মেলায় ঝামেলা

মেলায় ঝামেলা

বিকেল পাঁচটা নাগাদ বঙ্গবার্তার অফিসে একবার ঢুঁ মারল দীপক। ভবানী প্রেসের এক অংশে কাঠের পার্টিশন ঘেরা ছোট্ট কুঠুরি। তারই ভিতর বসেন সাপ্তাহিক বঙ্গবার্তা পত্রিকার সম্পাদক শ্রীকুঞ্জবিহারী মাইতি। ভবানী প্রেসেরও মালিক মাইতিমশাই। বছর পঁচিশেকের যুবা দীপক রায় বঙ্গবার্তার একজন সাংবাদিক। কাজটা তার শখের বলা চলে। কারণ সাংবাদিকদের পারিশ্রমিক দেবার সাধ্য নেই বঙ্গবার্তার, বড়জোর মাঝেসাঝে দু-চার টাকা গাড়ি ভাড়া মেলে।

কুঞ্জবিহারী চেয়ারে হেলান দিয়ে দ হয়ে বসে। সামনে টেবিলের ওপর দু-ঠ্যাঙের অর্ধেক ছড়ানো। চোখ আধবোজা। ডান হাতের আঙুলে ধরা খোলা ডটপেন। টেবিলে বিছানো কয়েক পাতা ফুলস্কেপ সাদা কাগজ। আগামী সপ্তাহের জন্য একটি জ্বালাময়ী সম্পাদকীয় ভাবছেন।

ক্যাচ। স্যুইং-ডোরে মৃদু আওয়াজে চোখ খুললেন কুঞ্জবিহারী। দীপক মুন্ডু বাড়িয়েছে দরজা ঠেলে। সম্পাদককে চিন্তামগ্ন দেখে সে কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হয়ে বলল, ‘ঠিক আছে পরে আসব, এই এমনি এসেছিলাম।’

অন্যমনস্ক ভাবে দীপকের পানে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে কুঞ্জবিহারীর থমথমে মুখে খুশির আভা ফোটে। সোজা হয়ে বসতে বসতে বললেন, ‘এস দীপক, তোমার কথাই ভাবছিলাম আজ। কাজ আছে।’

দীপক ঘরে ঢুকে সম্পাদকের সামনে বসল চেয়ারে।

কুঞ্জবিহারী মাঝবয়সী। দৃঢ়কায় শ্যামবর্ণ। বেঁটেখাটো। গোলগাল চোখে প্রখর দৃষ্টি। মাইতিমশাই বাজখাই গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘পাথরচাপুড়ীর মেলায় গেছ কখনো?’

‘না।’ ঘাড় নাড়ে দীপক।

‘কিছু জান মেলাটা সম্বন্ধে? কোথায় হয়? কি উপলক্ষে?’

দীপক আমতা আমতা করে, ‘সিউড়ি শহর থেকে খানিক দূরে হয় শুনেছি। কোনও এক ফকিরের নামে। আর কিছু ঠিক—’ সে চুপ করে যায়।

‘হুঁ’, সিউড়ি থেকে মাইল পাঁচ-ছয় দূরে পাথরচাপুড়ী গ্রামের পাশে মেলা বসে’, জানালেন কুঞ্জবিহারী; ‘মেলার হিস্ট্রিটা ইন্টারেস্টিং। প্রায় দেড়শো বছর আগে এক মুসলমান ফকির এসে পাথরচাপুড়ী গ্রামে বাস করতে থাকেন। ফকিরের নাম ছিল বোধহয় মহবুব শা। কিছু অলৌকিক ক্ষমতার গুণে এবং দাতা হিসেবে তিনি বিখ্যাত হন। ভক্তদের থেকে যা পেতেন সব বিলিয়ে দিতেন গরীব-দুঃখীদের। লোকে তাঁকে তাই নাম দেয় দাতাসাহেব। ১৮৯৮ সালে দাতাসাহেব ওইখানেই দেহত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ১৯১৮ সাল থেকে ওখানে মেলা বসতে শুরু করে। ১০ই চৈত্র দাতা সাহেবের মৃত্যু দিন। সেইদিন মেলা শুরু হয়। অফিসিয়ালি তিন দিন থাকে। অবশ্য ভাঙতে আরও দিন দুয়েক কেটে যায়। প্রথম দিকে ছোট মেলা ছিল। এখন বিরাট ব্যাপার। প্রচুর লোক আসে। অনেক দোকানপাট বসে। হিন্দু মুসলমান সব ধর্মের লোক যায় মেলায়। শুধু বীরভূম নয়, আশেপাশের অন্য জেলা থেকেও লোক যায়। ভক্তরা দাতাসাহেবের সমাধি দর্শন করে। প্রণামী দেয়। আমি প্রায় কুড়ি বছর আগে একবার গিয়েছিলাম পাথরচাপুড়ীর মেলায়। এখন মেলাটা ঢের বড় হয়েছে। আজ ১০ই চৈত্র। অর্থাৎ আজ থেকে মেলা শুরু হলো। পারলে কালই চলে যাও। ঘুরে দেখে এসে লেখ মেলাটার বিষয়ে। স্পেশাল পয়েন্টগুলো নোট করবে। আর যদি’-কুঞ্জবিহারী মূহূর্ত থেমে একবার ভুরু নাচালেন, ‘তেমন কোনও ঝামেলা, মানে ইয়ে কোনও ইন্টারেস্টিং অভিজ্ঞতা হয়ে যায়, স্টোরিটা জমে যাবে।’

‘সিউড়ি গিয়ে বাস চেঞ্জ করে পাথরচাপুড়ী?’ দীপক জানতে চায়।

‘আমি তাই গিছলাম। তবে এখন কিছু বাস এই বোলপুর থেকেই সোজা পাথরচাপুড়ী অবধি যায় মেলার সময়।’ জানালেন কুঞ্জবিহারী।

‘ঠিক আছে যাব কাল।’ দীপক বিদায় নিল।

দীপক পাথরচাপুড়ীর মেলায় যাবে শুনে তার ন্যাওটা দুই ভাইপো ভাইঝি ষোল বছরের ছোটন আর চোদ্দ বছরের ঝুমা আবদার জুড়ল, ‘কাকু, আমরাও যাব তোমার সঙ্গে।’

দীপক ভেবে দেখল, মন্দ নয়। একা একা ঘুরে ব্যাজার হব। এরা দুটোই খুব চালাক চতুর। তার নিজের কাজে বাধা হবে না। বরং গল্পগুজব করে সময়টা ভালই কাটবে। তবু সে ওদের একটু সাবধান করে দেয়, ‘নিয়ে যেতে পারি তবে বেশি ছটফট করা চলবে না। আমার চোখে চোখে থাকতে হবে। শেষে লোকের ভিড়ে হারিয়ে গেলে খুঁজে মরব তা হবে না।’

‘না না কাকু, একদম তোমার লেজ ধরে থাকব।’ ঝুমা সরবে জানায়।

‘কি বললি? কি ধরে থাকবি?’

দীপক চোখ পাকাতেই ঝুমা জিভ কাটে। অমনি ছোটন কাকাকে উসকোয়, ‘দরকার কি ওকে নেবার। মেলার ভিড়ে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া ভারি ঝামেলা। কেবল আগলাও।’

‘থাক থাক তোমায় আর আমার ঝামেলা বইতে হবে না,’ ঝুমা ফোঁস করে, ‘কাকু নেবে না আমায়?’ তার চোখ ছলছল। দীপক তাড়াতাড়ি বলে, ‘বেশ বেশ যাবে দু’জনেই।’ এবার তার আদরের ভাইঝির মুখে হাসি ফোটে।

দুপুর দুটো নাগাদ ছোটন ও ঝুমাকে নিয়ে দীপক পাথরচাপুড়ী পৌঁছল। একা এলে সে সকালেই আসত। কিন্তু ছোটন ঝুমা থাকায় দুপুরের খাওয়াটা সেরে এসেছে। মেলায় কোথায় আবার ভাত খাবে ওদের নিয়ে? এরপর বাসের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। পথে একবার বাস বিগড়েছিল। এই সব কারণে মেলায় পৌঁছতে দেরি হয়ে গেল তাদের।

বাস যেখানে থামে সেখান থেকে মেলায় ঢুকতে মিনিট পাঁচসাত হাঁটতে হয়। বাস থেকে নেমে দীপক থ। এ মেলায় এত ভিড় হয় সে ভাবতে পারেনি। জনস্রোত বইছে দু’মুখো । একদল ঢুকছে মেলায়, অন্যরা বেরিয়ে আসছে। শুষ্ক চৈত্রে মেঠো পথে যাত্রীদের পায়ে পায়ে ওড়া গেরুয়া ধূলোয় মেলার আকাশ কিছুটা ঘোলাটে। নানান বয়সী লোকের ভিড়। কেতাদুরস্ত মানুষ কম। বেশির ভাগই গ্রাম অঞ্চলের গরীব বা মধ্যবিত্ত মানুষ। বাস স্ট্যান্ডের আশেপাশে গোরুর গাড়ি রয়েছে অন্তত শ’খানেক। বেশির ভাগ গাড়ির জোয়াল নামানো, মুখ থুবড়ে রয়েছে। পাশে দাঁড়িয়ে গরুগুলি জাবর কাটছে। গাড়ির কাছাকাছি বসে রান্না করছে বা বিশ্রাম নিচ্ছে অনেক আরোহী। চার-পাঁচখানা প্রাইভেট মোটরগাড়ি এবং কয়েকটা লরি দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে। ধারে কাছে দূরে নানান আকারের তাঁবু পড়েছে অনেক।

তিনজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। একটার পর একটা মিছিল আসছে নানারকম বাজনা বাজাতে বাজাতে। ঢুকে যাচ্ছে মেলায়। প্রত্যেক মিছিলের সঙ্গে ট্রলি-রিক্সা বা ঠেলাগাড়ি। রিক্সা বা ঠেলার ওপর বিছানো সুন্দর সুন্দর চাদর। চাদরের ওপর ছড়ানো রয়েছে গাদা নোট আর খুচরো পয়সা। গাড়িগুলিতে আরও কি সব পোঁটলাপুঁটলি। মিছিলের লোকের হাতেও পোঁটলা, তাছাড়া সঙ্গে নিয়ে চলেছে ছাগল মুরগি খাসি ইত্যাদি।

‘এত মিছিল কোথায় যাচ্ছে কাকু?’ জিজ্ঞেস করে ঝুমা। দীপক পাথরচাপুড়ীর মেলা সম্বন্ধে কিছু খোঁজখবর নিয়ে এসেছিল। তাই জবাবটা আটকাল না। বলল, ‘এরা ভক্ত। যাচ্ছে, দাতাসাহেবের মাজার অর্থাৎ সমাধি দর্শন করতে। সেখানে প্রণাম জানাবে আর টাকাকড়ি সিন্নি নানারকম রাধা খাবার, তাছাড়া মোরগ খাসি ছাগল এইসব উৎসর্গ করবে। শুনেছি নগদে আর জিনিসে মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক টাকার মতন জমা পড়ে দাতাসাহেবের নামে এই মেলার ক’দিনে। চ’ এবার মেলায় ঢুকি।’ দীপক এগোলো।

মেলায় ঢোকার মুখেই এক অদ্ভূত দৃশ্য। পায়ে চলা হাত দশেক চওড়া ধূলিধূসর কাঁচা রাস্তার দু’ধারে সার দিয়ে রয়েছে কয়েক শো ভিখিরি। কানা খোঁড়া রোগগ্রস্ত কে নেই ! নানান বয়সী পুরুষ ও নারী ভিখিরিরা কেউ বসে, কেউ বা মাটিতে শুয়ে। কেউ বিকট চিৎকার করে ভিক্ষে চাইছে। কেউ বা মৃদু কাতর স্বরে সাহায্য প্রার্থনা করছে। ভিক্ষুকদের বেশির ভাগেরই চেহারা করুণ বীভৎস। এই দৃশ্য দেখে ঝুমা তো একদম দীপকের গা ঘেঁষে এল। ভিখিরিদের সামনে রাখা বাটি থালা চটে পয়সা পড়ছে মন্দ নয়। বোঝা যায় দাতাসাহেবের কাছে আগমন উপলক্ষে যাত্রীরা উদার হস্তে দান করে গরীব দুঃখীদের।

দীপকরা মেলায় ঢুকে প্রথমে দাতাসাহেবের সমাধি-সৌধ দর্শন করল। সুন্দর তবে আড়ম্বরহীন মাঝারি আকারের বাড়িটি। এর ভিতরে আছে দাতাসাহেবের কবর। মাজারের ভিতরে রাইরে বেজায় ভিড়। খানিক তফাতে থেকে অল্পক্ষণ মাজার দেখে দীপক ভাইপো ভাইঝিকে নিয়ে মেলায় টহল দিতে লাগল।

বীরভূমে আর পাঁচটা মেলার মতন এখানেও সার্কাস ম্যাজিক নাগরদোলা চিড়িয়াখানা ফোটো তোলার স্টুডিও ইত্যাদি এসেছে। হরেকরকম দোকানপাট। খাবার দোকান প্রচুর। দীপক মাঝে মাঝে কোনও দোকানদার বা কোনও যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে মেলাটা সম্বন্ধে খোঁজ নিতে লাগল।

যেতে যেতে ঝুমা বলল, ‘কাকু, দেখেছ এখানে কত বাতাসার দোকান!’

ব্যাপারটা দীপকেরও নজরে এসেছিল। এক দোকানীকে জিজ্ঞেস করে তারা জানতে পারল যে দাতাসাহেবের ভক্তরা অনেকেই বাতাসা কিনে মাজারে প্রণামী দেয়। তাই এখানে বাতাসার চাহিদা খুব।

ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মন্টুর মুখোমুখি হলো দীপক। মন্টু ওরফে তারাপদ গড়াই সমাচার পত্রিকার সাংবাদিক। সমাচারও সাপ্তাহিক সংবাদপত্র। বোলপুর থেকে প্রকাশিত হয় এবং বঙ্গবার্তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী। মন্টু দীপকেরই বয়সী। তার কাঁধে ব্যাগ ও ক্যামেরা।

‘কি মেলা কভার করতে বুঝি?’ মন্টু বাঁকা হেসে দীপককে জিজ্ঞেস করে।

‘হুঁ, মানে এই বেড়ানো আর রিপোর্টিং দুই। আগে দেখিনি এই মেলা। এরাও ধরল খুব।’ দীপক তার ভাইপো ভাইঝিদের দেখায়।

‘কখন এলে?’

‘একটু আগে।’

‘এঃ দেরি করে ফেললে। আমার তো প্রায় কাজ শেষ। একটু বাদেই ফিরে যাব,’ জানায় মন্টু। ‘মেলা অফিসে গিছলে?’

‘হুঁ, যাব।’ মন্টুকে এড়িয়ে এগোয় দীপক।

মেলা কমিটির প্রৌঢ় সেক্রেটারি ভুরু কুঁচকে জানালেন ‘কোথাকার কাগজ বললেন, বোলপুর? বোলপুরের কাগজকে দিলাম তো সব স্টাটিটিকস্। ফের কেন?’

দীপক বুঝল যে সেক্রেটারি সাহেব মন্টুর কথা বলছেন। সে বলল, ‘আগে যার সঙ্গে কথা বলেছেন সে বোলপুরের বটে তবে অন্য কাগজের রিপোর্টার। আমি বঙ্গবার্তা থেকে আসছি।’

‘ও!’ সেক্রেটারি এবার একটা টেবিলের ডুয়ার খুলে এক তাড়া কাগজ বের করলেন, তাতে টাইপ করা এবং হাতে লেখা নানান ফিরিস্তি। কাগজগুলো দীপকের সামনে ফেলে দিয়ে তিনি বললেন, ‘এতে সব হিসেব আছে। কত দোকান এসেছে। কি কি টাইপ। সার্কাস ম্যাজিক এই সব কটা। গতকাল, আন্দাজ কত লোক এসেছে মেলায়। মেলা কমিটির ফাংশান। কত গেস্ট রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। বলুন কি কি চান?’

কাগজগুলোর ফিরিস্তিতে চোখ বোলাচ্ছে দীপক, সেক্রেটারি বললেন, ‘ফোটো তুলবেন না?’

‘ফোটো!’ দীপক অবাক।

‘হ্যাঁ। আগের রিপোর্টার তো আমাদের মেলা কমিটির ফোটো নিলেন ওঁদের কাগজে ছাপবেন বলে?’ জানান সেক্রেটারি।

দীপক জানে বঙ্গবার্তার মতই সমাচারেও কস্মিনকালে ফোটো ছাপা হয় না। কারণ খরচে পোষায় না। মন্টু ফলস্ দিয়েছে। নিজের জন্য মেলায় ফোটো তুলতে ক্যামেরা এনেছে। সমাচারের জন্য নয়। কিন্তু সে কথা তো আর বলা যায় না এখানে। তাই সে ম্যানেজ দিতে বলল, ‘আমাদের ফোটোগ্রাফার এবার আসতে পারেনি। পরের বছর ফটোসুদ্ধ মেলাটা কভার করব।’

‘ও!’ সেক্রেটারির সুরে কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্য। তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়ে বললেন, ‘আমি যাচ্ছি। জরুরি কাজ আছে একটা। এই সেলিম রইল, মেলা কমিটির মেম্বার। ওকে যা দরকার জিজ্ঞেস করবেন।’

গাঁট্টাগোট্টা বছর কুড়ির এক যুবককে দেখিয়ে সরে পড়লেন সেক্রেটারি।

দীপক সেলিমকে প্রশ্ন করল, ‘সমাচারের রিপোর্টার কি এই সব তথ্যই নিয়েছে?’

‘হ্যাঁ!’ ঘাড় নাড়ে সেলিম।

‘কারও ইন্টারভিউ মানে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলেনি?’

‘সেক্রেটারি সাহেবের সঙ্গে কথা বলছিলেন কিসব, আমি শুনিনি।’ সেলিম কাঁচুমাচু।

দু’চারটে দরকারি তথ্য টুকে নিল দীপক। কিন্তু এই সমস্ত খবর তো সমাচারেও থাকবে। বাড়তি নতুন কিছু চাই। সেলিমকে খুঁচিয়ে দেখল ছেলেটার মগজ বেশ নিরেট। কেবল হেঁ হেঁ করে, মাথা চুলকোয় আর সেই মেলার কাগজপত্র হাতড়ায়। তেমন নতুন কিছুই দিতে পারল না। একে বোধহয় নেহাতই গায়ে খাটার জন্যে কমিটিতে ঢোকানো হয়েছে। খানিক হতাশ হয়েই দীপক মেলা অফিস ছেড়ে ফের ঘুরতে বেরোল।

একটা ম্যাজিকের তাঁবুতে ঢুকল দীপক। ছোট তাঁবুটা প্রায় ভরে গেছে দর্শকে। একটু পরেই শুরু হবে শো। সাদা ফুলপ্যান্ট ও কালো কোট গায়ে, সরু গোঁফ, ব্যাকব্রাস করা চুল, আধা-বয়সী ম্যাজিসিয়ান ভেল্কি দাঁড়িয়ে ছিলেন টিকিট কাউন্টারের কাছে। দীপক তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে নোটবই ও পেন হাতে প্রশ্ন করতে লাগল। যেমন-বাড়ি কোথায়? এর আগে কি এসেছেন এই মেলায়? টিকিট বিক্রি কেমন হচ্ছে? খেলা শিখেছেন কেমন করে? ইত্যাদি।

ম্যাজিসিয়ান উত্তর দিতে দিতে ইতস্তত করে বললেন, ‘আপনি কি খেলা দেখবেন?’

‘দেখতে পারি,’ জানায় দীপক ।

দীপকের সঙ্গে ছোটন আর ঝুমার ওপর এক নজর বুলিয়ে নিয়ে ম্যাজিসিয়ান বললেন, ‘দেখুন স্যার, বোলপুরের কাগজকে আর কিন্তু ফ্রি-পাশ দিতে পারব না। তবে হাপ-ফ্রি দিতে পারি। নইলে লোকসান হয়।’

দীপক বুঝল যে শ্রীমান মন্টু একে ইন্টারভিউ করে গেছে এবং বিনি পয়সায় শো দেখেছে। সে চটে গিয়ে বলল, ‘না না, আমাদের ফ্রি দেবার দরকার নেই। দেখলে টিকিট কেটেই দেখব?’

দীপক ছোটন ও ঝুমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘দেখবি ম্যাজিক?’ কাকার মুড বুঝে ছোটন বলে উঠল, না: এখন থাক, পরে।’

ম্যাজিসিয়ান ভেল্কিকে আপাতত বরবাদ করে দীপক বেরিয়ে এল। একটু বাদেই মন্টুর সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ।

‘কি গিয়েছিলে মেলা অফিসে? আরে ওরা শুধু মামুলি খবর দেয়। কিছু ইন্টারেস্টিং লোক পাকড়ে বরং ইন্টারভিউ কর, স্টোরি জমে যাবে।’ মন্টু মাতব্বরি ঢঙে বলল।

‘তুমি করেছ?’ জানতে চায় দীপক।

‘হুঁ হুঁ করেছি বৈকি?’ মন্টু রহস্যময় মিচকে হাসি দেয়। তারপর একবার আকাশ পানে তাকিয়ে নিয়ে বলে, ‘এবার ফিরব বোলপুরে। সকাল থেকে ঘুরছি। টায়ার্ড। মেঘ করেছে। ঝড় জল আসতে পারে। আচ্ছা গুড বাই।’

দীপক গুম হয়ে রইল কিছুক্ষণ। মনে মনে ভাবল, মন্টু ক্লু-টা ভালই দিয়েছে। কয়েকটা ইন্টারভিউ করতে হবে, বেশ চমকপ্রদ। যাতে সমাচারকে টেক্কা দেওয়া যায়। ভাবতে ভাবতে একটা আইডিয়া তার মাথায় খেলে যায়। ছোটনকে বলল, ‘আয় আমার সঙ্গে।’

ঝুমা বলল, ‘কাকু খিদে পেয়েছে।’

‘এই মিনিট পনেরোয় একটা কাজ সেরে এসে খাওয়া যাবে।’ অগত্যা দীপকের পিছু নিল ছোটন ও ঝুমা।

মেলায় ঢোকার মুখে ভিখিরিদের সারির কাছে এসে দীপক বলল, ‘আমি কয়েকজন ভিখিরির ইন্টারভিউ নেব। দাতাসাহেবের মেলা, ভিখিরিদের জন্য বিখ্যাত। এত ভিখিরি অন্য মেলায় আসে না। দেখি ওদের থেকে ইন্টারেস্টিং কিছু পাই কিনা?’

শুনেই ঝুমা থমকে গিয়ে বলল, ‘কাকু তুমি যাও, আমরা এখানে থাকি।’

ছোটনের ভাব দেখে মালুম হলো, তারও ওখানে যাবার ইচ্ছে নেই। দীপক বলল, ‘বেশ তোরা এখানে অপেক্ষা কর।’ দীপক প্রথমে এক বৃদ্ধা ভিক্ষুকের সামনে গেল। তাকে জিজ্ঞেস করল- ‘কোত্থেকে আসছো?’

‘হুই গাঁ হতে।’ বৃদ্ধা এক দিকে আঙুল দেখায়।

‘ভিক্ষে করচ কেন? কেউ নেই তোমার?’

‘কেউ নেই বাবা, কেউ নেই। আপন নোক সব শত্রুর। বুড়িকে ঠকিয়ে সর্বস্ব নিয়ে এখন কেউ দু’মুঠো খেতে দেয় না।’ —বৃদ্ধা কাঁদতে থাকে এবং কাঁপা কাঁপা দুর্বোধ্য কণ্ঠে নিজের দুঃখের কাহিনী বলে চলে।

দীপক তার কথা কিছুই উদ্ধার করতে পারে না৷ অপ্রস্তুত হয়ে বৃদ্ধাকে পঁচিশ পয়সা দিয়ে সে সরে যায়।

দীপকের নজর পড়ল কাছেই আর একজন ভিখিরির দিকে।

লোকটির শরীর বেশ জোয়ান। বয়স বেশি নয়। মাথাভরা রুক্ষ চুল। রং কালো। সারা গায়ে ধুলো ময়লা। মুখে অযত্নে ছাঁটা পাতলা দাড়ি গোঁফ। পরনে ছেঁড়া ধুতি ও শার্ট। তার বা পায়ে হাঁটুর নিচ থেকে গোছ অবধি নোংরা ন্যাকড়া পেঁচানো ব্যান্ডেজের মতন। নিশ্চয় ঘায়ের ওপর ন্যাকড়া জড়িয়েছে। কারণ ব্যাণ্ডেজ তেলতেলে, তার ভেতর থেকে ফুটে উঠেছে লালচে ছোপ ছোপ। লোকটির পাশে শোয়ানো একটা মোটা লাঠি। লোকটি কুঁজো হয়ে বসেছে। তার ডান পা মাটিতে ছড়ানো, বাঁ পা হাঁটু মুড়ে সামনে তুলে রেখেছে। সে নিচু গলায় কাতর স্বরে মাঝে মাঝে ভিক্ষে চাইছে। করুণ চোখে দেখছে আগন্তুকদের। কখনো বা মাথা নামিয়ে থাকছে। সামনে ভিক্ষাপাত্র, একখানি টিনের থালা।

দীপক ওই ভিখিরিটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার বাড়ি কোথায়?’

ভিখিরিটি বোকার মতন দীপকের মুখ পানে তাকিয়ে থাকে। যেন প্রশ্নটা ধরতে পারেনি।

দীপক ফের জিজ্ঞেস করল।

‘সিউড়ির কাছে।’ ঘড়ঘড়ে চাপা গলায় জানায় লোকটি।

‘পায়ে কি হয়েছে?’

লোকটি নিজের ন্যাকড়া জড়ানো পা-টা দেখে। জবাব দেয় না।

‘কি হয়েছে ঘা?’ জিজ্ঞেস করে দীপক

লোকটি বলে, ‘হ্যাঁ’

‘কি করতে আগে?’

‘আজ্ঞে মজুর খাটতাম।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওষুধ খেয়েছিলে?’

লোকটি চুপ করে থাকে।

দীপক বোঝে ঠিক মতো ডাক্তার দেখানো বা ওষুধ খাওয়া সম্ভব হয়নি ওর। সে জিজ্ঞেস করল, ‘বাড়িতে কে কে আছে?’

‘আছে।’ এর বেশি উত্তর মেলে না। লোকটি ঘাড় নিচু করে থাকে। যেন নিজের পরিচয় দিতে তার বড়ই সঙ্কোচ। হয়তো এই বীভৎস ঘা হওয়ার কারণে নিজের স্বজনরা তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এই ঘায়ের জন্য কাজও জোটে না। ফলে এখন ওর ভিক্ষাবৃত্তি মাত্র সম্বল। তাই বুঝি আগেকার সুস্থ  জীবনের প্রসঙ্গ এড়াতে চায়। লজ্জা পায়। কষ্ট পায়।

দীপক জিজ্ঞেস করল, ‘ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মানে, যে রোগ লিখে দিয়েছিলেন কাগজে সেটা কি আছে? দেখাতে পারবে?’

লোকটি হতাশ ভাবে মাথা নাড়ে।

দীপক বলল, ‘তোমার যদি চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই করবে?’

লোকটি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।

দীপক বুঝল তার কথা ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।

দীপক ভাবে, সিউড়ির ডাক্তার মুখার্জি সৃচিকিৎসক এবং উদার হৃদয়। তিনি দীপককে খুব স্নেহ করেন। দীপক অনুরোধ করলে হয়তো এই লোকটিকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতে রাজী হবেন। যদি এর কুষ্ঠ হয়, কোনও কুষ্ঠ আশ্রমে পাঠাবার ব্যবস্থাও করতে পারেন ডাঃ মুখার্জি। হয়তো একে সারিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারা যাবে ঠিক মতো চিকিৎসা হলে। দরকারে দীপকও চাঁদা তুলে সাহায্য করবে সাধ্য মতো।

তবে এখনই একে বেশি আশা দিতে ভরসা হলো না দীপকের। সে লোকটিকে বলল, ‘তুমি এখানে আছ তো? আমি আসছি, খানিক বাদে, কথা আছে। দেখি কি ব্যবস্থা করতে পারি।’ ভিখিরিটি ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে থাকে।

ভিখিরিদের সাক্ষাৎকার নেবার আর ইচ্ছে হলো না দীপকের। সমাজের এই অসহায় অজ্ঞ মানুষগুলির ইতিবৃত্ত খুঁজলে মন দুঃখে ভরে ওঠে।

মেলায় ঝুমা আর ছোটনকে নিয়ে একটা খাবারের দোকানে ঢুকল দীপক। পেল্লায় সাইজের লেংচার সঙ্গে গরম সিঙ্গাড়া খেল।

ছোটন বলল, ‘আমরা ইলেকট্রিক নাগরদোলায় চড়ব।’

মেলার এক ধারে ইলেকট্রিক নাগরদোলা বসেছে। দীপক বলল, ‘বেশ তোমরা যাও নাগরদোলা চড়তে। আমি যতক্ষণ না যাই, ওখান থেকে আর কোথাও যেও না।’

‘বেশি তাড়াতাড়ি কিন্তু যেও না কাকু’ ঝুমা বলে। অর্থাৎ তারা বেশ খানিকক্ষণ নাগরদোলা চাপতে চায়।

ছোটন ঝুমা চলে গেল। দীপক এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সিউড়ির ডাঃ মুখার্জিকে একটা চিঠি লিখতে লাগল দোকানে বসে। ডাক্তারবাবুকে অনুরোধ জানাল, এই হতভাগ্য ভিখিরিটির চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে, যথাসম্ভব কম খরচে। এই চিঠিটা সে দেবে ওই ক্ষতদুষ্ট ভিখিরিটির হাতে। ঠিকানা দিয়ে বলবে, ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করতে তার চিকিৎসার জন্য। আর সে বোলপুরে ফিরেই একটা চিঠি লিখবে ডাঃ মুখার্জিকে।

মিনিট পঁয়তাল্লিশ বাদে দীপক নাগরদোলার কাছে গিয়ে দেখে যে তখনও দুই মূর্তিমান নাগরদোলায় ঘুরছে। ইলেকট্রিক নাগরদোলার বিশাল চাকা। বসার চেয়ারগুলো যখন টঙে ওঠে তখন যেন গগন ছোঁয়। দীপক হাতছানি দিয়ে এবং বিস্তর ডাকাডাকির পর ঝুমাদের ফের মাটিতে নামাতে পারল।

অন্য লোকটা দেখতে কেমন?

ঝুমা কাছে এসেই বলল, ‘জান কাকু, সেই যে ভিখিরিটা, যার পায়ে ভীষণ ঘা, যাকে তুমি জিজ্ঞেস করছিলে, তাকে দেখলাম। লাঠিতে ভর করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে গিয়ে দূরে একটা ছোট্ট তাঁবুতে ঢুকল। দাদা প্রথমে দেখেনি আমিই প্রথম দেখেছি।’

দীপক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘তাই নাকি! কি করে দেখলি?’

ঝুমা বলল, ‘কেন ওপর থেকে। নাগরদোলায় উঁচুতে বসে গোটা মেলা দেখা যায়। ব্যালান্স ঠিক হচ্ছিল না বলে আমরা অনেকক্ষণ উঁচুতে বসে ছিলাম।’

দীপক বলল, ‘ও বোধহয় ওই তাঁবুতে থাকে রাতে। কিন্তু ও চলে গেল কেন? বললাম ওখানে থাকতে। ওকে বেরুতে দেখলি?’

ছোটন বলল, ‘না তা দেখিনি। তবে নাগরদোলা ঘোরার সময় তো আর ওই তাঁবুটা সবসময় দেখতে পাচ্ছিলাম না। জান কাকু, খানিকবাদে আর একটা লোককে দেখেছি, ওই তাঁবুতে গিয়ে ঢুকল। লোকটাকে দেখে মনে হলো একজন চানাচুরওলা।’

‘এ্যাঃ আরও একজন! চানাচুরগুলা! ওই ভিখিরির সঙ্গে এক তাঁবুতে!’ দীপক রীতিমত অবাক। বলল, ‘চ’ তো দেখি লোকটা ফিরেছে কি না?’

ভিখিরিদের সারিতে গিয়ে দীপক দেখল, সেই পায়ে ঘা লোকটি নেই। ও কি তবে এখনও তাঁবুতে? সে ছোটনদের বলল, ‘চ’, সেই তাঁবুটা দেখা।’

মেলার একদিকের সীমানায় গিয়ে ছোটন দেখাল, ‘ওই তাঁবু।’

মেলার সেদিকে দোকান পাটের সীমানার শেষে কিছু বলদ ও মোষের গাড়ি এবং অল্প কটা তাঁবু কাছাকাছি। এদের থেকে বেশ খানিক তফাতে দূরে একটা গাছের নিচে ছোট্ট একটা তাঁবু। সরু গাছটার গুঁড়িকে মাঝের খুঁটি বানিয়ে ছেঁড়া চট টাঙানো হয়েছে তাঁবুর আকারে।

মিনিট দশেক মেলার সীমানায় দাঁড়িয়ে তাঁবুটা লক্ষ্য করল দীপক। তার মনে একটা সন্দেহ জাগে। কিন্তু ছোটনদের কাছে তা প্রকাশ করল না। সে বলল, ‘ছোটন ঝুমা তোরা একটা কাজ কর। এখানে বসে খানিকক্ষণ ওয়াচ্ কর তাবুটাকে। ওই খড় পড়ে আছে। দু-আঁটি এনে বস। আমি এই ফাঁকে মেলায় গিয়ে কিছু কাজ সেরে আসি। নজর রাখবি সেই ভিখিরিটা বেরোয় কিনা? বেরুলে কোন দিকে যায়। আর কেউ ঢুকলে বা বেরুলেও নজর করবি।’

ঝুমা ব্যাজার হয়ে বলল, ‘কতক্ষণ থাকতে হবে?’

‘বেশিক্ষণ নয়।’

‘মোগলাই পরোটা খাওয়াতে হবে কিন্তু,’ বলল ছোটন।

‘পুতুল নাচ দেখাতে হবে আর একবার নাগরদোলা চাপব।’ ঝুমা যোগ দেয়।

‘বেশ বেশ হবে সব, ঘুরে আসি।’ দীপক চলে যায়।

মেলায় গিয়ে দীপক চটপট দু’জনের সাক্ষাৎকার নিল। প্রথমে এক বৃদ্ধ মুসলমান আগন্তুকের। দুর্গাপুরে থাকেন। প্রতিবারই এই মেলায় আসেন। তিনি একটা নতুন কথা শোনালেন যে এই মেলায় নাকি মাছি আর কুকুর একদম দেখা যায় না। দীপক ভেবে নিল কথাটা যাচাই করব পরে।

এরপর সে এক পাথরের থালা বাটি ইত্যাদি দোকানদারের ইন্টারভিউ নিল।

এরপর দীপক গেল দাতাসাহেবের মাজারের কাছে। কালো আলখাল্লা ও টুপি পরা প্রচুর ফকির সেখানে ভিড় করেছে। দীপক তাদের হাবভাব লক্ষ্য করল। কান পেতে শুনে নোট করে নিল তাদের কিছু কথাবার্তা, আলাপ, পরিচয়। আধঘণ্টাটাক বাদে সে ফের ছোটনদের কাছে হাজির হলো।

ছোটনরা উৎসুকভাবে তাকিয়েছিল তাবুটার দিকে। কাকাকে দেখেই সমম্বরে বলে উঠল, ‘জান সেই চানাচুরগুলা আর অন্য একটা লোক ওই তাঁবু থেকে বেরিয়ে মেলায় গিয়ে ঢুকল। দু’জনা কথা বলতে বলতে যাচ্ছিল।’

‘অন্য লোকটা দেখতে কেমন?’ দীপকের প্রশ্ন।

ঝুমা বলল, ‘লোকটা গুণ্ডা মতন। ধূতি শার্ট পরা। রং ময়লা। মুখ ভাল দেখতে পাইনি এত দূর থেকে, তবে মোটা গোঁফ আছে।’

‘হাইট।’ জানতে চায় দীপক।

‘এই মাঝারি।’

‘দাড়ি আছে?’

‘না।’ ভাই-বোন ঘাড় নাড়ে।

দীপক ভাবে একটুক্ষণ। তারপর সে সোজা চলে যায় তাঁবুটার দিকে। চটের পর্দা সরিয়ে তাঁবুর ভিতরে উঁকি মারে। তাঁবু ফাঁকা, কেউ নেই। সে ফিরে আসে ছোটনদের কাছে।

দীপকের মনে যে সন্দেহটা জাগছিল সেটা দৃঢ় হয়। সে শুনেছে যে অনেকে কানা খোঁড়া ঘেয়ো রুগীর ছদ্মবেশ ধরে ভিখিরি সেজে ভিক্ষে করে। না খেটে এ এক দিব্যি রোজগারের পন্থা। এটাও তেমনি কেস নাকি? পায়ে ঘা সেই লোকটি ভিখিরিদের জায়গায় ফেরেনি। এখানে আসার সময় সে দেখে এসেছে। রহস্যটা অনুসন্ধান করে যদি সত্যি প্রমাণ পায় তাহলে দারুণ একখানা খবর ছাড়া যাবে বঙ্গবার্তায়।

ছোটন আর ঝুমাকে নিয়ে দীপক প্রথমে পুতুল নাচ এবং চিড়িয়াখানা দেখল। এরপর ছোটন ঝুমা দুপাক নাগরদোলা খেল। দীপক নাগরদোলায় উঠল না অবশ্য। ওই ফাঁকে এক কাপ চা খেয়ে নিল।

একটা দোকানে মোগলাই পরোটা ভাজা হচ্ছে দেখে দীপক ছোটনকে একখানা দশ টাকার নোট দিয়ে বলল, ‘তোরা খা। আমি একবার বাসের টাইমটা খোঁজ করে আসি। বোলপুরের বাস কখন কখন আছে? আরও দু’একটা খোঁজ নিতে হবে। খাওয়া হলে, এই দোকানেই অপেক্ষা করিস আমার জন্যে।’

যদিও ঘড়ির সময় মাফিক বিকেল শেষে সন্ধ্যা নামতে তখনো খানিক বাকি কিন্তু আকাশে মেঘ করেছে। দিনের আলো প্রায় নিব্ব নিব্ব। আর দেরি করা উচিত নয়।

দীপক বাস স্ট্যান্ডে মোটেই গেল না। সে প্রথমে ভিখিরিদের জমায়েতে গিয়ে একবার চোখ বোলাল। উঁহু, সে পায়ে ঘা লোকটির পাত্তা নেই। এরপর সে চলল মাঠের মাঝে সেই রহস্যময় তার উদ্দেশ্যে।

পর্দা ফাক করে তাঁবুর মধ্যে উঁকি দিল দীপক । ভিতরে একটা মোমবাতি জ্বলছে এবং একজন লোক মাটিতে বসে। লোকটির সামনে বিছানো একখণ্ড কাপড়ের ওপর একরাশ খুচরো পয়সা। বোধহয় পয়সা গুনছে লোকটি।

লোকটি চমকে মুখ তুলে দীপককে দেখেই খুচরোসুর কাপড়টা নিজের পকেটে পুরে ফেলে কর্কশ স্বরে বলল, ‘কে?’

লোকটাকে এক নজর দেখেই দীপক বুঝে নিয়েছিল, এ সেই লোক। যাকে চানাচুরওলার সঙ্গে তাঁর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিল ঝুমারা। ওদের বর্ণনার সঙ্গে এই লোকটার চেহারা ভীষণ মিলে যাচ্ছে। সে সপ্রতিভ ভাবে তাঁবুর ভিতর পা বাড়িয়ে হেসে বলল, ‘নমস্কার। আমি একজন সাংবাদিক। এই মেলার বিষয়ে খবর নিতে এসেছি। ঘুরতে ঘুরতে এই তাঁবুটা দেখে ভাবলাম, কোনও যাত্রী নিশ্চয়। আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই।’

-‘কে আপনি?’ লোকটি কেমন সন্দিগ্ধ।

-‘বললাম যে রিপোর্টার। মানে সাংবাদিক। মানে কাগজের লোক। খবর যোগাড় করি।’

-‘কি চাই?’

-‘কিছু প্রশ্ন করব যদি উত্তর দেন।’

-‘কি প্রশ্ন?’

-‘মশায়ের নাম?’

উত্তর হয়, ‘রাধাচরণ মণ্ডল।’

-‘কোত্থেকে আসছেন ?’

-‘সাইকিয়া।’

-‘প্রত্যেকবার আসেন এই মেলায়?’

-‘না, মাঝে মাঝে।’

-‘কি জন্য এসেছেন?’

-‘এমনি বেড়াতে।’

দু’চারটে এমনি আলতু-ফালতু প্রশ্ন করতে করতে দীপক লক্ষ্য করল যে যদিও এই লোকটি দাড়ি কামানো, মোটা গোঁফ, তেল চকচকে চুল পাট করে আঁচড়ানো তবুও এর নাক চোয়াল চোখ ইত্যাদি এবং শরীরের গঠনের সঙ্গে সেই পায়ে ঘা ভিখিরিটির মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

রাধাচরণও যেন কিঞ্চিৎ নার্ভাস। দায়সারা গোছের জবাব দিচ্ছে। দীপক ফস্ করে বলে বসল, ‘দুপুরের দিকে একজন ভিখিরি কি এসেছিল আপনার কাছে? তার বা পায়ে ঘা।’

রাধাচরণ কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল। তারপর রাগী চাপা সুরে বলল, ‘হুঁ। আপনি জানলেন কেমন করে?’

-‘এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন, দেখলাম দূর থেকে। এই তাঁবুতে ঢুকল ভিখিরিটি। চেনেন নাকি ওকে?’

-‘হুঁ। আমার মামার বাড়ির গায়ের লোক। ঘা হয়ে এখন ভিক্ষে করে। লোকে বলে কৃষ্ঠ।’

-‘কি করতে এসেছিল?’

—‘কিছু সাহায্য চাইতে। দিলাম। গরীব মানুষ অক্ষম হয়ে গেছে। খেতেও দিলাম কিছু।’

দীপক কিঞ্চিৎ ধন্দে পড়ে। রাধাচরণের বক্তব্য একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।। হয়তো বা ঠিক। এখানে কিছু সাহায্য নিতেই এসেছিল ভিখিরিটি। নাগরদোলায় পাক খাবার ফাঁকে তার চলে যাওয়া দেখতে পায়নি ঝুমারা। তবু রাধাচরণের উসখুস ভাব দেখে সন্দেহ ঘোচে না। তা ছাড়া দুজনের চেহারায় এত সাদৃশ্যই বা কেন?

সহসা দীপকের চোখ আটকে যায় তাঁর এক কোণে। সেখানে মাটিতে কিছু ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া ও কাপড়ের পাড় পড়ে আছে। তেল কালি মাখা ও লাল ছোপ ন্যাকড়াগুলোয়। এমনি ন্যাকড়া ও পাড় দিয়েই তো ভিখিরিটির পা জড়ানো ছিল। সঙ্গে সঙ্গে দীপকের দৃষ্টি চলে যায় রাধাচরণের বা পায়ের দিকে। হাঁটুর নিচে যেটুকু পা বেরিয়ে আছে তা মোটামুটি পরিষ্কার হলেও তাতে যেন অস্পষ্ট কালছে ছোপ জায়গায় জায়গায়। এই সময় রাধাচরণ চট করে তার বা পা ধৃতি টেনে ঢেকে দিল।

রাধাচরণের সঙ্গে খেজুরে আলাপ চালাতে চালাতে এবং নোট বইয়ে ইন্টারভিউ লেখার ভান করার ফাঁকে দীপক দ্রুত চিন্তা করে আসল কথাটা কি ভাবে পাড়া যায়? সোজাসুজি চার্জ করব কি? কি ভাই তুমিই না ভিখিরি সেজে বসেছিলে? পায়ে নকল ঘা বানিয়ে। হুঁ ঠিক চিনেছি।

লোকটা কি চটে গিয়ে তেড়ে উঠবে? মারতে আসবে? তাতে অবশ্য ভয় পায় না দীপক। ওর আক্রমণের মোকাবিলার শক্তি সে রাখে। তবে তেড়েফুড়ে ওঠার চেয়ে ওর ঘাবড়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। তখন চাপ দিয়ে আসল ব্যাপার টেনে বের করা যাবে। বরং আশ্বাস দেব, যদি আপত্তি থাকে কাগজে ছাপব না তোমার গপ্পো। শুধু এই নকল ভিখিরিদের ব্যাপারটা জানতে চাই। এদের কায়দা কানুন। রোজগার। স্রেফ আমার ব্যক্তিগত কৌতূহল।

অবশ্য এমন ইন্টারেস্টিং স্টোরি পেলে কি আর না ছাপা যায়। শুনে নিয়ে এখান থেকে চলে যাওয়ার পর কে আর রুখছে তাকে। আর এ লোকটাও কি আর ওর সত্যি পরিচয় দেবে? কক্ষণো নয়। এখানে সেজেছে ঘেয়ো রুগী। অন্য কোথাও হয়তো বনে যাবে বোবা কালা। ছদ্মবেশও পাল্টাবে। লোক ঠকানোর অপরাধে পুলিশ ওর হদিসই পাবে না। তবে হ্যাঁ, যদি ওর কথা শোনায়, দীপক এখানে ওর নামে পুলিশে নালিশ করবে না। সেটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ তার আছে।

মৃদু খসখস আওয়াজ আসে কানে। লেখা থেকে মাথা তুলে দীপক দেখলো, রাধাচরণ কেমন বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। তার নজর দীপকের ঘাড়ের ওপর দিয়ে নিবদ্ধ। দীপক পিছু ফেরার আগেই সে মাথার পেছনে এক প্রচণ্ড আঘাত পেল এবং সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল।

দীপক যখন চেতনা ফিরে পেল তখন তাঁবুর ভিতর অন্ধকার। বাইরে তখনো পুরোপুরি রাত নামেনি। তাঁবুর কাপড়ের ফাঁক দিয়ে আবছা দিনের আলো চোখে পড়ল।

দীপক পাশ ফিরে সটান পড়ে আছে মাটিতে। তার পা দুটো বাধা। দুই হাত পিছমোড়া করে বাধা। মুখও বাধা।

হাঁ-এর ভিতর কাপড় ঠুসে দেওয়া হয়েছে। তাঁবুতে আর কেউ নেই।

নড়াচড়া করতে গিয়ে দীপক টের পেল যে তাঁবুর মাঝে গাছের গুঁড়ির সঙ্গে তার কোমরের কাছে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাধা রয়েছে। অর্থাৎ বেশি নড়াচড়া করা বা চেঁচানোর উপায় নেই। অতি অসহায় অবস্থা।

দীপক প্রাণপণে চেষ্টা করে বাধনমুক্ত হতে। কিন্তু তার ছটফটানিই সার হয়। দড়ির গিঁট আলগা করতে পারে না। গলা দিয়ে চাপা গোঁ গোঁ আওয়াজ বের করতে পারে শুধু। কিন্তু এই নিরালায় সে আওয়াজ কি কারও কানে পৌঁছবে? কেউ কি এগিয়ে আসবে তাকে উদ্ধার করতে? এভাবে কতক্ষণ কাটবে কে জানে? বাইরের আলো ক্রমে আরও ম্লান হয়ে আসে।

খানিকক্ষণ এইভাবে কাটে। হঠাৎ তাবুর পর্দা সরিয়ে একটা মুখ উঁকি দিল ভিতরে। আবছায়ায় দেখে দীপকের মনে হলো ও মুখ ছোটনের। সে আপ্রাণ চেষ্টায় ডাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু একটা গোঙানির মতোন আওয়াজ মাত্র বের হয়। চট করে মাথা টেনে নেয় ছোটন, বোধহয় ভয় পেয়ে।

দীপক মাটিতে মুখ ঘষে মুখের বাধন আলগা করে ফেলল। ছড়ে গেল তার গাল, ঠোঁট থুতনি। কিন্তু তখন সে মরিয়া। কোনোরকমে মুখের ভিতরে গোঁজা ন্যাকড়ার পিণ্ড খানিকটা উগরে ফেলে সে আর্ত বিকৃত কণ্ঠে ডাক দিল, ‘ছোটন।’ এরপরই কাশতে কাশতে যেন তার দম আটকে আসে।

ছোটন দৌড়ে ঢুকল তাবুতে। দীপকের গলা সে ঠিক চিনেছে। ডাকল—‘কাকু।’

দীপক কাশি সামলে বলল, ‘খুলে দে। হাত পা বাঁধা।’

ছোটন অন্ধকারে হাতড়ায় বাধন খুলতে।

‘আমার প্যান্টের পকেটে দেশলাই আছে।’ জানায় দীপক।

দেশলাইয়ের আলোয় কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল।

বাঁধনমুক্ত হয়ে বসে হাঁপায় দীপক। হাত পা মুখে আঙুল বোলায় বাঁধনের জায়গাগুলোয়। ছাল উঠে গিয়ে মুখ ভীষণ জ্বলছে।

‘একি তোমায় এরকম করল কে?’ আতঙ্কে উত্তেজনায় ছোটন হতভম্ব।

দীপক সংক্ষেপে জানায় তার এই দুরবস্হার কাহিনী। বলে, ‘পেছন থেকে যে কে মারল দেখতে পাইনি। তবে তাঁবুর লোকটাই নকল ভিখিরি সন্দেহ নেই। ইস শয়তানটার আর বোধহয় পাত্তা পাওয়া যাবে না। কিন্তু তুই এখানে এলি কি করে? ঝুমা কৈ?’

দীপকের কথার জবাব না দিয়ে ছোটন উত্তেজিত ভাবে বলে ওঠে—‘জান সেই চানাচুরগুলাটাকে দেখলাম বাস স্ট্যাণ্ডে, একটু আগে। ওর সঙ্গে একটা লোক ছিল। তবে আগের লোকটা নয়, অন্য লোক। দাঁড়ি আছে, ছুঁচলো মতোন। লুঙ্গি জামা পরা। মাথায় মুসলমানী টুপি, সাদা রঙের। দু’জনে চা খাচ্ছিল।’

‘এ্যা বাস স্ট্যাণ্ডে!’ দীপক তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে ছোটনকে টানে–’চ’ চ’ শিগগির।’

বাস স্ট্যাণ্ডের দিকে যেতে যেতে অল্প কথায় দীপক জেনে নেয় কি ভাবে ছোটন হাজির হলো এই তাঁবুতে।

বেশ খানিকক্ষণ দীপকের আশায় ওই খাবার দোকানে অপেক্ষা করেও দীপক আসছে না দেখে, ছোটন ঝুমাকে দোকানে বসিয়ে রেখে যায় বাস স্ট্যান্ডে। কারণ কাকু বলেছিল যে বোলপুরের বাসের টাইম খোঁজ নেবে। সেখানে দীপককে না পেয়ে ছোটনের মনে হয় মাঠের মধ্যে সেই তাঁবুটা একবার দেখে আসি।

-‘ঝুমাকে একা রেখে এলি কেন ?’ বলল দীপক।

ছোটন বলল, ‘বাঃ তুমি যদি এসে ঘুরে যাও, আমাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে তো ভাবতে।’

বাস স্ট্যান্ডে জোরাল বৈদ্যুতিক বাতি নেই। সন্ধ্যা নেমেছে। আধো অন্ধকার মাঠে খাড়া অনেকগুলো বাস। যাত্রীও অনেক। বেশির ভাগ যাত্রীই ঘরে ফেরার অপেক্ষায়৷ যাত্রীরা কোথাও জটলা করছে, কেউ কেউ ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে। কোনো বাস একদম ফাঁকা। কোনো কোনো বাসের মাথায় ও কামরার ভিতরে আলো জ্বলছে। কিছু যাত্রী উঠে বসেছে সেসব বাসে। কণ্ডাকটাররা হাঁকাহাঁকি করে আহ্বান জানাচ্ছে প্যাসেঞ্জারদের। যাত্রীদের টর্চের আলো, বাসের আলো এবং দু তিনটে চায়ের দোকানের কার্বাইড-ল্যাম্পের আলোয় যতটুকু দেখা যায়।

দীপক ছোটনকে বলল, ‘লক্ষ্য রাখ, সেই চানাচুরগুলা বা তার সঙ্গীর দেখা পাস কি না।’

দীপকের নিজের চোখও খোঁজে তাঁবুর সেই গুঁফো লোকটাকে। দ্রুত পায়ে ঘোরে তারা। জনে জনের মুখে দৃষ্টি বোলায়। চায়ের দোকানে সেইলোক দুটো তখন আর নেই। দীপকের আশঙ্কা ইতিমধ্যে ওরা হয় তো বাসে চড়ে সরে পড়েছে। যতটা সম্ভব আড়ালে থাকে দীপক, উজ্জ্বল আলো এড়িয়ে। যাতে তাকে না দেখে ফেলে আততায়ীরা। মুশকিল এই যে ওই চানাচুরওয়ালাকে সে দেখেনি, তাই ছোটনই প্রধান ভরসা।

হঠাৎ ছোটন আঙুল দেখায়—‘ওই যে।’

একটা বাসের ভিতরকার বাল্ব জ্বলছে। সীট অর্ধেক ভরে গেছে যাত্রীতে। কণ্ডাকটার চিৎকার করছে, ‘সিউড়ি, চলে আসুন সিউড়ি।’

বাসটার দরজার উল্টো দিকের মাঝামাঝি জায়গায় একখানা দু’জনার সীটে বসা দুই প্যাসেঞ্জারকে দেখিয়ে ছোটন বলল, ‘জানলার ধারে যে ওই সেই চানাচুরওয়ালা। আর পাশে বসে দাড়িওলা লোকটা।’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লোক দুটোকে দেখতে দেখতে দীপক বলে, ‘ঠিক চিনেছিস?’

জানলার ধারে বসা লোকটা মুখে হাত চাপা দিয়ে ঘাড় গুঁজে রয়েছে। তার মুখ ভাল দেখা যাচ্ছে না। শুধু বোঝা যাচ্ছে তার মাথায় ঝাঁকড়া চুল।

‘হ্যাঁ’ দৃঢ়স্বরে জানায় ছোটন, ‘একবার মাথা তুলেছিল, তখন দেখলাম।’

দীপক ছোটন বাস থেকে খানিক তফাতে। অন্য একটা বাসের ছায়ায়। তাই ওই বাস থেকে তাদের দেখার সম্ভাবনা নেই।

দীপক সিউড়িগামী বাসের পিছনের দরজার কাছে গিয়ে

কণ্ডাকটারকে বলল, ‘দাদা বাস কখন ছাড়বে?’

জবাব হয়-এক্ষুণি।

দীপক দেখে নিল, ড্রাইভার তখনো সীটে বসেনি। সে কণ্ডাকটারকে অনুরোধ করল,’ আমরাও সিউড়ি যাব। এই ছেলেটা রইল, আমার ভাইপো। একজন মেয়ে আছে সঙ্গে, দোকানে বসিয়ে এসেছি। তাকে নিয়ে আসছি। প্লিজ একটু অপেক্ষা করবেন।’

‘যান যান তাড়াতাড়ি,’ কণ্ডাকটার তাড়া লাগায়।

‘আমি আসছি। তুই লোক দুটোর ওপর নজর রাখ।’ ছোটনের কানে ফিসফিসিয়ে বলেই দীপক হনহন করে হাঁটা দিল মেলার দিকে।

কণ্ডাকটার ছোটনকে বলল, ‘সীটে বসে জায়গা রাখ।’

ছোটন পিছনের সীটে একখানা রুমাল পেতে রেখে ফের নেমে এলো।

দীপক ফিরল মিনিট পনেরো বাদে। তার সঙ্গে ঝুমা এবং দু’জন কনস্টেবলসহ এক পুলিশ অফিসার।

বাসে তখন ড্রাইভার সীটে বসেছে। ঘন ঘন হর্ন বাজছে। সীটগুলো ভর্তি, দু-তিনজন প্যাসেঞ্জার দাঁড়িয়েও রয়েছে। কণ্ডাকটার গজগজ করছে ছোটনের কাছে,’ কৈ তোমার কাকা তো এখনো এল না। এবার বাস ছেড়ে দেব। আর লেট করতে পারব না।’

আচমকা পুলিশ সমেত দীপকের আবির্ভাবে কণ্ডাকটারের কথা থমকে গেল।

ঝুমাকে ছোটনকে নিচে রেখে দীপক পুলিশদের নিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে উঠল বাসে এবং সেই চানাচুরগুলা ও তার সঙ্গীকে দেখিয়ে পুলিশ অফিসারকে বলল-‘এই দু’জন।’

বাসের যাত্রীরা থ। তাদের গুঞ্জন মুহূর্তে স্তব্ধ। চমকে ঘাড় ফেরাল ঝাঁকড়াচুলো চানাচুরওলা এবং তার ছুঁচলো দাড়ি সঙ্গী। তারা ধড়মড় করে উঠে পড়তে গেল। কিন্তু তারা সীট ছেড়ে বেরুবার আগেই পুলিশ ইন্সপেক্টর তাদের পথ আগলে সীটের পাশে পৌঁছে গেছেন। হাতে তাঁর উদ্যত

রিভলবার। প্রচণ্ড ধমক লাগালেন ইন্সপেক্টর- ‘বস্। নড়লেই গুলি করব।’

তৎক্ষণাৎ দুই যাত্রী ফের বসে পড়ে কাঠ হয়ে থাকে। লোক দুটোকে খর চোখে দেখে নিয়ে ইন্সপেক্টর মাথা ঝাঁকালেন। তারপর দাঁড়িওলা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি নাম?’

‘এজ্ঞে নবাব আলি।’ লোকটি ঢোক গিলে জবাব দেয়।

‘একে চেন?’ ওর পাশের যাত্রীকে দেখান ইন্সপেক্টর।

‘এজ্ঞে না।’ নবাব আলি ঘাড় নাড়ে।

ইন্সপেক্টর স্থির দৃষ্টিতে তাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ তার দাড়ি ধরে মারলেন এক হেঁচকা টান। চড়াৎ করে খুলে এল নকল দাড়ি। চকিতে ইন্সপেক্টরের হাতের এক ঝটকায় উড়ে গেল লোকটার মাথার টুপি। দীপক চিনল, এই সেই পায়ে ব্যাণ্ডেজ বাধা সাজা ভিখিরি।

‘বেটাদের বেঁধে নামা। সাবধান, পালায় না যেন।’ ইন্সপেক্টর হুকুম দিলেন কনস্টেবলদের। অতঃপর তিনি ব্যঙ্গ কৌতুক মিশিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে মন্তব্য ছাড়লেন, ‘আহা নবাব বাদশাদের কি আর এমন ভিড়ের বাসে যাওয়া পোষায়। চ’ বাবা, তোদের আলাদা গাড়িতে সেপাইসান্ত্রী দিয়ে সিউড়ি পাঠাবার ব্যবস্হা করছি।’

হাত পিছমোড়া করে বেঁধে এবং কোমরে দড়ি এঁটে লোক দুটোকে নামানো হলো বাস থেকে।

বাসের বাইরে এসে পুলিশ ইন্সপেক্টর দীপককে বললেন থ্যাংকয়ু মিঃ রয়। দুটোই ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল। ফেরারী ডাকাত। পুলিশ খুঁজছিল এদের।’

আসামীদের নিয়ে চলে যায় পুলিশরা।

ছোটন ও ঝুমাকে নিয়ে দীপক চলল বোলপুরের বাসের খোঁজে। জব্বর খবর দীপকের পকেটে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *