মৃত্যুযোগ

মৃত্যুযোগ

বাইরে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ৷ নিজের চেম্বারে গদি আঁটা চেয়ারে একলা বসে ছিলেন কালীকিংকর৷ সামনের টেবিলের দু-পাশে স্তূপাকৃত পঞ্জিকা৷ ভূতডামর, বগলামুখীতন্ত্র, বশীকরণবিদ্যা-এ-জাতীয় কয়েকটা বই, সাদা কাগজে আঁকা জন্ম ছক ইত্যাদি৷ আজ অমাবস্যা, তায় শনিবার! এসব দিনে সাধারণত, বি.বি. গাঙ্গুলি স্ট্রিটের জ্যোতিষীদের চেম্বারে হাত দেখানোর জন্য লম্বা লাইন পড়ে যায়৷ আর কালীকিংকরের মতো যাঁদের বেশ নামডাক আছে, অর্থাৎ যাঁদের টেলিভিশনে দেখানো হয় অথবা ফি হপ্তায় কাগজে ছবি ছাপা হয়, তাঁদের এসব বিশেষ দিনে, অনেক লোককে ফিরিয়ে দিতে হয়৷ কিন্তু সন্ধ্যা ৭টা বেজে গেলেও আজ এখনও পর্যন্ত এক জনও হাত দেখাতে আসেনি কিংকর জ্যোতিষীর চেম্বারে৷ আর আসবেই বা কী করে? দুপুর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ থামার কোনো লক্ষণই নেই৷ দিনের বেলাতেই আকাশ অন্ধকার ছিল আর এখন সন্ধ্যার অন্ধকার তার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে৷

‘না, আজ আর কেউ আসবে না,’ মাথাজোড়া টাকে একবার হাত বুলিয়ে নিজের মনে বললেন কালীকিংকর৷ এরপরই তিনি চেম্বার বন্ধ করে উঠে পড়বেন মনে করে তার অ্যাসিসটেন্ট কাম ড্রাইভার হরিপদকে হাঁক দিতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল, তাকে তিনি একটা কাজে পাঠিয়েছেন৷ হরিপদ এখনও ফেরেনি৷ আর সে যতক্ষণ না ফিরবে তাকেও আটকে থাকতে হবে চেম্বারে৷ কালীকিংকরের টেবিলে একটা টেবিল ল্যাম্প রাখা আছে৷ তার হালকা আলো ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে৷ তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন ঘরটা৷ বেশ কিছুদিন ধরে চেম্বারটা হালফ্যাশানের কায়দায় সাজাবেন বলে ভাবছেন, একটা কম্পিউটারও বসানোর ইচ্ছা আছে৷ যুগ পালটাচ্ছে, কম্পিউটারের সাহায্যে ভাগ্য গণনার আজকাল খুব চাহিদা৷ অনেক জ্যোতিষী বসিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু এসব কাজ করি করি করেও অন্য কাজের চাপে আর করা হয়ে উঠছে না তার৷ চেম্বারের দেয়ালে টাঙানো আছে সার সার ছবি, তার কোনোটাতে বিখ্যাত কোনো মানুষের সাথে কালীকিংকর, কোনোটা দশমহাবিদ্যার বা প্রসিদ্ধ সাধনপীঠের৷ যারা এখানে আসে তাদের মনের উপর, তাদের বিশ্বাসে, একটা প্রভাব বিস্তার করে এসব ছবি৷ কালীকিংকরের প্রতি একটা বাড়তি আস্থা জন্মায় ক্লায়েন্টের মনে৷

ছবিগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে ঘরের কোনায় একটা ছবির দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল তাঁর৷ অনেকদিন পর তিনি তাকালেন ছবিটার দিকে৷ অনেক পুরোনো, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া একটা বাঁধানো ফটোগ্রাফ৷ ঝুল জমেছে ফ্রেমে৷ এক জটাজূটধারী পুরুষের আবছা অবয়ব ফুটে আছে সেখানে৷ ও ছবি কালীকিংকরের গুরু মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের৷ তাঁর থেকেই জ্যোতিষ শাস্ত্রের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন ‘জ্যোতিষ সম্রাট কালীকিংকর’৷ ‘জ্যোতিষ সম্রাট’! হ্যাঁ, এই উপাধিটাই কালীকিংকর ব্যবহার করেন তাঁর নামের আগে৷ জ্যোতিষ সম্রাট গুরু মৃত্যুঞ্জয় এক আশ্চর্য ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন! কাকচরিত্র, ললাটলিখন পাঠে অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর৷ কোনো মানুষকে দেখে তিনি মুহূর্তের মধ্যে তার ভূত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারতেন৷ তবে জ্যোতিষী বলতে সবাই এখন যা বোঝে, ঠিক সেই অর্থে কিন্তু তিনি জ্যোতিষী ছিলেন না৷ মহাবিদ্যার অন্যতম ‘ধূমাবতী’র উপাসক শ্মশানচারী এই তান্ত্রিক আসলে ছিলেন ত্রিকালজ্ঞ৷ তবে তিনি শুধু ভূত-ভবিষ্যতের কথাই বলতেন, কোনো বিধান দিতেন না৷ মৃত্যুঞ্জয় বলতেন, ‘ভাগ্যের লিখন কেউ বদলাতে পারে না৷ আর মৃত্যু হল অপ্রতিরোধ্য, তাকে রোখার সাধ্য কারও নেই৷ বিধাতা পুরুষ জন্ম মুহূর্তে প্রত্যেকের যে আয়ু নির্দিষ্ট করে দেন, তা অমোঘ নিয়ম মেনে চলে৷ সে হিসাবের একচুলও এদিক-ওদিক করা সম্ভব নয়৷’ কালীকিংকর একবার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা, আপনার তো এত ক্ষমতা, আপনার ক্ষেত্রে কি একই বিধি প্রযোজ্য?’

তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ রে বেটা৷ এই মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকও মৃত্যুকে জয় করতে পারবে না৷ তিন কুড়ি বয়স আমার, আর এক কুড়ি বছর বাঁচব আমি৷ তার চেয়ে একদিন কম-বেশি নয়৷ ঠিক যেমন তোর আয়ু তিন কুড়ি বছর৷ তোর ক্ষেত্রেও অন্যথা হবে না৷’ হ্যাঁ, এই কথাই বলেছিলেন তিনি৷

ছবিটার দিকে তাকিয়ে অনেক দিন পর কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেল কালীকিংকরের৷ মনে মনে হিসাব করতে লাগলেন তিনি, এইসব কতদিন আগের কথা হবে? তাঁর তখন প্রায় যুবা বয়স৷ চল্লিশ বছর আগের কথা এসব! মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের নিজের সম্পর্কে গণনা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে অন্তত কুড়ি বছর আগে গত হয়েছেন তিনি৷ তাঁর শেষ জীবনের খবর অবশ্য জানা নেই কালীকিংকরের৷ মাত্র বছর খানেক গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক টিকে ছিল, তারপর চির বিচ্ছেদ হয়ে যায় দু-জনের৷

আসলে গুরুর উলটো পথে হাঁটতে শুরু করেছিলেন কালীকিংকর৷ গুরুর কাছে বেশ কিছু বিদ্যা শেখার পর লোভ তাঁকে পেয়ে বসেছিল৷ ভাগ্য পালটানোর বিধান দিতে শুরু করেছিলেন তিনি৷ মৃত্যু ভয়ে ভীত একজন লোককে মোটা অর্থের বিনিময়ে এক বার একটা তাবিজ দিয়েছিলেন কালীকিংকর৷ কথাটা কানে গেছিল মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের৷ শিষ্যকে সতর্ক করেছিলেন তিনি৷ কিন্তু কালীকিংকর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি৷ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষই তাঁর জীবনের জাগতিক উন্নতির সোপান৷ মৃত্যুর হাত এড়াতে মানুষ তার সর্বস্ব সমর্পণ করতে পারে অন্যের হাতে৷ আর এ ব্যাপারটা যে কত বড়ো সত্যি, তার প্রমাণ কালীকিংকর নিজে৷ কোথায় বীরভূমের এক অখ্যাত গ্রামে ততোধিক অখ্যাত এক শ্মশানের, শবযাত্রীদের কৃপা অন্নে প্রতিপালিত মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের শিষ্য কালীকিংকর৷ আর কোথায় আজকের, ‘জ্যোতিষ সম্রাট’ কালীকিংকর! গাড়ি, বাড়ি, অর্থ, প্রতিপত্তি সম্মান, কী নেই আজ তাঁর? আর এ সবই তিনি পেয়েছেন, মানুষের মৃত্যুভয় আছে বলেই৷ চল্লিশ বছর আগের এক নিঃস্ব যুবক আজ একজন সফল মানুষ৷ তিনিই ঠিক-শেষের এই কথাগুলো ভেবে মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের ছবির দিকে তাকিয়ে একটা আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন কালীকিংকর৷

একলা ঘরে বসে নানা কথা ভাবতে লাগলেন তিনি৷ বৃষ্টি যেন আরও বাড়ছে৷ কড়াৎ কড়াৎ শব্দে কোথায় যেন বাজ পড়ল! আর তার পরেই বাতি নিভে গেল৷ টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে একটা মোমবাতি বার করে সেটা জ্বালিয়ে টেবিলের উপর রাখলেন কালীকিংকর৷ তিরতির করে মোমবাতির শিখাটা কাঁপছে৷ আধো অন্ধকার ঘর৷ মোমবাতির একটা আলোকরেখা কীভাবে গিয়ে যেন পড়ছে দেওয়ালের কোণে মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের সেই ছবির উপর৷ কালীকিংকরের চোখ আবার চলে গেল সেদিকে৷ কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর কালীকিংকরের হঠাৎ মনে হল, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছবিটা মোমের আলোতে কেমন যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে৷ ছবির ফ্রেমের ভিতর থেকে উজ্জ্বল চোখে যেন তার দিকে তাকিয়ে আছেন মৃত্যুঞ্জয়! তাঁর ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠেছে একটা হাসি! ছবিটার এই জীবন্ত হয়ে ওঠা হয়তো আলো-ছায়ার কারসাজি, কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে কালীকিংকর কেমন একটা যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন৷ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে তিনি চোখ সরিয়ে নিলেন৷

হরিপদ আসছে না, বৃষ্টিতে কলকাতার রাস্তার যা অবস্থা হয়! হয়তো জমা জলে আটকে গেছে তার গাড়ি! টেবিলেই রাখা ছিল হাল সনের পঞ্জিকা, কালীকিংকর সেটা খুলে পর দিনের গ্রহ-নক্ষত্র-রাশিফল দেখার জন্য তার পাতা উলটাতে লাগলেন৷ কাল রবিবার, জুলাইয়ের ছয়, বাংলার তেরোই আষাঢ়! পাতাটিতে পৌঁছে, বড়ো বড়ো হরফে লেখা বাংলা বছরের তারিখটা হঠাৎই যেন বিশেষ চেনা চেনা মনে হয় কালীকিংকরের৷ এ দিনটার কী একটা যেন আলাদা তাৎপর্য আছে৷ কিন্তু কী সেটা? কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অবশ্য তিনি ব্যাপারটা ধরে ফেললেন৷ আরে ‘তেরোই আষাঢ়’ তো তাঁর জন্ম দিন! কাজের চাপে ব্যাপারটা একদম ভুলেই গেছিলেন তিনি! কত বয়স হল তাঁর? মনে মনে হিসাব করলেন, কাল তিনি একষট্টিতে পা রাখতে যাচ্ছেন৷ ‘দেখতে দেখতে ষাটটা বছর পার করে ফেললাম!’ ব্যাপারটা ভেবেই নিজেই যেন তিনি একটু অবাক হয়ে গেলেন৷

ঠিক সেই সময় হঠাৎ চেম্বারের দরজার বাইরে পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে কালীকিংকর বললেন, ‘কে? হরিপদ ফিরলি নাকি?’

ওপাশ থেকে ভেসে এল অন্য একটা গলার স্বর, ‘না, মানে আমি হাত দেখাতে এসেছি . . .৷’

এই দুর্যোগের মধ্যে কোনো ক্লায়েন্ট আসবেন তা ধারণা করতে পারেননি কালীকিংকর৷ মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল তাঁর৷ আজকের দিনটা তাহলে একদম নিষ্ফলা নয়! গম্ভীরভাবে কালীকিংকর বললেন, ‘আসুন, ভিতরে আসুন৷’

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে সামনে এসে দাঁড়াল বছর পঁচিশের এক যুবক৷ পরনে দামি পোশাক, মনিবন্ধে দামি ঘড়ি৷ সম্ভবত গাড়িতে এসেছে, তাই বৃষ্টিতে ভেজেনি সে৷ নাকের ডগায় নামানো চশমার উপর দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে পেশাদারী চোখে তাকে জরিপ করে নিয়ে কালীকিংকর বুঝতে পারলেন সম্ভবত বেশ পয়সাকড়ি আছে৷ ‘জ্যোতিষ সম্রাটে’র চেহারাতেও একটা সম্ভ্রম জাগানো ভাব আছে৷ টকটকে ফর্সা রং, মাথাজোড়া বিরাট টাক, টিয়া পাখির মতো বাঁকানো নাকের ডগায় দামি রিমলেস চশমা, গলায় রুদ্রাক্ষের ছড়া, ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি৷ প্রথম দর্শনেই একটা ভক্তি শ্রদ্ধা জাগে৷ ছেলেটা নমস্কার করে কালীকিংকরের মুখোমুখি উলটো দিকের চেয়ারে বসল৷

কালীকিংকর তাঁর গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন কী সমস্যা? কোথা থেকে আসছেন আপনি?’

ছেলেটা বিষণ্ণ মুখে বলল, ‘আমি অনিমেষ সেন৷ এই কলকাতাতে থাকি যোধপুর পার্কে৷ প্রমোটারি ব্যাবসা আছে আমার৷ ব্যাবসা ভালোই চলে৷ জানেন তো এসব কারবারে নানারকম অসুবিধা থাকে৷ অনেক সময় খুনোখুনি হয়৷ কিছুদিন ধরে এক মস্তান টাকার জন্য আমাকে হুমকি দিচ্ছে! দেখুন তো আমার কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই তো?’ এই বলে সে তার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল কালীকিংকরের দিকে৷

টেবিলে রাখা আতস কাচটা তুলে নিলেন, তারপর তার হাতটা স্পর্শ করলেন কালীকিংকর৷ কী ঠান্ডা হাত, ঠিক যেন বরফ! আতস কাচের নীচে হাতটা দেখতে দেখতে তিনি কী করবেন চিন্তা করে নিলেন৷ মিনিট পাঁচেক হাত দেখার পর ছেলেটার জন্ম তারিখ জেনে নিয়ে একটা কাগজে বেশ কিছুক্ষণে রাশিচক্র আঁকিবুকি করে কালীকিংকর গম্ভীর মুখে তাকালেন ছেলেটার দিকে৷ ছেলেটার চোখে স্পষ্ট উৎকন্ঠা ফুটে উঠেছে৷

কী বলবেন ভাবা হয়ে গেছে কালীকিংকরের৷ তিনি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যা দেখছি ব্যাপারটা ভালো নয়৷ মঙ্গল ভীষণ কুপিত, তা ছাড়া আপনার অপঘাতে মৃত্যুযোগও আছে!’

‘মৃত্যুযোগ’! চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠল ছেলেটা৷

‘হ্যাঁ, মৃত্যুযোগ৷ জ্যোতিষ সম্রাট কালীকিংকরের গণনা মিথ্যা হয় না৷’ বললেন তিনি৷

ছেলেটা তা শুনে বেশ ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, ‘কী হবে তাহলে? আপনি একটা ব্যবস্থা করুন যাতে রক্ষা পাই আমি৷ আমি বাঁচতে চাই৷’ ছেলেটার গলার স্বর কেঁপে উঠল৷

কয়েক মুহূর্ত গভীর চিন্তার ভান করে কালীকিংকর বললেন, ‘প্রতিকার অবশ্য একটা আছে৷ পাঁচ রতির একটা চুনি ধারণ করতে হবে৷’

ছেলেটা বলল, ‘তাহলে সেটা কোথায় পাওয়া যাবে? কীরকম দাম হবে? যাই হোক না কেন আমি নেব৷’

জ্যোতিষী বুঝলেন তার ওষুধ ধরেছে৷ তিনি বললেন, ‘আমার কাছে পাওয়া যাবে৷ তবে, আজেবাজে জিনিস আমি রাখি না৷ খাঁটি বর্মি চুনি৷ হাজার কুড়ি টাকার মতো পড়বে৷’ এই বলে তাঁর রিভলবিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে তার ঠিক পিছনেই দেওয়ালের গায়ে গাঁথা লোহার সিন্দুক খুলে একটা ছোটো বাক্স বার করে আনলেন৷ তার মধ্যে বেশ কয়েকটা তুলোট কাগজের মোড়ক৷ একটা মোড়ক খুলে তিনি ছেলেটার সামনে মেলে ধরতেই মটর দানার মতো লাল পাথর মোমের আলোতে চকচক করে উঠল!

ছেলেটা কয়েক মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘এতে কাজ হবে তো?’

কালীকিংকর বললেন, ‘নিশ্চয়ই হবে৷ একদম খাঁটি রত্ন৷ এটা ধারণ করলে মৃত্যু আপনাকে স্পর্শ করতে পারবে না৷’ তাঁর কথা শুনে ছেলেটার চোখ ঝলমল করে উঠল৷ পরক্ষণেই প্যান্টের পকেট থেকে একতাড়া নোট বার করল কালীকিংকরকে দেবার জন্যে৷

মিনিট পাঁচেক সময় লাগল রসিদ-টসিদ কাটার জন্য৷ কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোটগুলো গুনে দিয়ে চুনিটা নিয়ে হাসিমুখে ছেলেটা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল৷ হাসি কালীকিংকরের মুখেও৷ টাকাগুলো সিন্দুকে রেখে তিনি ছেলেটার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনি নিশ্চিন্তে যান, প্রয়োজন হলে আবার আসবেন৷’

হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে ছেলেটা বলল, ‘আপনি আমাকে বাঁচালেন৷ অবশ্যই আসব৷’ এরপর সে বাইরের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে একবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘দরজার বাইরে বেঞ্চে আরও দু-জন আছে৷ মনে হয় তারাও হাত দেখাবেন৷ ভিতরে পাঠিয়ে দেব কি?’

এই বৃষ্টিতে আরও দু-জন! ব্যাপারটা ভাবতে পারেননি কালীকিংকর৷ এই দুর্যোগের দিনেও লক্ষ্মীদেবী তাঁর প্রতি প্রসন্ন! মনটা নেচে উঠল তাঁর৷ কিন্তু মনের ভাব গোপন করে তিনি বললেন, ‘আজকেও দেখছি আমার মুক্তি নেই৷ এক জনকে ভিতরে আসতে বলুন৷’ এমন ভাবে তিনি কথাগুলো বললেন, যেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাত দেখতে হবে তাঁকে৷

যে ভদ্রলোক এবার কালীকিংকরের সামনের চেয়ারে বসলেন তিনি মধ্যবয়সী৷ পরনে ধূসর রঙের দামি থ্রি-পিস সুট৷ সুন্দরভাবে কামানো ফর্সা মুখ৷ চোখের চশমাটাও সোনার বলেই মনে হয়৷ বেশ একটা আত্মবিশ্বাসের ভাব আছে লোকটার মধ্যে৷ কিন্তু সে বিশ্বাসে নিশ্চয়ই টোল খেয়েছে৷ নইলে ইনি জ্যোতিষীর দরবারে হাজির হবেন কেন? জ্যোতিষদের পেশায় ক্লায়েন্টদের সাইকোলজি বোঝাটা বেশ জরুরি৷ অভিজ্ঞ কালীকিংকর ধরতে পারলেন এই ব্যাপারটা৷

চেয়ারে বসার পর লোকটা একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আমার নাম অবনী হালদার৷ পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট৷ নিজস্ব ফার্ম আছে৷ কয়েক মাস ধরে একটা ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে আমাকে৷ কোনো কাজে মন বসাতে পারছি না৷ তাই আপনার কাছে এসেছি৷ যদি কোনো পাথর-

টাথর . . .৷’ কথাটা আর শেষ করলেন না তিনি৷

‘কী ভয়?’ স্থির দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন কালীকিংকর৷

অবনী হালদার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, ‘মৃত্যুভয়৷’

এরও মৃত্যুভয়? এ তো মেঘ না চাইতে জল! সোজা হয়ে বসে কালীকিংকর জানতে চাইলেন, ‘কীসের মৃত্যুভয়?’

অবনী হালদার বললেন, ‘আমার পেটে একটা ব্যথা আছে দীর্ঘ দিন ধরে৷ ডাক্তারের পিছনে অনেক পয়সা ঢেলেও কোনো কাজ হচ্ছে না৷ মাস তিনেক ধরে ব্যথাটা ক্রমশই বাড়ছে৷ যদিও ডাক্তারেরা এখনও ফাইনালি কিছু বলেননি৷ তবে একটা আশঙ্কা ক্রমশই দানা বাঁধছে আমার মনে৷ আসলে আমার বাবা-ঠাকুরদাও ওই রোগে আমারই মতন বয়সে চলে গেছেন৷ আমার ধারণা যদি সত্যি হয় তাহলে আর বেশি দিন বাঁচব না আমি৷ এ রোগের এখনও কোনো চিকিৎসা বেরোয়নি৷’ কথাগুলো একটানা বলার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অবনী হালদার বললেন, ‘আপনার অনেক নাম শুনেছি৷ তাই আপনার কাছে এসেছি৷ টাকাপয়সার ব্যাপারে আমি কোনো কার্পণ্য করব না, দেখুন যদি কিছু করতে পারেন৷’

তাঁর কথা শোনার পর কালীকিংকর শুধু বললেন, ‘আপনার ডান হাতটা দেখি৷’ অবনী হালদার ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন৷ তাঁর অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে একটা চুনি বসানো সোনার আংটি৷ ঠিক যেমন একটা চুনি একটু আগে তিনি ছেলেটাকে দিলেন, ঠিক সেইরকম৷ আংটিটা দেখে কালীকিংকরের বুঝতে অসুবিধা হল না যে, ইতিপূর্বে কোনো কারণে কোনো-না-কোনোদিন কোনো জ্যোতিষীর কাছে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক৷ হয়তো সেখান থেকেই কোনো কারণে পাথর-টাথরে তাঁর বিশ্বাস জন্মেছে৷

বাইরে বৃষ্টির বিরাম নেই৷ ঘন ঘন বাজের শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ অবনী হালদার বললেন, ‘কী বুঝলেন বলুন? আমার ধারণাই কি ঠিক? বাপ-ঠাকুরদার মতোই কি এই বয়সেই মৃত্যুযোগ লেখা আছে আমার ভাগ্যে?’ কথাগুলো বলতে গিয়ে অবনী হালদারের গলার স্বর কেঁপে উঠল৷

কালীকিংকর একটা আক্ষেপের ভাব গলায় ফুটিয়ে তুলে বললেন, ‘দুশো সেন্ট অর্থাৎ অন্তত দুই রতির একটা বেলজিয়াম হিরে ধারণ করতে হবে আপনাকে৷ হাজার চল্লিশের মতো দাম পড়বে পাথরের৷ পারবেন?’

অবনী হালদার বলে উঠলেন, ‘পারব না কেন? হিসাব করলে দেখা যাবে যে, এর চেয়ে অনেক বেশি টাকা আমি ডাক্তারের পেছনে ঢেলেছি৷ ও টাকা এখনি আমার সঙ্গে আছে৷ কোন জুয়েলারি দোকানে ও পাথর পাওয়া যাবে বলুন? আমি এখনই কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরব৷’

কালীকিংকর বললেন, ‘এই বৃষ্টির রাতে এখন দোকান হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে৷ তবে আপনাকে একটা কথা বলি, ক্লায়েন্টদের সুবিধার জন্য কয়েকটা দামি পাথর আমি রেখে দিই৷ দু-রতি হিরে আমার কাছে আছে৷ দাঁড়ান আপনাকে দেখাচ্ছি৷’ এই বলে সিন্দুকের দিকে ফিরলেন কালীকিংকর, আর কয়েক মুহূর্ত পরই তাঁর হাতের তালুতে ছোট্ট একটা পাথর নিয়ে তা মেলে ধরলেন ভদ্রলোকের সামনে৷ মোমের আলোতে ঝলমল করে উঠল বেলজিয়াম হিরে৷

পাথরটার দিকে তাকিয়ে অবনী হালদার বিস্মিতভাবে বললেন, ‘এই পাথর সত্যিই আমার মৃত্যুযোগ দূর করতে পারবে?’

শান্ত গলায় জ্যোতিষ সম্রাট বললেন, ‘হ্যাঁ, এই হিরেই একমাত্র পারে আপনার মৃত্যুযোগ দূর করতে৷’ লেনদেনের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে৷ হিরে নিয়ে চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন অবনী হালদার নামের ভদ্রলোক৷

অবনী হালদারের টাকাগুলো সিন্দুকে তুলে রেখে ঘড়ির দিকে তাকালেন কালীকিংকর৷ আটটা বাজে৷ হরিপদর এখনও দেখা নেই৷ একটু ভয় ভয় লাগল৷ এতগুলো টাকা! দিনকাল মোটেই ভালো নয় আজকাল৷ সিন্দুকে ভালো করে চাবি দিয়ে সেটা তিনি ট্যাঁকে তুলতে যাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় দরজার কাছ থেকে ভেসে এল একটা কন্ঠস্বর, ‘আমি কি ভিতরে আসব?’

কালীকিংকরের হঠাৎ খেয়াল হল, ও, আরও এক জন তো অপেক্ষা করছেন৷ ‘হ্যাঁ, ভিতরে আসুন,’ জবাব দিলেন কালীকিংকর৷

বৃদ্ধ ভদ্রলোক, বয়স মনে হয় সত্তরের উপরে হবে৷ চোখে চশমা, চুনোট ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম, হাতে রুপো-বাঁধানো ছড়ি৷ নমস্কার জানিয়ে চেয়ারে বসলেন তিনি৷ কালীকিংকর ভালো করে দেখলেন তাঁকে৷ সম্ভ্রান্ত চেহারা ভদ্রলোকের৷ স্বভাব সুলভ গাম্ভীর্য বজায় রেখে কালীকিংকর বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন, কী সমস্যায় এসেছেন আপনি? কী করা হয়?’

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার নাম অঘোর চক্রবর্তী৷ একসময় সরকারি দপ্তরে বেশ একটা উঁচু পদে চাকরি করতাম৷ একলা মানুষ৷ বর্তমানে বাড়িতে ধর্মকর্ম নিয়েই সময় কাটাই৷ জ্যোতিষে আমার বিশ্বাস আছে৷ বয়স পড়ে এল৷ শেষ বয়সে একটু ললাটলিখনটা জানতে এসেছি৷ আপনি ললাটলিখন পড়তে পারেন? আমার যা বয়স তাতে হস্তরেখা সব হারিয়ে গেছে৷’

কালীকিংকর বললেন, ‘পারব না? সব বিদ্যাই আমার জানা আছে৷ একসময় মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের শিষ্য ছিলাম আমি৷’ সাধারণত এই কথাটা বলেন না তিনি৷ নিজের অজান্তেই যেন মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের নামটা অনেক দিন পর তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল!

বৃদ্ধ বললেন, ‘ও মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিক! আমি নাম শুনেছি তাঁর৷’ বৃদ্ধ তাঁকে খুশি করার জন্য কথাটা বলল কি না, তা বুঝতে পারলেন না কালীকিংকর৷

তাঁর কপালের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কালীকিংকর বললেন, ‘আপনার জন্ম তারিখটা বলুন৷ ললাটরেখার সাথে জন্ম তারিখ মিলিয়ে তার পর আমাকে যা বলার বলতে হবে৷’

তারিখটা বলে দিলেন ভদ্রলোক৷ কাগজে আঁক কাটতে কাটতে কালীকিংকর ভাবলেন, ‘এ লোকটারও পয়সা ভালোই আছে৷ তার সিন্দুকে একটা পান্নার আংটি রাখা আছে৷ ভাগ্যদেবী তাঁর প্রতি আজ সুপ্রসন্ন৷ খেলাটা এ লোকটার ক্ষেত্রেও খেলে দেওয়া যাক৷ বৃদ্ধ হলেও সকলেরই তো বাঁচার আকাঙ্খা থাকে৷

বেশ কিছুক্ষণ আঁকজোক করার পর কাগজের দিকে চোখ রেখে জ্যোতিষী বললেন, ‘যা দেখলাম সুবিধার মনে হচ্ছে না৷ আজকাল সত্তর বছর বয়স মরার বয়স নয়৷ কিছু মনে করবেন না, আপনার ললাটলিখন বলছে শীঘ্রই আপনার মৃত্যুযোগ আছে৷’

‘মৃত্যুযোগ! তাই লেখা আছে?’ একটা বিস্মিত কন্ঠস্বর বেরিয়ে এল বৃদ্ধর গলা থেকে৷

কালীকিংকর এরপর বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই তো লেখা আছে৷ তবে যদি হাজার দশেক খরচ করতে পারেন, তাহলে এই যাত্রায় ফাঁড়াটা কেটে যেতে পারে৷ একটা কলোম্বিয়ান পান্না ধারণ করতে হবে৷ আমার কাছে একটা আছে৷ রুপোর আংটিতে বসানো৷ সস্তাতেই দিয়ে দেব৷’

ভদ্রলোক বললেন, ‘ও টাকা আমি এখনই দিতে পারি কিন্তু . . .৷’

টাকা যখন ভদ্রলোক দিতে পারেন, তখন তাকে বেশি কথা বলতে দিলে অসুবিধা হতে পারে৷ তাই কালীকিংকর বলে উঠলেন, ‘টাকা যখন আপনার কাছে, তখন আংটিটা নিতে দ্বিধা করবেন না৷ জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার বলে কথা! দাঁড়ান, জিনিসটা আমি আপনাকে বার করে দেখাই৷’ এই বলে সিন্দুকের দিকে চেয়ারের মুখ ফেরালেন কালীকিংকর৷

আংটিটা বার করে কালীকিংকর বললেন, ‘দিন ডান হাতটা দেখি৷ মনে হয় হয়ে যাবে৷ নইলে কাল স্যাকরার কাছে নিয়ে যাবেন৷’

বৃদ্ধ তাঁর হাতটা বাড়িয়ে দিলেন৷ মোমের আলোতে সে হাতে দুটো আঙুল ঝিলিক দিয়ে উঠল৷ আরও দুটো দামি পাথর রয়েছে তাঁর আঙুলে৷ আংটি পরাবার জন্য তাঁর আঙুল স্পর্শ করলেন কালীকিংকর৷ কী বরফের মতো ঠান্ডা সে হাত! আংটিটা বৃদ্ধের তর্জনীতে পরিয়ে সে দিকে তাকিয়ে রইলেন জ্যোতিষ সম্রাট৷ অন্য দুটো পাথরের পাশে বেশ মানিয়েছে সবুজ রঙের পাথরটা৷ কিন্তু তারপরই অন্য দু-আঙুলের পাথর দুটোও যেন চেনা চেনা মনে হল তাঁর৷

ঠিক সেই সময় বৃদ্ধ হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘পাথর কি মৃত্যুযোগকে খণ্ডাতে পারবে! ভাগ্যের লিখন কেউ বদলাতে পারে না৷ আর মৃত্যু হল অপ্রতিরোধ্য৷ তাকে রোখার সাধ্যি কারও নেই৷’

কথাটা শুনেই চমকে উঠে বৃদ্ধর দিকে তাকালেন জ্যোতিষ সম্রাট কালীকিংকর৷ এ কার কন্ঠস্বর! বৃদ্ধর ঠোঁটের কোণে যেন ফুটে উঠেছে একটা হাসি৷ মোমের শিখাটা দপদপ করতে শুরু করেছে নিভে যাবার আগে৷ সে আলোতে কালীকিংকর দেখলেন, বদলে যাচ্ছে বৃদ্ধর মুখ৷ বয়স কমছে তাঁর! অঘোর চক্রবর্তী থেকে অবনী হালদার তার থেকে অনিমেষ সেন! কালীকিংকর চিৎকার করে উঠলেন, ‘কে! কে আপনি?’

বাইরে কোথায় যেন প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ল, কেঁপে উঠল সারা ঘর৷ মোমবাতির শিখাটা শেষ বারের মতো একবার দপ করে জ্বলে উঠল৷ মুহূর্তের জন্য কালীকিংকর দেখতে পেলেন তাঁর সামনে বসে আছেন জটাজূটধারী এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী! পর মুহূর্তেই ঘর অন্ধকার হয়ে গেল৷ সেই অন্ধকারের ভিতর থেকে ভেসে এল বহুদিন আগে কালীকিংকরের শোনা এক পরিচিত কন্ঠস্বর, ‘বিধাতা পুরুষ জন্ম মুহূর্তে প্রত্যেকের আয়ু নির্দিষ্ট করে দেন৷ তার আর অন্যথা হয় না৷ আমার ক্ষেত্রেও হয়নি, তোর ক্ষেত্রেও হবে না . . .৷’ কথাগুলো অনুরণিত হতে লাগল অন্ধকার ঘরের মধ্যে৷

আতঙ্কিত কালীকিংকর টেবিল ছেড়ে উঠে পালাতে গেলেন, কিন্তু যে হাতে তিনি পাথরটা পরালেন, সেই হাত ততক্ষণে চেপে ধরেছে তাঁর হাত৷ অন্ধকারে মধ্যে শুধু সেই হাতটাকেই দেখতে পাচ্ছেন কালীকিংকর৷ সে হাতে রক্ত মাংস কিছু নেই, সাদা ফ্যাটফেটে কতগুলি হাড়! আর তাতে পরানো আছে মৃত্যুযোগ কাটানোর জন্য তাঁর দেওয়া হিরে-চুনি-পান্না! একটা আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল কালীকিংকরের গলা থেকে৷ বাজের শব্দে ঢেকে গেল কালীকিংকরের আর্তনাদ৷

পরের দিন সংবাদপত্রে একটা ছোট্ট খবর ছাপা হল, ‘জ্যোতিষ সম্রাট কালীকিংকর গত কাল রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেছেন৷ যৌবনে তিনি ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় তান্ত্রিকের শিষ্য৷ মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ষাট বছর৷ আজ তেরোই আষাঢ় ছিল তাঁর একষট্টিতম জন্মদিন৷’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *