মৌর্য – ১০৬

১০৬

রাতে সবাই চলে গেলে হেলেন মন্দাকিনীকে বললেন, একটা পত্র লিখতে হবে।

লিখুন রানিমা, একটা কাগজ-কলম এনে দিই?

হেলেন বললেন, আমি বলব, তুমি লিখবে।

গ্রিক ভাষায়?

না, তোমার ভাষায়ই লিখে দাও।

বলুন কী লিখতে হবে।

লিখো

চন্দ্ৰ,

এ চিঠি যখন আপনার হাতে পৌছাবে, তখন আমি আপনার থেকে বহুদূরে।

বলে থামলেন হেলেন। বললেন, গুছিয়ে কিছু বলতে পারছি না, মন্দাকিনী। পরে এসো। এখন ভালো লাগছে না। কে বাঁশি বাজাচ্ছে? নিখিল? মন্দাকিনী বলল, নিখিল I

ভাবনাগুলো তাঁর এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ক্ষয়ে যাচ্ছেন তিনি। বড় বেশি ওষুধ দেওয়া হয়েছে তাঁকে, এটাও কারণ হতে পারে। কারণ যা-ই হোক না কেন, এখন তাঁর লেখার বা বলার শক্তি নেই।

ঘুম হচ্ছে না তাঁর। শৈশবের স্মৃতিগুলো ভিড় করছে। সেলুকাস সবে ‘বেসিলেয়াস’ খেতাব অর্জন করেছেন, এত দিন ছিলেন জেনারেল, আনন্দের বন্যা বয়ে গেল তাঁদের পরিবারে। বেসিলেয়াস মানেই তো রাজা। তাঁর মা স্ট্রেটোনিস তখনো পরিবারে সম্মানের আসনে, শ্রদ্ধার আসনে আপামা। পরিবারে সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে তাঁর প্রতি স্নেহ-আদর সবার। এন্টিওকাসেরও প্রিয় বোন। লাউডিস তো স্বর্গ হাতে পেয়েছেন। এত দিন তার খেলার সাথি ছিল না, তিনি যেন পুতুল পেয়ে গেলেন একটা।

আপামা ছিলেন দেবীতুল্য নারী। সত্মা এত ভালোবাসতে পারে, ভাবাই যায় না। কত কষ্টে পুড়ে যে তিনি খাঁটি সোনার মানুষ হয়েছেন, তাঁর তুলনা চলে না। তাঁর স্নেহ-মমতা-ভালোবাসায়ও খাদ ছিল না। এত এত স্নেহ আর ভালোবাসা পেয়ে বেড়ে উঠেছেন তিনি। একবার খুব অসুখ হয়েছিল তাঁর, আপামা সারা রাত তাঁর পাশে জেগে আছেন। যমকে যেন পাহারা দিচ্ছিলেন। ওষুধ-পথ্য, নাওয়া সবই করেছেন। দাসদাসীর অভাব ছিল না। কিন্তু তিনি নিজেই এগিয়ে এলেন হেলেনকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য।

হেলেনের মনে হলো, ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এখন এ দায়িত্বই পালন করছেন তাঁর আরেক সত্মা স্ট্রেটোনিস। অদ্ভুত ব্যাপার। মাঝেমধ্যে তাঁকে দেখতেও মনে হয় আপামা। ভুল দেখেন না তো হেলেন। কখনো কখনো গ্রিক দেবতারা তামাশা করেন। হোমারের ইলিয়াডে মানুষের সঙ্গে দেবতাদের বহু তামাশার পরিচয় আছে। মানুষের সঙ্গে তামাশা করে এঁরা মজা পান। হেলেনের সঙ্গেও এ রকম মজা করছেন না তো? না হয় আপামা এ দুঃসময়ে কেন আবার আসবেন স্ট্রেটোনিস হয়ে? আসল মা স্ট্রেটোনিস কত কষ্টই না দিলেন। ভারতীয় আইনে মৃত্যুদণ্ডতুল্য অপরাধ করেও তিনি এখন সম্রাজ্ঞী, তাঁর অপরাধসঙ্গী এন্টিওকাস সেলুসিড সাম্রাজ্যের সম্রাট। আর ভাবতে পারছেন না হেলেন।

তিনি ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। রাজবৈদ্য বলেছেন, ঘুমটা তাঁর প্রয়োজন। একটু দূরে স্ট্রেটোনিস ক্লান্ত হয়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছেন। কত রাত গেছে জেগে আর সেবা করে, তাই তাঁর শরীরে কুলোচ্ছে না। হেলেনের যমের সঙ্গে তিনিও যুদ্ধ করছেন। কে জিতবে কে জানে। হেলেন এ কথা মনে করে শ্লেষের হাসি হাসছেন। খুব মায়া হয় স্ট্রেটোনিসের জন্য। তাঁর চেয়ে বয়স অনেক কম, কিন্তু মা। সত্মাও তো মা। তিনি কি আপামার মতো জিতবেন? এত পুণ্য কি তাঁর থলিতে জমা আছে? নিজে নিজেই বলে হাসলেন হেলেন।

ঘুম আসছে না। শরীরও নাড়াতে পারছেন না তিনি। একেবারে স্থবির হয়ে গেছে। সুখের স্মৃতিরোমন্থন করতে চাইলেন তিনি। তাঁর মনে হলো, ভাগ্য তাঁর সঙ্গে ভালোই আচরণ করছে। শৈশব মহানন্দে কেটেছে। সবার স্নেহ আর ভালোবাসা পেয়েছেন। মাঝখানে খুব খারাপ গেছে সময়। তখনো আর্কিেেডস সময় দিয়েছে, আনন্দে ভরিয়ে দিতে চেয়েছে, গ্রিক ছেলেদের প্রতি ঘৃণা সে আনন্দ গ্রহণ করতে দেয় নি তাঁকে। পরের ঘটনা তো একটি ইতিহাস। নিকোর মতো একজন বন্ধু পাওয়াও সৌভাগ্য। সে যা করেছে, তুলনা হয় না, কিন্তু এদের ভাগ্য এমন কেন যে আজ উদ্বাস্তু হয়ে দেশে দেশে ঘুরতে হবে। উদ্বাস্তুদের মন ছোট হয়ে আসে, সে আনন্দ আর স্বতঃস্ফূর্ততা থাকে না, নিকো কেমন যেন নিরানন্দ হয়ে গেছে।

আবার নিজের ভাবনায় ফিরে এলেন হেলেন। তিনি কি কখনো ভেবেছেন জীবনের শেষ সময়ে ফের এত মানুষের ভালোবাসা পাবেন, আর রাজকীয় সব ভালোবাসা? যেদিকে তাকিয়েছেন, দেখেছেন তাঁর প্রতি সবার হাসিমুখ, আজ যখন তাকান, দেখেন বুকভরা কষ্টের নিঃশ্বাস সবার। এ ছাড়া দিদাইমেইয়ারা এমন এক সময় এসে গেছেন, যখন তাঁর যাওয়ার সময় হয়েছে। ভাগ্যকে ধন্যবাদ। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত? তাঁকে না জানিয়ে পলাতকা হওয়ার মধ্যেও একধরনের আনন্দ খুঁজে পেলেন হেলেন। যাকে বলা যায় ফাঁকি দিয়ে চলে যাওয়া।

এভাবেই চিরতরে পালাতে চান হেলেন। পরপারে গিয়ে দেখতে চান চন্দ্রগুপ্ত কোথায় খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁকে (মানসিক সংকটকালে অ্যাবসার্ডিটি থেকেও এমনটি মনে হয়)।

রাত শেষ হয়ে এসেছে। হেলেনের অস্থিরতা বেড়ে গেছে। জলপান করতে চাচ্ছেন তিনি। কিন্তু মুখ থেকে শব্দ বের হচ্ছে না। একসময় শ্বাস টানতে শুরু করলেন। তখনই জেগে দ্রুত উঠে এলেন স্ট্রেটোনিস। চিৎকার করে ডাকলেন সবাইকে।

হেলেন সবাইকে ছেড়ে যাচ্ছেন। মানুষের সব নিঃশ্বাসই হয় উষ্ণ বা গরম, শেষ নিঃশ্বাসটি হয় শীতল। হেলেন শীতল নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

দিদাইমেইয়ারা এসেছেন। যুবরাজ এসেছেন। প্রাসাদের সবাই এসে ভিড় করছে। ছুটে এসেছেন শর্মিলাও। এঁদের সবার চোখেমুখে নিস্তব্ধতার আর্তি। দীর্ঘশ্বাস। যুবরাজ একেবারে ভেঙে পড়েছেন। তাঁর মনে হলো সত্যিকার অর্থেই তিনি আজ মা-হারা। সন্ন্যাসিনীদের ক্রন্দন করতে নেই। শর্মিলা কাঁদছেন নিয়মনীতি ভঙ্গ করে। শতবছরের নীরবতা ভঙ্গ করে প্রথমেই হাহাকার করে উঠলেন দিদাইমেইয়া। বললেন, বৃথাই এত বছর যাবৎ উপাসনা করছি আমি দেবতা অ্যাপোলোর। তাঁর কাছে ছোট্ট আবেদন করেছিলাম মেয়েটির জীবন বাঁচাতে, বাঁচাল না সে। লাউডিস পিসিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুক ভাসালেন। স্ট্রেটোনিস বিলাপ করে বললেন, আমাকে সন্তান দিয়েও নিয়ে গেলে, কত নিষ্ঠুর তুমি জিউস।

ফাওলিন নিকোমেডেসের কাঁধে দুহাতের ওপর মাথা রেখে তার সঙ্গে কষ্ট ভাগ করছে, ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। বন্ধুর মৃত্যুতে নিকোমেডেস বাকশূন্য। তার কান্না নেই, নীরব-নিথর, যেন পাথর হয়ে গেছে।

যুবরাজ বের হয়ে যাবেন। তিনি চলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছেন, পা চলছে না তাঁর ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদেন, পারছেন না। সঙ্গে আছেন সুবন্ধু। বললেন, যুবরাজ, ভগবান যা ভালো মনে করেছেন, তা-ই হয়েছে। জানি আপনার কষ্ট বেশি, আপনি সবচেয়ে বড় শুভার্থীকে হারিয়েছেন। মাকে দেখেন নি, যখনই মায়ের স্নেহস্পর্শ পেতে শুরু করলেন, তখন তাঁকেও হারাতে হলো। এ কষ্ট ভোলা যায় না।

সুবন্ধু, আপনি জানেন, মা আমার সব কর্মের সহযোগী ছিলেন। বন্ধুর মতো, অভিভাবকের মতো আমাকে অনুসরণ করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, উপদেশ দিয়েছেন, শাসন করেছেন। আর তো কেউ রইল না শাসন করার। বাবাকে আমি কী জবাব দেব? মাকে আমার কাছে রেখে যুদ্ধে গেছেন তিনি। ফিরে এসে যখন জানতে চাইবেন, কী বলব আমি?

যুবরাজ শান্ত হোন, আমাদের সামনে এখন অনেক কাজ। সম্রাটকে সংবাদ দিতে হবে। সম্রাজ্ঞীর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করতে হবে। সব তো আপনাকেই করতে হবে।

হ্যাঁ, আমাকেই করতে হবে, এ ছিল আমার নিয়তি। ডাকুন সবাইকে। সর্বাগ্রে সংবাদ দিন আচার্য ভদ্রবাহুকে। পরামর্শ করতে হবে, অমাত্যদের ডাকুন।

সম্রাটকে সংবাদ পাঠানো হলো। সংবাদ পৌঁছানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। মৌর্য সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। সম্রাটের সময় কাটে আদিবাসীদের জন্য কাজ করে। অবসর সময়টায় চলে যান সমুদ্রে। সেখানে তাঁর নৌজাহাজ আর নৌসেনারা রয়েছে। কিন্তু তিনি জাহাজে ওঠেন না। সমুদ্রের দৃশ্য দেখেন বেলাভূমিতে বসে বসে। জীবনের সব গ্লানি, সব ব্যথা, সব শূন্যতা এতে ভুলে থাকা যায়। কখনো কখনো সুখস্মৃতি মনে আসে, তখন হেলেনের কথা মনে হয়, বিন্দুসারের কথা মনে হয়, আচার্য ভদ্রবাহুর কথা মনে হয়, হয়তো সেলুকাসের কথাও মনে হতো, একটি চিঠি তাঁর হৃদয় ভেঙে দিয়েছে, তারপর থেকে মনে হয় না।

দুঃখস্মৃতিগুলোও ভিড় করে। শৈশবে মায়ের ফেলে যাওয়া, পথ থেকে তুলে নিয়ে শিকারির কাছে বিক্রয় করে দেওয়া, সেখান থেকে চাণক্যের নিয়ে আসা, তক্ষশীলায় লেখাপড়া করা এবং আলেকজান্ডারের বাহিনীর পেছনে লাগা, নন্দদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা এবং পরাজয়বরণ করা-এসব সকল সুখস্মৃতিকে ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। দুঃখ-কষ্টগুলোকেই বোধ হয় মানুষ বেশি মনে রাখে।

তখন নিজের অজান্তেই বালুকাবেলায় হাঁটেন, দাগ কেটে মানুষের নানা ছবি আঁকেন। কখনো কখনো বালির পাহাড় তৈরি করেন। তখন থর মরুভূমির কথা মনে পড়ে। বাসররাতের পরিবর্তে থর মরুভূমিতে হেলেন শিশুদের মতো এ রকম পাহাড় বানিয়েছিলেন। তিনি তাতে যোগ দিয়েছিলেন। একজন মানুষের জীবন কত বিচিত্র, কত বর্ণময়। তারপরও তিনি নিঃসঙ্গ, বড় একা।

এ রকম একদিন বার্তাবহ ছুটে এল দুঃসংবাদ নিয়ে। সঙ্গে মহামন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি এবং অন্ধ্রের সে প্রবীণ মানুষটি। বার্তা পাঠ করে মাথায় হাত দিয়ে একেবারে বসে পড়লেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যে এ সাগর, মহামন্ত্রী, সেনাপতি, সাম্রাজ্য, পৃথিবী—সব মিথ্যে হয়ে গেল। হৃদয়ে শুধু আহাজারি, হেলেন, তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারলে? কী পাপে তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে? এভাবে পালালে কেন পলাতকা, যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না।

মহামন্ত্রী সান্ত্বনা দিতে আসছিলেন, হাতে তাঁকে থামিয়ে দিলেন, প্রধান সেনাপতি চুপ করে আছেন, কিছু বলার সাহস তাঁর নেই।

প্রবীণ মানুষটি কাছে এসে বললেন, মানুষের যখন সময় হয়, তখন তাকে সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে হয়। এই অমোঘ বিধানের কাছে মানুষ অসহায়, মহান সম্রাট।

আপনি আমাকে মহান সম্রাট বলছেন, এত হত্যা, এত নির্যাতন, এত ধ্বংসের পরও আমি মহান?

এ কয় মাস যাবৎ আমি আপনাকে দেখছি, অন্ধ্রের মানুষজন দেখছে। মিথ্যে বলি নি আমি, ভুল করা আর তা থেকে অনুশোচনার মধ্য দিয়েই মানুষের মহত্ত্ব প্রকাশ পায়।

সম্রাট মনে মনে বললেন, তাহলে এত বড় আঘাত কেন পেলাম আমি? এ আমার প্রায়শ্চিত্ত, ভুলের মাশুল। কেউ আমায় ক্ষমা করে নি, করবে কেন? আমি যে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে চলেছি।

মহান সম্রাট, আপনার ফিরে যাওয়া দরকার, প্রবীণ মানুষটি আবার বললেন।

একটু ভেবে সম্রাট বললেন, হ্যাঁ যাব, অবশ্যই যাব।

.

চাণক্য আর প্রধান সেনাপতি চোখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন। চাণক্য এগিয়ে এসে বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমরা এখনই রওনা দিতে চাই।

চন্দ্রগুপ্ত নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন। বললেন, চলুন।

তিনি লক্ষ করলেন, অন্ধ্রের অনেকগুলো মানুষ জড়ো হয়েছে। প্রবীণ লোকটি বললেন, আপনাকে বিদায় জানাতে এরা এসেছে, মহান সম্রাট।

চতুরাশ্বযানে চড়ে সম্রাট তাদের উদ্দেশে হাত নাড়লেন। মনে হলো এত বড় একটা বিপর্যয়ের পরও অন্ধ্রের লোকজন চন্দ্রগুপ্তকে তাদেরই সম্রাট মনে করছে।

.

এদিকে আচার্য ভদ্রবাহু, হেলেনের আত্মীয়স্বজন, সুবন্ধুসহ অপরাপর অমাত্যদের নিয়ে বসেছেন যুবরাজ বিন্দুসার। আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, শেষকৃত্যের বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে গেছেন সম্রাজ্ঞী। তিনি বলেছেন, দিদাইমেইয়ার সঙ্গে পরামর্শ করে শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে।

দিদাইমেইয়া চমকে উঠলেন। তাঁর দিকে দৃষ্টি সবার। তিনি বললেন, বিয়েটা আমরা উভয় রীতিতে সম্পন্ন করেছিলাম। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তো সে সুযোগ নেই। সম্রাট আসুন, তাঁর উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হওয়া ভালো হবে। তিনি আমার পরামর্শ চাইলে আমি আমার কথা বলব।

যুবরাজ বললেন, ঠিক কথা বলেছেন আপনি।

ভদ্রবাহু বললেন, সম্রাজ্ঞী আরেকটা কথাও বলে গেছেন।

সবাই আচার্যের দিকে তাকালেন। তিনি বললেন, সম্রাট না আসা পর্যন্ত যেন তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা না হয়।

তা তো অবশ্যই, বললেন দিদাইমেইয়া।

যুবরাজ বললেন, সম্রাট এলেই শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হবে। তবে সম্রাজ্ঞীর ইচ্ছেটা কী, তা বোঝা যাচ্ছে। গ্রিক রীতিতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন সম্পন্ন করতে কী কী করা লাগবে, যদি এখনই বলে দেন তো ভালো হয়।

দিদাইমেইয়া বললেন, অনেক বড় প্রক্রিয়া।

বিন্দুসার সুবন্ধুকে বললেন, আপনি টোকা নিন। সুবন্ধু গ্রিক ভালো জানেন না, অসহায়ের মতো তাকালেন। শর্মিলা বললেন, আমি আপনাকে সাহায্য করছি। মেগাস্থিনিস বললেন, শর্মিলা ঠিকই আপনাকে সাহায্য করতে পারবে। ও আমার দোভাষী হিসেবে কাজ করছে।

আমাদের পরকালের একজন দেবতা আছেন, নাম হেইডেস। তিনি মূলত কবরবাসীদের দেবতা। দেখতে বিদঘুটে, এটুকু বলে থামলেন দিদাইমেইয়া।

নিকোমেডেস বলল, মা, রিচুয়াল সম্পর্কে বলো। দেবতার কথাটা পরে বলো।

দিদাইমেইয়া বললেন, মৃতের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা ও কর্তব্যবোধের ওপর আমাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। মাইসেনিয়ান যুগ থেকে তা চলে আসছে। কত নিয়মরীতি যে পালিত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। তবে আমরা সবগুলো পালন করি না। এখনকার নিয়মরীতি অনুসরণ করি। নিয়মরীতির আওতায় যেসব ব্যক্তি ও পণ্যসামগ্রীর প্রয়োজন হবে, তার কথাই বলছি।

শেষকৃত্যানুষ্ঠানে মহিলাদেরই মুখ্য ভূমিকা নিতে হয়। এরা মরদেহ শেষকৃত্যের জন্য প্রস্তুত করে দেন। ধোয়া, তৈল বা সুগন্ধি লাগানো, বস্ত্র বা অন্য কিছু দিয়ে আবৃত বা জড়িয়ে সৌন্দর্যকরণ প্রভৃতি এদেরই কাজ। তাই উপকরণগুলো সংগ্রহ করতে হবে। মরদেহের মুখে স্বর্ণের একটি মুদ্রা দিয়ে দিতে হয়। তার পেছনে অবশ্য একটি বিশ্বাস কাজ করে। অদৃশ্য এক খেয়ানৌকায় চড়ে এ পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে যে যাত্রা, খেয়ানৌকার মাঝির জন্য কিছু তো দিতে হবে। কেউ কেউ মরদেহের সঙ্গে প্রচুর মুদ্রা এবং তাবিজকবচ দিয়ে দেয়, যাতে পরপারে মৃত ব্যক্তি শান্তিতে থাকেন। গোরদেবতা হেইডেসকে উদ্দেশ করে মৃত ব্যক্তির শান্তির জন্য সাধ্যমতো কাগজ, কাপড়, তাম্রপত্র কিংবা স্বর্ণপাত্রে পত্র লিখে দেয়। এ রকম একটা হিপ্পনেয়নে দেওয়া হয়েছে স্বর্ণপাত্রে। স্মৃতি সংরক্ষণ বা স্মারক হিসেবেও এটা কাজ করে। মৃত ব্যক্তির জন্য স্টেলেস তৈরি করে দেওয়া হয়। এতে নানা রকম মানুষ, জীবজন্তু ও দেবতার দৃশ্য ফলকচিত্রের মতো শোভা পায়। এগুলোর মধ্যে হেইডেসের ছবি বেশি থাকে।

মরদেহ প্রস্তুতির পর একদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে দিতে হয়। একজন মহিলা আত্মীয় নিজেকে ঢোলাঢিলা কালো বস্ত্রে আবৃত করে মরদেহের শকটের চারদিকে ঘুরবেন। আরেকজন আত্মীয় স্বামী বা স্ত্রী অথবা মা প্রধান শোককারী হিসেবে সামনে থাকবেন, বাকিরা পেছনে। তাই আমাদের দুজন মানুষ (একজন অবশ্যই মহিলা, দুইজন হওয়াই ভালো) লাগবে। তাদের নানা বিষয়ে ধারণা দিতে হবে।

শোকটা শুরু হবে ভদ্রমহিলাদের নেতৃত্বে। এরা শোক করবে তাদের চুল, বস্ত্র, বিশেষ করে বক্ষদেশের আবরণ ছিন্ন করে। হাত-পা-মস্তকবিহীন মানুষের জন্য এ শোক। এটি আগে বাইরে হতো লোকসমক্ষে। সলোন এক ডিক্রিতে তা বন্ধ করে ঘরের ভেতর পালনের নির্দেশ দেন। এখন ঘরের ভেতরেই তা হবে। একে প্রোথেসিস বলা হয়। তৃতীয় দিনের আগেই শবযাত্রা নিয়ে প্রস্তুতি শুরু হয়। কে কে অংশ নেবে, কোন অবস্থানে থাকবে—এসব নির্ধারণ করা হয়। এ কাজটি সম্পর্কে আমাদের আগেভাগে ভেবে রাখতে হবে।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় অনেক কিছু দিতে হয়। আর তা দেন মৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয় ও প্রিয়জনরা। ঘি বা মধুজাতীয় দ্রব্য এবং নিজ দেহের শান্তিক রক্ত হচ্ছে এগুলোর মধ্যে অন্যতম, প্রধান শোককারীর একগুচ্ছ চুল, যাতে মেখে দেওয়া হয় মধু, জল, মদ, সুগন্ধি এবং নানা রকম তৈল। এসব উৎসর্গ করতে গিয়ে প্রার্থনা করতে হয়। একেকটি জিনিস আবার আলাদা আলাদা পাত্রে সমাধির মধ্যে রেখে আসতে হয়।

সুবন্ধু বললেন, পরিমাণ?

ইচ্ছেমতো। তবে যে পাত্রগুলোয় এসব দ্রব্য রাখা হয়, তার ঐতিহ্য রয়েছে।

মরদেহ কারা বহন করে কবরে নামাবে?

শকটে তোলা এবং নামানোর কাজ মহিলারাই করবে। আরেকটি বিষয়, শবযাত্রাকালে শেষযাত্রার স্তবসংগীত গাইতে হবে। তাও মেয়েদের গাইতে হয়। তবে পুরুষেরা অংশ নিতে পারে।

আচার্য ভদ্রবাহু বললেন, সম্রাজ্ঞী মৃত্যুকালে নিখিলের বাঁশি শুনতে চেয়েছিলেন। তার শেষ ইচ্ছে কি পূরণ হবে?

এ কথার জবাব পাওয়ার আগেই যুবরাজ বললেন, আচার্য, এখানে একটা রাজকীয় অনুষ্ঠান, বিশেষ করে সামরিক সংস্কৃতির অন্তর্গত কিছু অবশ্যপালনীয় ব্যাপার আছে। দুটো ব্যাপারকে কীভাবে সমন্বয় করা যায়, ভেবে দেখতে হবে।

প্রাক্তন তিনজন গ্রিক সামরিক অফিসার উপস্থিত আছেন। এঁরা বললেন, তা মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, সমন্বয় করে নেওয়া যাবে।

যুবরাজ বললেন, দ্রব্যগুলো রাখার পাত্রের কথা বলছিলেন।

দিদাইমেইয়া বললেন, ভালো কথা মনে করেছেন। তার সঙ্গে তো শুধু পটারিগুলোই যাচ্ছে। রাজপরিবারে এগুলোর সংস্থান থাকে, অথবা সংগ্রহ করে নিতে সমস্যা হয় না। এখানে কোথায় পাবেন? এগুলোতে পিনাক্স করা থাকে। এক্সেকিয়াস ছিলেন এর সেরা পটশিল্পী।

ভদ্ৰবাহু বললেন, আপনারা অঙ্কনের ধারণা দিলে আমাদের শিল্পীরা রাতদিন কাজ করে এঁকে দিতে পারবে। সরোজ তো ভালোই আঁকে, কী বলো সুবন্ধু?

চমৎকার। আর সে পারবে, আচার্য। নামই তো সরোজ পটুয়া।

যুবরাজ বললেন, সবই হবে। রাজকীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে। মহামান্য সম্রাটের পৌছানোর আগেই আমরা প্রস্তুতির সব কাজ শেষ করব। একজন গ্রিক পুরোহিতের প্রয়োজন হবে।

ফাওলিনের বাবা বললেন, এ কাজটি আমিই করতে পারব।

মেগাস্থিনিস বললেন, আপনাকে আমি সহযোগিতা করব।

এখান থেকে উঠে গিয়ে দিদাইমেইয়ারা নিজেরা বসলেন। নিকোমেডেস যেতে চায় নি, সে বেশি ভেঙে পড়েছে। ফাওলিন বলল, এত ভেঙে পোড়ো না, মৃত্যুর ওপর কারও হাত নেই। আমরা চেষ্টা করেছি। স্ট্রেটোনিসকে দেখো কেমন হয়ে গেছেন, দিনরাত খেটে খেটে। তাঁর সঙ্গে শর্মিলা। কত আন্তরিক এঁরা। চলো আমরা যাই। পরিকল্পনাটা চূড়ান্ত করে রাখতে হবে।

অনির্ধারিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হলো, মূল শবযাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন দিদাইমেইয়া। স্ট্রেটোনিস বাকি সব রিচুয়ালের মূল দায়িত্বে থাকবেন। এটি তিনি চেয়ে নিয়েছেন। গ্রিক রমণীরা সংখ্যায় কম হওয়ায় তাঁদের সহায়তার জন্য এখানকার রমণীরা চাইলে অংশ নিতে পারবেন। মূল রিচুয়ালে তাঁদের না থাকাই ভালো।

দিদাইমেইয়া বললেন, আমাদের যে মুদ্রাটায় পাখি হাতে বসে থাকা অ্যাপোলোর ছবি আছে, সেটা কর্নির মুখে দেব। আমার কাছে মুদ্রাটি আছে। স্বর্ণমুদ্রা এটি।

সবাই বললেন, কালো কাপড় কোথায় পাব?

ফাওলিনের পিতা বললেন, সংগ্রহ করতে হবে। জেনারেল কিউকেকাস আমার সঙ্গে যাবে।

কিউকেকাস বললেন, সবচেয়ে ভালো হয় একজন দরজি আনিয়ে নিলে।

ঠিক বলেছ, সবারই তো কালো কাপড়ের প্রয়োজন, বললেন লাউডিস।

এ কথা শেষ হতে না হতে সুবন্ধু দুজন দরজি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। বললেন, যুবরাজ বিন্দুসার পাঠিয়েছেন।

যুবরাজের কাছে নিখিল, সরোজ ও ভবদানব তিনজনেরই ডাক পড়ল। সম্রাজ্ঞী তোমাদের খুব ভালোবাসতেন, বলে একটু থামলেন যুবরাজ। পরে আবার বললেন, মৃত্যুর আগে তিনি নিখিলের বাঁশি শুনতে চেয়েছিলেন।

ভবদানব বললেন, তিনি আমাকে একটি কথা বলে গেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর সমাধিসৌধটা যেন আমি নির্মাণ করি। এ কথা শুনে আমি চিৎকার করে উঠি।

তুমি সমাধিসৌধ নির্মাণের সুযোগ পাবে। সরোজকে বললেন, সরোজ, তোমাকে কতগুলো পটচিত্র আঁকতে হবে। তুমি এখনই দিদাইমেইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তোমার হাতে ওটা কী?

সরোজ একটা ছবি এঁকেছে। সম্রাজ্ঞীর অসুস্থতার ছবি। যুবরাজ বললেন, আমাকে দেবে?

সরোজ এগিয়ে দিল। ছবিটার দিকে তাকিয়ে যুবরাজের চক্ষু স্থির হয়ে গেল। বাস্তবতার এমন রূপায়ণ তিনি আর কখনো দেখেন নি। একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাসও ভেতর থেকে বের হয়ে এল। বললেন, তোমরা এখন যাও। সুবন্ধু তোমাদের কাজ বুঝিয়ে দেবেন।

এরা চলে যাওয়ার পর সুবন্ধু একটি বড় সোনার পাত ও কলমিকে নিয়ে এলেন। তাকে বললেন, লেখাটা ওরা দেবেন। প্রয়োজনবোধে পাতটা আরও বড় করে নেবে, কিন্তু খুবই সুন্দর হতে হবে।

যুবরাজ, সমাধি স্মারকের জন্য শিল্পীকে বলেছি আসতে। আমি ওদের কাছে নিয়ে যাব? সরোজের কাছে নিয়ে যাবে। ভবদানব সাথে থাকলে ভালো হয়। আরেকটা কথা। আমরা সমাধির ভেতর অনেকগুলো স্বর্ণমুদ্রা দিতে চাই।

মুদ্রা দিয়ে কী হবে?

সমাধিতে দেব। সামর্থ্য থাকলে ওরাই দিতেন। সম্রাট জানলে নিজেই দিতে চাইবেন। ব্যবস্থা করে রাখবেন। আর কিছু করার প্রয়োজন আছে কি না, মেগাস্থিনিস থেকে জেনে নেবেন এবং আমাকে জানাবেন। কোনো কিছুর কমতি যাতে না হয়।

এরা সবাই চলে গেলে একদৃষ্টিতে ছবিটির প্রতি তাকিয়ে থাকলেন বিন্দুসার। মাকে দেখেন নি, এ মায়ের অকালপ্রয়াণে বুক ভেঙে যাচ্ছে তাঁর। যুবরাজদের কাঁদতে নেই। কিন্তু স্মৃতি তো মানুষকে কাঁদায়, যুবরাজের হয়তো অন্তরই কাঁদছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *