মৌর্য – ১০৭

১০৭

পথে বিরতি চাচ্ছিলেন চাণক্য। চন্দ্রগুপ্ত বললেন, কোনো বিরতি নয়, আচার্য। একটা বিশাল বহর যাচ্ছে সম্রাটের সঙ্গে। তাই যাত্রাবিরতিটা অনিবার্য। চাণক্য এবার ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলেন। তাঁর বিশ্বস্ত লোকদের সঙ্গে কথা বললেন। এ অবস্থায় বহর চলতে থাকলে নানা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। জলপানের বিরতি একেবারে অনিবার্য। অশ্বগুলোকে জলপান করাতে হবে, সঙ্গীসাথিদের জলযোগ করাতে হবে। সম্রাটকেও কিঞ্চিৎ আহার্য গ্রহণ করাতে হবে।

চাণক্য কয়েকজন অশ্বারোহীকে ভিন্ন পথে পাঠালেন। সামনে আগে চলে যাবে এরা এবং কৌশলে পথ রোধ করবে। জায়গাটা হতে হবে বিশ্রামযোগ্য।

চাণক্যের এ কৌশলটাও কাজে লাগল। কিন্তু সম্রাট কোনো অবস্থায়ই আহার্য গ্রহণে রাজি হচ্ছেন না। এখন কোন কৌশল? চাণক্য চিন্তায় পড়ে গেলেন। এদিকে সম্রাট বিজয়গুপ্তকে তাগাদা দিচ্ছেন রাস্তা পরিষ্কার করে পুনরায় যাত্রা করার জন্য।

সম্রাট চতুরাশ্বযান থেকে নেমে পায়চারি করছেন। তাঁর মধ্যে রাজ্যের অস্থিরতা। চাণক্য হাতে করে ফলের রসের একটা গ্লাস নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, চন্দ্র, একসময় আমি তোমার শিক্ষাগুরু ছিলাম। আজ থেকে আমি আর তোমার মহামন্ত্রী নই। আগের অবস্থায় ফিরে গেলাম। আমি গুরু হিসেবে নির্দেশ দিচ্ছি, তুমি ফলের রসটা খেয়ে নাও।

চাণক্যের অদ্ভূত ব্যবহারে চন্দ্রগুপ্ত একেবারে তাজ্জব বনে গেলেন। বুঝতে পারছেন না এর অর্থ কী। রাজা হওয়ার পর থেকে চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে ‘আপনি’ সম্বোধন করেন। কখনো আড়ালে- আবডালে কিংবা ভুলেও ‘তুমি’ বলেন না।

চাণক্য আবার বললেন, তোমাকে আমি আজ অনুরোধ বলো আর নির্দেশ বলো একবারই করব, আর কখনোই করব না। নাও, রসটা খেয়ে নাও।

চন্দ্রগুপ্ত ফলের রসটা খেয়ে নিলেন এবং বললেন, আচার্য, আপনি আমাকে এ সংকটে ফেলে পদত্যাগ করছেন?

তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা আমার কর্তব্য। আচার্য ভদ্রবাহু এখানে থাকলে তা আমাকে করতে হতো না। তিনিই তোমাকে আহার্য গ্রহণ করাতেন। তাঁর ভূমিকায় গিয়ে আমাকে আচরণে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। সে জন্য আমি দুঃখিত। আমি আমার পদত্যাগের ইচ্ছা প্রত্যাহার করে নিলাম।

আবার যাত্রা শুরু করলেন এঁরা। পথ যেন শেষ হচ্ছে না। চন্দ্রগুপ্তের মনে কত কত স্মৃতি। সিন্ধু নদীর তীরে বিকেলের সোনালি সূর্যালোক তির্যকভাবে পড়েছে। নদীতীরের খয়েরি রঙের ঘাসগুলো তাতে অপূর্ব রূপ পেয়েছে। একটি কম বয়সী বালিকা খালি পায়ে সে ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটছে। পরনে তার স্কার্ট। ববকাট চুল। তারুণ্য পার করা চন্দ্রগুপ্ত তার রূপে মুগ্ধ। মেয়েটি কে? শুনলেন, সে মেয়েটি কর্নেলিয়া, আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাসের কন্যা। দূর থেকে দেখেছিলেন। তাই ঝিলামের প্রমোদপ্রাসাদে তাঁকে চিনতে পারেন নি, এ ছাড়া যৌবন তাঁকে বদলে দিয়েছিল। চিঠিগুলোর কথা মনে হলো। এক চিঠিতে কর্নেলিয়া বলেছিলেন, দেবতা ডায়োনসাসের মতো চন্দ্রগুপ্তের জীবনেও ট্র্যাজেডি আছে। ট্র্যাজিক পরিণতির জন্য চন্দ্রগুপ্ত প্ৰস্তুত ছিলেন। শেষটায় যে পরিণাম, তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। হেলেন তাঁর আগে পৃথিবী থেকে চলে যেতে পারেন না। কষ্টের আর কোনো স্মৃতি নয়। বুকে ব্যথা হচ্ছে চন্দ্রগুপ্তের। দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রকৃতির দিকে তাকালেন। প্রকৃতিও যেন তাঁর মতো কষ্টে বিবর্ণ হয়ে আছে।

.

নিখিল, সরোজ ও ভবদানবকে নিয়ে সুবন্ধু গেছেন দিদাইমেইয়ার কাছে। নিখিল শবযাত্রায় বাঁশি বাজাতে চায়। স্তবগানের সঙ্গে সুরসংগত করতে বাঁশির তুলনা নেই।

দিদাইমেইয়া বললেন, শবযাত্রার স্তবগানে কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা হয় না। খালি কণ্ঠে সংগীত পরিবেশন করা হয়।

সুবন্ধু বললেন, বাঁশির সুরই বেশি করুণ।

নিখিল বলল, চীনা শিল্পী এবং রাবণহাথার শিল্পীও বাজাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

ফাওলিনের বাবা বললেন, বিউগলের সুর সামরিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে আবশ্যিকভাবে বাজানো হয়। বাঁশি সংযুক্ত করা যাবে।

কিউকেকাস তাঁকে সমর্থন করে বললেন, শুনেছি হেলেন নিখিলের বাঁশি পছন্দ করত।

দিদাইমেইয়া বললেন, অনুষ্ঠানটা সাজাতে তোমাদের দুজনের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।

সরোজ পটশিল্পী, বললেন, দিদাইমেইয়া। আমি তার কাজ দেখেছি বিয়ের সময়। পটগুলোয় রিচুয়াল ছবি আঁকবে সে। ছবির ধারণা আপনাদের দিতে হবে, বললেন সুবন্ধু।

লাউডিস বললেন, এখনই ছবির ধারণা দিয়ে দিতে হবে। সময় খুবই কম।

ফাওলিনের বাবা বললেন, হলুদের ওপর কালো ফিগার।

ফাওলিন বলল, বাবা, ও ফিগার বুঝবে না। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। মানুষের ছবি। যারা শোকার্ত। অথবা দেবতা হেইডেসের ছবি। তাকে একটু বিদঘুটে দেখাবে। এ সময় গ্রোটে ফিগার খুব জনপ্রিয়।

কবরের ভেতরকার পটচিত্র জনপ্রিয় কিরে, বললেন লাউডিস।

মানে পছন্দ করে আরকি। পাত্রটা হবে এমফোরা আকৃতির।

সরোজ বলল, সে ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। নিকোমেডেস শর্মিলাকে ডেকে আনল। শর্মিলা ব্যাপারগুলো ভালোভাবে শুনে নিয়ে বললেন, এমফোরা পটারিটাই ঐতিহ্যবাহী। পট বা পাত্র নির্বাচন করবে সরোজ নিজেই। পট বা পাত্রে যে ছবি আঁকা হবে, তার মধ্যে পরপারের ভাবনা থাকতে হবে। মানুষের ছবিগুলো হবে চিকনচাকন। এমফোরাটা জ্যামিতিক। শর্মিলা কয়েকটা রেখা টেনে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটা বুঝিয়ে দিলেন।

সরোজ একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মনে হয় তুমি বোঝো নি, বললেন শর্মিলা। উপস্থিত সবাই হতাশ। বেশি হতাশ ফাওলিন। দিদাইমেইয়া বললেন, আমি তোমার আঁকা ওদের বিয়ের ছবিগুলো দেখেছি। চমৎকার এঁকেছিলে। এখনো পারবে।

সরোজ বলল, আমি বুঝি নি বা পারব না, তা তো বলি নি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম রানিমার কথা মনে করে। তাঁর কবরে রাখা পটচিত্র আমাকে আঁকতে হলো। আঁকাআঁকিটা আমার না জানাই ভালো ছিল।

সবার মধ্যে আবার বেদনার ঢেউ খেলে গেল। লাউডিস আড়ালে চোখ মুছলেন। এ ধরনের কান্না সংক্রামক। বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। এখন সবার চোখে জল।

.

হেলেনের শেষ বিদায়টা কেমন হবে, তা নিয়ে ভাবছেন চন্দ্রগুপ্ত। চতুরাশ্বযানে অনেক ভাবনার সঙ্গে তা-ও এসে স্থান করে নিল। তিনি দেখলেন, এ ব্যাপারে তাঁর কোনো ধারণাই নেই, না গ্রিক, না ভারতীয়। ভারতীয়রা শবদেহ পুড়িয়ে ছাই করে দেয়, যাতে দেহে আত্মার স্থান না হয় এবং পুনর্জন্ম লাভ না করতে পারে। হেলেনের বেলায় তা হবে না। পোড়ানো হবে না তাঁর মরদেহ। গ্রিক রীতিটা জেনে তবে সিদ্ধান্ত হবে। গ্রিক রীতিটা যদি ভারতীয় বৌদ্ধরীতির মতো হয়, তাহলে সমাধিতে প্রচুর সোনাদানা দেওয়া যাবে। আর সমাধিসৌধ। এটি হবে বিশ্বের সেরা। এখানে তিনি প্রয়োজনে রীতির লঙ্ঘন করবেন। কিন্তু গ্রিক রীতি-রেওয়াজ জানবেন কী করে। হঠাৎই তাঁর মনে হলো মেগাস্থিনিসের কথা। তিনি সাহায্য করতে পারেন। দিদাই মেইয়াদের আসার কথা পত্রে ছিল না।

.

দিদাইমেইয়া এবার তুললেন সমাধিফলক ও সমাধির কথা। সুবন্ধু ভবদানবের দিকে তাকালেন। সে শর্মিলাকে লক্ষ করে বলল, সমাধিসৌধ নির্মাণের জন্য রানিমা তাকে আদেশ দিয়ে গেছেন। জেনারেল কিউকেকাস বললেন, পটচিত্রের আলোচনা কি শেষ হয়ে গেছে? দিদাইমেইয়া বললেন, তুমি কিছু বলবে? কিউকেকাস বললেন, পিলহট, ডেকর, মিশুয়ান ও ডিসঝেকটা মেমরা সম্পর্কে কথা ছিল।

লাউডিস বললেন, এতক্ষণ চুপ করে ছিলে কেন?

দিদাইমেইয়া বললেন, ভালোই হলো, তোমাকে পটচিত্রের সব দায়িত্ব দেওয়া হলো। নিকোরা তোমাকে সহযোগিতা করবে।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং সমাধিসৌধ নির্মাণে মাইসেনীয় যুগের অবসান ঘটান ফিলিপ দুই। তিনি আলেকজান্ডারের পিতা। সেলুকাসের পিতা এন্টিওকাস ছিলেন তাঁরই জেনারেল, যিনি নিজেকে দেবতা অ্যাপোলোর পুত্র মনে করতেন। মনে হয় ফিলিপ তাঁর সমাধিসৌধের নকশাও নিজে করে গিয়েছিলেন। এ রাজকীয় সমাধি ছিল আভিজাত্যে ঐশ্বর্যময়। ভার্জিনিয়ায় এখনো আছে এ সমাধি। ক্ল্যাসিক্যাল যুগের সমাধিসৌধ থোলো সম্পর্কে ধারণা দিলেন দিদাইমেইয়া। এটি খুব সাদাসিধে ধরনের সমাধিসৌধ। এটিও নির্মাণ করা যেতে পারে।

ভবদানব বলল, রানিমার সমাধিসৌধ হবে রাজা ফিলিপের মতো।

এটা অনেক ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। তুমি কি পারবে, বললেন লাউডিস।

আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি। ব্যয়ের ব্যাপারটা ছাড়া অন্য বিষয়গুলোর দায়িত্ব আমার। রানিমার জন্য আমি সব করতে পারব।

কিউকেকাসকে এ দায়িত্ব নিতে হবে, বললেন দিদাইমেইয়া। বাজেট জানতে হবে, বললেন কিউকেকাস। সুবন্ধু বললেন, নকশা ও প্রাক্কলন করে দিন, আমি যুবরাজের সঙ্গে কথা বলব।

.

চাণক্য আলাদা শকটে আসছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন বিজয়গুপ্ত। বিজয়গুপ্ত বললেন, আচার্য, সম্রাজ্ঞীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া কোন রীতিতে হবে?

কেন? গ্রিক রীতিতে।

ওই সব রীতিনীতি তো আমরা জানি না।

জেনে নেব। আর গ্রিক রীতিতে যা-ই থাকুক না কেন, তোমার কাজ তুমি করবে। সামরিক কায়দায় বিদায়ী শ্রদ্ধা জানাবে।

সম্রাট এ রকম ইচ্ছে না করলে?

তুমি তৈরি থেকো।

চাণক্য ভাবছিলেন প্রথম দেখা স্মৃতির কথা। তাঁর ও সম্রাটের ঘোড়া ব্যবসায়ী সেজে ঝিলামের প্রমোদপ্রাসাদে যাওয়ার স্মৃতিটা স্পষ্ট মনে পড়ছে। প্রথম দেখায়ই সম্রাট দুর্বল হয়ে পড়েন। এ দুর্বলতাটা চাণক্য কাজে লাগান। এ সুযোগে নন্দরাজের কফিনে শেষ পেরেকটা মেরে দেন তিনি।

সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুতে কোনো একটা সুযোগের চিন্তায় আছেন। কিন্তু এখন সম্রাটের মন খুব খারাপ। পাটালিপুত্রে পৌঁছে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে। এখন রাজ্যজয়ের আর কোনো পরিকল্পনা নেই। তিনি ভাবছেন তাঁর পরবর্তী অ্যাজেন্ডা কী হবে। হঠাৎ করেই তাঁর মনে হলো, সুবন্ধুকে রেখে গেছেন, কিন্তু সে কী করল? সম্রাজ্ঞীর অসুস্থতার সংবাদটা পর্যন্ত পাঠাল না। যুবরাজ ছেলেমানুষ। তার কোনো ত্রুটি উত্থাপনই করা যাবে না। এবার সুবন্ধুকেই তোপের মুখে ফেলতে হবে। আগে খোঁজখবর নিয়ে জানতে হবে তার দুর্বলতা এবং ত্রুটি ছিল কোথায়। যুবরাজ আর সম্রাজ্ঞীর কাছে প্রিয় হয়ে ওঠার মাশুল এখন তোমাকেই গুনতে হবে, সুবন্ধু।

বিজয়গুপ্ত, বিজয়গুপ্ত ঝিমুচ্ছিলেন। মহামন্ত্রীর ডাকে হঠাৎ জেগে উঠলেন, আচার্য, কিছু বলছেন?

বলছিলাম সম্রাজ্ঞীর অসুস্থতার সংবাদ না জানিয়ে সুবন্ধু কাজটা কি ঠিক করেছে?

একদম ঠিক করে নি, আচার্য।

আমি কথাটা যখন সম্রাটের সামনে তুলব, তুমি তখন সায় দেবে।

অবশ্যই, আচার্য।

আরেকটি কথা। অভিযানের বিষয়ে সম্রাট কিছু জানতে চাইলে আমার অগোচরে বলবে না।

সম্রাট একান্তে জানতে চাইলে?

বুদ্ধি খাটাবে, বিজয়গুপ্ত, বুদ্ধি খাটাবে।

আমার একটা বিষয় জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, আচার্য।

বলো, কী জানতে চাও?

সম্রাটকে কী বলে আপনি ফলের রস পান করালেন? তিনি তো শোকে কিছুই খেতে চান নি।

তোমার কৌতূহল বেশি, বিজয়গুপ্ত। কৌতূহল থাকা ভালো। পাটালিপুত্রে পৌঁছে তুমি যবন সৈন্যদের ডেকে পাঠাবে। তাদের সঙ্গে আমি কথা বলব।

বিজয়গুপ্ত বুঝতে পারলেন চাণক্য তাঁর প্রশ্নটি এড়িয়ে গেছেন।

.

হঠাৎ করেই শর্মিলা মেগাস্থিনিসের বাসভবনে উপস্থিত হয়েছেন। সম্রাজ্ঞীর মৃতদেহ সৎকারের ব্যাপারে গ্রিক রীতি নিয়ে কথা বলতে চান এবং জানতে চান কোনো আনুষ্ঠানিকতায় তাঁর অংশগ্রহণের সুযোগ আছে কি না?

মেগাস্থিনিস সরাসরি বললেন, আপনার অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। কারণ, ভারতীয় নারীদের, বিশেষ করে সন্ন্যাসিনীদের আমরা কোনো অনুষ্ঠানেই রাখব না।

সহকারী হিসেবেও না?

কোনো কাজেই না।

আপনার সহকারী বা দোভাষী হিসেবেও না?

সৎকারের কাজে দোভাষীর প্রয়োজন হয় না।

ভারতীয় রীতিতে সৎকার করলে? বলছিলাম কি, সম্রাট তো এখনো পৌঁছান নি, তাঁর মতামত পাওয়া যায় নি।

তখন দেখা যাবে।

কী দেখা যাবে?

আমরা কী করব।

আপনার তো আর এখানে থাকার প্রয়োজন নেই।

দেখুন, আমি সেলুসিড সম্রাটের দূত, সম্রাজ্ঞীর সহকারী নই।

চুক্তিটার কথা একবার মনে করুন।

আমার মনে আছে।

এবার শর্মিলা হাসলেন। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, আমরা দক্ষিণ ভারতে চলে যাচ্ছি।

আমরা মানে কারা?

আচার্য ভদ্রবাহু এবং বারো হাজার জৈন।

আচার্য যাবেন কেন?

স্থুলভদ্র তাদের নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তিনি যাবেন না। তাই আচার্য নিজেই দলটির নেতৃত্ব দেবেন।

স্থুলভদ্রেরই যাওয়া উচিত। আচার্য রাজধানী ছেড়ে যাবেন কেন? তিনি সম্রাটের আধ্যাত্মিক গুরু। সম্রাট কি যেতে দেবেন?

সিদ্ধান্তটা এ রকমই হয়েছে।

আমিও অমরাবতী চলে যাব।

আমরা অমরাবতী যাচ্ছি না।

তাহলে কোথায় যাচ্ছেন?

তা জেনে আপনার কী?

তাই তো, আমার কী। একজন ভারতীয় সন্ন্যাসিনী, যিনি মনের কথা জেনে যান, তিনি কোথায় যাবেন, তা জেনে আমার লাভ কী

আপনি আসলে আমার কাছে কী চান?

কিছুই চাই না।

আপনার মন তো সে কথা বলছে না। আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না, আপনার মন যা চাইছে, ঠিক চাইছে না।

আমার মন যা ভাবছে, তা ঠিক কি না, বলুন।

কী ভাবছে?

কেন আপনি ম্যালোড্রামাটিক আচরণ করছেন?

আপনাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। আমি দুঃখিত মিথ্যে অভিনয়ের জন্য, এ রকম কথা বলতে গিয়েও বললেন না শর্মিলা। বললেন, আমাদের চলে যাওয়ার সময় আপনি উপস্থিত থাকবেন।

আমি পারব না। আমার…

শেষটা না শুনেই শর্মিলা চলে গেলেন।

শর্মিলার সঙ্গে পথেই সাক্ষাৎ হলো নিকোমেসে ও ফাওলিনের। নিকোমেডেস হেলেনের মৃত্যুতে এতটা শকট যে তার মুডের পরিবর্তন হচ্ছে না। এটা ভালো লক্ষণ নয়। তাই ফাওলিন তাকে নিয়ে আচার্য ভদ্ৰবাহুর কাছে যাচ্ছে। সেখানে শর্মিলার সঙ্গেও সাক্ষাৎ হওয়ার কথা। এখানে শর্মিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাওয়ায় ভালোই হলো। শর্মিলা বললেন, চলুন আমরা বৃক্ষ উদ্যানের দিকে যাই। আজ মনে হলো ফাওলিনের নিকোমেডেসকে একা শর্মিলার সঙ্গে পাঠাতেও আপত্তি নেই। এঁরা একেবারে উদ্যানের ভেতরে চলে গেলেন।

নিকোর মন ভালো না থাকারই কথা। আমি দেখেছি, তাদের বন্ধুত্ব কত নিবিড়। একজন মানুষের বহু বন্ধু থাকতে পারে, কিন্তু ভারতীয় প্রথায় জীবনসঙ্গী থাকে একজনই। ফাওলিনের মতো জীবনসঙ্গী পেলে জীবন সার্থক হয়ে যায়। আমিই কথা বলে যাচ্ছি, তোমরা কেউ কিছু বলছ না, বললেন শর্মিলা।

নিকোমেডেস বলল, ঠিক বলেছেন, শর্মিলা। বন্ধু হারানোর বেদনা অনেক। সহ্য করা কঠিন। সুস্থ দেখলাম, এর মধ্যে এত কিছু ঘটে গেল।

ফাওলিন বলল, চোখের সামনে ঘটে গেল ব্যাপারটা, সহ্য কী করে করি বলুন?

যেন তাঁকে স্বপ্নে পেয়েছি আবার স্বপ্নের মধ্যেই হারিয়ে ফেললাম। তিনি একজন সফল মানুষ। সবাইকে কেমন করে যেন জয় করে ফেললেন। কাউকে আমি তাঁর বিরুদ্ধে বলতে শুনি নি, বললেন শর্মিলা। তোমরা থেকে যাও এখানে। সম্রাজ্ঞীর আত্মা শান্তি পাবে। মৌর্যদের এত বড় সাম্রাজ্য, কোনো অসুবিধাই হবে না। তোমরা দুজনই চাকরি করবে এখানে। একজন সেনাবাহিনীতে, অন্যজন দূতের সঙ্গে।

শুনে কষ্টের মধ্যেও নিকোমেডেস হাসল। বলল, আপনি এত চমৎকার মানুষ যে শুধু ভালোটাই দেখেন। আমরা আসলেই পরদেশি, উদ্বাস্তু।

না না, নিকো, তুমি ঠিক বলো নি, তোমরা আমাদের আত্মীয়, ঘনিষ্ঠজন। এ কথা শুনলে সম্রাট খুব কষ্ট পাবেন। আচার্যও কষ্ট পাবেন।

ফাওলিন বলল, দিদি, হেলেনই তো নেই, আমরা কার ওপর ভরসা করে থাকব?

অন্য সময় হলে শর্মিলা বলতেন, কেন, আমরা আছি না, এখন বলতে পারলেন না, কারণ, তাঁর যে সে রকম বলার অবস্থা নেই। দাক্ষিণাত্যে চলে যেতে হচ্ছে। তবু বললেন, আমাদের সম্রাট তো আছেন। আপনাদের তাঁকে না চেনার কথা নয়। আচার্য একটি কথা বলেন যে ভালোর বিকল্প ভালো, ভালোর কোনো সমস্যা নেই।

আমরা এখানে থাকলে হয়তো আরও ভালো হতো।

নিকো বলল, এখানে থাকলে অর্থ কী, আপনারা অন্য কোথাও যাচ্ছেন নাকি?

হ্যাঁ, আমরা দাক্ষিণাত্যে চলে যাচ্ছি।

অমরাবতীতে?

না, জানি না কোথায়। তবে নিশ্চিত চলে যাচ্ছি।

আপনি আবার মন খারাপ করে দিলেন।

মন খারাপের কী আছে, বউদি? তোমরাও সেখানে বেড়াতে যাবে।

কিন্তু এ অবস্থায় কেন যাবে?

কারণটা বললেন শর্মিলা। নিকোমেসে তা শুনে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল। পরে বলল, আপনি আর আচার্য না থাকলে এখানে থাকা অর্থহীন।

যুবরাজ আসলেই ভালো। তিনি আপনাদের আনন্দে রাখবেন।

কবে যাচ্ছেন, দিদি?

ফাওলিনের প্রশ্নের জবাবে শর্মিলা বললেন, ঠিক জানি না, আচার্য জানেন।

.

আচার্যের কাছে গেছেন মেগাস্থিনিস। দাক্ষিণাত্যে আচার্যের যাওয়ার কথায় প্রতিক্রিয়া জানালেন। বললেন, আপনি সম্রাটের আধ্যাত্মিক গুরু। তাঁর এ দুঃসময়ে আপনি তাঁকে ছেড়ে যাবেন?

উপায় কী, বলুন? মানুষকে তো রক্ষা করতে হবে, ধর্মকে রক্ষা করতে হবে। মানুষ থাকলে তবেই তো ধর্ম।

এখানকার সব মানুষ কি একই সঙ্গে মারা যাবে?

তা যাবে না বটে। কিন্তু সাবধানে থাকলে সবই রক্ষা পায়। এ ছাড়া বারো হাজার মানুষের খাবার বাঁচবে এখানে।

এখানে খাবার বাঁচাতে চাচ্ছেন? সম্রাট এলে আমি বুঝাব। আপনারা এখানেই থাকুন।

মেগাস্থিনিসের কথা শুনে আচার্য সৌম্য হাসি হাসলেন। প্রসঙ্গান্তরে বললেন, আপনার উল্টো পায়ের লোকজন সেদিন নিখিলের বাঁশি শুনতে এসেছিল

অবাক হয়ে মেগাস্থিনিস বললেন, তাই নাকি? আমাকে বলেন নি কেন?

আপনি গেলে হয়তো ওরা বাঁশি না শুনে চলে যেত। এদের এই পরিবেশে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। যদিও মুখ ঢেকে এসেছিল, তাও একটা ভালো লক্ষণ।

খুশিতে গদগদ হয়ে মেগাস্থিনিস বললেন, এটা যে কত আনন্দদায়ক, বোঝানো কঠিন। আমি ‘ইন্ডিকা’ নামে একটা বই লেখা শুরু করেছি। বইতে তাদের কথাও লিখব।

আর কী কী থাকছে আপনার বইতে?

আপনাদের রাষ্ট্র এবং সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে লিখব। ভারতবর্ষের প্রতিষ্ঠাতা হারকিউলিস এবং ডায়োনিসাস, সে কথা লিখে সবাইকে অবাক করে দেব। দেশটা এত সুন্দর যে ভৌগোলিক বিবরণ লেখার লোভ সামলানো মুশকিল। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের শাসনব্যবস্থা ইজিপ্টের মতো সুশৃঙ্খল, তা আমি লিখব।

মহামন্ত্রী চাণক্যের কথা লিখবেন না?

তাঁর কথা লিখলে খারাপ কিছু লিখতে হবে। তাই আমি লিখতে চাই না। সুন্দর নগরী পাটালিপুত্র সম্পর্কে লিখব। আমার ব্যক্তিগত বিষয় কিছু লিখব না।

শেষের কথাটা শুনে আচার্য হাসলেন।

মেগাস্থিনিস বললেন, সম্রাজ্ঞী নেই, আপনি না থাকলে, বিশেষ করে শর্মিলা না থাকলে, বড় সমস্যায় পড়ে যেতে পারি।

যুবরাজের সঙ্গে কথা হয়েছে?

হয়েছে। খুব বেশি নন। তাঁর মন খুবই খারাপ।

বইয়ে আর কী কী থাকবে?

(সবাই জানে মেগাস্থিনিস ‘ইন্ডিকা’ নামে গ্রন্থ লিখেছিলেন। কিন্তু গ্রন্থটি হারিয়ে যায়। তার প্রায় তিন-চার শ বছর পর গ্রিক ও লাতিন ভাষায় কিছু কিছু অংশ উদ্ধার করা হয়। ডায়োডোরাস সিকুলাস, স্ট্রাবো, প্লিনি, এরিয়ান প্রমুখরা নানা সংকলনে মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকার অংশ বিশেষ ব্যবহার করেন। লেখক চাণক্যের মতোই লেখক মেগাস্থিনিসের ব্যক্তিজীবনকে লেখকজীবনের সঙ্গে মেলানো যায় না। তাই শুধু তাঁদেরই লেখার আলোকে উপন্যাসের চরিত্রকে চিত্রিত করা যৌক্তিক মনে হয় নি।)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *