মেয়েলি আড্ডার হালচাল – ৮

চন্দনের এক ফোঁটা

অবাক কাণ্ড। দেখি কাজল চন্দন বরাটের গাড়ি করে আমাদের স্টেশনে নিতে এসেছে। বাঁ চোখটা টিপল আমার দিকে চেয়ে। তীর্ণা বলল— ‘চন্দনকাকুকে আবার কোথা থেকে জোগাড় করলে।’ ঝংকার দিয়ে উঠল কাজল— ‘বি.এ. ক্লাসের বন্ধু। একটা উপকার করে দিতে পারবে না? কত দিন এড়িয়ে থাকবে? ই-হহ।’

চন্দন বরাট একগাল হেসে বলল— ‘তুই-ই তো আমায় এড়িয়ে চলতিস কাজলা। কাজলাদিদি নামটা আমরাই প্রথম তোকে দি, এক দিন বোধ হয় বিপিনবাবুর ক্লাসে কোনও কবিতা থেকে দু লাইন জন্মের মধ্যে কম্ম বলতে পেরেছিলি, সেই থেকেই তোকে দেখে আমরা গাইতুম, “মাগো আমার শোলোকবলা কাজলা দিদি কই।” তুই আর তোর বন্ধু সেই কান্তা না মান্তা ডিজেল এঞ্জিনের মতো ঘস ঘস করে চলে যেতিস।’

‘কান মুলে দেব চন্দন মিছে কথা বললে, কাজলা হাত ওঠায়। কান্তা না মান্তা, না! —ওকে দেখলেই তো তোদের বুক ধড়াস ধড়াস করত। এখন কান্তা না মান্তা! হুঁ।’

‘আরে সেই কান্তা এখন পিসিমা হয়ে গেছে। এক দিন বড়বাজারে দেখা হয়ে গেল। খাঁটি মশলাপাতি, ভাল ঘি সব কিনছে। শস্তায় উল, আপেল, ডেকচি, পিন, কুশন কিছু বাকি নেই। আমি আবার পুরনো প্রেমের কথা স্মরণ করে এক ডজন লেবু কিনে দিই।’

‘কী পাতিলেবু?’ কাজলা শুধোয়।

‘আবার কী! ওতো পাতিলেবুরই খদ্দের এখন। সকালবেলা মধু দিয়ে পাতিলেবুর রস খায় … তা সে তুলনায় তুই এখন অনেক সরেস আছিস। তোর সঙ্গে একটু-আধটু পরকীয়া করা যায়।’

কাজল এক থাপ্পড় তোলে— ‘তুই নিজে পিসেমশাই হয়ে গেছিস কিনা আয়নায় দ্যাখ একবার। তারপর আর কারও সঙ্গে পরকীয়ার কথা ভাবিস।’

তীর্ণা এ বার নাক গলায়— ‘চন্দনকাকু, মা তোমরা বাড়ি গিয়ে তোমাদের কলেজি ফষ্টি নষ্টি করো। এখানে ট্রেন-ফ্রেন সব থেমে যাচ্ছে— তা ছাড়া রঞ্জুমাসির খিদে পেয়েছে, শান্ত আর নিরুপমের জন্যে মন কেমন করছে।’

কাজল এ বার আমার সঙ্গে পরিচয় করায়— ‘আমার আরেক বন্ধু রঞ্জনা গড়াই। মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের গল্প লেখে, তুই ওর সঙ্গেও পরকীয়া করতে পারিস। ওর নিশ্চয়ই অনেক অভিজ্ঞতা ও বিষয়ে নইলে লেখে কী করে! তা ছাড়া তোদের পদবির বেশ মিল, পদবি কেন? নামেরও তো!’

চন্দন বলল— ‘সে আবার কী?’

‘কেন? ও রঞ্জনা গড়াই, তুই চন্দন বড়াই।’

আশে-পাশে কিছু লোক মিচকি মিচকি হাসছে। আমি আর তীর্ণা তীরবেগে বেরিয়ে আসতে থাকি ক্যারেজওয়ের দিকে।

‘ওইটা রঞ্জুমাসি, ওই নেভি ব্লু এস্টিমটা।’

চন্দন দেখলুম, ওস্তাদ ড্রাইভার। ভিড়-টিড় চমক্কার কাটিয়ে গল্প করতে করতে চলেছে।

‘তা রঞ্জনা, আপনার তা হলে দুই পুত্র?’

‘কোথা থেকে জানলেন?’ —তখন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করি।

‘হুঁ হুঁ বাবা, হোমস কি শুধু ইংল্যান্ডেই জন্মায় পোয়ারো কি শুধু বেলজিয়ামেই? নামও বলে দিতে পারি শান্ত আর নিরুপম।’

তীর্ণা হাঁ- হাঁ করে ওঠে—‘এমা চন্দনকাকু নিরুপম রঞ্জুমাসির হাজব্যান্ডের নাম।’

‘তা হলে তুই যে বললি শান্ত, নিরুপম!’

‘ও সব আজকালকার ছেলে-মেয়েদের ঢং’— কাজল মন্তব্য করে, ‘গুরুজনদের নাম-ফাম ধরে। তা এক হিসেবে তুই ঠিকই বলেছিস, নিরুপম একা কেন, তুই তোরা … সবাই তো সারাজীবন খোকাবাবুই থেকে যাস।’

‘রঞ্জনা প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।’

‘না না ঠিক আছে, আপনি নির্ভাবনায় থাকুন। অত সহজে মাইন্ড করলে …’

‘তুই আর রঞ্জনা থাকতিস না, গঞ্জনা হয়ে যেতিস, বল’— কাজল আমার মুখের কথা কেড়ে নিল, ‘রঞ্জুও কিন্তু শিল্পীর বন্ধু। রঞ্জুদি বলতে ও অজ্ঞান। আমার বি.এ পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে গেল। রঞ্জু বি.এ পাস করল এম. এ পাস করল, কবিতা লিখল, বুদ্ধদেব বসুর নেটিপেটি হয়ে, গপ্পো লিখল কার নেটিপেটি হয়ে তা জানি না। পরকীয়ার ভাল ক্যানডিডেট।’

চন্দন, স্টিয়ারিং-এ হাত, ঠোঁটে সিগারেট— তারই ফাঁক দিয়ে বলল ‘কাজলা তুই তা হলে পথের কাঁটা সরে দাঁড়াচ্ছিস? ভাল, রঞ্জনা, আপনি রাজি তো?’

“আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা,” সহসা আমার কানের কাছে কে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে, আমি কেঁপে উঠি,— তারপর বলি— ‘আমি পিসিমা না হলেও মাসিমা হয়ে গেছি যে মি বরাট।’

‘ওর উচ্ছ্বাসে জল ঢেলে দিলি যে রে রঞ্জু, তুই তো এমন বেরসিক ছিলি না, ব্যাপার কি বল তো!’ —কাজল সন্ধানী চিন্তিত চোখে আমাকে জরিপ করে।

চন্দন বলে ‘মাসি আপনি নিশ্চয়ই তীর্ণার, আমার মেয়ে তুলতুলের কিন্তু মাসি-মা আপনি নন।’

‘কিন্তু তুই মেসোমশাই’ কাজল ঘোষণা করে— ‘ইন এভরি সেন্স অফ দা টার্ম।’

‘অবজেকশন। রঞ্জনা আপনি বলুন, তীর্ণা তুই বল।’

আমি সন্তর্পণে বলি— ‘ইউ আর স্টিল ভেরি হ্যান্ডসম চন্দন ভাই।’

‘আর ভুড়িটা? টেনিস বলের মতো ভুঁড়িটা?’ কাজল ককিয়ে ওঠে। গঙ্গাপ্রসাদের পাঞ্জাবির তলায় চাপাপড়া বিস্তৃত ভুঁড়িটা আমার মনে পড়ে, আমি খুব নরমগলায় বলি— ‘ভুড়িজ রিয়্যালি ডোন্ট ম্যাটার।’

কাজল আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে— ‘ভুঁড়িজ? ভুঁড়িজ? তুই বহুবচন কেন ব্যবহার করছিস রঞ্জু!’

আমি ক্লান্ত গলায় চোখ বুজে বলি— ‘উঃ কাজল আমাকে চিপটে দিচ্ছিস একেবারে। এ বার আগে বাড়ি পৌঁছে দে। চন্দন, কাজলদের বাড়ির আগেই আমার বাড়ির গলি পড়বে, খেয়াল রাখবেন, গলির মুখে নামিয়ে দিলেই হবে।’

‘সে কী কথা! সে কী কথা! চন্দন চেঁচামেচি করে ওঠে। —‘আপনার বাড়ির একেবারে যাকে বলে দোরগোড়ায় নামিয়ে দেব, তারপর আপনি চা কি কফি কি কোল্ড ড্রিংকস খেয়ে যেতে বললে নামব, নইলে নামব না।’

আমি বলি— ‘আজ আর নামতে বলব না, কিছু মনে করবেন না। বড্ড ক্লান্ত আজ, কদিন পরে নিশ্চয়ই শুধু কোল্ড কেন …’

‘হট-ও দেবেন বলছেন?’—কথাটা লুফে নেয় চন্দন।

এভাবেই আমি বাড়ি পৌঁছই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *