মৃত্তিকার মৃত্যু – ৩

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

(১)

গত দু-তিন দিন ধরে আদিত্যর মনে হচ্ছে কে যেন তার ওপর নজর রাখছে। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। যখন সে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটছে তখন এই অনুভূতিটা হচ্ছে না। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে চলতে চলতে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিচ্ছে তাকে অনুসরণ করে কেউ পেছন পেছন আসছে। আদিত্যর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বহুবার তাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে, কয়েকবার একেবারে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে। তাই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র সাবধান বাণী সে উপেক্ষা করতে পারে না। তাছাড়া একবার-দু’বার নয়, গত দু-তিন দিনে বেশ কয়েকবার এইরকম ঘটেছে। কিন্তু, কী আশ্চর্য, যখনই সে ভিড়ের রাস্তা থেকে ফাঁকা রাস্তায় পৌঁছে যাচ্ছে, তখনই মনে হচ্ছে সেই অদৃশ্য চোখ-জোড়া আর তার পেছনে নেই ।

এমন কি হতে পারে যে তাকে অনুসরণ করছে সে নিজেকে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে চায়? ফাঁকা রাস্তায় পেছন পেছন এলে আদিত্য তাকে দেখে ফেলবে এটা সে এড়াতে চাইছে? কিন্তু এরকম অনুসরণ করে লাভ কি? আদিত্য যে মুহূর্তে ভিড় থেকে নির্জনে আসছে সেই মুহূর্তে সেই লোকটাকে অনুসরণ থামিয়ে দিতে হচ্ছে। আদিত্য ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না। অবশ্য এটা হতে পারে, কেউ তাকে অনুসরণই করছে না, সবই তার মনের ভুল। কিন্তু আদিত্যর স্থির বিশ্বাস তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে ভুল সংকেত দেবে না।

আজকাল কেয়া কোনও দিনই আটটার আগে ফিরতে পারে না। কেয়া বাড়িতে না থাকলে আদিত্যরও বাড়ি ফিরতে ভাল লাগে না। তাই সে একটু দেরি করে আপিস থেকে বেরিয়ে কলেজ স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফেরে। হাঁটতে হাঁটতে নানা কিছু চিন্তা করে। কখনও কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইএর দোকানে কিছুটা সময় কাটায়, কখনও কোনও অখ্যাত চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে রাস্তায় মানুষজনের যাতায়াত দ্যাখে। যে রাস্তা দিয়ে আদিত্য হাঁটতে হাঁটতে ফেরে তার বেশিরভাগটাই জনাকীর্ণ। এই জনাকীর্ণ অঞ্চল দিয়ে হাঁটার সময় সে টের পাচ্ছে কেউ তার ওপর নজর রাখছে। তারপর যেই সে কলেজ স্ট্রিট পেরিয়ে আরও উত্তর দিকে আসছে, রাস্তায় লোকজনের যাতায়াত কমে আসছে, সে অনুভব করছে নজরদারি করা চোখ-জোড়া আর তার পেছনে নেই। আদিত্য মহা মুস্কিলে পড়েছে।

অবশেষে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। সেদিন সন্ধে সাড়ে ছটা নাগাদ তার আপিস থেকে বেরিয়ে আদিত্য যখন বউবাজার স্ট্রিটের ভিড় ঠেলে পুব দিকে হাঁটছিল তখন হঠাৎ হলুদ চুড়িদার পরা একটি অল্পবয়সী শ্যামলা মেয়ে ভিড়ের ধাক্কায় আদিত্যর গায়ের ওপর এসে পড়ল। সরি বলে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যাবার আগে মেয়েটি একটা মুখবন্ধ খাম আদিত্যর হাতে গুঁজে দিয়েছে। এই ক’টা দিন ভেবে ভেবে আদিত্য যে ব্যাখ্যাটা দাঁড় করিয়েছিল, মনে হচ্ছে সেটাই ঠিক। কোনও কারণে এই মেয়েটি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে, কিন্তু খোলাখুলি নয়, লুকিয়ে-চুরিয়ে, গোপনে। নিশ্চয় মেয়েটির ওপর কেউ নজর রাখছে। আদিত্যর সঙ্গে সে যোগাযোগ করেছে জানাজানি হয়ে গেলে মেয়েটি নিশ্চয় আশঙ্কা করছে তার ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই কোনও রকমে আদিত্যর হাতে খাম গুঁজে দিয়ে পালিয়ে গেছে। এটাও বোঝা যাচ্ছে, মেয়েটি এই কাজে খুব পটু নয়। কয়েকটা দিন চেষ্টা করার পরে আজ সফল হয়েছে।

বাড়ি ফিরে আদিত্য দেখল কেয়া তখনও ফেরেনি। ইলেকট্রিক কেটলিতে কফির জল গরম করতে দিয়ে সে পড়ার টেবিলে বসে খামটা খুলল। ভেতরে একটা ছোট্ট চিরকুট। তাতে মেয়েলি হাতের লেখায় লেখা রয়েছে – আপনার সঙ্গে আমার ভীষণ দরকার। দরকারটা যতটা আমার হয়ত তার থেকেও বেশি আপনার। আজ রাত ন’টার পরে আমার হোয়াট্সঅ্যাপ নম্বরে একটা ফোন করুন প্লিজ। এর নিচে একটা নম্বর দেওয়া আছে।

নটা বাজতে এখনও দেরি আছে। আজ সকাল থেকে খবর কাগজটা ভাল করে পড়া হয়নি। আদিত্য কফি খেতে খেতে ইন্টারনেটে খবর দেখছিল। পাতা জুড়ে নেতাদের রাজনৈতিক তরজা, ভারত-চিনের পারস্পরিক আস্ফালন, পেট্রলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আশঙ্কা, ইয়োরোপীয় ফুটবলে এ-বছর কে চ্যাম্পিয়ান হবে তাই নিয়ে জল্পনা। স্ক্রোল ডাউন করতে করতে একটা খবরে আদিত্যর চোখ আটকে গেল। প্রতিবেদক লিখছেন, পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং অল্প-বয়সীদের মধ্যে মাদকের ব্যবহার খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। দু’টি নার্সিং হোম আলাদা করে জানিয়েছে যে অতিরিক্ত মাদক ব্যবহারের ফলে অসুস্থ রুগির সংখ্যা গত ছ’সাত মাসে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কলকাতা ও মফস্বলের তিনটি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার জানাচ্ছে, তাদের চাহিদা ইদানীং এত বেড়ে গেছে যে সবাইকে তারা জায়গা দিতে পারছে না। পুলিশ দু’একটা চুনোপুঁটি মাদক বিক্রেতাকে ধরতে পেরেছে। কিন্তু ওপর থেকে যারা চক্রটা চালাচ্ছে তাদের হদিশ পায়নি। বিশেষ করে কীভাবে মাদকগুলো সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে সে ব্যাপারে পুলিশ এখনও সম্পূর্ণ অন্ধকারে।

বৃষ্টি নেমেছিল, আদিত্য টেরই পায়নি। আটটার একটু পরে কেয়া বৃষ্টি মাথায় ফিরে এল। চুলে-কপালে জলের ফোঁটা চিকচিক করছে।

ভিজে শাড়ি-জামা বাথরুমে ছেড়ে রেখে শায়া আর ব্রেশিয়ার পরে কেয়া রান্নাঘরে ঢুকল। কফির জল বসাতে বসাতে বলল, ‘আমি কিন্তু এবার একটা গাড়ি কিনছি।

রোজ ফেরার সময় এই উবার নিয়ে অশান্তি আর ভাল লাগে না। আজ তো উবার পেলামই না। হলদে ট্যাক্সি নিতে হল। লোকটা বলে কিনা গলিতে ঢুকবে না। বড় রাস্তায় ছেড়ে দিতে হবে। আমি বললাম এই বৃষ্টির মধ্যে আমি যাব কী করে? আমার সঙ্গে তো ছাতা নেই। শেষে পঞ্চাশ টাকা আরও এক্সট্রা দিতে বাড়ি অব্দি এল। ভাবতে পার?’

কেয়া আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল কিন্তু আদিত্য শুনছিল না। সে লুকিয়ে লুকিয়ে কেয়ার শরীরটা দেখছিল। কেয়া যেন পরস্ত্রী। কেয়া যেন জানলায় বসে থাকা রাজকন্যা আর সে রাখাল বালক। কাঙাল চোখ দুটো ছাড়া তার আর কিছু নেই। এমন কি বাঁশের বাঁশিটাও হারিয়ে গেছে। আছে শুধু দুটো চোখ। ভিখিরির মতো দুটো চোখ কেয়ার শরীরটাকে দেখছে। কিন্তু এখন তো সময় নয়। তাছাড়া কেয়ার মেজাজটাও ভাল নেই। এখন ওসব দিকে এগোতে গেলে ধমক খেতে হবে। আদিত্য জোর করে কম্পিউটারের খবরে মন দিল।

‘কী, বললে না তো?’ কেয়া শোবার ঘর থেকে অন্তর্বাস ছেড়ে বাড়ির পোশাক পরে এসেছে। দু’কাপ কফি নিয়ে সে আদিত্যর পাশে এসে বসল ।

‘কী বলব?’ আদিত্য নিরীহ গলায় বলল। যেন ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানে না ।

‘আমার অর্ধেক কথা তোমার কানে ঢোকে না, এটাই তোমার সব থেকে বড় প্রবলেম। কী অত ভাব কে জানে। তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম কবে তুমি আমাকে একটা গাড়ি কিনিয়ে দিতে পারবে?’

‘ঠিক করেছ কী গাড়ি কিনবে?’

‘সেদিন তো কথা হয়েই গেল মারুতি কিনব। তুমিই তো বললে মারুতির সার্ভিস সব থেকে সহজে পাওয়া যাবে।’

‘ঠিক আছে। চল তাহলে একদিন মারুতির শো রুমে। বিবাদী বাগে একটা আছে। আমার আপিসের কাছে। ওখানেই যাওয়া যাক।’

‘কবে যাবে?’

‘আমি তো রোজই ফ্রি। তুমি কবে যেতে পারবে?’

‘সামনের বুধবার একটা ছুটি আছে। আমাদের স্কুলের ফাউন্ডেশন ডে। বুধবার যাবে?’

‘যেতেই পারি। তবে গাড়ি কেনার আগে ভাবতে হবে গাড়িটা থাকবে কোথায়। সেটা কিছু ভেবেছ?’

‘ভেবেছি। দুটো অলটারনেটিভ আছে। আমাদের পাড়ার অনেকে তো রাস্তাতেই গাড়ি রাখে। আমরাও রাখতে পারি। নাইটগার্ডকে একটু পয়সা দিলে ও রাত্তিরবেলা গাড়িটার ওপর নজর রাখবে। অবশ্য একদম খোলা যায়গায় রাখা তো। একটা কভার পরিয়ে রাখতে হবে।’

‘আর অন্য অলটারনেটিভ?’

‘আমাদের বাড়ির উল্টো ফুটপাথে একটা মোটর গ্যারেজ আছে দেখেছ? ওখানে রাখা যায়। আমি কথা বলেছি। মাসে তিন হাজার টাকা নেবে। মাথার ওপর একটা ছাউনি থাকবে।’

‘ফ্লিপ সাইডগুলো ভেবে দেখেছ? মোটর গ্যারেজে রাখলে তেল চুরি হতে পারে। আর রাস্তায় রাখাটা তো সম্পূর্ণ বেআইনি।’

‘তোমার মুস্কিল হচ্ছে কোনও ভাল কাজে উৎসাহ দিতে পার না, শুধু ব্যাগড়া দাও। তেল চুরি হোক, বেআইনি হোক, যাই হোক, গাড়ি আমি কিনছি। কেয়া বেশ রেগে গেছে।

‘না, না। সে তো কিনবেই। আমি শুধু সমস্যাগুলোর কথাও মাথায় রাখতে বলছি। আচ্ছা গাড়িটা চালাবে কে? আমি মাঝে-সাঝে চালাতে পারি। কিন্তু তোমার রোজকার আসা-যাওয়ার ভার নিতে পারব কি? সকালে হয়ত তোমাকে পৌঁছে দিতে পারব। কিন্তু সন্ধেবেলাটা আমার কী কাজ পড়বে আমি নিজেই জানি না।’

‘তোমাকে আমার পৌঁছনোর ভার নিতে হবে না। আমি সৌমিত্রর সঙ্গে কথা বলেছি। ও আমার গাড়ি চালাতে রাজি আছে।’

‘সৌমিত্র আবার কে? ‘

‘সৌমিত্রকে ভুলে গেলে? আশ্চর্য লোক বাবা! এইরকম মেমরি নিয়ে তুমি আবার গোয়েন্দাগিরি কর!’ কেয়া হাত উলটে হতাশার ভঙ্গী করল।

আদিত্যর মনে হল সৌমিত্রকে ভুলে গিয়ে সে একটা বড় ধরনের অন্যায় করে ফেলেছে। সে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘একবার একটু ধরিয়ে দাও না। তাহলেই মনে পড়ে যাবে।’

‘সৌমিত্র, মানে সৌমিত্র কর্মকার। আমি গাড়ি ভাড়া করলে যে ছেলেটা গাড়ি নিয়ে আসে।’

‘ওর নাম সৌমিত্র নাকি? তুমি তো আগে কখনও বলনি? তুমি তো ওকে গোপু বলে ডাকতে, আর ও তো তাতেই সাড়া দিত।’

‘ওই গোপুরই ভাল নাম সৌমিত্র। সৌমিত্র কর্মকার। ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স-এ ভাল নামটাই লেখা আছে।’

‘সেটা আমি কী করে জানব? আমি কি ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখেছি?’

‘আমি তোমাকে ওর ভাল নামটা বলিনি? নিশ্চয় বলেছি।’ কেয়া হার মানার পাত্রী নয়।

‘হয়ত বলেছ, আমার মনে নেই। কিন্তু ওসব কথা ছাড়। ও কি ওর মালিকের চাকরি ছেড়ে তোমার গাড়ি চালাবে বলেছে?’

‘বলেছে।’

‘কত নেবে কিছু বলেছে?’

‘চোদ্দ বলেছিল। আমি বললাম বারো। শেষে তেরোতে রফা হয়েছে। ‘ঠিকই আছে। ওর কমে আর কী হবে? তাহলে চল বুধবার গিয়ে দেখা যাক।’

ঘড়িতে যখন ঠিক ন’টা পনের বেজেছে, আদিত্য চিরকুটে দেওয়া নম্বরটা তার মোবাইলে সেভ করল। তারপর হোয়াট্সঅ্যাপে গিয়ে নম্বরটা ডায়াল করল। ধরে নেওয়া যায়, মেয়েটি অতিরিক্ত সাবধান। না হলে সে আদিত্যকে হোয়াট্সঅ্যাপে ফোন করতে বলত না। হোয়াট্সঅ্যাপে ফোন করলে আড়ি পাতা যায় না।

‘হ্যালো?” ওপার থেকে একটা স্বাভাবিক মেয়েলি গলা শোনা গেল। ‘আমি আদিত্য মজুমদার বলছি।’

‘আদিত্যবাবু?” মেয়েটির গলায় উত্তেজনা। গলার আওয়াজ কয়েক পর্দা নেমে গেছে। হয়ত আশেপাশে কেউ আছে যাকে এই কথোপকথন মেয়েটি শুনতে দিতে চায় না।

‘হ্যাঁ, আমি আদিত্য মজুমদার বলছি। আপনি আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন।’ ‘একটু ধরবেন? আমি আগে ছাতে চলে যাই। ওখান থেকে কথা বলতে সুবিধে হবে।’

আদিত্য ফোন ধরে রয়েছে। মিনিট দুয়েক কেটে গেল। আদিত্যর বিরক্ত লাগছে। খিদেও পাচ্ছে। সে আড়চোখে দেখল কেয়া টেবিলে ডিনার সাজাচ্ছে।

‘আদিত্যবাবু?’ আবার মেয়েটির গলা। এবার অনেক স্পষ্ট।

‘হ্যাঁ, বলুন। আমি লাইনে রয়েছি।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলছি। আসলে কী ভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না।’ ‘আপনার নাম কী? কী করেন?’

‘আমার নাম মিতা অধিকারী। আমি গ্লোবাল ট্রেডিং এজেন্সি বলে একটা কম্পানিতে কাজ করি। আমাদের কম্পানি মূলত শাড়ি এক্সপোর্ট করে। আমি প্রোকিওরমেন্টে আছি। মানে আমার কাজ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে শাড়ি কেনা। তাঁতিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা।’

‘তা আমাকে হঠাৎ আপনার দরকার পড়ল কেন?’

‘বলছি, বলছি। এর আগে আমি দারুচিনি বলে একটা শাড়ির বুটিকে কাজ করতাম । কলকাতায় দারুচিনি-র চার-পাঁচটা আউটলেট আছে। পুরো স্টকটাই লোকালি বিক্রি হয়। এক্সপোর্ট হয় না। হেড অফিসটা সল্ট লেকে। ওখানেও আমি প্রোকিয়োরমেন্টের কাজ করতাম। মানে ওই তাঁতিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে শাড়ি কেনার কাজ। ঘোরাঘুরি করতে হত। তবে দরকার পড়লে রিটেল আউটলেটগুলোতেও বসতে হত। আবার মাঝে-মাঝে ব্যাঙ্কেও যেতে হতো। ছোট কম্পানি তো। খুব বেশি লোক নেই। তাই অনেক রকম কাজ করতে হতো।’

‘আমি কিন্তু এখনও বুঝতে পারছি না এসবের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?’ আদিত্য অধর্য্য হয়ে পড়ছে। তার খিদেটা বাড়ছে।

‘এক্ষুনি বুঝতে পারবেন। আমাকে একটু সময় দিন প্লিজ।’ মিতা অধিকারী কাতরভাবে বলল। ‘দারুচিনি-র ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল সল্ট লেকেরই একটা ব্যাঙ্কে, ওখান থেকে কিছু লোনও নেওয়া হয়েছিল। ওই ব্যাঙ্কের ক্রেডিট ডিপার্টমেন্টের হেড ছিলেন অশনি রায়। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন কেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি?’

মিতা অধিকারী একটু থামল। জিরিয়ে নিচ্ছে। আদিত্যর খিদে নিমেষে উধাও হয়ে গেছে।

‘দারুচিনি-র কাজে আমাকে মাঝে-মাঝেই ওই ব্যাঙ্কে যেতে হতো। অশনি রায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হতো। রায়সাহেবের সঙ্গে বেশ ভালই একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। একদিন একটা কাজে রায়সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেছি, কাজ শেষ হবার পর রায়সাহেব বললেন, আপনাদের বুটিক থেকে একটা শাড়ি কিনতে চাই। আমার বান্ধবীকে জন্মদিনে প্রেজেন্ট করব। জিনিসটা একটু এক্সক্লুসিভ হতে হবে। আমি বললাম সেলস পারসন হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা হল, শাড়ি পছন্দের ব্যাপারটা ভীষণ সাবজেক্টিভ। আপনার যে শাড়িটা এক্সক্লুসিভ মনে হচ্ছে আর একজনের সেটাকেই খুব খারাপ দেখতে মনে হতে পারে। তাই সব থেকে ভাল হয় আপনি যদি আপনার বান্ধবীকে নিয়ে আমাদের শর্ট স্ট্রিটের দোকানে চলে আসেন। ওখানেই স্টক সব থেকে ভাল। আমি নিজে উপস্থিত থেকে আপনাকে শাড়ি কিনিয়ে দেব।’

‘উনি বান্ধবীকে নিয়ে এলেন?’

‘একবার নয়। আমার যতদূর মনে পড়ছে মোট তিন-চারবার উনি বান্ধবীকে নিয়ে দারুচিনি-র শর্ট স্ট্রিট রিটেল আউটলেটে এসেছিলেন। খুব দামী কয়েকটা শাড়ি কিনেছিলেন।

‘অশনি রায়ের বান্ধবীকে আপনার মনে আছে?’

‘একটু একটু মনে আছে। ঈষৎ চাপা রঙ। চোখ সর্বদা কালো চশমায় ঢাকা থাকত ৷ মুখের আধখানা ঢাকা থাকত ওড়নায়। ওঁর নাকি রোদ্দুরে এলার্জি ছিল। আমি ভাবতাম, দোকানের ভেতরে রোদ্দুর কোথায়? এখানে ওড়নায় মুখ ঢাকার কী দরকার?’

‘তারপর?’

‘তারপর হঠাৎ একদিন গ্লোবাল ট্রেডিং থেকে আমি একটা অফার পেলাম। এদেরও শাড়ির ব্যবসা, তবে প্রায় সবই এক্সপোর্টের জন্যে। এরা দারুচিনি-র থেকে অনেক বড় কম্পানি। আমার কাজ অবশ্য সেই একই। নর্থ ইন্ডিয়ার বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে শাড়ি প্রোকিওর করতে হবে। ধকলের চাকরি সন্দেহ নেই, কিন্তু স্যালারি, আগে যা পাচ্ছিলাম তার প্রায় ডবল। আমি রাজি হয়ে গেলাম। এখনও বাইরেই থাকি । জয়পুরে আমার অফিস। দেশের সঙ্গে যোগাযোগ কম। তবে মাঝে মধ্যে কাজের জন্য কলকাতায় আসতে হয়। কলকাতায় আমাদের হেড অফিস।’

‘তার মানে অশনি রায়ের মামলা যখন চলছিল আপনি তখন বাইরে। আপনি কি জানতেন এরকম একটা মামলা চলছে?’

‘তখন তখন জানতাম না। পরে একটু একটু করে জেনেছি। যখন পুরোটা জানতে পারলাম ততদিনে রায়সাহেবের বেশ কয়েক বছর জেল খাটা হয়ে গেছে। ইন্টারনেটে কেসটার ডিটেল পড়ার পর আমার মনে হল আমি তো এই মামলার একজন ইম্পর্টেন্ট সাক্ষী হতে পারতাম। আমি তো বেশ কয়েকবার অশনি রায়ের বান্ধবীকে দেখেছি। পুলিশকে আমি হয়ত দরকারি কিছু জানাতে পারতাম। যদিও ততদিনে দেরি হয়ে গেছে, তবু আমি আমাদের কম্পানির মালিক মুকেশ ঝুনঝুনওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি একবার পুলিশের সঙ্গে দেখা করব? মুকেশজি প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, খবরদার না। কেউ যেচে পুলিশের কাছে যায় নাকি? একবার পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ বারবার ডেকে পাঠাবে। পুলিশ ডাকলে বারবার রাজস্থান থেকে তোমাকে ছুটে আসতে হবে। তখন তোমার কাজের কী হবে ভেবে দেখেছ? পুলিশের কাছে যদি যেতে হয় তাহলে চাকরি ছেড়ে দাও। আমি তোমার জায়গায় অন্য লোক দেখি। কাজেই পুলিশের কাছে আমার যাওয়া হল না।’

‘তাহলে এখন আমার সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলতে চান? আচ্ছা তার থেকেও আগে বলুন, আমি যে অশনি রায়ের কেসটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি সেটা আপনি জানলেন কী করে?’

‘আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নটার উত্তর আগে দিই। আপনি বোধহয় সব বাংলা কাগজ ভাল করে পড়েন না। আমি এখানে এলে গোগ্রাসে বাংলা খবর কাগজ পড়ি। ওখানে থাকতে কাজের চাপে হয়ে ওঠে না। একটা বাংলা কাগজেই দেখলাম পুলিশ সম্ভবত অশনি রায়ের বেকসুর খালাসের বিরোধিতা করে ডিভিশন বেঞ্চে অ্যাপিল করবে এবং আপনি অশনি রায়ের কেসটা হাতে নিয়েছেন। ইন্টারনেট থেকে আপনার ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার পেয়ে গেলাম। কিন্তু সরাসরি ফোন করে যোগাযোগ করতে পারলাম না। রেকর্ডেড মেসেজ বলছে এই নম্বরের কোনও অস্তিত্ব নেই। আপনি কি রিসেন্টলি ফোন নম্বর বদলেছেন?’

‘হ্যাঁ, বদলেছি। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় এখনও পুরোনো নম্বরটা রয়ে গেছে।’ আদিত্য ঈষৎ কুণ্ঠিতভাবে বলল।

‘আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছিল। সরাসরি আপনার ঠিকানায় এসে দেখা করতে পারছিলাম না। কেমন যেন মনে হচ্ছিল কেউ আমার ওপর নজর রাখছে। তাই বহু কষ্টে আপনার হাতে চিঠি দিয়ে এলাম। এখানে আমি কম্পানির গেস্ট হাউসে আছি। এখন ছাতে এসে কথা বলছি যাতে কেউ দেখে না ফেলে। সাবধানের মার নেই।’

‘আমি এখনও বুঝতে পারছি না আপনি কী ধরনের সাহায্য আমার কাছে চাইছেন? ‘

‘আমি আপনার কাছে সাহায্য চাইতে যাব কেন? আমিই আপনাকে একটা ইম্পর্টেন্ট ইনফর্মেশন জানিয়ে সাহায্য করতে চাই। ইনফর্মেশনটা হলো, আমি কিছুদিন আগে অশনি রায়ের সেই বান্ধবীকে দেখেছি। যখন দেখেছি তখন ঠিক বুঝতে পারিনি। শুধু একটু চেনা চেনা মনে হয়েছিল। পরে যত ভাল করে ভেবেছি, তত কনভিন্সড হয়েছি যে তিনি অশনি রায়ের সেই বান্ধবী ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না।’

আদিত্য খানিকটা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নিয়ে সে বলল, ‘কতদিন আগে আপনি ওঁকে দেখেছেন?’

‘সেটা জোর দিয়ে বলতে পারব না। আমাকে বছরে দু’তিনবার কলকাতায় আসতে হয়। সেই সময় কখনও দেখেছি। এক বছর আগেও হতে পারে। দু’বছর আগেও হতে পারে। ঠিক মনে নেই।’

‘কলকাতার কোথায় ওঁকে দেখেছেন?’

মিতা অধিকারী খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি ভদ্রমহিলাকে আমাদের মালিক মুকেশ ঝুনঝুনওয়ালার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম।’ আরও কিছুটা চুপ করে থেকে মেয়েটি বলল, ‘আদিত্যবাবু আমার খুব ভয় করছে।’

(২ )

আদিত্যর ছেলেবেলায়, যখন তাদের অবস্থা খুব ভাল ছিল, নুরুল বলে এক বৃদ্ধ মুসলমান বাবুর্চি তাদের বাড়িতে রান্না করত। নুরুলের পুরো নামটা আদিত্যর মনে নেই। চেহারাটাও মনের মধ্যে আবছা হয়ে এসেছে। সাদা চুল, সাদা দাড়ি, শুধু এইটুকু মনে আছে। লোকটা আগে কোনও এক সাহেবের বাড়িতে রান্না করত। জুটমিলের বড় সাহেব। জুটমিল বন্ধ হয়ে যাবার পর সাহেব স্কটল্যান্ডে ফিরে গেল। আদিত্যর বাবা তখন বেকার নুরুলকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসে। তার আগে নুরুল কাজ করত জৌনপুরের কাছে কোনও এক পড়তি নবাব-বাড়িতে। নুরুল যখন এ-বাড়িতে এল ততদিনে মা মারা গেছেন। বাবা কোথা থেকে নুরুলের সন্ধান পেল আদিত্যর জানা নেই। তবে সে ওই বয়েসেই বুঝতে পেরেছিল মা নেই বলেই বাড়ির হেঁসেলে মুসলমান বাবুর্চি ঢোকানো গেল, না হলে এটা সম্ভব হতো না।

বাড়ির রোজকার রান্না রাঁধতো বামুন ঠাকুর। কিন্তু বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান হলে, বিশেষ করে গানবাজনা থাকলে, নুরুল রান্না করত। বিরিয়ানি, কোর্মা, কালিয়া, কাবাব বিশেষ করে শেষের পদটিতে নুরুলের তুলনা ছিল না। কাবাব যে এত রকমের হতে পারে, নুরুল তাদের বাড়িতে রান্নার কাজ না করলে আদিত্য জানতেই পারত না। দেশের বাঘা বাঘা সব ওস্তাদ, যাঁরা আদিত্যদের বাড়িতে গান শুনিয়ে শ্রোতাদের ধরাশায়ী করে দিতেন, তাঁরা নিজেরাই নুরুলের কাবাব খেয়ে ধরাশায়ী হতেন। আবার কখনও কখনও মহারাষ্ট্র থেকে বিশুদ্ধ শাকাহারী গায়ক-গায়িকারা আসতেন। নুরুল তাঁদের নানা রকমের নিরামিষ কাবাব খাইয়ে কুপোকাত করে দিত।

খানদানী মোগলাই রান্না ছাড়াও নুরুল অসাধারণ বিলিতি রান্না করতে পারত। স্টেক, রোস্ট, পুডিং, সুক্ষ্ণে। এসব তার সাহেব গিন্নির কাছে শেখা। তবে নুরুল ছিল ঘোর ধর্মভীরু মুসলমান। সে চাকরিতে ঢোকার সময়ই বলে নিয়েছিল আর সব কিছু সে রান্না করবে কিন্তু পোর্ক সে ছোঁবে না। শুধু তাই নয়, যে বাড়ির রান্নাঘরে পোর্ক ঢোকে সেখানে সে চাকরি করতে পারবে না। নুরুলের অসাধারণ গুণাবলীর জন্যে আদিত্যর বাবা এই শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু মাঝে মাঝে ভাল পোর্ক চপ কিংবা পোর্ক রোস্টের জন্য বাবার মন কেমন করত।

নুরুল একটা অসাধারণ ব্রেড পুডিং বানাত। এই রেসিপিটাও সেই চটকলের সাহেব গিন্নির। কিন্তু ব্রেড পুডিং বানানোর জন্যে সেন বেকারির আনস্লাইসদ্ধগ্ধ পাঁউরুটি নুরুলের চাই-ই চাই। সে বলে দিয়েছিল, সেন বেকারির পাঁউরুটি না হলে ব্রেড পুডিং-এ স্বাদ হবে না। সেই সময় সেন বেকারির পাঁউরুটি ছিল বাজারের সেরা। শহরে এবং মফস্বলে। স্কটল্যান্ডের সাহেব-মেমও সেই পাঁউরুটির তারিফ করত। বাঙালি তখনও ব্যবসায় এতটা অবনতি করেনি।

শ্যামবাজারে মেট্রো স্টেশন থেকে নেমে বাগবাজার স্ট্রিট ধরে গঙ্গার দিকে হাঁটতে হাঁটতে আদিত্যর এইসব পুরোনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেন বেকারির বর্তমান মালিক পল্লব সেন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সময় দিয়েছেন। সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ’টা। সোয়া ছ’টায় তাঁকে নাকি দরকারি কাজে বেরিয়ে যেতে হবে। আদিত্য ঝুঁকি না নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। ঘড়িতে এখনও পৌনে পাঁচটাই বাজেনি।

এই গ্রীষ্মকালে এখন চড়চড়ে রোদ থাকার কথা। থাকলে হাঁটাটা কষ্টকর হতো। কিন্তু বিধাতার আশীর্বাদে আজ আকাশে মেঘ আছে। এবছর প্রায় রোজই বিকেলের দিকে মেঘ করছে। আজও তাই। রাস্তায় হালকা ভিড়। কচুরির দোকানের পাশে চায়ের দোকান। লোকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কচুরি খাচ্ছে। তারপর পাশের দোকানে চা। রোল-চাউমিনের দোকানেও ভিড় আছে। আরও খানিকটা এগিয়ে ‘লড়াই-এর চপ’এর জন্য বিখ্যাত সেই তেলেভাজা বিপণি। সেসব প্রলোভন পেরিয়ে আদিত্য চিৎপুর রোডে এসে পড়ল।

পল্লব সেনের বাড়িটা বাগবাজার গঙ্গার ধারে। পল্লব সেন বলে দিয়েছিলেন, বাগবাজার স্ট্রিট ধরে পশ্চিমমুখো হাঁটতে হাঁটতে চিৎপুর রোড পেরিয়ে গঙ্গার ধার অব্দি চলে আসতে হবে। সামনেই পড়বে বাগবাজার ঘাট। তার গা দিয়ে গঙ্গার ধার ঘেঁসে স্ট্র্যান্ড ব্যাঙ্ক রোড চলে গেছে। সেটা ধরে দক্ষিণমুখো অর্থাৎ কাশী মিত্তিরের ঘাটের দিকে কয়েক মিনিট গেলেই রাস্তার ওপরে সেনেদের বনেদি বাড়ি। ওখানে যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে।

পল্লব সেনের কথা শুনতে শুনতে আদিত্য খেয়াল করেছিল তিনি চিৎপুর রোডকে তার আধুনিক নাম, অর্থাৎ রবীন্দ্র সরণী, বলে উল্লেখ করছেন না। আদিত্যর মনে পড়ে গিয়েছিল অন্নদাশঙ্করের সেই ছড়া, “দ্বিধা হও, দ্বিধা হও ওগো মা ধরণী/ চিৎপুরের নাম হল রবীন্দ্র সরণী’।

একটা লোক রাস্তার চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছে। তাকে জিজ্ঞেস করতেই পল্লব সেনের বাড়িটা দেখিয়ে দিল। গঙ্গার দিকে মুখ করে একটা বৃদ্ধ, অতিকায় দৈত্যের মতো বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। ছাতের কার্নিশ ফুঁড়ে বট-অশত্থের চারা। বাইরের দেয়ালে শ্যাওলা ধরেছে। এই রকম ভেঙে পড়া পুরোনো বাড়ির সঙ্গে আদিত্য খুব একাত্মবোধ করে। তার ওপর সামনে গঙ্গা, ওপরে মেঘ, মেঘের ফাঁক দিয়ে রোদ্দুরের তির জলের ওপর এসে পড়েছে।

আদিত্য নদীর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নদীর আধখানা মেঘের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছে। বাকিটা রোদ্দুরের দখলে। দু’একটা নৌকো ভাসছে এদিক-ওদিক। কয়েকটা পাড়ে নোঙর করা। মাঝির সংসার দুলছে, ভাসছে। ঢেউএর তালে তালে নাচছে। ঢেউএ তেজ আছে। ফুলে ওঠা জলের মাংসপেশি পাড়ে আছড়ে পড়ছে। ফুল, লতাপাতা, পুজোর উপাচার, বাঁশের কাঠামো ঢেউএর টানে তীরে এসে জমা হচ্ছে। সাড়ে পাঁচটা বাজতে এখনও সাত-আট মিনিট বাকি। এই সময়টুকু গঙ্গা দেখতে দেখতে চমৎকার কেটে যাবে। আদিত্য সিগারেট ধরাল। কেয়ার বকুনিতে কয়েকদিন ধূমপান বন্ধ ছিল। গতকাল থেকে আবার চুপি চুপি শুরু হয়েছে।

যে লোকটা আদিত্যকে বাড়ি দেখিয়ে দিয়েছিল তার বোধহয় চা খাওয়া হয়ে গেছে। আদিত্যকে গঙ্গার ধারে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে এগিয়ে এল।

‘পল্লব সেনের সঙ্গে দেখা করবেন?” লোকটা মনে হয় গল্প করার মুডে আছে। আদিত্যর একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। সে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’ ‘পাখি? না পাঁউরুটি?’

আদিত্য এবার সত্যিই অবাক হয়েছে। সে জিজ্ঞাসু চোখে লোকটার দিকে তাকাল । ‘মানে বলছিলাম, আপনারও কি ওই পাখি দেখার শখ? নাকি কেক-পাঁউরুটির এজেন্সি নেবেন? এদের কেক-পাঁউরুটি কিন্তু আগেকার মতো আর নেই।’

‘পাখি দেখার শখ ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।’

‘সে কী! আপনি পল্লব সেনের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন আর জানেন না উনি দেশের সেরা পাখি-দেখিয়েদের একজন? এদের কী যেন একটা ইংরিজি নামও আছে, ঠিক মনে পড়ছে না।’

‘বার্ড ওয়াচার।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই, ওই, ওটাই।’

‘আপনি কি এই পাড়াতেই থাকেন?’ আদিত্য জিজ্ঞেস করল। সে এবার সরাসরি লোকটার দিকে তাকিয়েছে। আধময়লা জামা, প্যান্টটাও পুরোনো, কিন্তু মাথার চুল এবং গালের দাড়ি বেশ পরিপাটি করে কাটা ।

‘এই পাড়াতে থাকি তো বটেই। এখানে আমাদের তিন পুরুষের বাস। একটু এগিয়ে গঙ্গার ধারেই আমার একটা সেলুন আছে। আমি নিজে আর চুল কাটি না। তিনজন সেলুনে কাজ করে। ওরাই এখন চুল-দাড়ি কাটে।’

লোকটার পরিপাটি করে চুল-দাড়ি কাটার রহস্য বোঝা গেল। ‘বললেন না তো পল্লব সেনের সঙ্গে কী দরকার।’

‘আপনিই তো বলে দিলেন। কেক-রুটির এজেন্সি নেব। বনগাঁয়।’

‘বনগাঁয়? বনগাঁর কোথায়? আমার বড় সম্বন্ধী বনগাঁয় থাকে। আমি ওদিকটা অনেকবার গেছি।’

আদিত্য প্রশ্নটা না শোনার ভান করে বলল, ‘পল্লব সেন লোক কেমন? ‘

প্রশ্নটা মনে হল সেলুন মালিকের পছন্দ হয়েছে। সে রহস্যময় হাসি হেসে বলল, ‘ওপর ওপর দেখলে আপনার মনে হবে লোকটা ভোলা-ভালা, পাগল-ছাগল গোছের। সারাদিন পাখি নিয়ে পড়ে আছে। হয় দুরবীন দিয়ে পাখি দেখছে আর না হয় পাখির ছবিওলা মোটা মোটা বিলিতি বইএর পাতা ওল্টাচ্ছে আর গান শুনছে। আমরা পুজোর চাঁদা বা পাড়ার অন্য কোনও সমস্যার কথা বলতে গিয়ে লোকটাকে ওই রকমই দেখেছি। পাড়ার কাজে টাকা-পয়সা দিতে অবশ্য পল্লব সেন কখনও কার্পণ্য করে না।’

‘আপনাদের এখানে পাখি-টাখি আসে নাকি?’

‘আসে বৈকি। গঙ্গার ওপরে এখনও অনেক রকম পাখি আসে। গাংচিল -টাংচিল গোছের। আমি অত নাম টাম জানি না। মাঝে মাঝেই দেখি পল্লব সেন বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুরবীন দিয়ে পাখি দেখছে। তাছাড়া সেন বাড়ির পেছনে এখনও বেশ বড় একটা বাগান আছে। ওখানেও নানারকম পাখি আসে।’

‘তা আপনি বলছিলেন না পল্লব সেন লোকটা ওপর ওপর ভোলা ভালা? ভেতরটা কি তাহলে অন্যরকম?’

“আরে, সেটাই তো বলতে যাচ্ছিলাম। আসল কথাটা খুব বেশি কেউ জানে না। আমরা দু’একজন, যারা অনেক দিন এই পাড়ায় আছি, আমরা জানি। পল্লব সেন লোকটা আসলে এক নম্বরের শয়তান। ওর শয়তানি দেখে ওর বউ ওকে ছেড়ে চলে গেছে। ওর দাদা যে অ্যাক্সিডেন্ট-এ মারা গেল সেটাও অনেকে বলে সুইসাইড। তার কারণও পল্লব সেনের কুকীর্তি। আপনাকে দেখে ভালমানুষ মনে হচ্ছে তাই বলছি। পল্লব সেন লোকটা মোটেই সুবিধের নয়। ওর সঙ্গে খুব সাবধানে ব্যবসা করবেন।’

‘আমি নিশ্চয় সাবধান হব। কিন্তু পল্লব সেনের শয়তানিটা কী ধরনের একটু খোলসা করে বলবেন?’ আদিত্য মুখটা যথাসম্ভব করুণ করে বলল।

‘শয়তানি কি একটা নাকি? তবে সব থেকে বড় বদমায়েসিটা হল, বৌদির সঙ্গে লটঘট করা। পল্লব সেনের সঙ্গে ওর বৌদির খুব নোংরা সম্পর্ক আছে। সেই জন্যেই তো ওর বউটা ভেগে গেল। দাদা সুইসাইড করল। আমার এসব বলতেও খারাপ লাগে।’ যদিও লোকটার কথা শুনে মনে হচ্ছিল কথাগুলো বলতে তার বেশ ভাল লাগছে।

কথাবার্তা আরও কতক্ষণ চলত কে জানে, আদিত্য হঠাৎ লক্ষ করল ঘড়িতে প্রায় পাঁচটা পঁয়ত্রিশ। সে খুব বিনীতভাবে বলল, “আপনি আমার খুব উপকার করলেন । আমাকে কিন্তু এবার এগোতে হবে। পল্লব সেন সাড়ে পাঁচটায় সময় দিয়েছেন।’

পল্লব সেনের বাড়ির লোহার গেটটা খুলতে খুলতে আদিত্য ভাবছিল, ভদ্রলোক তো পাড়ার চাঁদা-টাদাগুলো নিয়মিত দিয়ে দেন। তাহলে তাঁর ওপর পাড়ার লোকেদের এত রাগ কেন? নাকি এটা শুধু সেলুন মালিকের রাগ?

কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়িতে ওঠার মুখে দুদিকে দুটো ভারী পেতলের পাত্রে ফণিমনসা। পালিশ করা কাঠের হাতল। পায়ের নিচে ভারি কার্পেট। বাইরে থেকে বাড়িটাকে যেমন জরাক্রান্ত মনে হয়, ভেতরটা মোটেই তেমন নয়। গেটে নিশ্চয় আদিত্যর নাম বলা ছিল। নাম শোনা মাত্র দরোয়ান সদর দরজা অব্দি পৌঁছে দিয়েছে। ধুতি এবং হাতগুলা গেঞ্জি পরা যে পরিচারক দরজা খুলল সে আদিত্যকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিয়ে যেতে যেতে জানাল ছোটসাহেব আদিত্যর জন্যে দোতলার বসার ঘরে অপেক্ষা করছেন।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হালকা গানের আওয়াজ আদিত্যর কানে ভেসে এল। যত ওপরে উঠছে তত স্পষ্ট হচ্ছে গানের আওয়াজ। দোতলায় পৌঁছে আদিত্য বুঝতে পারল গলাটা রসলুন বাই-এর। ভৈরবী ঠুংরি গাইছেন। ফুলগেন্দয়া না মারো, লগত করজোয়া মে চোট।

বসার ঘরটা বেশ বড়। জানলাগুলোতে পর্দা টানা, তাই কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। মনে হয়, গঙ্গার দিক থেকে আসা পশ্চিমের রোদ্দুর যাতে ঘরে ঢুকতে না পারে তার জন্য এই ব্যবস্থা। আধো-অন্ধকারে আদিত্য ঠাহর করে দেখল কোণের দিকে একটা আরাম কেদারায় কেউ একজন বসে আছে। আদিত্যকে দেখতে পেয়ে দাঁড়িয়ে উঠে সে বলল, ‘আসুন, আসুন। বসুন। মৃত্যুঞ্জয়, ঘরের আলোগুলো জ্বালিয়ে দাও।’ শেষ কথাগুলো পরিচারকের উদ্দেশে।,

আদিত্য বসল। গৃহকর্তাও বসল। মৃত্যঞ্জয় আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে। পল্লব সেনকে এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বয়েস পঞ্চাশের নিচেই হবে। বনেদি চেহারা, সুপুরুষ, গায়ের ফরসা রঙ রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাঁ কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির নিচ দিয়ে শরীরের আসল রঙটা বেরিয়ে পড়েছে।

‘দাঁড়ান, গানটা বন্ধ করে দিই। পল্লব সেন আবার ওঠার উপক্রম করল। ‘না, না। চলুক না গানটা।’ আদিত্য প্রায় স্বতস্ফূর্তভাবে বলল। ‘আপনি এইসব গান শোনেন?’ পল্লব সেন যেন যাচাই করে নিতে চায় আদিত্য নেহাত ভদ্রতার খাতিরে কথাগুলো বলল নাকি সত্যিই সে গানটা শুনতে চায়।

“শুনি। খুব শুনি। তাছাড়া এই গানটা বিশেষ করে শুনতে ইচ্ছে করছে। এটার রেকর্ডের ভার্সানটা ইউ টিউবে আছে, সেটা শুনেছি। কিন্তু সেটা তো মাত্র আড়াই-তিন মিনিট। এইটা মনে হয় লাইভ রেকর্ডিং। তবে নিশ্চয় পুরোনো। রসলুন বাই-এর গলাটা বেশ ইয়াং শোনাচ্ছে।’

‘আপনি তো সমঝদার লোক মশাই।’ পল্লব সেনকে উল্লসিত শোনাল। ‘এটা আর্লি ফিফটিজে কলকাতায় গাওয়া। তখন রসলুন বাই-এর বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। কিন্তু গলার দাপট দেখেছেন?’

এর পরের পনের মিনিট গান চলল। আদিত্য বুঁদ হয়ে শুনছে। আবার মাঝে মাঝে ভাবছে পল্লব সেন বলেছিল ছ’টা অব্দি সময় দিতে পারবে। ছ’টা বাজতে তো আর মিনিট পাঁচেক বাকি। ভদ্রলোকের সঙ্গে ভাল করে কথা বলা যাবে তো?

গান শেষ হতে পল্লব সেন বলল, ‘এরকম ওজনদার গলা আর শোনা যাবে না। আখতারী বাইও নেই, রসলুন বাইও নেই। শেষ ছিলেন সিদ্ধেশ্বরী বাই। তিনিও কবে চলে গেছেন। আর কার গান শুনব?’ পল্লব সেন ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

আদিত্য বলল, ‘আপনাকে তো সোয়া ছটায় বেরিয়ে যেতে হবে। আমার কথাগুলো তাহলে তাড়াতাড়ি সেরে নিই।’

‘বলেছিলাম বুঝি সোয়া ছ’টায় বেরিয়ে যেতে হবে?” পল্লব সেনকে খানিকটা অপ্রস্তুত দেখাল। ‘আসলে কী জানেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না আপনি লোকটা কেমন হবেন। এমন লোক আপনি হতেই তো পারতেন যার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলা যায় না। তাই রিস্ক না নিয়ে একটা সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি যখন রসলুন বাইএর গলা চিনতে পেরেছেন, আপনার সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধে হবে না। আপনি সময় নিয়ে বলুন কী জানতে চান।’

আদিত্য মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। কীভাবে শুরু করবে? কীভাবে এগোবে?

‘টেলিফোনে আপনাকে বলেছিলাম আমি একজন সাংবাদিক। বাঙালির ব্যবসা নিয়ে একটা লেখা তৈরি করছি। তাই সেন বেকারি সম্বন্ধে কথা বলতে চাই।’ আদিত্য শুরু করল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে আছে। তবে ব্যবসার ব্যাপারটা আমি খুব একটা জানি না। বাবা মারা যাবার পর ব্যবসাটা দাদাই দেখত। প্রায় ষোলো বছর হতে চলল দাদা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। বৌদি আমারই মতো। ব্যবসার ব্যাপারটা খুব বেশি বোঝে না। আমাদের একজন পুরোনো ম্যানেজার আছেন, দাদা মারা যাবার পর থেকে তিনিই ব্যবসাটা দ্যাখেন। আমাদের বেকারি প্রডাক্ট আগেকার মতো না হলেও এখনও কিন্তু খানিকটা চলে। বিশেষ করে মফস্বলে। মাইনে-পত্তর নিয়ে ওয়ার্কারদের খুব একটা গ্রিভান্স আছে বলে মনে হয় না। এবং আমি আর বৌদি সেন বেকারির মালিক হিসেবে প্রফিটের যে অংশটা পাই, দেখতেই তো পাচ্ছেন, তাতে আমাদের বেশ কমফরটেবলি চলে যায়। তা আপনি আমাদের ব্যবসার ব্যাপারে ঠিক কী জানতে চাইছেন?’

‘পল্লববাবু, আমি টেলিফোনে আপনাকে মিথ্যে বলেছিলাম। আমার সত্যি পরিচয়টা দিলে আপনি সম্ভবত আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হতেন না’। আদিত্য ঈষৎ কুণ্ঠিতভাবে বলল।

‘মিথ্যে বলেছিলেন?”পল্লব সেনের ভুরু দুটো ধনুকের আকার ধারণ করেছে। ‘হ্যাঁ। আসলে আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা।’

‘বেসরকারি গোয়েন্দা? সে আবার বাস্তবে হয় নাকি? তাদের তো দিশি-বিদেশি থ্রিলারে দেখা যায়। শার্লক হোমস, একুল পোয়ারো, ডরোথি সেয়ার্সের লর্ড পিটার হুইমসি, রেমন্ড চ্যান্ডলারের ফিলিপ মারলো। আমাদের দিশি গোয়েন্দা জয়ন্ত-মানিক, ফেলুদা। আর সবার ওপরে ব্যোমকেশ বক্সি।’ পল্লব সেন চওড়া করে হাসলেন। মনে হচ্ছে আদিত্যর কথাটা তিনি ঠাট্টা মনে করছেন। বললেন, ‘জানেন তো শখের গোয়েন্দা জয়ন্ত-মানিকের স্রষ্টা হেমেন্দ্রকুমার রায় এই গঙ্গার ধারে আমাদের তিনটে বাড়ি পরে থাকতেন ? ‘

‘পল্লববাবু আমি সত্যিই একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। তবে জয়ন্ত-মানিকের মতো শখের গোয়েন্দা নই। নেহাতই পেটের দায়ে এই লাইনে এসেছি।’ আদিত্য মরিয়া গলায় বলল।

আদিত্যর গলা শুনে পল্লব সেন খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেছে। বোধহয় বুঝতে পেরেছে আদিত্য ঠাট্টা করছে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, “কিন্তু আমার কাছে গোয়েন্দা কেন? আমি তো চুরি-ডাকাতি কিছুই করিনি।’

“ছি, ছি। আপনি চুরি-ডাকাতি করতে যাবেন কেন? আমি আপনার কাছে এসেছি কিছু তথ্য পাবার আশায়।’ আদিত্য কাঁচুমাচু হবার ভান করল।

‘তথ্য? আমার কাছে কীসের তথ্য?’

‘আপনার নিশ্চয় মনে আছে, বছর তিনেক আগে ভি আই পি রোড সংলগ্ন বাঙ্গুর অ্যাভিনিউ-এ আপনাদেরই একটা ফ্ল্যাটে আপনাদের ডিস্ট্রিবিউটার পার্থ মিত্র আর তার স্ত্রী মৃত্তিকা মিত্র খুন হয়েছিলেন। এবং খুনের অভিযোগে অশনি রায় বলে এক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। সম্প্রতি হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ অশনি রায়কে বেসুর মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু শোনা যাচ্ছে, পুলিশ ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করবে। অশনি রায়ের বাবা আমাকে কেসটাতে নিযুক্ত করেছেন। আমার কাজ অশনি রায়ের সপক্ষে কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করা। ডিভিশন বেঞ্চে মামলা উঠলে যেগুলো আদালতে পেশ করা যাবে।’

‘আপনি রসলুন বাই-এর গান শোনেন আবার গোয়েন্দাগিরিও করেন? কী আশ্চর্য!’ আদিত্য কথা শেষ করার আগেই পল্লব সেন বলে উঠল। ‘আপনি যেমন পাখিও দেখেন আবার পাঁউরুটিও বিক্রি করেন।’ আদিত্যর মুখ দিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কথাগুলো বেরিয়ে গেছে। সে ভাবছে, লোকটা নিশ্চয় খুব রেগে যাবে।

পল্লব সেন কিন্তু রাগল না। মৃদু গলায় বলল, ‘আমি তো আপনাকে আগেই বললাম ব্যবসা আমি দেখি না। পাঁউরুটি বিক্রি করা আমার কাজ নয়। পাখি দেখা, গান শোনা ইত্যাদি কয়েকটা সখ আমার আছে। ওগুলো নিয়েই আমি থাকি। খুনের ব্যাপারটা আমি ততটুকুই জানি যতটা খবর কাগজ পড়ে আর পাঁচজন জানে। আমি আপনাকে খুব একটা সাহায্য করতে পারব বলে মনে হয় না।’

‘আমি আপনাকে খুনের ব্যাপার নিয়ে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করছি না, মিস্টার সেন। আমি শুধু পার্থ মিত্র লোকটি সম্বন্ধে একটু জানতে চাইছি। উনি কত দিন আপনাদের ডিসট্রিবিউটার ছিলেন?’

পল্লব সেনের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছেন। মৃত্যঞ্জয় বলে সেই পরিচারক চা নিয়ে এসেছে।

চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে পল্লব সেন বলল, ‘পার্থ মিত্রকে আমি খুব একটা চিনতাম না। আমার বাবার আমলে গোবিন্দ লাহা ছিলেন আমাদের সোল ডিসট্রিবিউটার। তার ছেলে অভিজিৎ লাহা দাদার আমলে আমাদের সমস্ত প্রডাক্ট ডিসট্রিবিউট করত। কোনও কারণে আমাদের পুরোনো ম্যানেজার প্রণব মাইতির সঙ্গে অভিজিৎ লাহার খুব একটা বনতো না। ফলে, দাদা হঠাৎ চলে যাবার পরে লাহাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ফিকে হয়ে আসে। যদিও আমার মনে হয় লাহাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু আমার মতের খুব একটা দাম নেই, যেহেতু আমি ব্যবসাটা দেখি না। তবু প্রণববাবুকে বলেছিলাম। তো তিনি লাহাবাড়ির নতুন প্রজন্মের নানারকমের খুঁত বার করলেন। তারপর একদিন এই পার্থ মিত্রকে ধরে আনলেন। বললেন পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলোতে এদের খুব ভাল ডিসট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক আছে । এদের সঙ্গে ব্যবসা করলে কম্পানির ভাল হবে। আমি আর কী বলব? রাজি হয়ে গেলাম।’

‘আপনার দাদা মারা গেছেন ষোলো বছর আগে। তার মানে রাফলি ষোলো বছর আগে পার্থ মিত্রদের কম্পানিকে আপনারা ডিসট্রিবিউটার হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। আর পার্থ মিত্র খুন হয়েছে তিন বছর আগে। অর্থাৎ তেরো বছর ওর কম্পানি আপনাদের প্রডাক্ট ডিস্ট্রিবিউট করেছে। এই তেরো বছরে আপনার সঙ্গে পার্থ মিত্রর ইন্টার‍্যাকশান হয়নি?’

‘হয়েছে, তবে খুবই সামান্য। আমাদের কিছু পুরোনো শেয়ার হোল্ডার আছে। প্রত্যেক বছর একটা করে এজিএম করতে হয়। সেখানে পার্থ মিত্রর সঙ্গে দেখা হতো। তাছাড়া আরও দু’একবার হয়ত কোনও কাজে পার্থ মিত্র আমার কাছে এসেছে।’

‘লোকটা সম্বন্ধে আপনার কী রকম ইম্প্রেশন?’

‘দেখুন, পার্থ প্রায় আমারই বয়সী। বড় জোর তিন-চার বছরের ছোট হবে। কিন্তু ওর সঙ্গে আমি একটা জেনারেশন গ্যাপ অনুভব করতাম। পার্থ ছিল আর পাঁচটা চল্লিশ-পেরিয়ে-যাওয়া আধুনিক যুবকের মতো। সেই রকম পোষাক, সেই রকম কথাবার্তা। আর আমি একেবারে সেকেলে। না হলে বলুন না আমার বয়সী ক’টা লোক খেয়াল-ঠুংরি শোনে? আসলে, আধুনিক যুবকদের সঙ্গে আমি একেবারেই মিশতে পারি না। বন-জঙ্গলে পালিয়ে যাই। দোষটা আমারই। পার্থ মিত্র যে মানুষটা খারাপ ছিল তা নয়।’

‘পার্থ মিত্র খুন হবার পর আপনাদের ডিসট্রিবিউশনটা কোন কম্পানি হ্যাল্ করে?’

‘আমরা নিজেরাই এখন আমাদের ডিসট্রিবিউশনটা ম্যানেজ করি। বাইরের কোনও কম্পানিকে আর আমরা এমপ্লয় করিনি। একজন ডিসট্রিবিউশন ম্যানেজার আছে। সে-ই ডিসট্রিবিউশনটা দ্যাখে।’

‘আপনি কি পার্থ মিত্রর স্ত্রী মৃত্তিকা মিত্রকে চিনতেন?’

‘খুব ভাল চিনতাম বলতে পারি না। দু’চারবার দেখেছি।’

‘কী রকম মনে হয়েছে?

‘ওই আজকালকার মেয়েরা যেমন হয়। চোখে মুখে কথা বলে। আসলে কী জানেন, আমি মেয়েদের সঙ্গে খুব একটা মিশতে পারি না। বিশেষ করে মৃত্তিকা মিত্রর মতো অ্যাগ্রেসিভ মেয়েরা আমাকে প্রচণ্ড রিপেল করে।’ পল্লব সেন কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘একমাত্র আমার বৌদি আমাকে বুঝতে পারে। বৌদি আমার থেকে মাত্র চার বছরের বড়। কিন্তু মাতৃস্নেহে আমাকে আগলে রেখেছে। বৌদি না থাকলে আমার কী যে হতো।’ পল্লব সেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

‘আপনার পড়শিদের কেউ কেউ কিন্তু আপনার প্রতি ততটা সদয় নন। আপনার বাড়িতে ঢোকার মুখে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হল। কাছেই কোথাও তার একটা সেলুন আছে। আপনার বিরুদ্ধে তার অনেক অভিযোগ।’

পল্লব সেনের মুখটা অন্ধকার হতে হতে হঠাৎ হাসিতে ভরে গেল। বলল, “ও। বুঝতে পেরেছি। কেষ্ট প্রামাণিক। আমার জমিতে একটা সেলুন করতে চেয়েছিল। আমি রাজি হইনি তাই আমার নামে কুৎসা রটিয়ে বেড়ায়। ও একটা হনুমান। ওকে স্বচ্ছন্দে ইগনোর করতে পারেন।’

‘আর এক দিন এসে আপনার গানের কালেকশানটা দেখব। আপত্তি নেই তো?’ আদিত্য উঠতে উঠতে বলল।

‘আপত্তি কীসের? গান এমনই জিনিস সমঝদারদের সঙ্গে শেয়ার করতে ইচ্ছে করে। আপনি একটা ফোন করে চলে আসবেন। আমি আবার মাঝে মাঝে কলকাতায় থাকি না তো।’

আদিত্য বাইরে বেরিয়ে দেখল সন্ধে নেমে এসেছে। অন্ধকার নদীতে চলমান আলোর বিন্দু। যাত্রী নিয়ে ইস্টিমার নদী পেরোচ্ছে।

(৩)

কয়েক দিন অসহ্য গরম পড়েছে। দাবদাহ। বেলা এগারোটার পর রাস্তায় বেরোনো যায় না। বাড়িতেও টেকা মুস্কিল। আদিত্যদের ফ্ল্যাটের দেয়ালগুলো বেশ পাতলা। সিলিংটাও নিচু। আজকালকার ফ্ল্যাটবাড়ি যেমন হয়। সব মিলিয়ে গ্রীষ্মের দুপুরগুলোতে বাড়িটা অসহনীয় হয়ে ওঠে। কেয়া সকাল সকাল বেরিয়ে যায় বলে গরমটা ততটা টের পায় না। গত কয়েক দিন যাবত আদিত্য কেয়ার সঙ্গেই বেরিয়ে যাচ্ছে। পুরোনো দিনের বাড়ি বলে আদিত্যর আপিসটা প্রবল গ্রীষ্মেও বেশ ঠাণ্ডা থাকে।

মনে হচ্ছে কেয়া এবার একটা গাড়ি কিনেই ফেলবে। শো-রুমে গিয়ে একটা লাল রঙের মারুতি ওয়্যাগন আর পছন্দ করে এসেছে। লাল রঙটা কেয়ার খুব পছন্দ। গাড়িটা ডেলিভারি পেতে কয়েক দিন লাগবে। এর মধ্যেই কেয়া ছক কষে ফেলেছে গাড়িটা এলে কী করবে। সকালে কেয়াকে তার ইস্কুলে নামিয়ে গাড়িটা আদিত্যকে আপিসে পৌঁছে দেবে। তারপর আবার কেয়ার ইস্কুলে ফিরে আসবে। আদিত্য বলে দিয়েছে ফেরার সময় সে কিছুতেই গাড়ি নেবে না। কিছুটা বাসে, কিছুটা হেঁটে যখন যেমন ইচ্ছে করে তেমনি করে ফিরবে। এই স্বাধীনতাটা আদিত্যর খুব ভাল লাগে। একটাই সমস্যা। গাড়িটা রাখার একটা বন্দোবস্ত হলেও ড্রাইভার এখনও পাওয়া যায়নি।

আজ আপিসের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বিমলের ফোন। পুরোনো দিনের খাড়া খাড়া অনেকগুলো সিঁড়ি। সিঁড়ি ভাঙার সময় এমনিতেই আদিত্যর কষ্ট হয়। কথা বলতে হলে আরও কষ্ট। আগে এতটা হতো না। ইদানীং হচ্ছে। এখনও সিগারেটটা ছাড়া হল না । কেয়াকে লুকিয়ে আবার দিনে দশ-বারোটা হয়ে যাচ্ছে। আদিত্য বিমলকে বলল, ‘ঘরে গিয়ে কল ব্যাক করছি।’

‘বল, কিছু খবর আছে?’ ঘরে পৌঁছে সিগারেট ধরানোর পর আদিত্য বিমলের ফোনটা লাগাল।

‘আছে স্যার। তাই তো ফোন করছি। সোমনাথ বাগের খোঁজ পেয়েছি। ও আর এখন চ্যাম্পিয়ান সিকিউরিটিজ-এ কাজ করে না। তবে ওরাই সোমনাথের নতুন কম্পানির হদিশ দিল। বেরিয়ে আসছি, হঠাৎ একজন জিজ্ঞেস করল, সোমনাথ বাগকে কী দরকার? বললাম, সোমনাথ বাগের বাবা আমার বাবার বন্ধু। আমরা কুচবিহারে থাকি। আগে সোমনাথরাও থাকত। তা, ক’দিনের জন্যে কলকাতা এসেছি, তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই। সেই লোকটা বলল, সোমনাথরা তো নদীয়ার লোক, ওরা আবার কবে কুচবিহারে থাকত? আমি বললাম, নদীয়ায় তো পরে গেছে। আগে কুচবিহারেই থাকত। লোকটা বলল, এটা সোমনাথ কখনও বলেনি তো। লোকটার কথা শুনে মনে হল সে আমাকে ঠিক বিশ্বাস করছে না। যাই হোক, আমি কোনও রকমে ভুজুং ভাজাং দিয়ে বেরিয়ে এলাম। সোমনাথ বাগের নতুন কম্পানির নামটা তো আগেই জানা হয়ে গেছে।’

‘কোন কম্পানি?’

‘তিরুপতি গার্ডস। সল্ট লেকে অফিস। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম ওরা একটা সরকারি কম্পানিতে সোমনাথকে ডিউটিতে দিয়েছে। বিবাদী বাগে সেই কম্পানির অফিস। আমি এখনও সেখানে যাইনি, কারণ আমার মনে হচ্ছে চ্যাম্পিয়ান সিকিউরিটিজ-এর সেই লোকটা ইতিমধ্যে সোমনাথের সঙ্গে কথা বলেছে। আমি গেলেই সোমনাথ আমাকে চেপে ধরবে। তাই বলছিলাম, আমি যাব, নাকি আপনি যাবেন?’

‘আমিই যাব। তুমি কম্পানির নাম আর ঠিকানাটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দাও। আর শোনো, তোমার মেয়ে কেমন আছে?’

‘এখন অব্দি ঠিক আছে স্যার। এখনও পেন ওঠেনি। যে কোনও দিন উঠতে পারে। গিন্নি মেয়ের কাছে আছে।’

‘কিছু হলে খবর দিও। চিন্তায় রইলাম।

মোবাইলটা টেবিলে রেখে আদিত্য কফি বানাতে যাবে, ফোনটা আবার বেজে উঠল। এক-একদিন এরকম হয়। সারাদিন ধরে নানা ফোন আসে। আবার এক-একদিন ফোনই আসে না। আদিত্য কফি বানানোর পরিকল্পনা বাদ দিয়ে টেবিলে এসে ফোনটা ধরল। গৌতম।

‘আরে তোর ব্যাপারটা কী? পাত্তাই নেই। কী করিস সারাদিন?’ গৌতমের গলা ওপার থেকে গমগম করে উঠেছে।

“আমার পাত্তা নেই মানে? আমাকে তো সব সময় পাওয়া যায়। তোকেই ফোন করলে পাওয়া যায় না। মিটিং-এ ব্যস্ত থাকিস।’

‘আরে আমাকে তো আমি সব সময় দেখতে পাচ্ছি। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই দেখতে পাচ্ছি। তোকে কোথায় দেখছি?’

আদিত্যর সন্দেহ হল গৌতম রসিকতার চেষ্টা করছে। সে স্বাভাবিক গলায় বলল, “নিশ্চয় আমাকে কোনও কারণে তোর দরকার। বল কী দরকার।’

‘ঠিক ধরেছিস। তোকে আমার দরকার। তুই তৈরি হয়ে নিচে নেমে আয়। আমি তোকে তোর অফিসের সামনে থেকে তুলে নিচ্ছি। লাঞ্চ খেতে খেতে আমার দরকারটা বলব। এখন আসতে অসুবিধে নেই তো?’

মিনিট সাত-আট পরে গৌতমের গাড়িতে বসে আদিত্য জিজ্ঞেস করল, “আমরা কোথায় লাঞ্চ খেতে যাচ্ছি?’

‘পার্ক স্ট্রিটে কুইজিনস বলে একটা নতুন রেস্তোরাঁ হয়েছে। যেখানে আগে স্কাইরুমটা ছিল, তার কাছাকাছি। ওখানেই যাচ্ছি। ওখানে নাকি খুব অথেনটিক কিছু ইটালিয়ান ডিশ পাওয়া যাচ্ছে। ইংরেজি কাগজে রিভিউ বেরিয়েছে।’

‘রিভিউটা আমিও পড়েছি। যে খয়েরি সাহেব রিভিউটা লিখেছেন তিনি দেখলাম প্রশংসা করতে করতে একেবারে গাড়ু-গামছা হয়ে গেছেন। দেখা যাক, তাঁর আবেগটা কতটা খাঁটি।’

গাড়ি ভিড়ের রাস্তা দিয়ে শম্বুক গতিতে চলেছে। মেট্রো সিনেমা থেকে টাইগার সিনেমা অব্দি যেতে মিনিট কুড়ি লেগে গেল। এত কড়া রোদের মধ্যেও ফুটপাথের হকাররা জমিয়ে ব্যবসা করছে। মধ্যাহ্নের দারুণ অগ্নিবাণে বিদ্ধ হতে হতে লোকে অকাতরে চিনে খেলনা, জাপানি ছাতা, হাওড়ার হাটের জামাকাপড়, চটি-জুতো, প্লাস্টিকের মগ-বালতি, ইত্যাদি কিনে যাচ্ছে। মূলত হকার এবং তাদের খরিদ্দারদের ভিড়েই রাস্তায় এত জ্যাম।

‘এই হকারদের সরাবার ব্যাপারে তোরা কিছু করতে পারিস না?” কথাটা বলেই আদিত্যর মনে হল প্রশ্নটা নেহাতই বালখিল্য হয়ে গেছে।

‘আমাদের দেশে পলিটিক্স বলে একটা বস্তু আছে তুই জানিস না? হকারদের গায়ে হাত দেওয়া যায় নাকি?’ গৌতমের গলায় তিক্ততা ছিল।

কিছুক্ষণ হল পার্ক স্ট্রিটের ট্র্যাফিক পুবমুখো। গাড়ি বাঁদিকে বেঁকে পার্ক স্ট্রিটে ঢুকে পড়েছে। রাস্তাটার সেই পুরোনো মনোপলি আর নেই। আজকাল শহরের দক্ষিণ ও পুবদিকে বেশ কিছু নতুন ভোজনালয় হয়েছে যারা পার্ক স্ট্রিটের পুরোনো রেস্টোরেন্টগুলোর সঙ্গে অনায়াসে পাল্লা দিতে পারে। কিছু দূর যাবার পর কুইজিনস-কে বাঁ দিকে দেখা গেল ।

‘আমি একটা বিয়ার খাব।’ গৌতম মেনুর ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে বলল । ‘তুই ?’

‘আমিও বিয়ার খাব ।

আদিত্যরা এক কোণে গুছিয়ে বসেছে। জানলা দিয়ে পার্ক স্ট্রিটের বহমান জনস্রোত দেখা যায়।

আরও মিনিট কয়েক পরে বিয়ারের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে আদিত্য বলল, ‘এবার বল আমাকে কী কারণে দরকার।’

‘হ্যাঁ, সেটা একটু ভাল করে গুছিয়ে বলছি। কিছুদিন আগে তুই আমাকে বললি কেয়ার চেনা একটি টিন-এজার ছেলে ড্রাগ ওভারডোজ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে ৷ তুই তাকে দেখতে যেতে চাস। ব্যবস্থা করে দিতে। নিশ্চয় তোর মনে আছে?’

আদিত্য ঘাড় নাড়ল।

‘টিন-এজারদের এই ড্রাগ নেবার ব্যাপারটা ইদানীং ভীষণ বেড়ে গেছে।’ গৌতম বলতে লাগল। ‘পুরোটা ভাল করে বলতে গেলে অন্তত পনের বছর আগে থেকে শুরু করতে হবে। সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে তখন ড্রাগ পেডলিং ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু ড্রাগ পেডলিং নয়, তার সঙ্গে খুন, গ্যাং ওয়ার। রোজ রাত্তিরে ঝামেলা লেগে থাকত। কলকাতা এবং মফস্বল শহরগুলোর কিছু অঞ্চল ক্রমশই অবাসযোগ্য হয়ে উঠছিল। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও পুলিশ কিছু করতে পারছিল না।

‘মূলত দুটো গ্যাং ড্রাগ পেডলিং করত। এবং তাদের মধ্যে মারাত্মক রাইভ্যালরি ছিল। সেই রাইভ্যালরি থেকেই নিয়মিত মারামারি, খুন জখম। একটা ছিল ইসমাইলের গ্যাং। এটা পুরোনো গ্যাং। আগে বিহার-ইউ পি অঞ্চলে অপারেট করত। ওদিক থেকে পুলিশের তাড়া খেয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। অন্য গ্যাংটা বেশ নতুন ৷ চালাত দুবে বলে কোনও এক ব্যক্তি। তার সম্বন্ধে পুলিশ প্রায় কোনও কিছুই জানতে পারেনি । শুধু এটুকু জানা গিয়েছিল যে দুবের বয়েস বেশি নয়।’

‘আর ইউ রেডি টু অর্ডার?’ পরিচারিকা টেবিলে এসে দাঁড়িয়েছে। দুটো মেনু কার্ড সে আগেই দিয়ে গিয়েছিল।

‘আমি রিসোতো খাব।’ গৌতম বলল।

‘আমি র‍্যাভিওলি খাই?’ আদিত্য মেনুর দিকে তাকিয়ে ভেবেচিন্তে জানাল। ‘এনি মীট অর ফিশ ডিশ টু অর্ডার স্যার?’

‘রিভিউটাতে লিখেছিল, এরা ভাল খরগোসের মাংস করে।’ গৌতম পরিচারিকার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ডু ইউ সার্ভ র‍্যাবিট?’

‘ইয়েস স্যার। ইউ মে ট্রাই আওয়ার র‍্যাবিট ক্যাকিতোরি।’

‘এই ডিসটাই তো রিভিউতে রেকমেন্ড করেছিল রে।’ গৌতম উল্লসিত হয়ে বলল। ‘ডু ইউ থিংক ওয়ান অর্ডার কেন বি শেয়ার্ড বাই দ্য টু অফ আস?’

‘ইজিলি স্যার। উইথ দি রিসোতো অ্যান্ড র‍্যাভিওলি ইট উইল বি এনাফ। এনি দোলচে? সুইট ডিস?

‘উই উইল অর্ডার দ্যাট লেটার।’

পরিচারিকা মেনু কার্ড ফেরত নিয়ে চলে গেল। আদিত্য বলল, “তারপর?” ‘তারপর হঠাৎ পুলিশ একটা মেজর লিড পেয়ে গেল অ্যাবাউট দুবে গ্যাং। লিডটা এল ইসমাইলের দলের একজনের থেকে। লোকটা আগে দুবের দলে কাজ করত, পরে ইসমাইলের দলে চলে আসে। চলে এসে, দুবের দলের বেশ কিছু খবর, বিশেষ করে তাদের প্রোকিওরমেন্ট এবং ডিসট্রিবিউশান চ্যানেলগুলো সম্বন্ধে বেশ কিছু ইনফরমেশান পুলিশকে জানিয়ে দেয়। পরে অবশ্য দুবের লোকেদের হাতে লোকটি খুন হয়। কিন্তু ততদিনে পুলিশ যা জানার জেনে ফেলেছে। টু কাট আ লং স্টোরি শর্ট, দুবের দলটা তাদের সমস্ত নেটওয়ার্ক সুদ্ধু ওয়াজ কমপ্লিটলি ডেসট্রয়েড। এই সাকসেস-এর ফলে পুলিশ নিশ্চয় একটা বুস্ট পেয়ে গিয়েছিল, কারণ দুবের দলটা ভেঙে যাবার কিছুদিন পরে পুলিশ ইসমাইলের দলের কয়েকজন চাঁইকেও ধরে ফেলে। ইসমাইল নিজে আবার বিহার-ইউপির দিকে পালিয়ে যায়। পরে সে ওদিকেই আবার ব্যবসা শুরু করে। মোট কথা, এর পরের বছর দু’তিন কলকাতা এবং পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য গণ্ডগোলের জায়গাগুলোতে মোটামুটি শান্তি বিরাজ করেছিল। আর একটা বিয়ার খাবি?’

‘পুরো একটা খেতে ইচ্ছে করছে না। একটা নিয়ে শেয়ার করা যাক।’ ‘সেটাই ভাল।’ গৌতম হাত নেড়ে ওয়েটারকে ডাকল।

গেলাশে বিয়ার ঢালার একটা কায়দা আছে। গেলাশের ওপর দিকের দেয়ালে একটু একটু করে ঢালতে হয়। না হলে ফেনা উপচে পড়ে। আদিত্য মুগ্ধ হয়ে দেখছিল কী অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে ওয়েটার বিয়ার ঢালছে। প্রত্যেক পেশাতেই তার নিজস্ব কিছু দক্ষতা লাগে।

বিয়ারের গেলাশে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে গৌতম আবার বলতে লাগল ৷

‘দুর্ভাগ্যবশত, গত ছ’সাত বছরে আবার একটু একটু করে কলকাতা এবং মফস্বল শহরগুলোতে ড্রাগ পেডেলিং বাড়তে শুরু করেছে। পুলিশ প্রথমে বুঝতেই পারেনি ইসমাইলের দলটাই আবার ফিরে এসেছে, নাকি দুবে আবার নতুন দল নিয়ে আবির্ভূত হল, নাকি এটা সম্পূর্ণ নতুন তৃতীয় কোনও দল। আস্তে আস্তে জানা গেছে দুবেই আবার নতুন দল নিয়ে ফিরে এসেছে। ইসমাইলও ফিরে এসেছে, কিন্তু বাজারের কর্তৃত্ব দুবেরই হাতে। হাসপাতালগুলোর রেকর্ড থেকে বোঝা যাচ্ছে বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে অল্পবয়সীদের মধ্যে, ড্রাগের ব্যবহার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। কিন্তু কীভাবে সেই ড্রাগ তাদের কাছে পৌঁছচ্ছে, অনেক চেষ্টা করেও পুলিশ সেটা বার করতে পারছে না।’

‘তার মানে গ্যাং একাধিক?’ আদিত্য একটা চিনেবাদাম মুখে দিয়ে প্রশ্ন করল। ‘হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম, আমাদের ইনফর্মাররা বলছে মেন গ্যাং একটাই। সেটাই দুবের গ্যাং। গত পাঁচ-সাত বছর এই দলটাই সারা রাজ্যে ড্রাগ পেডলিং-এর বাজারটা কনট্রোল করছে। কিন্তু পেরিফেরিতে আরও দু’চারজন আছে যারা বাজারে ঢুকতে চাইছে। তার মধ্যে ইসমাইলের দলটা সব থেকে বড়। খুচরো আরও দু’একটা আছে । ফলে কনফ্লিক্ট বাধছে। খুন-টুনও হচ্ছে মাঝে মাঝে। গত পাঁচ বছরে আমাদের কয়েকজন ইনফর্মারও খুন হয়েছে। বস্তুত, যে দলটা বাজারের সিংহভাগ দখল করে বসে আছে, তারা অত্যন্ত সাবধানী। আমাদের ইনফর্মেশন, কোনও একটা ভাইটাল খবর যাতে বাইরে না বেরিয়ে যায় তার জন্য এরা নিজেদের দলের কয়েকজনকেও মেরে ফেলেছে। কিন্তু কী সেই ভাইটাল খবর আমরা জানি না। তবে আন্দাজ করা যায় এটা ড্রাগ ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক সংক্রান্ত কোনও তথ্য।’

গৌতম থামল। বিয়ারের গেলাশে চুমুক দিল। আদিত্য চুপ করে আছে। ভাবছে। ভাবতে ভাবতে বলল, “তা আমি এর মধ্যে আসছি কোথায় ? ‘

‘আমরা তোর সাহায্য চাইছি। আমাদের খবর নদীয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যে বর্ডার সেখান দিয়ে ড্রাগটা দেশে ঢুকছে। একবার নদীয়া গিয়ে দেখবি? নদীয়া জেলার একেবারে উপরের টিপটাতে। ওই করিমপুর অঞ্চলে। ওখানে মধুবনা, সাহেবরামপুর, জলঙ্গী, এর কোনও একটা জায়গায়, আমাদের বিশ্বাস, ড্রাগটা প্রসেস করার জন্য ওই গ্যাংটার একটা লুকোনো কারখানা আছে। তোর সঙ্গে সুভদ্রকে দেব। তাতে তোর কাজ করতে সুবিধে হবে। যাবি?”

আদিত্য এখনও ভাবছে। তাকে নিশ্চুপ দেখে গৌতম বলল, ‘আর একটা দরকারি কথা। এক ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলে কিছুদিন আগে ড্রাগ ওভারডোজে মারা গেছে। পশ্চিমবঙ্গে ড্রাগ পেডলিং বন্ধ করার জন্য একটা মোটা টাকা উনি দান করেছেন। একটা কমিটি হয়েছে যার চেয়ারম্যান আমার মেন্টার, দাদা-স্থানীয়, একজন রিটায়ার্ড পুলিশ কমিশানার। এই কমিটি ঠিক করবে টাকাটা কীভাবে খরচ হবে। চেয়ারম্যান আমার ওপর ভার দিয়েছেন একজন ভাল প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটারকে নিয়োগ করতে যিনি পুলিশের সঙ্গে কাজ করবেন। এই কাজের জন্য তোর থেকে যোগ্য আর কে আছে? কমিটির ফান্ড থেকে তোর প্রফেশানাল ফী-টা অনায়াসে দেওয়া যাবে। অতএব তোকে বিনি পয়সায় কাজ করতে হবে না।’

‘গৌতম, আমি টাকা নিয়ে ভাবছি না রে। যদিও সংসার চালানোর জন্যে টাকা আমার সর্বদাই দরকার। খুব বেশি ক্লায়েন্ট পাই না তো। কিন্তু আমি অন্য কথা ভাবছি। তুই আমাকে অশনি রায়ের যে কেসটা নিতে বললি, যেটার জন্যে অশনির বাবার কাছ থেকে আমি টাকা নিয়েছি, সেটার কী হবে? একটা কাজ করতে করতে আরেকটা কাজ ধরলে দুটোই পণ্ড হয়ে যাবার সম্ভাবনা।’

‘ঠিক উলটো। শুধু একটা কাজ নিয়ে চিন্তা করতে থাকলে অনেক সময় চিন্তাটা আটকে যায়। নতুন রাস্তা দেখা যায় না। সেক্ষেত্রে একটা ডাইভারশানের পর, কিছুদিন চিন্তাটা অন্যদিকে চালনা করার পর, আবার পুরোনো কাজে ফিরে এসে দেখা যায় অনেক নতুন সম্ভাবনার কথা মাথায় আসছে। কথাগুলো আমার নয়। কোনও এক বিখ্যাত ফিজিসিস্টের কথা। কোন ফিজিসিস্ট মনে পড়ছে না।’

—তুই আমাকে কাজটা দিলে সেটা স্বজনপোষণ হবে না?’

‘মোটেই হবে না। তোর যা ট্র্যাক রেকর্ড তাতে অনায়াসে প্রমাণ করা যাবে এই কাজটার জন্য তোর থেকে যোগ্য কলকাতায় আর কেউ নেই।’

খাবার এসে গেছে। গৌতম বলল, “এখন তর্কাতর্কি বন্ধ করে খাবারে মন দেওয়া যাক।’

(8)

গৌতম আদিত্যকে বিবাদী-র মোড়ে নামিয়ে দিয়েছিল। আদিত্যই নামিয়ে দিতে বলেছিল। সোমনাথ বাগ যে সরকারি কম্পানিতে কাজ করে সেটা গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের পাশে, একটা বহুতলের পাঁচতলায়। কী বলা যায় লোকটাকে? আদিত্য হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে, কিন্তু তখনও ঠিক করতে পারেনি লোকটাকে কী বলবে।

অফিসে ঢোকার মুখে ইউনিফর্ম পরা সিকিউরিটি। আদিত্য লোকটাকে বলল, ‘সোমনাথ বাগ এসেছে?’ বলেই ভাবল লোকটা নিজেই সোমনাথ বাগ নয় তো? আদিত্যর ভাগ্য ভাল, লোকটা সোমনাথ বাগ নয়। সে বলল, “সোমনাথ? ও তো ক্যান্টিনে ভাত খাচ্ছে।’

‘ক’টা অব্দি ওর ডিউটি?’

‘ওর আড়াইটেতে ডিউটি শেষ হয়ে গেছে। ডিউটি শেষ করে এইমাত্র খেতে ঢুকল।’

‘আপনাদের কত ঘন্টার ডিউটি?’

‘আট ঘন্টার। তবে সপ্তাহে রোজ। মাসে দু’দিন ছুটি। সোমনাথকে ডাকব?’ আদিত্য আন্দাজ করল, সোমনাথ বাগ মফস্বল থেকে ট্রেন বা বাস ধরে কলকাতায় ডিউটিতে আসে। ডিউটি শেষ করে আপিসের ক্যান্টিনে ভাত খায়। তারপর আবার ট্রেন কিংবা বাস ধরে বাড়ি ফেরে।

‘না, না। ডাকতে হবে না। এখান দিয়েই তো বেরোবে। তখন কথা বলে নেব।’ আদিত্য আপিস থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। সামনেই লিফট। লিফট পেরিয়ে একটা জানলা আছে। সেখান থেকে বিবাদীর জনস্রোত দেখা যায়। পাঁচতলা থেকে বেশ লাগে দেখতে। আদিত্য ব্যস্ত বিবাদী বাগের দৃশ্য দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল। সোমনাথ বাগ বেরিয়ে না যায়।

মিনিট পাঁচেক পরে আপিসের সদর দরজা দিয়ে মাঝবয়সী একটা লোক বেরিয়ে এল, তার পেছন পেছন সেই সিকিউরিটি যে আদিত্যর সঙ্গে কথা বলছিল।

‘এই ভদ্রলোক তোর জন্যে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্যর দিকে আঙুল দেখিয়ে সিকিউরিটি বলল। সন্দেহ নেই অন্য লোকটা সোমনাথ বাগ।

‘আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে?’ সোমনাথের কপালে ভ্রুকুটি। ‘আপনার সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে।’ আদিত্য এগিয়ে এসে খানিকটা কড়া গলায় বলল।

“আমার সঙ্গে কী দরকার?’ সোমনাথ বাগের গলাটা একটু কেঁপে গেছে। তাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে।

‘নীচে চলুন, বলছি।’ আদিত্য গলায় কড়া ভাবটা বজায় রেখেছে। ‘বাঙ্গুর এভিনিউ-এর বাড়িটাতে যে খুন হয়েছিল, আবার সেই কেসটা আদালতে উঠছে। পুলিশ আবার আপনাকে ডাকতে পারে।’ আদিত্য লিফট দিয়ে নামতে নামতে বলল।

‘আপনি কি পুলিশ?’

‘আমি পুলিশ নই, কিন্তু পুলিশের সঙ্গে কাজ করে থাকি।’

‘বুঝলাম না। আপনি যদি পুলিশ না হন, তাহলে আপনি কে?’

‘আমি একজন বেসরকারি গোয়েন্দা। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে আমার কোনও ঝগড়া নেই ।’

‘আপনি যদি পুলিশ না হন তা হলে আপনার সঙ্গে আমি কথা বলব না। আমি পুলিশ ছাড়া কারও সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য নই।’ সোমনাথ বাগ যেন হঠাৎ খুব সাহস পেয়ে গেছে।

লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছেছে। লিফট থামতেই সোমনাথ বাগ দরজা খুলে হনহন করে হাঁটা লাগাল। তার নাগাল পেতে গিয়ে আদিত্যকে প্রায় ছুটতে হচ্ছে। ‘সোমনাথবাবু আপনি যদি আজ কথা না বলে চলে যান, কাল আমি পুলিশের সঙ্গে আসব। তখন আপনাকে কথা বলতেই হবে। তার বদলে যদি আজ কথা বলেন তা হলে আপনার সময়ের দাম আমি মিটিয়ে দেব।’ আদিত্যকে গলা তুলে কথা বলতে হচ্ছে। ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ নেই।

সোমনাথ বাগকে বাগে আনতে আরও খানিকটা সময় ব্যয় হল। তার ওপর অর্থব্যয়। পাঁচ হাজার টাকায় রফা হয়েছে সোমনাথ এখনই আদিত্যর অফিসে গিয়ে আদিত্যর প্রশ্নের উত্তর দেবে। টাকাটা অবশ্য অশনি রায়ের বাবাকে বিল করে দেওয়া হবে।

‘আমি আপনাকে কয়েকটা জিনিস জিজ্ঞেস করব। আপনাকে ঠিকঠিক উত্তর দিতে হবে।’ মিনিট পঁচিশ পরে আপিসে নিজের চেয়ারে থিতু হয়ে বসে আদিত্য বলল। ‘মিথ্যে বললে আমি কিন্তু ধরে ফেলব। তখন আপনি এক পয়সাও পাবেন না।’

উল্টোদিকে সোমনাথ বাগ জড়সড় হয়ে বসে আছে।

‘আমার প্রথম প্রশ্ন, তিন বছর আগে, যে সময় ওই খুনের ঘটনাটা ঘটে, কারা কারা তখন বাঙ্গুর এভিনিউ-এর ওই বাড়িটাতে থাকত?’

‘বাড়িটা তখনও পুরো তৈরি হয়নি। বাইরেটায় শুধু প্লাসটার, রঙ-টঙ নেই। ভেতরেও রঙ পুরো হয়নি। প্রাইমার লাগানো। সিঁড়িতে রেলিং বসেনি। অনেক ফ্ল্যাটের ভেতরের কাজও বাকি। এই অবস্থায় বাড়িতে কে থাকবে? তিনতলা অব্দি প্রায় ফাঁকা পড়ে ছিল। শুধু দোতলায় একঘর এসেছে। আর চারতলায় সেন বেকারির দুটো ফ্ল্যাটে লোক থাকত। ৪০১-এ পার্থ মিত্র আর তার ম্যাডাম। আর ৪০২-তে কখনও কখনও কম্পানির কেউ কেউ এসে থাকত। ওই অনেকটা কম্পানির গেস্ট হাউসের মতো । ৪০৩ ফ্ল্যাটটা আধা-তৈরি অবস্থায় ফাঁকা পড়েছিল।’

‘আপনি থাকতে থাকতেই কি ৪০২ আর ৪০৩ ফ্ল্যাট দুটো ৪০১-এর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়?’

‘আমি কম্পানি ছেড়ে দেবার কিছুদিন আগে এটা হয়েছিল।’ ‘আচ্ছা, খুনটা যখন হয় তখন কি কেউ ৪০২ ফ্ল্যাটে ছিল?’

‘এই প্রশ্নটা পুলিশ আমাকে করেছিল। কোর্টও জিজ্ঞেস করেছিল। তাদের যা

বলেছি, আপনাকেও সেটাই বলছি। না, সেই সময় ৪০২ ফ্ল্যাটে কেউ ছিল না।’

‘খুন হবার আগে শেষ কবে ওই ফ্ল্যাটে লোক এসেছিল?’

‘আমার ঠিক মনে নেই। সপ্তাহ খানেক আগে বোধহয় কম্পানির দু’জন কর্মচারি এসে কয়েক দিন ৪০২ ফ্ল্যাটে ছিল।’

“তারা কবে চলে যায়?’

‘যতদূর মনে পড়ছে খুন হবার দিন দুয়েক আগে। এটা তিন দিন বা এক দিনও হতে পারে। জোর দিয়ে বলতে পারছি না।’

‘এবার অন্য একটা প্রশ্ন। আপনি কি ঘটনার দিনটা ছাড়া কখনও অশনি রায়কে দেখেছিলেন? মানে ধরুন দেখলেন, অশনি রায় রাত্তিরে মৃত্তিকা মিত্রকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন। কিংবা কখনও দেখলেন, বাড়ির সামনে থেকে ম্যাডামকে গাড়িতে তুলে নিচ্ছেন। অথবা ধরুন, ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন? এরকম কিছু দেখেছিলেন কখনও ? ‘

‘না দেখিনি।’

‘কখনও দেখেননি? একটু ভাল করে ভেবে দেখুন।’

‘না, দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না…।’

আদিত্যর মনে হল সোমনাথ বাগ কিছু একটা বলতে গিয়েও বলছে না । ইতস্তত করছে।

‘শুনুন, আপনার মনের ভেতর যদি কিছু থাকে বলে দিন। যদি আপনি পুরো নিশ্চিত না হন তাও বলে দিন। ঠিক-ভুল আমি বিচার করব।’

‘ওই যে আপনি বললেন না স্যার, মিথ্যে বললে টাকা দেবেন না, তাই একেবারে নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলতে চাই না।’

‘ওটা আমার কথার কথা। ওটা ভুলে যান। আপনার টাকা আপনি অবশ্যই পাবেন । আপনি যেটা বলতে এত ইতস্তত করছেন সেটা মন খুলে বলুন।’

‘আমার মনে হয়, একবার যেন অশনি রায়ের মতো দেখতে একজনকে মৃত্তিকা ম্যাডামের সঙ্গে দেখেছিলাম। ওই ফ্ল্যাটে নয়। অন্য জায়গায়। পার্ক স্ট্রিট এরিয়ায়। দুপুরবেলা। যেন দেখলাম, দু’জনে এক সঙ্গে হাঁটছেন। তবে এটা নিশ্চয় আমার মনের ভুল। অশনি স্যার মৃত্তিকা ম্যাডামের সঙ্গে কী করবেন?’

‘এটা কি আপনি পুলিশকে বলেছিলেন?’

‘না, না। পুলিশকে কিচ্ছু বলিনি। কারণ আমি নিজেই নিশ্চিত ছিলাম না যেটা মনে হচ্ছে সেটা ঠিক কিনা।’

‘আচ্ছা, মৃত্তিকা মিত্রর স্বামী পার্থ মিত্র কি মাঝে মাঝে কলকাতার বাইরে যেতেন?’ ‘হ্যাঁ, মাসে দু’তিন বার। ট্যাক্সি ডেকে সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে যেতেন, মনে হয় ইস্টেশনে যেতেন। আবার পাঁচ-ছ’দিন পরে ট্যাক্সি করে ফিরে আসতেন।’

‘স্টেশনে যেতেন কী করে জানলেন?’

‘দু’একবার শুনেছিলাম ট্যাক্সিওলাকে ইস্টেশন যেতে বলছেন।’

‘ম্যাডাম কি কখনও ওঁর সঙ্গে যেতেন?’

‘সাধারণত যেতেন না। খুব কালেভদ্রে দু’একবার ম্যাডামকেও ওঁর সঙ্গে যেতে দেখেছি।’

‘পার্থ মিত্র যখন বাইরে যেতেন তখন কি ম্যাডাম একাই বাড়িতে থাকতেন?’ ‘হ্যাঁ, একাই তো থাকতেন।’

‘কখনও মনে হয়েছে ম্যাডামের স্বামী যখন বাইরে তখন ম্যাডাম বাইরে রাত কাটিয়ে সকালে বাড়ি ফিরছেন?’

‘না, না। এরকম আমার কখনও মনে হয়নি।’

‘এবার অন্য একটা প্রশ্ন। ঘটনার রাত্তিরে অশনি রায় কখন ওই ফ্ল্যাটে এসেছিলেন?’ ‘বেশ রাত্তিরে স্যার। ক’টা ঠিক বলতে পারব না। সাড়ে এগারোটা, বারোটা হবে।’ ‘এসে কী বললেন ?

‘উনি সোজা লিফটের দিকে চলে যাচ্ছিলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবেন? উনি বললেন, মৃত্তিকা মিত্রর ফ্ল্যাটে যাব।

‘মৃত্তিকা মিত্রর ফ্ল্যাটে যাব বললেন? নাকি অন্য কিছু বললেন? খুব ভাল করে ভেবে বলুন।’

‘না, না। উনি বললেন, ৪০১ নম্বর ফ্ল্যাটে যাব। আমি বললাম, কার কাছে যাবেন? উনি বললেন, ৪০১-এর ম্যাডামের কাছে যাব। আমি বললাম, এত রাত্তিরে আপনি ম্যাডামের ফ্ল্যাটে যাবেন, ম্যাডাম জানেন? উনি বললেন, ম্যাডামই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বলে লিফট ডাকার বোতাম টিপে দিলেন। আমার উচিত ছিল ওঁর সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া, গিয়ে দেখা উনি কোথায় যাচ্ছেন, ম্যাডাম ওঁকে সত্যিই ডেকেছেন কিনা। কিন্তু গেট ছেড়ে আমি যেতে পারছিলাম না। প্রচুর বিল্ডিং মেটিরিয়াল চারদিকে ছড়িয়ে ছিল, বাড়িটা তো তখনও তৈরি হচ্ছে, তাই গেট ছেড়ে আমি যেতে পারলাম না। উনি একাই উঠে গেলেন।’

‘অশনিকে কি খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল?’

“ঠিক উত্তেজিত নয় স্যার, কেমন যেন নার্ভাস দেখাচ্ছিল।’

‘নার্ভাস?’

হ্যাঁ স্যার। আমি দেখেছিলাম, ওঁর হাত কাঁপছে।’

‘কতক্ষণ পরে উনি নেমে এলেন?”

‘ঘন্টা খানেক হবে। ওঁকে দেখে মনে হচ্ছিল উনি যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছেন।’

‘এবার শেষ প্রশ্ন। আপনি কি জানতেন ফ্ল্যাটের পেছনে একটা সিসি ক্যামেরা আছে? মানে, যে ক্যামেরায় দেখা গিয়েছিল একটা লোক পাঁচিল টপকে পালিয়ে যাচ্ছে? আপনি জানতেন ওই ক্যামেরাটার কথা?’

‘জানতাম। ক্যামেরাটা সব সময় চালানোই থাকত তবে মাঝে মাঝে ওটা খারাপ হয়ে যেত। তখন কোনও ছবি পাওয়া যেত না। আবার নিজের থেকে ঠিকও হয়ে যেত। ঘটনার রাত্তিরে ওটা চালানো ছিল নিশ্চয় কিন্তু আসলে ওটা কাজ করছিল কিনা বলতে পারব না। পুলিশকে আমি বলে ছিলাম ক্যামেরাটার কথা। কিন্তু ওটার কোনও ছবি পুলিশ প্রথমে পায়নি। শুনলাম পরে পাওয়া গিয়েছিল। প্রথমে কেন পাওয়া যায়নি, পরে কী করে পাওয়া গেল, আমি কিছুই জানি না। শুধু জানি, কয়েক বছর পরে ক্যামেরাটা একেবারে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তখন ওটা সরিয়ে নেওয়া হয়। নতুন ক্যামেরা বোধহয় আর বসানো হয়নি।’

‘অনেক ধন্যবাদ, সোমনাথবাবু। আর আমার কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আপনাকে একটু আমার সঙ্গে এই মোড় অব্দি যেতে হবে। ওখানে একটা এটিএম আছে। সেখান থেকে টাকা তুলে আপনাকে দেব। পাঁচ হাজার টাকা ক্যাশ আমার সঙ্গে নেই।’

বাড়ি ফেরার পথে আদিত্য ভাবছিল সোমনাথ অনেকগুলো দরকারি তথ্য দিয়েছে। তবে তার সব কটা অশনি রায়ের পক্ষে যাবে কিনা সন্দেহ।

বাড়িতে ঢোকার আগে আদিত্য রাস্তা থেকে দেখল ঘরে আলো জ্বলছে। কেয়া কি তা হলে ফিরে এসেছে? এত তাড়াতাড়ি ফেরার তো কথা নয়! আজ ন’টা অব্দি কেয়ার কোচিং ক্লাশ থাকার কথা। শরীর খারাপ হল নাকি? ঈষৎ উদ্বিগ্ন হয়ে আদিত্য চাবি ঘুরিয়ে বসার ঘরে ঢুকল। কেয়া মাথা নিচু করে বসে আছে।

‘কী হল? তাড়াতাড়ি ফিরে এলে?’ আদিত্যর গলায় উদ্বেগ।

কেয়া মুখ তুলল। মুখে ক্লান্তির ছাপ।

‘একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়েছে। অমলাদির ছেলে জয় মারা গেছে।’

কয়েক মুহূর্তের জন্য আদিত্য বুঝতে পারছিল না। তারপর মনে পড়ল। ‘দুপুরে স্কুলে অমলাদির কাছে ফোন এসেছিল। ওর ছেলে আবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কোনও এক পড়শি ফোন করেছিল।’

‘কোথায় ছিল ছেলেটা? নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পেয়েছিল?’

‘এক সপ্তাহ আগে ছাড়া পেয়েছিল। এই ক’দিন কাজে যায়নি। বাড়িতেই ছিল।’

“তারপর?”

‘আমরা কয়েকজন অমলাদির সঙ্গে ওর বাড়ি গেলাম। গিয়ে দেখি, ছেলেটার মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। ছেলেটাকে নিয়ে সকলে গেলাম সেই পার্ক সার্কাসের নার্সিং হোমে। তারা তো পুলিশের পারমিশন ছাড়া কিছুতেই ভর্তি করবে না। যাই হোক অনেক কষ্টে শেষ পর্যন্ত ভর্তি করা গেল। কিছুক্ষণ জমে-মানুষে টানাটানি চলল। তারপর সব শেষ। ডাক্তার বলছে ছেলেটা আবার ড্রাগ নিয়েছিল। একটু বেশি মাত্রায় নিয়েছিল। আর সামলাতে পারেনি।’

‘কিন্তু বাড়িতে ড্রাগ পেল কোথায়?’

‘সেটাই তো সব থেকে বড় রহস্য। অমলাদি হলফ করে বলছে ছেলেটা যে ঘরে ছিল সেখানে ড্রাগ লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সত্যি, আমরাও দেখলাম ঘরে শুধু একটা তক্তোপোষ ছাড়া আর কিছু নেই। ঘরের দরজাটাও অমলাদি বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে এসেছিল।’

‘তাহলে পড়শিরা জানল কী করে ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে?’

‘ঘরের একটা জানলা খোলা ছিল। সেই জানলা দিয়ে পড়শিদের কেউ দ্যাখে জয় মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছে। তখন সে অমলাদিকে খবর দেয়।’

‘ওই জানলা দিয়ে ড্রাগটা আসেনি তো?’

‘অমলাদি বলছে সেটা অসম্ভব। অমলাদিদের বাড়িটা তিনতলায়। তিনতলার জানলা দিয়ে ড্রাগটা পৌঁছবে কী করে?’

‘পড়শিরা কেউ পৌঁছে দেয়নি তো?’

‘অমলাদি বলছে সেটা আরও অসম্ভব। পড়শি বলতে একজন বৃদ্ধ আর একজন বৃদ্ধা। তারা জয়কে জন্মাতে দেখেছে। অমলাদির মতোই তারা জয়কে ভালবাসত।’ ‘আমি একবার ওই ঘরটা দেখতে চাই। আজ আর হবে না। কাল সকালে যাব । কড়েয়া থানাকে বলছি আমি যাওয়া অব্দি ঘরটা যেন সিল করে রাখে।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *