অষ্টম পরিচ্ছেদ
(১)
কেয়া আদিত্যর ওপর রাগ করেছে। প্রায় দু’দিন হতে চলল কথা বলছে না। মহা বিপদে পড়েছে আদিত্য। কী করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। একবার বসার ঘরে এসে বসে, একবার শোবার ঘরে গিয়ে বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। আবার একবার রান্নাঘরে গিয়ে দ্যাখে কেয়া কী করছে। আদিত্য যে রান্নাঘরে ঢুকেছে কেয়া যেন খেয়ালই করেনি। আদিত্যকে উপেক্ষা করে একমনে নিজের কাজ করে যায়। ইচ্ছে করে গুনগুন করে গান করে। যেন ঘরে আর কেউ নেই। যেন দেখাতে চায় আদিত্যকে বাদ দিয়ে সে খুব ভাল আছে। মাঝে মাঝে কেয়ার ওপর ভীষণ রাগ হয়ে যায় আদিত্যর। এটা ঠিক যে সে একটা গন্ডগোল করে ফেলেছে। কিন্তু তাই নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করা কী উচিত? আসলে দোষটা ঠিক তারও তো নয়। এটা তো তার পেশা। পেশার জন্য এটুকু তো করতেই হবে। দোষটা সুভদ্রর।
ঘটনার সূত্রপাত কৃষ্ণনগর থেকে ফিরে আসার পর। ফেরার পরের দিন বোকা সুভদ্রটা আদিত্যদের বাড়িতে এল। এসে ফলাও করে গল্প করল আদিত্যদা কী অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে তাকে এবং নিজেকে রক্ষা করেছে। কীভাবে সে আর আদিত্যদা ড্রেন পাইপ বেয়ে নামল। আদিত্যদা কেমন ধপাস করে পড়ে গেল। তারপর সাপখোপের ভয় না করে সে আর আদিত্যদা কেমন সারা রাত্তির কারখানার ওপর নজর রাখল। তারপর হঠাৎ কেমন করে কারখানা আর গেস্ট হাউসটা জ্বলতে লাগল।
সুভদ্রর উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না। আদিত্যর কত বুদ্ধি এটা বোঝানোর জন্যেই সুভদ্র কেয়াকে গল্পটা বলছিল। কিন্তু আদিত্য টের পাচ্ছিল গল্প যত এগোচ্ছে কেয়ার মুখ তত গম্ভীর হচ্ছে। সুভদ্রকে বলে দেওয়া উচিত ছিল কৃষ্ণনগরে কী ঘটেছে কেয়াকে যেন না বলে।
গল্প শেষ হবার পর আদিত্যর দিকে তাকিয়ে কেয়া থমথমে মুখে বলল, “এসব বাহাদুরি দেখানোর সময় একবারও মনে পড়ল না মাত্র কিছুদিন আগে তোমার স্টেন্ট বসেছে?’
কেয়ার মুড দেখে সুভদ্র বুঝতে পারল সে একটা বিরাট ফোফা করে ফেলেছে। দু’একটা কথা বলার পর সে মানে মানে কেটে পড়ল। সুভদ্র চলে যাবার পর কেয়া একটাই কথা বলেছিল।
‘আমার কথাটা একবারও তোমার মনে পড়ল না? মনে হল না, তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কোথায় যাব?”
সেই শেষ কথা। তারপর দু’দিন হয়ে গেল আদিত্যর সঙ্গে কেয়া আর কোনও কথাই বলছে না।
মৃত্তিকা মিত্রর কেসটা ছাড়া আদিত্যর হাতে এখন আর কোনও কাজ নেই। মৃত্তিকা মিত্রর কেসটার ব্যাপারে আদিত্যর একটা ইনফর্মেশন দরকার ছিল। সেটার জন্যে তার উকিল বন্ধু সুনন্দ সরকারকে ফোনও করেছিল। কিন্তু সুনন্দর ফোনটা সুইচড অফ হয়ে আছে। তার মানে সম্ভবত সুনন্দ দেশে নেই। আদিত্য জানে মাঝে মাঝে এরকম হয়। পরিবার নিয়ে সুনন্দ বিদেশে বেড়াতে যায়। এখনও হয়ত বিদেশে বেড়াচ্ছে। সুনন্দ ফিরে আসা অব্দি অপেক্ষা করতে হবে।
বাকি কাজ বসে বসে চিন্তা করা। সেটা আপিসে বসে করা যায়, আবার বাড়িতে বসেও করা যায়। আপিসে কতক্ষণ আর থাকবে? সেই বাড়িতেই ফিরে আসতে হবে। বাড়ি ফিরে সারাক্ষণ তো আর মৃত্তিকা মিত্রর কেসটা নিয়ে ভাবা যায় না। কেয়ার রাগটা যদি একটু পড়ত তাহলে কেয়ার সঙ্গে গল্প করে করে সময়টা বেশ কেটে যেত। কেয়া কথা বলছে না দেখে দ্বিতীয় দিনের শেষ থেকে আদিত্য ওয়ার অ্যান্ড পিস পড়তে শুরু করেছে। সেই কলেজে পড়ার সময় পড়েছিল। আর একবার পড়ার ইচ্ছে ছিল। একশ-দেড়শ পাতা পড়ার পর, বইটা ছাড়া যাচ্ছে না, এত টানটান। কেয়ার সঙ্গে ঝগড়ার কথাও প্রায় ভুলে গেছে। চারটে দিন কেটে গেল, তবু শান্তি এল না জেনারেল কুটুসভ এবং নেপোলিয়নের মধ্যেও নয়, আদিত্য আর কেয়ার মধ্যেও নয়। আদিত্য বইএর মধ্যে ডুবে আছে। ভাবছে, আর ক’টা দিন ঝগড়া চললে বইটা পড়া হয়ে যাবে।
পঞ্চম দিন সকালে বই রেখে আদিত্য আবার সুনন্দ সরকারের নম্বরটা ডায়াল করল। রোজ সকালেই নিয়ম করে একবার করে, রোজই নম্বরটা সুইচড অফ পায়। আজ, কী সৌভাগ্য, নম্বরটা বাজছে!
‘কী রে, সাত সকালে ফোন? ব্যাপার কী?’ সুনন্দর গলাটা খুশি-খুশি শোনাল। ‘কবে থেকে তোকে ধরার চেষ্টা করছি। তুই কলকাতায় ছিলি না?’ আদিত্য খানিক বিষণ্ণ গলায় বলল ।
‘পাগল নাকি? সারা বছর কেউ কলকাতায় থাকে? আমি তো সুযোগ পেলেই পালাই।’
‘কোথায় গিয়েছিলি?’
‘এবার গিন্নিকে নিয়ে স্লোভেনিয়া গিয়েছিলাম। ওদের রাজধানী লুবলিয়ানায় আমার ভাগ্নেটা থাকে। বিলেত থেকে ইকনমিক্সে পিএইচডি করে বছর খানেক হল ব্যাঙ্ক অফ স্লোভেনিয়ায় চাকরি করছে। ব্যাঙ্ক অফ স্লোভেনিয়া ওদের সেনট্রাল ব্যাঙ্ক, মানে আমাদের যেমন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। যাই হোক, প্রথমে ভাগ্নের কাছে ক’টা দিন কাটালাম। ছবির মত শহর লুবলিয়ানা। ভাগ্নের রান্নাঘর থেকে আল্পস দেখা যায়। ওখান থেকে ক্রোয়েশিয়া গেলাম। ফিরে এসে সাত দিন ইটালি ঘুরলাম, ত্রিয়েস্তে, রোম, ফ্লরেন্স, ভেনিস। আমার আগে একবার দেখা। গিন্নির এই প্রথম। কাল রাত্তিরে ফিরেছি। তা আমাকে ধরার চেষ্টা করছিলি কেন ?
‘হ্যাঁ, বলছি। তোর কি মনে আছে বছর ছয়েক আগে হাইকোর্টে একটা মামলা উঠেছিল কার্ডিওলজিস্ট অসীমাভ রায়ের এগেন্সটে। মামলা করেছিল বনানী দাস বলে এক মহিলা। তার বক্তব্য ছিল ডাঃ রায় তার স্বামীকে টাকার লোভে অপরেশনের পরামর্শ দিয়ে মেরে ফেলেছেন। আসলে অপরেশনের কোনও দরকার ছিল না। মামলাটা ছিল ডাঃ অসীমাভ রায় এবং ডাঃ সমীরণ সান্যালের বিরুদ্ধে। ডাঃ সমীরণ সান্যাল অপরেশনটা করেছিলেন। সেই সময় কেসটা নিয়ে বেশ হইচই হয়েছিল। তোর মনে আছে?’
‘খুব ভালই মনে আছে। এমনিতেই হয়ত মনে থাকত, কিন্তু এক্ষেত্রে মনে রাখার একটা বিশেষ কারণ ছিল। আসলে ডাঃ সমীরণ সান্যাল ওপেন হার্ট সার্জারি করে আমার বাবাকে প্রায় দশ-পনের বছর বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। অসাধারণ ডাক্তার। তাঁর এগেন্সটে কেস, মনে তো থাকবেই। আমি ডাঃ সান্যালের হয়ে দাঁড়াতে রাজি ছিলাম। কিন্তু ওদের হয়ে লোয়ার কোর্ট থেকেই অরুণকান্তি ব্যানার্জী তাঁর টিম নিয়ে লড়ছিলেন। অরুণকান্তি ব্যানার্জীর ওপর তো আর কোনও কথা চলে না। তাই আমি আর দাঁড়ালাম না। তবে কেসটা খুব ক্লোজলি ফলো করতাম।’
‘উল্টোদিকে কে দাঁড়িয়েছিল?’
‘উল্টোদিকে বাচ্চু সেন, মানে অরূপ সেন দাঁড়িয়েছিল। বাচ্চুদাও বিরাট লইয়ার। আমার দাদার মতো। সেই বিলেত থেকে চেনা। তবে বাচ্চুদার কিচ্ছু করার ছিল না। কেসটার কোনও মেরিটই ছিল না, বাচ্চুদা কী করবে?”
‘তুই আমার একটা উপকার করে দিবি? বাচ্চু সেনের সঙ্গে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিবি? বেশি সময় নেব না, বড় জোর দশ মিনিট। একটু কথা বলিয়ে দিতে পারবি?’ আদিত্য কাতর গলায় বলল।
‘ঠিক আছে। তোর কত তাড়াতাড়ি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দরকার?’ ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আজ হলে আজ।’
‘ওক্কে। তুই তাহলে আজ দুটো নাগাদ হাইকোর্ট পাড়ায় চলে আয়। আমার চেম্বারটা তো তুই চিনিস। ওখানে চলে এলে আমি তোকে বাচ্চুদার কাছে নিয়ে যাব। বাচ্চুদার চেম্বার আমার চেম্বার থেকে দু’মিনিট।’
‘আমি ওই মহিলাকে বলেছিলাম ওর কেসটা দাঁড় করানো অসম্ভব। এমন দু’জন অত্যন্ত রেপিউটেড মেডিকাল প্র্যাকটিশনারের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে যাদের ট্র্যাক রেকর্ড ইমপিকেবল। তাছাড়া সমস্ত মেডিকাল রিপোর্ট বলছে আপনার হাসবেন্ড-এর ক্ষেত্রে ওপেন হার্ট সার্জারিটাই একমাত্র অপশন ছিল, যদিও তাতে রিস্ক কিছু কম ছিল না। সব থেকে বড় কথা, আপনি নিজে রিস্ক আছে জেনেও কনসেন্ট ফর্মে সই করেছিলেন। আমি কী করে আপনার কেসটা দাঁড় করাব? ভদ্রমহিলা নাছোড়।’
বাচ্চু সেনের বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়েছে। তোবড়ানো গাল, টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো নাক, কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে একজোড়া অন্তর্ভেদী চোখ। গায়ের রঙ সাহেবদের মতো ফরসা। দেখে মনে হয়, বাচ্চু সেনের শরীরে বিদেশী রক্ত আছে। পরে, বাচ্চু সেনের চেম্বার থেকে বেরিয়ে, সুনন্দকে জিজ্ঞেস করে আদিত্য জানতে পারল বাচ্চু সেনের ঠাকুমা আইরিশ।
‘শেষ পর্যন্ত কেসটা আমাকে নিতেই হল। সবাই বলাবলি করতে লাগল আমি খুব লোভী হয়ে গেছি। টাকার জন্যে যে কোনও কেস নিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন টাকার জন্যে কেসটা আমি নিইনি। ভগবানের দয়ায় আমার টাকার কোনও অভাব নেই। কাজেরও অভাব নেই। ওই কেসটা না নিয়ে আমি অনায়াসে অন্য কোনও কেস নিতে পারতাম। তাতে একই টাকা রোজগার হত। আসলে আমি ভদ্রমহিলার হাত থেকে বাঁচার জন্যে কেসটা নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। ভদ্রমহিলা দিনের পর দিন আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। অনেক রাত্তির হয়ে যেত, তাও নড়তেন না। শি ওয়াজ সাচ আ নুইসেন্স। শেষে আমার স্ত্রী বললেন, কেসটা নিয়েই নাও।’
‘আর তুমি বৌদির কথা শুনে নিয়ে নিলে।’ সুনন্দ মুচকি হাসল। ‘সবাই বলত তুমি নাকি বিধবা মেয়েটার সঙ্গে লাইন মারছ।’
‘আমার খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই ওইরকম অখাদ্য, আন-সফিসটিকেটেড, হাফ-এডুকেটেড, ছিঁচকাঁদুনে একটা মেয়ের সঙ্গে লাইন মারব। ওর সঙ্গে তো কথাই বলা যেত না। দু’একটা কথা বলতে বলতে স্বামীর নাম করে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলত। ডিসগাস্টিং।’
‘তারপর কী হল?” আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘যা হবার তাই হল। অরুণকান্তি ব্যানার্জীর জেরার সামনে মেয়েটা দাঁড়াতেই পারল না। সব থেকে বড় কথা, সমস্ত মেডিকাল রিপোর্ট আমাদের এগেন্সটে ছিল। আদালত তো ইমোশান দিয়ে চলে না, এভিডেন্স দিয়ে চলে। সমস্ত এভিডেন্স আমাদের বিরুদ্ধে ছিল। ফলে আমরা গোহারান হেরে গেলাম।’
‘এটা সিঙ্গল বেঞ্চে তো?’ সুনন্দ জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ সিঙ্গল বেঞ্চ। হেরে গিয়ে মেয়েটার অ্যাটিটিউড পুরো বদলে গেল। আগে কাকুতি-মিনতি করত। এবার রেগে আগুন। বলল, আপনি টাকা খেয়ে ইচ্ছে করে আমাকে হারিয়ে দিয়েছেন। আমি আপনাকে দেখে নেব। আমি রেগে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম। পাগলের ওপর রাগ করে কী লাভ? আর ততদিনে আমি শিয়োর হয়ে গেছি যে মেয়েটা পাগল। তারপর একদিন শুনলাম বনানী দাস ডিভিশান বেঞ্চে যাবে বলে উকিল খুঁজছে। বলাই বাহুল্য, কোনও ভাল লইয়ার ওর কেসটা নিতে চাইল না। শেষে ও একটা জোচ্চোরের পাল্লায় পড়ল। হাইকোর্ট পাড়ায় তো জোচ্চোরের অভাব নেই।’
জোচ্চোরের পাল্লায় পড়ল মানে?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘একটি উকিল, সে নিজেকে ব্যারিস্টার বলে জাহির করত, যদিও আদৌ সে ল পাশ করেছিল কিনা সন্দেহ, বনানীকে বোঝাল ডিভিশন বেঞ্চে তার জয় অবধারিত। বনানী তো এটাই শুনতে চায়। সে বেজায় খুশি হয়ে সেই জোচ্চোরটাকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে যেতে লাগল। পরে শুনেছিলাম এর জন্যে তাকে বসতবাড়িটা বিক্রি করতে হয়েছিল।’
‘তার মানে তুমি নিয়মিত বনানী দাসের খোঁজ-খবর রাখতে?’ সুনন্দর ঠোঁটে বক্র হাসি ।
‘অ্যাজ এ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট, রাখতাম। পরের দিকে মেয়েটার জন্যে আমার বেশ চিন্তা হত। শি ওয়াজ এক্সট্রিমলি ভালনারেবল। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। আমার কথা তো আর ও শুনবে না।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী? শুনলাম ও নাকি ডিভিশন বেঞ্চে যাবে। ওই জোচ্চোরটা ওকে বুঝিয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের কিছু জজ ঘুষখোর, কিন্তু সবাই নয়। তাদের কপাল মন্দ তাই খারাপ জজের খপ্পরে পড়েছিল। সেই জজ টাকা খেয়ে ওকে হারিয়ে দিয়েছে। ডিভিশন বেঞ্চে গেলে এরকম হবে না। তবে শেষ পর্যন্ত বনানী দাস আর ডিভিশন বেঞ্চে যায়নি। কেন যায়নি, জানি না। জোচ্চোরটার হাত থেকে ও কী করে মুক্তি পেল তাও জানি না। মুক্তি পেয়ে কোথায় গেল সেটাও আমার অজানা।’
‘বনানী দাস এখন কোথায় আছে আমি জানি। তার সঙ্গে আমরা দেখা করে এসেছি। সেই কাহিনিটা আপনাকে বলছি। কিন্তু তার আগে বলুন, ওই উকিল, যে ডিভিশন বেঞ্চে বনানীর হয়ে লড়বে বলেছিল, যাকে আপনি জোচ্চোর বলছেন, সে এখন কোথায়? তার নামটাই বা কী? ‘
‘সে এখন কোথায় ঠিক বলতে পারব না। হাইকোর্ট চত্বরে অনেকদিন তাকে দেখি না। লোকটার নামটা ছিল কিছু একটা নন্দী। স্বপন নন্দী বা ওইরকম একটা কিছু। নামটা স্বপন ছাড়া অন্য কিছুও হতে পারে। তবে টাইটেলটা নন্দী। আপনি এক কাজ করুন। দীপঙ্কর রায় বলে আমাদের এসোশিয়েশনের একজন পাণ্ডা আছে। সুনন্দ তাকে খুব চেনে। দীপঙ্করকে বলা হয় হাইকোর্টের গেজেট। ওর কাছে হয়ত ওই নন্দীর খবর পেতে পারেন।’
বাচ্চু সেনের চেম্বার থেকে আদিত্যরা যখন বেরোল তখন তিনটে বেজে গেছে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল দশ মিনিটের, কার্যত দেখা গেল কথায় কথায় এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে।
‘এই দীপঙ্কর রায়ের সঙ্গেও কিন্তু তোকেই যোগাযোগ করিয়ে দিতে হবে।’ আদিত্য রাস্তায় বেরিয়ে বলল।
‘দেখছি কী করা যায়। কিন্তু তার আগে আমার চেম্বারে চল। চা খাই।’
চেম্বারে বসে সুদৃশ্য বোন চায়নায় সুগন্ধী দার্জিলিং চা খেতে খেতে সুনন্দ তার এক জুনিয়ারকে ফোন করল।
‘দীপঙ্কর রায়কে এখন কোথায় পাব জান? মানে, অ্যাসোসিয়েশনের দীপঙ্কর। একটু দরকার ছিল। এক্ষুনি কথা বলতে পারলে ভাল হয়। একটু দেখ না ধরে আনতে পার কিনা।’
একটু পরে সুনন্দর জুনিয়ার অঞ্জন কুন্ডু যাকে সঙ্গে নিয়ে চেম্বারে এসে ঢুকল তার বয়েস সুনন্দর থেকে কমই হবে। হাসিখুশি, নাদুসনুদুস চেহারা। মাথা জোড়া টাক।
‘কী দাদা? এত জরুরি তলব কীসের?’ দীপঙ্কর রায় চেয়ারে বসতে বসতে বলল। ‘চা খাওয়ান। আপনার অফিসের চা-টা কিন্তু অনবদ্য।’
‘চা তো নিশ্চয় খাওয়াব। কিন্তু কেন তোমাকে দরকার সেটা বলি। ইনি আমার বাল্যবন্ধু আদিত্য মজুমদার। এর একটা ইনফর্মেশন দরকার যেটা একমাত্র তুমিই দিতে পারবে।’
‘আদিত্য মজুমদার? মানে গোয়েন্দা আদিত্য মজুমদার? আরেব্বাবা। আপনি তো মশাই বিখ্যাত লোক। আপনার কথা কত বার পেপারে পড়েছি। বলুন, বলুন কী জানতে চান।’ দীপঙ্কর রায় আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল ।
‘আপনার নিশ্চয় মনে আছে বছর ছয়েক আগে বনানী দাস বলে একজন মহিলা তার স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করে ডাঃ অসীমাভ রায় এবং ডাঃ সমীরণ সান্যালের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। কেসটা কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ অব্দি গিয়েছিল। আপনার মনে আছে?’
‘খুব মনে আছে। খুব মনে আছে। কিন্তু এতদিন পরে কেন জিজ্ঞেস করছেন? কেসটা ডিভিশন বেঞ্চে যাবে নাকি?’
‘না, না। তা নয়। বনানী দাস আর মামলা-টামলার মধ্যে যাবে বলে মনে হয় না। আমার জিজ্ঞাস্য অন্য। ডিভিশন বেঞ্চে যিনি বনানী দাসের হয়ে লড়বেন বলেছিলেন, কিছু একটা নন্দী, তিনি এখন কোথায় বলতে পারেন? সম্পূর্ণ অন্য একটা কেসে তার সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার। ‘
‘সজল নন্দী। জালি লোক। ক্রিমিনালদের হয়ে লড়ত। শোনা যায়, জাজদের ঘুষ দেবার চেষ্টা করত। তারপর একদিন কোনও এক জাজকে ঘুষ দিতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। ফলে এখন আর কোর্টে দাঁড়াতে পারে না। অ্যাডভোকেট হিসেবে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে গেছে, আইনের ভাষায় যাকে বলে, ডিসকোয়ালিফায়েড অন গ্রাউন্ডস অফ মরাল টারপিটিউড। আমি যতদূর জানি লোকটা এখন বাড়িতে বসে ক্রিমিনালদের নানা রকম লিগাল অ্যাডভাইস দেয়। ক্রিমিনালরাই ওর ক্লায়েন্ট।’
‘এই সজল নন্দী লোকটা কোথায় থাকে বলতে পারেন?’
‘আগে তো বেহালায় থাকত। এখনও সম্ভবত ওখানেই থাকে। আপনি যদি ওর সঙ্গে দেখা করতে চান, একটা ফোন করে গেলে সব থেকে ভাল হবে।’
“ওর ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে?’
‘আছে। এই কোর্ট সংক্রান্ত এমন জিনিস নেই যেটা আমার কাছে পাবেন না।’ দীপঙ্কর রায় একটা তৃপ্তির হাসি হাসল।
‘তার মানে আপনার সঙ্গে সজল নন্দীর যোগাযোগ আছে?’
‘কিছুটা আছে। খুব বেশি নেই। কেন বলুন তো?”
‘আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে যাব। আপনার রেফারেন্স দেওয়া যাবে?’ ‘স্বচ্ছন্দে। আমার সঙ্গে সবার সদ্ভাব।’ দীপঙ্কর রায় এক গাল হাসল। আবার চা এসেছে। এবার তিন কাপ ।
জেনারেল কুটুসভের রাত্তিরে ঘুম হয় না। সেদিন রাত্রেও কুটুসভ জেগে বসে আছেন এমন সময় দূত খবর আনল নেপোলিয়নের সৈন্যদল মস্কো ছেড়ে চলে যাচ্ছে। শীত, অনাহার ও ক্লান্তি তাদের ভেতরে ভেতরে একেবারে শেষ করে দিয়েছে। খবরটা প্রথমে কুটুসভের বিশ্বাস হচ্ছিল না। পরে যখন বুঝলেন খবরটা সত্যি, তিনি বললেন, ঈশ্বর অবশেষে আমাদের প্রার্থনা শুনেছেন। আদিত্য ওয়ার অ্যান্ড পিস বন্ধ করল। একটু আগে সে আর কেয়া পাশাপাশি বসে একটাও কথা না বলে নিঃশব্দে ডিনার শেষ করেছে। কেয়া এখন রান্নাঘরে। লেফট ওভার ফ্রিজে তুলে রাখছে। আদিত্যর মনে হল, ঢের হয়েছে, আর নয়। সে হঠাৎ বসার ঘর থেকে রান্নাঘরে গিয়ে কেয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। তার অতর্কিত আক্রমণে কেয়া হতচকিত। আদিত্যর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করতে করতে কেয়া বলতে লাগল, ‘ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও আমায়।’
কেয়ার গলার আওয়াজ ক্রমশ কান্নায় রূপান্তরিত হচ্ছে। সেই কান্নায় দুঃখ নেই, শুধু রাশি রাশি অভিমান আছে। আদিত্য আজ কিছুতেই কেয়াকে ছাড়বে না। জাপটে ধরে আছে। কেয়া যতই চেষ্টা করুক আদিত্য কিছুতেই কেয়াকে ছাড়বে না। কেয়া ধীরে ধীরে আদিত্যর কাছে নিজেকে সমর্পণ করছে।
এখন আদিত্য আকুল হয়ে কেয়াকে আদর করছে। কেয়া সেই আদর শুষে নিচ্ছে, দীর্ঘ অনাবৃষ্টির পর বৃষ্টি পড়লে মাটি যেমন জল শুষে নেয়। তাদের মধ্যে কোনও কথা হচ্ছে না, শুধু একটা শরীর আর একটা শরীরের ভাষা বুঝতে পারছে।
কেয়ার সঙ্গে আদিত্যর ভাব হয়ে গেল।
(২)
সজল নন্দীর সঙ্গে যোগাযোগ করা গিয়েছিল। আদিত্য নিজের পরিচয় দেয়নি, নামটাও বানিয়ে বলেছিল। আর বলেছিল, একটা আইনি পরামর্শ নেবার জন্য দেখা করতে চায়। তার সঙ্গে দীপঙ্কর রায়ের রেফারেন্সটাও দিয়েছিল। সজল নন্দী পরের দিন সন্ধে সাড়ে সাতটায় সময় দিয়েছে।
গন্ডগোল পাকিয়ে সুভদ্র সেই যে ডুব মেরেছিল, আর সে উদয় হয়নি। আদিত্য নিজের থেকেই সুভদ্রকে ফোন করল।
‘শোনো, একজনকে জেরা করার দরকার। তোমাকে সঙ্গে যেতে হবে। লোকটা অতি ধূর্ত। পুলিশ সঙ্গে না থাকলে মুখ খুলবে না। একটা গাড়ি জোগাড় করতে পারবে? কাল সন্ধে সাড়ে সাতটায় বেহালা পৌঁছতে হবে।’
‘নিশ্চয় যাব আদিত্যদা। গাড়ি জোগাড় হয়ে যাবে।’ একটা দোষ করে ফেলেছে বলে সুভদ্র যেন আদিত্যর জন্য বাড়তি কিছু করতে চায়। একটু থেমে সে বলল, ‘ব্যাপারটা একটু খুলে বলবেন ? ”
‘কাল তুমি আমাকে আমার অফিস থেকে তুলে নিও তাহলে। গাড়িতে যেতে যেতে বলব ব্যাপারটা কী। ইতিমধ্যে একটা জিনিস জেনে নিই। কিছুদিন ধরে জিজ্ঞেস করব ভাবছি, করা হয়নি। কানু বলে সেই যে লোকটাকে আমরা ধরেছিলাম তার থেকে আর কিছু পাওয়া গেল?’
‘তেমন কিছু পাওয়া যায়নি, আদিত্যদা। আপনি বলেছিলেন জেলের মধ্যে কানুকে একটা মোবাইল ফোনের ব্যবস্থা করে দিতে। আমরা তাই করে দিয়েছিলাম। খুব একটা লাভ হল কিনা জানি না। মোবাইল ফোনে কানু একবারই একজনের সঙ্গে কথা বলেছে। আমরা নম্বরটা ট্রেসও করেছি। লোকটা সম্ভবত একজন উকিল।’
‘উকিলটার নাম ঠিকানা বলতে পারবে?’
‘অফ হ্যান্ড পারব না। আমি তো কেসটা আর হ্যান্ডেল করছি না। আমি ইতিমধ্যে জেনে নিয়ে কাল আপনাকে বলে দেব।’
‘আর দীনবন্ধু মাহাতো?’
‘সেখানেও কিছু এগোনো যায়নি। লোকটা তার সেই পুরোনো গল্পটাতেই স্টিক করে আছে। ভেরি ফ্রাসট্রেটিং।’
‘কী আর করা যাবে। সব সময় তো ভাগ্য কাজ করে না। ঠিক আছে তা হলে কাল দেখা হচ্ছে।’
পরের দিন সকালটা হাইকোর্টের বার লাইব্রেরিতে অনেকটা সময় কাটাল আদিত্য। দীপঙ্কর রায়ের সহায়তায় কিছু পুরোনো কেসের ইতিহাস খুঁটিয়ে পড়ল। কাজ করতে করতে কখন বেলা পড়ে এসেছে আদিত্য টের পায়নি। আপিসে ফিরে কেয়ার দেওয়া টিপিনটা গোগ্রাসে খেয়ে নিয়ে শ্যামলকে চা আনতে বলল। মনটা খুশি-খুশি। বোধহয়
এবার মৃত্তিকা হত্যা রহস্য সমাধানের দিকে এগোচ্ছে। তবে কয়েকটা জিনিস এখনও ধোঁয়াটে রয়েছে। পরিষ্কার করতে হবে।
সাড়ে ছ’টা নাগাদ সুভদ্রর ফোন। ‘আদিত্যদা নিচে অপেক্ষা করছি। নেমে আসুন।’ সজল নন্দীর বাড়ি এবং চেম্বার বেহালার রায় বাহাদুর রোডে। ঠিক রায় বাহাদুর রোডের ওপর নয়, বারিক পাড়া রোড বলে ছোট একটা রাস্তা রায় বাহাদুর রোড থেকে বেরিয়েছে, বাড়িটা সেখানে। সৌভাগ্যক্রমে জায়গাটা আদিত্যর চেনা। তার ইস্কুলের বন্ধু সুপ্রিয় লাহিড়ি ওখানে থাকত। ইস্কুলে পড়ার সময় সুপ্রিয়র বাড়িতে আদিত্য বেশ কয়েকবার গিয়েছে। কলেজে পড়ার সময়ও। তারপর বহুদিন এই অঞ্চলে আসা হয়নি।
একটা সময় জায়গাটা ক্লাইড ফ্যান বলে পরিচিত ছিল। ক্লাইড ফ্যানের কারখানার নামে জায়গার নাম। সেই কারখানা বহুদিন উঠে গেছে। অঞ্চলটার চেহারাও আমূল বদলে গেছে। আদিত্য জায়গাটা চিনতেই পারছিল না। চোদ্দ নম্বর বাসগুমটিতে একটাও বাস নেই। ফাঁকা বাসগুমটির সামনে দিয়ে আদিত্যরা ডায়মন্ড হারবার রোড থেকে বাঁ দিকে বেঁকল। চোদ্দ নম্বর বাসটা বোধহয় আর চলে না।
আদিত্যর বন্ধু সুপ্রিয় লাহিড়ি এখানকার বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে রাজারহাট নিউ টাউনে চলে গেছে। সুপ্রিয়দের পুরোনো বাড়িটা ভেঙে প্রোমোটার যে নতুন পাঁচতলা বাড়িটা তুলেছে সেই বাড়িটা পেরিয়ে আরও মিনিট কয়েক যাবার পর সজল নন্দীর বাড়িটা বাঁ হাতে পড়ল। তিনতলা বাড়ি। নতুন রঙ হয়েছে। একতলায় সজল নন্দীর চেম্বার। নেমপ্লেটে লেখা, সজল নন্দী, লিগাল অ্যাডভাইসার। ঘড়িতে সাতটা কুড়ি । কলিং বেল বাজানোর পর যে লোকটি দরজা খুলে দিল সে পুলিশের ইউনিফর্মে সুভদ্রকে দেখে খানিকটা ঘাবড়েছে।
‘সজল নন্দী আছেন? তাকে খবর দাও। বল, পুলিশের লোক দেখা করতে এসেছে।’ সুভদ্র ধমকের স্বরে বলল।
‘বাবু আপিসঘরে মক্কেলের সঙ্গে কথা বলছেন।’ পরিচারকটি মিনমিন করে জানাল।
‘ঠিক আছে। তুমি খবর দাও। আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।’ আদিত্য অপেক্ষাকৃত নরম স্বরে বলল।
ইতিমধ্যে আদিত্যরা একটা বড় ঘরে এসে পৌঁছেচে। এক ঝলক দেখে মনে হয় সেটা একটা ওয়েটিং রুম। বড় ঘরের সংলগ্ন একটা ছোট ঘর আছে। সম্ভবত সেখানে বসে সজল নন্দী মক্কেলদের আইনি পরামর্শ দেয়। আদিত্য আর সুভদ্র ওয়েটিং রুমে বসল। পরিচারক ছোট ঘরে ঢুকে খবর দিতে গেছে।
মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পরে একটি রোগা, লম্বা মাঝবয়সী লোক ছোট ঘরটা থেকে বেরিয়ে এল। পুলিশ দেখে সে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। তারপর অস্বাভাবিক দ্রুততায় সে সদর দরজার দিকে পা বাড়াল। আরও কিছুক্ষণ পরে পরিচারকটি এসে বলল, ‘বাবু আপনাদের ডাকছেন।
ঘরটা ছোট হলেও আরামদায়ক। কড়া এসি চলছে। ওয়েটিং রুম থেকে ছোট ঘরে ঢুকলে আবহাওয়ার তফাৎটা বোঝা যায়। সজল নন্দীর চেয়ার-টেবিল বেশ সৌখিন। উল্টোদিকে মক্কেলদের বসার চেয়ারগুলোও তাই।
আদিত্য মনে মনে সজল নন্দীকে যেমন কল্পনা করেছিল লোকটা আদৌ সেরকম নয়। আদিত্য ভেবেছিল সজল নন্দী লোকটা রোগা-সিড়িঙ্গে-ধূর্ত টাইপের দেখতে হবে। কার্যত দেখা গেল লোকটা রীতিমত সৌম্যদর্শন। মাথার চুলগুলো অকালে সাদা হয়ে গিয়ে তার চেহারাকে আরও সম্ভ্রান্ত করে তুলেছে।
‘বলুন আপনাদের জন্যে কী করতে পারি?’ সজল নন্দীর কথা বলার ধরনটাও বেশ মার্জিত। ‘আমার কিন্তু সাড়ে সাতটায় একজন মক্কেল আসার কথা। তাকে খুব বেশিক্ষণ বসিয়ে রাখাটা সমীচীন হবে না।’
‘আমার মনে হয় না সাড়ে সাতটায় আপনার আর কোনও মক্কেল আসবে। আমিই আপনাকে ফোন করে সাড়ে সাতটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলাম। তখন যে নামটা বলেছিলাম সেটা অবশ্য আমার আসল নাম নয়।’ আদিত্য শান্তস্বরে বলল।
‘আসল নাম নয়?’ সজল নন্দীকে বিভ্রান্ত শোনাচ্ছে। নাকি লোকটা বিভ্রান্ত হওয়ার অভিনয় করছে?
‘না, আমার আসল নাম আদিত্য মজুমদার। আমি পেশায় বেসরকারি গোয়েন্দা। আর ইনি কলকাতা পুলিশের ইন্সপেকটার সুভদ্র মাজি।’
তথ্যটা হজম করতে সজল নন্দী কিছুটা সময় নিল। তারপর সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তা বেশ, তা বেশ। কিন্তু এই গরিবের বাড়িতে আপনাদের মতো মহাত্মাদের পদধূলি কেন পড়ল জানতে পারি কি? সাম্প্রতিক কালে কোনও আইন ভেঙেছি বলে তো মনে পড়ছে না।
‘অবশ্যই জানতে পারেন। না জানলে আমাদের প্রশ্নের জবাব দেবেন কী করে?’ ‘আপনাদের প্রশ্নের জবাব আমি যে দেবই সেটা জানলেন কী করে?’ ‘জবাব না দিলে আপনাকে লালবাজারে তুলে নিয়ে যাব। ওখানে নিয়ে গিয়ে কথা বার করার নানা রকম উপায় আমাদের হাতে আছে।’ সুভদ্র ঠান্ডা গলায় বলল ৷ ‘আমাকে লালবাজারে তুলে নিয়ে যাবেন? আমার অপরাধটা কী? দেশে আইন-টাইন নেই নাকি? তুলে নিয়ে গেলেই হল?’
‘শুনুন, একাধিক কারণে আপনাকে তুলে নিয়ে যাওয়া যায়। আপাতত, একটা কারণ বলছি। আপনি নিশ্চয় জানেন কিছুদিন আগে কানু বলে একজন দাগী আসামী ডাঃ অসীমাভ রায়কে ব্ল্যাকমেল করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। কানু এখনও আমাদের হেফাজতে আছে। পুলিশি হেফাজত থেকে কানু একজনের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিল। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে যে কানু আপনার ফোনেই ফোনটা করেছিল।’
সজল নন্দীকে কি কিছুটা নার্ভাস দেখাচ্ছে? সে উত্তেজিতভাবে বলল, ‘শ্ৰীকৃষ্ণবাবু আমার মক্কেল। উনি একজন সৎ নাগরিক। পুলিশ তাকে ইচ্ছে করে ফাঁসিয়েছে। আমি আমার মক্কেলকে আইনি পরামর্শ দিতেই পারি। শ্রীকৃষ্ণবাবু আইনি পরামর্শের জন্যে আমাকে ফোন করেছিলেন।’
‘আপনি কী করে আইনি পরামর্শ দেবেন? আপনি তো একজন নাম-কাটা উকিল। কারও হয়ে আদালতে দাঁড়ানোর অধিকার তো আপনার আর নেই।’ সুভদ্ৰ আক্রমণাত্মক । ‘এই দুঃসময়ে অন্তত বন্ধু হিসেবে তো আমি শ্রীকৃষ্ণবাবুর পাশে দাঁড়াতে পারি। দু’একটা কথা বলতেই তো পারি তার সঙ্গে।’
সুভদ্র কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আদিত্য তাকে হাত তুলে নিরস্ত করে বলল, ‘নিশ্চয় পারেন। অবশ্যই পারেন। কিন্তু তার মানে আপনি নিজেই স্বীকার করছেন যে কানু আপনার বন্ধু। যেহেতু কানু আপনার বন্ধু, তাই পুলিশ সন্দেহ করছে যে ব্ল্যাকমেলটা আপনারা দু’জনে মিলে করেছেন। ক্রিমিনাল কন্সপিরেসির সন্দেহে পুলিশ আপনাকে তুলে নিয়ে গিয়ে জেরা করতেই তো পারে। তাই না?’
সজল নন্দী চুপ করে আছে। ভাবছে। অনেকক্ষণ চিন্তা করে সে বলল, “ঠিক আছে। আপনারা প্রশ্ন করুন, আমি উত্তর দেব। পুলিশের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছি। বলুন কী জানতে চান।’
আদিত্য মনে মনে ভাবল সজল নন্দী লোকটা যতই ধূর্ত হোক, ফিজিকাল অ্যাসল্টকে নিশ্চয় খুব ভয় পায়। ও জানে তুলে নিয়ে গেলে পুলিশ ওর গায়ে হাত দিতে পারে। সেটাকে ও আটকাতে চাইছে। ও এটাও জানে ও যদি পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে তা হলে পুলিশ ওকে চট করে তুলে নিয়ে যেতে পারবে না। যে সহযোগিতা করছে তাকে জোর করে তুলে নিয়ে গেলে পুলিশেরই বিপদ। তাই আপাতত সহযোগিতা করাটাই ওর বেস্ট স্ট্র্যাটেজি।
‘কানুর প্রসঙ্গে পরে ফিরে আসব। আপাতত আপনাকে একটা অন্য প্রশ্ন করছি। বছর ছয়েক আগে আপনি বনানী দাস বলে এক মহিলার হয়ে মামলা লড়েছিলেন। মনে আছে?’
সজল নন্দী রীতিমত হকচকিয়ে গেছে। সে ভাবেনি, এতদিন পরে বনানী দাসের প্রসঙ্গ কেউ তুলতে পারে। নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে সে বলল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই মনে আছে।’
‘তা হলে আপনার নিশ্চয় এটাও মনে আছে বনানী দাস মামলা করেছিল ডাঃ অসীমাভ রায়ের বিরুদ্ধে যে অসীমাভ রায়কে কানু ব্ল্যাকমেলের চেষ্টা করে ধরা পড়ে গেছে। যে কানু আবার আপনার বন্ধু। এ সবই সমাপতন, কোয়েনসিডেন্স, কি বলুন?’
সজল নন্দী উত্তর দিল না। আদিত্য দেখল কড়া এসি চলা সত্ত্বেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে।
‘আচ্ছা অন্য একটা প্রশ্ন করছি। বনানী দাস সিঙ্গল বেঞ্চে হেরে গিয়ে ডিভিশন বেঞ্চে যেতে চেয়েছিল। হাই কোর্ট পাড়ায় সকলে জানত আপনি তার হয়ে দাঁড়াবেন।
কিন্তু আপনি কেসটা থেকে উইথড্র করলেন। বনানী দাসও আর কেসটা পারসিউ করল না। কেন বলুন তো?’
‘কেন পারসিউ করল না আমি কী করে জানব? হয়ত বনানী বুঝতে পেরেছিল সেটা জেতা যাবে না। বনানী কেসটা পারসিউ করল না বলে আমিও কেসটা থেকে সরে দাঁড়ালাম।’
‘ও তাই বুঝি? আচ্ছা, ওই সময় নাগাদ, মানে যখন বনানী দাস ডিভিশন বেঞ্চে যাবে কিনা ভাবছে, তখন আপনি একটা ইমমরাল কাজে জড়িয়ে পড়ে ওকালতির অধিকার হারান। ইমমরাল কাজটা কী ছিল, সজলবাবু?’
‘আমি কোনও দিন কোনও ইমমরাল বা ইললিগাল কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমার বিরুদ্ধে একটা চক্রান্ত হয়েছিল। আমার কয়েকজন শত্রু চক্রান্ত করে আমার কেরিয়ারটাকেই শেষ করে দিল।’
“ঠিক আছে। মেনে নিলাম আপনি কখনও কোনও ইমমরাল বা ইললিগাল কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু এটা তো ঠিক যে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল আপনি একজন জজসাহেবকে ঘুষ দেবার চেষ্টা করেছেন। এবং অভিযোগটা কোর্টে প্রমাণিতও হয়েছিল।’
‘কোর্টে প্রমাণিত হলেই অভিযোগটা সত্যি হবে এমন কোনও মানে নেই। আপনাকে আমি ভুরি ভুরি উদাহরণ দেখাতে পারি যেখানে অভিযোগ কোর্টে প্রমাণিত হয়েছে কিন্তু আসামী আসলে নির্দোষ। ‘
“ঠিক আছে। এটাও মেনে নিলাম। তবে আপনাকেও মানতে হবে যে ওই ঘটনাটার ফলে ওকালতি করার অধিকার না হারালে আপনি বনানী দাসের কেসটা লড়তেন। আপনি হাইকোর্ট থেকে ডিবার্ড হয়ে গিয়েছিলেন বলেই কেসটা লড়েননি।’
সজল নন্দী উত্তর দিল না। গোঁজ হয়ে বসে রইল।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আদিত্য বলল, ‘আপনাকে অন্য একটা প্রশ্ন করছি। যে কেসটাতে আপনার বিরুদ্ধে জজসাহেবকে ঘুষ দেবার অভিযোগ উঠেছিল সেটা কোন কেস?’
‘ঠিক মনে নেই।’
‘মনে নেই? ঠিক আছে আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। শবনম বলে এক দেহোপজীবিনীর হয়ে আপনি একটা মামলা লড়ছিলেন।অভিযোগ, সেই মামলায় আপনি জজসাহেবকে ঘুষ দেবার চেষ্টা করেছিলেন। মামলাটার ডিটেলটা একটু বলবেন?’
‘আপনি তো দেখছি সবই জানেন। আমি আর কী বলব?’
‘যেটুকু আদালতের রেকর্ডে আছে সেটুকু জানি। সেটা বলছি। এর বাইরে যদি কিছু থাকে আপনি যোগ করে দেবেন। শবনম নামক ওই মহিলা ব্লু ফিল্ম প্রোডিউস করত এবং তাতে নিজে অভিনয়ও করত। এতে তাকে সাহায্য করত কানু ওরফে শ্রীকৃষ্ণ ওরফে অসগর নামক এক ব্যক্তি যে এখন পুলিশের জিম্মায় আছে। পুলিশ এদের ধরেছিল এবং কোর্টে যখন কেসটা চলছিল তখন আপনার বিরুদ্ধে জজসাহেবকে ঘুষ দেবার অভিযোগ ওঠে এবং প্রমাণিত হয়। এদের হয়ে আপনি কয়েকবার দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু কেস শেষ হবার আগেই আপনার ওপর বিধিনিষেধ এসে যায়। বনানী দাসের কেসটার মতো এই কেসটাও আপনি শেষ অব্দি লড়তে পারেননি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত প্রমাণের অভাবে শবনম এবং কানু ছাড়া পেয়ে যায়। এসব তো রেকর্ডেই রয়েছে। সকলেই জানে। যা রেকর্ডে নেই তাই নিয়ে আমার দুটো প্রশ্ন। প্রথম প্রশ্ন হল, যেহেতু একই সময়ে বনানী এবং শবনম আপনার মক্কেল ছিল, তাই আপনার চেম্বারে কি দুজনের দেখা এবং ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল? দ্বিতীয় প্রশ্ন, শবনমের বর্তমান ঠিকানাটা কি আপনি জানেন?’
‘দুঃখিত। আপনার দু’টি প্রশ্নেরই উত্তর আমি জানি না। বনানী এবং শবনম দু’জনেই আমার ক্লায়েন্ট ছিল। কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে দেখা বা ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল কিনা আমি কী করে বলব? দ্বিতীয়ত, শবনমের সঙ্গে বহুদিন আমার যোগাযোগ নেই। অতএব তার বর্তমান ঠিকানাটা আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়।’
‘আপনি কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোঅপরেট করছেন না।’ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর সুভদ্র মাজি মুখ খুলেছে।
‘আমি যেটা জানি না সেটা বলব কী করে? আমি সত্যিই জানি না।’ ‘আমরা যেটা জানি সেটা তা হলে বলি?’ আদিত্য মৃদু স্বরে বলল। সজল নন্দী ঈষৎ উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
‘আমরা জানি, আপনি, শবনম এবং কানু, এই তিনজন মিলে অশনি রায়ের বাবা অসীমাভ রায়কে ব্ল্যাকমেল করার চক্রান্ত করেছিলেন। এর জন্য রূপলেখা দত্ত নাম নিয়ে শবনম অশনির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। এবং সেই বন্ধুত্বের সূত্র ধরে অশনির সঙ্গে নিজের কিছু ইনক্রিমিনেটিং ছবি তোলায়। ছবিগুলো তোলা হয়েছিল নিউ টাউনের একটা নির্জন বাড়িতে যেখানে অন্য সময় ব্লু ফিল্মও শ্যুট করা হতো। পরে সেই ছবিগুলো দেখিয়ে অসীমাভ রায়কে ব্ল্যাকমেলের চেষ্টা করা হয়।’
‘দেখুন, আপনাদের গল্পে কানু যে সরাসরি আসছে সেটা বুঝতে পারছি। কারণ সে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। হয়ত কল্পনার জোরে শবনমকেও আপনারা গল্পে টেনে আনতে পারেন, কারণ আপনাদের গল্পটা দাঁড় করানোর জন্য একটি মহিলা চরিত্র দরকার। কিন্তু এর মধ্যে আমি আসছি কোথায়? এটা ঠিক যে কানু আমার কাছে কিছু পরামর্শ চেয়েছিল। কিন্তু তার থেকে তো এটা প্রমাণ হয় না যে আমি ওই ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিলাম।’ সজল নন্দীর গলা শুনে মনে হল তার আত্মবিশ্বাস বাড়ছে।
‘এখনও তো সব প্রমাণ আপনার সামনে রাখা হয়নি, সজলবাবু। সময় হলেই রাখা হবে। আপাতত আপনাকে জানাই, পুলিশ বনানী দাসের সন্ধান পেয়েছে। বনানী দাস মুখ খুললে আমাদের সাক্ষ্য-প্রমাণ পেতে অসুবিধে হবে না।’
‘পুলিশ বনানী দাসের সন্ধান পেয়েছে? আমি আপনাদের কথা বিশ্বাস করি না।’
‘আমাদের কথা আপনি বিশ্বাস করবেন, না অবিশ্বাস করবেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপাতত ক্রিমিনাল কন্সপিরেসির চার্জে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আপনাকে লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হবে। আমাদের সঙ্গে ওয়ারেন্ট আছে।’ সুভদ্র গম্ভীর পুলিশি গলায় বলল।
(৩)
‘কৃষ্ণনগরের সেন বেকারি থেকে আমরা কিন্তু শেষ অব্দি খুব বেশি কিছু পেলাম না। শুধু আগুন লাগলে তবু ফরেনসিক এক্সপার্টদের কিছু পাওয়ার সম্ভবনা ছিল। কিন্তু আগুন নেভানোর জন্যে দমকল এসে এত জল স্প্রে করেছে যে সমস্ত এভিডেন্স ধুয়ে মুছে গেছে।’ গৌতম চায়ের কাপে একটা চুমুক দিল।
‘প্রণব মাইতি আর পল্লব সেনের কী অবস্থা?’ আদিত্যও চায়ে চুমুক দিল। ‘জামিনে ছাড়া পেয়েছে। তবে ইনশিয়োরেন্স কম্পানি ওদের বিরুদ্ধে কেস করতে খুব একটা উৎসাহ দেখাচ্ছে না। মনে হয় আউট অফ কোর্ট কোনও সেটলমেন্ট হয়েছে। আমরা সুয়ো মোটো একটা ইনটেন্ডেড ফ্রডের কেস করতেই পারি। কিন্তু ইনশিয়োরেন্স কম্পানি যদি কোঅপরেট না করে তা হলে কেসটা দাঁড়াবে না।’
‘তার মানে সেন বেকারি ইনশিয়োরেন্স কম্পানির কাছে কোনও ক্লেম করছে না ।’
‘সম্ভবত না।’
‘তুই সেন বেকারির হিসেবপত্রগুলো দেখেছিস?’
‘আমি নিজে এখনও দেখিনি। আমার ওই অ্যাকাউন্টিং স্টেটমেন্টগুলো দেখলেই মাথা ধরে যায়। সুভদ্রকে দেখতে বলেছিলাম। ও দেখে-টেকে বলল, কম্পানি বেশ লাভ করে। তবে রুটি বিক্রি করে নয়, শাড়ি বিক্রি করে। সেন বেকারি শুধু বাংলার শাড়ি নয়, আসাম-উড়িষ্যা থেকে শাড়ি প্রোকিওর করে ওই গ্লোবাল ট্রেডিংকে বিক্রি করে। আর হ্যাঁ, গ্লোবাল ট্রেডিং-এর পাঁচ বছরের হিসেবপত্র জোগাড় করে রেখেছি। এর জন্যে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। দিল্লির কানেকশান ব্যবহার করতে হয়েছে। ওরা তো ওদের ওয়েবসাইটে হিসেব-টিসেবগুলো দেয় না। তবে দিল্লিতে মিনিস্ট্রি অফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স-এ হিসেবপত্র জমা দিতেই হয়। সেখান থেকে জোগাড় করতে হলো।’
‘আমাকে গ্লোবাল ট্রেডিং-এর হিসেবপত্রের একটা কপি দিয়ে দে। আর সেন বেকারির হিসেবপত্রেরও একটা কপি। আমি ভাল করে দেখব। আচ্ছা, সেন বেকারির ফ্যাক্টরির মধ্যে যে শাড়ির গুদোমটা ছিল সেটা তো অক্ষতই আছে?’
‘হ্যাঁ, সেটা অক্ষতই আছে। যেখানে আগুন লেগেছিল, গুদোমটা তার থেকে অনেকটা দূরে বলে ওই অব্দি আগুন ছড়াতে পারেনি।’
‘আচ্ছা, পশ্চিমবঙ্গে এখন ড্রাগ ট্র্যাফিকিং-এর কী অবস্থা? তুই যে গ্যাংটার কথা বলেছিলি তারা কি এখনও পুরোদমে অপরেট করছে?’
‘পুরোদমে, পুরোদমে। তবে পেরিফেরিতে যে দলগুলো ছিল তাদের মধ্যে একটার অ্যাক্টিভিটি বেড়েছে। ফলে গ্যাং ওয়ারের ইনসিডেন্সও বেড়েছে। আমরা জেরবার হয়ে যাচ্ছি। তোর কথা শুনে ভেবেছিলাম সেন বেকারির কারখানা সার্চ করলে হয়ত একটা লিড পাওয়া যাবে। সেটাও হল না। আসলে কীভাবে ড্রাগটা ডিসট্রিবিউটেড হচ্ছে সেটা ধরতে পারলে কাজ অনেকটা এগিয়ে যেত।’ আদিত্যর মনে হল গৌতম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘তুই আমাকে আর ক’টা দিন সময় দে। আমি তোকে কথা দিচ্ছি একটা কিছু পেয়ে যাব। একটা কথা। সেন বেকারির ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার আগে ওখান থেকে দুটো সুটকেস নিয়ে একটা হালকা নীল, সাদা বা হালকা ছাই রঙের গাড়ি বেরিয়েছিল। আমি নদীয়ার এস পি কে মেসেজ করে রিকোয়েস্ট করেছিলাম যেন গাড়িটাকে পুলিশ ধরে। ওটা কি ধরা পড়েছিল?’
‘না। ওরা বলছে, গাড়িটাকে ওরা ধরতে পারেনি। ঝড়-বৃষ্টির সুযোগ নিয়ে গাড়িটা ওদের হাত থেকে বেরিয়ে গেছে।’
‘আমার কিন্তু মনে হয় লোকাল পুলিশের সঙ্গে সেন বেকারির আনডারস্ট্যানডিং আছে। তাই এস পি-র নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ডিউটিতে থাকা পুলিশ গাড়িটাকে ধরেনি। আমার বিশ্বাস গাড়িটাকে ধরতে পারলে সেন বেকারির বিরুদ্ধে সলিড এভিডেন্স পাওয়া যেত। আচ্ছা, তুই একটু খুঁজে বার করার চেষ্টা কর পাঁউরুটি ভর্তি যে ট্রাকগুলো সেন বেকারির ফ্যাক্টরি থেকে বেরোচ্ছে সেগুলো কোথায় যাচ্ছে। এই রকম একটা-দুটো ট্রাক আটক করতে পারলে খুব ভাল হয়।’
লালবাজার থেকে বেরিয়ে আদিত্য নিজের আপিসে ফিরে এল। দেড়টা বেজে গেছে। আপিসে ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দরজায় টোকা। শ্যামল।
‘আপনার টিপিনটা এনে রেখেছিলাম। আমাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। ষাট টাকা দেবেন।’
শ্যামল আদিত্যর লাঞ্চটা টেবিলে নামিয়ে রাখল। শালপাতার থালায় দু’পিস স্যাঁকা পাঁউরুটি। শালপাতার চৌকো বাটিতে ঘুগনি। সঙ্গে থার্মোকলের প্লেটে কিছু কাটা ফল। পেয়ারা, শসা, পাকা পেঁপে, তরমুজ, কলা। ফলের ওপর একটা টুথপিক গাঁথা আছে।
শরীর খারাপ হবার পর আদিত্য বাড়ি থেকে টিপিন নিয়ে আসে। আজ কেয়া বেরিয়ে যাবার পরে কাজের মাসি ফোন করে জানাল আসতে পারবে না। অগত্যা বাইরের খাবারই ভরসা। লাঞ্চ আনার জন্যে আদিত্য লালবাজার থেকেই শ্যামলকে বলে দিয়েছিল। গৌতমকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হল, না হলে ও সাধারণত আদিত্যকে লাঞ্চ খাইয়ে দেয়।
আদিত্য সেঁকা পাঁউরুটির দিকে তাকিয়ে ছিল। আনস্লাইড্ কোয়াটার পাউন্ড রুটি চার ভাগ করে কাটা ।
‘এটা কোন কম্পানির পাঁউরুটি গো? সেন বেকারি?”
‘পাগল হয়েছেন? সেন বেকারির পাঁউরুটি এখন কুকুর বেড়ালও খাবে না। কিছু পাতাখোর মাতাল হয়ত খায়। তাদের তো আর অত হুঁস থাকে না কী খাচ্ছে। এটা পায়োনিয়ার কম্পানির রুটি। এর ওপরে আর রুটি হয় না। আমাদের জগন্নাথদা বেস্ট রুটি ছাড়া রাখে না।’
‘জগন্নাথ কিন্তু ঘুগনিটাও খাসা বানায়।’ আদিত্য ঘুগনির ঝোলে পাঁউরুটি ডুবিয়ে মুখে তুলল। ‘আচ্ছা ডিলিশাস বলে একটা পাঁউরুটি আছে না? সেটা কেমন?’
‘সেটাও ভাল। তবে ডিলিশিয়াস এদিকে তেমন চলে না। নর্থ ক্যালকাটার দিকে ভাল চলে।’ শ্যামলের জেনারেল নলেজ দেখে আদিত্য মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায়।
সন্ধের ঝোঁকে আদিত্য আপিস বন্ধ করে রাস্তায় বেরোল। গৌতম ভুল বলেনি। সারা দুপুর, সারা বিকেল ওই দুটো কম্পানির হিসেবপত্র পরীক্ষা করতে করতে আদিত্যরও মাথা ধরে গেছে। তাই খোলা হাওয়ায় কিছুটা হাঁটা দরকার। আদিত্য বউবাজার স্ট্রিট ধরে হাঁটছিল। কিছু দিন ধরে কাবলি জুতোটা তলার দিক থেকে খুলে আসছে। সারাব সারাব করেও সারান হচ্ছে না। কলেজ স্ট্রিটে নিশ্চয় একটা মুচি পাওয়া যাবে। আদিত্য কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে পৌঁছে বাঁ দিকে বেঁকল। তার অনুমান সঠিক। মেডিকাল কলেজের সামনে পৌঁছে দেখা গেল একটা মুচি বসে আছে।
“তিরিশ টাকা লাগবে সাহেব। আঠা লাগিয়ে ভালো করে সেলাই করে দেব। আর কোনও দিন ছিঁড়বে না।’
‘কোনও দিন ছিঁড়বে না? ঠিক আছে। তা হলে তাই দাও।’
‘ওই পাটিটা দেখি সাহেব? আরে এটাও তো খুলে আসছে। এটাও করে দিই?’ ‘কোথায় খুলে আসছে?’
‘এই দেখুন না।’ মুচি অন্য পাটিটা ধরে এমন একটা হেঁচকা টান মারল যে নতুন জুতো হলেও খুলে আসত। বলাই বাহুল্য এটাও খুলে এল।
‘ঠিক আছে। এটাও করে দাও তা হলে। দুটো মিলিয়ে কিন্তু পঞ্চাশ টাকা দেব।’ মুচি কিছু বলল না। আদিত্য ধরে নিল তার আপত্তি নেই। এখন আদিত্যর দুটো জুতোই মুচির দখলে।
‘খালি পায়ে রাস্তায় দাঁড়াবেন না সাহেব। আমি আপনাকে চটি দিচ্ছি।’
রবারের এক জোড়া চটি। সেটা এতই ময়লা যে আদিত্যর মনে হল খালি পায়ে দাঁড়ালেই ভাল হতো। রাস্তাটা চটির ভেতরটার থেকে ঢের বেশি পরিষ্কার। উল্টোদিকে একটা রুটি-তরকারির দোকান। লেখা আছে, একটা রুটি চার টাকা, একটা রুটি (তরকারি সহ) পাঁচ টাকা। দুটো লোক স্তূপীকৃত আটা সামনে নিয়ে রুটি বানাতে বসেছে। একটা ধেড়ে ইঁদুর রুটির দোকানের মেঝে থেকে বেরিয়ে বিদ্যুৎগতিতে রাস্তা পার হয়ে ড্রেনের মধ্যে ঢুকে গেল। হঠাৎ দমকা হাওয়া দিচ্ছে। সারাদিন অসহ্য গুমোটের পর ঈশ্বরের উপহার। রাস্তায় খবর কাগজ উড়ছে। প্লাস্টিকের বোতল গড়িয়ে যাচ্ছে।
আদিত্য মুচির চটি পায়ে গলিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে। এখনই বৃষ্টি নামলে মুস্কিল। সঙ্গে ছাতা নেই, অথচ কেয়ার জন্যে একটা শাড়ি কিনতেই হবে। আগামীকাল তাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী। অর্থাৎ ঠিক দু’বছর আগে ওই দিনে তাদের সই করে বিয়ে হয়েছিল। দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে গেল? কী আশ্চর্য !
কেয়া একবার খুব ক্যাজুয়ালি বলেছিল তার একটাও আসাম সিল্ক নেই। কেয়া বলেছিল, যা দাম আসাম সিল্কের, কেনা যায়? আদিত্য ঠিক করেছে কেয়াকে এবার বিবাহবার্ষিকীতে একটা আসাম সিল্ক দেবে। কলেজ স্ট্রিটের মোড় থেকে শাড়িটা কেনা যেতে পারে। কেয়ার পছন্দ হবে তো? কিন্তু কেয়াকে দেখিয়ে কিনতে গেলে সারপ্রাইজ দেওয়া হবে না। তাছাড়া খুব দামী শাড়ি হলে কেয়া আপত্তি করতে পারে। কেয়াকে না জানিয়েই কিনতে হবে। কত দাম আসাম সিল্কের?
আসাম সিল্ক? সেন বেকারি গ্লোবাল ট্রেডিংকে আসাম সিল্ক বিক্রি করে। টাঙ্গাইল, ধনেখালি, মুর্শিদাবাদ সিল্ক ইত্যাদি অন্য শাড়িও বিক্রি করে। গ্লোবাল ট্রেডিং আবার সেই সব শাড়ি নিউ ইয়র্কের একটা কম্পানিকে বিক্রি করে দেয়।
একটা জিনিস আগে খেয়াল হয়নি, এখন এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ খেয়াল হচ্ছে। সেন বেকারির কাছ থেকে কেনা শাড়িগুলো গ্লোবাল ট্রেডিং সর্বদা ওই নিউ ইয়র্কের কম্পানিটাকেই বিক্রি করে। অন্য কোথাও নয়। অথচ অন্য শাড়ি, যেগুলো রাজস্থান থেকে, চেন্নাই থেকে, কর্নাটক থেকে কেনা সেগুলো গ্লোবাল ট্রেডিং অ্যামেরিকার অন্য শহরগুলোতেও বিক্রি করছে। অন্য কম্পানিকেও বিক্রি করছে। লস এঞ্জেলিসে, শিকাগোয়, টেক্সাসে। কিন্তু সেন বেকারির থেকে কেনা শাড়িগুলো শুধু নিউ ইয়র্কের ওই কম্পানিটাতেই বিক্রি হচ্ছে। এটা কেন হবে? অন্য শহরগুলোতে কি আসাম সিল্ক বা বাংলার টাঙ্গাইল-ধনেখালি-মুর্শিদাবাদ সিল্কের চাহিদা নেই? ব্যাপারটা আদিত্যকে ভাবাচ্ছে।
জুতো সারানো হয়ে গেছে। চিন্তামগ্ন পায়ে হাঁটতে হাঁটতে আদিত্য কলেজ স্ট্রিট, মহাত্মা গান্ধী রোডের মোড়ে পৌঁছল। এটা তার পুরোনো মেসের পাড়া। এখানে এলে আদিত্য একটু স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ে। এর পরের আধঘন্টা কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে খুব পুরোনো আর বনেদি একটা শাড়ির দোকানে ঢুকে শাড়ি বাছাই করতে কেটে গেল।
কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে একটা লাল টকটকে আসাম সিল্কের শাড়ি কিনে যখন কাউন্টারে টাকা দেবার জন্য আদিত্য ক্রেডিট কার্ড বার করেছে ঠিক তখনই সে সেন বেকারি এবং গ্লোবাল ট্রেডার্স-এর মধ্যে বেআইনি লেনদেনটা দেখতে পেল। হঠাৎ দেখতে পেয়ে গেল।
বাড়িতে ঢোকার মুখে সুভদ্রর ফোন।
‘খবর আছে, আদিত্যদা।’
‘বাড়িতে ঢুকছি। বাড়িতে ঢুকে তোমাকে ফোন করছি। রাখছি এখন।
বাড়িতে ঢুকে আদিত্য দেখল কেয়া তখনও ফেরেনি। কেয়া বলেছিল ইস্কুলের পরে কোথায় যেন যাবে। আদিত্য মন দিয়ে শোনেনি। ভাবল কেয়াকে ফোন করে জেনে নেবে। কিন্তু তার আগে সুভদ্রকে ফোন করতে হবে। কিন্তু তারও আগে কেয়ার শাড়িটা কোথাও একটা লুকিয়ে রাখা দরকার। কিন্তু সবার আগে এক কাপ কফি।
‘বলো এবার কী বলছিলে।’ আদিত্য কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল। ‘দুটো খবর দেবার ছিল আদিত্যদা। প্রথম খবর হল, শবনম বলে ওই মেয়েটার একটা সম্ভাব্য ঠিকানা পাওয়া গেছে। আমরা একশ শতাংশ নিশ্চিত নই যে এখানেই শবনমকে পাওয়া যাবে, তবে পাবার একটা সম্ভাবনা আছে।’
‘এ তো দারুণ খবর। কোথায় পেলে ঠিকানাটা?”
‘সজল নন্দীর কাছ থেকে পাওয়া গেল। এমনি দেয়নি। থার্ড ডিগ্রির ভয় দেখাতে হয়েছে। তবে থার্ড ডিগ্রি করতে হয়নি। প্রচণ্ড ভিতু লোকটা। একটু ভয় দেখাতেই গড়গড় করে সব বলে দিল।’
‘কী বলল ?”
‘বলল, কোলাঘাটের কাছে বোরোডাঙ্গি বলে একটা গ্রাম আছে। সেই গ্রামে শবনম থাকে। একটা বাগানবাড়িতে। ফুলের ব্যবসা করে। ওখানে গিয়ে ফুল দিদিমনির বাড়ি বললে যে কেউ দেখিয়ে দেবে।’
‘আমাদের ওখানে যেতে হবে। কিন্তু তার আগে একটু খোঁজ খবর নেওয়া দরকার । তুমি কি কাউকে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছ?’
‘এখনও পাঠাইনি। ভাবছিলাম আপনাকে জিজ্ঞেস করে পাঠাব।’
‘না পাঠিয়ে ভাল করেছ। পুলিশ, যত প্লেন ড্রেসেই থাকুক, লোকে ঠিক বুঝতে পারে। আর ছোট্ট জায়গা তো। পুলিশ ঘুরঘুর করলে সব জায়গায় খবর পৌঁছে যাবে। শবনমও জেনে যাবে। তার থেকে আমি বরং বিমলকে পাঠাই। ও ওখানে নেই-হয়ে ঘুরে আসুক। কেউ টের পাবে না। বিমলকে মনে আছে তো?’
‘খুব মনে আছে। আমার একটাই আর্জি। তাড়াতাড়ি বিমলকে দিয়ে খবর আনিয়ে নিন। যাতে যত শিগগির সম্ভব আমরা ওখানে যেতে পারি।’
‘সে তো নিশ্চয়। আমি এক্ষুনি বিমলকে ফোন করছি।’ “ঠিক আছে। রাখছি আদিত্যদা।’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। তুমি বললে না দুটো খবর দেবার আছে? দ্বিতীয় খবরটা কী?’ “ওই দেখুন। ভুলেই গিয়েছিলাম। দ্বিতীয় খবরটা হল, কানা মুমতাজ, কানু যাকে বলেছিল ব্ল্যাকমেলের মূল পাণ্ডা, মাস দুয়েক আগে দুবাইতে মারা গেছে। আমরা দেরিতে খবরটা পেয়েছি। মুমতাজের ক্যান্সার হয়েছিল। দুবাইতে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। মুমতাজ মারা যাবার পর ওর দলটা একেবারে ভেঙে পড়েছে। ইনফাইটিং শুরু হয়েছে। সকলেই বস হতে চায়।’
‘তার মানে কানু জানত কানা মুমতাজের ঘাড়ে দোষ চাপালে কোনও রিপারকাশান হবে না। অর্থাৎ মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য কানু জেনে শুনেই মুমতাজের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছিল। সম্ভবত কানুর খুব ক্লোজ দু’একজন ছাড়া আর কেউ এই ব্ল্যাকমেলের ব্যাপারটায় ইনভলভড নয়।’
‘আমারও ঠিক এটাই মনে হচ্ছে।’
‘একটা কথা। সজল নন্দী এবং কানুকে দূরে দূরে রাখা হচ্ছে তো? কানু যেন কিছুতেই টের না পায় সজলকে পুলিশ ধরেছে।’
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আদিত্যদা। দু’জনকে একেবারে আলাদা জায়গায় রাখা হয়েছে।’
সুভদ্রর নম্বরটা ডিসকানেক্ট করে আদিত্য বিমলের নম্বরটা লাগাল ।
‘রাস্তায় না বাড়িতে?’ ওপার থেকে বিমল সাড়া দেবার পর আদিত্য জিজ্ঞেস করল।
‘এখনও বাড়িতে স্যার। এবার বেরোব।’
‘দু’মিনিট সময় নেব। খুব দরকার।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। দু’মিনিট কেন, দশ মিনিট নিন না। আমার তো সেই আটটা থেকে ডিউটি।’
“ঠিক আছে শোনো। কোলাঘাট জান তো?’
‘জানব না কেন স্যার? আমাদের কম্পানির কৈলাস হালদারের শ্বশুরবাড়ি। গেল বছর আমরা পিকনিক করতে গেছিলাম।’
‘খুব ভাল। ওই কোলাঘাটের কাছে বোরোডাঙ্গি বলে একটা গ্রাম আছে। সেখানে একটা বাগানওয়ালা বাড়িতে একজন মহিলা থাকেন। ফুলের চাষ করেন। ওখানে সবাই তাকে ফুল দিদিমনি বলে। এই মহিলার সম্বন্ধে খবর আনতে হবে। জানতে হবে তিনি এখনও ওখানে থাকেন কিনা। থাকলে, কতক্ষণ বাড়িতে থাকেন। কখনও বেরোন কিনা। তিনি লোক কেমন। কিন্তু খবরদার, ওই মহিলা যেন ঘূণাক্ষরেও জানতে না পারেন তার সম্বন্ধে কেউ খোঁজ নিচ্ছে। পারবে তো খবর আনতে?’
‘কেন পারব না? নিশ্চয় পারব স্যার। কবে আপনার খবরটা দরকার?’ ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কাল হলে কাল। দু’তিন দিনের বেশি অপেক্ষা করতে পারব না।’
‘আমি কাল সকালেই কোলাঘাট চলে যাব। বিকেলের মধ্যে চলে আসব। এসে আপনাকে ফোন করব। আমার ডিউটি তো রাত্তিরে।’
বিমল লাইনটা কেটে দেবার পর আদিত্য ঘড়ির দিকে তাকাল। সাতটা বেজে গেছে। কেয়া এখনও ফিরল না। কেয়া ফিরে এলে এক সঙ্গে চা খাওয়া যেত। একটু খিদেও পেয়েছে।
আদিত্য কেয়াকে ফোন করতে যাচ্ছিল হঠাৎ ফোনটা নিজে থেকে বেজে উঠেছে। একটা নম্বর। অচেনা।
‘হ্যালো।’
‘হ্যালো, আদিত্য মজুমদারের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’ ওপারে পুরুষের গলা। তবে গলার আওয়াজটা পুরুষ আন্দাজে পাতলা।
‘আমি আদিত্য মজুমদার বলছি।’
‘মিঃ মজুমদার, আমার নাম সুপর্ণ ঘোষ। আমি সাউথ এশিয়ান ব্যাঙ্কে নিমগ্ন দাশগুপ্তর কলিগ। নিমগ্নর কাছ থেকে আপনার ফোন নম্বরটা পেয়েছি।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি। বলুন কী দরকার।’
‘মিঃ মজুমদার, দরকারটা তো আমার নয়, আপনার।’ টেলিফোনকারির কণ্ঠস্বরে কিঞ্চিৎ উষ্মা ফুটে উঠল। ‘আপনি জানতে চেয়েছিলেন মৃত্তিকা মিত্রর সঙ্গে অশনি রায়ের পরিচয় ছিল কিনা। আমি বলতে চাই, খুব গভীর পরিচয় ছিল কিনা আমি জানি না কিন্তু জানাশোনা নিশ্চয় ছিল। একটা সময় মৃত্তিকা মিত্রকে প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই আমাদের ব্রাঞ্চে আসতে হতো। সেই সুবাদে জানাশোনা।’
‘এটা আপনি পুলিশকে আগে জানাননি?’
‘অবশ্যই জানিয়েছিলাম। পুলিশ আমাকে সাক্ষী হিসেবে কোর্টে ডেকেও ছিল। কিন্তু অরুণকান্তি ব্যানার্জীর জেরার সামনে আমি দাঁড়াতে পারলাম না।’
‘কেন দাঁড়াতে পারলেন না?’
‘দুটো কারণে। এক, আমি নির্দিষ্টভাবে বলতে পারলাম না ঠিক কবে এবং কোথায় অশনি রায়ের সঙ্গে মৃত্তিকা মিত্রকে কথা বলতে দেখেছি। দুই, অশনি রায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ভাল ছিল না। অশনি রায় আমার বস ছিল এবং আমাকে পছন্দ করত না। ওর জন্যে আমি কিছুতেই প্রোমোশন পাচ্ছিলাম না। এই ব্যাপারটা ব্যাঙ্কে সকলেই জানত। অরুণকান্তি ব্যানার্জী বললেন, আমি ইচ্ছে করে অশনির বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষী দিচ্ছি কারণ অশনির ওপর আমার রাগ আছে। আর অশনি না থাকলে আমার প্রোমোশন পেতেও সুবিধে হবে।’
‘অশনি রায়ের ওপর কি আপনার সত্যিই রাগ ছিল?’
‘ছিল তো বটেই। এখনও আছে। ওর জন্যে আমার কেরিয়ারটা নষ্ট হয়ে গেছে।’ ‘ঠিক আছে, সুপর্ণবাবু। আমাকে ফোন করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।’ ফোনটা ডিসকানেক্ট করে আদিত্য ভাবল সুপর্ণ ঘোষের ব্যাপারটা একটু ক্রস চেক করা দরকার। সে নিমগ্ন দাশগুপ্তর নম্বরটা লাগাল।
‘নিমগ্নবাবু, আদিত্য মজুমদার বলছি। আমি জানি আপনি খুব ব্যস্ত। জাস্ট দু’মিনিট
সময় আপনার কাছে চেয়ে নিচ্ছি।’
‘বলুন, বলুন। এখনও ঘন্টা তিনেক আপিসে থাকতে হবে। তার মধ্যে একটু ব্রেক নিয়ে আপনার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলা যেতেই পারে।’
‘একটু আগে সুপর্ণ ঘোষ বলে একজন আপনার রেফারেন্সে ফোন করেছিলেন। বললেন, অশনি এবং মৃত্তিকা পরস্পরকে চিনত। উনি তার সাক্ষী। আপনি কি সুপর্ণবাবুকে আমার ফোন নম্বরটা দিয়েছিলেন?
ওপারে কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর নিমগ্ন ঘোষের গলা শোনা গেল, ‘আমি সুপর্ণ ঘোষকে আপনার ফোন নম্বর দিইনি। অন্য কয়েকজনকে দিয়েছিলাম তারা যদি বলতে পারে অশনির সঙ্গে মৃত্তিকা মিত্রকে কখনও দেখেছিল কিনা। সুপর্ণ নিশ্চয় তাদের কারোর থেকে আপনার নম্বরটা জোগাড় করেছে। এই সুপর্ণ ঘোষ লোকটি একটি নুইসেন্স। ও কখনও অশনির সঙ্গে মৃত্তিকা মিত্রকে কথা বলতে দেখেছিল কিনা আমি জানি না। কিন্তু এটা জানি যে ও ব্যাঙ্কে কোনও কাজ করে না। তাই সঙ্গত কারণেই অশনি ওকে প্রোমোশন দেয়নি। এই নিয়ে অশনির ওপর ওর প্রবল রাগ। এবং হয়ত সেই কারণেই আউট অফ দি ওয়ে গিয়ে ও অশনির বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিল। ইন ফ্যাক্ট, প্রোমোশন ওর এখনও হয়নি। তার মানে, অশনির জায়গায় পরে যারা এসেছিল তারাও ওর কাজে সন্তুষ্ট ছিল না। সুপর্ণ ঘোষের অবশ্য ধারণা ওর সম্বন্ধে অশনির কনফিডেনশিয়াল রিপোর্ট এত খারাপ ছিল যে পরের লোকেরা তার দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ অশনিই নাকি ওর কেরিয়ারের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আটার বুলশিট।’
‘অনেক ধন্যবাদ নিমগ্নবাবু। আপনি আমার খুব উপকার করলেন। ও একটা কথা। আপনাকে যে বলেছিলাম গ্লোবাল ট্রেডিং-এর অ্যাকাউন্টের পুরোনো ট্রানজাকশন গুলো দেখব, এখন মনে হচ্ছে তার আর প্রয়োজন হবে না। আপনাকে আবার ধন্যবাদ।’
“ঠিক আছে। দরকার হলে ফিল ফ্রি টু কল মি। তা হলে রাখি? বাই।’
প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। কেয়া গেল কোথায়? আদিত্য ফোনটা তুলে কেয়ার নম্বরটা লাগাতে যাবে এমন সময় সদর দরজায় চাবি ঘুরিয়ে ঢোকার শব্দ। কেয়া ফিরে এসেছে।
(৪ )
বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে কেয়া আজ ছুটি নিয়েছে। আদিত্যর তো রোজই ছুটি। সারাদিনের ইটিনারারি কেয়াই ঠিক করেছে। এসব ব্যাপারে আদিত্য দেখেছে কেয়ার হাতে সিদ্ধান্তগুলো ছেড়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে শুধু যে পারিবারিক শান্তিরক্ষা হয় তাই নয়, আখেরে সিদ্ধান্তগুলোও সঠিক হয়।
কেয়া বলে দিয়েছে দুপুরে বাইরে লাঞ্চ খাওয়া হবে কিন্তু রাত্তিরের খাওয়াটা হবে বাড়িতে। শুধুমাত্র আজকের দিনটার জন্য আদিত্য তার পছন্দ অনুযায়ী খাবার অনুমতি পেয়েছে।
দুপুরে কোথায় খেতে যাওয়া হবে তাই নিয়ে ঈষৎ মনোমালিন্য শুরু হয়েছিল। আদিত্য ভেবেছিল কিছুদিন আগে সে আর গৌতম যে নতুন ইটালিয়ান রেস্তোরাঁতে খেতে গিয়েছিল সেখানে কেয়াকে নিয়ে যাবে। ইটালিয়ান রেস্তোরাঁ শুনেই কেয়া বেঁকে বসেছে।
‘আমি ওসব আজেবাজে গেঁড়ি-গুগলি খেতে পারব না।’
ইটালিয়ান রান্নায় গেঁড়ি-গুগলির প্রসঙ্গ কেন এল আদিত্য প্রথমে বুঝতে পারছিল না। পরে মনে পড়ল। কিছুদিন আগে এক এন আর আই বন্ধু আদিত্য আর কেয়াকে একটা পাঁচতারা হোটেলে খাওয়াতে নিয়ে গিয়ে পায়েইয়া নামক স্প্যানিশ পদটি অর্ডার দিয়েছিল যাতে জাফরান মিশ্রিত স্পেনীয় ভাতের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি, স্কুইড এবং মাসেলস দেওয়া ছিল। আদিত্য খুব আহ্লাদ করে সেসব খেয়েছিল, এতটাই তার আহ্লাদ হয়েছিল যে কেয়া খাচ্ছে কিনা সে খেয়ালই করেনি। বাড়ি ফিরে কেয়া তুমুল চেঁচামেচি করে কয়েক গেলাস জল খেয়ে শুয়ে পড়ল। তার নাকি খাওয়াই হয়নি। বলল, সে আর কোনও দিন ওইসব গেঁড়ি-গুগলি খেতে যাবে না।
আদিত্য কেয়াকে কিছুতেই বোঝাতে পারছে না স্পেন এবং ইটালি দু’টি আলাদা দেশ। তাদের খাদ্যাভ্যাস এবং রন্ধন প্রণালীও আলাদা। তাছাড়া ইটালিয়ান রেস্তোরাঁটিতে গেঁড়ি-গুগলি ছাড়াও অনেক কিছু পাওয়া যায়। কেয়ার সেই একটাই কথা। সে আর গেঁড়ি-গুগলি খাবে না ।
‘তা হলে কী খাবে?’ আদিত্য নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করল।
‘কেন? চাইনিজ?’
শুনে আদিত্য বেশ মুষড়ে পড়েছে। এমন বিশেষ একটা দিনে সেই চাইনিজ? আসলে চিনে খাবার খেতে আদিত্যর খুব একটা ভাল লাগে না। কোনও স্বাদের ভেরিয়েশন নেই। সব এক রকম।
অবশেষে আদিত্যর মাথায় একটা মতলব এসেছে। সে বলল, ‘আমরা তা হলে আজ পার্ক স্ট্রিটে চিনে খেতে যাব। ওখানে একটা দোকান হয়েছে যেখানে নাকি বোম্বাইএর ফিল্ম স্টাররা খেতে আসছে।’
খবরটা কিছুদিন আগে কাগজে বেরিয়েছিল। আদিত্য পড়েছে। কেয়াও পড়েছে। পার্ক স্ট্রিটের ওই রেস্তোরাঁতে যাওয়া হবে শুনে কেয়া এক পায়ে খাড়া। আদিত্যর অবশ্য অন্য উদ্দেশ্য। ওই লেখাটাতেই সে পড়েছিল উক্ত রেস্তোরাঁটিতে একেবারে অথেন্টিক পিকিং ডাক পাওয়া যাচ্ছে। পিকিং ডাক-এর কথা আদিত্য বহু জায়গায় পড়েছে, কখনও বস্তুটা চেখে দেখা হয়নি।
খাওয়া ভালই জমল। তবে পিকিং ডাকের সমস্যা হচ্ছে পুরো প্লেট নিতেই হবে।
দু’জনে মিলে একখানা হাঁস খেয়ে ফেলা অসম্ভব। বেশিটাই বাড়ির জন্য প্যাক করে সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হল।
খাওয়া শেষ করে গাড়িতে ওঠার আগে কেয়া বলল, ‘একটা সিনেমা দেখলে হয়।’
আদিত্যরও আপত্তি নেই, কিন্তু অতক্ষণ গাড়ির ভেতরে থাকলে অবশিষ্ট পিকিং ডাক নির্ঘাত পচে যাবে। আদিত্য বলল, ‘তার থেকে বরং বাড়ি ফিরে খাবারটা ফ্রিজে রেখে দিই। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে ইভিনিং শো-এ সিনেমা দেখা যাবে।’
‘ইভিনিং শো-এ সিনেমা গেলে রান্না করবে কে? আজ বরং সিনেমাটা থাক।’ কেয়া ঠিক করে ফেলেছে বাড়ি ফিরে যাবে।
হঠাৎ আদিত্যর মনে পড়ে গেল এ-পাড়ায় একটা কাজ ছিল। সে বলল, ‘হার্টকেয়ার-এ কিছু টাকা বাকি আছে। কিছু কনসিউমেবল আছে যেগুলোর খরচ ইনশিয়োরেন্স কম্পানি দেবে না। আমাকে হার্টকেয়ার থেকে ফোন করে বলল সেগুলোর দাম আমাদের দিতে হবে। এদিকে এলাম যখন টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে যাই।’
‘কত টাকা চাইছে গো?’
‘বলছে পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি। এক্স্যাক্ট অ্যামাউন্টটা ওখানে গেলে বলে দেবে।’
‘টাকাটা কিন্তু আমি দেব। আমি ক্রেডিট কার্ড এনেছি।’
‘তুমি কেন দেবে? আমি দিয়ে দিচ্ছি।’
‘আমাকেই দিতে হবে। ঠনঠনিয়ায় মা কালির কাছে মানত করেছিলাম। বলেছিলাম, আমার স্বামীকে বাঁচিয়ে দাও মা। যা খরচ হয় সব আমি দেব। ঠনঠনিয়াতেও একটা পুজো দিতে হবে। সেটা আমি স্কুল থেকে এসে একদিন দিয়ে দেব। আজ নার্সিং হোমের টাকাটা মিটিয়ে দিয়ে যাই।’ গাড়িতে উঠে কেয়া আদিত্যর গায়ে গা লাগিয়ে বসল।
হার্টকেয়ার খুব বনেদি নার্সিং হোম। বাইরের চেহারাটা পুরোনো, কলোনিয়াল । ভেতরটা সেই কলোনিয়াল স্থাপত্য বজায় রেখেও রীতিমত আধুনিক। সব মিলিয়ে দেখার মতো আর্কিটেকচার। আদিত্য যখন এখানে রুগি হিসেবে ভর্তি ছিল তখন এসব দেখার সময় বা সুযোগ ছিল না। আজ খুঁটিয়ে দেখছে।
রিসেপশনে জিজ্ঞেস করতে বলল অ্যাকাউন্টস সেকশনে যাজ্ঞসেনী মল্লিকের কাছে যেতে হবে। তিনিই বলে দেবেন কী করতে হবে, কোথায় টাকা জমা দিতে হবে। একতলায় কাঁচের দেয়াল ঘেরা অফিস। তার একটা অংশে অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট। এদিক ওদিক জিজ্ঞেস করে অবশেষে যাজ্ঞসেনী মল্লিককে খুঁজে বার করা গেল। বছর চল্লিশের একটি মেয়ে, কিউবিকল-এর মধ্যে বসে একমনে কম্পিউটারে কাজ
করছে।
‘আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম। একটু দেখে বলছি আরও কত টাকা আপনাকে দিতে হবে।’ আদিত্য নিজের নাম এবং উদ্দেশ্য জানাবার পর মেয়েটি বলল।
কম্পিউটারে মেয়েটি আদিত্যর হিসেবটা খুঁজছে। আদিত্য চারদিকে তাকিয়ে দেখল সকলেই মন দিয়ে কাজ করছে। কেউ গল্প করছে না, ফাঁকি দিচ্ছে না। আদিত্য ভাবল, এই হল প্রাইভেট সেক্টর। মিনিট কয়েক পর হিসেবটা খুঁজে পেয়ে মেয়েটি একটা হলদে স্টিক-ইট চিরকুটে একটা সংখ্যা লিখল। তার নিচে আদিত্যর নাম, পেসেন্ট নম্বর, নার্সিং হোমে ভর্তি হবার তারিখ।
‘আপনাকে মোট পঁয়তাল্লিশ হাজার তিনশ নব্বই টাকা দিতে হবে। অ্যামাউন্টটা এখানে লেখা আছে। ক্যাশে গিয়ে আপনি এই কাগজটা দেখান। বলবেন আমি পাঠিয়েছি। ওরা টাকাটা জমা নিয়ে নেবে।’ মেয়েটি আদিত্যর হাতে হলদে চিরকুটটা দিল।
‘ক্রেডিট কার্ডে পে করতে পারব তো?” কেয়া জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ অবশ্যই। আর একটা কথা। টাকাটা দেওয়া হয়ে গেলে ক্যাশ-এর প্রিন্টার থেকে ট্রিপ্লিকেট রিসিট বেরোবে। মানে তিনটে রিসিট, একটা পিঙ্ক কাগজে, একটা সাদা কাগজে, একটা সবুজ কাগজে। সবুজ রিসিটটা ক্যাশ রেখে দেবে। সাদা রিসিটটা আপনার। আর পিঙ্ক রিসিটটা আমার এখানে আসবে। আপনি যদি পিঙ্ক রিসিটটা চেয়ে নিয়ে এখানে আমাকে একটু পৌঁছে দিয়ে যান, আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার কম্পিউটারে এনট্রি করে নেব। তা হলে আপনার অ্যাকাউন্টটাও ক্লোজড হয়ে যাবে। না হলে কী হয়, অনেক সময় এই ভাউচারগুলো দেরি করে আসে। কখনও আবার মিসপ্লেসডও হয়ে যায়। সেরকম হলে আপনার অ্যাকাউন্টটা ঝুলে থাকবে। তাই বলছিলাম হাতে হাতে আমাকে রিসিটটা পৌঁছে দিলে কাজটা হয়ে যায়। আপনাদের অসুবিধে হবে না তো?’
‘না, না। অসুবিধে কীসের?” আদিত্য মনে মনে ভাবল, প্রাইভেট সেক্টরেও তা হলে ভুলভ্রান্তি হয়।
মিনিট দশেক পরে আদিত্য আর কেয়া গোলাপী কাগজটা নিয়ে আবার যখন যাজ্ঞসানী মল্লিকের কাছে ফিরে এল সে তখনও নিবিষ্ট হয়ে কম্পিউটারে কাজ করে যাচ্ছে।
“রিসিটটা নিয়ে এসেছি।’ আদিত্য মৃদু গলায় বলল।
‘ও হ্যাঁ, থাঙ্ক ইউ।’ যাজ্ঞসেনী মল্লিক অনেকক্ষণ আদিত্যর দিয়ে তাকিয়ে আছে।
যেন কিছু বলতে চায় ।
“কিছু বলবেন ?’
‘হ্যাঁ, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। যদি কিছু মনে না করেন, জিজ্ঞেস করতে পারি।’
‘বলুন না। কী জিজ্ঞেস করবেন?’
‘আচ্ছা আপনিই কি গোয়েন্দা আদিত্য মজুমদার ?
‘হ্যাঁ আমিই সেই অধম।’ আদিত্য স্মিত হাসল। ভাবল, এই মেয়েটা নিশ্চয় তার কথা খবর কাগজে পড়েছে। আজকাল তার একটু একটু ফ্যান-ফলোয়িং হচ্ছে। ব্যাপারটাতে আদিত্য একটা ছেলেমানুষী মজা পায়। বিশেষ করে কেয়ার সামনে এই রকম একটা-দুটো ফ্যানের দেখা পেলে বেশ লাগে।
‘আমি কাগজে পড়লাম আপনি মৃত্তিকা মিত্র মার্ডার কেসটা তদন্ত করছেন। ঠিক বলছি তো?’
আদিত্য উপলব্ধি করল এই মেয়েটা ঠিক তার ফ্যান নয়, এর মনে অন্য কোনও প্রশ্ন আছে।
‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলছেন।’ আদিত্য সতর্কভাবে বলল।
‘মৃত্তিকা আমার বন্ধু ছিল। আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম।’ মেয়েটি বিষণ্ণভাবে বলল।
‘কোথায় এক সঙ্গে কাজ করতেন?
“এখানে। এই হার্টকেয়ার নার্সিং হোমে। এদের ব্যবসা ভাল যাচ্ছিল না। পাঁচ-ছ’জন ছাঁটাই হল, তার মধ্যে মৃত্তিকাও ছিল। হঠাৎ একদিন অফিসে এসে শোনে ওর চাকরি নেই। এক মাসের নোটিস। আমাদের ম্যানেজমেন্ট কী ক্রুয়েল ভেবে দেখুন।’ যাজ্ঞসেনী মল্লিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘তারপর?’ আদিত্য খুব মন দিয়ে শুনছে।
‘মৃত্তিকা অনেক দিন বাড়িতে বসে ছিল। তারপর অবশ্য শেষ পর্যন্ত আর একটা চাকরি পেয়ে গেল। ওর স্বামীর জানাশোনা একটা কম্পানিতে। মাইনেও এখানকার থেকে বেশি। আমরা ভাবলাম ভালই হল ওর। কিন্তু তার কয়েক বছর পরে এই রকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে আমরা কেউ স্বপ্নেও ভাবিনি।’
‘আচ্ছা, মৃত্তিকা মিত্র এখানে কী কাজ করতেন?’
‘মৃত্তিকা মেডিকাল রেকর্ডসটা দেখত। কম্পিউটারের ব্যাপারটা ও খুব ভাল বুঝত।’ ‘উনি মানুষ কেমন ছিলেন?’ ‘চমৎকার মানুষ। হাসিখুশি, আড্ডাবাজ। ওর এরকম পরিণতি হবে আমরা কেউ ভাবতেই পারিনি।’
‘এই কম্পানি ছেড়ে যাবার পরেও কি মৃত্তিকার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ ছিল?’ ‘প্রথম প্রথম খুব ছিল। তারপর যা হয়। যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যোগাযোগটা আস্তে আস্তে কমে এল।’
‘চাকরি চলে যাওয়া নিয়ে মৃত্তিকার কি কম্পানির ওপর রাগ ছিল?’ ‘ঠিক রাগ বলব না। একটা অভিমান ছিল। আসলে মৃত্তিকা এত নরম মনের মেয়ে ছিল, ও কারও ওপর রাগ করতে পারত না।’
‘মৃত্তিকার সঙ্গে অন্য যাদের চাকরি চলে গিয়েছিল, তাদের কারও সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে?
‘না, খুব একটা নেই। তারা কোথায় চলে গেছে কে জানে? আসলে এরা কেউই খুব একটা এফিশিয়ন্ট ছিল না। তাই এদের চাকরি যাওয়া নিয়ে অফিসে খুব একটা কথা হয়নি।’
‘মৃত্তিকার চাকরি চলে যাওয়া নিয়ে হয়েছিল?’
‘খানিকটা তো অবশ্যই হয়েছিল। আমি এখনও মনে করি মৃত্তিকার সঙ্গে কম্পানি ভাল ব্যবহার করেনি। ওর মতো এফিশিয়ন্ট একটা মেয়েকে কখনও সরানো উচিত? ওকে সরিয়ে ম্যানেজমেন্ট কিছুদিন পরে ওর জায়গায় যাকে আনল সে নাকি কোনও এক মালিকের আত্মীয়। সেটা হতেই পারে, কিন্তু আমরা জানি সে ভীষণ ইনএফিশিয়ন্ট। শুধু মালিকের আত্মীয় বলে টিকে আছে।’
এইটুকু বলেই যাজ্ঞসেনী মুখে হাত চাপা দিল। দিয়ে বলল, ‘ইশ। আমি খুব বেশি কথা বলে ফেলছি। কেউ শুনে ফেললে চাকরি চলে যাবে।’
আরও দু’একটা কথার পর আদিত্যরা যখন বাইরে বেরিয়ে এল তখন প্রায় চারটে বাজে।
কেয়া তেল-কই রাঁধছে। রেসিপিটা সে কোনও এক রন্ধন পটিয়সীর সাইট থেকে পেয়েছে। ইলিশ ভাপে আগেই হয়ে গেছে। আদিত্য গান শুনছে। নিখিল ব্যানার্জী মালগুঞ্জি বাজাতে শুরু করেছেন। ১৯৮০ সালে মিউনিখে বাজিয়েছিলেন। ইউ টিউব-এ আছে। আদিত্য সেখান থেকে ডাউনলোড করে রেখেছিল। এতদিন ভাল করে শোনা হয়নি ৷ দুটো গান্ধার লাগিয়ে, বাগেশ্রী-রাগেশ্রী মিশিয়ে নিখিল বন্দ্যোপাধায় একটা আশ্চর্য গল্প তৈরি করছিলেন, আদিত্য বুঁদ হয়ে শুনছিল, হঠাৎ ফোনটা বেসুরে বেজে উঠল।
‘বিমল বলছি স্যার।’
‘বল কী খবর পেলে।’ আদিত্য বাজনাটাকে পজে দিয়ে বলল।
‘যা জানতে বলেছিলেন মোটামুটি জেনে এসেছি স্যার।’
‘কী জানলে? কার কাছ থেকে জানলে ?
‘তা হলে প্রথম থেকে গুছিয়ে বলি স্যার?”
‘ঠিক আছে, তাই বল।’ কথাটা বলেই আদিত্য ঘড়ির দিকে তাকাল। ন’টা বাজে। রান্না হয়ে গেলেই কেয়া খেতে বসার জন্যে তাড়া লাগাবে। বিমলের একটু বাজে বকার স্বভাব আছে।
‘সেদিন বললাম না স্যার আমাদের কম্পানির কৈলাস হালদারের শ্বশুরবাড়ি কোলাঘাটে, তো প্রথমে সেখানেই গেলাম। কৈলাসের শালা ছেলেটা খুব ভাল। কলেজ স্ট্রিটের একটা জুতোর দোকানে কাজ করে। ওই পিকনিকের দিন আমার সঙ্গে খুব আলাপ হয়ে গিয়েছিল। ভোরবেলা বেরিয়ে ওকে ধরলাম। আর একটু হলেই কাজে বেরিয়ে যেত। আমি বললাম, একটু দাঁড়াও না। কিছু কথা আছে। ও বলল, দাঁড়ানোর সময় নেই। ন’টা দশের লোকালটা ধরতে হবে। তুমি আমার সঙ্গে স্টেশন অব্দি চল। যেতে যেতে বলবে। আমি আর কী করি? ওর সঙ্গে আবার হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন অব্দি চললাম।’
আদিত্য ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছিল। বলল, “ওইসব ভনিতা ছেড়ে আসল কথাটা বল না।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বলছি। স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ওকে বললাম, আমার এক বন্ধু ফুলের ব্যবসা করে। গড়িয়ায় দোকান। পুজো-পরবের দিনে, যখন ফুলের বিক্রি খুব বেড়ে যায়, আমিও ওর সঙ্গে হাত লাগিয়ে ফুল বিক্রি করি। বুঝতেই তো পারছ কম্পানি যা মাইনে দেয় তাতে চলে না। তা ভাবছি, পাকাপাকিভাবে আমার ওই বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারি করে ফুলের ব্যবসায় নামব। আমার তো রাত্তিরে ডিউটি, সকালটা ফাঁকাই থাকে। আর ফুল বিক্রি তো সকালেই হয়। কৈলাসের শালা বলল, তা এসব কথা আমাকে বলছ কেন? আমি বললুম, শুনেছি এখানে বোরোডাঙ্গি গ্রামে এক ফুল দিদিমনি আছে। ওখানে নাকি তার মস্ত ফুলের বাগান। হাওড়ার জগন্নাথ ঘাটে তার ফুলের খুব সুনাম। সেখান থেকেই নামটা শুনে এলুম। সরাসরি তার কাছে যাবার আগে ভাবলুম তোমাকে একবার জিজ্ঞেস করি। আমি যদি ওকে গিয়ে বলি আপনার বাগান থেকে ফুল কিনতে চাই, উনি রাজি হবেন?’
কেয়া ঘরে ঢুকেছে। বলল, “খাবার রেডি। আমি টেবিল সাজাচ্ছি। ফোন রেখে এবার খেতে এস। খাবারগুলো ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর খাওয়া যাবে না।’
‘আর পাঁচ মিনিট দাও। কথাটা সেরে নিই।’ আদিত্য মুখটা করুণ করে বলল। ‘ঠিক আছে। আমি টেবিল সাজিয়ে চান করতে যাচ্ছি। তার মধ্যে ফোন সেরে নাও।’
আদিত্যকে কেয়ার সঙ্গে কথা বলতে শুনে বিমল চুপ করে গিয়েছিল। কেয়া ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর আদিত্য আবার কথাবার্তা শুরু করার জন্যে বলল, ‘তারপর ?’
‘আমার কথা শুনে কৈলাসের শালা কিছুক্ষণ গুম মেরে রইল। তারপর বলল, শোনো, ওই ফুল দিদিমনির কথা আমি জানি। ওখানে তোমার সুবিধে হবে না। কেন হবে না? আমি জিজ্ঞেস করলুম। সে বলল, আমি অত কারণ-টারণ বলতে পারব না। শুধু এইটুকু বলতে পারি এদিককার দু’একজন ওখানে ফুল কিনতে গিয়ে গলাধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছে। ওই আমার ট্রেন আসছে। আমি চললুম। এই কথা বলে কৈলাসের শালা ট্রেনে উঠে গেল। আমি বোকার মতো প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইলুম।’
‘তারপর কী করলে? ফিরে এলে?”
‘না, না। ফিরে আসব কেন? আমি কি অত সহজে ছেড়ে দেবার লোক? একে ওকে জিজ্ঞেস করে ওই ফুল দিদিমনির বাগানবাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম। মস্ত বড় বাগান। পুরোটা উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। ভেতরে কী আছে বাইরে থেকে দেখার জো নেই। গেটে ষণ্ডামার্কা একজন দরোয়ান বসে আছে। তাকে বললুম, ভাই এখান থেকে কি ফুল কেনা যায়? লোকটাকে চোখে দেখে যতটা রুক্ষ-স্বভাবের মনে হয়েছিল, আসলে সে ততটা খেঁচুটে নয়। আমাকে ভালভাবেই বলল, এখান থেকে ফুল বিক্রি হয় না। নিউ মার্কেটের এক ব্যবসায়ী পুরো বাগানটার ইজারা নিয়ে নিয়েছে। যা ফুল হয় সে-ই ট্রাকে করে নিয়ে যায়। তার মানে ওখানকার ফুল জগন্নাথ ঘাটে যায়ই না। ভাগ্যিস লোকটাকে জগন্নাথ ঘাটের ঢপটা দিইনি। যাই হোক এর পরে তো আর কিছু বলার থাকে না। আমি মাথা নিচু করে চলে এলুম।
‘কোথায় চলে এলে? কলকাতায় ? ‘
‘না, না। ওই বাগানবাড়ির গেটের সামনে থেকে চলে এলুম। উল্টোদিকে একটা চায়ের দোকান। ভাবলুম কলকাতায় ফিরে যাবার আগে এক কাপ চা খেয়ে যাই। আমার ভাগ্য ভাল চায়ের দোকানিটা খুব গল্পে। ওই সময় দোকানে খুব একটা ভিড়ও নেই। দোকানিটা আমাকে দেখে বলল, আপনাকে তো আগে এদিকে দেখিনি। নতুন এলেন নাকি। আমিও সুযোগ পেয়ে আমার ফুল কেনার গল্পটা ওকে খাইয়ে দিলাম। ও বলল, আরে বাবা আপনি একেবারে ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন। আমরা গেরামের লোকেরা জানিই না ওই বাগানের ভেতরে কী হয়। বাড়িটা অনেকদিন খালি পড়েছিল। ঝোপ-জঙ্গল হয়ে গিয়েছিল। তখন পাঁচিল টপকে লোকে ওখানে হাগতে যেত। বছর দু’তিন আগে ওই মেয়েছেলেটা বাগানবাড়ি কিনে, জঙ্গল সাফ করে, নতুন পাঁচিল তুলে ওখানে ফুলের চাষ শুরু করে। কিন্তু গেরাম থেকে কাউকে কাজ দেয়নি। বাইরে থেকে মালি এনেছিল। মালিগুলো ভেতরেই থাকে। মেয়েছেলেটাও কারও সঙ্গে মেশে না। বাইরেই বেরোয় না। তবে পার্টিকে মোটা চাঁদা দেয় বলে ওকে কেউ ঘাঁটাতে সাহস পায় না। বাইরের কেউ ওখানে আসে না? আমি জিজ্ঞেস করলুম। দোকানি বলল, ওই সপ্তাহে একদিন ট্রাক এসে ফুল নিয়ে যায়। আর মাঝে মাঝে সিনেমা পার্টি শুটিং করতে আসে। আমি বললাম, আরেব্বাবা। এখানে সিনেমার শুটিং হয়? স্টাররা আসে? দোকানি বলল, ধুস! যারা আসে তারা গাড়ির কালো কাঁচ তুলে আসে। আমরা দেখতেই পাই না, কে আসছে যাচ্ছে। তবে ওই ম্যাটাডরে ক্যামেরা-ট্যামেরা এলে দেখা যায়। আর হ্যাঁ। একা একটা লোক মাঝে মাঝে গাড়ি নিয়ে আসে।’
‘ওকি? তুমি এখনও ফোন নিয়ে বসে আছ? রাখ, এবার ফোনটা রাখ। কেয়া চান করে এসেছে।
‘এক মিনিট। এক্ষুনি রেখে দিচ্ছি।’ আদিত্য মোবাইল মুখ থেকে নামিয়ে কেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল। তারপর আবার মোবাইল কানে দিয়ে বলল, “আর কি কিছু বলার আছে তোমার?’
‘নাঃ। মোটামুটি এইটুকুই।’
‘ঠিক আছে। আমার এতেই কাজ হবে। শুধু আর একটা জিনিস তোমায় করতে হবে। তিরুপতি গার্ডস-এর চাকরিটা ছেড়ে দেবার সময় সোমনাথ ম্যানেজারকে বলেছিল আমার পাওনা টাকাটা আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দেবেন। মনে আছে, এটা তুমিই আমাকে বলেছিলে?’
‘মনে আছে স্যার।’
‘আমাকে ওই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ডিটেলটা জোগাড় করে দিতে হবে।
‘এটা মনে হয় পেরে যাব স্যার।’
‘এবার দয়া করে ফোনটা রাখ।’ কেয়া বেজায় ক্ষেপে গেছে।
‘রাখছি, রাখছি। আর একটা ফোন করব। দু’মিনিট লাগবে। তুমি ভাতটা মাইক্রোতে দাও।’ আদিত্য বিমলের ফোনটা কেটে দিয়ে সুভদ্রর নম্বরটা লাগাল ৷
‘বলুন আদিত্যদা।’ সুভদ্রর গলা শুনে মনে হল সে খুশমেজাজে আছে। ‘একটা কাজ করে দিতে হবে। তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে ঘটনার একটা কালানুক্রমিক তালিকা পাঠিয়েছি। যাকে বলে ক্রোনোলজি অফ ইভেন্টস। প্রত্যেকটা ঘটনার পাশে সেই ঘটনার মাস এবং বছরটা বসাতে হবে। এর জন্যে একটু দৌড়োদৌড়ি করতে হতে পারে। হয়ত দু’একজন লোকও এনগেজ করতে হবে। এই কাজটা খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। এর জন্য তোমাকে আমি দু’দিন সময় দিলাম।’