মৌর্য – ১০৩

১০৩

ভোরের সূর্য ওঠার আগেই চন্দ্রগুপ্ত দুর্গের বাইরে এসে বসলেন। রাতে চাণক্য বেশির ভাগ লাশ সরিয়ে ফেলার জন্য সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর নির্দেশ পালন করা হয়েছে। তবে রাত জাগার জন্য তাঁকে অনেকটা বিধ্বস্ত দেখা যাচ্ছে। চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আচার্য, আপনাকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।

খুবই সমস্যা গেছে গত রাতে, তাই জাগতে হয়েছে।

কী সমস্যা? আমাকে বলেন নি কেন? আমিও তো জেগেই ছিলাম।

আমি জানতাম না। আমি রাতের বেলায় আপনার ঘুম ভাঙাতে চাই নি।

এখন সমস্যার কথা বলুন।

মহামান্য সম্রাট, বড় একটা দুর্ঘটনা গেছে। পরে চাণক্য আদিবাসী রাজার হত্যাকাণ্ডের কাহিনি পূর্বাপর বয়ান করলেন এবং এমন ভান করলেন যে যেন তিনি মর্মান্তিকভাবে এ ঘটনার জন্য শোক ও দায়গ্রস্ত!

সবাই ভেবেছিলেন সম্রাট খেপে উঠবেন। তিনি তা করলেন না। ঠান্ডা মাথায় বললেন, চলুন আমি ঘটনাস্থল দেখব

মহামান্য সম্রাট, আদিবাসী রাজার মৃতদেহ সেখানে নেই।

কোথায় আছে?

সব আদিবাসী লাশের সঙ্গে।

কেন?

সৈন্যরা বুঝতে পারে নি, রাতের বেলায় ক্লান্ত ও বেসামাল অবস্থায় কাজ করেছে। তাদের পরামর্শ দেওয়ার কেউ ছিল না।

যাক, রাজার মৃতদেহ নিয়ে আসা হোক। আমি দেখতে চাই।

চাণক্য একজন আদিবাসীর মৃতদেহ আনিয়ে তাকে রাজার মৃতদেহ বলে সম্রাটের কাছে উপস্থাপন করলেন।

সম্রাট এ নিয়ে কথা বললেন না। আদিবাসীদের কাছে সম্মানিত, এমন বিজ্ঞ একজন ব্যক্তিকে নিয়ে আসতে বললেন। চাণক্য তাঁর অনুচরদের এ নির্দেশ পালনের জন্য বলতে গেলে সম্রাট বললেন, আচার্য, আপনি ক্লান্ত, সবকিছুতে মাথা খাটাবেন না, আপনি বসুন, আমিই ব্যাপারটা দেখছি।

সম্রাটের চেষ্টায় কাঙ্ক্ষিত একজন ব্যক্তিকে পাওয়া গেল। তিনি অত্যন্ত নির্ভীক। বললেন, মহামান্য সম্রাট, আপনি আমাকে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন, আর কী করার আছে আপনাদের?

আপনি শান্ত হোন, আমরা জানতে চাইছি এ রাজ্যে কি নিয়মিত সেনাবাহিনী নেই?

কেন থাকবে না, সম্রাট? রাজার দুজন দেহরক্ষী আছে। আমরা সোয়া লক্ষ প্রজা এ রাজ্যের অতন্ত্র প্রহরী। সেই বৈদিক যুগ থেকে এভাবে চলছে। রাজা যান, রাজা আসেন। কোনো হাঙ্গামা নেই, বিদ্রোহ নেই, চুরি নেই, ডাকাতি নেই, সবাই সুখে আছি। অন্ধ্রের রাজবংশ আর অমরাবতীর কথা লোকজনের মুখে মুখে। কী অপরাধে রাজা আর এতগুলো লোককে মেরে ফেলা হলো। একজন প্রজার জীবনের বিনিময়ে হলেও অন্ধ্ররাজ্য তিনি (রাজা) আপনার হাতে তুলে দিতেন।

তাঁর বংশের কেউ কি জীবিত আছেন?

আমি জানি না, সম্রাট।

আমরা শুনেছি তিনি প্রজানিপীড়নকারী রাজা ছিলেন। একজন বিদ্রোহী সেনাপতি আমাদের এ সংবাদ দেন।

তাঁকে প্রজাসাধারণের অনুরোধেই রাজা নির্বাসনে পাঠান। তিনি অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে সংশোধন করা যাচ্ছিল না।

তাকে এখানে আনার ব্যবস্থা করুন, আচার্য।

সে তো উল্টো আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে, আপনাকে আমি তা বলেছি।

আচ্ছা, আচ্ছা। পরে সম্রাট প্রবীণ লোকটিকে বললেন, আপনার সঙ্গে আমরা প্রয়াত রাজার মুখ দর্শন করব। আসুন দেখি।

চাণক্য প্রধান সেনাপতির দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকালেন এবং বললেন, মৃতদেহের মুখ দর্শন করে আর কী হবে, সম্রাট?

প্রবীণ লোকটি করুণ চোখে তাকালেন সম্রাটের দিকে। সম্রাট আদেশ করলেন মৃতদেহের মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করে দেখাতে।

প্রবীণ লোকটি নিজেই মুখমণ্ডল উন্মুক্ত করে সরে এসে বললেন, মহামান্য সম্রাট, এ লাশ আমাদের রাজার নয়।

চাণক্য প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, তুমি তোমাদের রাজাকে চেনো?

মন্ত্রী মহোদয়, দীর্ঘকাল তাঁর খেয়েছি, পরেছি, তাঁকে চিনব না, এ কেমন কথা?

আপনার চোখের দৃষ্টি ঠিক নেই।

সম্রাট বললেন, মহামন্ত্রী, এবার থামুন। আমি ব্যাপারটা দেখছি, বলে তিনি প্রবীণ লোকটিকে

সঙ্গে নিয়ে বললেন, আমার সঙ্গে চলুন, প্রয়াত রাজার মৃতদেহ খুঁজে বের করতে হবে। যেতে যেতে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, রাজার বংশধরদেরও খুঁজে বের করতে চাই।

আপনি কি তাদেরও হত্যা করবেন।

না না। আর কাউকে হত্যা করা হবে না।

লাশের দীর্ঘ স্তূপ। সম্রাট বললেন, আপনি আমাকে সাহায্য করুন, প্রকৃত রাজার মৃতদেহ আমার প্রয়োজন। আমি তাঁকে যথাযোগ্য সম্মান জানাব।

আমি খুঁজে বের করছি, সম্রাট, কিন্তু সব মৃত নাগরিকই সম্মান পাওয়ার যোগ্য। নিজের জন্মভূমির জন্য এরা প্রাণ দিয়েছে।

আপনি ঠিক বলেছেন। আদিবাসী লোকদের একত্র করুন, মহামন্ত্রী। এরা তাদের রাজাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবে।

অনেকে গায়ে রক্ত মেখে পড়েছিল। এদেরও পুড়িয়ে ফেলার জন্য স্তূপের মধ্যে ফেলে রাখা হয়েছে। এরা সম্রাটের আশ্বাস পেয়ে উঠে এল। মৃত স্তূপ থেকে জীবন্ত মানুষদের উঠে আসতে দেখে সম্রাট খুবই অবাক হলেন এবং মহামন্ত্রী চাণক্যের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।

চাণক্য প্রবীণ লোকটির উদ্দেশে বললেন, আপনাদের রাজার লাশ শিগগির বের করে আনুন, আমাদের অনেক কাজ।

চন্দ্রগুপ্ত বললেন, মহামন্ত্রী, আপনি আপনার কাজ করুন, আমি এ ব্যাপারটা দেখছি।

.

সেলুকাসের মৃতদেহ দীর্ঘ সময় পড়েছিল। কেউ নিতে আসে নি। সংবাদ পেয়ে আরসিনোয় এসেছেন। সেলুকাসের মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে ফিরে গেছেন, কোনো রকম দুঃখ কিংবা কষ্ট তাঁর চোখে দেখা যায় নি। বরং তাঁর নিজের মনে হয়েছে, এই দেহটির প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। একে টেনে আনা সমস্যা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কিছু নয়, এ ছাড়া কার জন্য এ মরণোত্তর ক্লেশ স্বীকার, যে তার ও সন্তানদের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে? অদ্ভুত মানবচরিত্র!

সেলুসিয়া থেকেও কেউ আসে নি। তাঁর মৃত্যুসংবাদ অনেকে বিশ্বাসও করে নি। তাকে হত্যা করে এমন কারও জন্ম হয়েছে, এ রকম কেউ স্বপ্নেও ভাবে না। বিশ্বাস করেছেন দিদাইমেইয়া। কতগুলো পূর্বালামত তাঁর চোখে ধরা পড়েছে। লাউডিসকে তিনি তা বলেছেনও। তিনি এখন কী করবেন, কোথায় যাবেন, সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। লাউডিসও বাবার কীর্তির কথা জেনে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এখন এদের সবার কাজ একটাই, সেলুসিয়া থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে পড়া। এরা একমুহূর্তের জন্যও এন্টিওকাসের শাসনাধীনে থাকতে চান না। কিন্তু কোথায় যাবেন এঁরা?

অদ্ভুত সংবাদ হলেও সত্য যে তাঁর পূর্ব স্ত্রী স্ট্রেটোনিস এন্টিওকাসকে নিয়ে লাইসেমিয়ায় এসেছেন সেলুকাসের মৃতদেহ নিয়ে যেতে। উদ্দেশ্য দুটি, সৎকার করতে নয়, তাঁর কথামতো এন্টিওকাসকে সেলুকাসের লাশ দেখাতে এবং সেলুসিয়ার লোকজনের আস্থা অর্জন করতে যে আসলে সেলুকাস মৃত। সেলুকাসের মতো পরাক্রমশালী সম্রাটও মরণশীল জীব এবং তাঁর মৃত্যুতে উত্তরাধিকারী এন্টিওকাস ন্যায়সংগতভাবেই সেলুসিড সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আসীন হতে পারেন। সেলুসিয়ার মানুষ তাঁকে ঘৃণা করে। সঙ্গে এন্টিওকাসকেও। কিন্তু ঘৃণার কথা জেনেও তাঁদের মহত্ত্ব প্রকাশের মতো অন্তর আছে, সেলুসিয়ার মানুষ তা জানুক। সম্রাটকে রাজকীয় মর্যাদায়ই সমাহিত করা হবে। পরিকল্পনাটা এত দূর বিস্তৃত যে এন্টিওকাসের কাছে তা প্রথমে বোধগম্য হয় নি। তাঁর মনে হয়েছিল, সেলুসিয়ার বৃদ্ধ রাজার মৃত্যু হয়েছে, এখানে তাঁকে মাটিচাপা দিয়ে গেলেই সব দায়িত্ব শেষ। মৃত রাজাকে রাজধানীতে সমাহিত করা হয় নি এমন ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। এ ছাড়া এটা বলা সহজ যে টলেমি কেরাউনোস মৃতদেহ নিয়ে আসতে দেয় নি, শেয়াল-কুকুরে টানাহেঁচড়া করে খাবে বলে মাটিচাপা দিতে হয়েছে, শর্ত ছিল কবরের ওপর কোনো সমাধিসৌধ নির্মিত হবে না।

.

সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আদিবাসী রাজা আন্ধারেইয়ের মরদেহ খুঁজে পেয়েছেন। এটা তাঁর কাছে বাবার কবর খুঁজে পাওয়ার মতোই একটা বিশাল ব্যাপার। তিনি প্রবীণ লোকটিকে বললেন, রাজকীয় মর্যাদায় রাজার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান হবে। আপনি সবাইকে সংবাদ দিন। সব জীবিত আদিবাসী তাদের মৃত্যুকে তুচ্ছ করে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় হাজির হলো। এরা আদিবাসী রীতি অনুযায়ী আন্তরিকতার সঙ্গে সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করল। সম্রাট এবং তাঁর লোকজন সে আন্তরিকতাপূর্ণ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করলেন। তাঁর প্রতি প্রজাসাধারণের শ্রদ্ধাবোধ ও কর্তব্য প্রত্যক্ষ করে নিজেও গৌরবান্বিত বোধ করলেন। প্রবীণ লোকটিকে বললেন, রাজা এত শ্রদ্ধেয়, এত জনপ্রিয় যে তাঁর প্রতি আমারও শ্রদ্ধা ও গৌরববোধ জাগছে। আমি তাঁকে সামরিক কায়দায় শ্রদ্ধা জানাব।

চাণক্য সম্রাটের ইচ্ছায় তাঁর ইচ্ছার বাইরেও জাঁকজমকপূর্ণভাবে সামরিক কায়দায় আদিবাসী রাজাকে সম্মান জানালেন। সম্রাটের হাতে দেওয়া একটি ফুলের তোড়া রাজার কফিনে শোভা পেল। আদিবাসী লোকজন শোভাযাত্রা করে আন্ধারেইয়ের মরদেহ সমাধিস্থলে নিয়ে গেল।

সম্রাট তাদের বিদায় করে বললেন, এবার দ্বিতীয় কাজ। মহামন্ত্রী, আপনি অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে আসুন!

.

সেলুসিয়ায় সেলুকাসের মরদেহ পৌঁছাতে বেশ সময় লাগছে। জীবিত মানুষের জন্য যে পথটা দুই ঘণ্টার, মৃত মানুষের জন্য কেন যেন তা পাঁচ ঘণ্টার হয়ে যায়। শোভাযাত্রার মতো করে এন্টিওকাস ও স্ট্রেটোনিস মরদেহের পেছন পেছন যাচ্ছেন। তবে হেঁটে নয়, চতুরাশ্বযানে চড়ে। স্ট্রেটোনিসের মনোভাবটা এ রকম যে বিশ্ববাসী দেখো, আমরা আমাদের অপছন্দকারী সম্রাটের জন্য কী করছি। আমাদের দেখে শেখো। বিশেষ করে লাউডিস ও দিদাইমেইয়ার কথা তাঁর মনে এল। তোমরা আমাদের এত ঘৃণা করতে যে মুখ পর্যন্ত দেখতে না, অথচ আমরা? সম্রাট- সম্রাজ্ঞীর পথে পা বাড়িয়েও নিজেদের কর্তব্যকাজে সচেতন আছি, কোনো অবহেলা করি নি।

.

আদিবাসীরা তাদের রাজার সৎকার শেষ করে চিতার আগুন নিভিয়ে দিল। সব ছাই জড়ো করে বিভিন্ন পাত্রে পুরে নিল। প্রায় সবার হাতে ছাইয়ের পাত্র। একদল পাহাড়ের গাত্রে উঠল। বাতাসের মুখে পাত্রটি উপুড় করে তুলে ধরল। পাত্র থেকে ছাই বের হয়ে উড়ে গেল। সমস্ত অন্ধ্রে মিশে গেল ক্রমে ক্রমে।

আরেকটি দল কৃষ্ণা নদীতে নেমে এল। জলস্রোতে একে একে পাত্র থেকে ছাই ঢেলে দিল। চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে এসব ছাই নদীর স্রোতে মিশে গেল। আদিবাসীরা তাদের মতো করে বিদায়সংগীত গাইতে গাইতে যার যার বাড়ি ফিরে গেল।

.

দিদাইমেইয়া সবাইকে নিয়ে বসেছেন। সবাই মানে তাঁর ছেলে নিকোমেডেস, বউ ফাওলিন, ফাওলিনের সদ্য চাকরি ছেড়ে আসা পিতা, লাউডিস, তার মেয়ে হারমিজ, স্বামী জেনারেল কিউকেকাস এবং সেলুকাসের কনিষ্ঠ পত্নী স্ট্রেটোনিস। সেলুকাসের মরদেহ পৌঁছার আগেই তাদের সেলুসিয়া ত্যাগ করে যেতে হবে। কিন্তু এরা যাবেন কোথায়? গ্রিসে, নাকি পাটালিপুত্রে? গ্রিসের দিকে যাওয়ার মত শুধু ফাওলিনের বাবার। বললেন, সেখানে আমাদের পূর্বপুরুষেরা আছেন, গেলে ফেলে দেবেন না। দিদাইমেইয়া বললেন, তা ঠিক আছে ভাই, আমাদের শেষ পর্যন্ত গ্রিসেই যেতে হবে। এত বড় সেলুসিড সাম্রাজ্যের কোথাও ঠাঁই হবে না। তার আগে একবার পাটালিপুত্রে যেতে চাই। কর্নেলিয়াকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদতে চাই। আত্মজ বলে সেই শুধু বেঁচে আছে। হায় অ্যাপোলো! অবশেষে এত কিছু দেখালে তুমি?

লাউডিস বললেন, আমার আরেক ব্যবসায়ী ভাই আছে। তার কথা আমরা সবাই ভুলে গেছি।

দিদাইমেইয়া বললেন, ভুলি নি লাউডিস, ভুলে থাকতে চাই। সে কি কখনো তার পারিবারিক দায়িত্ব পালন করেছে? শুধু ব্যবসা আর টাকা। আমরা এখন পাটালিপুত্রেই যাব। সেখানে থেকে ঠিক করব আমাদের কোথায় যাওয়া উচিত।

ফাওলিনের বাবা আর আপত্তি করলেন না। মনে করলেন, ভারতবর্ষ ঘুরে দেখা যাবে। তারপর গ্রিসে। অবশ্য এতগুলো লোক নিয়ে যাত্রা, ঝুঁকি আছে তাতে।

.

সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত তাঁর দ্বিতীয় অ্যাজেন্ডা নিয়ে বসেছেন। তিনি জীবিত, আহত ও মৃত আদিবাসীদের একটি তালিকা তৈরি করতে চান। উদ্দেশ্য, এদের সাহায্য ও পুনর্বাসন করা। কাজটি কঠিন। সম্রাটের এসব কাজে মন্ত্রী চাণক্য সমর্থন দিচ্ছেন বটে তবে মন থেকে নয়। এ রকম সভায় তিনি ঘুমান অথবা ঘুমের ভান করেন। তাঁর কাছে এসব পাগলামি, যার কোনো অর্থ হয় না। পরাজিত শত্রুর পুনর্বাসন পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। বরং এখন সম্রাটের উচিত ছিল সব ঠিকঠাক করে আন্ধারেইয়ের রাজসিংহাসনে বসে পরা। কথাটা তিনি বললেন সম্রাটকে।

সম্রাট বললেন, আচার্য, আমার সিংহাসন পাটালিপুত্রে।

.

স্ট্রেটোনিস আর এন্টিওকাস পরিকল্পনামতো সেলুকাসের মরদেহ নিয়ে সেলুসিয়ায় পৌঁছে গেলেন। সেলুকাসকে শেষবারের মতো দেখা নিয়ে কারও আগ্রহ দেখা গেল না। লোকসমাগম হলো এন্টিওকাসকে স্বাগত জানানো কিংবা বরণ করে নেওয়ার জন্য। এন্টিওকাস এখানে সক্রিয় হলেন, স্ট্রেটোনিস পরিকল্পিতভাবে আড়ালে চলে গেলেন। সেখান থেকে লক্ষ করলেন কে কী করছে। কারা কারা তাঁদের আগমনকে মেনে নিয়েছে, কারা নেয় নি। এ প্রাসাদের অনেকেই তার পরিচিত। কেউ কেউ বয়োবৃদ্ধ, অবশ্য বয়স হয়েছে প্রায় সবারই।

সেলুসিড সাম্রাজ্যে মূলত সেনাশাসনই কায়েম ছিল। জেনারেল সেলুকাস সেনাপ্রাধান্যে সাম্রাজ্য চালাতেন। বেসামরিক প্রশাসন বস্তুতই অকার্যকর ছিল।

সেলুকাসের জেনারেলরা সবাই এন্টিওকাসের আনুগত্য স্বীকার করে নিলেন। জেনারেল মোলন দৃশ্যত সেনাপ্রধান। জেনারেল কিউকেকাস চাকরি ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে ভারতবর্ষে যাচ্ছেন।

সেলুকাসের মরদেহ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগে সম্রাটের অভিষেক হওয়া রাজকীয় সংস্কৃতির নিয়মাচার। দুই জ্যেষ্ঠ সামরিক অফিসার অনানুষ্ঠানিকভাবে সম্রাটের মুকুট পরিয়ে দিলেন এন্টিওকাসের মাথায়। তবে আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজে স্যালুট করে তাঁকে তাঁরা অভিনন্দন জানালেন। বেসামরিক প্রশাসন এগিয়ে এল তারপরই। কেউ কেউ মুখোশ বদলাল, সেলুকাসের শাসনে বঞ্চিতরা নেতৃত্ব নিতে চাইল।

একটি অনাড়ম্বর লোকদেখানো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেলুকাসকে সমাহিত করা হলো। কিন্তু ইতিহাস কোন বরপুত্রকে আসন করে দেবে, তা নির্ধারণ করার দায়িত্ব এন্টিওকাস কিংবা স্ট্রেটোনিসকে দেয় নি। ইতিহাস অপরাধীদের মার্জনাও করে দেয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, পরবর্তী সময় জিউস নিকেটরের সন্তান হিসেবে সেলুকাস পূজিত হতেন এবং ধ্রুপদি বিশ্বে নানা গল্পকাহিনির নায়ক হিসেবে সেলুকাস বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছিলেন।

.

রাজকীয় বাহনে রাজকীয় নিরাপত্তায় পূর্বে ভারতে এসেছিলেন দিদাইমেইয়ারা। এবার বিশ্বস্ত কিছু অনুচর নিয়ে সাধারণ চতুরাশ্বযানে চেপে আসছেন। পথে নানা ভয়। এন্টিওকাসের ভয়, ডাকাতদের ভয় এবং অবিশ্বাস করা যায় এমন কর্মচারীদের ভয় নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছেন এঁরা। ক্ষমতার রদবদলে বিশৃঙ্খলা হয়, লুটপাট-হাঙ্গামা হয়, পূর্বশত্রুতার শিকার হয় কেউ কেউ। তাতে একধরনের শঙ্কা, অস্থিরতা তৈরি হতে থাকে। ফলে মেজাজ সুস্থির ও নিয়ন্ত্রণে থাকে না।

দিদাইমেইয়া একজন ধীরস্থির মহিলা, এখনকার সংকটে তিনি নিজেও অস্থির। ভাবছেন চন্দ্রগুপ্ত কীভাবে নেবেন তাঁদের। দুঃসময়ে অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। ভারতের দিকে পা বাড়িয়ে ভুল করেন নি তো! সঙ্গে নিকোমেডেসের শ্বশুর, জামাতা জেনারেল কিউকেকাস এবং স্ট্রেটোনিস রয়েছে। কিন্তু এসবকেও ছাপিয়ে উঠল বড় দুশ্চিন্তা যে সেলুসিয়ায় কী ঘটছে। কত কত বছরের স্মৃতি। তাঁর রাগ হলো আরসিনোয়ের ওপর। কী কুক্ষণে জন্ম হয়েছিল তার। সে হয়তো বেঁচে যাবে, নিজের পথ খুঁজে নেবে। কিন্তু সেলুসিয়া কি সুশাসনের পথ দেখবে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *