মৌর্য – ১০১

১০১

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যরা যুদ্ধে চলে গেছেন। হেলেন ও বিন্দুসার চিরাচরিত নিয়মে তাঁদের এগিয়ে দিয়েছেন। দৃশ্যত এঁরা হাসিমুখে বিদায় দিলেও ভেতরে ভেতরে একটু খেদ লেগেই আছে। হেলেন বিন্দুসারকে বুঝিয়ে বললেন, তোমার বাবা খুব টেনশনে আছেন। দুঃস্বপ্নটা তাঁকে তাড়া করছে। তিনি মহামন্ত্রীকে খেপিয়ে দিয়ে অভিযানটা বিভক্ত করে দিতে চান না। যেকোনো বিভক্তি অথবা বিরূপ মনোভাবাপন্ন করে তোলা পরাজয়ের কারণ হতে পারে। আমরা চাই সম্রাট যুদ্ধে জয়লাভ করে ফিরে আসুন।

কিন্তু কি মা জানো, কোথায় যেন সমস্যা আছে, বাবার কাছে কিছু একটা গোপন করা হয়েছে। চতুর মহামন্ত্রী সম্রাটের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করেছেন।

এভাবে বলো না বিন্দু, মহামন্ত্রীর অনেক অবদান আছে মৌর্য সাম্রাজ্যে। তোমার বাবার পেছনেও তাঁর শ্রম কম নয়। তিনি সম্রাটের দুর্বলতার সুযোগ নিলে অন্যায় করবেন।

আসলে বাবাও কি তাঁকে পছন্দ করেন?

আমরা অনেককেই অপছন্দ করি, কিন্তু তাদের আমাদের প্রয়োজন হয়। তোমার মায়ের মৃত্যুতে তোমার বাবা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ।

সুবন্ধুও বলেছেন আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য মহামন্ত্রীই দায়ী।

আমি শুনেছি, তোমাকে বাঁচাতে তোমার মায়ের মৃত্যু অনিবার্য ছিল। তুমি আমাদের কথা শুনে নয়, বিচার-বিবেচনা করে দেখবে কোনটি সঠিক, যৌক্তিক কারণ ছাড়া কাউকে দায়ী কোরো না।

তাই করছি, মা, বলে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন বিন্দুসার।

আচার্য ভদ্রবাহু সবকিছু জানেন। তাঁর বিবেচনা পক্ষপাতহীন, বললেন হেলেন। পরে বললেন, এখনই এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে যেয়ো না, সময় নাও। সঠিক ব্যাপার অবশ্যই জেনে যাবে।

আচার্য ভদ্রবাহু মৌর্যদের যুদ্ধজয়ের জন্য একটি প্রার্থনাসভা পরিচালনা করছেন। বিন্দুসার, মেগাস্থিনিস ও সুবন্ধু তাতে উপস্থিত হয়েছেন। ভদ্রবাহু তাঁদের ইশারায় বসতে বললেন এবং যথানিয়মে প্রার্থনা শেষ করলেন।

আচার্য, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।

এখনই বলবে?

না, আপনি যখন সময় দেবেন।

কী বলবে বিন্দুসার, একটু ভাবিত হলেন ভদ্রবাহু। আবার বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসবে না তো। সে কি আমার সাহায্য চাইছে? বললেন, চলো, ভেতরে চলো। এঁরা এখানেই বসুন। আমি স্থুলভদ্রকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বিন্দুসার সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, আমার মাকে নাকি মহামন্ত্রী হত্যা করেছেন?

কে বলল তোমাকে?

আমি শুনেছি, আচার্য, সত্য কিংবা মিথ্যে যা-ই ঘটে থাকুক, তা আমি জানতে চাই এবং আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।

ঘটনার সময় আমি গান্ধারা প্রাসাদে ছিলাম না। পরে শুনেছি বিষক্রিয়ায় যখন সম্রাজ্ঞীর মৃত্যু আসন্ন, মহামন্ত্রী তোমার মায়ের পেট কেটে তোমাকে বের করে আনেন। পেট কর্তনের উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা।

আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য তাহলে তিনিই দায়ী।

উদ্দেশ্য কী ছিল, তা-ও যাচাই করে দেখো। এ নিয়ে আক্রোশ কিংবা ক্রোধ প্রকাশ না করাই শ্রেয়।

বিন্দুসার উঠে গেলে মেগাস্থিনিস আচার্যের কক্ষে প্রবেশ করলেন।

কী ব্যাপার দূতপ্রবর, নতুন কোনো সংবাদ আছে নাকি?

আমি যুদ্ধের প্রার্থনায় অংশ নিতে এসেছি। প্রার্থনা আমার ভালো লাগে। আমি চাই সম্রাট যুদ্ধে জয়ী হয়ে আসুন।

শর্মিলাকে ডেকে দিই?

না না, তার প্রয়োজন নেই। আপনাকে ও প্রিন্সকে ধন্যবাদ, উল্টো পায়ের লোকদের মানুষ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং এরা এখন লোকালয়ে আছে।

আমি নই, এ ধন্যবাদ সম্রাজ্ঞী ও যুবরাজের- প্রাপ্য। তাঁদের কথায় সম্রাট এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

ভারত ভ্রমণের ওপর আমি একটা বই লিখব।

বেশ তো, লিখুন। কী লিখবেন?

আপনার কথা অবশ্যই লিখব। লিখব আপনি একজন দার্শনিক। ভূত-ভবিষ্যৎ সবই জানেন। আমাদের নাটকে এ রকম একটা চরিত্র আছে, নাম টিরেসিয়াস, ত্রিকালদর্শী

তবে সবকিছু জানতে নেই, জানলেও বলতে নেই, এতে সমস্যা হয়।

ঠিক বলেছেন। মানুষ ভালো-মন্দ না বুঝে কেবল জানতে চায় আর নিয়তির নির্মম জালে জড়ায়। রাজা ইডিপাস জেনেছিলেন তিনি তাঁর মাকে বিয়ে করেছেন। সত্য যত নির্মমই হোক, তা জানতে চান তিনি। জেনে নিজের দুচোখ উপড়ে ফেলেন মায়ের খোঁপার কাঁটা দিয়ে। কী নির্মম, পরে সিথায়েরন পর্বতে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে যান।

অদ্ভুত কাহিনি। সত্মাকে বিয়ে করার মধ্যে কোনো পাপ নেই?

নাটকে আছে। ক্ষমতাশালী রাজা হলে নেই। আপনি কী বোঝাতে চেয়েছেন, আমি বুঝতে পেরেছি। তবে পাপের শাস্তি বংশপরম্পরা চলতে থাকে। কেউ তা খণ্ডাতে পারে না।

এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন বিশাখা। মেগাস্থিনিস চলে গেলে তিনি ভদ্রবাহুর সামনে এসে বললেন, আচার্য, একটা কথা।

বলো, বিশাখা, কী বলতে চাও।

দুটি সংবাদ শুনে মন খারাপ হয়েছে। কোথাও কোথাও দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। মহামারি আকারে আসতে পারে।

সম্রাট এর আগমনবার্তা স্বপ্নে পেয়েছিলেন, আরেকটি কী?

আচার্য স্থলভদ্ৰ।

স্থুলভদ্ৰ কী?

শ্বেতাম্বর জৈন সম্প্রদায় গড়তে চাচ্ছেন।

তোমার কী মত?

আমার মত তা কোনো অবস্থায়ই অনুমোদনযোগ্য নয়।

আচার্য মৃদু হেসে বললেন, সে যদি শ্বেতাম্বর মত বিশ্বাস করে, সে রকম সমাজ গড়তে চায়, আমি আপত্তি করব না।

আমি করব, আচার্য। জৈন সমাজ এই ইস্যুতে বিভক্ত হতে পারে না।

মানুষের মতামতকে আমি সম্মান করি। স্থুলভদ্র তার নিজস্ব মতকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আমি অসহিষ্ণু হব না। তুমিও হতে যেয়ো না।

তার মত চাপিয়ে দিলে?

তা হবে কেন? তুমি তোমার বিশ্বাস ও আচারবহির্ভূত অন্যের মত মানবে কেন? তোমাকে এ কথা কে বলল?

আমি নিজে তাকে বলতে শুনেছি।

দুর্ভিক্ষের কথা কে বলল? সম্রাট যুদ্ধে গেছেন, তাঁর পুত্র কি এসব সামলাতে পারবে? তুমি একটা কাজ করো, শর্মিলাকে পাঠাও। শর্মিলা এলে বললেন, তুমি এখনই সম্রাজ্ঞী এবং যুবরাজকে জানাও আমি প্রাসাদে আসছি, জরুরি কথা আছে। সুবন্ধুও যেন থাকে।

যুবরাজের খুব মাথা ধরেছে। সহ্যশক্তি কম। হেলেন বললেন, যা ঘটে গেছে, তা নিয়ে পড়ে থাকাটা ঠিক নয়। কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটে, মন খারাপ থাকে, কিছু করতে ইচ্ছে করে না। তোমার উচিত এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে কাজে মন দেওয়া। যদিও আমি জানি মায়ের অকাল এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কোনো সন্তানই মেনে নিতে পারে না।

কী করে ভুলে থাকি, মা? মৃত্যুরহস্যটা আমাকে জানতেই হবে।

শর্মিলা এসে আচার্যের আসার সংবাদ দিলেন।

হেলেন বললেন, এ সময় আচার্য? অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটে যায় নি তো? সম্রাট কেমন আছেন? উৎকণ্ঠায় তাঁর শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার অবস্থা। মন্দাকিনীকে ডেকে বললেন, যুবরাজকে খবর পাঠাও। আচার্য কী বলতে চান, তাকেও শুনতে হবে।

শর্মিলা বললেন, তাকে জানানো হয়েছে। এখন হেলেনের মনে হলো সম্রাটের সঙ্গে তাঁরও যাওয়া উচিত ছিল। তাঁর হৃদয় হুহু করে উঠল।

.

চন্দ্রগুপ্তের যুদ্ধশিবির পছন্দ হয়েছে। ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিনি। সঙ্গে মহামন্ত্রী চাণক্য এবং প্রধান সেনাপতি বিজয়গুপ্ত। হঠাৎ প্রধান সেনাপতিকে চন্দ্রগুপ্ত জিজ্ঞেস করলেন, বিজয়, এখান থেকে অমরাবতীর দূরত্ব কত?

বিজয়গুপ্ত মহামন্ত্রীর দিকে তাকালেন। মহামন্ত্রী বললেন, কোনাকুনি হিসাব দেবে। আসলে ব্যাপারটা সে রকম নয়। এখানকার ভৌগোলিক অবস্থা উত্তর ভারত কিংবা পাটালিপুত্রের মতো নয়। পাহাড় আছে, মালভূমি আছে, নদী আছে, নীলগিরি পর্বত, বিন্দপর্বত আছে। এসব পার হতে একে বেঁকে যেতে হবে।

শুনেছিলাম যাত্রাপথে একটা ঝরনা আছে।

গোগেনাকাল ঝরনা।

আমি ঝরনার সৌন্দর্য দেখব। প্রকৃতিতে যে কত কিছু দেখার আছে। সম্রাজ্ঞী সঙ্গে থাকলে আরও ভালো হতো।

তিনি পরে আসবেন। এটি তখন মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে যাবে। নদী গিয়ে পড়েছে সমুদ্রে, সে মোহনা জ্যোৎস্না রাতে যে কত সুন্দর, না দেখলে বোঝানো শক্ত।

আচার্য, আপনি এ দৃশ্য কোথায় দেখলেন?

দেখি নি, কল্পনা করলাম। শুনে চন্দ্রগুপ্ত হাসলেন।

যুদ্ধ অনিবার্য। তবু মহামন্ত্রীর মনে শঙ্কা। তিনি গভীর রাতে তার বিশ্বস্ত এক সেনানায়ককে ডেকে পাঠালেন। তাঁকে ফিসফিস করে বললেন, আসার সময় যা বলেছিলাম,

সঙ্গে করে এনেছ তো?

এনেছি মহামন্ত্ৰী।

বেশ, তোমার দুজন বিশ্বস্ত সৈনিককে পোশাক পরিয়ে নিয়ে এসো।

দুজন সৈন্যকে আদিবাসীদের পোশাক পরিয়ে চাণক্যের সামনে নিয়ে আসা হলো।

চাণক্য বললেন, বেশ সুন্দর হয়েছে। এবার অন্যদেরও পরাও এবং আমাদের শিবির আক্রমণ করাও।

সেনাপতির নেতৃত্বে কতিপয় মৌর্য সৈন্য আদিবাসী সৈন্য সেজে নিজেদের শিবির আক্রমণ করে বসল। তাতে বেশ হইচই ও হাঙ্গামা-হট্টগোল সৃষ্টি হলো। সম্রাটসহ সবাই ঘুম থেকে উঠে ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। মহামন্ত্রী চেঁচামেচি করে পরিবেশকে একেবারে উত্তপ্ত করে তুললেন এবং বললেন, মহামান্য সম্রাট, আমাদের আর বিলম্ব না করে রাতের অন্ধকারেই শত্রুদের আক্রমণ করা উচিত। সব বাহিনীকে একসঙ্গে আক্রমণ করতে হবে। পর্বতবাহিনী, সমতলের পদাতিক বাহিনী, অশ্বারোহী, গজারোহী, রথী, নৌজাহাজ-সব দিক থেকে তাদের আক্রমণ করে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আপনার এবার সামনে থাকার দরকার নেই, পেছন থেকে শক্তি, সাহস ও প্রেরণা জোগাবেন, মহামান্য সম্রাট। আমাদের বাহিনীতে সব ধরনের সৈন্য রয়েছে। শক, কিরাত, কম্বোজ, বাহলিক, পারসিক ও যবন সৈন্যও রয়েছে। এরা যেমন দুর্ধর্ষ, তেমনি চৌকস। উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে এরা। নানা ভাষাভাষী হলেও যুদ্ধে জয়লাভে একেবারে এককাট্টা এবং দৃঢ়সংকল্প। সৈনিকেরা, ঠিক বলেছি কি?

সবাই সমস্বরে বলল, ঠিক ঠিক।

আর দেরি কেন সম্রাট, এবারে আদেশ করুন।

সম্রাট আগ-পাছ না ভেবে আক্রমণ করার আদেশ দিয়ে দিলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *