস্ত করেন না। এদের মাথায় তুললেই বিপদ। লঘু-গুরু জ্ঞান থাকে না। শিবুর রসিকতা শুনে সাতসকালেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল তাঁর। বিড়বিড় করতে করতে ঢুকে গেলেন ঘরে। মাস-কাগজের টাকাটা গুনে নিয়ে এসে তুলে দিলেন শিবুর হাতে।

হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল শিবু। কিন্তু তার মুখের বিপন্নতা কাটেনি। সে আমতা আমতা করে বলল, ‘বাবুর কি শরীর খারাপ? আপনাকে তো চিনলাম না? বাবুর আত্মীয় হন?’

বিরক্ত হয়ে সশব্দে দরজাটা শিবুর মুখের ওপরেই বন্ধ করে দিলেন সুশান্তবাবু।

সকালেই মনটা খিঁচড়ে গেছে সুশান্তবাবুর। চায়ের জল বসিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। বেসিনের কল খুলে চোখেমুখে জল দিলেন। হ্যাঙ্গিং প্যালেট থেকে টাওয়ালটা নিয়েই নিশ্চল হয়ে গেলেন সুশান্তবাবু।

নিশ্চলভাবটা কাটতেই বুঝতে পারলেন কপালের দু’কোণ দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। মেরুদণ্ড বেয়ে নামছে বরফস্রোত। ঘটনার অভিঘাতে শরীর দুলে উঠল তাঁর। আয়নার ওপর ঝুঁকে পড়লেন সুশান্তবাবু।

তিনি, তিনি কোথায়? সেই বুড়োটে মুখটা? চুল পাতলা হয়ে টাক বেরিয়ে পড়া লোকটা? অসংখ্য ভাঁজ পড়া কপালটা কোথায়? সাদা দাড়িতে ভরে থাকা মুখটা? তুবড়ে যাওয়া গাল? গলকম্বলের মতো থুতনির তলায় ঝুলতে থাকা চর্বির থলিটা? কোথায় গেল তাঁর একান্ত চেনা শরীরটা? ছেলেবেলা থেকে যাকে বইতে বইতে জীবনের প্রান্তিক স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলেছেন!

আয়নার প্রতিবিম্বে বছর তিরিশের এক যুবক! পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। কানের লতি ছাড়িয়েছে মোটা জুলপি। পরিষ্কার কামানো মুখ। ধারালো, ঘন একজোড়া ভ্রু। খাড়া নাক। চৌকো, কাটা থুতনি। উল্টোদিকে যাঁকে দেখছেন, তাকে চেনেন না সুশান্তবাবু। কখনও দেখেননি। এ মুখ কোনও বাঙালির নয়! কোনও ভারতীয় হতে পারে না! এ এক বিদেশি! কিন্তু, কিন্তু এ কে?

সুশান্তবাবু একা মানুষ। ফ্ল্যাটটা বিশেষ ঝাড়পোঁছ করা হয় না। জলের ছিটে লেগে-লেগে ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে বেসিন মিরর। কল খুলে দু’তালুতে জল ভরে বারবার ধুতে লাগলেন আয়নাটা।

জলে ধুয়ে যাচ্ছে আয়না। মুছে যাচ্ছে প্রতিবিম্ব। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আবার ফুটে উঠছে সেই অচেনা মুখ! একজোড়া শান্ত, তীক্ষ্ণ, গভীর চোখ। ওই চোখ দুটো নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে রয়েছে তাঁর দিকে। গভীর মনযোগ দিয়ে দেখছে। সুশান্তবাবুর রক্তমাংসের শরীর ভেদ করে পড়ে ফেলতে চাইছে তাঁর মন!

সুশান্তবাবুর মনে পড়ে গেল, একটু আগে শিবু তাঁকে দেখে অবাক হয়েছিল। প্রচণ্ড ভয় পেলেন তিনি। একদলা বাতাস আটকে গেল তাঁর গলায়। দমবন্ধ হয়ে আসছে। এই অবস্থাতেই ভাঙাভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কে তুমি, কে?’ নিজের গলার আওয়াজটাও অচেনা লাগল সুশান্তবাবুর। এমন গম্ভীর, কর্কশ গলা তাঁর নয়। দুর্বোধ্য কিছু শব্দ বেরিয়ে এল সুশান্তবাবুর গলা থেকে। কোন ভাষায় কথা বললেন তিনি?

এক ছুটে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন সুশান্তবাবু। এই ফ্ল্যাটের প্রতিটা কোণ তিনি চেনেন। সমস্ত ফার্নিচার তাঁর কেনা। ড্রইংরুম থেকে, কিচেন, বেডরুম ছুটে বেড়ালেন সুশান্তবাবু। ওই তো গ্যাসের ওপর বসানো রয়েছে সসপ্যানটা। গরম জল বাস্প ওড়াচ্ছে। ওই তো ডাইনিং টেবলের ওপর রাখা সকালের কাগজটা। যেটা শিবু একটু আগে ছুঁড়ে দিয়ে গিয়েছিল ব্যালকনিতে। তিনি তুলে এনে রেখেছেন। হালকা সবুজ রংয়ের পর্দা ঝুলছে জানলায়। বেডরুমের আলুথালু হয়ে থাকা বিছানার চাদর, বইয়ের র‍্যাক, ধুলোপড়া টিভি টেবল। সব ঠিক আছে। শুধু তিনি পাল্টে গেছেন! স্বপ্ন দেখছেন না তো?

সুশান্তবাবুর হাঁটুতে আর্থারাইটিস আছে। খুঁড়িয়ে হাঁটেন। ইদানীং ব্যথাটা তাঁকে প্রায়ই কাবু করে রাখে। অথচ, এখন কোনও ব্যথাই নেই! বেডরুমের আয়নায় দাঁড়িয়ে আবার নিজেকে খুঁটিয়ে দেখলেন ভীত, সন্ত্রস্ত সুশান্তবাবু। সেই মুখ! এখন যেন ওই মুখে ঘুরছে মৃদু হাসি। ডানহাতটা তুলে মুখে বোলালেন তিনি। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, শুধু মুখ নয়, হাতটা তাঁর অচেনা। জড়সড় চামড়ার ওপর কাঁচা-সাদা লোম ছিল তাঁর হাতে। নির্লোম বলিষ্ঠ এই দুটোহাত তাঁর নয়! ফতুয়া খুলে ফেলে পুরো শরীরটা দেখলেন সুশান্তবাবু। না, এ শরীর তাঁর হতে পারে না! সম্পূর্ণ অচেনা এক খোলসের মধ্যে বন্দি রয়ে পড়েছেন তিনি। ভাবনাটুকু শুধু তাঁর। সত্যিই কি তাই? তাঁর ভাবনা, তাঁর চিন্তা, উপলব্ধিও থিতিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কেউ একজন ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে সুশান্ত চক্রবর্তীর!

প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছে সুশান্তবাবুর। কান পাতলে শুনতে পাচ্ছেন অন্যরকম সুর ও লয়ে তোলা এক অচেনা শরীরের হার্টবিট, ধমনী দিয়ে বয়ে যাওয়ার রক্তস্রোত। বেডরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আতঙ্ক নিয়ে লক্ষ্য করতে থাকলেন শরীরটাকে। ভয়টা শুধুই তাঁর মনে। শরীরে তার ছাপ নেই। ধরা গলায় ফিসফিস করে প্রশ্ন করলেন আবার, ‘কে, কে তুমি?’ এবারও অচেনা শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে।

বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়লেন। কান্না পাচ্ছে তাঁর। সুশান্তবাবু নির্বিবাদী লোক। সাতেপাঁচে থাকেন না। তাঁকেই কিনা অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হল! শিবু তাঁর পাল্টে যাওয়া চেহারা দেখে চমকে গেছিল। অ্যাপার্টমেন্টের লোকজন, বন্ধুরা জানলে কী হবে? এই ফ্ল্যাটে চিরকাল বন্দি থাকতে পারবেন না। বেরোতে তাঁকে হবেই। মছলন্দপুর জায়গাটা এখনও মফস্বল। একজন বিদেশিকে দেখলে তাঁরা কী বলবেন? চেনা কাউকে দেখলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবেন?

গতকাল রাতেও চেহারার কোনও বদল হয়নি। যদি হত, ঠিক বুঝতে পারতেন। শুতে যাওয়ার আগে ব্রাশ করা তাঁর অনেকদিনের অভ্যেস। বেসিন মিররের সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করার সময় নিজের পুরোনো শরীরটাই দেখেছিলেন।

রাতারাতি কী করে ঘটল এমন? সব গুলিয়ে যাচ্ছে সুশান্তবাবুর।

মাথা ঠান্ডা করে ভাবার চেষ্টা করলেন, গতকাল কী কী করেছেন। রোজ যা করেন, গতকালও তাই করেছেন। সকালে ক্লাবে গিয়ে আড্ডা মেরেছেন। দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছেন। সন্ধেবেলায় গেছিলেন চন্দনের বাড়িতে। চন্দন পুরোনো বন্ধু। বিভূতি, সুজন, অবিনাশ, সুমঙ্গল, পরাশররাও তাঁরই মতো আসে চন্দনের বাড়িতে। ঘণ্টাচারেক আড্ডা চলে। কাল তিনি আড্ডা দেননি। বন্ধুরা আসার আগেই বেরিয়ে এসেছিলেন। কই, আর তো কিছু ঘটেনি। বাড়ি ফিরে ডিনার করেছিলেন। তারপর, দীর্ঘদিনের অভ্যেস ডায়েরি লেখা। মঁ ব্লাঁ ফাউন্টেন পেনটা দিয়ে কয়েকপাতা লিখে শুয়ে পড়েছিলেন।

‘মঁ ব্লাঁ ফাউন্টেন পেন…!’ কে যেন বিড়বিড় করে সুশান্তবাবুর কানের কাছে বলে উঠল! চমকে তাকালেন আশেপাশে। কাউকে দেখতে পেলেন না। বাইরে থেকে নয়, শব্দগুলো এসেছে তাঁর ভেতর থেকে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলেন, কেউ তাঁকে টেনে নিয়ে চলেছে ড্রইংরুমের দিকে। সুশান্তবাবুর মজবুত শরীর। সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পরও নিয়মিত ফ্রিহ্যান্ড করেন। তবু তিনি আটকাতে পারছেন না সেই অদৃশ্য শক্তিকে!

যন্ত্রচালিতের মতো রিডিং টেবলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ডেস্কের ওপর ডায়েরিটা রাখা। একপাশে মঁ ব্লাঁ ফাউন্টেন পেনটা। সুশান্তবাবু বসলেন চেয়ারে। ডায়েরিটা খুললেন। শরীরে বশে না থাকলেও মনের ওপর এখনও ক্ষীণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তাঁর। সভয়ে দেখলেন, গতরাতে যা লিখেছিলেন, তা মুছে গিয়েছে! পেন নয়, যেন পেন্সিল দিয়ে লিখেছিলেন তিনি। ইরেজার দিয়ে কেউ মুছে দিয়েছে! ভিতরের শক্তিটা আবার প্রবল উঠল। তার ইচ্ছেয় পেনটা তুলে নিলেন সুশান্তবাবু। লিখতে শুরু করলেন। ডানহাতে নয়, বাঁহাতে!

‘ইখ্ বেন জোহান হার্নান, আইন ডয়েশর ম্যাজিয়ের’!

সুশান্তবাবুকে যে বাঁহাত দিয়ে লেখাচ্ছে, তার ভাষা এবার বুঝতে পারলেন। জার্মান ভাষায় তাঁর বাঁহাত লিখেছে, ‘আমি জোহান হার্নান, এক জার্মান জাদুকর!’

সুশান্তবাবুর বাঁহাত লিখে চলেছে…

‘১৮৮০-তে জার্মানির কোলনে জন্ম। ছেলেবেলা থেকেই জাদু খেলার প্রতি মোহ ছিল। একটু বড় হতে ইতালি পালিয়ে যাই, বিখ্যাত জাদুকর আলেসান্দ্রো মানেত্তির কাছে। ‘দ্য আলেসান্দ্রো শো’ তখন বিশ্ববিখ্যাত। ওঁর কাছেই পড়ে থাকি পাঁচবছর। আরও অনেক শিষ্য ছিল। ওখানেই আলাপ ব্রাজিলের পেন্টোর সঙ্গে। বন্ধুত্ব হয়। আলেসান্দ্রো সহকারী হিসেবে ওঁর ম্যাজিক শো-তে কাজ শুরু করি আমরা। সেই সময় ইউরোপে হইচই ফেলে দিয়েছিল আলেসান্দ্রোর অদৃশ্য করার খেলা। দর্শক আসনে বসে থাকা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে ভ্যানিশ করে দিতেন। মঞ্চের পিছন থেকে উঠে আসত মেয়েটি। অন্যান্য ট্রিকসের সঙ্গে এই খেলাও শিখে নিয়েছিলাম। আলেসান্দ্রোর বয়স হচ্ছিল। শরীর দিচ্ছিল না। আমাকে উত্তরসূরী বলা হচ্ছিল আলেসান্দ্রোর। পেন্টোও ভালো জাদুকর। কিন্তু হিপ্নোটিজমটা আমার মতো পারত না। আলেসান্দ্রো ম্যাজিক টিমে অনেক লোক কাজ করত। তাঁর অবসরের সিদ্ধান্তে শো ম্যানেজার এবং প্রোমোটার দু’জনেই আপত্তি করল। আলেসান্দ্রো শুনলেন না। ঠিক করলেন, একটা শোতে আমার আর পেন্টোর মধ্যে একজনকে বেছে নেবেন তাঁর উত্তরসূরী হিসেবে। আমি জানতাম, আমাকে হারানো পেন্টোর পক্ষে সহজ নয়। সেই শোতে আলেসান্দ্রোর বদলে আমি আর পেন্টো দেখালাম ভ্যানিশের খেলা। পেন্টো হেরে গেল আমার কাছে। আলেসান্দ্রো আমাকেই তাঁর উত্তরসূরী বাছলেন। আর একটা খেলা খুব বিখ্যাত হয়েছিল তখন। আলেসান্দ্রোকে চোখ বেঁধে দেওয়া হত। দর্শকাসনে বসে কেউ পেন দিয়ে কিছু লিখলে হুবহু বলে দিতে পারতেন আলেসান্দ্রো। এই ট্রিকসকে বলা হত, পেন ম্যাজিক। আলেসান্দ্রোর প্রথম স্ত্রী মারিয়ম ওই পেনটা উপহার দিয়েছিল। পরে তিনি মারা যান। লোকে বলত, ওই পেনে মারিয়মের আত্মা আছে। দর্শকরা কী লিখছে, সেই নাকি আলেসান্দ্রোকে বলে দিত কানে কানে! জাদু ছড়ি আর পেনটাও আমাকে দিয়ে দেন আলেসান্দ্রো। বললেন, ‘এই পেন যতক্ষণ তোমার কাছে থাকবে, দুনিয়ার কেউ হারাতে পারবে না তোমাকে।’

আমার নাম ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ‘দ্য আলেসান্দ্রো শো’ ততদিনে ‘দ্য জোহান্স আর্থ’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। খ্যাতি বাড়ছে। ভক্ত বাড়ছে। হাউসফুল থাকছে প্রতিটা শো। তখনও বুঝতে পারিনি, আমার জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়ঙ্কর পরিণতি। একদিন সকালে পেনটা খুঁজে পেলাম না। তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেলাম না। কে নিল? যখন বুঝলাম, আমার পৃথিবীটা কেড়ে নিয়েছে পেন্টো। ও ব্ল্যাকম্যাজিক জানত। সেই সন্ধেয় শোতে ভ্যানিশের খেলা দেখাতে গিয়ে হঠাৎ থমকে গেল আমার হৃদযন্ত্র। মঞ্চের মাঝখানে, তেপায়া টুলটার ওপর থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম আমি। কেউ জানতেও পারল না, এটা দুর্ঘটনা নয়। খুন! সুকৌশলে আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে পেন্টো। ওকেও বাঁচতে দিলাম না। দু’দিন পর ওর প্রথম ম্যাজিক শোতে ‘পেন ম্যাজিক’ দেখাতে গিয়ে মারা গেল পেন্টো।

পেন ম্যাজিক দেখানোর জন্য যে পেনটা ব্যবহার করা হত, সেটাই এই পেন। মঁ ব্লাঁ ফাউন্টেন পেন! এটা শুধুমাত্র আমার। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাদুকর দিয়ে গেছিলেন তাঁর যোগ্য উত্তরসুরীকে।

‘সুশান্তর মতো হাসিখুশি একটা লোক এভাবে আত্মহত্যা করল? ওকে সেদিন দেখে তোমার কিছু মনে হয়েছিল চন্দন?’ সুজন সরকারের গলায় যন্ত্রণা।

চন্দন চৌধুরীর বাড়ির ড্রইংরুমে বসে ছয় বন্ধু। বিপর্যস্ত চেহারা। বিপন্ন মুখ। একটু আগে দাহ করে এসেছেন বন্ধু সুশান্ত চক্রবর্তীকে। চারদিন আগে যাঁর সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন, সেই সুশান্তবাবু যে আত্মহত্যা করতে পারেন, বিশ্বাসই করতে পারছেন না তাঁরা। ক’দিন আড্ডায় আসেননি। আজ সকালে ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে সুশান্তবাবুকে। ওই ফ্ল্যাট থেকে পচাগন্ধ ছড়াতে প্রতিবেশীরা খবর দিয়েছিল পুলিশে।

‘একটা সামান্য পেনের জন্য সুশান্ত আত্মহত্যা করবে কেন? চন্দন আমি কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।’ অস্থির গলায় বলেন বিভূতি রায়।

চন্দন দাশগুপ্ত এবারও নীরব। কী বলবেন তিনি? কী বোঝাবেন বন্ধুদের? এই ঘটনার কি কোনও ব্যাখ্যা হয়?

সুশান্তবাবুর দেহ ময়নাতদন্তে পাঠানোর পর তল্লাসি চালিয়ে একটা ডায়েরি পেয়েছে পুলিশ। যেটাকে সুইসাইড নোট বলা যায়।

সুশান্তবাবু লিখেছেন, ‘জীবনে কখনও কারও জিনিস না বলে নিইনি। এটুকু নৈতিক শিক্ষা ছিল। সততা যে অনেকসময় ভেঙে পড়ে, উপলব্ধি করলাম নিজেকে দিয়ে। লোভ গ্রাস করে নেয় সহজসরল মানুষকেও। আমার ক্ষেত্রেও তাই হল। সেদিন সন্ধেয় চন্দনের বাড়িতে।

রোজ সন্ধেতে আমরা চন্দনের বাড়িতে যাই। বিভূতি, সুজন থাকে। অবিনাশ, সুমঙ্গল, পরাশরও আসে। আমরা সকলেই মোটামুটি ঝাড়াহাতপা। আড্ডায় কামাই নেই। চন্দন কলেজ থেকে অবসর নেওয়ার পর ম্যাজিকের শখ চেপেছে। জাদু ও জাদুকরদের নিয়ে একটা বইও লিখছে। চন্দনের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, কেউ আসেনি। এক বিদেশি ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছে চন্দন। ভাষাটা বুঝতে পারলাম না। ও আমাকে রিডিং টেবলে বসতে বলে। ওর লেখার খাতার ওপর একটা ফাউন্টেন পেন দেখতে পেলাম। অ্যান্টিক জিনিস নিয়ে চন্দনের নাড়াঘাটা নেই। অথচ পেনটাকে বেশ পুরোনো মনে হল। কালো মিশমিশে চেহারার পেনটা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানছিল। লোভ হল বড়। বাকি বন্ধুরা আসার আগেই পাঞ্জাবির পকেটে পেনটা ঢুকিয়ে বেরিয়ে এলাম চন্দনের বাড়ি থেকে।

এইরকম একটা ফাউন্টেন পেনের শখ অনেকদিনের। বাড়ি ফিরে পেনটা দিয়ে ডায়েরি লিখতে গিয়ে অশান্তিটা টের পেলাম। জীবনে কখনও চুরি করিনি। লোভ আমাকে সাময়িক বশ করলেও আমি চোর নই। মনে মনে দগ্ধ হতে লাগলাম। নিজেকে ছোট মনে হল। চন্দন অনেকদিনের বন্ধু। তার জিনিস চুরি করেছি! ওর সামনে দাঁড়াব কী করে? ঘৃণা হল নিজের ওপর। রাত যত বাড়তে লাগল, অপরাধবোধ কুরে কুরে খেতে লাগল। একটা সময় ঠিক করলাম, শাস্তি আমাকে পেতেই হবে।

আমাকে ক্ষমা করো চন্দন।’

‘চন্দন, একটা ব্যাপার মেলাতে পারছি না। সুশান্ত সুইসাইড নোটটা জার্মানভাষায় লিখল কেন? যতদূর জানি, বাংলা আর ইংরেজি আর কোনও ভাষা ও জানত না! ডায়েরিতেও সবই বাংলায় লেখা! তাছাড়া যে পেনের জন্য ও সুইসাইড করল, সেটা গেল কোথায়?’ পরাশর মল্লিক উত্তেজনার বশে একটু চেঁচিয়ে উঠলেন।

চন্দন গুম হয়ে বসেছিলেন। সুইসাইড নোটে সুশান্ত তাঁর নাম লিখে যাওয়ায় পুলিশি সওয়াল-জবাবে পড়েছেন। সুইসাইড নোটটা কোন ভাষায় লেখা, প্রথমে উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। ওটা জার্মানে লেখা, চন্দনই জানায়। নোটটার মর্মোদ্ধারও করেছিল। কিন্তু সুশান্তের চুরি করা পেনটা খুঁজে পায়নি পুলিশ।

‘আজ আমাকে ছেড়ে দাও। মনটা ভালো নেই। একটু বিশ্রাম চাই। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।’ পাঁচ বন্ধুর উদ্দেশ্যে মৃদুগলায় বললেন চন্দন।

একে একে বন্ধুরা বিদায় নেওয়ার পরও ড্রইংরুমের সোফায় বসে থাকলেন চন্দন। ছেলেবেলা থেকেই জাদুবিদ্যার প্রতি তাঁর ঝোঁক। হাতসফাই, তাসের খেলা সহ বেশ কিছু ট্রিকস শিখেছিলেন। সিকিমের এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছ থেকে শেখেন হিপনোটিজম। কলেজে চাকরি পাওয়ার পরও ম্যাজিক থেকে সরে যাননি। দেশি-বিদেশের ম্যাজিকের বই পড়া শুরু করেন। উনিশ শতকের গোড়ার দিকের বিশ্ববিখ্যাত ইতালিয়ান ম্যাজিশিয়ান আলেসান্দ্রো মানেত্তির কথা জানতে পারেন। তাঁর জার্মান শিষ্য জোহান হার্নানের উত্থান, সাফল্য এবং রহস্যজনক মৃত্যুর কথাও। আরও গভীরে ঢুকে জানতে পারেন একটা ফাউন্টেন পেনের গল্প। পেনটা পেন্টোর মৃত্যুর পর হারিয়ে যায়। ম্যাজিকের সূত্রে বিদেশে কিছু বন্ধু তৈরি হয়েছিল। তাদেরই একজন মার্কো ভার্দিনো এসেছিলেন ইতালি থেকে। মঁ ব্লাঁ পেনটা দেখিয়ে দাবি করেন, ওটা নাকি জাদুকর জোহানের পেন! কুড়িহাজার ডলার দাম চেয়েছিল সে। ভারতীয় টাকায় প্রায় পনেরো লাখ। পেনটা যে জোহানেরই, বিশ্বাস হয়নি চন্দনের। এত টাকা খরচ করে কিনে যদি ঠকে যান!

মার্কো বলেছিল, ‘তুমি তো হিপনোটিজম জানো। এই পেন তোমাকে সম্মোহিত করতে পারবে না। অন্য যে কেউ হবে। পরীক্ষা করে দেখে নাও। তারপর না হয় দাম দিও। আর একটা কথা, এই পেনে একবার যে লিখেছে, সে আত্মহত্যা করেছে। সুতরাং, পরীক্ষাটা বুঝেসুঝে করো।’

মার্কোর সঙ্গে যখন পেন নিয়ে দরাদরি চলছে, তখনই এল সুশান্ত। বন্ধুকে রিডিং টেবলে বসালেন চন্দন। ওখানেই রাখা ছিল জোহানের ম্যাজিক পেনটা। সুশান্তর ওপর নজর রেখেছিলেন তিনি। দেখলেন অবাক বিস্ময়ে পেনটার দিকে তাকিয়ে আছে সুশান্ত। শরীর খারাপ লাগছে বলে একটু পরে বাড়ি চলে যায় সুশান্ত। যাওয়ার আগে যে পেনটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছে বন্ধু, খেয়াল করেছিলেন চন্দন। পরশু সকালে শিবুর সঙ্গে বাজারে দেখা হয়েছিল। সে তারও বাড়িতে কাগজ দেয়। শিবু বলেছিল, সুশান্ত নাকি বাড়িতে নেই। এক বিদেশি ভদ্রলোককে দেখেছে তার বাড়িতে। চন্দন বুঝতে পারেননি শিবুর কথা। তবে অপেক্ষা করেছেন, কী ঘটে দেখার জন্য।

আজ সকালে সুশান্তর আত্মহত্যার খবর পেয়েই ছুটেছিলেন তার ফ্ল্যাটে। যাতে বেহাত না হয় পেনটা। প্যান্টের গোপন পকেট থেকে হাত ঢুকিয়ে বের করলেন জিনিসটা। ড্রইংরুমের আলোয় ঝলমল করছে জাদুকর জোহানের মঁ ব্লাঁ ফাউন্টেন পেন। পেশাদার না হলেও তিনি নিজে জাদুকর। হিপনোটিজম জানেন। পেনটা তাঁকে মোহাচ্ছন্ন করতে পারবে না। তবে জাদুকরের পেন আর এক জাদুকরের হাতেই মানায়।

একশো বছরেরও বেশি পুরোনো পেনটা দিয়ে কেমন লেখা পড়ে, দেখতে ইচ্ছে হল তাঁর। রিডিং টেবলের দিকে এগোলেন চন্দন। ঢাকনা খুলে ডায়েরির পাতায় লিখলেন, ‘চন্দন মল্লিক, ম্যাজিশিয়ান।’

মুহূর্তে অবাক হয়ে দেখলেন, লেখাটা মুছে যাচ্ছে! তাঁর ক’টা শব্দ কেউ যেন ভ্যানিশ করে দিচ্ছে। তার বদলে ফুটে উঠছে, ‘তোমার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আমাকে ক্ষমা করো সুশান্ত!’

এই শব্দ ক’টা বাংলা নয়, জার্মান!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *