মুহূর্তরা দু’বছর আগে – ৭

মোবাইল ফোনটা নতুন অফিস থেকে দিয়েছে। কিন্তু খুব একটা দামি নয়। বরং একদম সাধারণ। ছোট রঙিন স্ক্রিন। তাতে ছানাকাটা ছবি আসে। তবু মোবাইল তো! প্রোজেকশন কর্প-এ ওকে সুখেনদাই ঢুকিয়েছেন। আর বলেছেন, ‘আমি দেখি তুই ক’টা চাকরি পালটাতে পারিস। মাইরি রুহান, খেলাটা তো গেছেই, মানুষ হিসেবেও এমন ক্যালাস কেন তুই?’

প্রোজেকশন কর্প-এ সুপারভাইজার পদে ঢুকেছে রুহান। কিন্তু আসলে টুকটাক কাজ ওকে দেওয়া হয়। জব সাইটে মাল পৌঁছে দেওয়া, লেবার পেমেন্টের টাকা নিয়ে যাওয়া, বাজার থেকে খুচখাচ ফিটিং কেনা ইত্যাদি মিসলেনিয়াস কাজ করে ও। মাসে চার হাজার টাকা প্লাস টিএ। কনট্রাক্ট-এ রাখা হয়েছে ওকে। অন্যান্য বেনিফিট নেই।

তবে বেনিফিট টিট নিয়ে কখনওই চিন্তা করে না রুহান। সুখেনদার কল্যাণে চাকরি যে পেয়েছে, এই অনেক। না হলে ওর যোগ্যতায় কি আর এসব হত নাকি? আগের চাকরিটা যেদিন গেল সেদিন বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে যা হেনস্থা হয়েছিল ও!

মা। মনে পড়লেই ভয় লাগে রুহানের। দিনকে দিন মা যেন আর সহ্যই করতে পারছে না রুহানকে। রুহান সামনে আসলেই যেন মায়ের প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। চাকরি গেল যেদিন সেদিন তো রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিল রুহান। ভেবেছিল ডাক্তার টাক্তার ডাকতে হবে বোধহয়।

দু’টি মাসের মাইনের খাম হাতে নিয়ে বাড়িতে ফিরে প্রথমেই তোপের মুখে পড়েছিল রুহান। মা বসে ছিল ঘরে। মুখচোখ লাল। ও বুঝতে পারেনি কেন এমন করে রয়েছে মা। তাই জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী হয়েছে মা? শরীর খারাপ?’

‘তোর মতো জানোয়ার ছেলে থাকলে শরীর, মন সব খারাপ থাকে।’

‘কেন? আমি কী করলাম?’ রুহান অবাক হয়ে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে।

‘জানোয়ার, খেয়ার বাপের বাড়ি গিয়েছিলি কেন তুই?’

‘কাকিমার বাপের বাড়ি? কে বলল তোমায়?’ রুহান অপ্রস্তুত হয়েছিল খুব।

‘ও, লুকিয়ে-চুরিয়ে আজকাল এসব করা হচ্ছে! খেয়ার মা ফোন করে বলছিল যে, তুই খুব ভাল। খাবার পৌঁছে দিয়েছিস। ভাল! হুঁঃ। ঘরের শত্রু বিভীষণ! কাকা-কাকিমা চাকরের মতো খাটাচ্ছে আর তুই খাটছিস। গোরু একটা। সারাজীবন এমন গোরু হয়ে থাকবি তুই? বাবাকে খেয়েছিস এবার আমায় খাবি?’

‘মা,’ রুহান চিৎকার করে উঠেছিল, ‘কী যা-তা বলছ? কেন তোমায় খাব?’

‘অ্যাঁ, আমার জন্য কী করেছিস তুই? কী করেছিস আমার জন্য?’ মা চিৎকার করছিল সমানে, ‘ও, তা করবি কেন? আমার জন্য করলে তো আর আমি ফোন করে তোর নামে অন্যের কাছে সুখ্যাতি করব না। মা তো আপদ, মরলেই হয়!’

‘কেন এমন বলছ মা?’ রুহানের ক্লান্ত লাগছিল, ‘তোমার জন্য কিছুই করিনি আমি?’

রুহানের মনে পড়ে যাচ্ছিল সব। নন্দার মুখটা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে।

‘না, কিচ্ছু করিসনি। বরং আমার স্বামীকে খেয়েছিস।’ মা হাঁফাচ্ছিল রীতিমতো।

রুহান কী করবে, কী বলবে, বুঝতে পারছিল না। ও পকেট থেকে মাইনের খামটা বের করে মায়ের দিকে দিয়ে রাগটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, ‘মা, বাদ দাও। এটা রাখো। দু’মাসের টাকা।’

‘দু’মাসের? কেন?’ মা থমকে গিয়েছিল।

ভুল। আবার ভুল। রুহান যে সারাজীবনে কত ভুল করবে! কষ্ট হচ্ছিল নিজের নির্বুদ্ধিতায়। ভাবছিল, কী করতে গিয়ে কী বলে ফেলল।

মা বুঝে গিয়েছিল এক লহমায়। তারপর বলেছিল, ‘ও এই কাজটাও খুইয়েছিস? ইতর একটা! অকম্মার ঢেঁকি! লোকের হয়ে বিনি পয়সায় চাকরগিরি করতে পারো আর একটা ঢঙের চাকরি রাখতে পারো না। তোর জন্য কি এবার লোকের বাড়িতে ঝি-গিরি করব নাকি? ক্লাব থেকেও তো এক পয়সা আনিস না। অমন বাপের এমন অপদার্থ ছেলে হল কী করে?’

মা চিৎকার করতে করতে হঠাৎ টলে পড়ে গিয়েছিল বিছানায়। রুহান ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়েছিল মায়ের দিকে। মা চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। কোনও কথা বলছিল না। খাবার জলের গ্লাস থেকে হাতে জল নিয়ে মায়ের মুখে ঝাপটা মেরেছিল রুহান।

চোখ মেলে মা বলেছিল, ‘মরিনি এখনও। অত সহজে মরব না। দেখব তুই অধঃপাতের কোন চরম সীমায় যেতে পারিস।’

অধঃপতন! রুহান মাথা নিচু করেছিল। চুরির অপবাদে চাকরি যাওয়া। প্রেমিকাকে অদ্ভুত পরিস্থিতিতে ছেড়ে আসা। খেলার টিম থেকে বাদ হয়ে যাওয়া। বাবার মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হওয়া। আর কোথায় পতিত হবে রুহান? আর কত দূর নামবে ও?

ভাগ্যিস সেপ্টেম্বর থেকেই এই প্রোজেকশন কর্প-এ সুখেনদা ঢুকিয়ে দিয়েছেন রুহানকে। না হলে কপালে যে কত ভোগান্তি ছিল! রুহান এই কাজটা আর হারাতে চায় না। কোম্পানিটা খুব ভাল। এক বছর ভাল কাজ করলে বলেছে পার্মানেন্ট করে নেবে। এবার চাকরি গেলে সুখেনদা আর কিছু করবেন না। মানে, রুহানের আর নিজের কিছু বলার মুখ থাকবে না। তাই কাজটা মন দিয়েই করছে। এই যেমন আজ রোববার, তবু দরকার বলে কাজে বেরিয়েছে।

প্রোজেকশন কর্প ত্রিপুরায় একটা বড় সোয়েজ ট্রিটমেন্ট প্লান্টের অর্ডার পেয়েছে। সেখানে অনেকগুলো রিডাকশন গিয়ার লাগবে। এখন, রিডাকশন গিয়ারের মেক, অর্থাৎ কোন কোম্পানির রিডাকশন গিয়ার হবে তা বলে দেওয়া রয়েছে অর্ডারে। কিন্তু প্রোজেকশন কর্প খুব খারাপ দামে কাজটা নিয়েছিল, তাও দেড় বছর আগের রেটে। কিন্তু সব কিছুরই তো দাম বেড়ে গিয়েছে। ফলে লস নির্ঘাত হবে।

ঠনঠনিয়ায় কিছু দোকান আছে যেখানে ব্র্যান্ডেড কোম্পানির নামে ডুপ্লিকেট জিনিস বিক্রি হয়। প্রোজেকশন কর্প তেমন একজন দোকানির সঙ্গে কথা বলে মাল নেবে ঠিক করেছে।

আজ রোববার, দোকান বন্ধ, কিন্তু তবু দোকানের লোকটি তার ম্যানেজারকে পাঠাচ্ছে কিছু ক্যাশ নেবে বলে।

নিজের ঘড়িটা বেশ কিছুদিন হল নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এখন আর ঘড়ি টড়ি পরে না রুহান। তা ছাড়া মোবাইল তো সময় বলেই দেয়। মোবাইলেই সময় দেখল ও। দেড়টা বাজে এখন। এবার এখান থেকে কাজ সেরে দেশপ্রিয় পার্কে যেতে হবে। একটা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আছে। ওই টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ধাঁচের। খেললে দু’হাজার টাকা পাওয়া যাবে। একটা মারোয়াড়ি কোম্পানি আয়োজন করেছে টুর্নামেন্টটার। ষোলোটা টিম খেলবে। চ্যাম্পিয়ন হলে পাঁচ লক্ষ টাকা পাবে টিম। তবে টিম মানে নানা ছোটখাটো ক্লাব টিম। তারা বেশির ভাগই কলকাতার এ-ডিভিশন ক্লাবগুলো থেকে প্লেয়ার তুলে আনে। আর টাকার জন্য প্লেয়ারও খেপ খেলে দেয়।

রুহান এসব খেপটেপ খেলত না একদম। ওর মনে হত, ফাস্ট বোলারদের জীবন এমনিতেই প্রচুর চোট-আঘাতের হয়। তার ওপর যদি কেউ বেশি চাপ দেয়, তা হলে খেলোয়াড় জীবন অনেক ছোট হয়ে যাবে। তাই যে যতই টাকার প্রলোভন দেখাক, স্টার ইউনিয়নে যোগ দেওয়ার পর রুহান আর এই ছোটখাটো ঘুঘনি-পাউরুটির খেলায় ঢোকেনি।

কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্য। তিরিশ বছর বয়স হয়ে গেছে ওর। বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নরা ধরাশায়ী হয়েছে একে-একে। এখন শুধু ভয়, স্টার যদি বাতিল করে দেয় ওকে! যদি বলে দেয়, ভাই এবার এসো। তবে? তবে কী হবে? কোথায় যাবে ও এই বয়সে?

তাই ফসল তুলে নিতে হবে। যেখানে যতটা রোজগার করা যায়, সবটা করে ফেলতে হবে। তবু বহু বছরের অভ্যেস, তাই হালকা দ্বিধা ছিল। কারণ, জগুদা।

জগুদা শুধু স্টার ইউনিয়নে ওকে আনেনি। বরং হাতে ধরে বল করা শিখিয়েছে। বুঝিয়েছে, ফাস্ট বোলিং মানে গায়ের জোর দেখানোই নয় শুধু। এ আরও বেশি কিছু। আরও জীবন্ত কিছু। অতটা দৌড়ে এসে যে অমন জোরে বলটা ছুড়ছে, সে তো শুধু আর নিজের শক্তির পরীক্ষা দিচ্ছে না। সে জীবনীশক্তি আর মস্তিষ্কশক্তিরও পরীক্ষা দিচ্ছে।

জগুদাই প্রথম বুঝিয়েছিল যে, ফাস্ট বল করা মানেই সব বলকে জোরে করতে হবে, এমন নয়। বরং ভাল বোলার সবসময় গায়ের জোরের চেয়ে বুদ্ধিকে প্রাধান্য দেবে। তখন জগুদা একদম চোখে চোখে রাখত রুহানকে। পান থেকে চুন খসলে বকে শেষ করে দিত।

এমনই এক সময় নৈহাটির একটা টিম কলকাতায় এসে রুহানকে ওদের হয়ে একটা টুর্নামেন্ট খেলতে বলে। বলে, দশ হাজার টাকা দেবে। সে টিম জিতুক বা হারুক, যাই হোক না কেন। রুহানের আনন্দ হয়েছিল খুব। তা ছাড়া সংসারে টাকাটাও দরকার ছিল। তবে লুকিয়ে-চুরিয়ে নয়। ও ভেবেছিল জগুদাকে বলেই যাবে। জগুদার তো না বলার কারণই নেই।

কিন্তু জগুদা রেগে গিয়েছিল ভীষণ। রুহান যখন কথাটা বলেছিল জগুদার হাতে একটা স্টাম্প ছিল। রুহানের কথাটা শুনে জগুদা প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘না, না, একদম নয়। খবরদার ওই পথ মাড়াবি না।’

‘কেন জগুদা?’ রুহান অবাক হয়েছিল।

‘কেন মানে? আমি বলছি বলে।’ জগুদা বিরক্ত হয়ে তাকিয়েছিল ওর দিকে।

‘কেন বলছ?’ রুহানের মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। বয়সে যারা বড় হয় তারা মাঝে মাঝে এমনভাবে কথা বলে যেন মাথা কিনে নিয়েছে। সম্মান করা হয় বলে কি যা ইচ্ছে তাই বলবে নাকি!

‘বলছি যখন শুনতে আপত্তি কোথায় তোর?’ জগুদার চোখ দুটো যেন জ্বলছিল।

‘কেন বলবে তো? জানো, ওরা টাকা দেবে? দশ হাজার টাকা।’

‘টাকা?’ নাক কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়েছিল জগুদা, ‘তো? টাকা দেবে তো কী হয়েছে? মাথা কিনেছে নাকি?’

‘আমার টাকাটা দরকার জগুদা। খুব দরকার।’

‘দশ হাজার টাকার জন্য ভবিষ্যতের দশ লাখ বাদ দিবি?’

‘মানে?’ রুহান অবাক হয়েছিল।

‘গাধা তুই? আস্ত গাধা নাকি? স্টার থেকে এবার তোর বেঙ্গলে চান্স হতে পারে। আর সে এমন ভিখিরিগিরি করার জন্য খেপ খেলে বেড়াবে? লজ্জা লাগছে না?’ বিরক্তিতে হাতের স্টাম্পটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল জগুদা।

‘কিন্তু টাকাটা যে এখন ইম্পর্ট্যান্ট।’ রুহান আর কী বলবে বুঝতে পারছিল না।

‘ইম্পর্ট্যান্ট। হ্যাঁ, ইম্পর্ট্যান্ট। জানি। কিন্তু শুধু টাকাটাই চিনবি? আর কিছু ভাববি না? এদেশে মানুষ মেরেও হাজার হাজার টাকা রোজগার করা যায়। লোক ঠকিয়ে রোজগার করা যায়। ইম্পর্ট্যান্ট বলে তাই এগুলোও করবি? নাথিং ইজ ইম্পর্ট্যান্ট আনলেস উই মেক ইট সো। আরে টাকাটাই শুধু দেখিস? ডিগনিটি কিছু নয়? ফাস্ট বোলারের শরীরটাই সব। বাজে জায়গায় খেলে এই শরীরটার ক্ষমতা কমাবি কেন? জানিস, এইসব খেপ খেলার মাঠ কেমন হয়? তারপর কত ম্যাচ খেলতে হয়? ফালতু চোট হয়ে গেলে কী করবি? শুধু টাকা আর টাকা। লোভ। এত লোভ কেন তোদের?’

জগুদার উত্তেজিত চেহারা আর চিৎকারে আশপাশে লোক জমে গিয়েছিল। অন্যান্য যারা প্র্যাকটিস করছিল তারা নেট ছেড়ে চলে এসেছিল। দু’-চারজন কর্মকর্তা আশপাশের আড্ডা ছেড়ে উঠে এসেছিল। আর সব্বাই অদ্ভুত এক চোখে দেখছিল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা রুহানকে।

রুহান, উত্তেজিত জগুদার সামনে থেকে সরতেও পারছিল না। আবার সবার অমন, ‘এই ব্যাটা চোর’ ধরনের দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও খারাপ লাগছিল। আসলে কষ্ট হচ্ছিল রুহানের। মনখারাপ হচ্ছিল। ও কী এমন কথা বলেছে যে, জগুদা এমন রাগ করল? ও তো ইচ্ছে করলে না বলেও খেলতে যেতে পারত। জগুদা জানতে পারত? সততা দেখাতে গিয়ে এ কেমন ঝঞ্ঝাট হল রে ভাই!

জগুদার রাগও যেন কমছিল না। এক নাগাড়ে বলেই যাচ্ছিল যা খুশি কথা। রুহান মাথা নিচু করেছিল শুধু। শেষে জগুদা বলেছিল, ‘আমি যদি শুনি তুই খেলতে গেছিস, তা হলে তোর একদিন কি আমার একদিন। যেমন রাস্তায় ছিলি তেমনই রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেব তোকে।’

জগুদার রুদ্রমূর্তি আর শেষের কথাটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল রুহান। ও রাস্তায় পড়ে ছিল? রাস্তা থেকে ওকে কুড়িয়ে এনেছে? জগুদা এমনটা বলতে পারল!

বাড়ি ফেরার পথে খুব কান্না পেয়েছিল রুহানের। সবার সামনে জগুদা এমন বলতে পারল! মনে হয়েছিল আর মাঠে যাবে না কোনওদিন। কী হবে মাঠে গিয়ে? ও ছোট, সামান্য প্লেয়ার তাই কি ওকে অসম্মান করা, খারাপ কথা বলা সহজ? আর রাস্তার ছেলে তো ও নয়। বাবা যদি অমনভাবে মারা না যেত ও কি আর এই অবস্থায় থাকত? দিব্যি তো রেজাল্ট ভাল হচ্ছিল ক্রমশ। বাবা যে হঠাৎ কেন মারা গেল?

বাড়িতে ফিরে যথারীতি মায়ের গঞ্জনা শুনে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। তা ছাড়া বন্ধুবান্ধবও তো কেউ নেই রুহানের। আর যে ছিল, সেই কিগান থাকত নর্থে। সুকিয়া স্ট্রিটে।

আচমকা মায়ের ডাক শুনতে পেয়েছিল ও। মুখ ঘুরিয়ে দেখেছিল ছাদের দরজার কাছে মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে জগুদা!

জগুদা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছিল ওর দিকে আর মা আবার নেমে গিয়েছিল নীচে।

রুহান যতই রেগে থাকুক বা ওর যতই মনখারাপ হোক কোনওদিনই কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারে না। জগুদাই বলে যে, ওর ফাস্ট বোলার হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হল এই নরম স্বভাব। পৃথিবীর অধিকাংশ ফাস্ট বোলাররা অ্যাগ্রেসিভ হয়।

রুহান তর্ক করত, বলত, ‘কোর্টনি ওয়াল্‌শ? তিনি তো অমন নন।’

‘আরে পাগলা,’ জগুদা হাসত খুব, ‘একসেপশন এগজ্যাম্পেল হতে পারে নাকি?’

সেই জগুদা এসে পাশে দাঁড়িয়েছিল রুহানের। দূরে বজবজ লাইন ও তার সবুজ-হলুদ ট্রেনের দিকে তাকিয়ে জগুদা হাতে ধরা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট ছাদের পাঁচিলের ওপর রেখে বলেছিল, ‘পেঁয়াজি আছে। বুধনের পেঁয়াজি। যদিও এসব খাওয়া আমার ছেলেদের আমি এনডর্স করি না। তাও, আজ খা।’

রুহান কিছু না বলে দূরে তাকিয়েছিল।

জগুদা বলেছিল, ‘কী রে খুব রেগে আছিস? নে, খা তো।’

গোল ঘুঁটের মতো দেখতে পেঁয়াজি হাতে নিয়েছিল রুহান।

জগুদা সামনে দিয়ে যাওয়া ট্রেনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেছিল, ‘লোকাল ট্রেনের সঙ্গে দূরপাল্লার মেল ট্রেনের পার্থক্য কী জানিস?’

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল রুহান। ও বুঝেছিল উত্তরটা জগুদাই দেবে।

‘শোন,’ জগুদা শুরু করেছিল, ‘মেল ট্রেন লোকাল ট্রেনের মতো সব স্টেশনে দাঁড়ায় না। সে অধিকাংশ স্টেশন টপকে গন্তব্যের দিকে দৌড়োয়। সে খেয়াল করে না, কার কী মনে হয়। জীবনে দূরে যেতে হলে বারবার থামলে হয় না। লোকাল ট্রেন হয়ে থাকলে, ইন্ডিয়া কাপ আসবে?’

চোখে জল এসে গিয়েছিল রুহানের। ও তাড়াতাড়ি বলেছিল, ‘ওঃ, লঙ্কা এত ঝাল যে, চোখে জল চলে এল।’

জগুদা হেসে বলেছিল, ‘লঙ্কা? আমি বারণ করেছিলাম, তাই দেয়নি। কান্না খারাপ নয়, তবে না আসতে দেওয়াই ভাল। ক্যাকটাসের জলের দরকার হয় না। যত রগড়ানি খাবি, বলের বিষ তত বাড়বে। বুঝেছিস?’

এতগুলো বছর তো বুঝেইছিল রুহান। কিন্তু তাতে হলটা কী? সত্যি কী হল? সব যেন কেমন গুলিয়ে ঘেঁটে গেছে রুহানের। নন্দা, মা, খেলা। সব কিছুতেই এত মার খাচ্ছে যে, কী বলবে? আর কিছু বলতে ইচ্ছে করে না ওর। ভাবতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু জীবন এমন হয়ে গেছে যে, ভাবতেই হয়।

গত দু’দিন আগে হঠাৎ আবেশ এসেছিল বাড়িতে। একদম আচমকা এসেছিল। অবশ্য ও এমনভাবেই আসে। আবার হঠাৎ হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়। এমন ছেলে কোনওদিন দেখেনি রুহান। পয়সার জন্য যেন সব করতে পারে আবেশ।

বহু দিন পর আবেশকে দেখে একটু অবাকই হয়েছিল রুহান। জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী রে তুই? এতদিন পর? ছিলি কোথায়?’

আবেশ হেসেছিল, ‘দরজায় দাঁড়িয়েই তিনটে প্রশ্নের উত্তর শুনবি?’

‘আয়, আয়।’ রুহান ডেকে নিয়ে গিয়ে আবেশকে নিজের ঘরে বসিয়েছিল।

আবেশ চোখ ঘুরিয়ে ঘরটা দেখছিল ভাল করে। লাল মেঝে। তবে মাঝে মাঝে খোশটা উঠে গেছে। দেওয়ালটার চুনকামে এখন সেঁকা পাঁউরুটির মতো রং ধরেছে। তাতেও ভিভ রিচার্ডস আর ম্যালকম মার্শালের প্রায় জ্বলে যাওয়া পোস্টার। সেগুন কাঠের খাট। যদিও কালো হয়ে গিয়েছে। একটা গদার মতো দেখতে পাখা আর টেবিল চেয়ার। আর টেবিলের তলায় ক্রিকেটের কিট। এইসব সামান্য তুচ্ছ জিনিসপত্রগুলো খুব মন দিয়ে সময় নিয়ে দেখছিল আবেশ।

অবাক হওয়ার সঙ্গে বিরক্তিও লাগছিল রুহানের। ফাটা জামা পরা মানুষকে যদি কেউ খুঁটিয়ে দেখে তার কি বিরক্তি লাগবে না? ও বলেছিল, ‘কী রে শালা, অমন করে কী দেখছিস!’

আবেশ হিঃ হিঃ করে হেসেছিল খুব। বলেছিল, ‘দেখছিলাম যে, ধোনির বাড়ির সঙ্গে তোরটার কতটা মিল!’

‘মারব শালা লাথ,’ রুহান ঠোঁট কামড়ে বলেছিল, ‘তোর মাথা খারাপ?’

‘না রে, তোর খারাপ। ভালই তো খেলতিস! তা এমন ক্যালানে হয়ে গেলি কেন? আর ওই টুকটাক যে ম্যাজিক দেখাতিস, তা কি দেখাস? না সেটাও গেছে?’

রুহান মাথা নিচু করে নিয়েছিল। ম্যাজিক দেখাত বটে রুহান। কিন্তু সে তো সামান্য শখ। আবেশের মনে আছে সেটা!

আবেশ হেসে ওর বিছানায় আধশোয়া হয়ে বলেছিল, ‘তোদের ওই জগু মাস্টার শালা হেভি খিটকেল, তোর পেছনে দিয়ে নিজে লোকাল টুর্নামেন্টে টাকা প্যাঁদাচ্ছে।’

‘মানে?’ সোজা হয়ে বসেছিল রুহান। আবেশ কী বলছে? অবশ্য আবেশ সবসময় এমন ভুলভাল কথাই বলে, ওর কথাকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়ার কোনও মানে হয় না।

আবেশ আর রুহান সেই স্কুলজীবনের বন্ধু। একসঙ্গে সব ক্রিকেট খেলত ওরা। তখন আর একজন, ওদের চেয়ে সামান্য জুনিয়র, তার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আদিত্য। আদি। যদিও আদিকে অনেকদিন দেখে না ও। শুনেছে এখন ভাল চাকরি করে। ব্যস ওইটুকুই।

আর আদির সূত্রে ওদের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে যেত রুহান। তখন কী করে যেন আদির জ্যাঠতুতো দাদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। ক্রমশ সেটা বাড়তে বাড়তে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। আর আদির সঙ্গে সেই শুরু হয় দূরত্ব। বা বলা যায়, আদি যেন নিজেই ক্রমশ সরিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। কেন, রুহান জানে না। তবে কিগানের সঙ্গে দেখা হওয়াটা দারুণ ব্যাপার ছিল ওর কাছে। এখনও আছে। শুধু হঠাৎ কী যে হল মধ্যে থেকে!

আজও কিগানকে প্রথম দেখার দিনটা স্পষ্ট মনে আছে ওর।

শীতকাল ছিল সেটা। সকালবেলা আবেশ আর রুহান একরকম হামলা চালিয়েছিল আদিদের বাড়ি। বা আরও সঠিকভাবে বললে আদির ঠাকুরমার কাছে। আদির ঠাকুরমা ছিল অদ্ভুত মানুষ। যেমন সুন্দরী, তেমন পার্সোনালিটি। রান্নাবান্না, সেলাই, কথাবার্তা, সবেতেই দারুণ।

একদিন এই কথাটা এমন করেই বলেছিল রুহান। তাতে ঠাকুরমা বলেছিল, ‘এমন করে বলছিস যেন আবার আমার বিয়ের সম্বন্ধ করতে যাচ্ছিস। এই এত কিছু যা বলছিস সেই পারাগুলো বেঁচে থাকার মধ্যেই পড়ে। তার বেশি কিছু নয়, বুঝলি?’

না, ঠিক বোঝেনি রুহান। ও এমন কথাবার্তা কোনওদিনই ঠিক বোঝে না। মানুষ মাঝে মাঝে বাংলা ভাষাতে কথা বললেও ঠিক বাংলা মানেতে বলে না। কিন্তু রুহান একটা জিনিস বোঝে, যাতে নিজের ক্ষতিবৃদ্ধি হচ্ছে না, তা মেনে নিতে কোনও সমস্যা তৈরি করতে নেই।

আবেশ আর ওর সেই সময় রোববারগুলোর টার্গেট থাকত আদির বাড়িতে গিয়ে ওর ঠাকুরমার হাতের ঘিয়ে ভাজা লুচি আর কালোজিরে দিয়ে আলুর সাদা তরকারি খাওয়া। প্রথম দিন যেদিন গিয়েছিল সেদিনই খেয়েছিল। তার পরে আরও চারদিন খেয়েছিল। এর দু’সপ্তাহ পরে আবেশের প্ররোচনায় আবার হানা দিয়েছিল আদিদের বাড়িতে। মানে ঠাকুরমার কাছে।

সেদিন গিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিল রুহান। লুচি আর সাদা তরকারির সঙ্গে, চাকা চাকা বেগুনভাজা, কড়াপাকের সন্দেশ আর রাবড়িও রয়েছে।

আবেশ আনন্দের সঙ্গে প্রায় চিৎকার করে বলেছিল, ‘আরেব্বাস, এত কিছু!’

‘আমার নাতির জন্য।’ ঠাকুরমা মুখ টিপে হেসেছিল।

‘কে, আদি? কেন আদির আজ জন্মদিন?’

‘না আদির জন্য নয়, এ আমার বড় নাতির জন্য। বাইরে গিয়েছিল। আজ এসেছে। আসবে একটু পরে। তখন দেখবি। একেবারে রাজপুত্র।’

তা সেই শীতের সকালে প্রথম রাজদর্শন হয়েছিল রুহানের।

এখন কোথায় কিগান? কত মাস হয়ে গেল দেখা নেই! কথা নেই! তখন মোবাইল ছিল না। কথা বলতে পারেনি। কিন্তু এখন তো পারে রুহান। তবে বলে না কেন? লজ্জা? কার লজ্জা? যা হয়েছে তা সত্যিই কি কিগানের জন্য হয়েছে? সবাই তো তাই বলে। শুধু আদি? আদি কী বলে?

‘কী রে শালা, এবার মাটি থেকে উঠে টুঠে যাবি নাকি সমাধি অবস্থায়?’ একটা ছোট্ট বালিশ নিয়ে আধশোয়া অবস্থাতেই আবেশ ছুড়ে মেরেছিল রুহানের দিকে।

রুহান বালিশটা ধরে কোলের কাছে নিয়ে রেখে বসেছিল। তারপর বলেছিল, ‘বল, কেন এসেছিস?’

‘মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌স লিমিটেড-এর নাম শুনেছিস?’ আবেশ দরজার দিকে তাকিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বের করেছিল।

‘আরে মা আছে বাড়িতে।’ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রুহান উঠে দাঁড়িয়েছিল।

‘তো, দরজা বন্ধ করে দে। মাইরি, মায়ের কত বাধ্য! শালা, তুই সেই স্কুললাইফ থেকেই ঢ্যামনা রয়ে গেলি। ঘোমটার তলায় খ্যামটা নেচেই বয়স বাড়ল তোর। আমার মুখ খোলাস না। জিয়োগ্রাফির মিসেস বড়ুয়াকে লাগানোর সময় মায়ের ‘নো অবজেকশন’ নিয়েছিলি? আবার তার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছিস? আমায় সিগারেট দেখাচ্ছে!’

‘চুপ কর। প্লিজ চুপ কর।’ রুহান দৌড়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল।

‘শালা, মিসেস রবিনসনের কেস। তুই মাইরি আর ফালতু চো…’

‘চুপ কর না।’ রুহান এবার বালিশটা পালটা ছুড়ে মেরেছিল আবেশকে। তারপর বলেছিল, ‘কী জন্য এসেছিস, বল।’

‘তার চেষ্টাই তো করছিলাম। তুই এমন করলি যেন বাড়িতে বসে অ্যাটম বোমে আগুন লাগাচ্ছি!’ মুখ দিয়ে একটা বিরক্তির শব্দ করে সিগারেট ধরিয়ে শুরু করেছিল আবেশ, ‘আদির সঙ্গে দেখা করতে ওদের অফিসে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া মিজোরাম থেকে এসে কাজেরও দরকার ছিল। তাই…’

‘দাঁড়া, দাঁড়া,’ অবাক হয়েছিল রুহান, ‘মিজোরাম? সেখানে কী করছিলি?’

‘কুকুর ধরছিলাম।’ আবেশ ছোট্ট করে বলেছিল।

‘কুকুর? মানে? কেন?’

‘আচ্ছা মুশকিল! তাতে তোর কী? আমি কুকুর ধরি বা তিমি, তাতে তোর কিছু এসে যায়? কী বলতে এসেছি শোন।’

‘ওকে, ওকে…’ কৌতূহলটা অনেক কষ্টে চেপে রুহান মনঃসংযোগ করেছিল।

‘শোন, মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌স, একটা টোয়েন্টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট করতে চলেছে। ছ’টা টিম তৈরি করে তাদের মধ্যে লিগ সিস্টেমে খেলাবে। সেখান থেকে প্রথম চারজনকে নিয়ে সেমিফাইনাল, তারপর ফাইনাল।’

‘তা, তুই এর মধ্যে এলি কীভাবে?’

‘আরে, আমি আদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম ওর অফিসে। আদিকে ওর বস কথাটা বলছিল আদির কিউবিক্‌লের সামনে দাঁড়িয়ে। লোকটার নাম গৌর রওশন দিওয়ান। খুব চালাক-চতুর। আর অদ্ভুত ফ্রেন্ডলি। কে বলবে পুরো এই ইস্টার্ন জোনটার মাথা? কোনও ঘ্যাম নেই। তা, আদিকে বলল যে, ওদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়ানোর জন্য মুম্বইয়ের একজন নায়ককে ওরা কনট্যাক্ট করছে বিজ্ঞাপনের জন্য। সঙ্গে এখন যেটা বাজারে চলছে, টি-টোয়েন্টি, তাই অ্যারেঞ্জ করতে চায়। সেই নিয়ে একটা রিপোর্ট আদিকে দিয়েছে। তখন আদি আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল যে, আমি ভাল খেলতাম। কলেজ খেলেছি। সেকেন্ড ডিভিশন খেলেছি। তখন গৌর আদিকে বলল, তা হলে আমায় গোটা প্ল্যানটার সঙ্গে যোগ করে নিতে। তো, সেই নিয়ে আমি কাজ করছি।’

‘আরেব্বাস, চাকরি! এভাবে পেয়ে গেলি?’ অবাক হয়েছিল রুহান।

‘ইল্লি আর কী? চাকরি নয়, কাজটা করতে হবে। ব্যস। কী টাকাপয়সা পাব জানি না। আদি বলেছিল ওর সঙ্গে দেখা করতে। তাই গিয়েছিলাম। আর গিয়ে এটা জুটে গেল।’ আবেশ সিগারেটটা শেষ করে, ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে গিয়ে ফেলে দিয়ে আবার এসে বসেছিল।

‘সে কী রে! কাজ করবি, টাকার কথা জানিস না!’ খুব অবাক হয়েছিল রুহান।

‘সবসময় টাকাটা দেখতে নেই। এমনিও কাজ করতে হয়, বুঝলি?’

‘অ্যাঁ?’ রুহান ভুরু তুলেছিল, ‘শালা, এ যে, ভূতের মুখে রামনাম। নিশ্চয় কিছু পুল তোর আছে এর ভেতর। নেই?’

‘শোন, ওদের চারিদিকে নানা কাজকর্ম হয়। এই টুর্নামেন্টটা ভাল করে উতরে দিতে পারলে অন্যরকম একটা হিল্লে হয়ে যাবে আমার। বুঝলি?’ আবেশ হেসেছিল।

‘তা আমি কী করব? আমার কাছে কেন এসেছিস?’

‘সেটাই তো বলছি। শোন, নর্থ, সাউথ, ইস্ট আর ওয়েস্ট কলকাতা থেকে চারটে টিম, সঙ্গে নর্থ চব্বিশ পরগনা আর সাউথ চব্বিশ পরগনা থেকে একটা করে মোট ছ’টা টিম করতে হবে। সাউথ কলকাতা থেকে যে-টিমটা হবে তাতে তুই থাকবি।’

‘আমি? হঠাৎ?’

‘মনে হল তোর কথা। বলটা খুব ভাল করতিস তুই। একবার কলেজের একটা ম্যাচে মনে আছে কীভাবে ছ’ উইকেট নিয়েছিলি? তা, পারবি না খেলতে?’

‘পারব। কিন্তু সেই ফর্ম নেই রে আর! ভাল পারি না। কী হয়েছে কে জানে! কিন্তু সত্যি এখন মার খাই খুব। স্টার-এও ফার্স্ট টিমে নেই। আর চান্সও পাব না। আমায় বাছলে তোর বদনাম হয়ে যাবে। ভাল করে ভেবে দেখ।’

‘শালা, বড্ড বাজে কথা বলিস।’ আবেশ বিছানা থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়েছিল ওর সামনে, ‘কী হয়েছে তোর রুহান? এমন গোঁত্তা খেয়ে আছিস কেন? সবসময় ‘হবে না’, ‘পারব না’। এমন করছিস কেন?’

‘না, মানে, জগুদা জানলে রাগ করবে।’

খেঁকিয়ে উঠেছিল আবেশ, ‘তোদের সাউথের ক্লাবটাকে কোচ করবে জগুদা। সুখেনদা না কে একজন আছেন তোদের ক্লাবে। সে মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌সের কনসালটেন্ট। খবর শুনে ও-ই নিজের থেকে লিস্ট ধরিয়েছে আদির হাতে। শালা, স্টারের কর্মকর্তা তো তাই তার চোদ্দো গুষ্টির প্লেয়ার আর কোচদের এনে ঢোকাচ্ছে সব টিমে। বটুক নামে তোদের বেস্ট ব্যাটসম্যানটাকে নর্থের টিমে পুরেছে। সুখেনদাই তোর নাম দিয়েছে। জগু মালটা তেন্ডাই মেন্ডাই করছিল, কিন্তু ধোপে টেকেনি। শালা নিজে কামাবে, কিন্তু তোকে কামাতে দেবে না। গান্ডু!’

‘ওভাবে বলিস না। জগুদা আমার ভাল চায়।’ রুহান নিচু গলায় বলেছিল।

‘সেই জন্য টিমে নেয় না! রোজগারের জায়গায় কাঠি করে! তুই শালা মানুষ হবি না। কী করে যে, মিসেস বড়ুয়াকে তুই…’

‘আঃ, চুপ কর না!’ রুহান যেন জোর পাচ্ছিল না গলায়।

‘শোন, পার ম্যাচ দশ হাজার পাবি। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হলে পনেরো এক্সট্রা। চ্যাম্পিয়ন হলে কুড়ি লাখ টাকা প্রাইজ মানির ফাইভ পারসেন্ট। নেমে পড়। ফালতু মটকা গরম করিস না। নেক্সট সোমবার চলে আসবি এই ঠিকানায়। কনট্র্যাক্ট সই করে যাবি। আর এই নিয়ে একদম ঝোলাবি না।’ আবেশ একটা কার্ড দিয়েছিল ওকে।

আবেশ চলে যাওয়ার পর রুহান মাথা নিচু করে বসে ছিল। কোথায় ছিল আবেশ এতদিন? হঠাৎ কোত্থেকে এসে এমন একটা প্রস্তাব দিয়ে গেল! মার্চেন্ট মাল্টিপল্‌সের নাম ও শুনেছে। খুব বড় কোম্পানি। অনেক কিছু বানায়। এদের টুর্নামেন্ট তো বড়ই হবে।

পরের সোমবার কনট্র্যাক্ট সই করে প্রথম ম্যাচের আগাম হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিল। ভালই লেগেছিল। তবে জগুদা ওখানে বসে থাকলেও একদম কথা বলেনি। এমনকী গত দু’দিন সকালের প্র্যাকটিসেও কথা বলেনি। আজ গেলে খেলাবে কিনা কে জানে! পায়ের চোটটা নেই আর। তবু জগুদা প্র্যাকটিস ম্যাচেও চান্স দেয় না।

নভেম্বরের প্রথম। তবুও গরম আছে বেশ। এই দুপুর দুটোয় সূর্যর যা মেজাজ তাতে মানুষ গলে যেতে পারে। নন্দা বলত, ‘আমার একদম গরম পোষায় না। বিয়ের পর শোওয়ার ঘরে এসি লাগাবে তো?’

বিয়ের পর! আমহার্স্ট স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎ যেন মুখটা তেতো হয়ে গেল রুহানের। এই অঞ্চলে প্রচুর বিয়ের কার্ডের দোকান। আজ বন্ধ, কিন্তু তবু তাদের হোর্ডিংগুলো দেখা যাচ্ছে। নন্দা ওকে বিয়ের কথা বলত বারবার। ভালবাসত, খুব ভালবাসত মেয়েটা ওকে। ও-ও তো বাসত। কিন্তু টাকাপয়সার ব্যাপারে এমন খচখচ করত, অপরাধী মনে হত নিজেকে। আর অপরাধবোধ নিয়ে কক্ষনও প্রেমের পূর্ণতা আসে না।

‘আরে দাদা সরি, অনেক দেরি হয়ে গেল।’ আচমকা গলার স্বরে সংবিৎ ফিরল রুহানের। লোকটা ঠিক চিনতে পেরেছে। আসলে রুহান ফোনে বলেছিল যে, আমহার্স্ট স্ট্রিট মোড়ে যে-মিষ্টির দোকান রয়েছে তার সামনে হলুদ রঙের টি-শার্ট পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ও। লোকটা ঠিক চিনেছে।

লোকটা পকেট থেকে একটা দশ টাকা বের করে বলল, ‘নিন, মিলিয়ে নিন, আমি সেই লোক কিনা!’

অফিসে এইভাবে লোক চেনা আর টাকা লেনদেন হওয়ার প্রক্রিয়া ও গল্প যখন প্রথম শুনেছিল, খুব আশ্চর্য হয়েছিল রুহান। যেন ফুটপাথের গোয়েন্দা গল্পের প্লট। কিন্তু তারপর শুনেছিল বহু জায়গাতেই এমনভাবে কেনাকাটা, লেনদেন হয়।

অফিস থেকেই ওকে একটা কাগজে একটা নম্বর দিয়ে বলা হয়েছিল যে, এই নম্বরের নোট যে দেখাবে তাকে যেন দেওয়া হয় টাকা। লোকটা নম্বর দেখানো মাত্র হাতের প্লাস্টিকে মুড়ে রাখা চোদ্দো হাজার টাকা লোকটার হাতে দিয়ে দিল রুহান। তারপর যেমন হঠাৎ করে এসেছিল লোকটা, তেমন হঠাৎ করে চলে গেল টাকা পাওয়ামাত্র।

এবার মাঠ। রুহান সময় দেখল মোবাইলে। প্রায় তিনটে বাজে। এখান থেকে বাসে করে দেশপ্রিয় পার্ক পৌঁছোতে গেলে এ খেলা তো বাদ দাও, পরের খেলাও শেষ হয়ে যাবে। গা চড়চড় করছে, তবু শিয়ালদার দিকে যেতে থাকা একটা ট্যাক্সি ধরল রুহান।

রুহানের কাছে শুধু ছোট একটা ব্যাগ রয়েছে। তাতে ওর জুতো আর মোজাটা রাখা আছে। বাকি জার্সি তো টিমের কাছেই পাওয়া যাবে।

রুহান ট্যাক্সির জানলা দিয়ে শহর দেখতে দেখতে যেতে লাগল। না, টেনশন হচ্ছে না তেমন। কারণ, জগুদার যা মুড দেখেছে, তাতে ও নিশ্চিত যে, ওকে জগুদা খেলাবে না কিছুতেই। ফলে পুরো ম্যাচ খেললে দশ হাজার। আর রিজার্ভে ফুলদানির মতো বসে থাকলে পাঁচ হাজার। আর সেই পাঁচ তো কনট্র্যাক্ট সইয়ের সময়ই পেয়ে গিয়েছে। ফলে আজ ট্যাক্সি ভাড়াটা গোটাটাই লস। জগুদার যে কী শত্রুতা ওর সঙ্গে!

দেশপ্রিয় পার্কের মাঠটা আলো, হোর্ডিং, নতুন চুনের দাগ আর ম্যাটিং উইকেট দিয়ে সাজানো হয়েছে। আর লোকজনও হয়েছে মোটামুটি।

এই ধরনের রংচঙে ক্রিকেটের একটা মজা আছে। খেলা কী হবে ঠিক নেই কিন্তু হাবভাবে একদম চকচকে মহার্ঘ হয়ে থাকে। মনে হয়, এর চেয়ে ভাল আর কিছু নেই।

ওদের টিমের নাম ‘সাউদার্ন ব্রিজ’। দখিণা বাতাস যে এই হেমন্তের সময় কোত্থেকে বইছে, তা বুঝতে পারল না রুহান। কারণ ট্যাক্সি থেকে নেমেই একদম বাঘের সামনে পড়ল। জগুদা!

এ ক’দিন জগুদা কথা বলেনি। কিন্তু আজ দেখামাত্র দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর নিজের থেকেই এগিয়ে এসে বলল, ‘কনট্র্যাক্ট সই করেই একদম ট্যাক্সি থেকে নামছিস? পরে, ম্যাচ খেললে তো কানে দুল, গলায় হার এসবও চড়াবি!’

রুহান থতমত খেল। আমতা আমতা করে বলল, ‘না জগুদা, ওই নর্থ থেকে আসছি। অফিসের কাজ ছিল। দেরি হয়ে গেছে তো!’

‘দেরি নয়। অনেক কিছুই হয়েছে। চল তাড়াতাড়ি, ড্রেস করবি। তোকে দলে রাখা হয়েছে।’ জগুদা আর না দাঁড়িয়ে মাঠের লোহার গেট পেরিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে।

বাকি পাঁচ হাজার! প্রথম এটাই মনে এল রুহানের। আর সঙ্গে সঙ্গে খারাপ লাগল। ইস, টাকা আর টাকা! শুধু টাকা ছাড়া কি ও নিজে কিছু ভাবতে পারে না? ওর তো ভাবা উচিত যে, নর্থ কলকাতার টিম, ‘গ্লেসিয়ার নর্থ’-এর প্রধান ব্যাটসম্যান বটুককে প্রথম বলেই তুলতে হবে। তা নয়, ও ভাবছে টাকা। কোনও সত্যিকারের স্পোর্টসম্যান এমন ভাবে? ও নিজে দু’বছর আগে এমন ভাবত? নিজের ওপরই নিজের বিরক্ত লাগল রুহানের।

নিজেদের টেন্টে গিয়ে ড্রেস করে এক কোনায় চুপ করে বসল রুহান। প্রতিটা ম্যাচে নামার আগে ও চুপ করে বসে একটু সময়। নিজের ভেতরের বাকি সব কিছু বের করে শুধু খেলোয়াড় মানুষটুকুকে ধরে রাখে।

কিন্তু আজ তখনই এল আবেশ। গলায় অফিশিয়ালের কার্ড আর মুখে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত লোকের বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে এসে বলল, ‘আরে, সেদিন তোকে যে বললাম, প্যান দিতে। তা দিলি না তো নম্বরটা। আরে বাবা, টাকা নিবি আর নিয়ম মানবি না?’

‘প্যান?’ রুহান অবাক হল, ‘কেন, তোকে বললাম না আমার ওসব নেই।’

‘নেই? সে কী?’ আবেশ এমন করে আঁতকে উঠল যেন কলকাতার থেকে হাওড়া ব্রিজ গায়েব হয়ে গিয়েছে!’

‘হ্যাঁ, তোকে বললাম তো। তাতে যা টাকা কাটার তা কাটবি। আমি আর কী বলব? এখন একটু কনসেন্ট্রেট করি! একটু স্পেস দে।’

আবেশ আরও কিছু বলতে গিয়েছিল কিন্তু তার আগেই একটা নরম মেয়েলি গলা আবেশকে পিছন থেকে ডাকল, ‘বাদ দিন। ম্যাচের পরে যা বলার বলবেন, এখন এখানে আমাদের না থাকাই ভাল।’

গলার স্বরের ভেতরে কী ছিল ঠিক স্পষ্ট করে বলতে পারবে না রুহান কিন্তু একটা অদ্ভুত ঠান্ডা হাওয়া যেন পাক খেয়ে উঠল রুহানের ভেতরে। সাউদার্ন ব্রিজ! ও নিজের অজান্তেই ঝুঁকে পড়ে আবেশের পিছনে দাঁড়ানো অমন সুন্দর স্বরের অধীশ্বরীকে দেখল।

গোল পাহাড়ি গড়নের মুখ। সামান্য চাপা নাক। কী অদ্ভুত সুন্দর আর মিষ্টি দেখতে! গলা শুকিয়ে এল রুহানের। হাঁটুতে জোর কমে এল হঠাৎ। মনে হল, কিছু না ধরলে পড়ে যাবে এক্ষুনি। এ কে?

‘ওভাবে তাকাস না।’ জগুদা আজ যেন যাত্রা দলের বিবেকের পাঠ নিয়েছে। সবেতেই স্টেজে উঠে নীতিকথা ঝাড়ছে!

রুহান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সামলাল নিজেকে। বলল, ‘না… মানে…ইয়ে…’

‘আমি বুঝতে পারছি, কী!’ জগুদা মুখটা ব্যাজার করল, ‘বটুককে শর্ট বল দিবি না। ভাল পুল করে। আর অফ স্ট্যাম্প-এর বাইরে রাখতে গিয়ে ওয়াইড দিস না।’

রুহান টালুমালু চোখে তাকাল জগুদার দিকে। কী বলছে লোকটা? মাথায় ঢুকছে না কেন রুহানের?

রুহান যেন নিজের অজান্তেই বলে ফেলল, ‘আচ্ছা জগুদা, ভদ্রমহিলার নাম কী?’

জগুদা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, ‘আজ মার খাবি। বুঝেছি, খুব মার খাবি।’

মার? সে তো সারাজীবন খেয়েছে রুহান। এখনও খায়। কিন্তু আজ এই মেয়েটার সামনে মার খাবে? এই মেয়েটার সামনে ওকে নাস্তানাবুদ করবে ব্যাটসম্যান? রুহানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। ও জগুদার দিকে তাকিয়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আজ আমায় বোলিংটা ওপেন করতে দাও। তারপর দেখছি।’

জগুদা অল্প হেসে চলে যাওয়ার আগে নিজের মনেই যেন বলল, ‘মালিনী সিংহ। মালিনী সিংহ নাম মেয়েটার। এর বেশি জানতে হলে পারফর্ম কর।’

রুহান দেশপ্রিয় পার্কের নেড়া হতে থাকা গাছের মাথায় বসানো সূর্যের দিকে তাকিয়ে ভাবল, ‘শর্ট বা ওয়াইড এবার দেব না। কিছুতেই দেব না।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *