৮
গুন্ডার পাশে ছেলেটাকে মনে হচ্ছে টুথপিক। তার ওপর এমন আগোছালো জামাকাপড় পরে রয়েছে ছেলেটা যে, আরও হাস্যকর লাগছে। ছেলেটা বিশেষ কথাও বলছে না। শুধু হুঁ হাঁ করছে প্রথম থেকে।
নভেম্বরের বারো আনা হয়ে গেলেও ঠান্ডা তেমন পড়ছে না। দিঘির মনে হয় আজকাল সব কিছুই কেমন যেন উলটোপালটা হয়ে আছে। ঠিকমতো বৃষ্টি হয় না, গরমে ডিম আপনা থেকে সেদ্ধ হয়ে যায়। ঠান্ডা পড়ি পড়ি করেও ঠিক ঠান্ডাও পড়ে না। আজ থেকে দশ বছর আগেও কিন্তু এমন ছিল না। খুব বাজে লাগে দিঘির। চাপা রাগ হয়। মনে হয় কিছু একটা করে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারে না কী করবে! আসলে দিঘির সমস্যা এটাই। লোকে হয়তো ওকে খুব সাহসী, স্ট্রেট ফরোওয়ার্ড আর অ্যাগ্রেসিভ ভাবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে দিঘি বোঝে ও কতটা নিস্তব্ধ, চুপচাপ, ইনট্রোভার্ট। তাই অনেক সময়ই কিছু করতে চাইলেও ঠিক পারে না। ওর গলা বুজে আসে কষ্টে। কিন্তু তবু কিছু বলতে পারে না।
আর কষ্টগুলোও খুব বেয়াড়া ধরনের। জলের মতো। কোথায় যেন পড়েছিল দিঘি যে, পৃথিবীতে সমস্ত জলই নিজেদের ভেতরে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। মানুষের মনের দুঃখগুলোও ঠিক তেমনই। সবক’টা দুঃখই যেন এ ওর ল্যাজা-মুড়ো ধরে রেখেছে। একটায় টান লাগলে সবক’টা এসে হুড়মুড়িয়ে পড়ে এ ওর ঘাড়ে।
এই যে নভেম্বরের প্রায় শেষে এসে ঠান্ডাটা পড়ল না তার জন্য যে মনখারাপটা হালকাভাবে শুরু হয়েছিল সেটা ক্রমশ এ-গলি ও-গলি দিয়ে এসে পড়ল রাজপথে। এই শেষ বিকেলের আলোয় কলেজ স্কোয়ারের জলের পাড়ে বসে আচমকাই যেন জীবনটা ফিরে গেল তিন বছর আগে এক পুজোর সকালে। কেন এমন হল? একটা বিকেল কী করে মনে করায় সকালকে? মানুষের চিন্তার পদ্ধতিটা কী? মনের পদ্ধতিটাই বা কী? দিঘি বোঝে না। যেন খানিক বুঝতেও চায় না। ওর শুধু মনে পড়ে সেই সকালটুকু।
তখন সবে সুকিয়া স্ট্রিটে এসেছিল ওরা। নর্থ কলকাতার সঙ্গে আস্তে আস্তে পরিচয় হচ্ছিল দিঘির। সব যে ভাল লাগছিল তা নয়, কিন্তু তবু একটা অন্যরকমের স্বাদ পাচ্ছিল ও। দেখছিল এখানে এখনও অনেক পুরনো বাড়িঘর থেকে গিয়েছে। জাফরি-আঁটা ছাদ থেকে গিয়েছে। শ্বেতপাথরের টেবিল আর কালো কাঠের চেয়ারওয়ালা কেবিন থেকে গিয়েছে। থেকে গিয়েছে করি বরগার বাড়ি, লম্বা সিঁড়ি, জট পাকানো ইলেকট্রিকের তারের মিটার ঘর। এর মাঝে মাঝে কাচের কনফেকশনারি, মোবাইলের দোকান, অটোমেটিক সিগন্যালও এসে গিয়েছে। দিঘি দেখেছিল গুরুচণ্ডালি দোষের একটা শহর ক্রমশ যেন বদলে দিচ্ছে, মানিয়ে নিচ্ছে তার নিজের বেঁচে থাকার ব্যাকরণ।
অষ্টমীর পুজো ছিল সেদিন। বাদুড়বাগানের প্যান্ডেলে অঞ্জলি দিয়ে মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরেছিল দিঘি। মা বলেছিল, ‘চল, পাশের বাড়ির মাসিমাকে গিয়ে প্রণাম করে আসি। তুই তো ঠিকমতো কাউকে চিনলিই না এ পাড়ায়।’
আসলে সুকিয়া স্ট্রিটের এই বাড়িটা মা পেয়েছিল উত্তরাধিকার সূত্রে। এটা দিঘিদের মামার বাড়ি ছিল। দিঘির দাদু-দিদিমা না থাকলেও, মামা ছিল এক। কিন্তু সে বিয়ে করেনি। এত বড় বাড়িটায় মামা একা থাকত। অবশ্য ঠিক একা নয়। মহুল এসে মাঝে মাঝে থাকত মামার সঙ্গে। ফলে মহুলের সঙ্গে এ পাড়ার সবার পরিচয় ছিল। কিন্তু মামা আচমকা মারা যাওয়ার পর ওরা যখন দক্ষিণ কলকাতা থেকে এখানে এসে উঠল, দিঘি যেন নতুন এক পৃথিবীতে এসে পড়েছিল। মা নিশ্চয়ই বুঝেছিল দিঘির মনের অবস্থা। তাই দিঘিকে নিয়ে মাঝে মাঝেই এ-বাড়ি ও-বাড়ি গিয়ে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিত। মায়ের ছোটবেলার জায়গা যে। মাকে যে সবাই চেনে এখানে।
সেদিন বাড়িতে পায়েস করেছিল মা। সঙ্গে আলুর দম আর লুচি। তাই থালায় সাজিয়ে নিয়ে মায়ের সঙ্গে পাশের বাড়ির ঠাকুরমার কাছে গিয়েছিল। মা যাওয়ার আগে দিঘিকে বলেছিল, ‘আমি মাসিমা বললেও তুই ঠাকুরমা বলবি। হৈম মাসিমা এক আশ্চর্য মহিলা। চল, তোর ভাল লাগবে।’
সুন্দরী দিঘি বহু দেখেছে। কিন্তু আশি বছর বয়সেও যে, কোনও মানুষ এতটা সুন্দরী থাকতে পারে তা ঠাকুরমাকে না দেখলে বুঝতেই পারত না দিঘি।
সোনার গোল ফ্রেমের চশমা পরে, ঠাকুরমা একটা বই পড়ছিলেন। মাকে দেখে বই রেখে খাট থেকে নেমে এসেছিলেন বৃদ্ধা, ‘আরে মম, তুই?’
মা থালাটা দেখিয়ে হেসে বলেছিল, ‘বলছি, আগে এটা কোথায় রাখব বলো তো?’
ঠাকুরমা বলেছিলেন, ‘কী এনেছিস আবার পাকামি করে?’
‘ওই সামান্য লুচি-আলুর দম আছে।’
‘ও,’ হেসেছিল ঠাকুরমা, ‘দাঁড়া,’ বলে, ‘খুশি, খুশি,’ ডাক দিয়েছিলেন।
মধ্যবয়স্কা একজন কাজের মহিলা ঘরে এসে দাঁড়িয়েছিল।
ঠাকুরমা বলেছিল, ‘হাতের থালাটা নিয়ে গিয়ে খাবার টেবিলে রাখ। আর দা’ভাই কই?’
খুশি বলেছিল, ‘নিজের ঘরে আছে। ক্যামেরাটা ভেঙে কীসব করছে।’
‘ক্যামেরা ভেঙে?’ ঠাকুরমা ভুরু কুঁচকেছিলেন এক মুহূর্তের জন্য। তারপর হেসে বলেছিলেন, ‘ও লেন্স পরিষ্কার করছে। যা তো, বল আমি ডাকছি।’
‘কাকে ডাকলে গো?’ মা জিজ্ঞেস করেছিল।
‘কেন, বুঝতে পারছিস না? অর্কর ছেলে, কিগান।’
‘ও,’ মায়ের যেন মনে পড়ে গিয়েছিল সব, ‘তাই তো! দেখো দেখি, আমিও বোকা, সব কেমন যেন ভুলে যাই আজকাল। থাইরয়েডের জন্যই কি? তা, কই ও?’
ঠাকুরমা কিছু বলার আগেই স্বরটা শুনেছিল দিঘি। দরজার বাইরে থেকে নরম একটা স্বর বলেছিল, ‘ডাকছিলে ঠাকুরমা?’
মায়ের সঙ্গে দিঘিও ঘুরে তাকিয়েছিল। আর তাকে দেখেছিল প্রথম। বারান্দা দিয়ে আসা কাচের মতো রোদ এসে পড়েছিল দরজার কাছে। আর সেই রোদের চৌখুপির মাঝে দাঁড়িয়েছিল সে। লম্বা, দোহারা চেহারা। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। কোঁকড়া এলোমেলো চুল আর দুটো অদ্ভুত নীল রঙের চোখ।
কোথায় এসে দাঁড়িয়েছিল কিগান? ওই রোদের চৌকোর মাঝখানে? না, দিঘির মনের মাঝখানে? টলমল করে উঠেছিল দিঘির মন। বাঙালিদের এমন নীল চোখ হয়!
ঠাকুরমা আলাপ করিয়ে দিয়েছিল ওদের সঙ্গে। মা কিগানের গাল টিপে, চুল ঘেঁটে আদর করে দিয়েছিল। কথাও বলেছিল কীসব। কিন্তু দিঘির কিচ্ছু কানে ঢোকেনি। ও শুধু দেখছিল কিগানকে। আর ওর বুকের ভেতর একটা গোটা দিঘি টলমল করছিল যেন।
সেই শুরু, তারপর, দিঘি প্রায় রোজই যেত ঠাকুরমার কাছে। ঠাকুরমার কাছে? দিঘি অন্তত তাই বলত মাকে। মাঝে মাঝে অবশ্য কিগানের কথাও বলত। বলত অঙ্ক বা বিজ্ঞানের কোনও কিছু বুঝে নিতে চায় ও কিগানের থেকে। দিঘি বলত, ‘কিগানদা এত ভাল বোঝায় না!’
দিঘি মাকে বোঝাত। নিজেকেও। কিন্তু সব কিছুর তলায় তলায় একটা অবুঝ কাঠবেড়ালি নেচে বেড়াত। সে তার বাদাম খুঁজে বেড়াত। তারপর কোত্থেকে যে কী হল! পুজো শেষ হয়ে, ক্রিসমাস ছুঁয়ে, সরস্বতী পুজো টপকে সময় এসে দাঁড়াল দোলের দিনে। আর সেই দিনের থেকেই কীভাবে যেন পালটে গেল দিঘির বেঁচে থাকা।
‘কী রে, তখন থেকে দেখছি চুপ মেরে আছিস। কী হয়েছে তোর?’ কংক্রিটের বেঞ্চটাতে একটা থাপ্পড় মেরে বলল গুন্ডা।
সামান্য চমকে উঠলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল দিঘি। বলল, ‘না, মানে ভাবলাম যে নভেম্বর শেষ হতে চলল, কিন্তু দেখ, ঠান্ডার নামগন্ধ নেই। ক্লাইমেটের যে কী অবস্থা হয়েছে না! খুব খারাপ সময় আসছে।’
‘আসছে?’ রোগা ছেলেটা এতক্ষণে প্রথম স্পষ্ট ভাষায় কিছু বলল।
দিঘির সঙ্গে স্নেহা, রূপ আর জয়ও তাকাল ছেলেটার দিকে।
গুন্ডা বলল, ‘যাক ত্রয়ণদা, তুমি যে কথা বলতে পারো তা সবাই অন্তত বুঝতে পারল।’
ত্রয়ণ বাঁ হাতের স্টিল ব্যান্ডের সস্তার ঘড়িটা ঠিক করে নিয়ে বলল, ‘তোমাদের তা হলে সত্যি মনে হয় যে, খারাপ সময় আসছে। এখনও আসেনি!’
‘না, মানে…’ জয় চিরকাল সব বিষয়েই কিছু না-কিছু বলতে চায়। কিন্তু কিছুতেই কোনও কথা শেষ করতে পারে না।
‘কী, মানে?’ ত্রয়ণ জয়ের দিকে তাকাল প্রথমে, তারপর সবার দিকে ঘুরে ঘুরে এসে থামল দিঘির কাছে। বলল, ‘আর কত খারাপ সময় আসবে বলে মনে হয় তোমার? তোমাদের কলেজের ভোট সামনে। এই গুন্ডা তোমাদের ক্লাস রিপ্রেজেন্ট করে। ওর কথায় জাস্ট তোমাদের কলেজে ঘুরে গেলাম। ক্যাম্পেনিং দেখলাম। কথা শুনলাম। বুঝলাম যে, কিছুদিনের মধ্যে বোধহয় মারামারিও হয়ে যাবে একচোট। তারপর ভোটে একটা দল জিতবে। ক্ষমতা পেয়ে যাবে। কিন্তু তাতে কি কলেজটার কিছুমাত্র অদল-বদল হবে? পাতি কথায়, উন্নতি হবে কিছু?’
গুন্ডা বলল, ‘কেন হবে না? নিশ্চয়ই হবে। ছাত্রশক্তি, শুভ বুদ্ধি আর পরিশ্রমের ত্রিপাক্ষিক মেলবন্ধন ঘটাতে পারলে উন্নতি আসতে বাধ্য।’
‘চুপ কর।’ ত্রয়ণ ধমক দিল, ‘এমন জানলে কলকাতার কাজ সেরে ফিরে যেতাম বাড়িতে। তোর কথামতো এখানে আসতাম না।’
‘কেন, কী ভুল বললাম?’ গুন্ডা দূরে একটা বাদামওয়ালাকে হাত দিয়ে ডেকে ত্রয়ণকে প্রশ্ন করল।
ত্রয়ণ আবার সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখানে তিনটে দল কনটেস্ট করবে। আজ তিনজনেই এজেন্ডা, অবজেক্টিভ, ভিশন ইত্যাদি নিয়ে গালভরা সব ভাষণ দিল। কিন্তু তাতে নতুন কিছু বলল কি? যে যার পার্টির দাদা-কাকাদের বুলিগুলো গড়গড় করে বলে দিল। বক্তৃতা জুড়ে শুধু পার্টি হেড কোয়ার্টারের ইস্তেহারগুলো কে কত ভাল মুখস্থ করেছে তার পরীক্ষা যেন! যখন সব শিয়াল এক স্বরে ডাকে তখন বুঝতে হবে অবস্থা খারাপ হতে বাকি নেই কিছু। শোনো, যে-রাজনীতিতে এত রিজিডিটি চলে আসে, সেটা ব্রেনওয়াশের যন্ত্র হয়ে যায়। আর বরফির মগজ প্রক্ষালন যন্ত্রের ফলে কী হয়েছিল, তা নিশ্চয়ই তোমাদের আলাদা করে বলে দিতে হবে না। স্টুডেন্টদের তো কাজ, সিস্টেমকে প্রশ্ন করা। পুরনো ভুলগুলো শোধরানো। তা না করে তোমরা কী করছ? মান্ধাতার আমলের কয়েকজন নেতার ইগোসমৃদ্ধ, একগুঁয়ে কিছু বুলি আউড়ে চলেছ, আর অন্য পার্টি ক’টা খুন করল, ক’টা রেপ করল, সেই হিসেব দিয়ে নিজেদের ভুলগুলো জাস্টিফাই করার চেষ্টা করছ। আর বলছ খারাপ সময় আসছে? ওয়েকআপ বাডি। খারাপ সময় চলছে এখন। ছাত্র রাজনীতি হল যাত্রাপালার বিবেকের মতো। দ্য ভয়েস অব দ্য সোল। কিন্তু সেই বিবেক যখন ক্ষমতার ওকালতি করে, জানবে এমন দুঃসময় আর নেই!’
জয় বলল, ‘কিন্তু মূল্যহীন বলছেন কেন? আমাদের এই ইয়ে মানে…চেষ্টা আর ভোট…মানে আমি বলছি যে…’
‘চুপ কর,’ গুন্ডা ধমক দিল, ‘সব বিষয়ে শুধু লাফিয়েই পড়ে, কিছুই বলতে পারে না। তবু কথা বলা চাই। না?’ তারপর ত্রয়ণকে বলল, ‘তুমিও তো সক্রিয় রাজনীতি করো। এখানে বসে যা বলছ তা তোমাদের ওই উত্তর চব্বিশ পরগনার কেষ্টবিষ্টুদের সামনে বলতে পারবে?’
ত্রয়ণ হাসল, ‘বলি তো। আমি তো বলিই। বারাসতে একটা হাউজিং নিয়ে দীর্ঘদিন ঝামেলা চলছে। যে-গ্রুপ প্রোমোটিং করছে তারা তো টাকাপয়সা দিয়ে প্রায় ম্যানেজ করে ফেলেছিল সব নেতানেত্রীকে। ভেবেছিল তাতে হয়তো পার্কের জন্য জায়গাটা না ছাড়লেও চলবে। কিন্তু আমি তো তা হতে দিইনি। লোকাল মানুষকে বুঝিয়েছি। ব্যস, ক্রাউড আমার সঙ্গে। তারাও নাছোড় হয়ে গেছে। অবস্থা খারাপ বুঝে নেতানেত্রীরাও ডিগবাজি খেয়ে এখন আমাদের দাবি সমর্থন করছে। আরে বাবা পাবলিকের বিরুদ্ধে কে যাবে? তা ছাড়া চাপাডাঙাতে একটা গন্ডগোল পাকাচ্ছে। সেখানেও বারাসতের পার্টিটাই মিনারেল ওয়াটার প্লাস জুসের ফ্যাক্টরি খুলতে চায়, কিন্তু সেটা জমি দখল করে। একটা গন্ডগোল হবে। আমি দেখব যাতে জমির গায়ে আঁচড় না পড়ে।’
দিঘির মাথা বোঁ-বোঁ করছে। কী কথা থেকে টেনে নিয়ে কত কথা বলে গেল ছেলেটা! বাব্বা, সারাটা সময় চুপ করে থাকাটা যেন উশুল করে নিল! দিঘিও মানুষের জন্য কিছু একটা করতে চায়, কিন্তু রাজনীতির জার্সি চাপিয়ে নয়। আসলে রাজনীতিটা কোনওদিনই বোঝে না দিঘি। আর সত্যি কথা বলতে কী, বুঝতেও চায় না। নেহাত গুন্ডা ওদের বন্ধু তাই ওর সঙ্গে সঙ্গে থাকে। এই ত্রয়ণ যে এত কিছু বলে দেবে এটা জানলে তেমন কিছু বলতই না দিঘি। এরকম আর্ট ফিল্মের হিরো মার্কা, গায়ে সস্তা সিগারেটের গন্ধওয়ালা ছেলেদের চিরকাল অসহ্য লাগে দিঘির। তবে, কী আর করবে! উঠে চলে যাওয়াটা বড্ড মোটা দাগের হয়ে যাবে। তার ওপর গুন্ডার কাজিন হোমিদির চেনাশুনো এই ত্রয়ণ। ফলে গুন্ডার জন্যই খানিকটা সহ্য করছে ছেলেটাকে।
দিঘি দেখল স্নেহা বড় বড় চোখ করে কথাগুলো শুনলেও, রূপ একের পর এক সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে, পাত্তা দিচ্ছে না। দিঘি ভাবল দিদি এসে পড়লে ও বেঁচে যায়।
ত্রয়ণের কথার ফাঁকেই বাদামওয়ালার থেকে বাদাম কেনা হয়েছিল। সবাই খেয়ে নিলেও রূপ ধরেইনি প্যাকেটটা। গুন্ডা সেটা তুলে নিয়ে বলল, ‘যাই বলো ত্রয়ণদা, পার্টির যারা মাথা, তাদের কথা শুনব না?’
‘শুনবি না কেন? কিন্তু শুনলেই কি মানতে হবে? কেউ মাথার দিব্যি দিয়েছে? প্রশ্ন করবি না পালটা? বাজিয়ে দেখবি না যা বলছে ঠিক বলছে কিনা! জানবি, ছাত্র রাজনীতি হল সমাজের ল্যাবরেটরি।’
জয় বলল, ‘তা ঠিক। তবে শুধু রাজনীতি করেই ইয়ে…মানে কাজ করতে ইয়ে…দরকার কী রাজনীতি? মানে আমি বলতে চাইছি যে…’
‘বুঝেছি,’ ত্রয়ণ আবার ঢিলে ঘড়িটা ঠিক করল, ‘না, মানুষের জন্য কাজ করতে গেলে রাজনীতির দরকার নেই। তোমরা যদি চাও, এমনিও করতে পারো। তবে তার জন্য কনভিকশন লাগবে। দেখবে রাজনীতির লোকজন সেখানেও খোঁচা দিচ্ছে। তবে তাতে তোমাদের থামলে চলবে না।’
গুন্ডা বলল, ‘হোমিদির “হেল্প আর্থ” তো এমনই একটা সংস্থা।’
‘হ্যাঁ, সেখানে তোমরা এসো। এই যে, বলছিলে না, যে, গরম বাড়ছে। এই গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে কমানোর জন্যই তো হোমিরা কাজ করছে। ইউ পিপ্ল ক্যান জয়েন।’ ত্রয়ণ আবার ঘড়ি ঠিক করল।
‘এই আমি উঠি,’ রূপ আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল, ‘মাথা ব্যথা করছে।’
‘কেন?’ স্নেহা উদ্বিগ্ন হল। স্নেহার শরীর খারাপ নিয়ে একটা ভয় কাজ করে সবসময়।
‘না, কিছু নয়, এমনি।’
ত্রয়ণ হাসল, ‘ইনডিফারেন্স হল বুর্জোয়াদের লক্ষণ।’
রূপ পাত্তা দিল না। গুন্ডার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার চারটে সিডি নিয়েছিলি। কবে ফেরত দিবি?’
‘আরে ডিভিডি প্লেয়ারটা মা ধরতে দিচ্ছে না। আর দু’-চারদিন সময় দে, দিয়ে দেব। তুই রাগ করিস না।’
রূপ ঠোঁটের কোণে পুরনো দিনের হিন্দি ছবির ভিলেনদের মতো করে সিগারেট ঝুলিয়ে চোখ ছোট করে বলল, ‘রাগ করব কেন? সময়মতো দিয়ে দিস তা হলেই হবে। আমি আসি, বাই।’ রূপ ত্রয়ণের দিকে একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি দিয়ে কলেজ স্কোয়ারের ছোট গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।
দিঘির অস্বস্তি লাগল খুব। রূপ মাঝে মাঝে এত রুড হয়ে যায় না! খুব খারাপ লাগে দিঘির। আসলে রূপ একটু পাগলাটে ধরনের। যেটা খারাপ লাগে দুম করে বলে দেয়।
রূপ চলে যাওয়াতে স্নেহাও উসখুস শুরু করল। স্নেহার অস্থির হওয়ার লক্ষণই হল শাড়ির আঁচল নিয়ে হাত দিয়ে পাট পাট করা। দিঘি আড়চোখে দেখল স্নেহা আঁচলটা নিয়ে নিজের কাজ শুরু করে দিয়েছে। জয়, ত্রয়ণ আর গুন্ডা নিজেদের মধ্যে কীসব কথা বলছে এখন। দিঘি স্নেহার দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে রে?’
স্নেহা বলল, ‘আমাকেও যেতে হবে এবার। বাড়িতে লোকজন আসবে। দেরি হলে মা বকবে খুব! আমায় যেতেই হবে রে।’
দিঘি বলল, ‘কেন?’
স্নেহা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘রূপ চলে গেল। আমিও যাই। রিধিমাটা চলে যাওয়ায় আমাদের গ্রুপটা কেমন যেন হয়ে গেছে! কে রিধিমাকে বলেছিল দিল্লি চলে যেতে?’
দিঘি হাসল, ‘ও, মায়ের বকাটা তা হলে ঢপ?’
স্নেহা কিছু না বলে হ্যাঁ আর না-এর মাঝামাঝি মাথা নাড়াল।
ত্রয়ণের থেকে মুখ ফিরিয়ে এবার দিঘিদের দিকে তাকিয়ে গুন্ডা বলল, ‘শোন, ত্রয়ণদা বলল যে, সামনে “হেল্প আর্থ”-এর একটা ডেমনস্ট্রেশন আছে। কলকাতা থেকে লোকজন গেলে গুরুত্ব আরও বাড়বে। তোরা যাবি?’
স্নেহা জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যেতে হবে?’
‘ওই হাবড়া অঞ্চলে।’
‘সেটা কোথায়?’ স্নেহা আবার প্রশ্ন করল।
‘ক্যালানের মতো কথা বলিস না। ওটা নর্থ চব্বিশ পরগনায়।’ গুন্ডা বিরক্ত হল এবার।
‘ওরে বাবা!’ স্নেহার মুখটা লাল হয়ে গেল, ‘মা অত দূর যেতেই দেবে না। আমি যাব না বাবা।’
‘ন্যাকা খুকি আমার!’ গুন্ডা ঝাঁঝিয়ে বলল, ‘তোর বিয়ের সময় কী হবে রে? বাপ-মা ঘরজামাই রাখবে?’
সবার সামনে এমন বলছে দেখে স্নেহা রেগে গেল, ‘হ্যাঁ, রাখবে, তাতে তোর কী রে মোটা?’
‘রাখবে!’ গুন্ডা হঠাৎ অমন বিশাল শরীরটা নিয়ে ধপ করে বসে পড়ল স্নেহার পায়ের কাছে। বলল, ‘তা হলে আমায় রাখতে বলবি? বাজারহাট সব করে দেব। হাত-পা টিপে দেব। তোদের সবার ব্রা-প্যান্টি-জাঙিয়াও কেচে দেব। আমায় প্লিজ বিয়ে করে ঘরজামাই রাখবি? মাইরি বাড়ির সবার মুখঝামটা আর রুটি-আলুর চোখা খেতে খেতে পেটে চর পড়ে গেল। এই স্নেহা, মাইরি আমায় বিয়ে করবি? বিদ্যা বলছি, তোর ইচ্ছে না করলে তোর সঙ্গে ইয়েও করব না।’
‘মানে?’ স্নেহা আঁতকে উঠল, ‘ওঠ বলছি, মাটি থেকে ওঠ। এমন সিন ক্রিয়েট করছিস কেন? এমন চিপ ইয়ারকি মারবি না।’
গুন্ডা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ত্রয়ণ আর তা বলতে দিল না। বরং গম্ভীর গলায় বলল, ‘গুন্ডা তুই চুপ কর। ছ্যাবলামি করিস না। শোনো তোমরা, হাবড়া খুব একটা দূরে নয়। শিয়ালদা থেকে ট্রেনে দেড় ঘণ্টার মতো। সকালে যাবে, বিকেলে চলে আসবে। কলকাতার বাইরের কথাও তো ভাবতে হবে তোমাদের। শুধু কলকাতা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত নয়। এই যে দিঘি তুমি গরম কমছে না বলছিলে, আমাদের এই ডেমনস্ট্রেশনটা গাছ কাটার বিরুদ্ধে। ন্যাশনাল হাইওয়েকে চওড়া করার জন্য দু’পাশের মোটা মোটা গাছ কাটা হবে। এটা বন্ধ করা জরুরি। বহু বহু দিন ধরে তিল তিল করে ওই গাছগুলো বেড়েছে। আর কিছু দালাল টাইপের লোক, উন্নয়নের নামে দামি দামি গাছ কেটে পকেট ভরবে, তা হতে দেওয়া যায় না! তোমরা এসো। আসল পশ্চিমবঙ্গকে সামনে থেকে দেখো। কতগুলো শপিং মল, ফ্লাইওভার আর ফাস্টফুড সেন্টার দিয়ে কিন্তু আসল পশ্চিমবঙ্গ তৈরি নয়। আসল পশ্চিমবঙ্গ আরও অনেক জটিল, কঠিন এক জায়গা। যেখানে প্রতিদিন মানুষকে রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। কলেজ স্কোয়্যারের থেকে বেরিয়ে এবার আসল পৃথিবীর সামনে দাঁড়ানোর সময় এল। বুঝেছ?’
ত্রয়ণের কথা শেষ হওয়ার পর গুন্ডা গর্ব গর্ব চোখ নিয়ে তাকাল সবার দিকে। একটু সময় দিল কথাগুলোকে ওদের মাথার ভেতরে ঘুরতে দেওয়ার। মনের ভেতর নামতে দেওয়ার। তারপর বলল, ‘তো, যাবি তো তোরা?’
‘কোথায় রে?’ হঠাৎ পাশের ছোট গেট দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে উদয় হল আর্য, ‘কোথায় যেতে হবে রে গুন্ডা?’
গুন্ডা নির্লিপ্ত মুখে আর্যর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সামনের মাঘে দিঘির বিয়ে। তাই সবাইকে জিজ্ঞেস করছিলাম কনেযাত্রী যাবে কিনা! তা, তুই যাবি তো আর্য?’
‘কী?’ আর্যর ক্লান্ত ফরসা মুখটা আরও লাল হয়ে উঠল। ও দিঘির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী বলছে ওরা? তোমার বিয়ে? আঠারো বছর বয়সে বিয়ে? মানে?’
দিঘিকে কিছু বলতে না দিয়ে গুন্ডা বলল, ‘হ্যাঁ, কিগানের সঙ্গে ওর বিয়ে। আর আমরা কনেযাত্রী। তুই যাবি না?’
‘কী?’ আর্য ওর পিঠের ব্যাগটা একটা ঝটকায় খুলে ফেলল।
‘আঃ গুন্ডা।’ দিঘি ধমক দিল এবার। গুন্ডার মুখে কোনও ট্যাক্স নেই। ত্রয়ণ বাইরের লোক। তার সামনে এসব কথা বলছে! দিঘি একবার চট করে ত্রয়ণকে দেখে নিল। নাঃ, শোনেনি! এই বালখিল্য ব্যাপার স্যাপার না দেখে একটু সরে গিয়ে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছে। ভাগ্যিস! না হলে এসব শুনে ফেলত। কী ভাবত কে জানে!
আর্য এবার সরু চোখ করে গুন্ডাকে দেখল। তারপর আচমকা লাথি চালাল, ‘শালা, জলহস্তীর বাচ্চা, একদম ভাট বকবি না। শোন, দিঘির কনেযাত্রী যাবি তোরা, কিন্তু সেটা আমাদের বাড়িতে। কোনও বুড়ো পার্ভাটের বাড়িতে নয়। বুঝেছিস?’
পনেরো বছরের বড়। তার মানে কি বুড়ো? দিঘির এই ‘বুড়ো’ শব্দটা খট করে কানে লাগল। ওর মনে পড়ে গেল, কিগানও ওকে এমন বলেছিল না?
ফোনটা শেষ করে ত্রয়ণ এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তা হলে এখন আসি। শোনো, আমি যা বলার বললাম। তোমরা নাগরিক হিসেবে ঠিক করবে, কী করা উচিত। কেমন?’
ত্রয়ণ চলে গেলে আর্য বলল, ‘এই গম্ভীর ধরনের লোকটা কে রে? মনে হচ্ছিল খুব কঠিন কিছু বলছিল!’
গুন্ডা বলল, ‘এই ব্যাপারটা তুই ঠিক বুঝবি না। হিউম্যানিটিজের ব্যাপার তো। তোর মতো মিস্ত্রি বুঝবে না।’
‘মিস্ত্রি মানে?’
‘আরে ইঞ্জিনিয়ার আর মিস্ত্রি মানে এক।’ গুন্ডা খিকখিক করে হাসল।
দিঘির ভাল লাগছে না এসব কথাবার্তা। দিদি এলে বেঁচে যায় ও। আজ বাড়িতে যাবে দিদি। মা রাতে খেতে বলেছে দিদিকে। বাবার একটা ভাল প্রোমোশন হয়েছে। তাই সেলিব্রেট করা হবে।
দিঘি মোবাইলটা বের করল পকেট থেকে। দিদিকে একটা ফোন করতে হবে। কাজে থাকলে দিদির হুঁশ থাকে না। এদিকে মা যখন নেমন্তন্ন করেছিল, তখন বলেছিল যে, বিকেল বিকেল পৌঁছে যাবে। এখনই পাঁচটা বাজে। আর কখন আসবে দিদি?
ফোনটা করতে গিয়েও করতে পারল না দিঘি। আর্য গুন্ডার সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করে বসল দিঘির পাশে। বলল, ‘বলো না, কোথায় যাবে তোমরা?’
‘আরে ওই ত্রয়ণ বলে যে-লোকটা এসেছিল, সে আমাদের যেতে বলেছে একটা ডেমনস্ট্রেশনে। “হেল্প আর্থ” বলে একটা সংস্থা আছে। তারা গাছ কাটার বিরুদ্ধে নামবে পথে। তাই আমাদেরও হাবড়ায় গিয়ে যোগ দিতে বলল ওদের কাজে।’
‘ডেমনস্ট্রেশন?’ আর্য তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, ‘সে তো খুব ঝামেলার ব্যাপার।
‘কেন, ঝামেলা কেন?’ দিঘি অবাক হল।
‘বোকার মতো প্রশ্ন কোরো না। ডেমনস্ট্রেশন মানে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে যাওয়া। সেখানে পুলিশ থাকবে। ভুলভাল লোকজন থাকবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস। সেখানে যাবে তুমি? পাগল নাকি? রোম্যান্টিসিজমের একটা মাত্রা থাকবে তো! এ তোমার ওই কথায় কথায় মোমবাতি জ্বালিয়ে ‘রং দে বাসন্তী’-র মতো মার্চ নয়। তা ছাড়া কলকাতা থেকে অত দূরে গিয়ে, জানাশোনা নেই কীসব সংস্থা, তাদের হয়ে গলা ফাটাবে কেন?’
‘ওরে বাবা।’ গুন্ডা অবাক হয়ে তাকাল আর্যর দিকে, ‘তুই তো ফাটিয়ে দিলি একদম। দিঘি তোর সম্পত্তি নাকি যে, এমন করে টার্মস ঠিক করে দিচ্ছিস?’ কথাটা শেষ করে গুন্ডা খুচ করে চোখ টিপল দিঘিকে লক্ষ্য করে।
দিঘি বুঝল আর্যকে তাতানোর জন্য এমন গলা কাঁপিয়ে একটু যাত্রা করে নিল গুন্ডা। আসলে আর্য এসব বোঝে না। সেন্স অফ হিউমার ব্যাপারটাই ওর নেই। সবসময় শুধু পড়া, কেরিয়ার আর দিঘি। এর বাইরে ও কিচ্ছু ভাবে না। এই ক’দিনেই আর্যকে বড্ড ক্লান্তিকর লাগে দিঘির। মনে হয় এ কোন ছেলের সঙ্গে ভাব করল? ভাবে, সত্যিই ভাব আছে তো? কারণ, আর্যর জন্য ওর মনে বিশেষ জায়গা থাকলে কেন সেই পনেরো বছরের বড় মানুষটাকে ভুলতে পারে না ও? কেন ভুলতে পারে না তার গিটারকে? তার এলোমেলো চুলকে? কেন বারবার মনে পড়ে ওই নীল দুটো চোখ?
আর্য গুন্ডার চোখ টেপাটা খেয়াল করেনি। ও তড়বড় করে উঠল আবার ঝগড়া করবে বলে, কিন্তু তার আগেই দিঘির হাতের মোবাইলটা বেজে উঠল।
‘হ্যালো, দিদি? কোথায় তুই?’
মহুল বলল, ‘আমি বেনিয়াটোলা লেনের ক্রসিং-এর সামনে ওয়েট করছি। তাড়াতাড়ি আয় তোরা। দেরি করিস না কিন্তু। রাস্তাটা সরু। এখানে গাড়ি পার্ক করা কিন্তু খুব অশান্তির কাজ। বুঝলি?’
বাঁচা গেল। মনে মনে ভাবল দিঘি। ভাগ্যিস দিদি ফোন করে ডাকল, না হলে আর্য আরও গার্জেনগিরি ফলাত। এসব ক্রমশ অসহ্য লাগছে দিঘির। মনে হচ্ছে একটা ফাঁস ক্রমশ চেপে বসছে ওর গলায়। আর্য বড্ড রুটিন যেন। বড্ড সিরিয়াস। স্বার্থপর। ইঞ্জিনিয়ারিং করে ও ম্যানেজমেন্ট করতে বিদেশে যাবে। ওর ইচ্ছে তার আগে দিঘির সঙ্গে এনগেজমেন্ট করে রাখবে। দিঘির এসব বিরক্ত লাগে। কত বয়স যে, এখনই বিয়ে বিয়ে করে পাগল করে? সবসময় একটা বেঁধে রাখার প্রবণতা। আটকে রাখার প্রবণতা। যেন জোর করে আটকে রাখলেই মানুষ আটকে থাকে। ইস, কী যে ভুল হয়েছিল মাথা গরম করে সুবর্ণর কাছে ওই সব কথা বলে! ব্যাটা সব লাগিয়ে দিয়েছে। আর তার ফলেই তো… মনটা তেতো হয়ে গেল দিঘির।
‘কী রে দিঘি? আবার সমাধিস্থ হয়ে গেলি নাকি? মাইরি এত চাপ নিস কেন তুই? আজকাল প্রায়ই দেখছি কেমন হয়ে যাচ্ছিস। কী রে আশ্রম ফাশ্রম খুলবি নাকি?’ গুন্ডা হিঃ হিঃ করে হাসল।
দিঘি উঠল, ‘চল, দিদি এসে গেছে। আর লেট করা যাবে না। মেন রোডের ওপর গাড়িতে অপেক্ষা করছে।’
জয় আর স্নেহাকে নেমন্তন্ন করেছিল দিঘি। কিন্তু কাজ আছে বলে ওরা যাবে না। রূপ বলেছিল যে, সন্ধে নাগাদ ও পৌঁছে যাবে বাড়িতে। গুন্ডা তো যাবেই। আর সেটাও দিঘির সঙ্গে।
পাড়ায় সুবর্ণকে নেমন্তন্ন করেছে মা। আর কাউকে বলেনি। আসলে কিগান আর দিঘিকে নিয়ে যে-গন্ডগোলটা হয়েছে সেটা স্পষ্টভাবে পাড়ায় কেউ না জানলেও কাজের লোকদের মুখে মুখে দু’-এক লাইন খবর পৌঁছেছে এর-ওর কানে। সুবর্ণ ব্যাপারটা পাঁচকান করেনি। কিগানের কাকাও যা বলার কিগানকেই বলেছে, আর কাউকে বিশেষ জড়ায়নি এর ভেতরে। তবু, আজকাল পাড়ায় ঢুকলেই অস্বস্তি লাগে দিঘির। কেউ না তাকালেও মনে হয় জোড়ায় জোড়ায় চোখ লক্ষ করছে ওকে। মনে হয় ভূতুড়ে মানুষজন নিশ্বাস ফেলছে ওর ঘাড়ের কাছে।
গুন্ডা বলল, ‘আবার স্ট্যাচু হয়ে গেছে! কী কেস বল তো দিঘি? মাদাম তুসোয় ভরতি করে দেব? চল না। সেই আধঘণ্টা থেকে না খেয়ে, না খেয়ে কেমন রোগা হয়ে গেলাম দেখছিস না? আচ্ছা, এখন গেলে মোগলাই পরোটা ফরোটা খাওয়াবে নিশ্চয়ই?’
‘তুইও যাবি?’ আর্য রাগ রাগ চোখে তাকাল গুন্ডার দিকে।
‘হ্যাঁ, যাব। কাকিমা নিজে আমায় ফোন করেছিল। তোর আপত্তি আছে?’
আর্য পিঠে ব্যাগটা নিয়ে বলল, ‘তুই সামনে দিদির সঙ্গে বসবি। আমি আর দিঘি পিছনে বসব।’
‘খুব শখ না? সামনে দিদি, তবু পিছনে বসে অসভ্যতা করার ইচ্ছে!’
‘চল তো,’ দিঘি এবার ধমক দিয়ে গেটের দিকে হাঁটা দিল।
পিছন পিছন যেতে যেতে গুন্ডা বলল, ‘আর্য, মাইরি তুই এমন করিস না যেন আমি তোর পয়সায় খাচ্ছি। দেখ, গরিব ব্রাহ্মণ সন্তান আমি। পইতে ছিঁড়ে গেছে, তবু ইমাজিনারি পইতে হাতে নিয়ে এই তোকে অভিশাপ দিচ্ছি যে, তুই যা চাস তা কোনওদিন পাবি না। দিঘি কেন, কোনও নালাও তোর জুটবে না।’
‘ব্রাহ্মণ সন্তান মানে! তুই আবার ব্রাহ্মণ হলি কবে থেকে রে?’ আর্য খেঁকিয়ে উঠল।
সূর্যটা খসে পড়ে গেছে আকাশ থেকে। তার জায়গায় ছাই মাখা নীল প্লাস্টিক কে যেন ভাসিয়ে দিয়েছে মাথার ওপর। পৃথিবীর সমস্ত বাস ট্রাম আর ট্যাক্সি বোধহয় প্রেসিডেন্সি কলেজের এই সামনেটায় এসে জড়ো হয় শেষ বিকেলে। আর তাদের ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে রয়েছে ভ্যান, ঠেলা আর প্রচুর উৎকট সবুজ রঙের অটো। গোটা শহরটার রাস্তাই যেন জিগ’স পাজল। সবাই যেন টুকরোগুলো সাজিয়ে নিজের মতো তৈরি করতে চাইছে শহরটাকে। কিন্তু পারছে না। উলটে জট পাকিয়ে দিচ্ছে আরও।
শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটকে বাঁদিকে রেখে দিঘি সোজা হাঁটা দিল। ভিড়ের মধ্যে এগোনো যথেষ্ট কঠিন। তবু চেষ্টায় যে সব কিছু হয় তা ওরা বুঝতে পারল, যখন বড় রাস্তায় এসে উলটোদিকের ফুটপাথে দেখল ইলেকট্রিক ব্লু রঙের ছোট্ট গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাড়ির কাচ তোলা। দিঘি বুঝল এসি চলছে। দিদির ডাস্টস্মোকে সমস্যা হয়। তাই গাড়িতে সবসময় এসি চলে। ও দেখল গাড়ির স্টিয়ারিং-এর ওপর দু’হাত দিয়ে তাল ঠুকে অল্প মাথা নাড়ছে মহুল। গান শুনছে। মনটা তা হলে ভালই আছে। যাক, বাড়িতে গিয়ে তা হলে বাবা-মায়ের সঙ্গে সামান্য কারণ নিয়ে ঝামেলা করবে না।
‘হাই দিদি,’ গাড়ির কাচে ঠকঠক করল দিঘি।
মহুল হেসে গাড়ির চাবিটা ঘোরাল। খটখট শব্দে লকগুলো খুলে গেল। মহুল আর্যকে বলল, ‘এই আমার পাশে বস। আর দিঘির সঙ্গে গুন্ডা পিছনে বসবে।’
‘সামনে বসব!’ আর্যর মুখটা শুকিয়ে গেল।
‘হ্যাঁ। আমি কি দিঘির চেয়ে কম সুন্দরী? তা ছাড়া একটা সুন্দর ছেলে আমার পাশে বসলে গাড়ি চালাতে আরও ভাল লাগবে। চল, ওঠ।’
আর্য ব্যাজার মুখে গাড়ির সামনে বসল। পিছনে দিঘির পর সারা গাড়ি কাঁপিয়ে গুন্ডাও উঠল। আর্য শুধু গায়ের জ্বালা মেটাতে বলল, ‘পুলিশ তোমায় ফাইন করবে মহুলদি। প্রাইভেট গাড়িতে লরির মাল তুলছ তো। এক্সট্রা ওজনের জন্য চার্জ নেবে।’
গুন্ডা হইহই করে বলল, ‘তাও যদি পুলিশ জানত আসল মালটা কে!’
কলেজ স্ট্রিট থেকে সুকিয়া স্ট্রিট একটুখানি রাস্তা। কোনও কোনও দিন দিঘি হেঁটেই ফেরে, কিন্তু আজ মহুলের সঙ্গে যাবে বলেই অপেক্ষা করছিল। দিঘি গাড়িতে উঠে বুঝল যে, হাঁটাই সবচেয়ে ভাল অপশন। কারণ এই জ্যাম, জট কাটিয়ে এগোয় কার সাধ্য! তাও বলতে হবে মহুলের হাত খুব ভাল। এই ক’মাসেই একদম পাকা ড্রাইভার হয়ে উঠেছে। তবু ঠোক্কর খেতে বিচ্ছিরি লাগছে দিঘির। জানলা দিয়ে বাইরের কলকাতাটাকে কেমন যেন কালো আর নোংরা লাগছে। হলুদ, জন্ডিস রোগীর চোখের মতো আলো। ফুটপাথে প্লাস্টিকের তৈরি রোগা রোগা মানুষজন। উপচে পড়া ময়লা। টেরা-বাঁকা চায়ের দোকান। ক্লান্ত দোকানি। শীতের আমেজ-বঞ্চিত একটা শহর। দিঘির খুব বাজে লাগছে। হঠাৎই বাজে লাগছে। পুরনো একটা হিন্দি গান খুব আস্তে চালিয়েছে দিদি। খুব মনখারাপ করা একটা সুর। কথাগুলো কিছু মাথায় ঢুকছে না দিঘির। শুধু মনখারাপ করা সুরটা কী করে যেন লেপটে যাচ্ছে ঘষা কাচের মতো কলকাতার সঙ্গে।
‘হ্যাঁরে দিঘি, ওই মর্কটটা তোকে ফোন করে আর?’ আচমকাই প্রশ্নটা করল মহুল।
‘মর্কট, মানে?’ একটু হকচকিয়ে গেল দিঘি।
‘কে বুঝতে পারছিস না? পৃথিবীতে মর্কট তো একটাই আছে। ওই মিথ্যেবাদী, জাল, জোচ্চোর-তোর শমীদা।’
দিঘি ঠোঁট কামড়াল। দিদির কাণ্ডজ্ঞান নেই একদম। সবার সামনে বাড়ির ঝামেলা এমনভাবে হাট করার মানে আছে কোনও? যদিও বন্ধুরা সবই জানে। তবু, সবাই সব কিছু জানলে কি আর সবার সামনে বলতে আছে? এটাই দিদি বোঝে না। মাঝে মাঝে খুব এমব্যারাসিং লাগে দিঘির। ও আড়চোখে দেখল এতক্ষণ গানের তালে মাথা নাড়ানো গুন্ডা, এই প্রসঙ্গটা উঠতেই জানলা দিয়ে যেন বাইরের প্যারিস শহর দেখতে লাগল!
‘কী রে বললি না, মালটা আর ফোন করে?’
‘না, শমীদা কলকাতায় নেই। সিঙ্গাপুর গেছে। কাদের সঙ্গে যেন মোল্ডেড উডের ফার্নিচারের জন্য কোলাবোরেশন করবে। প্রায় পনেরো দিন থাকবে।’
‘মোল্ডেড উডের ফার্নিচার!’ মহুলের গলায় একটা অদ্ভুত বিস্ময় দেখতে পেল দিঘি।
মহুল আবার বলল, ‘গেছে তো বাপের পয়সায়। একটা ফ্রড, মিথ্যেবাদী! আমায় সেদিন বলল প্রপোজালটার একটা ড্রাফ্ট ওকে দিতে। ও ওর বাবাকে দেখাবে। কিন্তু করল কিছু? সেই আগস্টে ওর জন্মদিনের থেকে এখন নভেম্বরের প্রায় শেষ। বলে কিনা ওর কাছে ফিরে যেতে। কে যাবে ফিরে অমন একটা মিথ্যেবাদীর কাছে? রাতের পর রাত শুধু ওর দাপাদাপি সহ্য করার জন্য? এর চেয়ে কনভ অনেক ভাল ছিল। এখন ভাবছি ওকে পাত্তা দিলেই হত। কিন্তু তারও তো উপায় নেই। সেও তো বিদেশে পালিয়েছে।’
‘দিদি!’ দিঘি রাগের গলায় বলল, ‘শোন, বাজে কথা রাখ। তোকে ছাড়া শমীদা কষ্টে থাকে। তাই তোকে ওর কাছে গিয়ে থাকতে বলে। সেদিন রেস্তরাঁয় তোকে সত্যিই বলেছিল। কিন্তু শমীদার বাবা দু’মাস হল লন্ডনে গেছেন। নিজের কাছে তোকে নিতে চায় বলেই শমীদা চেষ্টা করে। কিন্তু হয়তো পারে না। তা বলে এমন করে বলিস না। সবাই তো আর ভালবাসা এক্সপ্রেস করতে পারে না। কেউ হয়তো শমীদার মতো করে। আবার কেউ হয়তো অন্যভাবে করে। হয়তো চুপ করে…’
নিজেকে অনেক কষ্টে সামলাল দিঘি। কীসব বলে ফেলছিল ও! আজকাল এই হচ্ছে বিপদ। সব কথাই কেমন যেন বেঁকে যাচ্ছে দিঘির। আর চলে যাচ্ছে সেই এক লক্ষ্যে!
‘কিন্তু আমি অমন নই। আমি দিঘিকে ভালবাসি আর খোলাখুলি বলি, না?’ আর্য পিছন ঘুরে সামনের দুটো সিটের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিঘির হাত দুটো ধরার চেষ্টা করল।
‘আবার আলু… মানে ইয়ে শুরু করেছিস?’ গুন্ডা মহুলের কথা ভেবেই নিজেকে সংযত করে নিল।
ঝগড়াটা আরও বাড়ত। যদি না বাড়িতে পৌঁছে যেত ওরা। মহুল গাড়িটা পার্ক করে, নেমে বলল, ‘বাকি ঝগড়াটা বাড়িতে গিয়ে হবে। আর আর্য যখন তখন আমার বোনের গায়ে হাত দিয়ে আলুবাজি করবি না, বুঝেছিস?’
আর্যর থতমত মুখের ওপর সারা শরীর কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে উঠল গুন্ডা।
আর্যর মুখটা দেখে কষ্ট হল দিঘির। ও ধমক দিল গুন্ডাকে, ‘আঃ, থামবি তুই? দশেরার রাবণের মতো লাগছে। চল ঘরে।’
দু’পা এগিয়ে ওদের বাড়ির সিঁড়িতে উঠতে গিয়েও থমকে গেল মহুল, দিঘি আর বাকিরা। মহুল বলে উঠল, ‘আরে আদি! আজ বিকেলে হঠাৎ পাড়ায়?’
দিঘি ঘুরে দেখল আদিত্যকে। ওর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ক্ষণিকের জন্য মনে হল তা হলে সেও কি… না, তা কী করে সম্ভব? সে তো চলে গেছে পাড়া থেকে। কোথায় গেছে কে জানে!
আদি চিরকালীন গম্ভীর। আজ যেন আরও গম্ভীর লাগল। বলল, ‘এমনি। কিছু বলবে?’
মহুল অপ্রস্তুত হল সামান্য। তবু স্মার্টনেস দেখিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তোর সেই পিডোফিল দাদাটি কই?’
‘মানে?’ আদির চোয়াল শক্ত হয়ে গেল হঠাৎ, ‘দাদাভাই পিডোফিল নয়, বাজে কথা বোলো না মহুল।’
‘তাই?’ আদির এমন মুখটা দেখেই বোধহয় একটু থমকে গেল মহুল। তারপর লাইট করার জন্য বলল, ‘আরে জাস্ট পুলিং ইয়োর লেগ্স। তা কোথায় কিগানদা?’
আদি চোয়াল শক্ত করে দিঘির দিকে তাকাল একবার। তারপর অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, ‘জানি না। দাদাভাই কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না আর।’
কলকাতা একটা ঘষা কাচের শহর। এখানে প্লাস্টিকের মানুষজন থাকে। ময়লা পাতিলেবুর মতো চাঁদ ওঠে এখানকার আকাশে, উত্তর থেকে আঁশটে গন্ধ নিয়ে আসে শীতের না-আসা হাওয়া। এখানে এ ওর গায়ের মাংস খুঁজতে বের হয় মানুষের মতো দেখতে জন্তুরা। বড় বড় ঠোঁট ঝুলিয়ে ব্রিজের মাথায় বসে থাকে চিল। এখানে বকুল ফুলের থেকে মরা ইঁদুরের গন্ধ আসে। দিঘি জানে এখানের ওই দোতলার দক্ষিণের জানলায় আর আলো জ্বলে না। মাস্কের মন-কেমন করা গন্ধ আর আসে না এ পাড়ায়।
দিঘি জানে ওর কাছ থেকে সারা জীবনের মতো চলে গেছে কিগান।