মৃত রাজা জাগো

মৃত রাজা জাগো

এক

মধ্যপ্রদেশের পান্না জায়গাটা দুটো কারণে বিখ্যাত। এক, টাইগার-রিজার্ভ। আর দুই, হিরের খনি। তবে হিরে আর বাঘ দুটোর অবস্থাই ইদানিং খুব খারাপ। খোঁজ নিয়ে জানলাম, সরকারি খনিগুলোতে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে সারা বছরে একশো পিস হিরে পাওয়া গেলেই অনেক। সে হিরের কোয়ালিটিও নাকি একদম ভালো নয়।

বাঘের অবস্থা আরো করুণ। রিজার্ভ-ফরেস্টের এক অফিসার আমতা আমতা করে জানালেন, এখনো জঙ্গলে তিনটে বাঘ রয়েছে। তবে গুরেলাল সে কথা হেসেই উড়িয়ে দিল। বলল, বাঘ থাকলে আমরা দেখতে পেতাম না? সারাক্ষণ ওই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করছি। কই, গত পাঁচ বছরে একটাকেও তো দেখতে পাইনি।

গুরেলাল আমার সর্বকর্মা। বাজারহাট, রান্নাবান্না থেকে শুরু করে লন্ঠন সাফাই অবধি সবই ওর দায়িত্ব। সবচেয়ে বড় কথা, গুরে নিজে নারিয়া উপজাতির লোক। তাই ও সঙ্গে থাকা মানে নারিয়াদের সঙ্গে মেলামেশার পাসপোর্ট হাতে পেয়ে যাওয়া।

নারিয়াদের নিয়ে কাজ করার জন্যেই আমি গত একমাস ধরে পান্নায় ঘাঁটি গেড়ে বসে আছি। প্রপার পান্না শহরে নয় অবশ্য। ওটা বড়লোকেদের জায়গা। ওখানে নারিয়াদের মতন গরিব লোকেদের পাবো কোথায়? নারিয়ারা থাকে জঙ্গলে। পান্না শহরকে ঘিরে যে মাইলের পর মাইল পাথুরে-জমি, টিলা-পাহাড় আর সেগুনের বন, তারই মধ্যে ছোট ছোট গ্রামে ওরা ঘর বেঁধে থাকে। বনের ফলপাকুড় কুড়োয়, ছোট ছোট জীবজন্তু শিকার করে, নালায় মাছ ধরে। কোমরে নামমাত্র কাপড় জড়ানো। শুকনো পাতায় ছাওয়া কুঁড়েঘর। হাজার হাজার বছর ধরে এইভাবেই ওরা বেঁচে আছে। টেলিভিশন, মোবাইল, শপিং-মল, ফ্লাই-ওভার—এইসব কিছুই ওরা দ্যাখেনি।

সেইজন্যেই নৃতাত্ত্বিকদের মধ্যে নারিয়াদের মতন উপজাতিদের নিয়ে ভারী আগ্রহ। ওদের ভালো করে স্টাডি করলে হাজার বছর আগে মানুষ কেমন জীবন কাটাতো তার একটা আঁচ পাওয়া যায়।

নারিয়া উপজাতিদের নিয়ে প্রথম বড় মাপের কাজ করেছিলেন আমার স্যার—বিশ্বদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিরিশ বছর আগে নারিয়া উপজাতির দেবদেবীদের নিয়ে ওনার রিসার্চ-পেপার Gods and Goddesses of Naria Tribe ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিশড হয়েছিল।

স্যারের আন্ডারেই আমি পি এইচ ডি করছি। স্যার আমাকে খুব ভালোবাসেন। সেটার একটা কারণ, আমার আগের পরীক্ষাগুলোর রেজাল্ট। কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ, উনি নিজে যেটা বলেন, আমার পরিশ্রম করবার ক্ষমতা। স্যার আমাকে প্রায়ই বলেন, বুঝলে মৃন্ময়, অ্যানথ্রোপোলজিস্টের কাজটা ঠান্ডাঘরের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে হয় না। ওটার জন্যে মানুষের সঙ্গে তাদের নিজেদের জায়গায় গিয়ে মিশতে হয়। তাদের ঘরের দাওয়ায় বসতে হয়, তাদের সঙ্গে একসঙ্গে শালপাতার দোনায় ভাত খেতে হয়। এ ব্যাপারে আদর্শ হচ্ছেন ভারতে অ্যানথ্রোপোলজির জনক ভেরিয়ার এলুইন সাহেব। জানো তো, উনি একজন গোন্দ উপজাতির মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন?

সবাই জানি। জানি বলেই আমিও সেই কলেজের দিনগুলো থেকেই যতটা পারি ফিল্ড-ওয়ার্কের ওপর জোর দিই। সেটা যে শুধু নিজের কেরিয়ারের কথা ভেবে করি তা নয়। আমার সত্যিই টেনশন আর লোভে ভরা শহুরে জীবনের চেয়ে অনেক বেশি ভালো লাগে আদিবাসীদের সহজ সুন্দর নির্লোভ জীবনযাত্রা। আলো ঝলমলে শপিং-মলে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই আমার চোখের সামনে থেকে সারি সারি দোকানপাট সব মুছে যায়। কানে ভেসে আসে মাদলের দ্রিদিম দ্রিদিম তাল। মনে হয় জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে কোনো এক মালভূমি। বুনো শিউলির গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। আর আমার সামনেই আগুন ঘিরে নাচ শুরু করেছে আমার আদিবাসী বন্ধুরা। মনে হয় এক্ষুনি ছুটে চলে যাই ওরকম একটা জায়গায়।

আমার এই পাগলামির কথা জানতেন বলেই একমাস আগে স্যার আমার হাতে তুলে দিলেন তাঁর একটা অসমাপ্ত রিসার্চ-পেপার।

ফাইলটা হাতে নিয়ে প্রথম পাতার ওপরে শিরোনামটা দেখেই চমকে উঠেছিলাম। “Is there any mummy of a Naria king?”

কোনো নারিয়া রাজার শরীর কি মমি করে রাখা আছে?

দুই

মমি জিনিসটা যে মিশরের একচেটিয়া নয় সেটা জানতাম। জাপানে আর সাউথ আমেরিকায় মৃতদেহ মমি করে রাখার চল ছিল। আমাদের দেশেও অনেক জায়গায় মমি করা শরীর পাওয়া গেছে—হিমাচল প্রদেশের কাজায়, অসমের মাইলাং-এ, অরুণাচল প্রদেশে। তবে দেশে দেশে মমি করার পদ্ধতিতে তফাৎ রয়েছে।

সেইজন্যেই মমির কথা পড়ে অবাক হইনি। অবাক হয়েছিলাম সেই মমিটাকে স্যার কোথায় খুঁজে পাওয়ার আশা করছেন, সেটা দেখে। মধ্যপ্রদেশের কোনো উপজাতির মধ্যে মৃতদেহ মমি করে রাখার কথা তো এতদিন অবধি জানা যায়নি!

ফাইল-টা আমার হাতে তুলে দিয়ে স্যার বলেছিলেন, মৃন্ময়, এই কাজটা আমি আর শেষ করে উঠতে পারব না। আমার বয়স হয়ে গেছে, শরীর আর ফিল্ড-ওয়ার্কের ধকল নিতে পারবে না। তুমি এটা নিয়ে এগোও। সত্যিই যদি নারিয়া রাজার মমি খুঁজে বার করতে পারো, তাহলে তোমার পি এইচ ডির থিসিসও ক্যাম্ব্রিজ থেকে পাবলিশড হবে।

বিখ্যাত হওয়ার লোভ আমার ছিল না, কিন্তু অ্যানথ্রোপোলজির অন্ধিসন্ধি জানার প্রবল ইচ্ছে তো ছিলই। তাই যাকে বলে ‘দুরুদুরু বক্ষে’ স্যারের সামনে বসেই পরের পাতাগুলো ওলটাতে যাচ্ছিলাম। স্যার আমার মুখের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে বললেন, তাড়া কিসের মৃন্ময়? তিনশো পাতার ফিল্ড-রিপোর্ট তুমি তো একবারে পড়ে শেষ করতে পারবে না। বাড়ি নিয়ে যাও। বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা মাথায় লেখাটা দ্যাখো। তারপর আমার কাছে এসো।

তাই করলাম। পরের তিনদিনে খুঁটিয়ে পড়লাম স্যারের রিপোর্ট। যা বুঝলাম, এই মমি নিয়ে ভাবনার বীজটা স্যারের মাথায় ঢুকেছিল তিরিশ বছর আগের সেই দিনগুলোতে, যখন তিনি ছিলেন যুবক। দিনের পর দিন নারিয়াদের গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরছেন। শিখে নিচ্ছেন ওদের ভাষা, ওদের ভদ্রতা। নারিয়াদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন তাদের নিজেদের লোকের মতন। সেইসব দিনের অভিজ্ঞতার কথা ডায়েরির মতন করে লিখে রেখেছিলেন তিনি এই রিপোর্টের প্রথম অংশে।

তখনও গ্রামগুলোর অবস্থা আজকের মতনই খারাপ ছিল। কুড়ি-তিরিশ কিলোমিটার তফাতে একেকটা গ্রাম। দুটো গ্রামের মধ্যে যাতায়াত ভীষণ কঠিন, কারণ তাদের মাঝখানে গভীর জঙ্গল আর রাস্তাঘাটের বালাই তো এসব জায়গায় কোনোদিনই ছিল না। একেকটা গ্রাম যেন এক একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।

সেইজন্যেই একেক অঞ্চলের নারিয়াদের একেকজন উপাস্য দেবতা। এক গ্রামের লোক যে উপকথার গল্প বলে, অন্য গ্রামের গল্প থেকে তা সামান্য হলেও আলাদা হয়ে যায়। রান্নার উপকরণ, কাপড় পরবার ধরন, বিয়েচুড়ো শ্রাদ্ধশান্তির প্রথাতেও একটু না একটু তফাৎ থেকে যায়। তফাৎ ছিল না শুধু একটা বিশ্বাসে। সারা বিন্ধ্যপর্বতে যেখানে যত নারিয়া ছিল তারা বিশ্বাস করত তাদের শেষ রাজা আবার ফিরে আসবে।

কে সেই শেষ রাজা?

রাজা কিলারায় নারিয়া। ঠিক চারশো বছর আগে তিনি ঘাতকের হাতে প্রাণ দেন। প্রফেসর বিশ্বদেব বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর অসমাপ্ত রিসার্চ-পেপারে লিখেছেন—…. He was assassinated by one of his courtiers. রাজামশাইয়ের কোনো এক সভাসদই তাঁকে খুন করেছিল।

নারিয়াদের কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। ওরা যে পুরাণকথা বলে, যে গান গায়, সেসবের মধ্যে থেকে স্যার ওদের যে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন সেটা এইরকম—

রাজা কিলারায়ের বাবা রাজা মহীসুখের আমলে নারিয়াদের ইতিহাসের সবচেয়ে সুসময়টা এসেছিল।

নারিয়াদের মধ্যে কোনো কোনো পরিবার নাকি ছিল দারুণ ওস্তাদ কামার। পাঁচশো বছর আগেও তারা ঘরোয়া উপায়ে মাটির ফার্নেসে হেমাটাইট-পাথর থেকে লোহা বার করার গুপ্তবিদ্যা জানত। শুধু তাই নয়, তারা গলানো লোহার সঙ্গে নানান জিনিস মিশিয়ে তার থেকে ইস্পাত তৈরি করতে পারত। এমনকি সেই ইস্পাতের তৈরি অস্ত্রশস্ত্রের ধার বাড়াবার জন্যে কেমন করে টেম্পারিং করতে হয় সেই টেকনিকও তাদের অজানা ছিল না।

রাজা মহীসুখ কয়েকটি পরিবারের হাত থেকে সেই গুপ্তবিদ্যা কেড়ে নিয়ে সমস্ত নারিয়ার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিটি নারিয়া হয়ে উঠেছিল অস্ত্র তৈরিতে সিদ্ধহস্ত। সেসব অস্ত্র ছিল যেমন হালকা, তেমনি ছিল তাদের ব্যালেন্স আর তেমনি ধার। নারিয়া-সোর্ড দিয়ে গলায় কোপ দিলে নাকি কাটা-মুন্ডু অনেকক্ষণ অবধি গলার ওপরেই বসে থাকত। যার মাথাটি কাটা গেল সে নিজেও বুঝতে পারত না, কী সর্বনাশ ঘটে গেল। ফলে আজ থেকে চারশো বছর আগে মধ্যপ্রদেশ থেকে উত্তরভারত অবধি সমস্ত রাজ্যের সৈন্যবাহিনীতে নারিয়াদের তৈরি তলোয়ার, বল্লম, তিরের ফলার বিরাট চাহিদা তৈরি হয়েছিল।

এই প্রথম একজন রাজা, রাজা মহীসুখ, নারিয়াদের জন্যে বাইরের জগতের জানলা খুলে দিয়েছিলেন। নারিয়ারা জঙ্গলের কুলগাছে তসরগুটির চাষ করতে শিখেছিল। সেই তসরের চাহিদাও ক্রমশ বাড়ছিল।

রাজা মহীসুখের আরো অনেক পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সেগুলো কাজে লাগানোর সময় পেলেন না। একদিন শিকার করতে গিয়ে তিনি বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারালেন। নারিয়াদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। রাজা মহীসুখকে তারা দেবতার মতন দেখত। সেই দুঃসময়ে সামনে এগিয়ে এলেন রাজবৈদ্য জগন নারিয়া।

নারিয়া উপকথা জগন নারিয়া সম্বন্ধে নানান গল্পে ভর্তি। এখনো নারিয়া গ্রামের দাদু-ঠাকুমারা ছোট ছোট নাতি-নাতনিদের ঘুম পাড়াবার সময় সুর করে রাজা মহীসুখ আর রাজবৈদ্য জগন নারিয়ার গল্প বলে। জগন নারিয়া নাকি ভেষজ চিকিৎসায় ছিলেন ধন্বন্তরি। বিরাট এই বিন্ধ্যঅরণ্যের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি ঘাস আর লতা ছিল তাঁর নখদর্পণে। কোন গাছের কী গুণ, কোন অসুখে তার ব্যবহার সব তিনি জানতেন। তাছাড়া তিনি ছিলেন জাদুকর। জগন নারিয়া নাকি মরা মানুষকেও বাঁচিয়ে তুলতে পারতেন।

এই জায়গাটা দেখলাম স্যার বোল্ড লেটারে লিখে রেখেছেন। কেন, সেটা একটু বাদে বুঝেছিলেম।

রাজা মহীসুখ মারা যাওয়ার পর ওই জগন নারিয়া মহীসুখের একমাত্র সন্তান কিলারায়কে সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্য চালাবার একটা চেষ্টা করেছিলেন। কিলারায় তখন নাবালক।

কিন্তু সেইসব পরিবার—যাদের হাত থেকে অস্ত্র তৈরির গুপ্তবিদ্যা কেড়ে নিয়ে রাজা মহীসুখ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন—তারা এবার প্রতিশোধ নিল। একদিন যখন কিলারায় রাজসভায় বসে আছেন, তখন ওরকমই একজন ক্ষিপ্ত সভাসদ দূর থেকে তাঁর বুকে একটা তির গেঁথে দিয়ে পালায়। কিলারায় সিংহাসনের ওপরেই লুটিয়ে পড়লেন।

এর পরে যেটা হল সেটাকে সময়ের চাকা উলটোদিকে ঘোরা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। একজন রাজার অভাবে নারিয়ারা দিশাহারা হয়ে পড়ল। সভ্যতার দিকে তারা যে দু-চার পা এগিয়েছিল, এই ঘটনার পরে তারা ঠিক ততটাই পিছিয়ে গেল। তার সঙ্গে যোগ হল বইয়ের পাতায় যাদের ‘উচ্চবর্ণ’ বলা হয় সেইসব সভ্য মানুষদের অত্যাচার। নারিয়াদের তারা মারতে শুরু করল। তারা নারিয়াদের হাতে যত উর্বর জমি ছিল সব কেড়ে নিল।

ইংরেজরা আসার পরে নারিয়ারা জঙ্গলে ঢোকার অধিকারটুকুও হারাল। কোনোরকমে ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচেছিল তারা। বেঁচেছিল শুধু একটা বিশ্বাস বুকে নিয়ে। রাজা কিলারায় আবার মৃত্যুর দেশ থেকে ফিরে আসবেন। তিনি ফিরে এলেই আবার নারিয়ারা তাঁকে সামনে রেখে যুদ্ধযাত্রা করবে। জিতে নেবে তাদের যত হারানো জমি। নতুন করে শিখে নেবে ইস্পাত আর তসর বানাবার কলাকৌশল। আবার তাদের সুখের দিন ফিরে আসবে।

রাজবৈদ্য জগন নারিয়া তাদের মনের মধ্যে এই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি নাকি রাজা কিলারায়ের মৃতদেহ নিয়ে এমন একটা কিছু করেছিলেন যাতে চারশো বছর পরে আবার রাজা কিলারায় পৃথিবীতে ফিরে আসেন।

তিন

ঠিক তিনদিন বাদে আবার সেই ফাইল নিয়ে স্যারের স্টাডি-রুমে ঢুকলাম।

স্যার জিজ্ঞেস করলেন, পড়েছো?

বললাম, হ্যাঁ।

রাজার আত্মা তাঁরা মৃত শরীরে ফিরে আসবে—এর সঙ্গে প্রাচীন মিশরীয়দের ভাবনার মিল পাচ্ছ না?

ঘাড় হেলালাম।

তাহলে তো সেই মৃতদেহকে সংরক্ষিত করে রাখতে হয়। পুড়িয়ে ফেললে রাজা কোন শরীরে ফিরবেন?

আমি আমতা আমতা করে বললাম, স্যার, পুরো ব্যাপারটাই যদি একটা আজগুবি গল্প হয়? ধরুন রাজবৈদ্য জগন নারিয়া প্রজাদের মনোবল ধরে রাখার জন্যে এরকম একটা গল্প বানিয়েছিলেন।

উঁহু। স্যার ঘাড় নাড়লেন। মনোবল ফেরানোর জন্যে হাতে-গরম কিছু করে দেখানোটাই ভালো। ধরো সঙ্গে সঙ্গে উনি নিজেই যদি রাজার সিংহাসনটায় বসে পড়তেন, তাহলে তুমি ও কথা বলতে পারতে। তাছাড়া তুমি তো নিশ্চয়ই আমার রিপোর্টের শেষদিকটা পড়েছ?

পড়েছি স্যার।

কী লেখা আছে সেখানে?

স্যার, আপনি পরে আরো একবার পান্না গিয়েছিলেন। এক্সটেনসিভলি ঘোরাঘুরি করেছেন গ্রাম থেকে গ্রামে। প্রতিটি গ্রামবাসী বিশ্বাস করে রাজা কিলারায়ের মৃতদেহ আজও অটুট অবিকৃত অবস্থায় রাখা আছে। কিন্তু কোথায় আছে সে কথা কেউ আপনাকে বলতে পারেনি।

এইবার স্যারের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি বললেন, সাধারণ নারিয়া মানুষেরা বলতে পারেনি। আর নারিয়াদের মধ্যে যারা স্পেশাল পজিশনে রয়েছে, যেমন ওদের গাঁওবুড়ো কিম্বা জানগুরুরা, তারা বলতে চায়নি। আমি একদম নিশ্চিত মৃন্ময়, ওরকম অন্তত পাঁচ-ছ’জন লোক আছে, যারা জানে, ঠিক কোথায় রাজা কিলারায়ের মৃতদেহ রয়েছে। আমার একের পর এক প্রশ্নের মুখে ওরা কখনো না কখনো নিজেদের অজান্তেই সেরকম ইঙ্গিত দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সেগুলো স্রেফ ‘স্লিপ অফ টাং’। পরমুহূর্তেই আবার ওরা মুখে কুলুপ এঁটেছে।

তাই বলছি, তুমি একবার পান্না গিয়ে সেরকম কাউকে খুঁজে বার করো যে তোমাকে মমির হদিশ দেবে। তোমার মধ্যে মানুষের সঙ্গে মিশবার ক্ষমতা আছে। ধৈর্য আছে। তুমি ঠিক সফল হবে, দেখো।

আমার ওপরে স্যারের সেই অগাধ বিশ্বাসটুকুকে সম্বল করেই একমাস আগে মধ্যপ্রদেশে চলে এসেছিলাম। পান্না থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে দেওপাটনি বলে একটা গ্রামে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম।

দেওপাটনি জায়গাটার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। সারা বিন্ধ্য রেঞ্জ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অজস্র টিলার মধ্যে একটা টিলার মাথায় এই দেওপাটনি গ্রাম। গ্রামের যে কোনো জায়গায় দাঁড়ালে চোখে পড়ে চারিদিকে শুধু জমাট ঢেউয়ের মতন সবুজ পাহাড়। সে সবুজের কত রকম শেড! কোথাও সেগুনের ঘন সবুজ, কোথাও বাঁশের কচি সবুজ, কোথাও কুসুমগাছের কচি পাতার লাল মেশানো সবুজ, আবার কোথাও বা গামার পাতার রুপোলি সবুজ।

শুধু কি সবুজ? আমি যখন দেওপাটনি এলাম তখন মার্চের শেষ। চতুর্দিকে পলাশ আর শিমুল ফুটেছে। বনের মাথায় এখানে-ওখানে তাই টকটকে লাল আবিরের ছোপ।

কিন্তু এসব সৌন্দর্য বাইরের। ভেতরে ভেতরে নারিয়াদের রঙচটা দুঃখের জীবন একইভাবে বয়ে চলেছিল। ওদের কাছাকাছি থেকে দেখলাম, ভোর থেকে রাত অবধি প্রচণ্ড পরিশ্রম করে কীভাবে ওরা দু-মুঠো ভাতের জোগাড় করে। কখনো সেটুকুও জোটে না। তখন ওরা পিঁপড়ের ডিম, কাঠবেড়ালি, ইঁদুর, বাদুড়—যা পায় তাই খায়। দেওপাটনির মানুষকে তেষ্টার জলটুকু অবধি আনতে হয় চার চার আট মাইল হেঁটে, প্রায় শুকিয়ে যাওয়া একটা নালা থেকে। রোগভোগ তাই লেগেই আছে। আমি ওখানে থাকতে থাকতেই ডায়ারিয়ায় একটা বাচ্চা মারা গেল।

তবু নারিয়ারা হার মানে না। ওরা একটা স্বপ্নকে বুকে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে যায়। দেওপাটনিতে মোবাইলের টাওয়ার নেই তাই এখানে পৌঁছনোর সাতদিন পরে একদিন পান্নায় গিয়ে স্যারকে ফোন করলাম। বললাম, নারিয়াদের স্বপ্ন এতটুকুও টাল খায়নি স্যার। আপনি যেরকম দেখে গিয়েছিলেন, ঠিক সেরকমই আছে।

স্যার বললেন, ওরা কি এখনো বিশ্বাস করে, রাজা কিলারায় ফিরে আসবেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ স্যার। আপনাব যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমারও ঠিক সেইরকম অভিজ্ঞতা হচ্ছে। কথায় কথায় ওরা বলে ফেলছে রাজা কিলারায়ের শরীর যত্ন করে কোথাও রাখা আছে। ওদের গানের মধ্যে বলা হচ্ছে—রাজা কিলারায়ের শরীরের সৎকার করতে দেননি জগন নারিয়া। তিনি রাজার মৃতদেহ নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন একটা বন্ধ ঘরের মধ্যে। তিনদিন ধরে নানান ওষধি লতাপাতা, ধুনো, কর্পূর আর গন্ধকের গন্ধে ভরপুর হয়েছিল রাজপ্রাসাদের চারিদিকের বাতাস।

তিনদিন বাদে সেই বন্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সবচেয়ে বিশ্বস্ত পাঁচজন গাঁওবুড়োর হাতে জগন সেই দেহ তুলে দেন। বলেন এই দেহেই আবার প্রাণ ফিরে আসবে, চারশো বছর পরে।

স্যার বললেন, প্রাণ ফিরে আসার কথা ছাড়ো। ওটা অন্ধবিশ্বাস। কিন্তু মৃতদেহটা কোথাও রয়েছে বলেই মনে হচ্ছে না? এইজন্যেই আমি মমির কথা ভেবেছিলাম।

আরেকটা কথা বলি। আমি যেটুকু ক্রশ-রেফারেন্স পেয়েছিলাম, তাতে মনে হয়েছিল, রাজা কিলারায়কে খুন করা হয়েছে ষোলোশো-পনেরো কি ষোলো সালে। তার মানে চারশো বছর কেটেই গেল প্রায়। মৃন্ময়, আমার চিন্তা হচ্ছে এরপর যদি নারিয়ারা দেখে যে রাজার শরীরে, মানে ওই মমির মধ্যে প্রাণ ফিরল না, তাহলে ওরা ওই মমিটারই সৎকার করবে। একটা দারুণ আর্কিওলজিকাল এভিডেন্স স্রেফ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। কাজেই তুমি একটু তাড়াতাড়ি ওটাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা কর।

বললাম, আপ্রাণ চেষ্টা করছি স্যার।

অল দা বেস্ট, বলে স্যার ফোন নামিয়ে রাখলেন। আমিও দেওপাটনিতে ফিরে এলাম।

এত গ্রাম থাকতে আমি যে দেওপাটনিতে এসে বাসা বেঁধেছিলাম সেটা এমনি এমনি নয়। এই দেওপাটনি-ই ছিল নারিয়া রাজাদের রাজধানী। এখানেই কিলারায়ের মৃত্যু হয়েছিল। এটা স্যারের কাছ থেকেই জেনেছিলাম।

গ্রামের পাতায় ছাওয়া ঝুপড়ির সারি ছাড়িয়ে উত্তরদিকে আধ কিলোমিটার মতন হেঁটে গেলেই দেখা যায় পুরনো রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ। বিরাট বিরাট পাথরের চৌকোনা স্ল্যাব এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে কোনো কোনোটায় অদ্ভুত সুন্দর মূর্তি কিম্বা লতাপাতার ছবি খোদাই করা। কখনো চোখে পড়ে পাতালের দিকে নেমে গেছে পাথরের সিঁড়ি। কোথাও একটা প্রায় বুজে যাওয়া ইঁদারা, কোথাও একটা ঘরের ভিত। বুঝতে অসুবিধে হয় না, এখানেই মাটির নীচে চাপা পড়ে রয়েছে কিলারায়ের রাজবাড়ি।

সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, উনুন বানাতে কিম্বা ঘরের দেয়াল তৈরি করতে পাথরের দরকার পড়লে দেওপাটনির গ্রামের লোকেরা কষ্ট করে দশ মাইল দূরের পাহাড় থেকে পাথর নিয়ে আসবে। তাকে কষ্ট করে কেটেকুটে চৌরস বানাবে। কিন্তু ঘরের কাছে ছড়িয়ে থাকা অত পাথরের মধ্যে একটাতেও নিজেরা হাত দেবে না, বাইরের কাউকেও হাত দিতে দেবে না।

গুরেলালকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা এরকম কর কেন? তাতে গুরেলাল উত্তর দিয়েছিল, বাবুজী, যেদিন কিলারায় ফিরে আসবে, সেদিন ওই সমস্ত ভাঙা পাথর আবার নিজে থেকেই যে যার জায়গায় বসে যাবে। মাটির ওপর মাথা তুলে দাঁড়াবে চারশো বছর আগের সেই তিনমহলা রাজপ্রাসাদ। আলো জ্বলবে, লোকলস্কর-হাতি-ঘোড়া সব নিজের থেকেই আবার উদয় হবে। তাহলে বলুন, একটা পাথর যদি এখান থেকে সরিয়ে নিই তাহলে সেই একটা পাথরই সেদিন কম পড়বে না?

সব শুনে আমার মনে হয়েছিল, কিলারায়ের মমি এখানে থাকার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। গল্পের আড়ালে জগন নারিয়া আর তাঁর অনুগত গাঁওবুড়োরা আসলে দেওপাটনিকে সুরক্ষিত করে রেখে গেছেন। যেখান থেকে বাচ্চারা ভয়ের চোটে পেয়ারা পাড়তে অবধি যায় না, সেখানে মমির খোঁজ কে চালাবে?

চার

খোঁজাখুঁজির ব্যাপারে আমার সবচেয়ে বড় সহায় ছিল গুরেলাল। আমি দেওপাটনিতে পা দিয়ে রাজা কিলারায়ের ব্যাপারে এক-দুটো কথা বলামাত্রই ভিড় ঠেলে গুরেলাল এগিয়ে এসেছিল। গুরেলাল কিছুদিন পান্নার ফরেস্ট-বাংলোয় সুইপারের চাকরি করেছিল, তাই হিন্দিটা ভালোই জানত। ওকে পেয়ে আমি হাতে চাঁদ পেলাম।

সেইদিনই গুরেলাল আমার থাকবার ঘর জোগাড় করে দিল, আমার রান্নাবান্নার দায়িত্ব নিয়ে নিল। এককথায় গত একমাস ধরে গুরেলাল-ই আমাকে চালাচ্ছে।

ওর বয়স মনে হয় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর হবে। কালো পাথরে খোদাই করা শক্তপোক্ত চেহারা। অ্যাভারেজ নারিয়াদের থেকে অনেকটাই বেঁটে। কালো মুখে ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারি। ওকে না হেসে কখনো থাকতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। আমার জন্যে যে ঘরটা জোগাড় করে দিয়েছিল তার ঠিক উল্টোদিকে আরেকটা কুঁড়েঘরে গুরেলাল পরিবার নিয়ে থাকত।

গুরেলালের পরিচ্ছন্ন পাতার কুঁড়েঘর ঘিরে বাঁশের বেড়া। আমি ঘরে বসেই দেখতে পেতাম নিকোনো উঠোনে সারাক্ষণ গুরের বউ মোতিয়া এটা-ওটা কাজ করে যাচ্ছে। গুরের একটা ছোট ছেলে আছে। সেটা দাওয়ায় কাঁথার ওপরে শুয়ে ঘুমোয়। মোতিয়া যখন বাইরের কাজে যায় তখন বাচ্চাটাকে ছেঁড়া কাপড় দিয়ে পিঠে বেঁধে নিয়ে যায়। খুব শান্ত বাচ্চা, কখনো কাঁদতে শুনিনি।

গুরেলালকে নিয়ে দিনের মধ্যে দু’বার আমি ঘুরতে বেরোই। একবার খুব ভোরে। ফিরে আসি দশটা নাগাদ, কারণ তারপরে রোদ্দুরের তেজে আর লু-এর দাপটে বাইরে থাকা যায় না। আবার বেরোই সূর্য ডোবার পরে, সন্ধে ছটা নাগাদ। ফিরি কখনো রাত নটায়, কখনো দশটায়। গুরেলাল দুটো সাইকেল জোগাড় করেছে। ওই সাইকেলে চেপে এ গ্রাম থেকে সে গ্রাম ঘুরে বেড়াই।

প্রথম প্রথম গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে গুরেলাল আমার দোভাষীর কাজ করত। তবে নারিয়ারা যে বুন্দেলি ভাষায় কথা বলে তার সঙ্গে হিন্দির বেশ মিল আছে। তাই দু’চারদিনের মধ্যেই আমি নিজেই কথাবার্তা চালাতে শুরু করে দিলাম।

আমার প্ল্যানটা ছিল সোজাসাপটা। যেখান থেকে যতটা পারি নারিয়াদের পুরাণকথা আর লোকগান জোগাড় করে যাচ্ছিলাম। মনে আশা ছিল, ওইসব গান আর গল্পের মধ্যে থেকেই একদিন না একদিন ঠিক পেয়ে যাব কিলারায়ের মমির ঠিকানা। যেমন ধাঁধার মধ্যে লুকিয়ে থাকে গুপ্তধনের হদিশ।

আমি যে ঠিক কিসের খোঁজে এসেছি সেটা গুরেলাল ছাড়া আর কেউ জানত না। জানতে পারলে নারিয়ারা নিশ্চয় আমাকে এখানে কাজ করতে দিত না। কিন্তু গুরেলালের ব্যাপার আলাদা। ও আমাকে খুব ভালোবাসত, বিশ্বাসও করত। আমিও ওকে কথা দিয়েছিলাম, সত্যিই যদি রাজার মমি খুঁজে পাই তাহলে তা কোথায় আছে কাউকে জানাব না। শুধু কটা ছবি তুলে নিয়ে ফিরে যাব। গুরেলাল তাতে রাজি হয়েছিল।

ও যে শুধু আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকে খোঁজাখুঁজি চালাত তাই নয়, নিজের মতন করেও একে-তাকে জিজ্ঞেস করত। মাঝে মাঝেই আফশোস করে বলত, বাবুজী, তোমার আর আমার একই অবস্থা। বুঝতে পারছি কয়েকজন লোক জায়গাটা জানে, কিন্তু তারা যে ঠিক কারা সেটাই ধরতে পারছি না।

এরমধ্যে একদিন গুরেলাল ভারী উত্তেজিত হয়ে ভর-দুপুরবেলায় আমার ঘরের দরজার কড়া নাড়ল। আমি দরজা খুলে বললাম, কী ব্যাপার গুরেলাল?

বাবুজী, একটা জায়গার হদিশ পেয়েছি। আমার এক বুড়ি ঠাকুমা আছে। তার কাছে গিয়েছিলাম। সে আমাকে কথায় কথায় বলল তারা ছোটবেলায় নাকি বরাকুলা বলে একটা গুহার সামনে রাজা কিলারায়ের নামে পুজো দিতে যেত। চলো তো একবার ঘুরে আসি বরাকুলার সেই গুহায়।

সেদিন ঠা-ঠা রোদ্দুরের মধ্যেই আমি আর গুরেলাল সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একটা হ্যাভারস্যাকের মধ্যে আমার ক্যাম্পিং-এর জিনিসপত্র থাকে। সেটাকেও সঙ্গে নিয়ে নিলাম। কপাল ভালো ছিল, একটু পরেই মেঘ করে এলো। নাহলে বোধহয় লু-এর দাপটে সেদিন রাস্তার মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যেতাম।

পাহাড়ের পাকদণ্ডি রাস্তায় দূরত্বের হিসেব ঠিক বোঝা যায় না। তবু মনে হয় সেদিন আট-ন’ কিলোমিটার সাইক্লিং করার পরে আমরা একটা গুহার মুখে পৌঁছেছিলাম। দু’দিকের পাথরের গায়ে পুরনো সিঁদুরের দাগ-টাগ দেখে বুঝতে পারছিলাম এককালে সত্যিই এখানে পুজো হত। কিন্তু এখন জঙ্গলে গুহার মুখটা ঢাকা পড়ে গেছে। গুরেলাল চটপট কোমর থেকে দা-টা খুলে নিয়ে সেই ঝোপজঙ্গল কেটে আমাদের ঢোকার বন্দোবস্ত করল। আমি হ্যাভারস্যাক থেকে বড় টর্চ, নাইলনের দড়ি, জলের বোতল এইসব বার করে সঙ্গে নিয়ে নিলাম। কারণ, অভিজ্ঞতা থেকে জানতাম, পাহাড়ের এইসব গুহার গোলোকধাঁধায় রাস্তা হারানোটা খুব সাধারণ ব্যাপার।

গুহায় ঢুকে মিনিট তিনেক হাঁটার পরেই বাইরের আলো মুছে গেল। আমি টর্চ জ্বালালাম আর টর্চের আলোটা দেয়ালে পড়ামাত্র আমার বুকটা কেঁপে উঠল।

মিশর যাইনি কখনো। কিন্তু অজস্র ছাপা বইয়ে আর ই-বুকে দেখেছি পিরামিডের ভেতরের ছবি। এই গুহার দেয়াল জুড়েও সেরকম অজস্র রঙিন ছবির ভিড়। এখানেও ছবি কথা বলছে—বলছে রাজা মহীসুখের নানান কীর্তির কথা, তাঁর বাঘের কবলে মৃত্যুর কথা। বলছে কিলারায়ের জন্ম ও তার অপমৃত্যুর কথা। পেছল পাথরের ওপর দিয়ে আমি আর গুরেলাল এক পা এক পা করে এগোচ্ছি আর দেখছি সিনেমার মতন ফ্রেমের পর ফ্রেমে রাজা মহীসুখ আর রাজা কিলারায়ের জন্ম থেকে মৃত্যু সবটাই ধরা রয়েছে।

তারপর একটা ছবির সামনে এসে আমার পা-দুটো যেন পাথর হয়ে গেল।

ছবিটায় দেখা যাচ্ছে মেঝের ওপর শোয়ানো রয়েছে এক মৃতদেহ আর তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। বৃদ্ধের ডান হাতে যা ধরা আছে তার সঙ্গে আজকের সার্জনের ছুরির বিশেষ তফাৎ নেই। একদিকে স্তূপ করে রাখা আছে সবুজ লতাপাতা। অনেকগুলো ধুনুচির থেকে ধোঁয়া উঠছে। আর হাওয়ায় যে মূর্তিগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে তারা নিশ্চয়ই নারিয়াদের দেবদেবী।

দেবতাদের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে রাজবৈদ্য জগন নারিয়া কিলারায়ের শরীর মমি করছেন।

আমার আনন্দে ডিগবাজি খেতে ইচ্ছে করছিল। মনে হচ্ছিল তখনই স্যারকে ফোন করে বলি—স্যার, আপনার থিয়োরির পক্ষে অকাট্য প্রমাণ খুঁজে পেয়েছি। মমিফিকেশনের ছবির সামনেই আমি দাঁড়িয়ে আছি স্যার। কিন্তু আগেই বলেছি, এই পাহাড়ে মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া যায় না।

গুরেলালের অবস্থাও দেখলাম আমারই মতন। হয়তো আমার থেকেও ওর রক্তের স্রোত বেশি জোরে দৌড়চ্ছিল, কারণ ও নিজে একজন নারিয়া। জন্ম থেকে ও শুনে আসছে ওদের দিনবদলের জাদুকর রাজা কিলারায়ের কথা। আর এই মুহূর্তে ও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই রাজার সমাধিতে।

আরো কিছুটা এগোনোর পরে সুড়ঙ্গটা হঠাৎ চওড়া হয়ে গেল। এই জায়গাটা অনেকটা একটা বড়সড় হলঘরের মতন। এখানেই সুড়ঙ্গটা শেষ, ওদিকে আর যাওয়ার জায়গা নেই। এইখানেই কি তাহলে রাজার মমি রয়েছে?

টর্চের আলো যেদিকেই ফেলছি সেদিকেই দেখছি নানান আকারের মাটির বড় বড় জালা, কলসি, গামলা এইসব রাখা আছে। রয়েছে কাঠের খাট, জলচৌকি এবং ওইরকমই আরো কিছু আসবাব। জিনিসগুলো অনেক পুরনো। ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে। পিরামিডের গুপ্তধনের সঙ্গে এসবের কোনো তুলনা চলে না। ফ্যারাওদের ঐশ্বর্য নারিয়াদের রাজা পাবেন কোথায়? তবু ওগুলো দেখেই আমার আশা দ্বিগুণ হয়ে উঠল। মনে হল, নারিয়ারাও তার মানে ইজিপ্সিয়ানদের মতনই বিশ্বাস করত মমির পাশে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখে দেওয়া দরকার, যাতে মৃত্যুর দেশ থেকে ফিরে এসেও রাজার কোনো অসুবিধে না হয়। জিনিসগুলো কমদামি হতে পারে, কিন্তু পেছনের স্পিরিট-টা এক।

কিন্তু মমি কোথায়?

ওই তো। ওই তো দেয়ালের কোনায় নামানো রয়েছে পাথরের তৈরি কফিনের মতন একটা বাক্স। গুরেলালের হাতে টর্চটা ধরিয়ে দিয়ে আমি দৌড়ে গেলাম বাক্সটার কাছে। গায়ের সমস্ত জোর এক করে উলটে দিলাম বাক্সের ঢাকনাটা আর তারপরেই একরাশ হতাশা আমাকে ঘিরে ধরল। আমি মেঝের ওপরেই বসে পড়লাম।

কফিনটা খালি। ভেতরে একগাদা পুরনো রেশমের কাপড় ছাড়া আর কিছুই নেই।

তারপর আমি একটার পর একটা কলসি আর জালার ভেতরে আলো ফেলতে শুরু করলাম। কিচ্ছু নেই। ওগুলোর ভেতরেও কিছু নেই। সব খালি।

এর একটাই মানে হয়। রাজা কিলারায়ের মমিঘর লুঠ হয়ে গেছে।

কিন্তু কারা এই কাজ করল?

আমি মুখে কোনো কথা বলিনি। কিন্তু গুরেলালের মুখ থেকে ঠিক সেই সময়েই উত্তরটা ভেসে এলো। রাগে গরগর করতে করতে ও বলল, এ সেই কিলারায়ের শত্রুদের কাজ। তাদের বংশধরেরা আজও নাকি কিলারায়কে একইরকম ঘৃণা করে। তারাই কেউ নিশ্চয় রাজার শরীর নষ্ট করে ফেলেছে; লুঠ করে নিয়ে গেছে মমিঘরের সমস্ত সম্পদ।

তাই হবে। কে এই কাজ করেছে তাতে আমার আর কিছু আসে যায় না। আসল কথা এইটাই যে, প্রফেসর বিশ্বদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্ন সত্যি হল না। খুঁজে পাওয়া গেল না রাজা কিলারায়ের মমি।

কিছুক্ষণ বাদে উঠে দাঁড়ালাম। একটা কাজই বাকি ছিল। ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বার করে প্রতিটি আসবাব, দেয়ালের প্রত্যেকটা ছবি আর সেই কফিনের মতন শবাগারের যতটা পারি নিখুঁত স্ন্যাপ নিলাম। হয়তো এগুলো থেকেই স্যার কিছু একটা দাঁড় করাতে পারবেন।

পরদিন ভোরবেলাতেই রওনা হয়ে গেলাম পান্নার দিকে। পান্না অবধি যেতে হল না। শহরে ঢোকার কয়েক কিলোমিটার আগে একটা জায়গায় পৌঁছে পকেট থেকে মোবাইল বার করে দেখলাম বেশ পরিষ্কার টাওয়ার ধরা যাচ্ছে। আমি স্যারকে কানেক্ট করলাম। ওদিক থেকে ভেসে এলো সেই গম্ভীর গলার স্বর—বলো মৃন্ময়।

আমি গতকালের সমস্ত ঘটনাই খুলে বললাম। আমি কথা শেষ না করা অবধি স্যার একটাও কথা বললেন না। তারপর প্রথম কথাটাই যেটা বললেন, সেটা শুনে আমি তো হতবাক। উনি বললেন, তুমি ঠকে গেছ মৃন্ময়। ইন ফ্যাক্ট, তিরিশ বছর আগে আমাকেও ওরা এইভাবেই ঠকাবার চেষ্টা করেছিল।

পাঁচ

স্যারের কথা আমার কিছুই মাথায় ঢুকছিল না। উনি বোধহয় আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, তোমার কাছে ক্যামেরাটা রয়েছে?

ক্যামেরাটা কাছেই ছিল। ভেবেছিলাম পান্নার কোনো সাইবার-কাফে থেকে কয়েকটা ছবি স্যারকে মেল করে পাঠিয়ে দেব। বললাম, হ্যাঁ, রয়েছে।

তুমি কি ওই পাথরের কফিনটার ছবি তুলেছিলে?

হ্যাঁ, স্যার। তুলেছিলাম।

বেশ। বার করো ছবিগুলো। আমি ফোন ধরে আছি।

ভিউ-ফাইন্ডারে একটা ছবি ধরে রেখে স্যারকে বললাম, হ্যাঁ স্যার। বার করেছি।

কফিনের ডালার কব্জাগুলো দেখো।

সঙ্গে সঙ্গে ছবিটাকে একটু জুম করে কব্জাগুলো দেখলাম। তারপরে নিজেকে ধিক্কার দিতে শুরু করলাম। আমার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিল।

তালা, কব্জা, এইধরনের জিনিসগুলো মানুষের সঙ্গে সঙ্গে অনেকদিন ধরে রয়েছে। সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে এদেরও বিবর্তন ঘটেছে। আমাদের তাই মোটামুটি শিখতে হয় কোন সময়ে কোন জায়গায় কেমন কব্জা বা কেমন তালার চল ছিল। ভালো করে দেখামাত্রই বুঝতে পারলাম, শবাগারের গায়ে যে কব্জাগুলো লাগানো রয়েছে সেগুলোর বয়স কোনোমতেই ভারতের স্বাধীনতার বয়সের থেকে বেশি নয়। একদম হাল আমলের জিনিস। টাটা-কোম্পানিতে তৈরি হলে অবাক হব না। চারশো বছর আগে এমন হালকা-পলকা ছোট কব্জার কথা কেউ ভাবতেই পারত না।

কী হল মৃন্ময়?—আমার মোবাইলে স্যারের গলা ভেসে এলো। তাতে তিরস্কারের ছিটেফোঁটা সুর নেই। বুঝতে পেরেছ কী বলতে চাইছি?

আমি কোনোরকমে বললাম, পেরেছি স্যার। কিন্তু এরকম হল কেন?

একে ইংরিজিতে বলে red herring তোমার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার একটা কায়দা আর কি।

আমি আমতা আমতা করে বললাম, আপনি কি…আপনাকেও কি ওরা ওই বরাকুলার গুহায় নিয়ে গিয়েছিল? মানে সেই তিরিশ বছর আগেও?

গিয়েছিল বই কি। ইন ফ্যাক্ট, আমার তো মনে হয়েছিল আমার জন্যেই ওই গুহার স্টেজটাকে প্রথমবার সাজানো হয়েছিল। ওখানে অন্যান্য যা কিছু দেখলে সেগুলো নারিয়াদের পক্ষে জোগাড় করা কঠিন নয়। চারশো কেন, হাজার বছরেও ওদের ওই মাটির হাঁড়ি, কলসি আর গামলা একটুও বদলায়নি। গ্রামের ছুতোরের তৈরি খাট, জলচৌকি সেসবও মোটামুটি একই রয়েছে। শুধু জিনিসগুলোতে একটু পুরনো রং ধরাতে হয়েছিল। কিন্তু চারশো বছর আগের কব্জা পাবে কোথায়? সেটা তো নারিয়াদের গ্রামে তৈরি হত না। ওরা জানেও না তখনকার কব্জা কেমন দেখতে হত। তাই একটু রিস্ক নিয়েই লোকাল হার্ডওয়ার দোকানের জিনিস লাগিয়ে দিয়েছিল।

আর আপনি সেটা ধরে ফেলেছিলেন। স্যার, আপনি ওই বরাকুলা গুহার খোঁজ পেয়েছিলেন কার কাছে?

সেকি! তোমাকে বলিনি? সে এক মজার গল্প। আমি ঘুরতে ঘুরতে দেওপাটনি গিয়ে একে-ওকে রাজার কথা জিজ্ঞেস করতেই এক বছর তিরিশের ছোকরা এগিয়ে এলো। নাম খুবলাল। খুবলাল নারিয়া। মাসদুয়েক ও আমার হেল্পিং-হ্যান্ডের কাজ করেছিল। ও-ই আমাকে একদিন এসে বলল, এক বুড়ির কাছে নাকি শুনেছে বরাকুলার গুহার কথা। সেই গুহাতে ওই বুড়িরা অনেক বছর আগে পুজো দিতে যেত। খুবলালের সঙ্গেই বরাকুলায় গিয়েছিলাম। তবে ওকে আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে দিইনি যে বরাকুলার ফাঁকিবাজিটা আমি ধরে ফেলেছি। বরং এমন মুখ করেই ফিরে এসেছিলাম যাতে মনে হয় মমি যে চুরি হয়ে গেছে সে ব্যাপারে আমি একেবারে কনভিন্সড।

কেন স্যার?

আরে, ততদিনে যে আমি আরেকটা জিনিস জেনে ফেলেছি।

কী স্যার?

যতই পাতার কুঁড়েঘরে থাক আর সারাদিন ছাগল চরাক, খুবলাল হচ্ছে সেই পাঁচ গাঁওবুড়োর একজনের বংশধর—যাদের হাতে জগন নারিয়া রাজার মৃতদেহ রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন। সেইজন্যেই ও দায়িত্বসহকারে আমাকে ঠকিয়েছিল, মানে ঠকানোর চেষ্টা করেছিল আর কি। তখন যদি ও বুঝতে পারত সেই চেষ্টা বিফলে গিয়েছে তাহলে কী করত কে জানে। হয়তো আমাকে খুনই করে ফেলত। কাজেই যে যাত্রা ওইভাবেই রণে ভঙ্গ দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, পরে গিয়ে আবার চেষ্টা করব। আর যাওয়া হয়নি।

স্যারের কথা শুনতে শুনতেই আমার মনের মধ্যে একটা সন্দেহ মাথা চাড়া দিচ্ছিল, তাই ওনার কথা শেষ হতেই জিজ্ঞেস করলাম, খুবলালের ফ্যামিলিতে আর কে কে ছিল মনে আছে স্যার?

কেন মনে থাকবে না? আমার মেমরি অত খারাপ নয়। ফ্যামিলি বলতে খুবলালের বউ আর দুটো ছেলে। ছোটটা তখনো হাঁটতে পারত না। মা কাজ করত আর ও মায়ের পিঠের ঝোলায় শুয়ে ঘুমোত। বড়টার বয়েস তখন ছিল পাঁচ বছর। খুব মিষ্টি ছিল ছেলেটা। একটু বেঁটেখাটো বলেই বোধহয়, ওরা ওকে গুরেলাল বলে ডাকত।

কিন্তু তুমি এসব কেন জিজ্ঞেস করছ বলো তো মৃন্ময়?

ছয়

পান্না অবধি আর গেলাম না। সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে নিলাম দেওপাটনির দিকে। আমার মাথার মধ্যে তখন রাগ, হতাশা, দুঃখ সব একসঙ্গে কিড়কিড় করছিল। যে গুরেলালের ওপর আমি এতটা ভরসা করেছিলাম, সে আসলে বিশ্বাসঘাতক!

মহুল গাছের ছায়ায় ছায়ায় কিছুক্ষণ সাইকেল চালানোর পরে অবশ্য মাথাটা অনেকটা ঠান্ডা হয়ে এলো। আমি ঘটনাটার পেছনে ভালো দিকগুলো দেখতে শুরু করলাম।

এক, গুরেলালের এই ধোঁকাবাজির চেষ্টা প্রমাণ করে দিল যে, সত্যিই কোথাও না কোথাও রাজা কিলারায়ের মমি রয়েছে।

দুই, সেই মমির খোঁজে আমাকে আর গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতে হবে না। হাতের কাছে গুরেলাল রয়েছে। গাঁওবুড়োর বংশধর, খুবলালের ছেলে গুরেলাল, যে মমির লুকোনো ঘরের কথা জানে। ওকে ভালো করে চেপে ধরলে ও কি একবার আমাকে সেটা দেখতে দেবে না?

কিন্তু সেসব কিছুই করা হল না। তার আগেই এমন একটা ঘটনার সাক্ষী হলাম যেরকম ঘটনা দুঃস্বপ্নেও কখনো দেখিনি।

আমি যখন সাইকেল নিয়ে দেওপাটনির দিকে ফিরছিলাম তখনই অনেকগুলো গাড়ির একটা কনভয় আমাকে ওভারটেক করে চলে গেল। সরু রাস্তার একদিকে কোনোরকমে সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে নিজেকে বাঁচালাম। ধুলোর মেঘের মধ্যে দিয়ে দেখলাম দুটো জিপ আর চারটে ট্রাক ভর্তি করে পুলিশ আর প্যারামিলিটারি ফোর্সের লোকেরা কোথায় যেন যাচ্ছে। প্রত্যেকের হাতে বন্দুক। ভাবলাম, বোধহয় অ্যান্টি-টেররিস্ট অপারেশন। তবে কনভয়ের একদম পেছনে ঢিকঢিক করতে করতে যে বুলডোজারটা যাচ্ছিল, টেররিস্ট দমনে সেটার ভুমিকা কী হতে পারে বুঝতে পারছিলাম না।

বুঝতে পারলাম দেওপাটনির কাছাকাছি এসে। ততক্ষণে সেই কনভয়ের পুলিশেরা গ্রামের লোকেদের মারতে মারতে বার করেছে। ছোট্ট গ্রামটাকে ঘিরে পুলিশের ব্যারিকেড। তারই মধ্যে বুলডোজারটা একটা একটা করে কুঁড়েঘর টান মেরে মাটিতে ভেঙে ফেলে দিচ্ছে। গ্রামের মেয়ে আর বাচ্চারা একটু দূরে দাঁড়িয়ে ডাক ছেড়ে কাঁদছিল। পুরুষেরা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে যতটা পারে নিজেদের সম্পত্তি উদ্ধার করে আনছিল। অবশ্য সম্পত্তি আর কী? দু-চারটে অ্যালুমিনিয়ামের থালা-বাটি, কাস্তে-কুড়ুল আর ছেঁড়া জামাকাপড়—এই তো।

গুরেলাল একদিকে পাথরের মতন দাঁড়িয়েছিল। দেখলাম ওর পায়ের কাছে আমার হ্যাভারস্যাকটা নামানো রয়েছে। তার মানে নিজের জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে আমার ঘরের জিনিসপত্রও আগেই বার করে এনেছে।

এই দৃশ্য দেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। একটা জিপের গায়ে হেলান দিয়ে উর্দিপরা যে লোকটা সিগারেট ফুঁকছিল সেই নিশ্চয় এই বীরপুঙ্গবদের দলপতি। আমি একরকম দৌড়তে দৌড়তেই তার সামনে গিয়ে বললাম, এসব কী হচ্ছে? নিরীহ লোকগুলোর ঘর ভাঙছেন কেন?

সিগারেটটা পায়ের জুতোর তলায় মাড়িয়ে সেই মেজর কিম্বা ক্যাপ্টেন ঠান্ডা চোখে আমার আপাদমস্তক মাপল। তারপর বলল, হু আর ইউ? সোসাল অ্যাকটিভিস্ট?

নো। আই অ্যাম আ স্টুডেন্ট ফ্রম ওয়েস্ট-বেঙ্গল। কেম হিয়ার ফর মাই ফিল্ড-ওয়ার্ক। কিন্তু আমার প্রশ্নটার জবাব দিন। এরা কি অপরাধ করেছে?

লোকটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দিল—এখানে এই পাহাড়ের নীচে বক্সাইটের খনি আছে। একটা মালটিন্যাশনাল কোম্পানি পাহাড়টা কিনে নিয়েছে। এদের অনেকদিন থেকে জায়গাটা ছেড়ে দেবার কথা বলা হচ্ছিল। শুনছিল না। তাই আজ বাধ্য হয়েই একটু জোর খাটালাম।

এরপরে লোকটার সঙ্গে অনেক তর্ক করলাম। অনেকভাবে হিউম্যান রাইটসের দোহাই দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে এইভাবে আদিবাসীদের নিজেদের জমি থেকে উৎখাত করাটা বেআইনি। কিন্তু কে শোনে কার কথা? শেষকালে আমি আর থাকতে না পেরে বললাম, তুমি একটি অমানুষ।

লোকটা হাতের বেটনটা তুলে আচমকা আমার কপালে সজোরে বসিয়ে দিল। আমার চোখের সামনে গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো।

চোখ খুলে দেখলাম মাথার ওপরে তারা ভরা আকাশ। তার মানে আমি চিত হয়ে শুয়ে আছি। কিন্তু কোথায়?

কপালে হাত দিয়ে দেখলাম, ন্যাকড়া দিয়ে কিছু লতাপাতার পেস্ট বাঁধা রয়েছে। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা। খুব সাবধানে এদিকে-ওদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। একটু দূরে ছায়ার মতন মানুষজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও কোথাও খোলা আকাশের নীচেই আগুন জ্বলছে। আস্তে আস্তে দু’ কনুইয়ের ওপর ভর রেখে উঠে বসলাম। দেখলাম একটা বাঁশের চালির ওপরে বসে আছি। বুঝতে অসুবিধে হল না, আমি মিলিটারি বেটনের ঘায়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর নারিয়ারা আমাকে এই চালিটায় শুইয়ে এখনে বয়ে নিয়ে এসেছে।

হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে আমার কাঁধের ওপর হাত রাখল। মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম গুরেলালের বউ মোতিয়া।

মোতিয়া বলল, এরকম কেউ করে বাবুজী? মিলিটারির সঙ্গে ঝগড়া করতে যায়? নারিয়ারা এক জায়গায় গ্রাম বসাবে, তারপর একদল রহিস আদমি তাদের সেখান থেকে মেরে তাড়াবে। এটাই তো আমাদের ভাগ্য। এইভাবেই তো আমরা বেঁচে আছি। রাজপুতরা আমাদের মেরেছে, ইংরেজরা মেরেছে। এখন নিজেদের পুলিশ-মিলিটারি মারছে। ততদিনই মারবে যতদিন আমাদের রাজা না ফিরে আসে।

কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। মোতিয়া আমাকে থামিয়ে দিল। তারপর এক লোটা ঠান্ডা জল দিয়ে যত্ন করে আমার হাত-মুখ ধুইয়ে দিয়ে হাতে গরম দুধের একটা গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলল, খেয়ে নাও বাবুজী। অনেক রক্ত বেরিয়ে গেছে তোমার শরীর থেকে। এখন কথা বললে কাহিল হয়ে পড়বে।

আমি দুধের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে নদীর চরে ঘুরে বেড়ানো লোকগুলোকে দেখছিলাম। বললাম, ওরা কী করছে?

মোতিয়া বলল, ওরা দেওপাটনিরই লোক। এখানে নতুন করে ঘর বাঁধছে। হাতে কাটারি রয়েছে। জঙ্গলে রয়েছে বাঁশ আর কুশের পাতা। ঘর বাঁধতে সময় লাগবে না।

তারপর মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলল, তুমি খুব ভালো লোক বাবুজী। আমি জানি তুমি কী খুঁজছ। আমরা সবাই জানি। কিন্তু কেউ তোমাকে বলব না ছোটরাজা কোথায় রয়েছে।

‘ছোটরাজা’! কথাটা কানে লাগল। মোতিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছোটরাজা’ বললে কেন?

মোতিয়া খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, তো কী বলব? রাজা যখন মারা গেল তখন তার উমর কত ছিল জানো? দো সাল। তারপর থেকে তো সে একইরকম রয়েছে। সে তো আর বড় হয়নি। তাই ‘ছোটরাজা’ বলি।

মোতিয়া চলে গেল। একটু বাদে গুরেলাল নিজেই এসে আমার পাশে বসল। আমি বললাম, গুরেলাল, তুমি জানো কোথায় রাজা কিলারায় রয়েছেন, তাই না?

গুরেলাল কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করল।

আমি একটু অপেক্ষা করে থেকে আবার বললাম, বিশ্বাস করো গুরেলাল, আমি ওই মমির কথা কাউকে জানাবো না। কোনো ছবি নেবো না। আমি এ ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছি। তোমাদের বিশ্বাসে আমি আঘাত করব না। আমি শুধু একবার ওই মমিটাকে নিজের চোখে দেখতে চাই।

গুরেলাল মুখ নিচু করেই বলল, পারব না বাবুজী। তুমি তো জানো, আমাদের মধ্যেই এমন এমন লোক রয়েছে যারা রাজার শরীর খুঁজে পেলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে নষ্ট করে ফেলবে। সেইজন্যেই আমরা যে কয়েকজন রাজার হদিশ জানি, তাদের শপথ নিতে হয় যে, প্রাণ গেলেও রাজার খোঁজ কাউকে দেব না। একটা কথা যে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে যায় তা কি কেউ বলতে পারে?

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কার কাছে শপথ নিয়েছিলে গুরেলাল? তোমার বাবা খুবলালের কাছে?

হ্যাঁ বাবুজী। মারা যাওয়ার সময় বাবা আমাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন।

তুমি জানো, তুমি আমাকে গতকাল যেভাবে বরাকুলার গুহায় নিয়ে গিয়েছিলে, তোমার বাবা আজ থেকে তিরিশ বছর আগে আমার গুরুজীকে একইভাবে একই গুহায় নিয়ে গিয়েছিলেন?

জানি বাবুজী। গুরেলালের গলায় কোনো অনুশোচনা খুঁজে পেলাম না। বরং পরের কথাটা ও একইরকম ঠান্ডা গলায় উচ্চারণ করল।

যদি আপনার গুরুজী বরাকুলার গল্পটা বিশ্বাস করে ফিরে না যেতেন, তাহলে বাবা ওনাকে গুমখুন করতেন। আমাদের ওপর জগন নারিয়ার সেরকমই নির্দেশ আছে।

আমি অবাক হয়ে গুরেলালের মুখের দিকে তাকালাম। এই গুরেলালকে কি আমি চিনি? আমি বললাম, গুরেলাল! বিশ্বাস তো আমি করিনি। তাহলে আমকে খুন করছ না কেন?

গুরেলাল বলল, হয়তো করতাম। আজ রাতেই করতাম। কিন্তু সকালের ওই ঘটনার পরে আর ওটা পেরে উঠব না।

তারপর হঠাৎ গুরেলাল আমার হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, বাবুজী, আমার বুকের ভেতরটা তোমাকে দেখাতে পারলে তুমি বুঝতে পারতে আমি কি যন্ত্রণা পাচ্ছি। তবে একটা কথা তোমাকে বলে দিচ্ছি বাবুজী, তুমি নিজে যদি কিলারায়কে খুঁজে বার করতে পারো, তাহলে তোমাকে কিচ্ছু বলব না।

গুরেলাল উঠে যাচ্ছিল। আমি ওকে পেছন থেকে ডাকলাম। বললাম, একটা কথা বলে যাও গুরেলাল।

গুরেলাল ফিরে এল। আবার আমার পাশে বসে বলল, কী বাবুজী?

আমি তো ভাবছিলাম দেওপাটনির ওই পাতালের দিকে নেমে যাওয়া সিঁডি, ওই বুজে যাওয়া ইঁদারা—ওসবের নীচেই খুঁজে দেখব তোমাদের রাজার মমিঘর। কিন্তু ওখানে তো এখন বুলডোজার ঢুকে পড়ল। তোমার চিন্তা হচ্ছে না গুরেলাল? যদি তোমাদের রাজার শরীর বক্সাইটের চাঙড়ের তলায় চাপা পড়ে যায়?

গুরেলাল আমার এই প্রশ্নের উত্তরে ভারী অদ্ভুত একটা কথা বলল। বলল, বাবুজী, তুমি মিশর না কোথাকার গল্প বলো, যারা নাকি মরা রাজাদের থাকার জন্যে আকাশছোঁয়া তিনকোনা বাড়ি বানায়। তা সে ওরা বানাতে পারে। ওদের রাজা বড় রাজা। তার ঘর তো কেউ ভাঙতে সাহস পায় না। কিন্তু আমাদের নারিয়াদের তাড়া খেয়ে খেয়ে জীবন কাটে। তাই আমরা পাকা ঘর বানাই না। আমাদের রাজারও পাকা ঘর নেই। সেও ঘুরে বেড়ায়।

দেওপাটনি মাটির তলায় চলে যাবে, আমাদের রাজা অন্য কোথাও গিয়ে বিছানা পাতবে। ও নিয়ে আমার চিন্তা নেই।

গুরেলাল চলে যাওয়ার সময় কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। মনে হল, ও আমাকে একটা কিছু ইঙ্গিত করে গেল।

সাত

দেখতে দেখতে নতুন জায়গায় তিনদিন কেটে গেল। মাথার যন্ত্রণাটা গুরেলালের ওষুধের গুণে এখন অনেক কম।

স্যার মাঝে মাঝে একটা কথা বলেন—সব যুদ্ধ যে জিততে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। যুদ্ধে নামাটাই আসল।

এই যুদ্ধটা জিততে পারলাম না। তবে এইটুকুই সান্ত্বনা, নারিয়াদের হৃদয় জিততে পেরেছি। একজন শহুরে মানুষের পক্ষে সেটাও কম বড় অ্যাচিভমেন্ট নয়। ভবিষ্যতে আবার এদের মধ্যে ফিরে এলে আমার কোনো অসুবিধে হবে না।

এরা আমার জন্যে একটা বেশ শক্তপোক্ত কুঁড়েঘর বেঁধে দিয়েছে। এখানে আসার পর প্রথম দু’দিন ওটার মধ্যেই সারাদিন শুয়ে বসে কাটালাম। আজই প্রথম বাইরে বেরিয়ে রিভারবেডে পায়চারি করছিলাম। গুরেলাল আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে বলল, তুমি কবে যাচ্ছ বাবুজী?

অস্বীকার করব না, মনে একটু আঘাত পেলাম। বললাম, আর বেশিদিন তোমাদের জ্বালাব না। ঠিক করেছি আগামীকালই কলকাতার দিকে রওনা দেব।

গুরেলাল মনে হল কথাটা শুনে নিশ্চিন্ত হল। কিন্তু একইসঙ্গে একটু লজ্জাও পেল। তাড়াতাড়ি বলল, না, না। আমাদের অসুবিধে কোথায়? শুধু আগামীকাল আমাদের একটা পরব আছে। সবাই দলবেঁধে দূরে এক জায়গায় যাব। তাই ভাবছিলাম তুমি একা থাকবে?

আমি বললাম, চিন্তা নেই, আমি কাল সকালেই বেরিয়ে পড়ব।

সত্যিই বেরিয়ে পড়লাম পরদিন সকালে। বেরোনোর সময়টা যত তাড়াতাড়ি পারি ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করব। দেওপাটনির লোকজন আমাকে ঘিরে ধরেছে। কেউ আমার হাতে তুলে দিচ্ছে একটা জংলি আতা, কেউ দিচ্ছে একটা ধনেশ পাখির পালক। বিদায় উপহার। সবার পেছনে সবার থেকে দূরে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে গুরেলাল আর মোতিয়া। মোতিয়ার পিঠে শাড়ির টুকরো দিয়ে বাঁধা ওদের বাচ্চাটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আমি হাত নেড়ে গুরেলালকে ডাকলাম। বললাম, চলি গুরেলাল। আবার দেখা হবে। গুরেলাল বলল, অপরাধ নেবেন না বাবুজী, আমি যে কতটা অসহায় সেটা বুঝতে চেষ্টা করবেন।

আমি গুরেলালকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর হ্যাভারস্যাকের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে যত টাকা-পয়সা পেলাম বার করে গুরেলালের হাতে গুঁজে দিলাম। ও অবাক হয়ে বলল, এ কি করছেন বাবুজী? আমি কি টাকার জন্যে আপনার সেবা করেছি?

বললাম, তোমাকে দিইনি তো। তোমার বাচ্চাকে দিলাম। চলি গুরেলাল।

গুরেলাল বলল, আসুন। ধনিকরামকে বলেছি, ও আপনাকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে নিয়ে যাবে। পান্না অবধি পৌঁছিয়ে দিয়ে ফিরে আসবে।

ধনিকরামকে চিনতাম। সতেরো-আঠেরো বছর বয়সের বেশ স্বাস্থ্যবান একটা ছেলে। পনেরো কিলোমিটার রাস্তা আমাকে আর আমার চেয়েও ভারী হ্যাভারস্যাকটাকে সাইকেলে ক্যারি করে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে ওর চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ হতে পারে না। তবে ও একটু বেশি কথা বলে। মনে হয় খুব সরল। ধনিকরামের সাইকেলে চেপে ওর সঙ্গে টুকটাক গল্প করতে করতে কখন যে পান্না পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না।

স্টেশনের কম্পাউন্ডে ঢুকতে ঢুকতে নিছক একজন নৃতত্ত্ববিদের কৌতূহল থেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের আজ কিসের পরব ধনিকরাম? আজ তো পূর্ণিমা নয়?

ধনিকরাম চলে যেতে যেতে বলল, সেকি, আপনি জানেন না? আজ তো রাজা ঘুম থেকে জাগবে। চারশো বছর আজকেই পূর্ণ হচ্ছে কিনা।

আমাকে ততক্ষণে ঘিরে ধরেছে স্টেশনের পাকা বাড়ি, লোহার পিলার, টিনের শেড। কানে আসছে ট্রেনের হুইসল, শয়ে শয়ে মানুষের চিৎকার-চেঁচামেচি আর পাবলিক-অ্যাড্রেস-সিস্টেমে তারস্বরে ট্রেন আসা-যাওয়ার ঘোষণা। বিন্ধ্যপর্বতের এককোনায় ঘন জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক কুঁচি গ্রামে বসে যেসব কথাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, এই পরিবেশে তাকেই মনে হয় পাগলের প্রলাপ। আমি ধনিকরামের কথা শুনে তাই একটু হেসে ওয়েটিংরুমের দিকে পা বাড়ালাম। আমার ট্রেন আসতে এখনো এক ঘণ্টা দেরি। ততক্ষণ ওখানেই সময় কাটাতে হবে।

বসে থাকতে থাকতে মন চলে গেল আবার গত একমাসের নানান ঘটনা আর নানান কথার দিকে। স্মৃতির কি আশ্চর্য খেলা জানি না। অত কিছুর মধ্যে থেকে সে কেবল দুটো কথাকে হঠাৎ পাশাপাশি বসিয়ে আমার কানে বাজিয়ে দিল।

একটা কথা স্যার বলেছিলেন ফোনে—”আমার মেমরি অত খারাপ নয়। ফ্যামিলি বলতে খুবলালের বউ আর দুটো ছেলে। ছোটটা তখনো হাঁটতে পারত না। মা কাজ করত আর ও মায়ের পিঠের ঝোলায় শুয়ে ঘুমোত। বড়টার বয়েস তখন ছিল পাঁচ বছর। খুব মিষ্টি ছিল ছেলেটা। একটু বেঁটেখাটো বলেই বোধহয়, ওরা ওকে গুরেলাল বলে ডাকত।”

আরেকটা কথা মাত্র চারদিন আগে গুরেলাল আমাকে বলেছিল। আমার তখনও মনে হয়েছিল কথাটার মধ্যে একটা অন্য মানে আছে। কথাটা হল—”আমাদের নারিয়াদের তাড়া খেয়ে খেয়ে জীবন কাটে। তাই আমরা পাকা ঘর বানাই না। আমাদের রাজারও পাকা ঘর নেই। সেও ঘুরে বেড়ায়।

‘দেওপাটনি’ মাটির তলায় চলে যাবে, আমাদের রাজা অন্য কোথাও গিয়ে বিছানা পাতবে। ও নিয়ে আমার চিন্তা নেই।”

আমি একজন হিপনোটাইজড মানুষের মতন ওয়েটিং রুমের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটতে শুরু করলাম স্টেশন ছেড়ে বাইরের দিকে। একবার যেন অস্পষ্ট শুনলাম হাওড়ায় যাবার ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে। হোক। ও ট্রেনে আমার যাওয়া হবে না। আমাকে অন্য এক জায়গায় যেতে হবে। যেখানে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা অপূর্ব সুন্দর এক নদীর চরায় দেওপাটনির নারী-পুরুষেরা তাদের রাজাকে বরণ করার জন্যে তৈরি হচ্ছে।

আট

সূর্য তখন রাত্তিরের স্যুইমিং-পুলে ঝাঁপ দেবে বলে পাহাড়চুড়োর ডাইভিং-বোর্ডে উঠে দাঁড়িয়েছে। নদীর চড়ায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেওপাটনির মানুষজন। আমি ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

সবার আগে আমাকে দেখতে পেল ধনিকরাম। ওর মুখটা হাঁ হয়ে গেল। তারপরেই ঘুরে তাকাল গুরেলাল। গুরেলাল কিন্তু অবাকও হল না, রাগলও না। বরং ওর সেই খুব চেনা ঝকমকে হাসিটা হাসতে হাসতে দৌড়ে এলো আমার দিকে। বলল, বাঁচালে বাবুজী। মনটা খুব খারাপ লাগছিল। জানি তো, রাজাকে জেগে উঠতে দেখলে তোমার চেয়ে বেশি খুশি কেউ হবে না।

তারপর গুরেলাল আমার হাত ধরে একটা পাথরের ওপর বসাল। বলল, আমি জানতাম, তুমি ধরে ফেলবে। এত দেরি হল কেন বলো তো?

আমি বললাম, স্যারের ওই কথাটা মন দিয়ে শুনিনি যে।

কোন কথাটা?

স্যার বলেছিলেন, তোমার বাবার দুটো ছেলে। একটা তুমি। তোমার তখন বয়স পাঁচ বছর। আর একটা তখন ছিল খুব ছোট। মায়ের পিঠের ঝোলায় চেপে ঘুরে বেড়াত। গুরেলাল, তোমার তো কোনো ভাই নেই। বেটাও নেই তাই না? তোমার মা যাকে পিঠের ঝোলায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, তোমার বউ মোতিয়াও তাকেই পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কত বছর ধরে গাঁওবুড়োর বাড়ির বউরা ছোটরাজার মমি নিয়ে এইভাবে ঘুরছে বলো তো।

চারশো বছর। বলল গুরেলাল। ঠিক চারশো বছর ধরে ছোটরাজাকে আমাদের বাড়ির বউরা কোলে-পিঠে নিয়ে ঘুরছে। তোমাকে বলেছিলাম না বাবুজী, আমাদের গরিব রাজা আমাদের সঙ্গেই পালিয়ে বেড়ায়?

আমি ভিড়ের ফাঁক দিয়ে রাস্তা করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। কেউ বাধা দিল না। দেখলাম, বালির ওপরে শোয়ানো আছে দু’বছরের এক বালকের মৃতদেহ। তার মাথার কাছে বসে আছে মোতিয়া।

কে বলবে ওই মৃতদেহের বয়স চারশো বছর? মনে হচ্ছে দুধ খেতে খেতে শিশুটি এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে।

কোথাও কোনো ধূপধুনো নেই, কোনো বাজনাবাদ্যি নেই। সেটাই তো স্বাভাবিক। জগন নারিয়ার নির্দেশের মধ্যে এটাও নিশ্চয় ছিল—রাজা যে জেগে উঠেছেন এটা কাউকে জানানো চলবে না। শত্রুর তো অভাব নেই।

তাছাড়া এখন আর কিছুরই দরকার হবে না। যা করবার চারশো বছর আগে সেই অলৌকিক রাজবৈদ্য করে রেখে গেছেন। ওই তো, তাঁরই দৌলতে মৃত শিশুটি আড়মোড়া ভাঙল। শিশুটির বুকের ওপর তিরের ক্ষতটা ওই তো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলের এদিক-ওদিক থেকে তীক্ষ্ন স্বরে ময়ূর ডেকে উঠল। পশ্চিমের পাহাড়ের আলসে থেকে মুখ বাড়াল সোনার কাস্তের মতন একফালি চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় চোখ মেলে শিশুটি বলল—আমমা।

আমি আস্তে আস্তে তার পাশে হাঁটু মুড়ে বসলাম। বললাম, প্রণাম মহারাজা। তুমি খুব শিগ্গির বড় হয়ে ওঠো। তুমি নারিয়াদের সমস্ত অপমান মুছে দাও। আমি অপেক্ষা করে রইলাম।

মোতিয়া আর গুরেলাল আমার দু’পাশে বসে আমার কথা শুনে খুব হাসছিল। শিশুটি আমার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে উগুল-বুগুল কিসব যেন বলল। আমি বললাম, নজরানা চাইছেন রাজামশাই? এই নিন নজরানা।

স্যারের সেই ফিল্ড-রিপোর্টের ফাইলটা ওর হাতে ধরিয়ে দিলাম।

কাগজগুলোকে দু’হাতে ছিঁড়ে কুটিকুটি করতে করতে কৃষ্ণকলির মতন সুন্দর সেই শিশু পৃথিবীর যে কোনো শিশুর মতনই অবোধ্য ভাষায় বলল—গি গি গি গি।

___

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *