১০৪
চন্দ্ৰগুপ্ত এত লাশ দেখে, তাদের নাম শুনতে শুনতে উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেছেন। তাঁর কথা আর ঘন ঘন চোখের পলক পড়ায় অস্থিরতা টের পাওয়া যায়। চাণক্য তার অর্থ বোঝেন। একটা চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাঁর সময়। সম্রাট কি তাহলে বিন্দুসারের কথাতেই ঘুরপাক খাচ্ছেন? বিন্দুসার বিশ্বাস করে নি এত সৈন্য আছে আদিবাসী রাজার। এ সূত্রেই বিন্দুসার বের করে ফেলেন এখানে কোনো গোলমাল আছে। তক্ষশীলায় পড়ুয়া ছেলে। নতুন সম্রাজ্ঞী হিরে চেনে। সে-ও হাত করে নিয়েছে বিন্দুসারকে। আমার কর্তৃত্ব থাকল কোথায়? ব্যাটারা বেশি লোক মেরে ফেলেছে। এসব ভাবছিলেন চাণক্য। একেবারে হতাশ না হয়ে ভাবলেন, অনেক সংকট পাড়ি দিয়ে এসেছি, এটাও পারব। এ রকম ভাবনার মধ্যে নিজেই সান্ত্বনা খুঁজে পেলেন। সম্রাটের কাছে গিয়ে বললেন, সামরিক তত্ত্বাবধায়কদের এই দায়িত্ব দিয়ে সম্রাট একটু বিশ্রাম নিন।
অস্থিরতার মধ্যেও নিজেকে সামলে নেওয়ার ক্ষমতা চন্দ্রগুপ্তের আছে। বললেন, দায়িত্বটা সম্রাটের। মহামন্ত্রী কিংবা অন্য কারও নয়। ওরা আমাকে সহযোগিতা করছে, করুক।
বিন্দুসার বলেছিল, সাধারণ প্রজা, যারা সৈন্য নয়, যুদ্ধ করে না, তাদের রক্ষার দায়িত্ব বিজয়ী সম্রাটের। তিনি তাদের রক্ষা করতে পারলেন কোথায়।
এ কাজে বিরতি দিয়ে সম্রাট মহামন্ত্রী, সেনাপ্রধান ও সামরিক তত্ত্বাবধায়কদের নিয়ে বসলেন। বললেন, আমাদের সৈন্যরা এখানকার যে ধন-সম্পদ লুট করেছে, সবগুলো রাজপ্রাসাদে জমা করবে।
চাণক্য বললেন, মহামান্য সম্রাট, রাজকোষের চাবি আমার কাছে। এখানে অনেক সম্পদ। আপনি চাইলে এ সম্পদ বিলি করা যায়।
আমি তো সম্পদ বিলিবণ্টনের কথা বলি নি, জমা করতে বলেছি। পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কী করা যায়। এখানে লোকজন কোথায়? সবাইকে তো মেরে ফেলেছেন, সম্পদ কাদের মধ্যে বিলি করবেন?
মহামন্ত্রী চুপ করে গেলেন। এত বুদ্ধিমান মানুষও মাঝেমধ্যে এমন ভুল করে ফেলেন। বলতে যাচ্ছিলেন, এরা আমাদের সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু বললেন না। পরিস্থিতিটা ঠিক বুঝতে পারছেন না তিনি। প্রধান সেনাপতি বিজয়গুপ্তকে ডেকে নিয়ে বললেন, কোনো হাঙ্গামা ছাড়াই সৈন্যদের কাছ থেকে লুট করা সম্পদ নিয়ে নিতে হবে।
সেনাপ্রধান বললেন, বহুদিন পর বিজয় লাভ করেছে সৈন্যরা, লুট করা সম্পদ কি দিতে চাইবে, আচার্য?
যা বলছি করো, সাবধানে করবে, কোনো হাঙ্গামা বাধাবে না। সম্রাট সবই বুঝে গেছে, কী ফল দাঁড়ায় বলা শক্ত।
সংকটের সময়টা পার করে দিন, মহামন্ত্রী, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
তাই যেন হয়। শোনো, ওরা চাইলে কিছু সম্পদ রেখে দিতে পারে। আমি সামলে নেব। এখন যাও দ্রুত ব্যবস্থা নাও। মরদেহগুলোর অবস্থা কী?
আচার্য, এতসংখ্যক মরদেহ কখনো দেখি নি। সামলানো মুশকিল। সম্রাট সব কথা জানেন না। প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ।
প্রবীণ লোকটিকে আবার ডাকলেন সম্রাট। তিনি তাঁর লোকজন নিয়ে এলেন। সম্রাট বললেন, যা হওয়ার হয়ে গেছে। যারা চলে গেছে, এরা আর ফিরে আসবে না। যারা বেঁচে আছে, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা আমি করব। এ ব্যাপারে আমার লোকদের আপনি সহযোগিতা করবেন। আমাকে ভুল বলা হয়েছিল যে এখানে একজন অত্যাচারী রাজা রাজত্ব করছেন, তার তিন লাখের বেশি সৈন্যসামন্ত রয়েছে। তিনি মৌর্য সাম্রাজ্য আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি কিছু বাজে স্বপ্ন দেখে আরও বেশি যুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে পড়ি। এখন আমি সব বুঝতে পারি। কিন্তু অনেক ক্ষতি তো হয়েই গেল। মরদেহগুলোর সৎকার, দুস্থ লোকদের পুনর্বাসন করে আমরা চলে যাব। আপনারা রাজ্য পরিচালনার ব্যবস্থা নেবেন।
প্রবীণ লোকটি বললেন, না সম্রাট, আপনারা যাবেন না। আমি আপনার মহানুভবতা বুঝতে পেরেছি। আপনারা চলে গেলে রাজার অভাবে এখানে অরাজকতা সৃষ্টি হবে। এখানে এমন কেউ নেই যে রাজ্য চালানোর ক্ষমতা রাখে। অমরাবতী সুন্দর জায়গা। জীবন এখানে সমৃদ্ধ। শুধু ধন- সম্পদ লুট করে নিয়ে গেলে তেমন ক্ষতি হতো না। এখানে সমুদ্র আর বন্ধুর পাহাড়ি প্রকৃতি এত সম্পদ দিয়েছে যে তা ফুরোবার নয়। আমি জানি, আবার সবাই (যারা বেঁচে আছে) মাজা সোজা করে দাঁড়াবে। সামাজিক ও রাজনৈতিক সুশৃঙ্খল অবস্থা বজায় না থাকলে তা সম্ভব হবে না। আমি এখানে মৌর্যদের শাসন চাচ্ছি।
তাঁর কথায় সম্রাট মত পরিবর্তন করলেন। ভাবলেন, এ রাজ্যটিকে পুনর্গঠিত করেই তবে তিনি পাটালিপুত্রে ফিরে যাবেন। পুনর্গঠনের কাজ তিনি মহামন্ত্রী চাণক্যকেই দিলেন। চাণক্য অবস্থা বুঝতে পারেন। সময় ক্ষেপণ না করেই অন্ধ্র পুনর্গঠনের কাজে নেমে পড়লেন। স্থানীয় প্রবীণ লোকটিকে সম্রাট মন্ত্রীর সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন। তাঁর পদমর্যাদা উপদেষ্টার সমান।
.
নিখিলের মনে সুখ নেই। দুর্ভিক্ষ আসছে। সম্রাজ্ঞী হেলেন এবং যুবরাজ বিন্দুসার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে। আচার্য ভদ্রবাহু খুবই তৎপর। কারও মনে শান্তি নেই। নিখিল তার দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিল না। একা একা চলে গেল মাঠে, যেখানে এবার বসন্ত উৎসব হয়েছিল। বাঁশের বাঁশি হাতে। একটি করুণ সুর তুলল সে। আস্তে আস্তে সুরটা চড়া হলো। পাটালিপুত্রের সম্রাটের প্রাসাদে পৌঁছে গেল সে সুর। হেলেন বললেন, কী করুণ সুর। নিশ্চয়ই নিখিল। তিনি যাবেন সেখানে। যুবরাজকে ডাকলেন। নিখিলের বন্ধু অঙ্কন এবং মঞ্চশিল্পী ছুটে গেল। আচার্য ভদ্ৰবাহু শর্মিলাকে বললেন, চলো বাঁশি শুনি। উপাসনার কাজ পরে হবে। রাবণহাথার শিল্পী বাদ্যযন্ত্রটা নিয়ে ছুটলেন, চীনা শিল্পী ছুটে আসতে গিয়ে হোঁচট খেলেন। কিন্তু থামলেন না, কোনোরকমে হাড়ের বারো ছিদ্রের বাঁশিটা সঙ্গে নিলেন।
জ্যোৎস্নারাত। দুর্ভিক্ষের আতঙ্ক। তারপরও মানুষ ছুটছে। আলোকের দিকে যেমন পোকামাকড় ছুটে যায়, তেমনি।
নিখিলের সুরে রাবণহাথা যুক্ত হলো। যুক্ত হলো বারো ছিদ্রের বাঁশি। নিখিলের ভ্রুক্ষেপ নেই। কারও প্রতি তার কোনো কৌতূহল নেই। মেগাস্থিনিস ছুটে এসে বসে গেলেন নিখিলের কাছে। আজ কারও সঙ্গে নয়, একা একা বাঁশি শুনতে ইচ্ছে করছে।
অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেশ দূরে বৃক্ষচ্ছায়ায় কারা যেন উপস্থিত হয়েছে। অস্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু চেনা যায় না।
হেলেন ও যুবরাজ পাশাপাশি বসে গেলেন সাধারণ মানুষের মতোই। নিরাপত্তারক্ষীরা ব্যস্ত হয়ে পড়লে তর্জনীর অনুশাসনে থামালেন বিন্দুসার। অর্থাৎ কোনো রকম শব্দ নয়। কোনো সেবারও দরকার নেই।
পাটালিপুত্র একাত্ম হয়ে গেছে বাঁশির সুরে। বিশাল জ্যোৎস্নারাতের আকাশও যেন তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। স্বর্গ বাদ যাবে কেন? দেবদেবীরা সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে যেন সে বাঁশি শুনছে। একটু দূরে গন্ধরাজের বাগান। সাদা সাদা ফুলে পরিরা যেন আলস্য কাটিয়ে চঞ্চল হয়ে উঠছে। সাদা মেঘের ভেলা এবং গন্ধরাজ ফুলে যাদের অবস্থান, তাদের অবশ্য দেখা যাচ্ছে না, অনুমান করা হচ্ছে, তারা ওখানেই আছে।
আচার্য ভদ্ৰবাহু শর্মিলাকে বললেন, তুমি মেগাস্থিনিসের কাছে গিয়ে বসো। কারণ, তিনি তাঁর চাঞ্চল্য লক্ষ করছিলেন। সলজ্জভাবে শর্মিলা উঠে গেলেন।
মেগাস্থিনিস অভিমান করে আছেন। তাঁর মনঃসংযোগ যেন বাঁশির সুরে। কিন্তু কান খাড়া করে আছেন। শর্মিলা কটু কথা হলেও বলুন তাঁর উদ্দেশে। আজকাল কটু কথা শুনতেই তাঁর বড় সুখ। শর্মিলা বললেন, আমি আপনার দোভাষীর কাজ করার জন্য এখানে এসেছি, অন্য কারণে নয়।
না তাকিয়ে মেগাস্থিনিস বললেন, আপনি কি এখন বাঁশির সুরেরও দোভাষী? ভাষার দোভাষী লাগে, সুরের দোভাষীর প্রয়োজন হয় না। আর যদি করুণ কোনো সুরের হয়, তাহলে তো নয়ই।
তাহলে আমি আসি?
সে আপনার ইচ্ছা।
আমি যাব কেন? এ জায়গাটা তো আপনার একার নয়।
বেশ, বসে বসে বাঁশি শুনুন।
আপনি তো বাঁশি শুনছেন না।
কী করছি আমি?
ভাবছেন, শর্মিলা যদি একটি কটু কথা বলত।
এবার মেগাস্থিনিস অবাক বিস্ময়ে তাকালেন তাঁর দিকে।
অবাক হওয়ার কিছু নেই, ওদিকে তাকিয়ে বাঁশি শুনুন।
নিখিলের কী হয়েছে কে জানে? এত করুণ সুর তার বাঁশিতে, শ্রোতারা যেন আর নিতে পারছে না, কিন্তু সে রাগ পরিবর্তন করছে না সে।
ভারটা হালকা করার জন্য হেলেন বিন্দুসারকে বললেন, তোমার বাবার কোনো সংবাদ পাচ্ছি না, বিন্দু, কী হলো তাঁর, সংবাদ পর্যন্ত পাঠাচ্ছেন না।
বিন্দু পিতার ওপর অভিমান করে আছেন বটে, কিন্তু এ কথা যে তিনি ভাবছেন না, তা নয়। বললেন, কী জানি মা, এত দিনে তো ফলাফল কিছু একটা হয়ে যাওয়ার কথা।
হেলেন বললেন, আমার কিছু ভালো ঠেকছে না। তুমি কাউকে পাঠাও।
সুবন্ধু যাবে?
না, সুবন্ধুর এখানে প্রয়োজন আছে, অন্য কাউকে পাঠাও।
আবার এরা সুরে মনঃসংযোগ স্থাপন করলেন।
নিখিলের কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চ স্বরে রাবণহাথার সংগীতগুরু কী যেন বললেন। নিখিল সুরের মধ্যে একটা নতুন মাত্রা যুক্ত করল। কিছুটা পরিবর্তনে দমবন্ধ হওয়ার ব্যাপারটা কেটে গেল বটে, কিন্তু হৃদয় হরণ করা ভাবটা গেল না। শ্রোতারা এ পৃথিবী ছেড়ে যেন অন্য কোথাও দুঃখে যে সুখ, তাতে ভেসে গেল।
আচার্য ভদ্রবাহু হঠাৎ করে বৃক্ষচ্ছায়ার দিকে দৃষ্টি দিলেন। অন্ধকারে মানুষগুলোকে দেখে ভাবলেন, এরা কারা? কোনো সমস্যা করবে না তো? আবার ভাবলেন, ওরা নয় তো? তিনি এগিয়ে গেলেন, তবে তাদের পেছন দিকে, পাছে তাকে দেখে উঠে চলে যায়।
তিনি যা ভেবেছিলেন, তাই। ওল্টো পায়ের মানুষদের কয়েকজন। বাঁশি শুনে এসেছে। ভদ্রবাহু তাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। এদের কথা বোঝা যায় না, ঠিক পিন আটকে যাওয়া প্রাচীন গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো খুবই পিনপিনে ঘন কথা। ভদ্রবাহু তাতেও সন্তুষ্ট। এরা মানুষের বাজানো বাঁশির সুর শুনে এসেছে। আলোতে যায় না, নিশ্চয়ই আলোর আহ্বানেও সাড়া দেবে একদিন।
বিরক্ত না করে উঠে এলেন তিনি। মনে বড় প্রশান্তি। এ সাফল্যটা মেগাস্থিনিসের। তাঁর ধন্যবাদ পাওয়া উচিত। কিন্তু এখনই দিতে চান না। যেভাবে মন দিয়ে বাঁশি শুনছেন, বিব্ৰত হতে পারেন।
.
মনটা চন্দ্রগুপ্তের ভালো নেই। অমরাবতীর কৃষ্ণা নদীর পাড় ধরে হাঁটতে তাঁর ইচ্ছে করছে। কাছে মোহনা, সমুদ্রে গিয়ে যেখানে নদীর সমুদ্রসংযোগ ঘটেছে। কথা ছিল যুদ্ধজয়ের অপার আনন্দ নিয়ে চাণক্যকে সঙ্গে করে এ জ্যোৎস্নারাতে এখানে আসবেন। একাই এলেন। নিরাপত্তারক্ষীরা নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে তাঁকে অনুসরণ করছে।
তাঁর কাছে মনে হলো জ্যোৎস্না বিগলিত হয়ে জলের সঙ্গে মিশে যেন অবিরাম কাঁদছে। সে কান্নার শব্দ তিনি শুনতে পাচ্ছেন। তাঁর মনে প্রশ্ন জাগল, সৌন্দর্যটা আসলে কি প্রকৃতিতে, না মনে? এ নিঃসঙ্গ সময়ে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য নিয়ে এগিয়ে আসতে পারত, যদি মনের অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হতো। পরিবর্তনটা ঘটাতে পারতেন হেলেন। হেলেনের কথা প্রায় ভুলেই ছিলেন। এসে তাঁকে পত্র লেখা উচিত ছিল। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতা, মৃত্যুর মিছিল তাঁকে ভুলিয়ে দিয়েছে সবকিছু। তাঁর বাহিনীর বিজয় হয়েছে, কিন্তু এ বিজয়ে কোনো গৌরব নেই। গ্লানিবোধ আছে। এই অভিযানের জন্য এত আয়োজন মাসের পর মাস, দিনের পর দিন, এত ব্যয়, এত ত্যাগ, ছেলের সঙ্গে মন-কষাকষি, শুধুই অর্থহীন। ওদের মুখোমুখি দাঁড়াবেন কীভাবে? আর ভদ্রবাহু? চৌদ্দ স্বপ্নের কী অর্থ, কী ব্যাখ্যা দিলেন? তিনি হয়তো ঠিক ব্যাখ্যাই দিয়েছেন, চন্দ্ৰগুপ্ত যুদ্ধের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখেছেন। যুদ্ধ ছাড়াও এ রকম ঘটতে পারে।
সেলুকাসের যুদ্ধের কী খবর, তা-ও তাঁর জানা হলো না। গ্রিস আক্রমণকালে আবার হস্তীবাহিনী লাগবে বলেছিলেন। হয়তো লাগবে না। কিন্তু পত্রে তিনি যে কথা লিখেছেন, তা হজম করা কঠিন। এ রকম বিক্ষিপ্তভাবে ভাবতে ভাবতে সম্রাট হাঁটছেন। একসময় ফিরে এলেন চতুরাশ্বযানের কাছে। মনের ওপর উদাসীন ভাব ভর করেছে। কিন্তু তাঁকে যে আরও পথ পাড়ি দিতে হবে।
.
নিখিলের বাঁশি তখনো শেষ হয় নি। চারদিক নিস্তব্ধ। অত্যন্ত মনঃসংযোগ করে শ্রোতারা তার বাঁশি শুনছে। কেমন করুণ এক সুর, কী বোঝাতে চাইছে সে। কোনো বার্তা কি?
হেলেন লক্ষ করলেন, নিরাপত্তারক্ষীরা কতগুলো লোককে নিয়ে আসছে। দূর থেকে ক্রমান্বয়ে এরা কাছে আসছে। স্পষ্ট হচ্ছে তাদের দেহাবয়ব। মনে হয় চেনা। তার আগেই মেগাস্থিনিস তাদের দেখতে পেয়েছেন। শর্মিলাকে বললেন, চলুন আমরা তাদের স্বাগত জানাই। এ কয় বছরে সবার মধ্যেই দৈহিক পরিবর্তন এসেছে। এ ছাড়া পথের ক্লান্তি আর মানসিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত এরা। দিদাইমেইয়ারা এসে পৌঁছেছেন।
মেগাস্থিনিস তাঁদের পেছনে নিয়ে গেলেন, যাতে দর্শকশ্রোতাদের কোনো অসুবিধা না হয়। শর্মিলা গেলেন হেলেন ও ভদ্রবাহুকে সংবাদ দিতে।
মেগাস্থিনিস এঁদের দেখে চমকিত হলেন। কিন্তু বুঝতে পারলেন না, সবাই এভাবে কেন? পথে কষ্ট হয় নি তো, শুধু এ কথাই জিজ্ঞেস করতে পারলেন। হেলেন বিন্দুসারকে নিয়ে এলেন এবং পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁদের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, বড়ই করুণ অবস্থা। ভদ্ৰবাহু এসে বললেন, চলুন সবাই আমরা ভেতরে গিয়ে কথা বলি। তাঁদের উপস্থিতির আকস্মিকতায় হেলেনও ভুলে গিয়েছিলেন কী বলা উচিত।
নিখিলের বাঁশি বাজছে। তাকে পেছনে ফেলে প্রাসাদের দিকে এঁরা এগিয়ে গেলেন।