৯
পিঠের ব্যাগটা ঠিক করে নিয়ে একবার ঘড়িটা দেখল আদি। প্রায় সওয়া পাঁচটা বাজে। গাড়ি এখনও এল না। এই ড্রাইভারটা নতুন। সপ্তাহখানেক হল জয়েন করেছে ওদের কোম্পানিতে। এমনিতে ছেলেটা ভালই। কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন যেন হয়ে যায়। নাম মল্লার। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স। গোবেচারা ধরনের। গোল মুখ। ফরসা। একটা ভালমানুষ ব্যাপার আছে চেহারায়। আর বই পড়ে খুব। তাও ইংরেজি বই-ই বেশি।
এ মাস থেকে একটা গাড়ি দেওয়া হয়েছে আদিকে। অবশ্য শুধু আদিকেই নয়, মালিনীকেও। আর সেই গাড়িটাই চালায় মল্লার।
আজ ওদের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের থার্ড প্লেস নির্ধারণ ম্যাচ ছিল। ম্যাচটা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার টিমটা জিতে গেছে। ভাল খেলাই হয়েছে। চিফ গেস্ট হিসেবে বাংলার একজন প্রাক্তন রঞ্জি ক্রিকেটারকে আনা হয়েছিল। তিনি যে-গাড়িটায় এসেছিলেন, সেটা ব্রেক ডাউন হয়ে গেছে। তাই অন্য কোনও গাড়ি না থাকায় আদি মল্লারকে গাড়ি দিয়ে পাঠিয়েছে ভদ্রলোককে বাড়িতে পৌঁছে দিতে। তাও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হয়ে গেল। কোথায় গেল ছেলেটা? বিরক্ত লাগছে আদির। আজ এরপর দুটো কাজ আছে। গৌরের গুরুসদয় রোডের বাড়িতে যেতে হবে আর তারপর সেখান থেকে যেতে হবে দমদম এয়ারপোর্টে। পরশু ওদের এই টোয়েন্টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের ফাইনাল। সেখানে প্রাইজ দিতে মুম্বইয়ের একজন স্টার আসবেন।
এই নায়কটি নতুন। এখনও এর স্টারগিরির সামনে ‘সুপার’ শব্দটি বসেনি। কলকাতায় এই ছেলেটির শুটিং আছে। তার ফাঁকে প্রাইজ দিয়ে যাবে। আজ গৌর বলে দিয়েছে যে, আদি আর মালিনী যেন ওকে রিসিভ করে এয়ারপোর্ট থেকে। তারপর যেন হোটেল অবধি দিয়ে আসে। ফলে কাজ আছে আদির। কিন্তু মল্লার যদি বুঝত! নতুন ছেলেদের নিয়ে এই এক প্রবলেম। তারা কাজের গুরুত্ব বোঝে না।
আদির মনটা একটু খিঁচড়ে আছে। অকারণে রাগ করতে ইচ্ছে করছে। চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে মল্লারকে ধরে আচ্ছা করে পেটায়। ও আসছে না বলেই তো এখান থেকে বেরোতে পারছে না। যেতে পারছে না পরের কাজে। ও আসছে না বলেই তো মালিনী এখনও ওই দূরে দাঁড়িয়ে অপদার্থটার সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে!
ব্যাড, ভেরি ব্যাড। মনে মনে একটা গালাগালি দিল আদি। মেয়েটাকে কত বোঝায়, এমন করে যার তার সঙ্গে কথা বলতে নেই। কিন্তু কিছুতেই বোঝে না মালিনী। বলে, ‘অত বাছাবাছি করে আমি মিশি না। যাকে আমার ভাল মনে হয়, তার সঙ্গেই কথা বলি। বুঝেছ?’
বুঝেছে। মালিনী সিংহ কেমন মেয়ে তা এই ক’মাসে যথেষ্ট বুঝেছে আদি। প্রথম দর্শনে যে কোনও মেয়ে এখনকার আদিকে এমন নাড়িয়ে দিতে পারে, তা আদি ভাবতেও পারেনি। স্যামের চেম্বারে মালিনীকে দেখে একদম বোবা হয়ে গিয়েছিল আদি। নিজের সেই ভিতু পনেরো বছরে ফিরে গিয়েছিল যেন। হাঁটু কাঁপছিল ওর। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
সেদিন স্যামের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর স্যামের সেক্রেটারি রায়না বলেছিল, ‘লুক আউট ব্যানার্জি। ডোন্ট ট্রাই ইয়োর ট্রিক্স।’
ট্রিক্স? না, সেসব তো মাথাতেও আসেনি আদির। সত্যি মাথায় আসেনি। যে-আদি পছন্দসই মেয়ে দেখলেই তাকে জামাকাপড় ছাড়া কেমন লাগবে বিছানায় চিন্তা করে নিত, সে কিনা সেসব ভাবেইনি একদম! আর সেখানে রায়না বলছিল যে, ও যেন ওর ট্রিক্স না দেখায়! আশ্চর্য!
স্যামের চেম্বারের বাইরে মালিনীর সঙ্গে প্রথম কথা হয়েছিল টি-কাউন্টারের সামনে। না, আদি খুব একটা চা খায় না। কিন্তু সেদিন যেই দেখেছিল যে, মালিনী কাউন্টারের সামনে গিয়ে চা নিচ্ছে, ও-ও এগিয়ে গিয়েছিল।
‘হাই!’ মালিনীই প্রথম কথা বলেছিল।
‘হ্যালো।’ আদি নিজেই বুঝতে পারছিল যে, ওকে খুব বোকা বোকা লাগছে।
‘ইউ ওয়ান্ট মি টু পোর সাম টি ফর ইউ?’ মালিনী হেসে জিজ্ঞেস করেছিল।
‘দ্যাট উইল বি নাইস।’
‘এখানের চা বেশ ভাল।’ মালিনী যেন কতকটা নিজের মনেই বলেছিল।
‘তা ঠিক।’ মাথা নেড়ে আদি ভাবছিল, কী বলা যায়, ‘তোমার বাংলা তো খুব ভাল। এত ভাল বাংলা শিখলে কোথায়?’
মালিনী হেসেছিল আবার। হালকা বাদামি চোখ, গভীর দুটো টোল আর চকচকে বিজ্ঞাপনের মতো দাঁত। আদি একটু বেশিক্ষণই তাকিয়ে ফেলেছিল।
মালিনী চোখে দুষ্টুমি এনে বলেছিল, ‘আমার মা বাঙালি। শান্তিনিকেতনে পড়েছেন। আমি নিজেও রবীন্দ্রসংগীত গাই। আমার বাবা সিকিমের লোক। তাই হয়তো আমায় দেখলে বোঝা যায় না। কেন, দ্য গ্রেট আদিত্য ব্যানার্জির হঠাৎ আমার অরিজিন নিয়ে চিন্তা কেন?’
‘মানে?’ আদি ভুরু কুঁচকেছিল।
মালিনী হেসেছিল, ‘তোমার যা সুখ্যাতি অফিসে! তুমি নাকি লেডি কিলার। রায়না ওয়াজ অল প্রেয়জ ফর ইউ। তাই বলছিলাম।’
‘ও,’ রাগ হয়েছিল আদির। মালিনীর কান ভাঙানো হয়ে গেছে তা হলে! রায়না তো হেভি খিটকেল। আচ্ছা, অমন ভারী বুক নিয়ে, বিপজ্জনক কাটের ড্রেস পরে আসার পরও যদি কোনও ছেলে সেই দিকে না তাকায়, তা হলে সে কি ছেলে? আর রায়নাকে কি কিছু বলেছে আদি? কিছু করেছে? তা হলে? তা হলে কেন ও মালিনীর কান ভাঙাতে গিয়েছে?
আদি দ্রুত চায়ে চুমুক দিয়ে চা-টা শেষ করে পেপার কাপটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে সরে এসেছিল কাউন্টার থেকে। মালিনী বুঝেছিল ব্যাপারটা। দ্রুত এসে দাঁড়িয়েছিল আদির সামনে। বলেছিল, ‘আরে তুমি তো রাগ করলে দেখছি! আই ওয়াজ জোকিং। দেখো তো, ইয়ারকি মারতে গিয়ে তোমার সঙ্গে প্রথমেই একটা বাজে সম্পর্ক হয়ে গেল!’
আদি তাকিয়েছিল মালিনীর দিকে। সুন্দর মুখটায় বিব্রত ভাব দেখতে ভাল লাগছিল না ওর। নিজের স্বভাববিরুদ্ধভাবে ও বলেছিল, ‘না না, ঠিক আছে। আসলে, নিজের সম্বন্ধে এমন কথা শুনতে কার ভাল লাগে বলো তো? তা ছাড়া রায়না এ কথা বলে কী করে? আমি কোনওদিন কিছু করেছি বা বলেছি ওকে? অমন ওয়র্কপ্লেস-এ সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট যারা করে তারা ঘৃণ্য প্রাণী। আমি তাদের দলে নই।’
‘আরে আরে, ডোন্ট গেট এক্সাইটেড।’ মালিনী আলতো করে আদির কাঁধে হাত রেখেই সরিয়ে নিয়েছিল, ‘শোনো না, আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। লোকে যতই বলুক যে, কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে আমরা রাইভ্যাল, আমরা কিন্তু তা হব না। বরং অন দ্য কন্ট্রারি, উই উইল বি ফ্রেন্ডস। কেমন?’
কোনও সুন্দরী মেয়ে, যাকে তোমার পছন্দ, সে যদি এমন মসৃণভাবে তোমার সঙ্গে কথা বলে, ‘ফ্রেন্ডস’ বলে হাত বাড়ায়, তা হলে জেনো তোমার ভাগ্য হিন্দি ছবির হিরোর বন্ধুর মতো হবে। জেনো, শুরুর আগেই তোমার গল্প শেষ। এসব আদি খুব ভাল জানে। তাই মালিনীর বাড়ানো বন্ধুত্বের হাত দেখে মনের ভেতর দমকলের ঘণ্টা শুনেছিল ও। বুঝেছিল ‘বন্ধু’ বলে আদেখলার মতো হাতটা ধরলে আদির আর ভবিষ্যতে কোনও চান্স থাকবে না।
ও মালিনীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘হ্যাঁ, আমরা রাইভ্যাল নই, ঠিকই। কিন্তু ফ্রেন্ডস কিনা সেটা ভাবতে হবে। মালিনী, আমার খুব একটা বন্ধুর দরকার হয় না।’
‘কী রে শালা, এখনও যাসনি?’ আবেশের আচমকা গলায় ঘোরটা কাটল আদির।
‘কী বলছিস?’ আদি দেখল একটা প্যাকেট থেকে কিছু খেতে খেতে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আবেশ।
‘বলছি, এখনও যাসনি?’
‘না, এবার যাব। দেখ না, মল্লার গাড়িটা নিয়ে গেছে ওই ক্রিকেটার ভদ্রলোককে পৌঁছে দিতে কিন্তু এখনও ফিরছে না। এদিকে ব্যাটার মোবাইলও নেই যে, ধরব। নাঃ, অফিস থেকে ওকে একটা মোবাইলের বন্দোবস্ত করে দিতেই হবে।’ আদি কথা বলতে বলতে আবেশের ঘাড়ের ওপর দিয়ে পিছনে দাঁড়ানো মালিনীকে দেখল আবার। এখনও ওই অপদার্থটার সঙ্গে কথা বলেই যাচ্ছে। কী কথা আছে অমন একটা লুজারের সঙ্গে? তাও এতক্ষণ ধরে! বুকের ভেতর যে-কাঁকড়াবিছেটা এতক্ষণ হুল ফোটাবে বলে হুমকি দিচ্ছিল, সে এবার হুলটা ফুটিয়েই দিল।
আবেশ বলল, ‘শালা, তোরা এমন কিপটে না! দেখ, খাবারের যে-প্যাকেট করেছিস, তার সিঙাড়াটায় গন্ধ। এত বড় একটা কোম্পানি তোদের, সেখানে এমন জঘন্য খাবার মানুষকে কেউ দেয়?’
আদি বিরক্ত গলায় বলল, ‘ওই শালা রুহানটাকে সাউথ কলকাতার টিমে তোকে কে ঢোকাতে বলেছিল বল তো?’
আবেশ একটা মিষ্টির অর্ধেক কামড়াতে গিয়েও স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল আদির দিকে। তারপর খুব ধীরে ধীরে হাসি ফুটল ওর মুখে, ‘ওরে কাকা! এই কেস!’
‘মানে?’ আদি ভুরু কুঁচকে তাকাল।
আবেশ মিষ্টিটা পুরো মুখে ঢুকিয়ে বলল, ‘মানেটা কি তোকে ডিকশনারি দেখে বোঝাতে হবে? শোন, রুহানও তো আমার বন্ধু। ওর টাকার দরকার। ক্রিকেটটা ও একসময় ভাল খেলত। তাই ভাবলাম ওকে প্রস্তাব দিই। কেন, তোর ভাল লাগেনি? ও তোর বন্ধু নয়?’
‘দেখ। রুহান ইজ ফিনিশ্ড। প্রথম ম্যাচটাতে ঝুলিয়ে লাট করল। তারপর তো আর চান্সই পেল না। শুধু মাঠে আসে আর যায়। দেখ না, আজও এসেছে। খেলা নেই ওদের, তবু এসেছে। মালটা পুরো ফ্রাস্টেটেড, হি ইজ নট মাই ফ্রেন্ড এনি মোর।’
আবেশ খাওয়া শেষ করে কায়দা করে প্যাকেটটা একটু দূরে রাখা বিন-এ ফেলে বলল, ‘শালা, চিরকাল স্বার্থপর রয়ে গেলি! নিজেরটা ছাড়া আর কিছু বুঝিস না, না? মালিনীকে তোর ভাল লাগে আর সেই মেয়েটা রুহানের সঙ্গে গল্প করছে দেখে তোর জ্বলছে! মালিনীকে নতুন ছক করছিস নাকি? সাবধান কিন্তু। দেখিস, এ তোর ওইসব মেয়েদের মতো নয় কিন্তু।’
‘আঃ,’ বিরক্ত লাগল আদির, ‘সব সময় নোংরামো না তোর? আমি মোটেই ওভাবে দেখি না মালিনীকে। বাজে কথা বলবি না।’
‘তাই?’ আবেশ হাসল, ‘বিড়াল বলে, মাছ খাব না। শোন, রুহানকে তো চিনিস। আতাক্যালানে টাইপ। ওর যে প্রেমিকা ছিল না? সেই যে রে নন্দা। তাকেও শালা কোনওদিন কিছু করেনি। তাই হয়তো মেয়েটা ওকে লাথ মেরে বের করে দিয়েছিল জীবন থেকে। ওকে যখনই এই নিয়ে জিজ্ঞেস করি মালটা চুপ করে যায়। শোন না, তুই টেনশন করিস না। আর দেখ না, পরশুর ম্যাচটার পর কোথায় রুহান, কোথায় মালিনী। দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ইয়োর্স ব্রাদার।’
আদি কিছু না বলে শুধু শব্দ করল মুখ দিয়ে। হুঁঃ, পৃথিবী নাকি ওর?
আবেশ এবার কাছে এল আরও। চাপা গলায় বলল, ‘শোন না, একটা মেয়ে আছে। একটু গরিব বাড়ির। কিন্তু ভাল। মাসাজ পার্লারে কাজ করে। টাকার দরকার। প্রাইভেটেও মাসাজ করতে রাজি। তুই দেখবি একবার?’
আদি হাত দিয়ে আলতো ধাক্কায় সরিয়ে দিল আবেশকে, ‘সবসময় ফালতু কথা বলবি না। মটকা গরম আছে, মনে রাখিস এই কাজটা কিন্তু তুই আমার জন্যই পেয়েছিস। ফারদার নোংরামো করবি তো…’
আবেশ খিকখিক করে হাসল, ‘বাব্বা, কাকা যে পুরো খেপে গিয়ে লাল হয়ে গেছে! এর আগে এমন মেয়েদের সঙ্গে তোর যোগাযোগ করিয়ে দিইনি? যাক গে, তোর যখন ইচ্ছে নয় তখন বাদ দে। আর হ্যাঁ, মাইরি এই টুর্নামেন্ট তো শেষ। এরপর কী করব বল তো? ওই গৌর স্যারকে বলে আর একটা কিছু করে দে না ভাই, না হলে খুব বাজেভাবে কেস খেয়ে যাব। জানিসই তো, মামার বাড়িতে অমানুষ আমি। মামি মালটা খুব বিষাক্ত। ভাতের সঙ্গে এমন এমন খিস্তি দেয় না যে, আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। ভাই, এরপর কিছু একটা করে দিস প্লিজ।’
আদির অবাক লাগে মাঝে মাঝে। এ ছেলেটা সত্যিই খুব অদ্ভুত। গালাগালি করো, মারো, বকো, কিছুতেই রাগ করে না। ভুলভাল কাজের সঙ্গে সমানভাবে ইয়ারকি ফাজলামো করে যায়। কোনও কিছুতেই যেন গা করে না।
‘স্যার, এই যে, আমি এসে গেছি।’ এই ডিসেম্বরেও ঘেমে স্নান করে এসে মল্লার দাঁড়াল সামনে। আদি দেখেই বুঝল খুব নার্ভাস হয়ে আছে ছেলেটা। রীতিমতো টেনশনে কাঁপছে ও। ফরসা মুখটা লাল হয়ে আছে একদম। ভেতরে ভেতরে রাগ হলেও আদি এখন ওকে দেখে আর তেমন রাগ করতে পারল না। তবু, সাব-অর্ডিনেটদের চাপে রাখতে হয় সবসময়। কর্পোরেট জগতের এটাই হল প্রথম পাঠ।
আদি গম্ভীর গলায় বলল, ‘তোমার এত দেরি হল কেন?’
‘সরি স্যার… আমি ইয়ে…’ মল্লার তোতলাতে লাগল ভীষণভাবে।
‘আমি কী? জানো না আমার কাজ আছে? ক’দিন হল কাজে জয়েন করেছ? এরই মধ্যে এসব শুরু করে দিয়েছ?’ আদি গলার স্বরটা রুক্ষ করল আরও।
‘আই সোয়্যার স্যার। আমি ইচ্ছে করে করিনি। পুলিশ ধরেছিল আমায়।’
‘পুলিশ?’ আদি অবাক হল।
‘আমার সিট বেল্ট বাঁধা ছিল না তাই… আমার লাইসেন্স রেখে দিয়েছে স্যার।’ মল্লার কাঁচুমাচু গলায় বলল।
‘এত বেখেয়াল কেন তুমি? আননেসেসারি আমার দেরি হয়ে গেল। গৌর স্যার জিজ্ঞেস করলে কি বলব যে, তুমি ইনএফিশিয়েন্ট বলে এমন হল?’ আদি গলার রুক্ষতা বজায় রেখে বলল।
‘না স্যার, প্লিজ স্যার এমন করবেন না। প্লিজ।’ মল্লার কেঁদে ফেলল প্রায়।
‘ঠিক আছে যাও। গাড়িতে গিয়ে বোসো।’
মল্লার মাথা নিচু করে চলে যাওয়াতে মনে মনে হাসল আদি। ছেলেটা খুব নার্ভাস। বকা খেলে আরও নার্ভাস হয়ে পড়ে। তার সঙ্গে একটু বোকাও আছে। গৌর রওশান দিওয়ান ডাইরেক্টর। সে একটা ড্রাইভার কী করল না করল তা নিয়ে মাথা ঘামাবে? পাগল নাকি?
মল্লার চলে যেতে আবেশ অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘এ কে রে? কোত্থেকে জোগাড় করেছিস? এ তো বার্নার্ড শ’! এমন ইংরেজি বলা ড্রাইভার বাপের জন্মে দেখিনি। ও গাড়ি চালাচ্ছে কেন?’
আদি বলল, ‘তা আমি জানব কেমন করে? নিশ্চয়ই কোনও গল্প আছে।’
‘তা জিজ্ঞেস করিসনি?’
‘অত কৌতূহল আমার নেই। ড্রাইভারের হাল হকিকত জিজ্ঞেস করব! একটা ক্লাস বলেও তো ব্যাপার আছে। নাকি?’
‘আরে, তোদের গাড়ি চালায়। ভদ্র, শিক্ষিত ছেলে, তাকে জিজ্ঞেস করলে দোষ কোথায়? ড্রাইভার বলে কি মানুষ নয়?’
‘ওসব ফালতু ভাষণ রাখ।’ আদি আর একবার দূরে তাকাল। এখনও কথা বলে যাচ্ছে ওরা! কী আশ্চর্য! মালিনী কেন করছে এমন?
আবেশ আর কথা বাড়াল না। বলল, ‘আমার ব্যাপারটা একটু মাথায় রাখিস। আবার কুকুর ধরতে যেতে পারব না ভাই। কেমন? ঠিক আছে, তোরা এগো। আমি কাটি।’
আবেশ চলে যেতেই মালিনীও এগিয়ে এল এবার। আর ওর সঙ্গে সঙ্গে এল রুহান। আদি চোয়াল শক্ত করল। এতক্ষণ খোশগল্প করেও শখ মেটেনি? আচ্ছা বেহায়া তো রুহানটা!
মালিনী কাছে আসতেই আদি কড়া গলায় বলল, ‘এতক্ষণ ওয়েট করছি! কী করছিলে কী? স্যার তো এবার আমায় ঝাড় দেবেন।’
মালিনী ওর টোল পড়া হাসিটা হাসল। বলল, ‘বাহ্ রে, তুমিই তো এতক্ষণ আবেশের সঙ্গে গল্প করছিলে দেখছিলাম। তাই তো আমি রুহানকে আমাদের ওল্ড এজ হোমটার কথা বলছিলাম। রুহান আমায় বলল যে, এবার থেকে ও-ও আমার সঙ্গে রোববার করে যাবে হোম-এ।’
আদি রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোদের ফাইনাল তো পরশুদিন। আজ কী করছিস এখানে? অফিস-কাছারি নেই? শুনলাম কোন একটা চাকরি পেয়েছিস নাকি? তা, চাকরি রাখার ইচ্ছে আছে তোর?’
রুহান এমন আচমকা আক্রমণে থতমত খেল সামান্য। তবু যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলল, ‘না, আমার তো তেমন কাজ থাকে না। তাই, কাছেই বাড়ি বলে চলে আসি। তোকে মাঝেমধ্যে দেখি। কিন্তু এত ব্যস্ত থাকিস বলে কথা হয় না।’
মালিনী বলল, ‘আদি সব সময় ব্যস্ত। তবে সব ম্যাচে তো আর আসতে পারে না। আজ থার্ড পজিশনের খেলা বলে আমরা এসেছি।’
রুহান বলল, ‘সেই তো বলছি। তা কেমন আছিস রে আদি? কাকু-কাকিমা কেমন আছেন? বহুদিন খবর পাই না।’
‘কেন? খবর পাস না কেন? দাদাভাইয়ের সঙ্গে তো তোর যোগাযোগ ছিল।’
‘তা ছিল। তবে সেটাও প্রায় মাস চারেক হয়ে গেল। তুই জানিস কিগানদা কোথায় গেছে?’
‘কেন, তোর কাছে দাদাভাইয়ের মোবাইল নম্বর নেই? ফোন করে খবর নিতে পারিস না? সবসময় এমন প্রশ্ন করে, তুই যে কনসার্ন তা বোঝাতে চাস কেন? তোর এই ভড়ংবাজি অনেক দেখেছি। যারা দেখেনি তাদের দেখা।’ আদি গুলি করার মতো করে কথাগুলো বলে দিল।
রুহান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইল শুধু।
মালিনী চট করে বলল, ‘ও কে রুহান, তোমার মোবাইল নম্বর তো নিয়ে নিলাম। শনিবার তোমায় ফোন করে রোববার কখন যাব সেটা ঠিক করে নেব, কেমন? তুমি কিন্তু রোববারটা ফ্রি রেখো। আমরা এবার আসি।’
প্রিয়া সিনেমার সামনে গাড়িটা রাখা ছিল। আদি আর মালিনীকে দেখে মল্লার চটপট দরজাটা খুলে দিল।
গাড়িটা ছোট হলেও নতুন। খুবই আরামদায়ক। প্রথমে মালিনী উঠে বসল। তারপর আদি উঠে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। মল্লারকে বলল, ‘গুরুসদয় দত্ত রোড চলো। স্যারের বাড়ি।’ তারপর জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
সন্ধে হয়ে গেছে এখন। ছ’টার শোয়ের ভিড়ে থিকথিক করছে জায়গাটা। গাড়িটা এগিয়ে নিয়ে যেতে মল্লার বেগ পেল বেশ। তারপর মনোহরপুকুর দিয়ে হাজরা রোডের দিকে গাড়ি ছোটাল ও। আদি একবারও তাকাল না মালিনীর দিকে। ও বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। আর তার মাঝেই শুনল মালিনী ফোন বের করে ডায়াল করল। কারও সঙ্গে কথা বলবে। আদি আরও বিরক্ত হল। ও যে রাগ করেছে, সেটা কেন বুঝতে পারছে না মালিনী?
‘হ্যালো জিয়ানাদি, হাউ আর ইউ?’
মালিনীর গলায় নামটা শুনে নড়েচড়ে বসল আদি। আরে, জিয়ানা বোসের সঙ্গে মালিনীর কী কথা থাকতে পারে? প্রোজেকশন কর্পে, ভাল পদেই আছে জিয়ানা। তিরিশের ওপর বয়স ভদ্রমহিলার। সামান্য মোটার দিকে। দেখলে বোঝা যায় যে, এককালে বেশ সুন্দরী ছিল।
প্রোজেকশন কর্প, চাপাডাঙায় ওদের যে নতুন ফ্রুট জুস আর মিনারেল ওয়াটারের প্রোজেক্ট আসছে তার জন্য কোট করছে। তাই জিয়ানা ওদের অফিসে মাঝে মাঝেই আসে। একটা নামী কনসালটেন্সি ফার্মকে এই কাজটার টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট হিসেবে রেখেছে গৌর। কনসালটেন্সি ফার্মটার ঠিক করে দেওয়া টেকনিক্যাল লাইন ধরে সবাইকে কোট করতে হবে।
কাজটার জন্য সারা ভারত থেকে ছ’টা কোম্পানি এসেছে। তাদের মধ্যে জিয়ানা বোসদের প্রোজেকশন কর্পও রয়েছে। আসলে প্রোজেকশন কর্পের বেশ কিছু সিনিয়র সেল্স ইঞ্জিনিয়ার একসঙ্গে রিজাইন করে ওয়াটার বার্ড কোম্পানিতে জয়েন করেছে। এই ওয়াটার বার্ড চেন্নাইয়ের কোম্পানি। এখন ইস্টার্ন ইন্ডিয়ায় ব্যাবসা করতে চাইছে। জীবনদীপের কাছে অফিসও নিয়েছে ওরা। এই চাপাডাঙার কাজটা পাওয়ার চেষ্টা ওয়াটার বার্ডও করছে।
আদির কাছে সব পার্টিই সমান। ওর কাজ হল এইসব কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কাজ নিয়ে যা কথাবার্তা হয়, তা যাতে মসৃণভাবে হয়, তা দেখা। মার্চেন্ট মাল্টিপল্সের ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশন আর পারচেজের সঙ্গে এইসব পার্টির কোঅর্ডিনেশন বজায় রাখতে গিয়ে আদি সবসময় নিজেকে নিরপেক্ষ রাখার চেষ্টা করে। ও জানে যে, এখানে এক্সট্রা টাকাপয়সা খাওয়ার জায়গা নেই। কারণ, ওর হাতে কিছুই নেই। তাই পক্ষপাতহীন অবস্থান নিতে ওর সুবিধে হয় খুব।
মালিনীরও তো তাই অবস্থান হওয়া উচিত। ওর তো জিয়ানাকে মিসেস বোস বলে একটা বিক্রিয়াহীন দূরত্বে রাখা উচিত। কিন্তু কাউকে এমনভাবে ফার্স্ট নেম-এ দিদি বলে ডাকাটা খুব অপেশাদারি হয়ে যাচ্ছে না? গৌর শুনলে কিন্তু বেশ রেগে যাবে!
আদি জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেও কানটা রাখল মালিনীর দিকে। ও শুনল, মালিনী সেই ওল্ড এজ হোম নিয়েই কথা বলছে। সামনের রোববার জিয়ানাকেও যেতে বলছে।
ভুরু কুঁচকে গেল আদির। মালিনী তো কোনওদিন আদিকে বলে না কিছু এই নিয়ে! কেন বলে না? আর এসব ওল্ড এজ হোম টোম করে কী হয়? যত সব ফালতু কাজকম্ম!
ফোনটা রেখে মালিনী ব্যাগ থেকে একটা চকোলেট বের করে আলতো খোঁচা দিল আদির হাতে, ‘খাবে?’
‘কী?’ আদি মুখ ফিরিয়ে বলল।
মালিনী বলল, ‘চকোলেট। খাও না?’
‘না।’ ছোট্ট করে জবাব দিল আদি।
‘কেন?’ মালিনী অবাক হল।
আদি দেখল বাঁ দিকে শিশুমঙ্গল হাসপাতাল আর তার সামনের সিগনালে গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। সামনে পিছনে অসংখ্য গাড়ির লাল-হলুদ আলো পিটপিট করছে। আদির এক মুহূর্তের জন্য মনে হল মানুষের চেয়ে কি এখন গাড়ির সংখ্যা বেশি এ শহরে? এত গাড়ি রাত হলে কোন সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়ে? তখন তো রাস্তা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকে একদম। আচ্ছা, অতিরিক্ত ব্যবহারের পর কি সব কিছুই এমন পরিত্যক্ত হয়ে যায়? তাই কি মালিনীদের ওল্ড এজ হোমের কথা বলতে হয়?
মালিনী আবার বলল, ‘কী হল? খাবে না?’
‘হঠাৎ? আমায় খেতে বলছ!’ আদি গোমড়া মুখে জিজ্ঞেস করল।
‘হঠাৎ নয়,’ মালিনী ওর বিপজ্জনক হাসিটা দিল, ‘আই হ্যাভ সামথিং টু আস্ক ইউ। আ ফেভার। করবে?’
‘তার জন্য চকোলেট দিতে হবে?’
‘না, রায়না বলেছে যে, তুমি নাকি ক্যাশ বা কাইন্ডসের প্রতি দুর্বল।’ মালিনী হাসিটা বাড়িয়ে দিল কয়েক ঘর।
‘মানে?’ আদি প্রায় ছিটকে গিয়ে ঘুরে বসল, ‘রায়না বলেছে যে, আমি ঘুষ খাই? তুমি জানো ও গৌর স্যারের সঙ্গে কখন কখন, কোথায় কোথায়…’
মালিনী আচমকা আদির হাতে চিমটি কেটে থামিয়ে দিল ওকে। আদি দেখল গাড়ির আবছা অন্ধকারের ভেতর মালিনী চোখ দিয়ে ইশারা করে সামনে বসা মল্লারকে দেখাল।
আদি সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল একদম। সত্যি রাগের মাথায় ও একটা ভুল করতে যাচ্ছিল। ও ঠোঁট কামড়ে বাইরের দিকে তাকাল আবার।
মালিনী বলল, ‘আমি কলকাতায় গ্র্যানির সঙ্গে থাকি। সি ইজ সিক। আই নিড টু অ্যাটেন্ড হার ফ্রম সেভেন ও’ক্লক। আমাদের সন্ধের আয়াটা আসবে না আজ। তাই বলছিলাম যে, গৌর স্যারের বাড়িতে যদি আমি না যাই, তুমি স্যারকে একটু ম্যানেজ করে নিতে পারবে না?’
‘তোমার গ্র্যানি অসুস্থ?’ কথাটা বলেই নিজের কানে খট করে লাগল আদির। একটু বেশি কনসার্ন দেখিয়ে ফেলছে কি?
‘হ্যাঁ। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। সকালের আয়া আজ সাতটায় চলে যাবে। তাই বলছিলাম আর কী?’
‘ঠিক আছে,’ আদি বলল, ‘তা কোথায় নামাব তোমায়?’
‘একটু যদি কষ্ট করে বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে ড্রপ করে দাও।’ মালিনী দ্বিধার সঙ্গে বলল।
‘এতে কষ্টের কী আছে?’ আদি ঘুরে বসল, ‘বলো না তোমার বাড়ি অবধি দিয়ে আসব। কোনও অসুবিধে হবে না।’
‘না না,’ মালিনী যেন গুটিয়ে গেল একটু, ‘বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে ওই ধাবার সামনে নামিয়ে দিয়ো, তা হলেই হবে। আমি হেঁটে চলে যাব।’
‘ভয় পাচ্ছ?’ আদি সামান্য ব্যঙ্গের গলায় বলল, ‘তোমার বাড়ি চিনতে দেবে না? আমি যদি খারাপ কিছু করি, তাই না?’
‘না না,’ মালিনী অপ্রস্তুত হল, ‘আরে আমার বাড়ি ভিতর দিকে। তোমার ফালতু টাইম ওয়েস্ট হবে। স্যার রাগ করবেন। তার চেয়ে এই ভাল।’
আদি গম্ভীর গলায় বলল, ‘ঠিক আছে। যেমন তোমার ইচ্ছে।’
বালিগঞ্জ ফাঁড়িটা এখান থেকে কাছে। কিন্তু সেখানেও প্রচুর জ্যাম। এই সন্ধের দিকে কি হঠাৎ করে গাড়ি বেড়ে যায় বাইরে? এই রাস্তার মোড়টা কাটাকুটির মতো। প্রচুর গাড়ি। প্রচুর হর্ন। তার আলো, হইচই, সব মিলিয়ে মানুষের নিজেরই হারিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। মালিনী সিগনালে গাড়ি থামামাত্র নেমে ওই পাঁচমিশেলি ভিড়ে মিলিয়ে গেল। আদি অবাক হয়ে দেখল, মেয়েটা পিছনে ফিরে তাকাল না পর্যন্ত!
বুকের ভেতরে কে যেন খুব জোরে গিট বাঁধল একটা। আদির অবিকল সেই যাজ্ঞসেনী আইয়ারের সময়কার মতো মনে হল নিজেকে। বহু বহু দিন পরে আবার তেমন কষ্ট হল ওর। মনে হল পৃথিবীর কেউ ওর কথা চিন্তা করে না।
প্রয়োজন নেই। চিন্তা করার প্রয়োজন নেই একদম। আদি দাঁত চেপে সংযত করল নিজেকে। মেয়েরা চিরকাল এমন হয়। নিষ্ঠুর একটা ফাঁদের মতো, ভেঙে যাওয়া বৃষ্টির স্বপ্নের মতো, হারিয়ে যাওয়া রুবিগুলির মতো। মেয়েরা কোনওদিন নিজেদের বাদ দিয়ে কিচ্ছু দেখতে পায় না। আদি অন্য দিকে তাকিয়ে রইল।
অল্প অল্প হাওয়া দিচ্ছে এখন। শীত শীত করছে আদির। সকালে তেমন ঠান্ডা ছিল না বলে স্রেফ একটা ফুলহাতা শার্ট পরে বেরিয়েছিল। কিন্তু এখন ঠান্ডা লাগছে অল্প। ও রাস্তার পাশের বড় বড় গাছগুলো দেখল। নেড়া। কঙ্কালের মতো। আর তার ফাঁক দিয়ে একফালি পাতিলেবুর মতো চাঁদ পড়ে রয়েছে আকাশে।
আর ঠিক তখনই গাড়িটাকে দেখল আদি। অফ হোয়াইট রঙের। নিচু। সোনালি প্লেটিং-এ লেখা নাম। হালকা নীলচে কাচ। আর সেই গাড়ির সামনের সিটে বসে রয়েছে দিঘি!
সোজা হয়ে বসল আদি। এমন একটা গাড়িতে কার সঙ্গে বসে রয়েছে দিঘি? ওর সেই বয়ফ্রেন্ডটার সঙ্গে কি?
ছেলেটাকে একবার-দু’বারই দেখেছে আদি। পাড়াতেই দেখেছে। লম্বা, ফরসা। আলুভাতে মার্কা। নামধাম কিচ্ছু জানে না। তবে দেখলেই বোঝা যায় যে, পয়সাওয়ালা বাপের ছেলে। মনে মনে হাসল আদি। ভালই পাকড়েছে দিঘি। দাদাভাইয়ের মাথা খেয়ে, বদনাম করে এখন ভালই ঘুরে বেড়াচ্ছে দামি গাড়ি চেপে। সত্যিই মেয়েরা পারে বটে। আদির কষ্ট হল দাদাভাইয়ের জন্য। এই মেয়েটার জন্য কী না শুনতে হয়েছে দাদাভাইকে! ওর বাবা-মা তো যা নয় তাই বলেছে। বাবা তো নিজের জুতো ছুড়ে মেরেছে পর্যন্ত দাদাভাইকে। তবু দাদাভাই দিঘির বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। সব কিছু সহ্য করে গেছে মুখ বুজে। টুঁ শব্দ পর্যন্ত করেনি। দাদাভাই তো বলতেই পারত। অনেক কথাই বলতে পারত। কিন্তু না, বলেনি। কিচ্ছু বলেনি। সব মুখ বুজে সহ্য করে গেছে। যেন সব দায় ওর। সব দোষ ওর। কলঙ্ক, পুলিশে দেওয়ার ভয়, সব মাথায় নিয়ে চলে গিয়েছিল বাড়ি থেকে। কেন গিয়েছিল দাদাভাই? কেন মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটাও করেনি? কার জন্য চুপ করে ছিল ও?
দাদাভাই বরাবরই এরকম। জ্ঞান হওয়ার থেকে দাদাভাইকে অমন ভাবেই দেখে এসেছে। আদি ছোটবেলায় দুষ্টুমি করত আর দোষ চাপাত দাদাভাইয়ের ওপর। সে পাশের বাড়ির কাচ ভাঙা থেকে শুরু করে ফ্রিজ খুলে মিষ্টি চুরি, সবেতেই দাদাভাইয়ের নামটা সামনে এগিয়ে দিত আদি। বাবা আর মা বেদম বকত দাদাভাইকে। ঠাকুরমা সামনে না থাকলে তো চড়চাপ্পড়ও লাগিয়ে দিত। কিন্তু তবু দাদাভাই কিছু বলত না। শুধু মার খাওয়ার পর চিলেকোঠার ঘরে চলে যেত একা। আর আদি দূর থেকে দেখত চিলেকোঠার জানলা দিয়ে দূরে, বহু দূরে তাকিয়ে রয়েছে দাদাভাই। কী দেখত দাদাভাই? বাইরে থেকে তো শুধু আকাশ দেখা যেত। তা হলে আকাশে কি কিছু খুঁজত দাদাভাই? কাকে খুঁজত আকাশে? চিলেকোঠার ঘরটা খুব প্রিয় ছিল দাদাভাইয়ের। সারা ঘরে স্তূপ করা ভাঙা ফার্নিচার, ধুলো-ঢাকা রেডিয়োগ্রাম, পোর্সেলিনের বাসনপত্তর, হরিণের শিং, বহু পুরনো কালো কম্বল ঢাকা ক্যামেরার সরঞ্জাম আর হাজারও কৌটোকাটির ভেতর নিজের মতো করে একটুখানি জায়গা করে নিয়েছিল দাদাভাই। মনখারাপ হলেই চিলেকোঠায় গিয়ে ওই জায়গাটায় বসে থাকত।
বছরখানেক হল চিলেকোঠা ভেঙে নতুন করে একটা বড় ঘর তৈরি করা হয়েছে। দাদাভাই মৃদু আপত্তি করেছিল। বাবা পাত্তা দেয়নি। আচ্ছা, তাই এবার কি কষ্ট পাওয়ার পর আর চিলেকোঠায় ওই জায়গাটা না পেয়ে একদম বাড়ি ছেড়েই চলে গেছে দাদাভাই?
আদি সন্ধের কলকাতার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজকাল এত দাদাভাইয়ের কথা মনে পড়ে কেন ওর? যে-মানুষটার সঙ্গে স্কুলজীবন অবধি অত সখ্য ছিল তার থেকে তো স্বেচ্ছায় নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল আদি। তা হলে, এখন দাদাভাই চলে যাওয়ার এতদিন পরে কেন এমন মনখারাপ হচ্ছে আদির? এমন চূড়ান্তভাবে কেন মনে পড়ছে ওই মানুষটাকে? তা হলে কি চলে গিয়েই মানুষ প্রকৃতপক্ষে একদম সরে আসে কাছে? তা হলে কি হারিয়ে ফেলার পরই বোঝা যায় জীবনের আসল গুরুত্ব? মানুষের আসল গুরুত্ব?
ছোটবেলায় না বুঝলেও এইট-নাইন থেকেই আদি বুঝত কেন বাবা-মা পছন্দ করে না দাদাভাইকে। সম্পত্তি। সমস্ত কিছুর মূল ছিল সম্পত্তি। এই বিরাট দোতলা বাড়ি। লোহার যন্ত্রপাতি তৈরির বিশাল কারখানা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সুন্দরবনের কাছে প্রচুর জমিজায়গা। ওই সবই ছিল দাদাভাইয়ের প্রতি বাবা-মায়ের খারাপ ব্যবহারের উৎস। ঠাকুরমার সামনে বাবা-মা কিছু বলতে পারত না দাদাভাইকে। কিন্তু আড়ালে খুব খারাপ খারাপ কথা বলত বাবা। বাবার মুখ খুব খারাপ। মাঝে মাঝেই বেজন্মা বলে গাল দিত দাদাভাইকে। অবশ্য শুধু দাদাভাইকেই নয়। বাবা রেগে গেলে সবাইকেই এমন অশ্রাব্য গালাগালি করত। তবে দাদাভাইকে খারাপ কথা বলার সময় মাঝে মাঝে মা-ও যোগ দিত। খুব খারাপ লাগত আদির। দাদাভাইয়ের কষ্টের মুখটা দেখলে মনে মনে দমে যেত ও। তবু মা ভাল রান্না করলে লুকিয়ে লুকিয়ে দাদাভাইকে এনে দিত আদি। দাদাভাই দিতে বারণ করত। বলত, ‘অশান্তি হবে, তুই যা আদি।’ তবু আদি শুনত না। ছোট থেকেই আদি জেদি, বাবা-মায়ের বকা বা মারের পরোয়া করত না বিন্দুমাত্র।
বাবা মাঝে মাঝে ঠাকুরমার কাছে গিয়েও দরবার করত। বলত, ‘এই ছেলেটাকে তুমি পুষছ কেন? একে কোনও হস্টেলে বা অরফ্যানেজে দিয়ে দাও।’
ঠাকুরমা বলত, ‘কেন? ও তোদের কী অসুবিধে করছে?’
বাবা গম্ভীরভাবে বলত, ‘দাদা যখন মেম বিয়ে করল, তোমার মনে নেই দাদা কী বলেছিল? বলেছিল, ও আর কোনওদিন এ বাড়িতে আসবে না।’
‘তো? ও তো আসেওনি!’
‘কিন্তু ওর ছেলেকে তুমি নিয়ে এসেছ কেন? আমাদের বংশের মর্যাদা নেই?’
‘বংশমর্যাদার কথা তোকে ভাবতে হবে না। এই যে রাত করে মদ খেয়ে ফিরিস, ঘোড়ার লেজে টাকা বাঁধিস, এতে কি বংশের মর্যাদা বাড়ে ভেবেছিস? বেশি সতীপনা দেখাস না। একটা বাচ্চা ছেলে, বাবা-মা নেই, কোথায় তাকে আগলে রাখবি! না, তার সঙ্গে এমন শত্রুতা করিস সবসময়! তোর গায়ে মানুষের রক্ত নেই?’
বাবা তবু গজগজ করত। বলত, ‘কোথাকার কে! উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। ম্লেচ্ছ রক্ত গায়ে। এটা তুমি ঠিক করছ না মা।’
‘শোন,’ ঠাকুরমা তখন সবচেয়ে রাগী গলাটা বের করে আনত। বলত, ‘তোকে বেশি দালালি করতে হবে না। তোর তো সম্পত্তির ভাগ নিয়ে চিন্তা! সব ঠিকমতোই ভাগ করে দেব আমি। আর এ নিয়ে একটা কথা বেশি বললে ফুটো পয়সাও পাবি না, বুঝলি? এখন দূর হ এখান থেকে।’
বাবা দূর হলেও, নিজের অ্যাজেন্ডা থেকে সরত না। হয় কি নয় হেনস্থা করত দাদাভাইকে। খারাপ কথা বলত। অপমান করত। আর সামান্য সুযোগ পেলে তো রীতিমতো মারত। এ সবকিছুই মুখ বুজে সহ্য করত দাদাভাই।
গুরুসদয় দত্ত রোডের গৌরের বাড়িটা দুর্গের মতো। একটা বড় গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার পর, আর-একটা বড় গেট। তাতে আবার দু’জন দারোয়ান। গৌর নিজে হাসিখুশি হলেও দারোয়ানগুলো হাসলে বোধহয় মাইনে কেটে নেয়। গাড়িটা বাড়ির গেট দিয়ে ঢোকার পর আদির সংবিৎ ফিরল।
আদি এর আগেও এই বাড়িতে এসেছে। দারোয়ানগুলো চেনা। আদি গাড়িটাকে বাইরে রেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সামনে। আর ঠিক তখনই ওকে পিছন থেকে ডাকল মল্লার, ‘স্যার।’
বিরক্ত হল আদি। ওর আবার কী দরকার? ও তবু ঘুরল, ‘কী হয়েছে?’
‘স্যার, আপনি ডাইরেক্টর সাহেবকে বলবেন না তো?’
‘কী বলব না?’
‘এই স্যার গাড়িটার লেট হওয়া, আমায় পুলিশে ধরার ব্যাপারটা! বলবেন না তো?’
আদির এই প্রথম হাসি পেল। মল্লারের ফরসা গোলগাল মুখটা দেখে খারাপ লাগল হঠাৎ। মনে হল, এমন একটা ছেলে এরকম একটা কাজ করে কেন? না, কোনও কাজই ছোট নয়। তবু সমাজের একটা প্রচলিত মাপ তো আছে। সেই মাপে ওর তো অন্যরকম কাজ করার কথা।
আদি তবু হাসল না। ওই সেই ব্যাপার। সাব-অর্ডিনেটকে কখনও চাপমুক্ত করবে না। একটা অদৃশ্য সুতো তোমার নিজের হাতে রাখতেই হবে। ও বলল, ‘দেখি। আর আমি কী করব আর করব না তা নিশ্চয়ই তোমায় বলব না!’
‘তবু, স্যার… প্লিজ…’ মল্লার মুখটা কাঁদোকাঁদো করল।
আদি আর কথা না বাড়িয়ে বাড়ির কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকে গেল।
বাড়ি নয়, আসলে এটা তিনতলা বাংলো। সামনে খুব সুন্দর লন। তার চারধারে কালো বোল্ডার বসানো রাস্তা। আর রাস্তার একদম শেষে শিল্পীদের প্যালেটের আকারের সুইমিং পুল। এ ছাড়া, গোটা কম্পাউন্ডটাতেই নানারকম গাছ লাগানো। সব কিছুই খুব ভালভাবে মেনটেন্ড। নেপালবাবু বলে একজন গোটা বাড়ির মেনটেনেন্সটা দেখেন।
কম্পাউন্ডে ঢুকতেই আদি নেপালবাবুর মুখোমুখি হল। লোকটা রোগা। প্রায় সবসময়ই খয়েরি আর হলুদের চেক শার্ট পরে থাকে। টেনশন করা নেপালবাবুর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
আদিকে দেখেই বলল, ‘আরে, সাহেব কখন থেকে ওয়েট করছেন। শরীর তো ঠিক নেই, তাই নানা লোকে আসছে দেখা করতে। আপনার জন্য সামান্য সময় বরাদ্দ করেছেন। তাড়াতাড়ি যান, না হলে বেজায় রেগে যাবেন। এমনিতেই মুড খারাপ।’
মুড খারাপ? আদি একটু দমে গেল। মালিনীরও এখানে আসার কথা ছিল। কিন্তু ও না আসার জন্য যে-ঝাড়টা হবে, সেটা আদিকে একাই খেতে হবে। নিজের ওপরই বিরক্ত হল আদি। কী দরকার ছিল মালিনীর কাজের জন্য ওকে ছেড়ে দেওয়ার? মালিনী কি জানতে পারবে যে, ওর জন্য কত লাঞ্ছনা সহ্য করছে আদি?
দোতলার বৈঠকখানায় বসে ছিল গৌর। সাদা কুর্তা পাজামার ওপর শাল জড়ানো। নিখুঁতভাবে দাড়িগোঁফ কামানো। দেখলে মনেই হচ্ছে না যে, অসুস্থ।
আদিকে দেখে গৌর আজ হাসল না। গম্ভীরভাবে উলটোদিকের সোফাটা দেখিয়ে দিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘মালিনী কোথায়? আয়ি কিঁউ নেহি?’
‘স্যার, হার গ্র্যান্ডমাদার ইজ ভেরি সিক। সো…’
‘ও,’ গৌর চোয়াল শক্ত করল, ‘পেটি অজুহাত। ডিসগাস্টিং। তো, তু কব যা রাহা হ্যায় এয়ারপোর্টমে উস মুম্বই কে হিরোকো লানে?’
‘রাতের ফ্লাইট স্যার।’
‘হুম,’ গৌর ঠোঁট কামড়াল। তারপর বলল, ‘বারাসতের হাউজিং কমপ্লেক্সের চারজন টাকা ফেরত চেয়েছে। বলছে, এই ডোলড্রামসে সব গন্ডগোল হয়ে যাবে। ওরা ফ্ল্যাট পাবে না। ভেরি ব্যাড সাইন আদি। আজ চারজন চাইল। কাল চল্লিশজন চাইবে। তু ক্যায়া উখাড় রাহা হ্যায় বৈঠকে?”
গৌরের রাগ দেখে আদি থতমত খেল, ‘স্যার, আমরা লেভেল বেস্ট চেষ্টা করছি। বাট…’
‘ইয়োর বেস্ট ইজ নট গুড এনাফ। আমার ওই হাউজিংটা ঝুলে গেল। চাপাডাঙার ফ্রুট জুস ফ্যাক্টরির জন্য এক্সট্রা জমি নেওয়াটাও ঝুলে গেল। তু ইয়ার ঝক মার রাহা হ্যায় ক্যায়া? সব বহেন…’
‘স্যার, পলিটিক্যাল প্রবলেম হচ্ছে।’
‘আই নো। একজনই সবাইকে খেপাচ্ছে। ত্রয়ণ। শালেকা নাম দেখ! তু উসসে মিল।’
‘স্যার আমি দেখা করেছি।’
‘ঘুটনো মে হ্যায় তেরা দিমাগ? ইনফরমালি মিল। মাল-শাল খাওয়া। ভাল বিছানায় শুইয়ে আন। শরীর গরম, পকেট গরম, ব্যস দেখবি কাম হো গয়া।’
‘কিন্তু স্যার…’
‘চোপ শালা,’ গৌরের মুখ লাল হয়ে উঠেছে, ‘কিন্তু কী বে? না পারলে চাকরি ছেড়ে দে। আই উইল নট লিসন এনি এক্সকিউজেজ এনি মোর। পারলে কর, না হলে ইউ নো দ্য ওয়ে আউট। রাইট?’
আদি মাথা নামাল। গৌর প্যাঁচ দিচ্ছে। চাপ দিচ্ছে। কোনায় ঠেলছে ওকে। আদি যেন দেখতে পেল ওর ভেতরেও একটা মল্লার রয়েছে। দেখতে পেল সে টেনশন আর ভয়ে ঘামছে একা। তার মাথার ওপর চাপ বাড়ছে। কর্পোরেট চাপ। যা বস-রা দেয় সাব-অর্ডিনেটদের। আদি বুঝল এই পৃথিবীতে জায়গা খুব দ্রুত বদলে যায়। নিজেকে ওর মল্লারের চেয়ে বেশি কিছু মনে হল না। আদি বুঝল, সামনে বেশ কঠিন সময় আসছে।