মৃত্যুর ঘোড়া
আমার বয়স যখন ন’বছর, একদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দেখি ঘরের দরজার কাছে মা দাঁড়িয়ে আছে—মুখটি লাল আর ফুলো ফুলো, চোখ দুটো ভিজে। মা অনবরত ফোঁসফোঁস করে হলুদের ছোপ লাগা আঁচলে নাক মুছছে। বারান্দায়—দরজার পাশেই মোড়ায় বসে আছে একটা লোক। লোকটার পরনে ডোরাকাটা লুঙ্গি, গায়ে ভীষণ ময়লা সাদা হাফশার্ট গোছের, যেটার কাঁধের দিকে কোনও কলার নেই। তার পায়ে কোনও জুতো ছিল না। থ্যাবড়া হলদে আর বাঁকাচোরা পায়ের আঙুলগুলো। ফাটা হাজাধরা বিচ্ছিরি পা দুটো দেখেই আমার সামান্য অভিজ্ঞতা বলে দিল, এই লোকটা নির্ঘাত মাঠেঘাটে বনবাদাড়ে জলকাদায় দিনের পর দিন হেঁটেছে। আঙুলে আঙুলে আঁকড়ানো হাত দুটোও তেমনি বিচ্ছিরি হলদে, ভীষণ পুরু আর খসখসে। প্রচণ্ড বাধা পার হতে হতে যে জিনিসটিকে এগোতে হয়—সম্ভবত সেই জিনিসটিকে চালিয়ে বা ঠেলে নিয়ে যাবার জন্যে তার হাত দুটোর এ দশা হয়ে থাকবে। কারণ, ওই বয়স থেকেই এক রকমের ক্ষমতা আমার ছিল, যা দিয়ে খুঁটিয়ে সব কিছু লক্ষ্য করতে পারতাম। বিচার-বিশ্লেষণ করতে পারতাম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমার এ চেষ্টা সত্যের কাছে পৌঁছে দিত আমায়। এই যে লোকটির হাত পা দেখছিলাম, তার সঙ্গে সহজেই ইতিহাসের ভোলানাথবাবুর হাত-পায়ের তুলনা করা গেছে। চকের হালকা রঙলাগা আঙুল, বেশ লম্বা আর হালকা, ডিমের মত সাদা চেটো—তাতে শিরাগুলো অর্থাৎ কররেখা খুবই স্পষ্ট আর গোলাপি—বিশেষ করে ওঁর হাতের চাপ সময়ে আমায় অনুভব করতেও হয়েছে—যাতে টের পেয়েছি খুবই নরম। ওঁর হাত দুটো এবং সময়ে পা দুটো টেবিলে তুলে দিলেও একই রকম ধারণা করা গেছে। তাছাড়া লাস্ট পিরিয়ডে সেদিন ইতিহাসের ক্লাস ছিল।
বাদামি কোঁচকানো শিরাবহুল দেহ নিয়ে যে লোকটি মোড়ায় বসে রয়েছে, তার চিবুক-গাল সাদা-কালো দাড়িতে ভরা, কেবল গোঁফটা যত্ন করে কামানো। তার মাথায় জালের মত ঝাঁঝরা গোল—কতকটা ওল্টানো বাটির সাইজ, একটা কালো টুপি। পরে ওর সঙ্গে যখন যেতে হচ্ছিল, জেনে নিয়েছিলাম, ওই টুপিটা তালগাছের বাগড়ার নিচে যে জালের মত জটিল শক্ত শিরাগুলো থাকে, তাই দিয়ে সে নিজেই তৈরি করে নিয়েছে। লোকটির আশ্চর্য ক্ষমতায় আমার তাক লেগে গিয়েছিল। যেতে যেতে তারপর আরও যা সব শোনাচ্ছিল, চারপাশের পাড়াগেঁয়ে সেই পৃথিবীর খুঁটিনাটি জিনিসে কত সব রহস্য, কী মজার ব্যাপার রয়ে গেছে—আমি তো ওকে মনে মনে আমার মাস্টারমশাইদের চেয়ে অনেক বড়, অনেক মহৎ, অনেক শক্তিমান বলে ভাবতে শুরু করেছিলাম, প্রতিটি পদক্ষেপে লোকটি জানিয়ে দিচ্ছিল যে, পৃথিবীতে মোটামুটি দু’জাতেরই মানুষ আছে—এক জাতের মানুষ সে নিজে এবং অন্য জাতের মানুষ হচ্ছেন ইতিহাসের ভোলানাথবাবু। আমি কোন জাতের, তা জানতে চাইলে নির্ঘাত সে জবাব দিত, তুমি এখনও খুব ছোট তো—তাই তোমায় মানুষ বলা ঠিক হবে না।
খুব গোলমাল করে ফেললাম কি? আগে অনেকগুলো দিন ভাবতে হয়েছে, ঠিকঠাক পূর্বপরম্পরা গোছানোর চেষ্টা করতে হয়েছে; কিন্তু লিখতে গিয়েই সব আমার বড় মুশকিল, এই গল্পটা লিখবার পূর্বাপর সামঞ্জস্য ও সরলতা আমি হারিয়ে ফেলতে বসেছি।
এর কারণ কিন্তু একটাই। স্মৃতি ভীষণ দুশমন। স্মৃতি বড় ঈর্ষাকাতর। স্মৃতি কলহপ্রিয়। বদমেজাজী খিটখিটে কটুভাষী। তাকে আমি বলব একটা রোগা হাড্ডিসার রোঁয়াওঠা নেড়িকুত্তা—যে আমার কত কিছু নিয়ে আগলে বসে আছে, এশপের গল্পের দি ডগ ইন দি ম্যানজার—নিজেও খাবে না, আমায়ও খেতে দেবে না।
বারান্দায় উঠতে গিয়ে সেদিন আমি ভড়কে গিয়েছিলাম। সচরাচর এই গড়নের বা চেহারার কোনও লোককে এত খাতির পেতে দেখিনি। ওকে দস্তুরমত একটা মোড়া দেওয়া হয়েছে। একটু খুলে বলতে হয়। আমার দাদু মুসলিম সমাজের এক ধর্মগুরু। ইসলাম ধর্মে যদিও বা জাতিবর্ণভেদ নেই, সব মুসলমানই মানুষ হিসেবে সমান, বাদশাহের পাশের আসনে পথের ভিখিরিও বসার অধিকার পায়—অনুশাসনের সঙ্গে প্রথার কিন্তু ফারাক আছে অসামান্য। কালগুণে সব ধর্মের মত ইসলামের একদা হাজার বছর পরে প্রথাকে খুব বড় করে দেখা হচ্ছিল। ফলে অভিজাত নিম্নজাত মানুষরা চিহ্নিত হতে থাকল পৃথক পৃথক চিহ্নে। আমাদের বংশধারা অভিজাত। যার দরুন আমায়ও পাড়াগেঁয়ে সমাজে লোকেরা খুব সম্মান দেখাত। বিশেষত আমার দাদু ধর্মগুরু মৌলানা। আর ব্যাখ্যার দরকার হবে কি? তা হলে তো গল্পটা আর লেখা হয়ে ওঠে না!
…অথচ আমরা ছিলাম, সত্যি বলতে কী, ভীষণ গরিব পরিবার। যতদূর জানতাম, এই গরিব থাকার প্রকৃত কারণ আমার দাদুর আচরণ। কিছু পৈতৃক ভূসম্পত্তি তাঁর ছিল। কিন্তু একে যাযাবর চরিত্র (দাদু বলতেন, আমরা এসেছি পারস্যের খোরাসান থেকে), তায় ভীষণ অমিতব্যয়ী এবং আবেগপ্রবণ। তাঁর বাবা উত্তর বাংলায় এক শিষ্যবাড়ি থেকে মারা যান। দাদুর বয়স তখন পনের। ফলে, নিজের বউ নিজেই খুঁজে নিয়েছিলেন তিনি। এই বন্ধ্যা মেয়েটি কী কারণে আত্মহত্যা করেছিল। দাদু তারপর হয়ে উঠলেন আরব্য উপন্যাসের সেই বাদশাহ শাহরিয়ারের মত—যে রাতের পর রাত বিয়ে করে আর প্রতি প্রত্যুষে তাকে হত্যা করে ফেলে—নারীজাতির প্রতি ক্রোধপরবশ হয়ে। না, অতটা সম্ভব ছিল না দাদুর পক্ষে। কারণ, তিনি বাদশাহ নন এবং সেটা ছিল ইংরেজ রাজত্ব। মুসলিম ধর্মমতে একই সঙ্গে চারটে বউ রাখা যায়। দাদু চারটে হিসেবে দুবার, দুটো একবার এবং পরিশেষে মাত্র একজনকেই বিয়ে করেছিলেন। এই শেষ বউটি ছাড়া সকলেই বিদঘুটে রোগে মারা গিয়েছিল। সেকালে সামান্য জ্বরজারিরই ওষুধ ছিল না ভালো, অতি সহজে মানুষ গরম গায়ে শুয়ে পড়ত আর ঠাণ্ডা হয়ে যেত। আমার ঠাকুমা দাদুর শেষ বউ। খুব খুঁটিনাটি লক্ষ্য করার মত ক্ষমতা ছেলে বেলায় না থাকলে আমি তো জানতেই পারতাম না যে, আমার এই ঠাকুমাটি এক নিম্নবংশীয় হিন্দুর মেয়ে—যাকে যুবতী বয়সেই ডাইনি বলে গাঁয়ের লোকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। লোকের অপরাধ আমি খুঁজি না। সে যুগে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যোগাযোগ যত বেশিই থাক না কেন, তারা প্রকৃতিকে ভীষণ অমঙ্গলের আর রহস্যময় বলে মনে করত। এখন, এই মেয়েটির সঙ্গে নাকি প্রকৃতির যোগাযোগ ছিল একটু ভিন্ন রকমের। সে সাধারণত রাত্রিচারিণী ছিল—গভীর রাত্রে বনেবাদাড়ে তাকে চুপি চুপি হাঁটতে, গাছপালা-পাখি-জন্তুজানোয়ার-পোকামাকড়দের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে লক্ষ্য করা গেছে; কেউ দেখেছে সে মাথায় বাতি নিয়ে অন্ধকারে ফাঁকা মাঠে পিছু হেঁটে অর্থাৎ পিছতে পিছতে কোথায় উধাও হয়ে যায়। সে ছিল বিধবা— তাদের জাতে সাঙা বা পুনর্বিবাহের প্রথা ছিল। কিন্তু সে আর পুরুষ যাচেনি। একটা গাইগরু, দুটো ছাগল, কয়েকটা হাঁসমুরগি (মুরগিও সে জাতের মানুষ পুষত) আর উঠানের সবজির মাচা কী দু-চারটে ফলমাকড়ের গাছ নিয়ে ছিল তার সংসার। হ্যাঁ, একটা ডাহুক পাখির বাচ্চা একবার বাঁশবনে কুড়িয়ে পেয়েছিল সে। বড় মায়ায় তাকে পুষেছিল। পাশের গাঁয়ের হাট থেকে খাঁচা কিনে এনেছিল। ডাহুকটা বেশ বড় হল একদিন। গভীর রাতে নিশ্চয় সে ডাকত—কুব্…কুব্..কুব্…কুব্!…ওফ, ঠাকুমার পাশে শুয়ে এইসব গল্প শুনতে শুনতে আমি সব স্পষ্ট দেখতে পেতাম, শুনতে পেতাম এবং কেন কে জানে, কুব্…কুব্…কুব্…কুব্ ডাকটা অনুমান করলেই মনে হত, কে নিষুতি রাতে আচমকা এসে আমার বুকের ভিতর আঙুল গলিয়ে কলজেয় খোঁচা দিচ্ছে এবং…না না! যন্ত্রণা নয়, ভীষণ কাতুকুতু পেয়ে হিহি করে বেদম হাসছি। ঠাকুমা বলতেন, তুই হাসছিস খোকা, কেন রে?…এখন বুঝি সে ছিল ঠাকুমার দুঃখের গল্প। কারণ, আমার হাসি দেখে ঠাকুমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু বলতেন, ঘুমো। রাত হয়েছে।
তারপর কী যেন ঘটেছিল। সেই গাঁয়ের কোন বড়বাবু না ছোটবাবুর ছেলের রঙ ছিল দুধের মত সাদা। একটা লাউ বেচতে গিয়ে রহস্যময়ী যুবতীটি আর লোভ সংবরণ পারেনি। উঠোনে ধুলোয় খেলতে বসা খোকাটিকে কোলে তুলে বলেছিল, আহা হা, মানিক সোনা, তোর দিকে কারোর মন নেই রে! তুই কি ধুলোয় খেলবার ধন? তুই থাকবি কিনা বাবুমশায়ের খাটপালঙ্কের শোভা…সন্ধ্যার দিকে সাদা খোকাবাবুটি হঠাৎ নীল হয়ে জুড়িয়ে যেতেই ওদের মনে পড়ল কুসুমের কথা! বাংলা দেশের সেই সময়টা অজ পাড়াগেঁয়ে যা জঘন্য না ছিল! ভাগ্যিস দাদু সেদিন সেখানে মুসলমানপাড়ায় শিষ্যবাড়ি আস্তানা গেড়েছেন। আহত যুবতীটিকে উদ্ধার করবার জন্য ছোটখাটো রকমের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও ঘটে গিয়েছিল। মামলা হল দাদুকে মূল আসামী করে—শুধু দাঙ্গার দরুন নয়, এক হিন্দু যুবতীর প্রতি লাম্পট্যের দরুনও বটে এবং আশ্চর্য একটু ভুল নিশ্চয় করা হয়েছিল বাদীপক্ষে—যুবতীটি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্পষ্ট বলে দিল,…উফ, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়—যুবতীটি বলল কী জানেন? বলল, ধর্মাবতার মৌলানা আমার ইচ্ছানুসারে আমায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছেন এবং সাদি করেছেন…আদালতসুদ্ধ তো বটেই, আমার দাদুর চক্ষু নিশ্চয়ই ছানাবড়া হয়ে থাকবে!
এখন বুঝি, এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না ঠাকুমার। তারপর আর কী! নতুন বউ সঙ্গে নিয়ে সদলবলে জাঁকিয়ে বাড়ি ফিরলেন দাদু। কুসুম হল কুলসুম। শূন্য ঘর ভরে উঠল এতদিনে। ঘাসের উঠোনে পড়ল রাঙামাটির লেপন। চাঁপাগাছে চাঁপা ফুটল। শিউলি গাছে শিউলি।
কথায় বলে, হিন্দুদের বাড়ি, মুসলমানের হাঁড়ি। দুটো যেখানে এক হয়, সেখানের ব্যাপারটা কল্পনা করুন। দাদুর নোংরা বাড়িটা রাতারাতি সুন্দর হয়ে উঠল। উঠোনে ফুলফলে গাছ, ঝকঝকে রাঙামাটির লেপন সবখানে। যেখানে খুশি গা গড়ানো যায়। সুচ পড়লেও চোখ এড়ায় না। ঝকঝকে বাসনকোসন, ছিমছাম রান্না, রাতে শুয়ে ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ঘুমানো যায়। তবে রান্নার ব্যাপারে—হ্যাঁ ঠাকুমার ট্রেনিংয়ের দরকার ছিল। মাসখানেক থেকে গেলেন দাদুর বোন। ননদ যত্ন করে শেখালেন পোলাও-কোর্মা-কালিয়া-কোপ্তা-কাবাব তৈরি, কারণ দাদুর ভোজনবিলাসের কোনও মাত্রা ছিল না, তাছাড়া শেখালেন আরবি ফারসি কেতাব পড়তে, শেখালেন কোরান পাঠ এবং নমাজ ইত্যাদি অবশ্য পালনীয় ধর্মাচরণ, বোঝালেন হাদিস অর্থাৎ অনুশাসনের সূত্রাবলি! আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ঠাকুমার! কিছুদিন পরেই, যখন দাদু ঘরে নেই, আকস্মিক জরুরি কোনও ব্যাপারে মামলা অর্থাৎ অনুশাসনের বিধিটা কী জানবার জন্যে লোকে বিবিসায়েবের কাছে মতামত নিতে আসে!
আর একটা কথা ভাবতে অবাক লাগে। দাদুর বয়স তখন বাহান্ন কি পঞ্চান্ন, ঠাকুমার বয়স বড়জোর তেইশ কি পঁচিশ—এই দাম্পত্য প্রেমের রহস্য কী? আমি জানি না, বুঝি না। তাঁরা কি অসুখী ছিলেন পরস্পর? বলা দুঃসাধ্য। ওই ন’বছর বয়স অবধি যতটা স্মৃতির থাবার ফাঁকে ঠাহর করি, কোনওদিন কোনও দাম্পত্য কলহের প্রসঙ্গ তাতে দেখি না। খুবই বিনীত নম্র আচরণ ছিল তাঁর। শিষ্যবাড়ি সফর শেষে দাদু ফিরলে ঠাকুমা যেভাবে সবার সামনে তাঁর পা-দুটোয় চুমু (অর্থাৎ কদমবুসি) খেতেন—তাতে মনে হত, উনি আগের হিন্দু জীবনের ভাষায় বলতে চান, তুমিই আমার দেবতা।
ঠাকুমা মরে যাবার পর দাদু একরকম বাড়ি আসা ছেড়েই দিয়েছিলেন। পুরো একটি বছর আর তাঁর দেখা নেই। তবে মাঝে মাঝে তাঁর মুরিদ অর্থাৎ শিষ্যবাড়ি থেকে লোক আসত এক কলসি গুড় কিংবা কয়েক সের ছোলা-মুসুরি কী দুটো নারকোল নিয়ে। মা দাদুর ওপর খাপ্পা ছিল—কারণ, দাদুর কোনও আয়ই আমরা আর পাইনি। বাবা দাদুর মত মৌলানা না হয়ে নিজের চেষ্টায় পাস করে স্কুলে পড়েছিলেন। এন্ট্রাস পাস করে তিনি বিদেশে চাকরি করেন। মাসে-মাসে যে টাকা আসে তা দিয়ে আমাদের কোনওরকমে চলে যায়।
সেই এক বছরে অনেকবার দাদু আমায় দেখতে চেয়েছেন—মা পাঠাতে রাজি হননি। আমার খুব ইচ্ছে করত যেতে। বিশেষ করে দাদু চলে যাবার পর মাঝে মাঝে পোলাও-কোর্মা খাবার চমৎকার সময়গুলো আর আসছিল না। দাদুর ঘরের ছাদ থেকে টাঙানো শিকগুলোতে শূন্য এনামেলের হাঁড়ি লক্ষ্য করে রাগে ক্ষোভে ঢিল ছুঁড়তাম। একসময় হাঁড়িগুলো কোনও না কোনও সুখাদ্যে পূর্ণ থেকেছে। দাদু ভীষণ ভোজনবিলাসী ছিলেন কি না!
সেদিন স্কুল থেকে ফিরে লোকটাকে দেখে আমার খুব খুশি হওয়া উচিত ছিল—কেন না, এতে নিশ্চয় কোনও গুড় নারকোল কিংবা সুন্দর উপহার আশা করব। কিন্তু খুশি হওয়াকে চেপে ধরেছিল বিস্ময়। লোকটি মোড়ায় বসার উপযুক্ত নয়—এবং মা কাঁদছে দরজার আড়ালে! কী ঘটেছে?
আমি এগিয়ে যেতেই মা আমায় দু’হাতে বুকে ধরল। তারপর চাপা স্বরে বলল, খোকা, তোমার দাদু মারা গেছেন।
মারা গেছেন! সত্যি বলতে কী মারা যাওয়া সম্পর্কে তখন এক অদ্ভুত ধারণা আমি পোষণ করি। আমার বরাবরই বিশ্বাস ছিল, যেহেতু আমরা মৌলানা এবং কুলগুরুদের ঘর—আমাদের কারুরই মারা যাওয়ার উপায় নেই। তার মানে, আমরা—আমি, বাবা, দাদু, মা ও ঠাকুমা ছাড়া দুনিয়ার সবাই তো শিষ্য বা মুরিদ মানুষ। ওরা সাধারণ, আমরা অসাধারণ। তা না হলে কেনই বা লোকে আমার মত খুদে লোকটিকেও এত ভক্তিশ্রদ্ধা করে! কাজেই আমরা অবশ্যই বেঁচে থাকব। ঠাকুমাকে মরতে দেখেও এ বিশ্বাস ঘোচেনি। কারণ, ঠাকুমা তো হিন্দু ছিলেন!
মায়ের কথাটা শুনে তাই আমি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে বলে উঠলাম, যাঃ! কে বলেছে?
মা বলল, ওই লোকটি খবর এনেছে।
অস্ফুট চেঁচিয়ে বললাম, ও মিথ্যাবাদী।
বলার সময় লোকটির দিকে আড়চোখে তাকিয়েছিলাম। দেখি, সে যেন হাসবার চেষ্টা করল—মাথাটা দোলাল—তারপর আপসোসে জিভে চুকচুক শব্দ করল মাত্র।
মা আমার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, চুপ চুপ। বলতে নেই। খোকা, তোমার দাদু সত্যি মারা গেছেন। তোমার বাবার এদিকে কোনও খবর পাচ্ছিনে—মাসের গোড়ায় মনিঅর্ডার এসেছে—তাতে কুপনে অল্প একটুখানি চিঠি ছিল। কী হল, কিছু বুঝতে পারছিনে—তার ওপর এই বিপদ।…
মাকে চুপ করতে দেখে আমি বললাম, ও লোকটা বসে আছে কেন? চলে যেতে বল না!
মা আমায় টেনে ঘরের ভিতর নিয়ে গেল। পরক্ষণে অবাক হয়ে দু’হাতে আমার মুখটা তুলে ধরে তাকিয়ে রইল। …তুই কাঁদছিস খোকা? কাঁদিসনে! এ বড় দুঃসময় আমাদের!
হ্যাঁ, আমি দাদুর জন্যে কাঁদছিলাম না। ওই লোকটির প্রতি আমার রাগ হচ্ছিল। কারণ সেই তো খবর এনে মাকে কাঁদিয়েছে, আমায় তোলপাড় করে ফেলেছে। ওর বসে থাকা দেখে মনে হচ্ছে একটুকরো আস্ত কালকুট্টে মেঘ—ফের দড়াম করে ফেটে যাবে, তার বিদ্যুৎ ঝলকাবে, বাজ পড়বে—উত্তাল আলোড়ন ঘটে যাবে এক্ষুনি এই ছোট্ট বাড়িটাতে!
এবার লোকটা আমার উদ্দেশে মুখ খুলল।…আপনার দাদুসাহেব মরার সময় আপনাকে দেখতে চেয়েছিলেন। আর তেনার ইচ্ছে ছিল, যেন আপনি তেনার কবরে এই ভিটের চাট্টি মাটি দিয়ে আসেন।
ন’বছরের ছেলে আমি। আমায় ‘আপনি’ বলাটায় অবাক হবার ছিল না। পাড়ার বেশিরভাগ মানুষই আমায় আপনি বলত। কিন্তু এই লোকটির কথাগুলো শুনে আমি অবাক হলাম। মায়ের কাছ থেকে সরে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালাম। বললাম, দাদুর ইচ্ছে!
জি হাঁ। লোকটি সসম্ভ্রমে মুখটা নামাল। নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, হুজুরসাহেব ইচ্ছের কথাটা আজ ভোরবেলায় জানিয়েছিলেন। তখনই আসা উচিত ছিল। কিন্তু খোদার ইচ্ছে! বড় আপসোস—আমার জমির জরুরি কাজ ছিল। ভাবলাম খেত থেকে ফিরে তারপর বেরিয়ে পড়ব। আপনাকে নিয়ে যাব। তা খোদার ইচ্ছেয়—যখন আমার খেতের কাজ আধাআধি হয়েছে, খবর গেল উনি মারা গেছেন। আমার গোনাহ হয়ে গেল, কী করব!
লোকটা কপালে করাঘাত করতে থাকল।
তাহলে আমায় এক্ষুনি ওর সঙ্গে যেতে হবে—সঙ্গে কিছু মাটি নিয়ে। দাদুর কবরে দিতে হবে। তা না হলে নাকি দাদুর আত্মা শান্তি পাবে না! মা সারা গায়ে ভালোমত কাপড় জড়িয়ে লোকটার পাশ দিয়ে বেরল। উঠোনের ওপাশে রান্নাঘর। তার লাগোয়া একটা ছোট্ট ঘরে দাদু থাকতেন। একটা কাটারি দিয়ে খানিক মেঝের মাটি তুলে আঁচলে রাখল মা। তারপর বলল, খোকা তাক থেকে ওই প্যাঁটরাটা নামা।
প্যাঁটরায় ঠাকুমার কিছু কাপড়চোপড় ছিল। একটা পরিষ্কার সুন্দর রেশমি শাড়ি—ঠাকুমা বলতেন ওর নাম ময়ূরকণ্ঠী শাড়ি, ওঁর বিয়ের উপহার—আমার চোখের সামনে ফরফর করে ছিঁড়ে ফেলল মা। বিস্ময়ে ক্ষোভে বলে উঠলাম, ছিঁড়ে ফেললে! অমন সুন্দর শাড়িটা?
মা কেমন হাসল। তারপর মাটিগুলো যত্ন করে সেটায় বাঁধল। হাতে তুলে তার ওজন পরখ করলও একবার। আমি নিয়ে যেতে পারব কি না, তাই দেখছিল মা। বললাম, মাটিগুলো দাদুর কবরে দেব। কিন্তু শাড়িটা?
মা চিন্তিতমুখে বলল, ফেলে দিস ওখানে কোথাও। যা ইচ্ছে করিস।
ঠিক এতক্ষণে আমার গল্পটা শুরু হল।
সময়টা ছিল এমনই শরৎকাল। সবুজ ধানের মাঠ পেরিয়ে ভিজে ঘাসেভরা স্যাঁতসেঁতে আলপথে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। আকাশটা ছিল ঘন উজ্জ্বল নীল আর বৃষ্টিধোয়া। কেবল মাঠের শেষ দিগন্তে ধূসর রঙের কুয়াশা দেখা যাচ্ছিল। বাঁপাশে সূর্য রেখে আমরা কোণাকুণি চলেছি। বাতাস বইছে শনশন করে। পায়ের জুতো খুলতে হচ্ছে বারবার—আলে কোথাও কোথাও কাদা জমে আছে। হাঁটুর নিচেটা ঘাসের ফুলে কুটকুট করছে। বারবার হাত বাড়িয়ে ঝাড়তে গিয়ে ধানের গোড়ায় খেতের কালো জল লক্ষ্য করছি। সেই স্বচ্ছ চমৎকার জলে অজস্র পোকা আর খুদে মাছ ছোটাছুটি করছে। কোথাও বা শামুক শুঁড় বাড়িয়ে ঘাসের ডগা স্পর্শ করছে।
মাঝে মাঝে এইসব দেখবার জন্যে দাঁড়াতেই পিছন থেকে লোকটা তাড়া দিচ্ছিল, জলদি চলুন, জলদি। অনেকটা দূর যেতে হবে।
অত বড় মাঠটা ঢালু হতে হতে যেখানে পৌঁছলাম, সেখানে শুধু জল আর জল। ধানের খেত থেকে বেরোতেই সামনে হঠাৎ বিশাল উজ্জ্বল উত্তরঙ্গ জল—প্রচণ্ড ভয়ে থমকে দাঁড়িয়েছি সঙ্গে সঙ্গে। পায়ের কাছে ঢেউয়ে ফেনা আর খড়কুটো দুলছে। কলকল ছলছল আলোড়নকারী ধ্বনিপুঞ্জের কাছে নিজের কণ্ঠস্বর খুবই অসহায় আর অবশ ঠেকল। বলছিলাম, আমরা কোথায়?
পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল লোকটা। আমার ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর শুনে সে তার বড়বড় হলুদ দাঁত খুলে হাহা করে হাসল। বলল, ডর লাগছে? পানি পেরতে হবে না। আমরা এবার বিলের ধারে ধারে যাব।
বেনা কাশকুশে ছোটবড় ঝোপের পাশ দিয়ে উঁচু পগারে আমরা বিলটার সমান্তরালে কিছু দূর হেঁটে গেলাম। কাঁটা ঝোঁপে সুন্দর সুন্দর প্রজাপতি উড়ছিল। কয়েকবার হাত বাড়ালাম তাদের ধরবার জন্য। একবার শুধু সামান্য একটুর জন্যে হাত ফসকে পালাল একটা। পরে দেখি আঙুলে গুঁড়ো গুঁড়ো রং লেগে রয়েছে তার ডানার। এত ভালো না লাগল! গাঙফড়িংয়ের ডানায় রোদের ঝিকিমিকিতে চোখে দুটো কতবার ধাঁধিয়ে দিল। ঘাসফড়িং উঠে গেল হাঁটুর ফাঁক দিয়ে। একটা নির্ভীক মুখে আমার বুকপকেটে বসে রইল। ইচ্ছে করেই তাকে বিরক্ত করলাম না। কিন্তু মাঝে মাঝে সাপ চলে যাচ্ছিল কিলবিল করে—চমকে উঠছিলাম। আর পিছন থেকে লোকটা বলে উঠছিল—ওর বিষ নাই, পা চালান।
ততক্ষণে খুব আলগোছে আমার মাথায় নানারকম ভাবনা এসে জুটেছে। এইসব পোকামাকড় প্রজাপতি গাঙফড়িং ঘাসফড়িং সাপ আর জলের দুনিয়ায় আর কতক্ষণ আমার হেঁটে যেতে হবে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমায়? প্রবল অবিশ্বাসে আড়চোখে পিছনে লক্ষ্য রাখছিলাম। শুধু দেখতে পাচ্ছিলাম ওর থ্যাবড়া হাজাধরা হলদে পা দুটো—বিচ্ছিরি বাঁকাচোরা মোটা কয়েকটা আঙুল! ওই পা-দুটো সারা জীবন—কতদিন ধরে এমন সব বিচ্ছিরি দুর্গম পথ হেঁটেছে এবং আমায়ও কি অমনি করে হাঁটাতে চায় সে? আর আশ্চর্য, এই পথ বিচিত্র দুনিয়া সম্পর্কে ওর বিন্দুমাত্র ভীতি নেই, বিস্ময় নেই, আশ্চর্যরকম নির্বিকার সে। চোখ দুটোয় শেষবেলার লালচে রোদ প্রতিফলিত হচ্ছে—জল থেকে অসম্ভব উজ্জ্বলতা তুলে নিয়ে ওই রোদ দৃষ্টিকে দিচ্ছে ধাঁধিয়ে—অথচ সে ঠিকই পা ফেলছে, আমি টলছি। শেষে স্থির করলাম, বাঁ পাশে জলের দিকে আর তাকাব না।
ক্রমশ পথ সামনে উঁচুতে উঠে গেল। একটু পরেই দেখি—নদী।
নদী! নদী সেই বয়সে বার তিনেক মাত্র দেখেছি। আমাদের গাঁয়ের পাশে কোনও নদী নেই। পিসির বাড়ির পাশে নদী দেখেছি। সেই নদীটাই তিনবার মাত্র। তারপর নদীর কথা ভূগোল পড়েছি। সেই নদী পেরোতে হবে যে!
একটা জোড়াবাঁধা তালডোঙায় মাঝি আমাদের পার করে দিল। ওপারে গিয়ে পয়সা চাইলে লোকটি আমার পরিচয় দিল সবিশেষ। দাদুর মৃত্যুসংবাদ জানাল। শুনে মাঝি বিড়বিড় করে কী বলতে বলতে ডোঙাটা ঠেলে দিল। খুব অবাক লাগল। আমাদের চলায় কেউ কোনও বাধা দিচ্ছে না যেন! সবাই পথ মুক্ত রাখতে সাহায্য করছে।
বেলা শেষ। আবছায়া ঘন করে তুলেছে বিস্তৃত নীলাভ কুয়াশা—ধানের খেতে, গাছপালায়, গ্রামের ওপর—সবখানে। যেন খুব যত্ন করে কুয়াশা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে দুনিয়াটাকে। কেন? খুঁটিনাটি লক্ষ্য করার প্রবণতার কথা আগে বলেছি। তাই এটা ছিল আমার নিভৃত সকুণ্ঠ প্রশ্ন। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকারের রঙ পুরো নীলচে দেখাল। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল আমার। দৃশ্যমান বিরাট দুনিয়া থেকে হঠাৎ সরে গেছি যেন—ভীষণ একলা হয়ে পড়েছি—খুব গভীর সব কিছুর আড়ালে আমায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, একটা কবরের দিকে, যে কবরের নিচে দাদুর আত্মা অপেক্ষা করছে আমার জন্যে, একমুঠো মাটি তাঁকে আমি দেব…আচমকা ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়ালাম। আমার…আমার যেন মনে হল, অবিকল মৃত্যুর স্বাদ আমি পেয়ে গেছি। মৃতদের গায়ে গন্ধ আমি টের পাচ্ছি। এমন কি, তাদের প্রতীক্ষিত নীল উজ্জ্বল চোখ দুটো আর ধূসর খড়ি-খড়ি কেঠো গতরগুলোও স্পষ্ট দেখছি। ওদের মধ্যে যে আমার দাদু সে একটা ভিজে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে আছে—ডাকছে, আয় রে খোকা, আয়!
মৃতরা তো ওইরকমই। কবরের নিচে পোকামাকড় আর প্রজাপতিদের ডিম, উইপোকারা থিকথিক করে, শেয়াল কি খরগোশ গর্ত বানিয়ে নেয়, কাঁকড়া, শামুক বা সাপ শীতের শুরুতেই ঘুমোতে চলে যায় মাটির নিচে, এবং এইসবের মধ্যে দাদুরা বিচরণ করেন।…
আমার চুল খাড়া হল। রোম কাঁটার মত শক্ত হল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম।
লোকটা হাত বাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুঁল আমায়। আলগোছে তুলে একেবারে কাঁধে বসিয়ে দিল। বলল, আহা, হা আমারই ভুল মিয়াসাব। ব্যস, বসেন—আমার মাথাটা ধরে বসে থাকেন। ঘোড়ার মতন টগবগিয়ে হাঁটতে লাগি এবার। আহা হা…কচি ছেলে!
কে এই লোকটা! অন্ধকারে কুয়াশার মধ্যে দুলে দুলে যাচ্ছি আর মাঝে মাঝে ওর তালশিরের টুপিটা স্পর্শ করছি। গা শিউরে উঠছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে ও হাঁটছিল—তারপর আস্তে আস্তে চলার গতি বাড়িয়ে দিল। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খাচ্ছিলাম। ও একটা সত্যিকার ঘোড়ার মত দৌড়তে শুরু করেছে। যতদূর পথ আমরা এসেছি, সবাই আমাদের সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিয়েছে—সরে গেছে। এবার আরও দ্রুত দু’পাশে সরে যেতে থাকল—যেন জীবজগৎটা পথ পরিষ্কার করে দিল একেবারে।
তারপর অন্ধকার রাতের মাঠ কুয়াশা পথ গ্রাম পেরিয়ে—কত দূর দূরান্ত পাড়ি দিয়ে ও এগিয়ে যাচ্ছিল একটা কবরের উদ্দেশ্যে। ক্রমে সব একাকার হয়ে যাচ্ছিল। দৃশ্যহীন কালো দুনিয়ায় কেবল চিৎকার করছিল কিছু পেঁচা, কতিপয় শেয়াল আর হাজার লক্ষ কোটি—সংখ্যাহীন পোকামাকড়েরা। কিছুক্ষণ পরেই মাথার ওপর নক্ষত্রময় আকাশটাও ঢেকে গেল। তখন যেন একটা অন্ধকার গুহায় প্রবেশ করলাম আমরা। আমি কেশর-ফোলানো ধাবমান একটা ঘোড়ার গলা জড়িয়ে সেঁটে রইলাম। এক হাতে ঠাকুমার রেশমি শাড়ির টুকরোয় বাঁধা দাদুর ভিটের কিছু মাটি। স্যাঁত স্যাঁত করে সারা জীবজগৎ সসম্ভ্রমে দু’পাশে সরে-সরে যেতে থাকল।
আমার গল্পের এখানেই শেষ।
তবে কি, কোনও গতিবান যানে—ধরুন ট্রেনে দীর্ঘ ভ্রমণের পর যেমন সেই গতির অনুভব গোপন প্রতিধ্বনির মত দেহে বা মনে কিংবা দেহমনে বেশ কিছুক্ষণ ধরে জেগে থাকে, তার মানে—আপনি স্থির মাটির ওপর দাঁড়িয়ে, বসে বা শুয়ে থেকেও গতিময় সেই চলার হাত থেকে নিষ্কৃতি পান না—আমার হয়ে গেছে সেই দশা!
অনেক সময় হয়ত বা ভুলে থাকি—মানুষের ভিড়ে বা পরিবারের মধ্যে—কিংবা কাজে ব্যস্ততায় দায়িত্ব-পালনে আদর্শবোধ খাওয়া-দাওয়া সামাজিকতা কত কিছুতে। কিন্তু যখনই একলা হয়ে পড়ি, ন’বছর বয়সের এক শরৎরাত্রির সেই অভিযাত্রার শক্তিমান থ্যাবড়া পা-ওয়ালা ঘোড়া কিংবা মানুষটার চলার ঝাঁকুনিতে আমি অস্থির হয়ে উঠি। আমার হাড়মাংস থেঁতলে দলা পাকিয়ে যেতে থাকে। হয়ত নিছক প্রতিধ্বনি—প্রতিধ্বনির মত প্রতিভাসিক। অথচ আমার ওই দীর্ঘস্থায়ী জ্বর দেখা দেয়। আঁতকে উঠে ভাবি, আমি কোথায় চলেছি? আরে, আরে! কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমায়—এই অন্ধকারে কুয়াশায় শিশিরে? রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে পড়ে, যখন হঠাৎ স্মৃতি ফিসফিসিয়ে ওঠে—তোমার যাত্রা তোমার পূর্বপুরুষের কবরাভিমুখে! আর চোখ খুলতেই দেখি, চরাচরের সব বর্ণময় উজ্জ্বলতা ক্রমান্বয়ে ঢেকে যাচ্ছে মাকড়সার জালের মত নীল ধূসর ব্যাপক কুয়াশায়—স্যাঁত স্যাঁত করে সমম্ভ্রমে দুপাশে সরে যাচ্ছে জীবজগৎটা, আর প্রসারমান বিশাল অন্ধকারের দেশে আমি চলে গেলাম—তারপর মাথার ওপর সকল নক্ষত্রকেও প্রায় নিঃশব্দে ঢেকে ফেলা হল। পাছে মুঠো আলগা হয়ে যায়, যা নিয়ে চলেছি তা খুলে পড়ে, ঠাণ্ডা মুঠোটা অধিকতর শক্ত হতে থাকবে। আমি প্রস্তুত হই কী এক পবিত্র দায়িত্ব পালনে।…
তা হলে বলা যায়, ওই ন’বছর বয়সেই জীবন ও মৃত্যুর পারস্পরিক সম্পর্কটা আমি টের পেয়ে গিয়েছিলাম।