মৌর্য – পুনশ্চ

পুনশ্চ

১. জৈনসূত্র মতে, প্রায় বার শ বছর পর (৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ) হরিসেনের বৃহৎকথাকোষ, রত্ননন্দীর ভদ্রবাহু চরিত (১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ), মুনিবংশ বায়ুধ্যা (১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং রাজাবলী কথা প্রভৃতি গ্রন্থে বলা হয়েছে, আচার্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বহু বছর সন্ন্যাসী বেশে শ্রাবণাবেলাগোলায় অবস্থানের পর ধর্মীয় উপবাস আচারের (সাল্লেখানা) মধ্য দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। যে পাহাড়ে চন্দ্রগুপ্ত অবস্থান করতেন, তার নাম হয়েছে চন্দ্রগিরি। সেখানে একটি মন্দির আছে, নাম চন্দ্রগুপ্ত বাসাদি। একটি গুহাও আছে, যাকে ভদ্রবাহু গুহা বলা হয়।

রাধাকুমোদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, আচার্য ভদ্রবাহু ও চন্দ্রগুপ্ত মুনি সম্পর্কে সবচেয়ে প্রাচীন লিপিটি হচ্ছে আনুমানিক ৬০০ খ্রিষ্টাব্দের। আনুমানিক ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দুটি লিপিতে (কাবেরীতে পাওয়া) চন্দ্রগিরির কথা বলা আছে। সেখানে ভদ্রবাহু ও চন্দ্রগুপ্তের পদচিহ্ন রয়েছে। শ্রাবণাবেলাগোলা লিপিতে (১১২৯ খ্রিষ্টাব্দ) ভদ্রবাহুকে শ্রুতকেবলী ও চন্দ্রগুপ্তকে বনদেবতার পূজ্য বলা হয়েছে। ১১৬৩ খ্রিষ্টাব্দের একটি লিপিতেও অনুরূপ বর্ণনা আছে। ১৪৩২ খ্রিষ্টাব্দের আরেকটি লিপি বলছে, যতীন্দ্রভদ্রবাহুর শিষ্য চন্দ্রগুপ্ত প্রায়শ্চিত্ত করণার্থে এখানে ছিলেন।

২. চতুর্থ শতকে (মতান্তরে অষ্টম শতক) বিশাখা দত্ত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নিয়ে ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটক লেখেন। উনিশ শতকে তাঁকে নিয়ে ডি এল রায়ও একটি ঐতিহাসিক নাটক লেখেন। দুটি নাটকেই চাণক্যের চরিত্রকে নেগেটিভ চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। জনশ্রুতি ও অর্থশাস্ত্রের লেখক হিসেবে আচার্য চাণক্যের যে সম্মানজনক অবস্থান ও প্রভাব থাকার কথা, নাটক দুটোয় তা দেখা যায় না। মন্ত্রী আর তক্ষশীলার শিক্ষাগুরু আচার্য চাণক্যকে নাটকগুলোয় বিপরীতমুখী মনে হয়েছে।

৩. চাণক্যের মৃত্যু হয়েছে করুণভাবে। বিন্দুসার সম্রাট হওয়ার পর মায়ের মৃত্যুর জন্য চাণক্যকে দায়ী করেন। তাতে ইন্ধন জোগান মন্ত্রী সুবন্ধু। এতে চাণক্য তাঁর পরিণাম জেনে গিয়ে নিজের ধনসম্পদ দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। নিজে সম্রাটের প্রাসাদের বাইরে মলমূত্রের একটি স্তূপ তৈরি করে এর ওপরে ধ্যান করতে বসে যান। জানা যায়, গভীর রাত্রে সুবন্ধু তাঁর লোকজন দিয়ে চাণক্যকে এখানেই পুড়িয়ে মারেন। চাণক্যের শেষকৃত্য হয়েছিল আজীবিক ধর্মমতে। তাঁর আজীবিক শিষ্য রাধাগুপ্ত সে কাজ সম্পন্ন করেন।

৪. মেগাস্থিনিস কবে ভারতবর্ষ থেকে চলে যান, সে তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। তবে তাঁর পরে দেইমেকাস গ্রিক দূত হয়ে বিন্দুসারের রাজদরবারে আসেন। তাতে মনে করার কারণ আছে যে বিন্দুসার ও এন্টিওকাস তাঁদের পিতার আমলের সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। ডায়োনিসিয়াস অশোকের দরবারে রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছিলেন। তিন প্রজন্মেই গ্রিকরা মৌর্য সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রদূত হয়ে আসেন।

মেগাস্থিনিসের বিবরণকে ঐতিহাসিক দলিল বলে মনে করা হয়। এরিয়ান এ বিবরণকে উচ্চপর্যায়ের বলে অভিহিত করলেও স্ট্রাবো, ডায়োডোরাস ও প্লিনি মেগাস্থিনিসের প্রতি সামান্যই শ্ৰদ্ধা দেখিয়েছেন। প্রথম শতকে জন্ম নেওয়া স্ট্রাবো মেগাস্থিনিস এবং তাঁর স্থলবর্তী রাষ্ট্রদূত দেইমেকাসকে ‘মিথ্যেবাদী’ এবং তাঁদের লেখাকে বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেছেন। বিশেষ করে ভারতের প্রতিষ্ঠাতা হারকিউলিস এবং ডায়োনিসাস এসব কথাকে বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিবিহীন বলে মনে করেন। ভারতে কোনো দাসপ্রথা নেই, মেগাস্থিনিসের এ রকম উক্তিরও সমালোচনা করেছেন অনেকে।

এসব বাদ দিলে ‘ইন্ডিকা’র ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্বীকার করতেই হয়। তবে অবাক ব্যাপার এই যে মেগাস্থিনিস তাঁর ‘ইন্ডিকা’র কোথাও চাণক্যের নাম উল্লেখ করেন নি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *